মুখ ও মুখোশ
শাঁওলি দে
(এক)
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ফটো-ফ্রেমগুলো দেখছিলাম। একটা গাছ বিরাট ডালপালা ছড়িয়েছে দেওয়াল
জুড়ে। প্রত্যেকটি ডালের শেষে পরিবারের কারও না কারও ছবি। একটি পারফেক্ট ফ্যামিলি-ট্রি।
অবাক হয়ে দেখছি সব ছবি। জমিদারি না থাকলেও ঠাটবাট এখনও বজায় রেখেছেন এঁরা। বাড়িতে
ঢুকতেই বিরাট একটা গেট, সেই পুরোনো আমলের সিংহদুয়ারের কথাই মনে করায়। নিচের বসার
ঘরটিও চমৎকার। বড়ো বড়ো বেতের চেয়ার চারদিকে, হাতলগুলো কোনও না কোনও পশুর মুখ,
মাঝখানে কাচের টেবিল, নিচে একটা বিরাট সিংহ হাঁ করে আছে।
আমার থাকার
জায়গা হয়েছে দোতলার একটা ঘরে। লম্বা করিডোর পেরিয়ে কোনার দিকের একটা ঘর। যাওয়ার
পথে দেওয়াল জুড়ে সারি সারি মুখোশ। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। একেকটা মুখোশের সামনে
এসে হাঁটার গতি শ্লথ হয়ে আসছিল আমার। আমি যার সঙ্গে এসেছি সে বর্তমানে এই বাড়ির
মালিক। অঙ্কুশ, আমার সহকর্মী। মুখোশগুলো
দেখতে দেখতে আমি ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর গলার স্বরে চমক ভাঙল।
“এইটুকু
দেখেই অবাক হচ্ছ? কাল আসল জিনিসগুলো দেখাব।”
তাকিয়ে
দেখলাম, ওর চোখে মুখে অহংকার ঝরে পড়ছে। হাসি মুখে বললাম, “যেসব জিনিস রেখেছ
সারাবাড়িতে, আমি তো তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি!”
“আরে এতে
আমার কোনও কৃতিত্বই নেই। সব পূর্বপুরুষের দান। ভোগ
করছি আমি। এই বিরাট রাজপ্রাসাদের মার্কেট ভ্যালু জানো?” আত্মতৃপ্তির হাসি হাসতে
হাসতে সে বলল।
“সে কীরকম
হবে, বুঝতেই তো পারছি।” তারপর একটু থেমে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “কেন, বিক্রি-টিক্রির
কথা ভাবছ নাকি আবার?”
আমার কথা
শুনে ও এক চোখ টিপে অদ্ভুত একটা ইশারা করল। আমি কথা বাড়ালাম না। এই জৌলুশ, এই জাঁকজমক পরখ করতে করতে নির্ধারিত ঘরের দিকে এগিয়ে
গেলাম।
ঘরের
বর্ণনা যেমন অঙ্কুশ দিয়েছিল, ঘরটা আদতেও তেমন নয়। ঢুকতেই
মেহগনি কাঠের এক বিরাট পালঙ্ক,
নিখুঁত কারুকাজ করা। তবে বেশ পুরোনো। দেওয়ালে একটা বাঘের মুখোশ, বিশালাকার।
কাচের জানালাও কারুকাজ করা। আমার মুখ দেখেই বোধহয় অঙ্কুশ বলে উঠল,
“বাইরেটাই মডিফাই করা হয়েছে, বুঝলে? ভেতরগুলো একই রাখার
চেষ্টা করা হয়েছে, ওই যতটা রাখা যায় আর কী।”
আমি ঘাড় নাড়লাম। অঙ্কুশ বলে চলছে, “এটা আমার ছোটোপিসির ঘর ছিল। পিসি চলে যাওয়ার পর বন্ধই পড়েছিল, তুমি
আসবে বলেই খুলিয়ে পরিষ্কার করালাম।”
জানতে চাইলাম, “কোথায় বিয়ে হয়েছে ছোটোপিসির?”
