আর্বেলসম্যান
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য
উনিশশো বাহান্ন সালের সতেরোই
মে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া শহরের লস এঞ্জেলেস মিরর দৈনিকে একটা চাঞ্চল্যকর
খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, নোবেল বিজয়ী আইনস্টাইন অঙ্কে ‘ফেল’ করেছেন!
খবরে প্রকাশ, এক পঞ্চদশী স্কুলছাত্রী
জ্যামিতির একটা প্রশ্ন সমাধান করতে না পেরে প্রিন্সটনে স্বয়ং আইনস্টাইনকে তা
পত্রযোগে জানিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে। আইনস্টাইন সে পত্রের উত্তর দিয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি যে সমাধান করে পাঠিয়েছিলেন সেটি বুঝতে না পেরে মেয়েটি স্থানীয় এক
দন্তচিকিৎসককে তা দেখায়। এই ডাক্তারবাবুর আবার অঙ্কে বেশ মাথা খেলত। তিনিই বলেছেন
যে বিশ্ববিশ্রুত বৈজ্ঞানিকের সমাধানটিতে একটু গলদ আছে। শুধু তাই নয়, নিজস্ব
পন্থায় তিনি প্রশ্নটির সঠিক সমাধানও করে দেখিয়ে দেন।
প্রশ্নটা ছিল হাইস্কুল
জ্যামিতির, দু’টো পরস্পর
স্পর্শকারী বৃত্তের সাধারণ স্পর্শকের দৈর্ঘ্য বার করতে দেওয়া ছিল। তেমন শক্ত কিছু
নয়। কিন্তু স্বনামধন্য আইনস্টাইনের অন্যমনস্কতার কথা তো সুবিদিত। তিনি দুই বৃত্তের
সাধারণ স্পর্শক আঁকবার পদ্ধতি লিখে পাঠিয়েছিলেন। খবরের কাগজে এই ছোট্ট ঘটনাটা পড়ে
ডাক্তারবাবু লঘুভাবেই সম্পাদকের কাছে মন্তব্য করেছিলেন, নোবেলজয়ী
এখানে একটু ‘ভুল’ করে
ফেলেছেন। অনন্য বিজ্ঞানপ্রতিভাকে হেয় প্রতিপন্ন করার কোনও উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না।
ঘটনাটাও অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু খবরের কাগজওয়ালারা সুযোগ ছাড়বে কেন, ফলাও করে তা
ছাপিয়ে দেয়। লস এঞ্জেলেসে ডাক্তারবাবুর নাম ছড়িয়ে পড়ে, তিনি আইনস্টাইনের
ভুল ধরেছেন!
কে এই রহস্যময় ডাক্তার? চিকিৎসাবিজ্ঞান
যাঁর পেশা তিনি অঙ্কে পাল্লা দিতে যান আইনস্টাইনের সঙ্গে?
বিশিষ্ট এই ব্যক্তিটির নাম ডঃ
লিঅন ব্যাঙ্কফ। পেশায় দন্তচিকিৎসক, নেশা কিন্তু তাঁর গণিত! পেশাবহির্ভূত
এই বিষয়টিকে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের আগ্রহ ও খেয়ালে। আর করেছিলেন
এতোটাই যে প্রথাগত গণিতশিক্ষা তাঁর না থাকলেও অনেক অভিজাত গণিতসভায় বক্তৃতা করার
ডাক পেতেন তিনি। বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ মন্ডলীতে তাঁর পরিচিতি ছিল ‘আর্বেলসম্যান’ — আর্বেলস
বিশেষজ্ঞ রূপে।
আর্বেলস! সেটা আবার কী বস্তু? খায় না
মাথায় দেয়? জানতে
চাইলে আমাদের পেছিয়ে যেতে হবে অনেকটা সময়। আর্বেলস গবেষণার সূত্রপাত হয় বাইশ
শতাব্দীরও আগে।
ছবিতে যেমন দেখানো হয়েছে, সেইরকম
তিনটি পরস্পর স্পর্শকারী অর্ধবৃত্তে গঠিত জ্যামিতিক আকারটিকে আর্বেলস নামে অভিহিত
করা হয়। এদের ব্যাস তিনটি একই সরলরেখায় অবস্থিত। গ্রীক ভাষায় আর্বেলস শব্দের অর্থ ‘শ্যু’মেকার্স
নাইফ’—অর্থাৎ
জুতো তৈরি করতে ব্যবহৃত গোল ফলাবিশিষ্ট ছুরি। যার ছবিও দেখানো হল। চর্মশিল্পীদের
ব্যবহৃত এই যন্ত্রটির ফলার সাদৃশ্য থেকেই আর্বেলসের নামকরণ। অবশ্য ‘শ্যু’মেকার্স
নাইফ’-এর
ফলা দু’দিকে
সুসমঞ্জস, আর্বেলসের
ক্ষেত্রে তেমন বিধিনিষেধ নেই। এটা যেন একটা বক্ররৈখিক ত্রিভুজ, বক্ররেখা
দিয়ে ঘেরা ধূমিল স্থানটিকেই আর্বেলসের ক্ষেত্রফল বলা হয়।
আর্বেলসের প্রথম উল্লেখ পাওয়া
যায় গ্রীক দার্শনিক আর্কিমিডিসের গবেষণায়। তিনি তাঁর রচিত গণিত প্রস্তাবের সংকলনে
চার, পাঁচ
ও ছয় সংখ্যক উপপাদ্যের বিবৃতিতে প্রথম আর্বেলসের কয়েকটি বিশেষ ধর্ম প্রমাণিত করেন।
বৈশিষ্ট্যযুক্ত জ্যামিতিক
আকার আরও অনেকই আছে,
কিন্তু আর্বেলসের মতো এতো অফুরন্ত ও আশ্চর্যজনক ধর্মের সমন্বয় খুব কম দেখা যায়। এদের
অনেকগুলোই বেশ অবাক করা,
হঠাৎ শুনলে মনে হয় এও কী হয় নাকি? কিন্তু গাণিতিক উপায়ে তার সবই প্রমাণ
করা যায়। বোধের বাইরে যুক্তির এই বিজয়ই বোধহয় এই অতি সাধারণ কিন্তু রহস্যময়
আকারটিকে এতটা আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
বিনোদন গণিতের বাইরে আর্বেলস
কিন্তু অনেক তন্নিষ্ঠ গবেষণারও উৎস। বৃত্ত বা আরও সাধারণ বিচারে বক্ররেখার
স্পর্শসংক্রান্ত তত্ত্ব জড়িত থাকায় ইনভারশন, র্যাডিক্যাল অ্যাক্সিস, সিমিলিটিউড
ও স্বর্ণানুপাতের মতো গুরুগম্ভীর বিষয়ের প্রভূত চর্চা করার সুযোগ আছে এই আর্বেলসের
মাধ্যমে। যুগে যুগে আর্বেলস খ্যাতনামা গণিত বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়েছে। প্যাপাস, ভীটা, ডিকার্টেস, ফার্মা, নিউটন, স্টেইনার
থেকে নিয়ে বিংশ শতাব্দীর ভিক্টর থীবো — বহু গণিতজ্ঞের কাছেই আর্বেলস তত্ত্বের
নান্দনিক আবেদন ছিল উদ্দীপনা ও চর্চার বিষয়।
দুই সহস্রাব্দীরও বেশী আগে
আর্কিমিডিস দেখিয়েছিলেন আর্বেলসের মাঝ দিয়ে একটা লাইন টেনে কাস্তের মতো দুটো ফলাকে
আলাদা করে দিলে, ঐ
লাইনের দুপাশের জায়গাদুটোতে আঁটসাঁট করে যদি দুটো বৃত্ত ধরানো হয় তাহলে বৃত্তদুটো
মাপে একদম সমান হবে! হ্যাঁ,
ভেতরের অর্ধবৃত্তদুটোর ব্যাসের অনুপাত যাই হোক না কেন। আশ্চর্য সিদ্ধান্ত!