একটা ছোট্ট
শ্বাস ফেলে অঙ্কুশ বলল, “বিয়ে? নাহ্,
বিয়ে শেষপর্যন্ত হয়নি ওর, তার আগেই… যাক,
সেসব গল্প পরে শুনো।”
একটা কৌতূহল
আমার মনের মধ্যে বাসা বাঁধলেও আর কিছু জিজ্ঞেস করা সমীচীন মনে করলাম না। বিরাট পালঙ্কের ওপর
উঠে বসলাম। অঙ্কুশ দাঁড়িয়ে ছিল। হেসে বলল, “একশো বছরের পুরোনো
পালঙ্কে বসলে, বুঝলে তো? ভাগ্যবান তুমি।”
আমিও হাসতে হাসতে বললাম, “দেখে বোঝা যায় না কিন্তু এত বছরের পুরনো। সত্যিই
নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।”
অঙ্কুশ আমার কাঁধে হাত রাখল। তারপর হেসে বলল, “নাও,
এখন রিল্যাক্স করো। রাতে খাওয়ার টেবিলে দেখা হবে।”
দরজাটা ভেজিয়ে অঙ্কুশ চলে গেল। এই বিরাট ঘরটিতে আমি এখন একদম একা। বাইরে
সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। দূরের লাল আকাশটা খোলা জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমি জানালার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঠান্ডা
শিরশিরে বাতাস আমাকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল অন্য কোনওখানে। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান
দিলাম। অবাক বিস্ময়ে ভাবছিলাম অঙ্কুশের পূর্বপুরুষদের কথা। সে যুগে কতটা শখ থাকলে
এই প্রায় স্বজন বিবর্জিত অঞ্চলে এই বিরাট রাজপ্রাসাদ বানানো যায়! যেদিকে তাকাই ধূ
ধূ প্রান্তর। শহর এলাকায় যখন পা ফেলারও জায়গা নেই, সেই পরিস্থিতিতে এমন মাইলের পর
মাইল ফাঁকা জমি, সত্যি ঈর্ষনীয়। মনে মনে ভাবলাম, কাল সকাল হলে চারপাশটা ভালো করে
পর্যবেক্ষণ করতে হবে অঙ্কুশকে নিয়ে। তখনও জানি না সকালবেলা আমার জন্য কী অপেক্ষা
করে আছে!
(দুই)
রাতে রীতিমতো রাজকীয় খাবারের আয়োজন করেছিল অঙ্কুশ। লুচি, নারকেল কুঁচো দিয়ে
ছোলার ডাল দিয়ে শুরু, তারপর পোলাও, পেল্লাই সাইজের চিকেন চাপ। শেষপাতে আমসত্ত্বের
চাটনি ও গরম গরম পান্তুয়া। ভরপেট খেয়ে ঘুমটাও দিব্য হয়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল সাবেকি
দেওয়াল ঘড়িতে তখন আটটার ঘন্টা বাজছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
সকালের আলোয় বিরাট বাড়িটা আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সারাবাড়ি জুড়ে দেখার মতো সব
কাজ, আমার চোখ থেকে মুগ্ধতা সরছে না কিছুতেই। আশপাশটা এবার একটু দেখতে যেতে হবে
ভাবতেই অঙ্কুশের কথা মনে পড়ল। কী ব্যাপার, এখনও কি ঘুম ভাঙেনি ওর? এক মেসে থাকি
আমরা। ওকে রোজ ভোরে উঠতেই দেখি। আমিই বরং লেট
রাইজার। তবে কি বাড়ি এসে বাবুর ঘুম ভাঙছে না? একবার খোঁজ নিয়ে দেখা দরকার।
এ-বাড়িতে
আপাতত লোক বলতে আমি, অঙ্কুশ আর পাঁচ-ছয়জন চাকরবাকর। অঙ্কুশের বাবা-মা গিয়েছেন
হরিদ্বারে। অঙ্কুশ ছুটি নিয়ে বাড়ি পাহারা দিতেই এসেছে। মাঝখান
থেকে সঙ্গী হয়েছি আমি। অঙ্কুশের মুখে ওর বাড়ির বর্ণনা শুনে দেখার আগ্রহ ছিল খুবই।
তাই ও একবার বলাতেই রাজি হয়ে যাই।
এত বড়ো বাড়িতে অঙ্কুশের ঘর খোঁজা আমার কম্ম নয়। ঘরময় চাকরবাকরেরা ঘুরে ঘুরে
কাজকর্ম করে বেড়াচ্ছে। একজনকে হাতের ইশারায়
ডাকলাম। কমবয়সী একটা ছেলে, কাল থেকেই দেখছি বাড়ি জুড়ে যা সমস্ত জিনিসপত্র আছে
সেগুলো পরিষ্কার করে চলেছে একনাগাড়ে। আমি ডাকতেই একছুটে চলে এল। আমি বললাম, “অঙ্কুশকে
দেখছি না, ঘুম থেকে ওঠেনি?”