কিন্তু সত্যি। এই বৃত্তদুটোকে সেই থেকে আর্বেলসে আর্কিমিডিসের ‘জোড়া’ বৃত্ত বলা
হয়।
এরপর প্রায় পাঁচশো বছর
আর্বেলস নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই, অন্তত লিখিত বা প্রামাণ্য নথিপত্রে। তারপর প্যাপাস এক
চমকপ্রদ সূত্র আবিষ্কার করেন, যার দ্বারা আর্বেলসের মধ্যে পরস্পর স্পর্শকারী বৃত্তের সারি
বসিয়ে যে বৃত্তের মালা পাওয়া যায়, তার মধ্যে যেকোনওটার মাপ নির্ণয় করবার পদ্ধতি পাওয়া যায়। বর্তমান
কালে জ্যামিতিক ইনভার্শন ব্যবহার করে খুব সহজেই সূত্রটা প্রমাণ করা যায়। কিন্তু
সেই যুগে প্যাপাস কিভাবে এই সত্যটা আন্দাজ করেছিলেন ভাবলে অবাক হতে হয়।
প্যাপাসের পর আরও অনেকেই
আর্বেলসের নানান আঙ্গিকের প্রতি আলোকপাত করেছেন। কিন্তু সেরকম উল্লেখযোগ্য পরিণাম
তেমন কিছু আসেনি। আমাদের ডঃ ব্যাঙ্কফের হাতে যেন তার আবার করে পুনরুত্থান হল।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে
ফরাসী অধ্যাপক থীবো আর্বেলস নিয়ে এক আকর গ্রন্থের পাঁচটি পরিচ্ছেদ রচনা করেন। তা
পড়ে ব্যাঙ্কফ আর্বেলসের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সাগর পেরিয়ে ফ্রান্সের প্রত্যন্ত
গ্রাম টেনি-তে গিয়ে থীবোর সঙ্গে দেখা করেন। দুজনের জাতীয়তা, ভাষা ও
পেশায় কোনও মিল না থাকলেও আর্বেলসের সূত্রে মনের কম্পাঙ্কে অনুরণন উঠতে দেরি হয়নি।
মনোজগতে ভাবের আদানপ্রদানে কোনও বাধাও হয়নি। বয়োবৃদ্ধ থীবো আর্বেলস নিয়ে তাঁর
অভিজ্ঞতার ঝুলি নবীনতর ব্যাঙ্কফকে দান করেন। এই সূত্রে ব্যাঙ্কফের অবশ্য আর একটা
লাভও হয়। অধ্যাপক থীবোর সঙ্গে আলাপচারিতায় যিনি দোভাষীর কাজ করেছিলেন, পরে সেই
ম্যাডাম ফ্রান্সিনকে তিনি পেয়েছিলেন নিজের জীবনসঙ্গিনী রূপে।
আর্বেলস ব্যাঙ্কফের নেশা হয়ে
দাঁড়ায়। উদ্ভাবন করেন আরও অত্যাশ্চর্য সব পরিণাম। ক্রমে তার পরিমাণ এতো বেশী হয়ে
যায়, ব্যাঙ্কফ
থীবোর গ্রন্থে আরও পাঁচটি পরিচ্ছেদ যোগ করার পরিকল্পনা করেন।
সে পরিকল্পনা তিনি অবশ্য
কার্যকরী করে যেতে পারেননি। কিন্তু তরুণ গণিতমানসে তিনি আর্বেলস গবেষণার বীজটা
বুনে দিতে পেরেছিলেন তাঁর সর্বাপেক্ষা চমকপ্রদ অনুসন্ধানের ফলে। আর্কিমিডিসের বাইশ
শতাব্দীরও বেশী পরে তিনি আবিষ্কার করেন, আর্বেলসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আরও
দুটি ‘আর্কিমিডিস
বৃত্ত’, যাদের
উৎপত্তি সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে, কিন্তু মাপে অবিকল আর্কিমিডিস বৃত্তদ্বয়ের সমান! এগুলি আজ
আর্বেলসের ‘ব্যাঙ্কফ
বৃত্ত’ বলে
খ্যাত।
এরপর যেন আর্বেলসের মধ্যে ‘আর্কিমিডিস
বৃত্ত’ খুঁজে
পাবার মিছিল লেগে গেল। দেখা গেল, আর্কিমিডিস ও ব্যাঙ্কফের দ্বারা আবিষ্কৃত মোট ঐ চারটি মাত্র
নয়, আর্বেলসের
বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে আছে আরও অনেক ‘আর্কিমিডিস বৃত্ত’। গবেষণায়
পাওয়া গেছে প্রায় একশ’র
বেশি এই একই মাপের বৃত্ত,
যারা কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত হয়ে আছে আর্বেলসের সঙ্গে। এখনও আবিষ্কৃত হয়ে চলেছে। একটা ওয়েবসাইট করা হয়েছে, এই সব ‘আর্কিমিডিস
বৃত্ত’-এর
বিবরণ সেখানে আর্কাইভ করা হচ্ছে। ‘আর্কিমিডিস সার্কল’-এর আর্কাইভ সাইটের লিঙ্ক — http://home.wxs.nl/~lamoen/wiskunde/Arbelos/Catalogue.htm
‘আর্বেলসম্যান’ ডঃ
ব্যাঙ্কফ আর আজ নেই। ১৯৯৭ সালে অষ্টাশি বছর বয়েসে এই অঙ্কপাগল ডাক্তারবাবু আমাদের
ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর জীবদ্দশার শেষ ত্রিশ বছরেও তিনি তাঁর সমস্ত আবিষ্কারের
গ্রন্থীকরণ করে যেতে পারেননি। আজকের তরুণ গাণিতিকেরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন
তাঁর অসমাপ্ত আরব্ধ কর্ম।
এই আশ্চর্য ডাক্তারবাবুটি
জীবনে কিন্তু শুধু অঙ্কই করেননি। যে কোনও শিল্পকর্মে ছিল তাঁর সহজাত আকর্ষণ। তিনি
গান শুনতেও ভালবাসতেন। সিদ্ধহস্ত ছিলেন গীটার ও বেহালাবাদনে। আবার তিনি ছিলেন ভালো
স্থপতি। অবসর সময়ে মূর্তি তৈরি করতেন। তাঁর আর এক নেশা ছিল ক্যালিগ্রাফি বা
হরফবিদ্যা। তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, বিভিন্ন পেশার মধ্যে তিনি দাঁতের
ডাক্তারিকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর এই শিল্পের প্রতি ঔৎসুক্যের কারণেই। মানুষের
দাঁতের গঠনের মধ্যে তিনি পেতেন অনেক শৈল্পিক নকশার প্রেরণা!
এতরকম শখের মাঝে তিনি
ডাক্তারিটা তাহলে করতেন কখন? চিকিৎসকের দায়িত্বে কি ফাঁকি দিতেন? উঁহু, তাও নয়। ডঃ
ব্যাঙ্কফ তাঁর সময়ের প্রথিতযশা দন্তবিশেষজ্ঞ ছিলেন। ভাবলে বিস্ময় জাগে, অর্ধশতাব্দীরও
বেশি সময়ব্যাপী চিকিৎসক পেশায় অগণিত ছিল তাঁর রোগীর সংখ্যা। তার মধ্যে ছিল বেশ
কিছু হলিঊডের তারকা,
রাজনীতি ও অন্যান্য ক্ষেত্রের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। আর শুধু মানুষই নয়, বেশ কয়েকটি
চতুষ্পদের— পূর্ণবয়স্ক বাঘ ও সিংহ সমেত — দন্তোপচারও তিনি করেছিলেন!
অদ্ভুত এই মানুষটির জন্মদিন
১৩ই ডিসেম্বর, গত
২০০৮ সালে ছিল তাঁর জন্মশতবার্ষিকী।
এরপর
কখনও যদি ডেন্টিস্ট আপনার দাঁত পরীক্ষা করতে গিয়ে আচমকা প্রশ্ন করে বসেন, আর্বেলসে
আরও একটা আর্কিমিডিস সার্কল বেরিয়েছে মশাই, তাহলে চমকে যাবেন না। আমি অন্তত যাব
না। বরং নিশ্চিন্ত হব এই ভেবে যে, ডঃ ব্যাঙ্কফের উত্তরাধিকার তাহলে শেষ হয়ে যায়নি।
No comments:
Post a Comment