ছেলেটি আমার মুখের দিকে অবাক চোখে তাকাল। বুঝলাম, বাংলা তেমন বোঝে না। আমি
আমার ভাঙা হিন্দিতেই জিজ্ঞেস করলাম, “অঙ্কুশবাবু, মেরা দোস্ত আভি তক নিদ সে নেহি
জাগা?”
এবার
ছেলেটির মুখে হাসি ফুটল, “ছোটাবাবু তো কব উঠ গয়ে। সুবহা উঠ কর ঘুমনে নিকল গয়ে।”
আমি ঘাড়
নেড়ে বললাম, “আচ্ছা, চা মিলেগা?”
ছেলেটি ঘাড়
নিচু করে বলল, “আভি লে কর আতা হু, বাবুজী।”
খুব ভালো
লাগছে এখানে এসে। মনে মনে অঙ্কুশকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলাম না। এত রাজকীয়
ব্যাপার গোটা বাড়ি জুড়ে, এখানে না এলে জানতেই পারতাম না। অঙ্কুশও ছুপা রুস্তম, ওকে
দেখলে বোঝাই যায় না ও এই বাড়ির ছেলে। ওর চাকরি করারই তো দরকার নেই! অফিসে গিয়ে সবাইকে
জানাতে হবে। এইসব উলটোপালটা চিন্তার মধ্যেই টের পেলাম, একজন এসে
টেবিলে ধোঁয়া-ওঠা গরম চা দিয়ে গিয়েছে, সঙ্গে বিস্কুট, পাউরুটি, ডিমসেদ্ধ। খেতে
খেতে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখছিলাম। কী অসম্ভব সুন্দর কারুকাজ গোটা হলঘর
জুড়ে! মাথার ওপর বিরাট ঝাড়বাতিটার দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। মুগ্ধ হয়ে
সবকিছু দেখতে দেখতে ব্রেকফাস্ট শেষ করলাম। অঙ্কুশ ফিরলে বাদবাকি দেখে ফেলতে হবে।
টেবিলে রাখা খবরের কাগজ উলটেপালটে দেখতে দেখতে কত সময় যে পেরিয়ে গেল জানি না।
সম্বিৎ যখন ফিরল হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি বারোটা বাজে। এ কী! এখনও অঙ্কুশ তো
ফিরল না! পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ওর নম্বরে ডায়াল করলাম। সুইচড অফ। কেমন একটা
খটকা লাগল। একটা অজানা অচেনা
আশঙ্কায় মন দুলতে লাগল।
(তিন)
বিকেল
পর্যন্ত অপেক্ষা করেও যখন অঙ্কুশ এল না, আমার সঙ্গে সঙ্গে ওর চাকরবাকরেরাও কেমন
অস্থির অস্থির করতে লাগল। সকালে সাফসুতরো করার ছেলেটিকে ডেকে বললাম, “ছোটেবাবুকে
কোই রিলেটিভ হ্যায় ইহাপে?”
ছেলেটি কী
বুঝল জানি না, দৌড়ে গিয়ে একটা বুড়োমতো ভদ্রলোককে ডেকে আনল। বয়স্ক লোকটি এসেই বলল,
“এখানে তো বাবু আর কেউ থাকে না, আমিই বাড়ির সব দেখাশোনা করি। বড়োবাবুদের খবর দেওয়া
ছাড়া আর উপায় নেই।”
আমি বললাম,
“দাঁড়াও দাঁড়াও, ওঁরা বয়স্ক মানুষ, হঠাৎ শুনলে ভয় পেতে পারেন। তার আগে বলো তো, ছোটোবাবু
মানে অঙ্কুশ যাওয়ার আগে কিছু কি বলে গিয়েছিল?”
“নাহ্, আমি
তো তখন বাইরেই ছিলাম। বাড়িতে
থাকলে অন্যদিন যেমন সকালে হাঁটতে বের হয় আজও তেমনই বের হল,” লোকটি বলে উঠল।
“ওদের কোনও
শত্রু আছে?” লোকটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
লোকটি আমার
কথা শুনে হাত কচলাতে লাগল। আমি একটু জোরের সঙ্গেই বললাম, “এবার তো দেখছি পুলিশে
খবর দিতে হবে।”
লোকটি চমকে
উঠল যেন। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “এদের
এখানে প্রচুর শত্রু। এই এলাকায় এরাই সবচেয়ে বড়োলোক। আর তাছাড়া...”
“তাছাড়া?
কী?” আমি বলে উঠলাম।
লোকটি থতোমতো
খেয়ে বলল, “না না, আমি এর বেশি কিছু জানি না। কিচ্ছু জানি না।”
আমি কিছু
বলে ওঠার আগেই লোকটি একছুটে ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেল। আমি একটু থমকালাম। ছোটোবেলা
থেকে গোয়েন্দা গল্প পড়তে পড়তে আমার মনটা বেশ সন্দিহান হয়ে উঠেছে। মনে মনে ভাবলাম,
অঙ্কুশের খোঁজ আমাকেই করতে হবে এবং কাকু-কাকিমা আসার আগেই। কিন্তু এর জন্য দরকার
এই বাড়ির লোকেদের সাহায্য। কিন্তু কে করবে আমাকে সাহায্য? ভাবতে
ভাবতেই দেখলাম, সকালের হিন্দিভাষী ছেলেটি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। দেখে মনে হচ্ছে, আমাকে যেন ও কিছু বলতে
চায়। আমি হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকলাম। তারপর ওকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম এই বিরাট
রাজপ্রাসাদের বাইরে।
(চার)
ঢং ঢং করে
বারোটার ঘন্টা পড়ল। আমি দম আটকে বসে আছি অনেকক্ষণ। হিন্দীভাষী ছেলেটির নাম সুরজ, ও
বাইরে পাহারায়। কিছু অদ্ভুত দেখলেই আমায় সতর্ক করবে। সারাদিন অঙ্কুশের কোনও খোঁজ পাওয়া
যায়নি। সন্ধে নাগাদ ওর বাবা-মাকে খবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাল সকালের ফ্লাইট ধরেই ওঁরা
চলে আসবেন। ওদের কথামতোই পুলিশে এখনও খবর দেওয়া হয়নি। কাল ওঁরা এসেই যা সিদ্ধান্ত
নেওয়ার নেবেন।
ইতিমধ্যে
আমি আমার তদন্ত শুরু করে দিয়েছি। সুরজকে সঙ্গে নিয়ে বিকেলে আশপাশটা ভালো করে দেখে
এসেছি। এই বিরাট এলাকায় যে ক’টা ঘর আছে, কারও সঙ্গেই অঙ্কুশদের সদ্ভাব নেই।
অঙ্কুশের ঠাকুরদা বা তাঁর বাবার আমল থেকেই এরা অত্যাচারী বলে পরিচিত। এখন অবস্থা পড়ে
গেলেও এদের অহংয়ের জেরে এরা সকলেরই চক্ষুশূল। তবে দু-চারজনের সঙ্গে কথা বলে এটুকু
আবিষ্কার করলাম যে অঙ্কুশ এদের মতো নয়। সুরজ আমায় ওই রাজপ্রাসাদ থেকে বেশ দূরে
একটা বস্তির কাছে নিয়ে গেল। অঙ্কুশদের
রাজপ্রাসাদের একবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান এই বস্তির। কত না খেতে পাওয়া মানুষ
চারদিকে, খারাপ লাগছিল এই অদ্ভুত বৈপরীত্য দেখে। সুরজের সঙ্গে একটা বিরাট হলঘরের
কাছে গেলাম। হলঘরের ভেতরের কর্মকান্ড দেখে আমি অবাক। বস্তির মেয়েরা মিলে তৈরি
করেছে স্বনির্ভর গোষ্ঠী। আচার, পাঁপড় বানানো থেকে শুরু করে সেলাই মেশিনের কাজ, পাপোষ
বানানো - সকলে নানারকম কাজ করে চলেছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই প্রচেষ্টা দেখে মনটা
ভালো হয়ে গেল। অঙ্কুশকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে যে অস্থির অস্থির ভাবটা দুপুর থেকে
ছিল তা একটু হলেও এখানে এসে কেটে গেছে। সুরজ জানাল, অঙ্কুশ নাকি এখানে মাঝেমধ্যেই
আসে। কথাটা শুনেই কেমন একটা খটকা লাগল। ওখানে
উপস্থিত দু-চারজনকে জিজ্ঞেসও করলাম অঙ্কুশের কথা, কিন্তু তারা কেউই সদুত্তর দিতে
পারল না। মনের মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন ওঠানামা করতে লাগল। সেইসব জিজ্ঞাসা নিয়েই আমি অঙ্কুশদের বাড়ি ফিরলাম।
কাল সিঁড়ি
দিয়ে ওঠার সময় যে মুখোশগুলো দেখেছিলাম, আজ সেগুলো কাছ থেকে দেখছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
মুখে কথা সরছে না আমার। যেগুলোকে দেখে কাল নকল মুখোশ মনে হয়েছিল সেগুলো
আসলে একেকটা আসল পশুর মুখ। কী ভীষণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার! বুকের ভেতরটা তোলপাড় করতে
লাগল। একটা হিমশীতল ভয়ের স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল নিচে। তবে কি এই মুখোশের আড়ালেই লুকিয়ে আছে
অঙ্কুশের অন্তর্ধান রহস্য?
সিঁড়ির নিচে
বসে থাকতে থাকতে একটা বেজে গেল, দু’টোও। কিন্তু কোনওরকম অদ্ভুত কিছু নজরে পড়ল না। সুরজকে
ডেকে শুতে বলব নাকি ভাবছি, অমনি খট করে একটা হালকা শব্দ কানে এল। আমি আরও সতর্ক
হলাম। হাতে ধরা টর্চ লাইটটা আরও শক্ত করে ধরলাম। একটা পায়ের শব্দ ক্রমশই ষ্পষ্ট
হচ্ছে। আমি কান খাড়া করে বসে আছি। ভয় যে লাগছে না তা নয়। হাতে তেমন অস্ত্রশস্ত্র
কিছুই নেই। তবুও মনের জোরে বসে
রইলাম। দেখি না যা ভাবছি তা মেলে কি না?
পায়ের
শব্দটা আরও কাছে আসছে, কিন্তু আমি নিচে বসে আছি বলে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু
কই, সুরজ তো কিছুই ইশারা করল না! আমি আস্তে আস্তে শব্দ বরাবর এগোতে লাগলাম।
অন্ধকারে টের পাচ্ছি, সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে একটা ছায়ামূর্তি কিছু করছে প্রায়
নিঃশব্দে। আমি আর দেরি করলাম না। যা থাকে কপালে ভেবে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ওই
ছায়ামূর্তির মুখের ওপর টর্চের আলো ফেললাম। কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা শরীরটা আমার দিকে
ধেয়ে এল। আমি প্রতিরোধ করছি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে। আর তখনই মুখ ঢাকা কালো কাপড়টা
খুলে পড়ে গেল নিচে। আর হলঘরের আবছা আলোতে যার মুখ ভেসে উঠল, তাকে দেখে আমি চমকে
উঠলাম।
(পাঁচ)
“অঙ্কুশ,
তুমি! এভাবে নিজের বাড়িতেই পালিয়ে?” আমি সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই অঙ্কুশকে জিজ্ঞেস করলাম।
“তুমি বুঝবে
না। আমার সব প্ল্যান ভেস্তে দিও না।” অঙ্কুশ বলে উঠল।
“সবই বুঝব। ইন ফ্যাক্ট বুঝেই গিয়েছি।” অঙ্কুশের কাঁধে
হাত রেখে বললাম।
“কী বুঝেছ?”
ও একটু অবাকই হল।
“কাল যখন
তুমি এই বিরাট সম্পত্তির মার্কেট ভ্যালুর কথা বললে, খটকাটা তখনই লেগেছিল। তারপর
রাতে যখন মুখোশগুলোর খুঁটিয়ে দেখলাম...”
অঙ্কুশ
হাসল। বলল, “জানো, মুখোশগুলোর দাম কত?”
“এগজ্যাক্ট
জানি না, তবে আন্দাজ তো করতে পারিই।” আমি বললাম।
অঙ্কুশ বলল,
“কী লাভ বলো তো এত কোটি কোটি টাকা এভাবে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখে?”
“তাই বলে
নিজের বাড়িতে চুরি করবে!” আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
“কী করতাম?
বাবা তো যখের ধনের মতো আগলে রেখেছে সব! কাকা, জ্যেঠারা তো আছেই। সব এক সে বড়কর এক।
জানো না তো!” অঙ্কুশ একটু রাগ করেই বলে উঠল।
“প্ল্যানটা
ঠিক কী ছিল তোমার?” আমি জানতে চাইলাম।
ও বলল, “প্ল্যান
আর কী? ওরা যখন ঠিক করল হরিদ্বার যাবে, আমি ভাবলাম এই সুযোগকেই কাজে লাগাই। সমস্যা
হল, তুমি। ইয়ার্কি করে তোমায় আসতে
বলাতেই রাজি হয়ে গেলে। ব্যস, তোমাকে নিয়েই ছক সাজাতে হল।”
“কীসের ছক?”
জানতে চাইলাম।
“সুরজকে
বলেছিলাম তোমাকে নজরে রাখতে। সে ব্যাটা নিজেই ভয়-টয় পেয়ে একাকার। বাড়ির অন্যান্য
চাকরগুলো বাবা-কাকাদের স্পাই। তাই ওদের হাত থেকে বাঁচতেই রাতের অন্ধকারে এই অভিযান।”
“কিন্তু
তুমি কী করবে এই মুখোশগুলো বিক্রি করে? নিজেই তো এত ভালো চাকরি করো!” একটু অবাক
হয়েই জানতে চাইলাম।
ও জোরে
হেসে উঠল। তারপর বলল, “এতকিছু ধরতে পারলে আর এটা বুঝতে পারলে না?”
আমি
অঙ্কুশের মুখের দিকে তাকালাম। অদ্ভুত নিষ্পাপ একটা মুখ। যে মুখের আড়ালে কোনও মুখোশ
নেই। ওই আবছা আলোয় আমি এগিয়ে এসে ওর হাতদুটো ধরলাম। তারপর বললাম, “ওই বস্তির
লোকগুলোর জন্য যদি আমিও কিছু করতে পারি খুব ভালো লাগবে, অঙ্কুশ।”
অঙ্কুশ
আমায় জড়িয়ে ধরল। তারপর কানে কানে বলল, “পৃথিবীতে গরিবের সংখ্যাই বেশি, বন্ধু! আমরা
যদি সবাই একটু একটু করে...”
বাইরে কাক
ডাকছে । ভোর হবে একটু পর। আমি অঙ্কুশের চোখ দিয়ে এক নতুন দিন দেখছি।
_____
অলঙ্করণঃ
সুজাতা চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment