তাম্রলিপ্তের
বজ্রপাণি
পুষ্পেন
মণ্ডল
হোটেলের
বাইরে পা রাখতেই চমকে উঠলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘার এমন সুন্দর দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য এই অগাস্ট
মাসে সাধারণত হয় না। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও মেঘে ঢাকা ছিল উত্তর-পশ্চিমের আকাশ।
এখন হঠাৎ মেঘ সরে যেতে ঝকঝক করছে সোনালি আলোয় শুভ্র গিরিরাজ। কিন্তু
সৌভাগ্যটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। চোখের সামনে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আবার ঢেকে গেল
মেঘ।
“একেই
বলে গোল্ডেন মোমেন্ট, বুঝলে!”
পাশ
ফিরে দেখি ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে কাঁচাপাকা ঝোলা গোঁফ-দাড়িওলা গৌরাঙ্গবাবু। ভদ্রলোকের
মাথায় কালো চামড়ার কাউবয় হ্যাট। কাল রাতেই ডাইনিং হলে পরিচয় হয়েছিল। দিল্লীতে
থাকেন। নেশা ছবি তোলা।
“আপনার
ক্যামেরায় উঠেছে তো?” প্রশ্ন করলাম আমি।
“সে
আর বলতে? দু-তিনদিন ধরে বসে আছি ক্যামেরা তাক করে। আকাশের যা অবস্থা! তা তুমি কি
আজকেই বেরিয়ে যাচ্ছ? রুম থেকে লাগেজ বের করতে দেখলাম যেন।”
“হ্যাঁ।
কালিম্পংয়ে আমার আয়ু ছিল এক রাত।”
“আচ্ছা!
তার মানে আসল গন্তব্য অন্য কোথাও? গ্যাংটক না দার্জিলিং?”
“কোনওটাই
নয়। যাচ্ছি সিল্ক রুটের দিকে।”
“বেশ
বেশ। জুলুখ, নাথাং ভ্যালি, নাথুলা। ওদিকটা আমার ঘোরা।
দারুণ জায়গা, বুঝলে।”
বললাম,
“গাড়ি এসে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ব্রেকফাস্ট করে বেরোব।”
ভদ্রলোক
আরও কয়েকটা শট এদিক ওদিক নিয়ে বললেন, “আমার এক বন্ধু আসার কথা আছে দিল্লী থেকে।
তাকে নিয়ে ভাবছি পেলিং যাব। ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউটা খুব ভালো পাওয়া যায়।
অবিশ্যি যদি ভাগ্যক্রমে আকাশের মুখে হাসি ফোটে তবেই।”
কিছুক্ষণ
রঙিন ফুলগুলির দিকে ফোকাস করে থাকার পর আবার বললেন, “সিল্ক রুটের কয়েক হাজার বছরের
ইতিহাস আছে, জানো তো?”
সামনে
পাইনের বন। ঢালু পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে গেছে দিগন্তে। জলো ঠাণ্ডা বাতাসে শিরশির
করছে শরীর। মাঝে মাঝেই ঢেকে যাচ্ছে ঘন মেঘে। সেদিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম,
“না। সেরকমভাবে পড়াশোনা করে আসা হয়নি। কীরকম ইতিহাস? বলুন, শুনি একটু।”
সবুজ
শিশিরমাখা ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “বহু শতাব্দী ধরে চিন আর তিব্বতের
ব্যবসায়ীরা এই পথেই যাতায়াত করতেন সারা পৃথিবীতে। বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন
অথবা হিউয়েন সাং এই রাস্তা দিয়েই এসেছিলেন ভারতবর্ষে। আবার ইউরোপ থেকে ভারত হয়ে
চিন গিয়েছিলেন মার্কোপোলো।”
তিনি
একটু থামতে আমি বললাম, “আপনিও তো ব্রেকফাস্ট করবেন? চলুন, একসাথেই বসা যাক। খেতে
খেতে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সাক্ষী রেখে ইতিহাসের পাঠ নিতে ভালোই লাগবে।”
“চলো
তবে।”
ক্যামেরার
লেন্সের মাথায় ক্যাপ পরিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলেন যত্ন করে। তারপর ডাইনিং হলের
কাচের বড়ো জানালার সামনে একটা টেবিলে বসে বললেন, “এখন যেমন আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার
করি, এটা একটা জ্ঞান আহরণের রাস্তা, আবার যোগাযোগের মাধ্যমও। হাজার বছর আগে এই
সিল্ক রুট ছিল তেমনই একটা মাধ্যম। এশিয়া থেকে আফগানিস্তান, কাজাকাস্তান হয়ে সুদূর
ইউরোপ আর আফ্রিকা পর্যন্ত প্রায় ৬৫০০ কিলোমিটার বিস্তৃত একটা প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। হিমালয়ের
উপর দিয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। এর নাম ‘সিল্ক রুট’ হওয়ার কারণ যদিও চিনের তৈরি সিল্ক
সাপ্লাই হত বলে। কিন্তু এই পথে নুন, সোনা প্রভৃতিও রপ্তানি করা হত। ইউরোপের গ্রীক
শিল্পকলা যেমন এই পথে ভারত ও চিনে এসেছে তেমনই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে পড়েছে
সারা পৃথিবীতে।”
মাখন
লাগিয়ে টোস্টটা মুখে পুরে আবার বললেন, “সব থেকে ইন্টারেস্টিং পার্ট হচ্ছে,
তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে সিল্ক রুটের একটা অংশ নাথুলা, নাথাং, জুলুখ, কালিম্পং
হয়ে নেমেছিল বাংলায়। পরে অবশ্য বহু যুগ অব্যবহৃত থাকার ফলে সেই রাস্তার চিহ্ন
জায়গায় জায়গায় মুছে গেছে। ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে আধুনিক সভ্যতার বালি, সিমেন্টের
নিচে।”
একটু
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, তাহলে এটা হল আসল সিল্ক রুটের একটা পার্ট! চিনা
ব্যবসায়ীরা দিল্লী বা মুর্শিদাবাদ যাওয়ার জন্য এই রাস্তা ব্যবহার করতেন। তাই তো?”
“শুধু
তাই নয়, লাসার সবথেকে কাছের সমুদ্র বন্দর ছিল তৎকালীন তাম্রলিপ্ত। যার এখনকার নাম
তমলুক। দিঘা যাওয়ার পথে পড়ে। সুবর্ণরেখা আর দামোদর নদের মোহনা। প্রাচীন ভারতে
তাম্রলিপ্ত ছিল এশিয়া মহাদেশের এক উল্লেখযোগ্য সমুদ্র-বন্দর। এখান থেকে যোগাযোগ
ছিল শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, জাভা, সুমাত্রা, বালি প্রভৃতি দেশের সঙ্গে।”
কফিতে
চুমুক দিয়ে নিয়ে তিনি বলে চললেন, “বছর দুয়েক আগে এক তিব্বতি লামার সঙ্গে পরিচয়
হয়েছিল দিল্লীতে। তিনি একটা প্রাচীন পুঁথির ফটোকপি দেখালেন আমাদের। আসল পুঁথিটি
নাকি রাখা আছে সিকিম আর ভুটানের বর্ডারে ঘন জঙ্গলে মোড়া পাহাড়ের গায়ে এক
প্যাগোডায়। বৌদ্ধধর্মে একটা রীতি আছে, ওরা পুরনো পুঁথিগুলির প্রতিলিপি তৈরি করে
বাঁচিয়ে রাখে শত শত বছরের পুরনো ইতিহাস। সেরকমই একটা পুঁথি থেকে জানতে পেরেছেন
একটা অদ্ভুত ঘটনার কথা। সেই সময়কাল সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীর পাল রাজাদের আমল। লেখায়
ধর্মপালের উল্লেখ আছে। একদল তিব্বতি ব্যবসায়ী জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন
তাম্রলিপ্তের পথে। পরিকল্পনা ছিল সেখান থেকে সমুদ্রপথে যাবেন সুমাত্রা। পথে
তমলুকের কাছে একদল দস্যু রাতের অন্ধকারে আচমকা আক্রমণ করল তাদের। নিজেদের
নিরাপত্তার জন্য যদিও অস্ত্রশস্ত্র ছিল। কিন্তু স্থানীয় ডাকাতদলের চতুরতার কাছে
এঁটে উঠতে পারেনি। ফলে প্রায় তিরিশজন ব্যবসায়ী মারা গেল এক এক করে। তাদের কাছে বেশ
কিছু সোনাদানা আর দামী পাথর ছাড়াও ছিল একটি একহাত লম্বা মণিমুক্তো খচিত সোনার
মূর্তি। সেটি তারা নিয়ে যাচ্ছিল সুমাত্রার রাজাকে উপহার দেওয়ার জন্য। বুদ্ধের দশম
অবতার ‘বজ্রপাণি’।”
“তারপর?”
আমার মুখ থেকে কথাটা আপনা থেকেই বের হল।
“অনেক
কষ্টে নিজের প্রাণ বাঁচিয়ে একজন তিব্বতি সেই মূর্তিটি কাছেই এক মন্দিরের মধ্যে
লুকিয়ে রাখলেন। পরে আহত অবস্থায় ফিরে গিয়েছিলেন তিব্বতে। কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেলেন
তিনি। এরপর সবাই ভুলে গেল সে কথা।”
আমার
মুখ ততক্ষণে হাঁ হয়ে গেছে। “সে তো অনেক মূল্যবান জিনিস। পরে খুঁজে পেয়েছিল কেউ?”
ভদ্রলোক
বললেন, “না মনে হয়। তবে যদি কেউ পায় রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাবে। হা হা হা...”
কফিতে
শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়লেন।
আমারও
গাড়ি এসে গেছে। হর্ন বাজিয়ে জানিয়ে দিল। হোটেলের বেয়ারা লাগেজ তুলে দিয়েছে। রিসেপশনে
হিসাব মিটিয়ে উঠে পড়লাম ড্রাইভারের পাশের সিটে। গাড়ি হোটেলের গেট দিয়ে যখন বেরোচ্ছে,
সেই ভদ্রলোক সামনে থেকে হাত দেখিয়ে বললেন, “হ্যাভ আ সেফ জার্নি।” তারপর চলে গেলেন
পাশ কাটিয়ে।
গাড়ি
ছুটতে শুরু করল পাহাড়ি রাস্তায়। মনে হয় জোরে বৃষ্টি আসবে আবার। আকাশ কালো করে মেঘে
ঢেকে গেছে কালিম্পংয়ের পাহাড়ি শহর। কিছুটা এগিয়ে ড্রাইভারকে বললাম, “বাঁয়ে গলি কে
অন্দর চলিয়ে।”
আসলে
এবারের পাহাড়ে আসা একটা সিরিয়াল কিলারকে খোঁজার জন্য। তানিয়া দু’দিন আগেই দিল্লী
থেকে বাগডোগরা হয়ে গ্যাংটক চলে এসেছিল। উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক মহলে ভালো যোগাযোগ না
থাকলে আজকালকার দিনে প্রাইভেট গোয়েন্দারা পাত্তা পায় না। সিকিম পুলিশের সাহায্য
পাওয়ার জন্য দিল্লী পর্যন্ত দৌড়াতে হয়েছিল ওকে। আমাকে
বলেছিল ডঃ অরিন্দম সরকারকে ফলো করতে। ইনিই হচ্ছেন এই কেসের প্রধান সাসপেক্ট। হোটেল
‘ওক’-এ যে উঠেছিলেন সে খবর জানা গিয়েছিল কালিম্পং থানার মাধ্যমে। আমার হোটেলটা ঠিক
উলটোদিকে। আজকে সকালে রিসেপশন থেকে যখন জানলাম উনি দুপুরেই চেক আউট করবেন। আমাকেও
নতুন করে প্ল্যান সাজাতে হল। রহস্যের জাল তানিয়া কতটা গোটাতে পারল সেটা আমার কাছে
এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। আর যতক্ষণ
না পুরোটা জানতে পারছি ততক্ষণ পেটের মধ্যে বেড়াল আঁচড়াতেই থাকবে। তার থেকে ভালো
পুরনো কথাগুলি একবার রোমন্থন করে নিই।
ঘটনাটা
শুরু হয়েছিল গতবছর শীতের প্রথমে। সেদিন সকালে তানিয়া আমাকে ফোন করে বলল, “অভিজিৎ, একটা
অদ্ভুত কেস আছে। চৌরঙ্গীতে আসতে পারবি এখুনি?”
ঘড়ির
দিকে তাকিয়ে বললাম, “পারব।”
আসলে
একটা বইয়ের তাগাদা দেওয়ার জন্য কলেজ স্ট্রিটে যাওয়ার ছিল। তা সে পরে গেলেও চলবে। কিছুক্ষণের
মধ্যেই বাইকে করে হাজির হলাম নির্দিষ্ট স্থানে। জায়গাটা হল ধর্মতলায় হোটেল
‘পিয়ারলেস ইন’-এর ঠিক পিছনে রক্সি সিনেমার গা ঘেঁষে ভিতরে চলে গেছে যে রাস্তা। সেখানে
ঢুকে ভিতরে আটতলা একটা কমার্শিয়াল বিল্ডিং। তানিয়া নিচেই অপেক্ষা করছিল। আমি যেতে
লিফটের ছ’নম্বর বোতাম টিপে জানাল, “মারা গেছে এক অল্পবয়সী ছেলে, নাম রাহুল পাওয়ার।
ওর বাবা বড়ো ব্যবসায়ী। ছেলেটির সপ্তাহ খানেক আগে অফিসের
মধ্যে অদ্ভুতভাবে মৃত্যু হয়। ওর বাবা পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছেন যে ছেলে নাকি খুন
হয়েছে।” আবার বলল, “তোর ইনস্পেক্টর সামন্তকে মনে আছে? আরে, সেই যে দয়মন্তী দেবীর হার খোঁজার সময়ে টালিগঞ্জ থানার ওসি ছিলেন, তিনি
এখন নিউ মার্কেট থানার ইনচার্জ। ফোন
করে বললেন, ফাঁকা থাকলে আসবেন একবার। খুনটা
হয়েছে খুব অভিনবভাবে। কোনও ক্লুই পাচ্ছি
না।”
আমি
শুনে বললাম, “কীরকম?”
“এই
ভদ্রলোকের ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যাবসা।
সারা দেশে বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে হোটেলও আছে। পুলিশ যদিও কোনওরকম তোলাবাজি বা ব্যবসায়ী
মোটিভ খুঁজে পায়নি। ছেলেটির বিষয়ে প্রচুর খোঁজখবর করেছেন ইনস্পেক্টর সামন্ত। কোনও
বদ নেশা বা খারাপ সঙ্গও ছিল না।”
প্রশ্ন
করলাম, “পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কী বলছে?”
“নিউরোটক্সিনের
প্রভাবে ব্রেন স্ট্রোক।”
“নিউরোটক্সিন!”
“এটা
একধরনের বিষ। ছেলেটির স্পাইনাল কর্ডের নার্ভাস সিস্টেমকে নষ্ট করে দিয়েছিল। ফলে
রক্তক্ষরণের জন্য ব্রেন স্ট্রোক হয়।”
“এরকম
একটা সাংঘাতিক বিষ ওর শরীরে গেল কী করে?”
“সেটাই
তো আশ্চর্য!”
লিফট
থেকে বেরিয়ে আমরা এগোলাম অফিসের দিকে। ‘পাওয়ার ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল’ কোম্পানির
নামটা লেখা আছে দরজার বাইরে। ভিতরে ছেলেটির বাবা, মানে বিষ্ণু পাওয়ার অপেক্ষা
করছিলেন আমাদের জন্য। তানিয়াকে দেখে এগিয়ে এলেন। ষাটের কাছাকাছি বয়স। দেখে মনে হল,
বেশ ভেঙে পড়েছেন।
“আসুন
ম্যাডাম, আমার চেম্বারে বসে কথা হবে। ওসি ফোন করেছিলেন আমাকে। একটা কথা আপনাকে
প্রথমেই জানিয়ে দিই। আমার ছেলেকে যে বা যারা হত্যা করেছে, তাদের যদি খুঁজে বের
করতে পারেন তো আমি আপনাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেব।”
“আপনাদের
এই ব্যাবসা কত বছরের?”
“তা
প্রায় তিরিশ বছর। আমার পিতাজী শুরু করেছিলেন। তারপর আমি। এখন ছেলেও বসছে ব্যাবসায়।”
“কাজের
জন্য বাইরেও যেতে হয় নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ,
তা হয়। ভারতের অনেক জায়গায় আমাদের হোটেল আছে।”
তানিয়া
চেয়ারে বসতে বসতে শান্ত গলায় প্রশ্ন করল, “সেই কি একমাত্র উত্তরাধিকারী আপনার
সম্পত্তির?”
একটু
হকচকিয়ে গিয়ে উনি জানালেন, “হ্যাঁ, তা তো বটেই।”
“ওর
হঠাৎ মৃত্যুতে কে বা কারা সবথেকে লাভবান হতে পারে বলে মনে হয় আপনার?”
বেশ
কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে থেকে বললেন, “আমার ভাইয়ের দুই সন্তান আছে। ওদের অবস্থা খুব একটা
সুবিধের নয়। তবে তারা এমন কাজ করবে বলে মনে হয় না।”
“সে
সমস্ত কিছু আমরা খতিয়ে দেখব। আপনি শুধু সম্ভাবনার কথা বলুন। তাড়া নেই কোনও। ধীরেসুস্থে
চিন্তাভাবনা করে বলবেন। এই আমার কার্ড। নম্বর রয়েছে।”
আমি
প্রশ্ন করলাম, “এই ঘরেই তো মারা গিয়েছিল রাহুল?”
“হ্যাঁ।
চেয়ারটা উলটে পড়ে ছিল। শরীরটা ছিল মেঝেতে।” চা দিতে এসে বেয়ারা উত্তর দিল কথাটার।
কারণ, যাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে তিনি চোখ বন্ধ করে রয়েছেন। ওঁর মনের অবস্থা আন্দাজ
করা যায়।
তানিয়া
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী, ভাই?”
“কৈলাস।”
“কতদিন
কাজ করছ এখানে?”
“বছর
পাঁচেক।”
“রাহুলবাবুর
সঙ্গে কারও ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হয়েছিল কি?”
“তা
তো বলতে পারব না। তবে সেদিন দুপুরে বড়োবাবু যখন ছিলেন না, কারও সঙ্গে খুব উত্তেজিত
হয়ে কথা বলছিলেন ফোনে। আমি বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছি।”
“এটা
জানিয়েছিলে পুলিশকে?”
“না,
সেদিন তো মনে পড়েনি।”
“ঠিক
আছে। এখন যাও তুমি।”
ছেলেটি
বেরিয়ে যেতে চায়ে একটা চুমুক দিয়ে সে বলল, “পুলিশ নিশ্চয়ই দেখেছে ওর ফোনের কল লিস্ট।
যাওয়ায় সময়ে একবার থানা হয়ে যাব।”
তারপর
আধঘণ্টা ধরে অফিস ঘরটা ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখল তানিয়া।
এরপর
প্রায় তিনমাস কেটে গেছে। রাহুল পাওয়ারের খুনিকে চিহ্নিত করার জন্য আমরা কোনও
ত্রুটি রাখিনি। ফোনের কল লিস্ট থেকে ওর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও কথা বলেছি বারংবার।
কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। অতঃপর তানিয়া ব্যস্ত হয়ে
পড়েছে তার কোর্টের হাজারো কাজ নিয়ে। আর আমি যেমন উড়ো খই গোবিন্দায় নমো হয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছিলাম, তেমনি আছি। মাঝে বিষ্ণুজী বার দুই ফোন করেছিলেন তানিয়াকে।
সে বলল, “শুধুমাত্র নিউরোটক্সিন বিষ প্রয়োগ ছাড়া আর কোনও সূত্র পাওয়া যায়নি। যিনি পোস্ট
মর্টেম করেছিলেন, সেই ডাক্তারের সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। তিনি শুধু একটা কথাই বললেন,
ডান হাতের তিনটি আঙুল কালো হয়ে গিয়েছিল। সেটা বিষক্রিয়ার ফলেও হতে পারে। কিন্তু এছাড়া
আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না।”
তখন
মনে হল, এই রহস্যটাও অমীমাংসিত রয়ে গেল তানিয়ার আরও বেশ কিছু আন-সলভড কেসের মতো। যদিও
শেষপর্যন্ত সমাধান না হলে এ-কাহিনি কেউ জানতেও পারত না।
ঠিক
সেই সময়ে একটি বাংলা কাগজের চতুর্থ পৃষ্ঠায় একটা খবর হঠাৎ করে চোখে পড়ল আমার।
শুরু হল এর দ্বিতীয় অধ্যায়। শিরোনাম ছিল, ‘অজানা বিষে
মৃত্যু ডাক্তার মনোজ সরকারের।’ চমকে উঠলাম। আমি চিনি এঁকে। ডঃ
সরকার! মানে শহরের নামকরা একজন হার্ট স্পেশালিষ্ট। আমাদের
পুরানো দেশের বাড়ি যেখানে, তার পাশের গ্রামেই থাকতেন। এখন অবশ্য দীর্ঘদিন কলকাতার
বাসিন্দা। মাঝে অনেক বছর অবশ্য যোগাযোগ নেই। গুগুলে সার্চ করতে একটা প্রোফাইল
পাওয়া গেল। ফোন নম্বরও। বাড়ির ঠিকানা রাজারহাটের এক অভিজাত আবাসন। ওদের দেশের
বাড়িতে গেছি কয়েকবার। সেই সূত্রে ফোনে ওঁর মেয়ের সঙ্গে কথা বললাম। এতদিন পরেও
চিনতে পেরেছে আমাকে সেটাই আশ্চর্য! কথায় কথায় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিলাম।
তারপরেই ফোনে ধরলাম তানিয়াকে।
“হ্যাঁ,
ঐ খবরটা দেখেছি আমি সকালে। বিকালে কোর্ট থেকে ফিরে আমি যাব তোর সঙ্গে। ব্যাপারটা
তলিয়ে দেখতে হবে।”
সন্ধ্যা
সাতটার সময়ে যথারীতি গিয়ে হাজির হলাম ওঁদের দশতলার ফ্ল্যাটে। খুব সুন্দর ছিমছাম,
সাজানো প্রায় তিন হাজার স্কোয়ার ফিটের ডুপ্লেক্স। ডাক্তারজেঠুর
মেয়ে অরুণিমা এখনও পড়াশোনা করছে। ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম তানিয়ার। বাড়িতে
লোকজন ভর্তি। অনেক বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়রা আসছেন সমবেদনা জানাতে। বললাম, “একটু
পার্সোনাল কথা ছিল।”
সে
নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল আমাদের। জিজ্ঞেস করলাম, “এই অজানা বিষের ব্যাপারটা কী? কাগজে
জানলাম।”
অরুণিমা
জানাল, “পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে সেরকমই লিখেছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আমার
কাকুমণি হয়তো বলতে পারবেন। তিনিও
ডাক্তার। বছর খানেক হল ফিরেছে বিদেশ থেকে।”
“কী
নাম?”
“অরিন্দম
সরকার। নিউরোলজিস্ট।”
তানিয়া
বলল, “রিপোর্টটা কি দেখা যায়?”
“সেটা
তো মনে হয় কাকুমণির কাছেই আছে।”
“ডিটেল
একটু বলুন তো কী হয়েছিল।”
কথাটা
শুনে চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। দেখলাম চোখের কোণে জল। সেটা মুছে নিয়ে শুরু
করল, “বাবার পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন ছিল। সেই উপলক্ষ্যে আমরা একটা পার্টি দিয়েছিলাম।
রাত দেড়টা পর্যন্ত পার্টি চলল। এই বিল্ডিংয়ের নিচে ব্যাঙ্কোয়েট হলে। বাবা
উপরে এলেন তখন সাড়ে বারোটা। আমরা আরও ঘণ্টা খানেক ছিলাম। পরে উপরে এসে আমি শুয়ে
পড়েছি নিজের ঘরে। সকালে বাবাই প্রতিদিন সবার আগে ওঠেন।
সেদিন এগারোটা বেজে যেতেও বেরোলেন না ঘর থেকে। আমি গিয়ে দেখি বিছানায় শুয়ে আছেন।
চোখদুটো খোলা। মুখে একটা কষ্টের ছাপ। বিছানা এলোমেলো...” তার গলার স্বর বুজে এল।
তানিয়া
কিছুক্ষণ থেমে আবার প্রশ্ন করল, “আপনার মা কতদিন আগে মারা গেছেন?”
“তিন
বছর আগে।”
“এখন
এখানে কে কে থাকেন?”
“বাবা
আর রমেনদা। মানে আমাদের কাজের লোক। সারাদিন
থেকে সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যায়। বছর তিনেক
কাজ করছেন বাবার কাছে। খুবই বিশ্বস্ত।”
“আপনি?”
“আমি
থাকি ব্যাঙ্গালোরে, ইকনমিক্স নিয়ে পড়ছি। এলাম ক’দিন
আগে ক্রিস্টমাসের ছুটিতে।”
“আপনার
কাকা কোথায় থাকেন?”
“পাশের
ফ্ল্যাটে। বাবাই কিনেছিল।”
“বিয়ে
করেননি?”
“করেছিলেন। এক
জার্মান মেয়েকে। সে আসেনি এদেশে।”
“আচ্ছা,
আপনার বাবার ঘরটা একটু দেখতে পারি? সেদিনের পর থেকে কিছু সরানো হয়নি আশা করি?”
অরুণিমা
কথাটা শুনে আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “পুলিশ এসেছিল। তারপর থেকে ও-ঘরটা
বন্ধই করা আছে। থানার পারমিশন ছাড়া খোলা বারণ।”
পকেট
থেকে ফোনটা বের করে তানিয়া প্রশ্ন করল, “কোন থানা? রাজারহাট?”
অরুণিমা
মাথা নাড়তেই সে ডায়াল করল একটা নম্বর খুঁজে নিয়ে। যতক্ষণ কথা বলল ফোনে, আমি অরুণিমাকে
বুঝিয়ে দিলাম যে তানিয়া কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন গোয়েন্দা-প্রধানের মেয়ে এবং নিজে
ক্রিমিনাল ল-ইয়ার ও প্রফেশনাল গোয়েন্দা। পুলিশ-মহলে ওর দহরম মহরম ভালোই। এইরকম
একটা মার্ডার কেস নিয়ে আমরা আগে থেকেই তদন্ত করছি।
শুনে
বেশ আশ্বস্ত হল মনে হয়।
“পারমিশন পাওয়া গেছে। আপনি
আমাকে আপনার বাবার ঘরে নিয়ে চলুন।”
ঘরটি
বেশ বড়ো। আধুনিক ধাঁচের সাজানো। তানিয়া খুঁটিয়ে
লক্ষ করল সমস্ত কিছু। এমনকি শুয়ে পড়ে
খাটের নিচেও টর্চ মেরে দেখল। অ্যাটাচ
বাথরুমটাও ঘুরে এল। বুক-সেলফে রাখা ইংরাজি বইগুলি দেখল উলটেপালটে।
বইয়ের পাশাপাশি আছে কিছু দামী শো-পিস। কিন্তু আমি এর মধ্যে খটকা লাগার মতো খুঁজে
পেলাম না কিছুই।
তানিয়া
শুধু জানালার পাশে ছোটো স্টাডি টেবিলটাকে দেখিয়ে প্রশ্ন করল, “ফুলের কোনও বোকে
রাখা ছিল কি এখানে?”
“ফুলের
বোকে? না তো! ও! এখানে একটা রুম প্ল্যান্ট রাখা ছিল। সেটা শুকিয়ে যাওয়ায় ফেলে দিয়েছিলাম।”
“রুম
প্ল্যান্ট!”
“হ্যাঁ,
বনসাইয়ের মতো। তবে সেটা কী গাছ তা আমি চিনি না।”
“ও।
আচ্ছা একটা কাজ করবেন, সেদিনের অতিথিদের লিস্টটা দেবেন আমাকে?”
অরুণিমা
বলল, “বসুন, হাতের কাছেই আছে। পুলিশকেও দিয়েছিলাম।”
উঠে
গিয়ে নিয়ে এল সে। লিস্টে একবার চোখ বুলিয়ে তানিয়া জানতে চাইল, “এঁরা কি সবাই আপনার
বাবার বন্ধু?”
“বাবার
বন্ধু ছিলেন মোট সাতজন। বেশিরভাগই ডাক্তার। বাকি আমার আর কাকার বন্ধুবান্ধব। আর এই
বিল্ডিংয়ের কয়েকজন।”
“কোনও
গিফট দিয়েছিল কেউ?”
মাথা
নেড়ে অরুণিমা জানাল, “হ্যাঁ, অনেকেই ফুল দিয়েছিলেন। একজন পেন, একজন পারফিউম আর
কয়েকটা শো-পিস।”
“জিনিসগুলি
একবার দেখা যাবে কি?”
“ফুলের
বোকেগুলি তো ফেলে দেওয়া হয়েছে। বাকি জিনিসগুলি...
দাঁড়ান, দেখছি।” বলে আবার উঠে গেল অরুণিমা।
এর
মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করলেন অরুণিমার কাকা অরিন্দমবাবু। আমাদের
দেখে বললেন, “আপনাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”
আমি
কিছু বলতে যাবার আগেই দেখি অরুণিমা ঢুকে পড়েছে ঘরে। “কাকু ইনি হলেন তানিয়া
চ্যাটার্জি, ক্রিমিনাল ল-ইয়ার এবং প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।”
ভ্রূদুটো
সামান্য উপরে উঠে গেল। “গোয়েন্দা! কিন্তু আমরা তো কাউকে ডাকিনি।”
“না,
ইনি আপাতত পুলিশের তরফ থেকে এসেছেন।”
“আই
সি!”
তানিয়া
উঠে দাঁড়িয়েছে। নিজের মাথায় আঙুলের টোকা দিয়ে প্রশ্ন করল, “আপনি তো ব্রেন?”
“হ্যাঁ।”
“পোস্ট
মর্টেম রিপোর্ট দেখেছেন তো? এটা কী ধরনের বিষ বলে মনে হয় আপনার?”
সামনের
সোফায় বসে তিনি বললেন, “সত্যি কথা বলতে কী, এখন পর্যন্ত যতরকম বিষ পৃথিবীতে আবিষ্কার
হয়েছে, তার সঙ্গে এই সিম্পটমগুলি ঠিক মেলে না। হাতের তিনটি আঙুল কালো হয়ে গিয়েছিল।
আর রক্তক্ষরণের ফলে ব্রেন স্ট্রোক। তবে ডঃ মালাকার, মানে যিনি ডেড বডির রক্ত পরীক্ষা
করেছিলেন, তিনি বললেন, দিস ইজ ওয়ান টাইপ অফ নিউরোটক্সিন। বাট মাস্ট নট বি শিওর।”
“নিউরোটক্সিন!”
রমেনবাবু
কয়েকটা জিনিস নিয়ে এসে সামনের টেবিলে রাখলেন। তানিয়া
খুঁটিয়ে দেখে নিল। তারপর ছবি তুলল নিজের ফোনে। পারফিউমের বাক্সটা রুমালে মুড়ে
ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “এটা আপাতত নিয়ে যাচ্ছি আমি। পরে ফেরত পাবেন।”
রাজারহাট
থানায় কিছু খোঁজখবর করে ফিরতে অনেক রাত হল সেদিন। বাইপাসের রাস্তা সুনসান। বেশ
স্পীডেই দৌড়োচ্ছিল গাড়িটা। হঠাৎ কেঁপে উঠল ঘটঘট করে একটা আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে।
ব্রেকে পা দিয়ে তানিয়া তাড়াতাড়ি সাইড করল বাঁদিকে। নেমে
দেখি ডানদিকের সামনের চাকার টায়ার ফেটে গেছে। কপাল চাপড়ে তানিয়া বলল, “অবাক
ব্যাপার! নতুন টায়ার ফাটল কীভাবে?”
আমি
বললাম, “এখন স্টেপনি পালটানো ছাড়া গতি নেই।”
সময়
নষ্ট না করে লেগে পড়লাম কাজে। গাড়ির পিছন থেকে জ্যাক বের করে লাগাতে শুরু করলাম।
তানিয়া মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আলো দেখাল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই কানে এল পিছন থেকে
আসা একটি গাড়ির শব্দ। আগেও দেখেছি বিপদের সময়ে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হঠাৎ সক্রিয় হয়ে
ওঠে। সেদিনও তাই হল। অন্ধকারের মধ্যে পিছনের টাটা সুমোটা
তিরবেগে ধেয়ে এসে পিষে দিত আমাদের যদি না আমি তানিয়াকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে নিজে
লাফ মেরে সরে যেতাম উলটোদিকে।
সুমোটা
কিছুটা এগিয়ে ব্রেক করল ঘ্যাঁচ করে। তারপর মুখঢাকা পাঁচজন যুবক নামল লাফিয়ে। রড
উঁচিয়ে দৌড়ে এল আমাদের দিকে। আমিও ক্ষিপ্র বেগে লাফিয়ে পড়লাম তাদের উপর। কিছুক্ষণ
ধস্তাধস্তি চলল। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলাম না যুঝতে। একটা রডের বাড়ি পড়ল মাথায়।
তারপর পুরো ব্ল্যাক আউট।
যখন
চোখে আলো পড়ল মনে হল একটা গভীর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম। দেখলাম, সবাই ড্যাবড্যাব
করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তানিয়া, মা ছাড়া ডাক্তারবাবুও আছেন।
নিজের ঘরে খাটের উপর শুয়ে আছি। বসতে যেতেই ঝন ঝন করে উঠল মাথাটা।
ডাক্তারকাকু বললেন, “উঠতে হবে না। মাথায় ছ’টা স্টিচ পড়েছে। রেস্ট নাও ক’দিন।”
“তোর
কিছু হয়নি তো?” তানিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।
“তেমন
কিছু নয়। তবে আমার হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে গেছে।”
“কী
ছিল তাতে?”
“টাকাপয়সা
গেছে কিছু। আর সেই পারফিউমের শিশিটা। ভাগ্যিস, ফোন আমার পকেটেই ছিল।”
“ডঃ
সরকার যেটা গিফট পেয়েছিলেন?”
মাথা
নেড়ে তানিয়া জানাল, “ওটা নেওয়ার জন্যই এসেছিল সেদিন।”
এর
সপ্তাহ দুই পরে একদিন ট্যাক্সি করে দুপুরে হাজির হলাম হাইকোর্ট চত্বরে। এখানে
এলেই আমার মনে হয় বিশ্বসুদ্ধু লোক কী ভীষণ ব্যস্ত! বেশ একটা হৈ হৈ ব্যাপার। কালো
কোট আর সাদা জামা পরা লোকজন গিজ গিজ করছে চারদিকে। ধীরেসুস্থে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে
ঢুকলাম তানিয়ার চেম্বারে। আমাকে দেখেই চোখ আকাশে তুলে বলল, “কীরে, মাথার স্টিচ
কেটে দিয়েছে? তা তুই ফোন না করে সোজা চলে এলি যে!”
একটা
চেয়ার টেনে ওর সামনে বসে হাসি হাসি মুখে বললাম, “ফোন তো তুইও করতে পারতিস। এই
ক’দিনে একবারও খোঁজ নিয়েছিস?”
তানিয়া
হাতের ফাইলগুলি গুছিয়ে পিছনের র্যাকে তুলে দিল। তারপর আমার সামনে এসে বলল, “চা
খাবি?”
“কেন
আমাকে কি তোর নতুন ক্লায়েন্ট পেয়েছিস যে মুরগি করার আগে দানাপানি দিয়ে খাইয়ে মজিয়ে
নিবি?”
সে
হেসে বলল, “আসলে কাকিমা... উনি হয়তো চান না তুই আমার সঙ্গে এরকম বিপজ্জনক কাজে
জড়িয়ে পড়িস।”
“কেন?
মা কী বলেছে তোকে? তাছাড়া এ তো আর নতুন নয়। ছোটোবেলা থেকেই আমি একটু ডানপিটে
গোছের। মা সেটা জানে। বাদ দে ওসব কথা। কেসের কী হল বল।
এগিয়েছে কিছু? কারা অ্যাটাক করল সেদিন?”
“ধরা
পড়েনি। তবে ঐ পারফিউমটা কে গিফট করেছিল সেটা
জানতে পেরেছি। চল, বলছি সব কথা।”
হাঁটতে
হাঁটতে গঙ্গার ধারে মিলেনিয়াম পার্কে এসে পৌঁছলাম আমরা। তানিয়া শুরু করল, “আমি দু’দিন
পরে আবার গিয়েছিলাম ওদের ফ্ল্যাটে। অরুণিমা ছিল না তখন। রমেনবাবুর সঙ্গে কথা হল। বললেন,
পারফিউমটা নাকি দিয়েছিল ডঃ সৌমার্ঘ ভট্টাচার্য। অরিন্দমের বন্ধু। দু’জনে মিলে
মুকুন্দপুরের কাছে একটা মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল খুলতে চলেছেন। তার জন্য প্রয়োজন
প্রচুর টাকা। কিন্তু অরিন্দমবাবুর দাদা যৌথ সম্পত্তি বিক্রি করে বা বন্ধক দিয়ে
টাকা দিতে রাজি নন। সেজন্য মনোজবাবুর বিরুদ্ধে পার্টিশন স্যুটের মামলাও করেছেন। সেই
নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে তুমুল অশান্তি হয়েছিল ক’দিন আগে। আমি
কোর্টে খবর নিয়ে দেখেছি, কথাটা সত্যি।”
কিছুক্ষণ
চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে তানিয়া আবার বলল, “দুই ভাইয়ের ঝগড়ার সময়ে অরিন্দমবাবু
নাকি মুখ ফসকে বলেছিলেন, তোমার কুকীর্তির হাঁড়ি হাটে যদি ভাঙি মানসম্মান তো যাবেই,
হাতে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে পুলিশ।”
“এর
মানে কী?”
“জানি
না।”
বললাম,
“তার মানে অরিন্দমবাবু সেন্টের শিশিতে বিষ মিশিয়ে সৌমার্ঘকে দিয়ে দাদার হাতে তুলে
দিলেন। আর যেই মুহূর্তে পারফিউমের গন্ধ নাকে গেল, তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে!”
“আমিও
প্রথমে সেরকম ভেবেছিলাম, বুঝলি। কিন্তু পরে মনে পড়ল, পারফিউমের শিশিটা তো মনোজবাবুর
ঘর থেকে পাওয়া যায়নি। সেটা স্টোর রুম থেকে বের করে এনে দেখিয়েছিল আমাদের রমেনদা। আর
শিশিটা ছিল সিলড প্যাক।”
“তাহলে!”
আমি আবার তলিয়ে গেলাম ধোঁয়াশার গোলকধাঁধায়।
“কিন্তু
আমার মন বলছে, পারফিউমের শিশিটাতে নিশ্চয়ই কিছু ছিল। না হলে ওটা আমার হাত থেকে
ছিনিয়ে নেওয়া হল কেন?”
একটা
বেঞ্চে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম দু’জনে নদীর দিকে তাকিয়ে। বললাম, “তার মানে,
মূল খটকা হল সেন্টের শিশি আর পুরনো কুকীর্তি।”
“আরও
একটা আছে। বৌদ্ধ লামা।”
“লামা!
এখানে আবার লামা এল কোথা থেকে?”
“রমেনদা
জানালেন, একজন বৌদ্ধ লামা এসেছিলেন উনি মারা যাবার ক’দিন আগে।”
অদূরে
জলযানগুলি ক্রমশ অন্ধকার থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। চিন্তার জালগুলি ছিঁড়ে তবুও
আমরা বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না কিছুতেই। সম্বিৎ ফিরল আমার মোবাইলের রিংটোনে। মা
ফোন করেছে।
“হ্যাঁ,
আসছি আধঘণ্টার মধ্যে।”
পরের
ঘটনাটা ঘটল এর প্রায় দেড় মাস পর। অরুণিমা ফোন করল সেবার আমাকে। “শুনেছেন? বাবার এক
বন্ধু মারা গেছেন। একইভাবে।”
“সে
কী!”
“হ্যাঁ।
ওঁর বাড়ি আমাদের পুরনো গ্রামের বাড়ির কাছে। রঘুনাথপুরে। নাম হরেন চক্রবর্তী। এইমাত্র
খবরটা পেলাম আমাদের দেশের বাড়ি থেকে। বাবার ভালো বন্ধু ছিলেন। বডি এখনও হয়তো
বাড়িতেই আছে।”
আমি
সঙ্গে সঙ্গে তানিয়াকে ধরলাম ফোনে। ও জানাল, গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে এখুনি। যাওয়ার পথে
তুলে নেবে আমাকে। দু’নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে কোলাঘাট থেকে বাঁয়ে সোজা রঘুনাথপুর। পূর্ব
মেদিনীপুরে। কলকাতা থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার। আনুমানিক সময়
লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। দ্বিতীয় হুগলী সেতুতে উঠেই ও ফোন করল পূর্ব
মেদিনীপুরের এস.পি.কে। তাঁকে
অবশ্য পাওয়া গেল না। শেষে বেঙ্গল
পুলিশের হেড কোয়ার্টার থেকে লোকাল থানার ওসির নম্বর খুঁজে তাঁকে ফোন করল তানিয়া।
তিনি জানালেন, “আপনারা না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত বডি রেখে দিচ্ছি।”
আমি
জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপারটা কী? একটার
পর একটা বছর পঞ্চাশের মানুষ খুন হচ্ছেন একইভাবে। এটা কি কোনও সিরিয়াল কিলারের
কাজ?”
“হতে
পারে। তবে এর পিছনের প্যাটার্নটা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। এই হরেন চক্রবর্তী আর
মনোজ সরকার না হয় পুরনো বন্ধু। কিন্তু যিনি প্রথম খুন হলেন, সেই রাহুল পাওয়ারের সঙ্গে
তো এঁদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। নাকি এমন
গোপন কোনও বিষয় আছে যেটা আমরা ধরতে পারছি না!”
আমি
কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, “আবার এমন যদি হয়, যে আমরা জানি না অথচ এমন খুন আগেও হয়েছে।
হয়তো সেটা প্রকাশ্যে আসেনি বা যিনি পোস্ট মর্টেম করেছেন তিনি খেয়াল করেননি।”
সামনের
দুটো ট্রাককে ওভারটেক করে তানিয়া উত্তর দিল, “হতেই পারে। তবে আমার মনে হচ্ছে এ
রহস্যের জাল অনেক গভীরে।”
রঘুনাথপুর
যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। পেটে এদিকে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে।
তানিয়ার অবশ্য কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ও হচ্ছে এক নম্বর কাজপাগল মানুষ। হরেন চক্রবর্তীর
বডি থানাতেই রাখা ছিল। একজন অফিসার নিয়ে গিয়ে দেখালেন। দেখে মনে হল মৃতদেহের বয়েস
ঐ পঞ্চাশের আশেপাশেই হবে। মাথাজোড়া টাক। কাঁচাপাকা গোঁফ।
বিস্ফারিত চোখের কোণে কালি।
“ওঁর
ডান হাতের আঙুলগুলি দেখব একবার।”
তানিয়ার
কথায় সম্ভবত বিরক্ত হলেন অফিসার। “কেন? আঙুলে কী আছে?”
“আপনি
বের করুন, তারপর বলছি।”
প্ল্যাস্টিক
সরিয়ে হাতের আঙুলগুলি দেখালেন। না, এটা তো একদম স্বাভাবিক। তাহলে!
“আচ্ছা,
বাঁ হাতটা দেখি একবার।” তানিয়া আবার অনুরোধ করল।
চমকে
উঠলাম আমরা। বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, তর্জনী আর মধ্যমা এই তিনটি কালো হয়ে আছে।
তানিয়া ব্যাগ থেকে আতসকাচ বের করে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে মাথা নাড়ল, “ইনি সম্ভবত
লেফট হ্যান্ডেড ছিলেন। অভিজিৎ ভালো করে দেখ, আঙুলে সাদা গুঁড়ো রোঁয়ার মতো লেগে আছে
কিছু একটা।”
আমি
দেখলাম। তারপর ওসির সঙ্গে কয়েকটা কথা বলে বেরিয়ে এলাম থানা থেকে। রাস্তায় একটা মিষ্টির
দোকানে পেটপুজো সেরে পৌঁছলাম গ্রামের ভিতর চক্রবর্তীদের বাড়ি। জানা গেল, ওঁর তিন
ছেলে আর দুই মেয়ে। তাদের কান্নাকাটি থামেনি এখনও। বড়োছেলের বয়েস পঁচিশ। সেই এগিয়ে
এল আমাদের দেখে। “আমার নাম সুমন্ত। আপনারা?”
নিজেদের
পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম, “কখন ঘটেছে এটা?”
“কালকে
রাতে।”
“আপনারা
বুঝতে পেরেছিলেন?”
“মা
বুঝতে পেরেছিল। ওঁর এখনও কান্না থামানো যাচ্ছে না।”
“ওঁরা
দু’জনে একই ঘরে ছিলেন?”
“না।
তবে পাশাপাশি।”
“ঘরটা
দেখব একবার।”
“আসুন
আমার সঙ্গে।”
সুমন্তর
সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম বাড়ির ভিতরে। দোতলা বড়ো বাড়ি। দেখেই বোঝা যায় বনেদি বড়োলোক।
আমাদের পুরনো বাড়িটা পাশের গ্রামে। আমি সেকথা জানাতে উনি বললেন, “হ্যাঁ, মনে
পড়েছে, আপনাকে ছোটোবেলায় দেখেছি।”
“আচ্ছা,
উনি কি ন্যাটা ছিলেন?”
“হ্যাঁ,
কেন বলুন তো?”
উত্তর
না দিয়ে তানিয়া আবার প্রশ্ন করল, “ডঃ মনোজ সরকারকে চেনেন আপনি?”
“তা
চিনব না কেন? উনিও তো এই গ্রামেরই বাসিন্দা। বাবার
বন্ধু। আমাদের বাড়িতেও আসা যাওয়া করতেন।”
আমি
জানালাম, “তিনিও মারা গেছেন একইভাবে।”
“তাই
নাকি! জানতাম না তো!”
“ইদানীং
কেউ দেখা করতে এসেছিল আপনার বাবার সঙ্গে?”
“আসলে
কী জানেন, বাবা সুদে টাকা খাটাতেন গ্রামে। বন্ধকী কারবার আমাদের বহুদিনের। কত লোকই
রোজ আসত দেখা করতে।”
“কোনও
বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা লামা এসেছিলেন কি?”
“জানি
না।”
ঘরে
ঢুকে দেখা গেল মেয়েরা এখনও ধাতস্থ হতে পারেনি। হরেনবাবুর স্ত্রী কেঁদে চলেছেন
ক্রমাগত। তাও মিনিট পনেরো ধরে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে তানিয়া একটা প্রশ্ন করল, “এখানে
কোনও টব রাখা ছিল কি?” জানালার কাছে একটা টেবিলের উপর আঙুল দিয়ে দেখাল সে। জায়গাটায়
এখনও একটা অস্পষ্ট গোল ভিজে দাগ রয়েছে।
“দাঁড়ান,
মিনতিকে ডাকছি। ওই দেখাশোনা করত বাবার।”
ডাকাডাকি
করতে মিনিট তিনেকের মধ্যে এসে হাজির হল বাড়ির কাজের লোক মিনতি। সে নিচু গলায়
জানাল, “ওখানে একটা গাছ রাখা ছিল।”
“কী
গাছ? কোথায় গেল সেটা?”
“কী
গাছ, তা বলতে পারবুনি। বিদঘুটে দেখতে। পাতা নেই। শুধু সরু সরু ডালপালা। শুকিয়ে গেল
দু’দিনেই। তাই ফেলে দিইছি।”
“ফেলে
দিয়েছ? কোথায়?”
“ঐ
পিছনের ডোবায়। ময়লা-জঞ্জাল সব ওখানেই ফেলা হয়।”
“আমাকে
নিয়ে চল একবার।”
বাড়ির
পিছনদিকে একটা ময়লা ফেলার জায়গা আছে। সেখানে অনেক খুঁজেও কোনও ছোটো টবসমেত গাছ
পাওয়া গেল না। অথচ মিনতি বার বার বলতে থাকল, “আমি তো সকালে এখানেই ফেলে গেলাম।
বাকি সবকিছু পড়ে আছে, শুধু টবটাই নেই!”
দুয়েকজন
বাড়ির লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেল, আমরা আসার কিছুক্ষণ আগে এক ময়লাকুড়ানি
ঢুকেছিল এদিকে। মিনতি আরও জানাল, “দু’দিন আগে এক ন্যাড়ামাথা সন্ন্যাসী এসেছিলেন
বড়োবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। ঘরে বসেই কথা বলছিলেন ওঁরা। আমি
চা দিতে ঢুকেছিলাম একবার। তখন প্রথম দেখি এই চারা গাছটাকে। টেবিলের উপর রাখা ছিল।”
আমি
প্রশ্ন করলাম, “সন্ন্যাসী! ওঁরা কী বিষয়ে কথা বলছিলেন, সেটা শুনেছ কি?”
“না,
তবে মনে হল ঐ গাছের বিষয়েই কথা হচ্ছিল। এরকম সন্ন্যাসী আগেও এসেছিলেন ওঁর সঙ্গে দেখা
করতে। বেশ কয়েকমাস আগে।”
ফেরার
পথে আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। বললাম, “আগের খটকাগুলির সঙ্গে যোগ হল টবের উপর চারাগাছ।
জিলিপির প্যাঁচ তো ক্রমশ বাড়ছে দেখছি।”
তানিয়া
হঠাৎ বলল, “তোর কি মনে আছে, অরুণিমাও একটা রুম প্ল্যান্টের কথা বলেছিল?”
আমি
ভেবে বললাম, “হ্যাঁ, তাই তো!”
ফোন
বের করে ডায়াল করল কাকে। “হ্যালো! আমি তানিয়া চ্যাটার্জি বলছি। প্রাইভেট
ইনভেস্টিগেটর। আপনি বিষ্ণু পাওয়ার বলছেন তো? শুনুন, এখন একবার দেখা করা যাবে আপনার
সঙ্গে?”
সন্ধ্যা
আটটার সময়ে আমাদের গাড়ি পৌঁছল চৌরঙ্গীতে। আবার সেই ছ’তলার অফিস।
ভিতরে
ঢুকে তানিয়া প্রশ্ন করল, “মিঃ পাওয়ার, যেদিন রাহুল মারা যায়, সেদিন বা তার আগে তার
সঙ্গে কোনও সাধু কি দেখা করতে এসেছিল? কোনও লিস্ট পাওয়া যাবে?”
“সে
তো অনেকদিন হয়ে গেল। আর কাজের সূত্রে তো অনেকেই আসতেন দেখা করতে। লিস্ট তো নেই।”
তানিয়া
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করল, “টবে বসানো কোনও প্ল্যান্টের কথা মনে পড়ছে কি?
অফিসের টেবিলে কেউ রেখে গিয়েছিল?”
“প্ল্যান্ট!
মানে পৌদা? কই না তো! দাঁড়ান, কৈলাসকে ডাকি। কৈলাস, ইধার আও জরা।”
ডাক
শুনে ভিতরে ঢুকল বেয়ারা। একে আগের দিনও দেখেছি। আমি প্রশ্ন
করলাম, “ঠিক করে মনে করে বলো। বাবু মারা
যাবার আগে এই অফিসের মধ্যে কোনও চারাগাছ দেখেছ?”
কথাটা
কানে যেতেই সে চমকে উঠল। তারপর গলা ঝেড়ে বলল, “নেহি সাব! আমি কিছু দেখিনি।”
“ভালো
করে ভেবে বলো, কৈলাস।” বিষ্ণুবাবুও অনুরোধ করলেন।
“না।
আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।”
“ঠিক
আছে, যাও তুমি।” তানিয়ার কথায় সে বেরিয়ে গেল অফিস রুম থেকে। “কৈলাসের বাড়ির
ঠিকানাটা দেবেন একটু। তবে ও যেন জানতে না পারে।”
“রহস্যের
জাল যত ঠাস বুনোটই হোক, যিনি জাল বুনবেন, তিনি কাঁচি মানে ক্লু ঠিকই ছেড়ে যাবেন,
বুঝলি? তবে সেটা সবার চোখে সবসময়ে ধরা পড়ে না।
গোয়েন্দারাও তো মানুষ। আর মানুষমাত্রেই ভুল করে।”
মাঝরাতে
সুনসান রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শুনছিলাম তানিয়ার ভাষণ। গাড়িটা
রেখে এসেছি অনেকটা দূরে। এলাকাটা একদম নিঝুম আর বেশ ঘিঞ্জি। ইনস্পেক্টর সামন্ত
আমাদের দু’জনের হাতে পুলিশের দুটো লাঠি ধরিয়ে দিয়েছেন। বললেন, “মাঝরাতে বেপাড়ায়
ঢুকতে গেলে এ-জিনিসটা অবশ্যই হাতে রাখবেন। তখন সব থেকে বড়ো বিপদ হল কুকুর।”
ঘড়ির
দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত দুটো চৌত্রিশ। আমাদের চার-পাঁচ
পা সামনে চলেছে বিশু। পরনে লুঙ্গি আর তাপ্পি দেওয়া হাফ হাতা
গেঞ্জি। সামন্তবাবু বলেছিলেন, “সব এলাকাতেই আমাদের কিছু সোর্স থাকে, বুঝলেন। এত
রাতে একা গেলে বাড়িটা খুঁজে পাবেন না। বিশুকে নিয়ে যান। ও খুব বিশ্বস্ত ছেলে।”
এই
ঘুমন্ত অন্ধকারে গলি তস্য গলির মধ্যে যে কোনও বাড়িই খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। যদি না
সঙ্গে কোনও লোকাল গাইড থাকে। দু-চারটে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু বিশু
আর আমাদের হাতের লাঠিগুলি দেখে কুঁই কুঁই করে পালাল। মিনিট সাতেক হাঁটার পর একটা
দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ও। চার-পাঁচবার
ঠক ঠক করার পর একজন মহিলা সাড়া দিল। “কে?”
“পুলিশ।
দরজা খুলুন।”
তারপরেই
ভিতরে সব চুপচাপ। আবার জোরে দরজা ধাক্কা দেওয়া হল। আর কোনও শব্দ নেই। কী ব্যাপার!
বিশু
ফিস ফিস করে জানাল, “পাখি ভেগেছে।”
“মানে!
দরজায় তো দাঁড়িয়ে আছি আমরা!”
“পিছনদিকে
খালের পাশ দিয়ে রাস্তা আছে একটা। চলুন আমার সাথে।” কথাটা বলেই সে দৌড়াতে শুরু করল।
তার পিছন পিছন আমরাও। এ গলি সে গলি দিয়ে দৌড়ে খালের পাড়ে আসতেই চোখে লাগল জোরালো
টর্চের আলো। সঙ্গে পুলিশের হুইসেল।
“এই
যে এদিকে চলে আসুন। কৈলাস সিং এখানে।” ইন্সপেক্টর সামন্তর গলা।
দেখলাম, চার-পাঁচজন কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে আগে থেকেই ওত পেতে ছিলেন তিনি।
এরপর
তাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে চলল পুলিশি জেরা। দু-চারটে চড়-থাপ্পড় দিতেই সাতকাণ্ড
রামায়ণ বলে গেল গড়গড় করে।
বছরখানেক
আগে এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে কৈলাসের পরিচয় হয় খালপাড়ের চা-দোকানে। তিনি একটা সস্তায়
থাকার জন্য ঘর খুঁজছিলেন। বস্তিতে যে ঘরে কৈলাস থাকে তারই পাশে একটা ঘর ফাঁকা ছিল।
রফা করে মাসিক ভাড়া ঠিক হওয়ামাত্র লোকটি ছ’মাসের টাকা অগ্রিম দেন। লোকটি কিন্তু সবসময়ে
থাকতেন না এখানে। মাঝে মাঝেই দরজায় তালা বন্ধ করে চলে যেতেন। আবার
ফিরতেন এক-দু’সপ্তাহ পরে। ঘরের
জানালায় আর পিছনের একচিলতে ঘেরা বারান্দায় ছোটো ছোটো টবে থাকত বিভিন্ন চারাগাছ। কৈলাস
একবার প্রশ্ন করতে তিনি নাকি জানিয়েছিলেন, তাঁর ঔষধি গাছগাছড়ার শখ। একবার কৈলাসের
মায়ের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল, তাঁর দেওয়া আয়ুর্বেদিক ওষুধ খেয়ে তিনদিনেই চাঙ্গা
হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে ওঁর উপর শ্রদ্ধা অনেকগুণ বেড়ে যায়। একটাই নেশা ছিল ওঁর,
সিদ্ধি। প্রতি রাতে সিদ্ধি খেয়ে চোখ লাল করে শুয়ে থাকতেন। সেই সময়ে কথা বলতেন
অসংলগ্ন। যার মাথামুণ্ডু নেই কিছু। আবার মাঝে মাঝে এমন কিছু গোপন কথা বেরিয়ে আসত
মুখ দিয়ে যে চমকে যেত কৈলাস।
সেরকমই
এক দুর্বল মুহূর্তে কৈলাস জানতে পারে তিনি নাকি উত্তরের পাহাড়ি ঘন জঙ্গলের মধ্যে
খুঁজে পেয়েছিলেন এক অদ্ভুত বিষাক্ত উদ্ভিদ। সেই গাছের চারা তিনি সংগ্রহ করে নিয়ে
আসেন। উদ্দেশ্য ছিল তিনজন মানুষকে খুন
করার। আর সেই জন্যই কলকাতায় এসে ঘাঁটি গেড়েছেন।
তিনি
আরও জানিয়েছিলেন, এই গাছটিতে পঁয়তাল্লিশ দিন বাদে বাদে একধরনের সাদা ছোটো ছোটো খুব
সুন্দর ফুল আসে। আর সেই সময়ে যদি ভুল করেও কেউ ফুলগুলিকে ছুঁয়ে ফেলে তাহলে গাছটির
গা থেকে একধরনের বিষ প্রাণীটির শরীরে ছড়িয়ে যায়। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাণীটি
ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সে যদি মানুষের মতো বড়ো প্রাণী হয় তাহলে ছোটো গাছটিও সেই
প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে না পেরে মারা যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে।
এই
তথ্যটি শোনার পর থেকেই কৈলাসের মাথায় চেপে বসে এক প্রতিহিংসা। বাবার চিকিৎসার জন্য
কিছুদিন আগে কয়েক হাজার টাকা চেয়েছিল সে। কিন্তু কৃপণ মালিক তাকে গালাগালি দিয়ে
ভাগিয়ে দেয়। তার জন্য বাবা প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন। ঐ নরকের কীটের
বেঁচে থাকার কোনও অধিকার নেই।
ঐ
প্রজাতির একটা টবসমেত গাছ বিষ্ণুজীর অফিসের টেবিলে রেখে আসে সে। রাহুলকে বলে,
বাস্তুশাস্ত্রমতে এটা খুব শুভ। কৈলাস জানত বড়োবাবু অনেক রাত পর্যন্ত অফিসে বসে
হিসাবপত্র চেক করেন। ফুলটি ফোটার সময় সূর্যাস্তের পর। ছ’ঘণ্টা এর আয়ু। একটা মিষ্টি
গন্ধ মানুষকে আকৃষ্ট করে ফুলটির প্রতি। তখন যদি আগ্রহবশত একবার কেউ হাত দেন ফুলটির
গায়ে, তাহলেই অবধারিত মৃত্যু।
কিন্তু
কার্যক্ষেত্রে হল উলটো। বিষ্ণুজীর বদলে মারা গেল তাঁর ছেলে রাহুল। কারণ সেদিন
বিষ্ণুজী আসেননি অফিসে। এই ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর থেকেই সেই লোকটি নিরুদ্দেশ
হয়েছেন।
পরের
দিন কৈলাসদের পাশের বন্ধ ঘরটি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কয়েকটা খালি মাটির টব ছাড়া
লোকটির আর কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না। তানিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, “লোকটি একটা জিনিয়াস।
কিন্তু তিনি নেশার ঘোরে জানিয়েছিলেন কলকাতায় এসেছেন তিনটি খুন করতে। তার মানে এখনও
একজন বাকি? সে কে?”
আমি
বললাম, “সেই বিষাক্ত গাছের ফুল ফোটে পঁয়তাল্লিশ দিন বা দেড় মাস বাদে বাদে। প্রথম
খুন, মানে রাহুল মারা যাবার তিনমাস পরে খুন হয়েছিলেন ডঃ সরকার। তার দেড় মাস পর খুন
হলেন হরেন চক্রবর্তী। পরের তিন নম্বর খুন হবে সম্ভবত আরও
দেড় মাস অথবা তিন মাস পর। এর আগে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে খুনিকে।”
“সেজন্য
আমাদের জানতে হবে খুনের মোটিভ। সেটাই তো এখনও অন্ধকারে।”
থানা
থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে তানিয়া বলল, “ব্যাপারটা আবার প্রথম থেকে সাজাতে হবে, বুঝলি?
ডঃ মনোজ সরকার আর হরেন চক্রবর্তী, দু’জনেরই ছোটোবেলা কেটেছে রঘুনাথপুরে। তোদের পুরনো
বাড়িও কাছাকাছি ছিল। তুই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর কর। ওঁদের সমবয়সী কোনও বয়স্ক
মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা কর যদি নতুন কোনও তথ্য পাওয়া যায়।”
এরপর
আমি গ্রামের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে রঘুনাথপুর হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ও বর্তমান
প্রধান শিক্ষক শ্রী ইন্দ্রনাথ মল্লিকের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি জানালেন, “হরেন আর
মনোজ দু’জনেই ছিল আমার জুনিয়ার। তবে বড়োলোকের ছেলে বলে ওদের একটু অহংকার ছিল গোড়া
থেকেই। স্কুলের শিক্ষকরাও ওদের সমীহ করে চলতেন। আরেকটি ছেলে ছিল, নামটা খেয়াল পড়ছে
না। স্কুলের এক ভূগোল শিক্ষক চণ্ডীবাবুর
ছেলে ওদের বন্ধু ছিল। কিন্তু কয়েক বছর পরে চণ্ডীবাবুর
ট্র্যান্সফার হয়ে গেল অন্য স্কুলে। তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এছাড়া...
একটা ঘটনা মনে পড়ছে। হরেনদের বাড়িতে একবার ডাকাত পড়েছিল। কিন্তু হরেনের বাবা খুব
সাহসী ছিলেন। এক ডাকাত মারা গেল তাঁর গুলিতে। আরেকজন ধরা পড়ল। শুনেছিলাম, সেই ডাকাতরা
নাকি এসেছিল পাশের গ্রাম থেকে। আর তাদের দু’জনের ছেলেও ঐ একই ক্লাসে পড়ত হরেন আর
মনোজের সঙ্গে। তাদেরও নাম মনে পড়ছে না।”
“এই
ঘটনাগুলি কোন সময়ের? সাল, তারিখ কিছু বলতে পারবেন?”
কিছুক্ষণ
চিন্তা করে তিনি বললেন, “আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আর ওরা এইটে। মানে উনিশশো আশি
সাল নাগাদ হবে।”
“সেই
সময়ে স্কুলের কোনও রেকর্ড পাওয়া যাবে?”
“নাহ্,
একেবারেই অসম্ভব। কারণ, বেশ কয়েকবার বন্যায় ডুবে গিয়েছিল স্কুল। অনেক নথি নষ্ট হয়ে
গেছে। আর নতুন বিল্ডিং হওয়ার পরে পুরনো কাগজপত্র কিছুই সংগ্রহ করা যায়নি।”
এই
ঘটনার প্রায় আড়াই মাস পর হঠাৎ তানিয়া আমাকে ফোন করে বলল, “অফিস থেকে ক’দিনের ছুটি
নিতে পারবি?”
বিনয়ী
গলায় আমি জানালাম, “আমার অফিস রবিবার ছাড়া ছুটি দেয় না। না গেলে টাকা কাটবে।”
“মনে
হচ্ছে কেসটা সলভ হবে শীঘ্রই। ক্লাইম্যাক্সে তুই থাকবি না, এটা হয়?”
“কোথায়
যেতে হবে?”
“আপাতত
কালিম্পং। ওখানে ডঃ অরিন্দম সরকার আছেন ‘হোটেল ওক’-এ। তুই
কালকের সকালের ফ্লাইটেই চলে আয়। টিকিট মেইল করছি। তোর কাজ হবে ভদ্রলোককে
ছিনেজোঁকের মতো ফলো করা। তবে সাবধানে। লোকটা যেন ঘুণাক্ষরেও
বুঝতে না পারে।”
“তুই
জানলি কী করে?”
“অরুণিমাও
ওর কাকাকেই সন্দেহ করছে। সেই খবরটা দিল আমাকে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ আগে
ওঁর সহকারীকে ফোন করেছিলাম পেশেন্ট সেজে। তিনি জানালেন, স্যার কলকাতায় নেই। এরপর
বিমানবন্দরে সাইবার মেইন্টেনেন্স বিভাগে আমার যে বন্ধুটি কাজ করে তাকে বললাম ওদের
সার্ভারে এই নাম সার্চ করে দেখতে। সে জানাল, আজকে সকালে ডঃ অরিন্দম সরকার
বাগডোগরার প্লেনে উঠেছেন। তারপরের কাজটা অবশ্য করেছেন লালবাজার ক্রাইমের ডি.সি.
রণজিৎ গাঙ্গুলি। তিনি এইমাত্র জানালেন, ডঃ সরকার নাকি কালিম্পংয়ের ‘হোটেল ওক’-এ
উঠেছেন।”
তারপরেই
আমার তড়িঘড়ি পাহাড়ে আগমন।
এখন
শুধু প্রতীক্ষা। ক’ঘণ্টা চুপচাপ বসতে হবে গাড়িতে জানি না। ড্রাইভারকে বলে রেখেছি,
আমি সরকারি গোয়েন্দা। অতএব কাজের বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করা চলবে না। এদিকে ‘হোটেল ওক’-এর
এক বেয়ারাকেও একই কথা বলে হাত করেছি। কিছু টাকা বকশিসের পরিবর্তে সে আমাকে জানাবে
ঠিক কোন গাড়িতে এবং কখন ডঃ সরকার হোটেল ছাড়লেন।
তাকিয়ে
ছিলাম বাইরের দিকে। পাহাড়ি রাস্তায় মেঘের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে
ভিজে যাচ্ছিল গাড়ির উইন্ড স্ক্রিন। ওয়াইপার
চালিয়ে বার বার পরিষ্কার করে নিচ্ছে সন্দীপ, মানে এই গাড়ির ড্রাইভার। অনেক
জায়গাতেই ঝর্নার জলের তোড়ে ভেঙে যেতে পারে রাস্তা। এই নিয়ে একটু ক্ষোভ প্রকাশ করছিল।
দু’দিকেই ঘন জঙ্গল। তার মধ্যে দিয়ে ঘুরে ঘুরে উঠছে রাস্তা। পথের
ধারে ফুটে রয়েছে কত বিচিত্ররকমের রঙিন ফুল।
সন্দীপকে
প্রশ্ন করতে জানাল, “হিমালয়ের এই অঞ্চল হল অর্কিডের স্বর্গরাজ্য। প্রায়
ছ’শো রকমের অর্কিড আছে এখানে। প্রতিটা
ফুলের রঙ আর চেহারা আলাদা। এই জঙ্গলে অনেকরকম ইনসেক্ট ইটিং প্ল্যান্টও আছে।”
আমি
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মানে, পতঙ্গভুক উদ্ভিদ বা কার্নিভোরাস প্ল্যান্ট!”
“আছে।
তবে ঘন জঙ্গলের মধ্যে।”
ছোটোবেলায়
বইয়ে পড়েছিলাম কলসপত্রীর কথা। ঝুলন্ত কলসির মতো একটা ফাঁদে পোকারা প্রবেশ করে
খাবারের সন্ধানে। আর উঠতে পারে না। সেখানেই তাদের শরীর থেকে নির্যাস বের করে
উদ্ভিদগুলি নিজেদের প্রোটিনের চাহিদা বজায় রাখে।
ঝাড়া
দু’ঘণ্টা বৃষ্টির মধ্যে অপেক্ষা করার পর ফোনটা এল হোটেলের ছেলেটির কাছ থেকে।
“স্যার, ডঃ সরকার অভি নিকল গয়ে। সাথ মে অউর এক আদমি থা। গাড়িকা নম্বর আপকো এস.এম.এস.
কর দিয়া।”
আমি
তৈরি থাকতে বললাম সন্দীপকে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল সাদা ইনোভাটা।
আমাদের গাড়িও বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে ছুটল পিছন পিছন। বৃষ্টির মধ্যে মাঝে মাঝে
অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে সামনের রাস্তাটা। কিছুদূর যাওয়ার পর সন্দীপ জানাল, “এ রাস্তা তো
পেলিং বা গ্যাংটক যাচ্ছে না!”
“সে
কী! কোথায় যাচ্ছে তাহলে?”
“পেডং-এর
দিকে।”
পেডং!
ম্যাপে সার্চ করে দেখলাম, পেডং হল পূর্ব সিকিমে ঢোকার আগে একটা ছোট্ট জনপদ। ঘণ্টা
দেড়েকের মধ্যে আমরা প্রথমে পেডং, তারপর রেশি নদী পেরিয়ে প্রবেশ করলাম সিকিমে।
এদিকে বৃষ্টি নেই। তবে একদম শুকনোও বলা যাবে না। সন্দীপ খুব বুদ্ধি করে চালাচ্ছে
গাড়িটা ওদের যাতে কোনওরকম সন্দেহ না হয়। প্রধান রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে একটা বাঁক
নিতেই সে বলল, “আরিটার।”
রঙ্গোলির
আগে ডানদিকে একটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে আরিটারে। আমাদের পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল
হয়ে গেল। মাঝে দু’জায়গায় ধ্বস নামার জন্য দেরিও হয়েছে।
ইনোভাটাকে দেখতে পাচ্ছি না আর। নিচের দিকেই একটা হোটেলের সামনে নেমে টাকা মিটিয়ে
ছেড়ে দিলাম সন্দীপকে। ‘চিটিজ’ নামে হোটেলটি বেশ সুন্দর। তিনতলায় আমার ঘরের জানালা থেকে
ভারি সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ঢেউ খেলানো
হরিৎ কার্পেট যেন। তানিয়াকে ফোন করার চেষ্টা করে দেখলাম নট রিচেবল। পাহাড়ে অনেক
সময়েই হয় এরকম। টাওয়ার থাকে না প্রায়ই। লাগেজ রেখে নিচে নেমে রিসেপশনে জিজ্ঞাসা
করতে মহিলা ম্যানেজার জানালেন, “কিছুটা উপরে পড়বে তিনমাথার মোড়। সেখান থেকে
বাঁদিকে গেলে আরিটার লেক।”
জঙ্গলের
মধ্যে দিয়ে রাস্তা। একা একা চলতে বেশ ভালোই লাগছে। কতরকমের পাখির ডাক। গাছের ছায়ার
নিচে শ্যাওলায় মোড়া পাথর-সারি। পথের ধারে
লম্বা লম্বা বৌদ্ধিক মন্ত্র লেখা রঙবেরঙের ঝাণ্ডা হাওয়ার তালে উড়ছে পতপত করে। একটা
বড়ো স্কুল পড়ল বাঁ হাতে। সেটা পেরিয়ে আরও কিছুটা গিয়ে চার হাজার ছ’শো ফুট উচ্চতায়
প্রায় পাঁচশো আঠারো বর্গ ফুট আয়তনের প্রাকৃতিক এই ল্যামপোখারি হ্রদ। ভিতরে প্রবেশের
জন্য গেটে টিকিট কাটতে হল। চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা লেকটি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। বোটিং
করার ব্যবস্থাও আছে। অনেকেই ভিড় জমিয়েছে সেদিকে। আমি
উলটোদিকে বাঁধানো পাড়ের পাশ দিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে বসলাম একটা লোহার চেয়ারে।
আসলে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে চিন্তাগুলি। রহস্যের কিনারা করা তো দূরে থাক,
ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছি জালের মধ্যে। ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে।
ফোনে বার বার চেষ্টা করেও তানিয়াকে পাচ্ছি না। শেষে উঠে পড়লাম।
একটা
গুমটি দোকানে মোমো খেয়ে ফেরার পথ ধরলাম। গাছেদের ডালপালার ফাঁকে তখন শুরু হয়েছে
পাখিদের কিচিরমিচির। ডঃ সরকার কোন
হোটেলে উঠেছে সেটা জানা জরুরি। কিন্তু আসার
পথে কোনও হোটেলেই তাঁদের গাড়িটির দেখা পেলাম না। এক চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করে
জানতে পারলাম, বেশ কয়েকটি রিসর্টও আছে এখানে। জঙ্গলের মধ্যে।
আধো
অন্ধকার রাস্তায় কিছুটা এগিয়েছি এমন সময়ে দেখি উলটোদিক থেকে একটা ল্যান্ডরোভার
বেরিয়ে গেল হুস করে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে মিঃ গৌরাঙ্গ সমাদ্দার। আশ্চর্য!
তিনি এখানে কেন? আমাকে অথচ বললেন, পেলিং যাব। তবে চিনতে পারেননি আমাকে। কানে ফোন
দিয়ে কথা বলছিলেন কারও সঙ্গে। অবশ্য পাড়ার বন্ধুরাও এই অবস্থায় আমাকে দেখলে চিনতে
পারত না আমি নিশ্চিত। কারণ, তানিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী আমার চেহারা এখন এক শিখ যুবকের। মাথায়
পাগড়ি, চাপ দাড়ি, গোঁফ, চোখে চশমা।
হোটেলে
ফিরতেই বেজে উঠল ফোনটা। টাওয়ার পাওয়া গেছে। তানিয়ার নম্বর।
“হ্যালো!”
“কী
খবর? কোথায় এখন?”
“আমার
খবর ঠিক আছে। এখন আরিটারে। ডঃ সরকারকে ধাওয়া করে এলাম। কিন্তু এখানে এসে খুঁজে
পাচ্ছি না আর। তুই কবে আসবি?”
“কাল
সকালেই পৌঁছাব।”
আবার
ফোনটা কেটে গেছে। টাওয়ার নেই।
এদিকে
মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কেন জানি কুরে কুরে খাচ্ছে। রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি সেরে
নিয়ে অন্ধকার রাস্তায় আবার বেরোলাম। মোটা লং জ্যাকেটাটা গলিয়ে নিয়েছি। গালায়
মাফলার। ঠাণ্ডাও পড়েছে জবরদস্ত। হোটেলগুলি পেরিয়ে পুনরায় এসে পৌঁছলাম তিনমাথার
মোড়টায়। একটা স্টেশনারি ছোটো গুমটি দোকানে টিমটিমে আলো জ্বলছে এখনও।
দোকানি সবে ঝাঁপ বন্ধ করার বন্দোবস্ত করছেন। এমন সময় পাশ থেকে একজন লোক অন্ধকার
ফুঁড়ে এসে সিগারেট চাইল। চমকে উঠলাম গলাটা শুনে। ডঃ অরিন্দম সরকার! মাথায় উলের
মোটা কানঢাকা টুপি। এক পা এক পা করে আমি সরে এলাম পিছনে মোটা গাছটার আড়ালে।
তিনি
ধীরেসুস্থে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে হাঁটা দিলেন উলটোদিকের রাস্তায়। ঘুটঘুটে
অন্ধকার। হাতে একটা সাদা টর্চ। আমি কিছুটা দূরত্ব রেখে পিছু নিলাম। উত্তরদিকে
প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর নেমে গেলেন ডানদিকের সরু রাস্তায়। অনুসরণ করতে করতে
আমি পৌঁছলাম একটা নির্মীয়মাণ বিল্ডিংয়ের কাছে। ভিতরে একটা হলুদ বাল্বের আলো জ্বলছে
টিমটিম করে। অরিন্দমবাবু কি এখানেই ঢুকেছেন? অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম
অনেকক্ষণ। নিস্তব্ধ এলাকায় দূরাগত কয়েকটা নিশাচর পাখির ডাক আসছে চিহু... চিহু...
করে।
একটা
টর্চের আলো উঠে আসছে নিচে থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। খস খস করে শব্দ কানে আসতেই লুকিয়ে
পড়লাম অন্ধকারে একটা মোটা পাইনগাছের পিছনে। বেশ কয়েকজনের
আওয়াজ। একটা হল্লা। কারা এরা? চার-পাঁচজন মিলে কাউকে ধরে নিয়ে এল। নির্মীয়মাণ
বাড়িটিতে ঢুকে যেতে আমিও সন্তর্পণে এগোলাম।
দেয়াল
ঘেঁষে উঁকি মারতে দেখি, একজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রেখেছে মেঝেতে। গোঁ গোঁ করে
একটা আওয়াজ করছে লোকটা। অরিন্দমবাবু পায়চারি করছেন সামনে। সিগারেটের টুকরোটা ছুড়ে
ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “জিনিসটা গেল কোথায়?”
“আমরা
হোটেলে সার্চ করেছি, স্যার। নেই কোথাও।”
“সোজা
করে দাঁড় করা একে।”
লোকগুলো
ওকে ধরে তুলতেই চমকে উঠলাম। এ তো রমেনবাবু!
অরুণিমাদের কাজের লোক। তার মুখের বাঁধনটা খুলে দিয়ে প্রশ্ন করলেন, “জিনিসটা দিবি,
না নলি কেটে এখানেই ফেলে দেব জঙ্গলে?”
“বিশ্বাস
করুন বাবু, মূর্তি আমি নিইনি। আমার কাছে নেই ও-জিনিস।”
“বাজে
কথা শোনার জন্য আসিনি আমি। দাদার বেডরুম থেকে তুই ছাড়া আর কেউই সরাতে পারত না ও-জিনিস। আর তুই
তো ফোন করেছিলিস আমাকে?”
“বাবু,
আমি ফোন করেছিলাম ঠিকই। কারণ, টাকার খুব দরকার। ছেলেটার ক্যানসার হয়েছে। টাকা না
পেলে বাঁচাতে পারব না। আপনাকে তো আগেও বলেছি।”
কিছুক্ষণ
চুপ থেকে রমেনবাবু আবার বলে উঠলেন, “আমি শুনেছি, আপনি জিনিসটা বিক্রি করে বিদেশে
চলে যাবেন।”
“সেজন্য
তুই আমাকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য এসেছিস এখানে?” ধমকে উঠলেন তিনি।
“না
বাবু, এখান থেকে সোজা উড়িষ্যা চলে যাব। ছেলেটা হসপিটালে ভর্তি। আমাকে কিছু টাকা
দিন, বাবু। বড়ো দাদাবাবু মারা যেতে পুলিশ আমাকে অনেক জেরা করেছে। মারধোরও করেছে। আমি
কিন্তু আপনার নাম বলিনি। তবে আমাকে ফাঁকি দিয়ে যদি পালাতে চান, তাহলে জানবেন সব কথা
পুলিশকে বলে দেব। সেন্টের শিশিতে যে আপনিই বিষ মিশিয়েছিলেন সেটা জানতে পারলে
সারাজীবন আপনাকে ঘানি টানতে হবে।”
“খুব
যে গরম দিচ্ছিস! এখন আমি যদি এখানে তোকে মেরে ফেলে দিই, কাকপক্ষীতেও টের পাবে না।”
ইটের
ফাঁকে চোখ রেখে দেখলাম, হলুদ টর্চের আলোয় অরিন্দমবাবুর হাতে চলে এসেছে একটা রিভলভার। এখনই
কিছু একটা না করলে বেঘোরে প্রাণটা যাবে। দুটো ইটের টুকরো তুলে নিলাম পায়ের কাছ
থেকে। তারপর ক্ষণিকের মধ্যে ছুড়ে দিলাম অরিন্দমবাবুর পিস্তল-ধরা হাত লক্ষ্য করে।
পিস্তল ছিটকে পড়ল। দ্বিতীয়টা গিয়ে লাগল আলোতে। অন্ধকারের মধ্যে একটা হুলুস্থুল
বেধে গেল। তার মধ্যেই ঘুসি মেরে ধরাশায়ী করলাম জনাতিনেক লোককে। রমেনবাবুর হাতের
বাঁধনটা খুলে দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে লাফ দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটল ঘটনাটা।
দু’জনে
দৌড়াতে দৌড়াতে জঙ্গলের কিনারে খাদের ধারে দাঁড়ালাম থমকে। সেই
মুহূর্তে আমিও খপ করে খামচে ধরেছি কলারটা। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “কিছু করিনি।
আমি কিছু করিনি, বিশ্বাস করুন!”
গলায়
গাম্ভীর্য এনে বললাম, “ব্ল্যাকমেল করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা যে আপনার
নেই তা তো বুঝতেই পারছি। কিছুক্ষণ আগে আমি যে আপনার প্রাণ বাঁচালাম সেই কৃতজ্ঞতা বোধটা
আছে তো?”
“মানে?”
“মানে
যা জিজ্ঞেস করব, সোজা সত্যি কথায় উত্তর দেবেন। বেচাল করলেই ঠেলে ফেলে দেব খাদে।”
তিনি
থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। “বলুন, কী জানতে চান।”
“সবকিছু।
প্রথম থেকে। কোনওরকম লুকোবেন না। পুলিশের জালে একবার জড়িয়ে গেলে খুনের ষড়যন্ত্র বা
সেটা জেনে তথ্য গোপন করার জন্য সাত বছরের জেল।”
একটা
ঢোঁক গিলে ধাতস্থ হয়ে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরালেন। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে শুরু
করলেন, “ঘটনাটা মনুদা মানে, মনোজ সরকারের ছোটোবেলার। ওরা তখন গ্রামের স্কুলে পড়ত।
মনু, ফুচু আর হরি - তিনজনের ভাব ছিল খুব। ওদেরই ক্লাসে পড়ত শৈল্য, সে ছিল নিচু
জাতের। গ্রামের বাইরে থাকত ওরা। পড়াশোনায় ভালো হলেও যেহেতু ওদের পরিবার খুব গরীব
ছিল, পরের বাড়িতে কাজ করত, তাই গ্রামে কোনও সম্মান ছিল না। রঘুনাথপুর গ্রামের
দক্ষিণপ্রান্তে একটা পোড়ো মন্দির ছিল। কতদিনের পুরনো তা কেউ জানে না। বট-অশ্বত্থের
মোটা মোটা শিকড় আর ঝুরি চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মন্দিরটিকে প্রায় মিশিয়ে
ফেলেছিল মাটির সাথে। একদিন প্রচণ্ড ঝড়ে গাছের গোড়াসমেত মন্দিরটা উপড়ে পড়ল। আর ঘটনাচক্রে
ঠিক পরের দিন নাকি শৈল্য খেলতে গিয়েছিল সেখানে আরেক বন্ধুর সঙ্গে। হঠাৎ
ওরা দেখে একটা চাঙড়ের মধ্যে থেকে উঁকি মারছে একহাত লম্বা একটা ধাতুর মূর্তি। ভালো
করে পরিষ্কার করে লক্ষ করে, রঙিন ছোটো ছোটো পাথর দিয়ে খুব সুন্দর কাজ করা আছে তার
গায়ে। জিনিসটা দেখে ওরা দু’জনেই চমকে যায়। পরে বাড়িতে নিয়ে গেলে প্রথমে ভয় পেয়ে
গিয়েছিল বাড়ির লোক। তারপর ওদের দু’জনের বাবা জোট বেঁধে
সেই রাতেই যায় হরিদের বাড়ি। হরির বাবা প্রাণকেষ্ট চক্কোত্তি ছিলেন গ্রামের সুদখোর
সাহুকার। তিনি জহুরীর চোখে এক পলকেই বুঝে নেন জিনিসটা খাঁটি সোনার, আর এর ঐতিহাসিক
মূল্য অনেক। কিন্তু জোচ্চুরি করে তাদের বলেন জিনিসটা পিতলের। সামান্য কিছু টাকা
দিয়ে ভাগিয়ে দেন ওদের।
“এরপর
হঠাৎ চক্কোত্তিদের বাড়িতে ডাকাতি হয়। কিন্তু সেই মূর্তিটা তখন ওদের বাড়িতে ছিল না।
চক্কোত্তি মশাইয়ের গলাকাটা সুদখোর হিসাবে দুর্নাম ছিল বাজারে। সেজন্য ওঁর শত্রুও
ছিল অনেক। হয়তো তাদের মধ্যেই ঘটিয়েছিল কেউ। কিন্তু
হরি আর মনু ফন্দি করে শৈল্যর বাবার নামে মিথ্যা দোষারোপ করে, যে ওরাই নাকি ঘটিয়েছে
এটা। আসলে পিছনে ছিল একটা হিংসা। শৈল্য
পড়াশোনা ও খেলাধুলোতে ওদের হারিয়ে দিত বরাবর। সেজন্য স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও
প্রিয়পাত্র ছিল। এইসব কারণে হরি আর মনু ওকে সহ্য করতে পারত না।
“প্রাণকেষ্টবাবু
ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে শৈল্যর বাবাকে জোর করে ধরে এনে হত্যা করেন গুলি করে। তারপর
অভাবের তাড়নায় পরিবারটাই ভেসে যায়।”
এই
পর্যন্ত বলে রমেনবাবু চুপ করলেন। আমার কাছে চিত্রটা পরিষ্কার হচ্ছিল ধীরে ধীরে। এতদিন
ধরে জমে থাকা ঘন মেঘ কেটে আলো দেখা দিচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, “ফুচু কে? মানে, হরি
আর মনুর তিন নম্বর বন্ধু?”
তিনি
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ফুচু ওদেরই ক্লাসে পড়ত। স্কুলেরই এক মাস্টারমশাইয়ের
ছেলে। সেও জানত সব আসল ঘটনা। কিন্তু মুখ খোলেনি। পরে
অবশ্য ওরা চলে যায় গ্রাম ছেড়ে।”
মনে
পড়ল রঘুনাথপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কথা। বললাম, “সে কি ভুগোলের শিক্ষক
চণ্ডীবাবুর ছেলে?”
“হ্যাঁ,
ভালো নাম ছিল গৌরাঙ্গ সমাদ্দার।”
চমকে
উঠলাম নামটা শুনে। আবার প্রশ্ন করলাম, “আপনি এত কথা জানলেন কী করে?”
কিছুক্ষণ
চুপ করে থেকে তিনি বললেন, “এসব কথা আমি অরিন্দমবাবুর কাছেই শুনেছি। দাদার সঙ্গে ঝগড়ার
সময়ে বলেছেন। ওঁর দাদার সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না মোটেই।”
“কেন?”
“নতুন
হাসপাতাল করতে গিয়ে ওঁর অনেক ধারদেনা হয়ে আছে। সেই মূর্তিটা বিক্রি করতে পারলে সব
দেনা মিটে যাবে। কিন্তু মূর্তিটা মনোজবাবু কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না।”
আমি
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করলাম, “মূর্তিটা কোথায়?”
“এখন
কোথায় জানি না। তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল সরকারবাড়িতেই। পরপর দু-তিনবার ডাকাতির
পর চক্কোত্তিরা অনেকটা ভেঙে পড়ে। প্রাণকেষ্টবাবু মারা যান। তারপর হরি জিনিসটা
মনুকে বিক্রি করে দিয়েছিল। ইদানীং অরিন্দমবাবু মনুদাকে চাপ দিচ্ছিল ওটা এক বিদেশি
খদ্দেরের কাছে বিক্রি করার জন্য। শুনেছি, আন্তর্জাতিক বাজারে নাকি জিনিসটার অনেক
দাম।”
“তারপর?”
“মনোজবাবু
মারা যাবার কয়েকদিন আগে জিনিসটা বাড়ি থেকেই চুরি হয়ে যায়।”
“সে
কী! অত দামী জিনিস বাড়িতে রাখা থাকত? চুরিই বা হল কী করে?”
“লকারে
রাখা ছিল। কিন্তু মনোজবাবু ওটা ব্যাঙ্ক থেকে এনেছিলেন। কেন তা জানি না।”
“বুঝলাম।
কিন্তু পুলিশে কমপ্লেন করেননি কেন? আর অরুণিমাও তো আমাদের বলেনি একথা।”
“যেহেতু
জিনিসটাকে নিয়ে একটা খারাপ ইতিহাস আছে, তাছাড়া ঘটনাটার
সঙ্গে বাড়ির লোকই জড়িত, তাই কাদা ছোড়াছুড়ি পছন্দ করেননি তিনি। আর দিদিমণি এত কথা
জানত না। ও তো অনেকদিন ব্যাঙ্গালোরে আছে।”
“জিনিসটা
অরিন্দমবাবু বাড়ি থেকে সরালেন, কিন্তু টাকা পেলেন না কেন? তাহলে কি ওঁর কাছ থেকেও
চুরি হয়ে গেল!”
রমেনবাবু
বললেন, “তা হতেও পারে। উনি হয়তো কাউকে দিয়েছিলেন মূর্তিটা বিক্রি করার জন্য। তারপর
সেখান থেকে হারিয়ে যায়। আসলে প্রায় দিন দশেক আগের কথা। একদিন অরিন্দমবাবু অফিস
থেকে ফিরে ফোনে কথা বলছিলেন কারও সঙ্গে। আমি শুনে যা বুঝলাম, সিকিমের আরিটারে কোনও
লামার কথা বলছিলেন।”
“লামা!
এখানেও সেই রহস্যময় লামা! আপনি তানিয়াকেও এক লামার কথা বলেছিলেন, মনে আছে?”
“হ্যাঁ,
এক লামা তো দেখা করতে এসেছিলেন মনুদার সঙ্গে।”
আমি
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “ঠিক আছে, এখন রাত অনেক হল, চলুন আপনাকে হোটেলে ছেড়ে
দিয়ে আসি।”
ওঁকে
নিরাপদ জায়গায় ছেড়ে দিয়ে বললাম, “ভোর থাকতে হোটেল পালটে নিয়ে কালকের দিনটা ঘাপটি
মেরে থাকুন কাছাকাছি। কাজ আছে।
মনে রাখবেন, পালানোর চেষ্টা করলেই পুলিশের হাতে ধরা পড়বেন। তখন আপনার বিপদ আরও
বাড়বে।”
বললেন,
“জানি।”
ফেরার
পথে জনমানবহীন নিশুতি রাতে একা হাঁটতে হাঁটতে হিসাব করছিলাম মনে মনে। এক নম্বর প্রশ্ন
হল, এরা সবাই একই সময়ে আরিটারে কেন এসেছে? সেটা কিছুতেই পরিষ্কার নয়। দুই, সেবার
রঘুনাথপুর গ্রামে মাস্টারমশাই বলেছিলেন, একজন ডাকাত মারা গিয়েছিল গুলিতে। আরেকজন
ধরা পড়েছিল। সেই ডাকাতরা এসেছিল পাশের গ্রাম
থেকে। আর তাদের দু’জনের ছেলেও ঐ একই ক্লাসে পড়ত হরেন আর মনোজের সঙ্গে। এদের
মধ্যে একজন যদি শৈল্য হয়, তাহলে দ্বিতীয়জন কে? তাদের আসল নাম কী? তিন, কে সেই
লামাজী, যিনি মৃত্যুর আগে দু’জনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন? চার, টালিগঞ্জের বস্তিতে কৈলাসের
বাড়িতে সেই ভাড়াটিয়াই বা কে? পাঁচ, এসব কি একই লোকের কাজ? না ভিন্ন ভিন্ন লোক এর সঙ্গে
জড়িয়ে আছে বিভিন্ন মতলবে? ছয়, মূর্তিটা এখন কার কাছে? এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে
হলে দরকার চুলচেরা বিশ্লেষণ। আর তাই তানিয়ার অভাব বোধ করছিলাম খুব।
হোটেলের
কাছাকাছি আসতেই একটা কড়া মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগল। তারপর অন্ধকার গলি থেকে আচমকা
চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘাড়ের উপর। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল ওরা। দু’জনকে ধাক্কা দিয়ে
ধরাশায়ী করলাম কোনওরকমে। কিন্তু ধস্তাধস্তির মধ্যে একজন নাকে
চেপে ধরল একটা রুমাল।
অনেকক্ষণ
পরে খেয়াল হল যেন অনেকদূর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। বেশ কয়েকজনের
কথাবার্তার শব্দ। ধীরে চোখ খুলতে দেখলাম, চারপাশটা
তখনও অন্ধকার। সবে ভোরের আলো ফুটছে। পিছমোড়া করে আমার হাত-পা বাঁধা একটা কাঠের
পিলারের সঙ্গে। নড়াচড়ার কোনও উপায় নেই। কানটা খাড়া করে শুনলাম, আমার পিছনে কয়েকজন
নেপালি আর হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছে।
“বস
বলল, দু’মিনিটের মধ্যে এসে যাবে মূর্তিটা। এখান থেকে
পাহাড় পেরিয়ে সোজা ভুটান চলে যাবি তোরা। ওখান থেকে
বর্ডার পেরিয়ে চিন। আমাদের এজেন্ট ওখান থেকে নেবে জিনিসটা।”
কিছুক্ষণ
চুপচাপ থাকার পর আবার একজন বলল, “এই টিকটিকিটার কী করব?”
“মূর্তিটা
আসা পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেরকমই নির্দেশ আছে। তারপর মেরে জঙ্গলের মধ্যে
খাদে ফেলে দেব।”
লোকগুলো
বেরিয়ে গেল দরজা বন্ধ করে।
আর
একটু আলো বাড়তে দেখলাম, এটা ভাঙাচোরা একটা ঘর। হালকা দিনের আলো ঢুকছে স্কাই লাইট
দিয়ে। এরকম পরিস্থিতিতে আমি আগেও পড়েছি
বহুবার। ফুল হাতা জামার কাফ লিঙ্কের সঙ্গে সর্বদা একটা সরু সার্জিকাল ছুরি থাকে।
কবজির বাঁধন কাটার কাজে লাগে। কিন্তু নাইলনের সরু দড়ি এত টাইট করে বেঁধেছে যে
হাতটা নাড়তেই পারছি না। তবুও অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করলাম। প্রায় অনেকটা কেটে ফেলেছি
তখন, একটা শব্দ কানে এল। বেশ কয়েকজন আসছে এদিকে। জোরে একটা হ্যাঁচকা মারতে ছিঁড়ে গেল
হাতের বাঁধনটা। তারপর তড়িঘড়ি করে পায়ের দড়িটা কেটে একটা ছোট্ট ডিগবাজি দিয়ে চলে
গেলাম দরজার পিছনে।
যেই
মুহূর্তে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতে গেল আমি পা-টা বাড়িয়ে দিলাম। ব্যস, দড়াম করে পড়ল
লোকটা মুখ থুবড়ে। আমিও ক্ষিপ্র চিতার মতো আক্রমণ করলাম। একটা ঘুসি খেয়ে নেপালি লোকটা
চিৎকার করে উঠল। তারপরেই একটা গুলির আওয়াজ পিছন থেকে। আমার জ্যাকেট ফুটো হয়ে
বেরিয়ে গেল কাঁধ ঘেঁষে। গড়িয়ে গেলাম মেঝেতে। আবার
দুটো ফায়ার হল। শুয়ে পড়েছি মেঝেতে। হাতের কাছে একটুকরো কাঠ ছিল পড়ে। তুলে নিয়ে ছুড়ে
দিলাম সেটা। কিন্তু অন্ধকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। আবার গুলি চলল। কিন্তু এটা বেশ
কিছুটা দূরে। জঙ্গলের মধ্যে। পর পর। এদিক থেকেও গুলি চলছে। একজনের আর্তচিৎকার কানে
এল। মনে হচ্ছে দুটো দলের মধ্যে চলছে গুলির লড়াই!
এই
সুযোগে পিঠে ব্যাগ বাঁধা একটা লোক পালাচ্ছিল পিছন দিয়ে।
হঠাৎ কী মনে হল, আমিও ছুটতে শুরু করলাম। ট্রপিকাল
রেন ফরেস্টের ঘন বন। বড়ো বড়ো গাছ উঠে আকাশ ছুঁয়েছে। নিচে বৃষ্টিভেজা স্যাঁতস্যাঁতে
পাতা। বুনো একটা গন্ধ। ব্রাউন রঙের জ্যাকেট গায়ে লোকটা দৌড়চ্ছে গাছের ফাঁক গলে। আমারও
জেদ চেপে গেছে। ওকে ধরেই ছাড়ব। পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে হু হু করে। আমি দৌড়াতে
দৌড়াতে শুধু ডালপালা খামচে ধরে ব্যালেন্স করছি। অনেকটা নিচে চলে গেছে ও। লাফ দিয়ে
একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়লাম উপর থেকে। দুলে গিয়ে শূন্যেই জড়িয়ে ধরলাম লোকটাকে।
তারপর টাল সামলাতে না পেরে দু’জনেই গড়াতে গড়াতে তিরবেগে নামতে শুরু করলাম নিচে।
জঙ্গলের শেষে এগিয়ে আসছে একটা খাদ। তিন থেকে চারশো
ফুট নিচে একটা জলের স্রোত। ওর পিঠের ব্যাগটাকে ধরেছিলাম খামচে। শেষে একটা গাছের
গুঁড়িকে ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে আটকে গেলাম আমি। আর ঐ নেপালি লোকটা ব্যাগটা ছেড়ে
দিয়ে পড়ল অনেক নিচে জলের মধ্যে।
হাঁপাতে
হাঁপাতে বসে পড়লাম। ব্যাগের চেনটা খুলতে বেরোল কাগজে মোড়া একটা মূর্তি। কাগজ সরাতে
ঝলসে গেল চোখ আমার। সোনার তৈরি মণিমুক্তাখচিত মূর্তিটি
সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীর তৈরি দশম বুদ্ধাবতার ‘বজ্রপাণি’।
বিস্ময়ের
ঘোর কাটিয়ে তাকালাম চারপাশে। জঙ্গলটা আমার একেবারেই অচেনা। কোন রাস্তায় ফিরব বুঝে
উঠতে পারছি না কিছুতেই। শেষে ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে হাঁটা শুরু করলাম আন্দাজে। মনে
মনে একটা রাস্তা ঠিক করে নিলাম। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা চলার পর মনে হল আমি রাস্তা
পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। যে কাঠের বাড়িটাতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল আমাকে সেটা
কিছুতেই খুঁজে পেলাম না।
বনের
মধ্যে কী সুন্দর সুন্দর ফুলের বিচিত্র রঙ মুগ্ধ করল আমাকে। চলতে চলতে লক্ষ করলাম, চারদিকে
ছড়িয়ে আছে অগাধ অনাবিল সৌন্দর্য। সূর্য ক্রমশ মাথার উপরে উঠল। তারপর ঢলতে শুরু করল
পশ্চিমে। সেটা লক্ষ করে একটা দিক নির্দিষ্ট রেখে হেঁটে চলেছি। খিদেতে পেট চোঁ চোঁ
করছে। তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে গলা। পা আর চলতে চাইছে না। আর এ চলার যেন কোনও শেষ নেই।
একবার নিচে, একবার উপরে। মাঝে একটা ঝর্না পড়তে আমি জল খেলাম পেট ভরে। কিন্তু তাতে
কিছুক্ষণের মধ্যে খিদে বেড়ে গেল আরও কয়েকগুণ। রক্তিম
সূর্য গাছের মাথার উপর দিয়ে ঢলে পড়ল পাহাড়ের পিছনে। মনে হল, সারাদিন ঘুরছি সেই একই
জায়গায়। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আদিম পৃথিবী।
অন্ধকার
হঠাৎ করে গ্রাস করে নিল গোটা জঙ্গলকে। ভয় পেয়ে গেলাম খুব। কোথায় আমার চেনা জগৎ। আর
কোথায় এই ঘন অরণ্যানীর মধ্যে কালো অন্ধকার। অসংখ্য পাখিদের কিচিরমিচির। ওরা বোধহয়
বিদ্রূপ করছে আমাকে। কেন যে আমি ওদের মতো চিনতে পারছি না নিজের গন্তব্যে ফিরে
যাবার পথ! মাথাটা ঝিম ঝিম করছে।
শেষে
মনে হচ্ছে বেরোতে পারব না এখান থেকে আজীবন। আচমকা খেয়াল হল, একটা মিষ্টি অচেনা
গন্ধ গ্রাস করছে ক্রমশ আমাকে। কী অদ্ভুত তার টান! নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না।
কোথা থেকে যেন আকর্ষণ করছে আমাকে। আমি এগিয়ে
চললাম। লতাপাতা ঠেলে, ডালপালা সরিয়ে, পাহাড় বেয়ে কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে চলল।
অন্ধকারে রাস্তা দেখতে পাওয়ার জন্য ব্যাগ হাতড়ে টর্চ পেয়ে গেলাম একটা। আলোটা
জ্বালতে হাজারো বুনো পোকা ধেয়ে এল আমার দিকে।
আরও
কতক্ষণ চলেছিলাম মনে নেই আমার। শেষপর্যন্ত নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না, মনে আছে
শুধু এটুকু। শেষে অদ্ভুত একটা স্থানে পৌঁছলাম। সাদা সাদা অসংখ্য জোনাকির মতো জ্বলজ্বল
করছিল চারপাশের গুল্ম ফুলগুলি। দু’চোখের পাতা বুজে এল আপনা থেকে।
“এখন
কেমন আছ?”
কথাটা
শুনে চোখ খুললাম। মাথায় একটা স্নেহাতুর হাতের ছোঁয়া।
“কোথায়
আমি?”
“এটা
ভুটান-লাগোয়া একটা বৌদ্ধ গুম্ফা। তুমি কি জানো আমাদের কী উপকার করেছ? আজকে ফিরিয়ে
দিয়েছ আমাদের হারিয়ে যাওয়া দেবতাকে। তুমি আমাদের কাছে দেবদূত।”
অবাক
হয়ে চেয়ে রইলাম। হাসি মুখে লামাজী আবার বললেন, “কাল রাতে আমি পশ্চিমের জঙ্গলে একটা
টর্চের আলো দেখে অবাক হয়েছিলাম। ঐ বনে আমরা যাই না কেউ। ওখানে বিষাক্ত কিছু
মাংসাশী গাছেদের বাস। কালকে ছিল ওদের ফুল ফোটার দিন। কোনও জীবিত প্রাণী যদি সেই
ফুল ছোঁয় তৎক্ষণাৎ মৃত্যু। তবুও মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষা করা আমাদের প্রধান ধর্ম। তোমার
এলোমেলো টর্চের আলোয় মনে হয়েছিল রাস্তা ভুল করেছ। তাই
গিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম তুমি আমাদের জন্য হাজার
বছরের পুরোনো স্মৃতি নিয়ে আসছ সঙ্গে! তবে আর কিছুক্ষণ থাকলে তোমারও মৃত্যু
অনিবার্য ছিল।”
বললাম,
“তার মানে সোনার মূর্তিটা এই গুম্ফার?”
“হ্যাঁ,
সেরকমই লেখা আছে আমাদের পুরোনো পুঁথিতে। তবে সেই সময়ে হয়তো এই গুম্ফার কোনও
অস্তিত্ব ছিল না। একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ভগবান বজ্রপাণির সোনার মূর্তিটি নিয়ে
যাচ্ছিলেন সুমাত্রার রাজাকে উপহার দেওয়ার জন্য।
পথে হারিয়ে যায় সেটা।”
“এই
কথাটা আমাকে গৌরাঙ্গবাবুও বলেছিলেন বটে। কিন্তু আপনি
কে? আমার সঙ্গে কথা বলছেন পরিষ্কার বাংলায় অথচ পরনে লামাদের পোশাক।”
“কেন,
বাঙালীরা বৌদ্ধ ভিক্ষু হতে পারে না? আমার জন্ম তমলুকের কাছে রঘুনাথপুর গ্রামে।
গৌরাঙ্গকে আমিই বলেছিলাম ইতিহাসটা। গতবছর দিল্লীতে বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলনে দেখা
হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। অবশ্য পরিচয়টা অনেক পুরোনো।”
আমি
একটু চমকে উঠে বসলাম। “আপনি... আপনার নাম কি শৈল্য? মানে
শৈবাল গড়াই?”
কিছুক্ষণ
চুপ করে থেকে তিনি মাথা নাড়লেন। “তুমি তো অনেক কিছুই জানো দেখছি!”
“তাহলে
ঐ বিষাক্ত গাছের প্রভাবে যে তিনজন মারা গেছেন সেগুলি...”
“সত্যি
বলতে কী, সেটা আমারই দোষ। আসলে আমার ছোটোবেলার স্মৃতি যথেষ্টই বেদনাদায়ক। বাবাকে
চোখের সামনে মরতে দেখেছি। মাও কষ্ট সহ্য করতে না পেরে চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে।
অনাহারে ঘুরে বেড়িয়েছি পথে পথে। আমার বন্ধু বলরামের বাবার জেল হয়েছিল মিথ্যা
ডাকাতির অভিযোগে। তখন খুব রাগ হত, জানো। মনে হত
সুযোগ পেলে ওদের সবাইকে শেষ করে দেব। কিন্তু জীবন বড়োই অদ্ভুত। এক বৌদ্ধ ভিক্ষু
আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসে সিকিমে। মঠে শুরু হয়
নতুন জীবন। শিখেছি, ক্ষমাই পরম ধর্ম। ছোটোবেলার কথা ক্রমশ ভুলে গেলাম তারপর।
“বছর
পাঁচেক আগের কথা। রুমটেক গুম্ফায় গিয়েছিলাম বিশেষ এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তখন
গ্যাংটকে হঠাৎ বলরামের সঙ্গে দেখা। একটা মাড়োয়ারি হোটেলে ও বেয়ারার কাজ করছে। আমিই
চিনতে পেরেছিলাম প্রথমে। আনন্দে জড়িয়ে ধরল আমাকে। দেখলাম, ও পুরোনো কথা কিছুই
ভোলেনি। প্রতিহিংসার আগুন এখনও জ্বালিয়ে রেখেছে মনের মধ্যে। ওকে বোঝালাম অনেক করে।
আমার সঙ্গে নিয়ে এলাম এই গুম্ফায়। ছিল বেশ কয়েক মাস। ভাবলাম, আমার মতো ওরও মনের
পরিবর্তন হবে। সেই সময়ে এক রাতে ঐ জ্বলন্ত সাদা ফুলের বন দেখে প্রশ্ন করতে আমিও
সরল মনে উত্তর দিলাম। এর দুয়েকদিন পরেই বলা কাউকে কিছু না বলে চলে গেল।”
“তারপর
আপনি ওকে খুঁজতে গিয়েছিলেন কলকাতায়?”
“না,
ওকে খুঁজতে নয়। আমি ঐ মূর্তিটির টানেই গিয়েছিলাম। প্রথমে রঘুনাথপুরে গিয়ে দেখা
করলাম। বললাম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি পুরোনো কথা মনে রাখতে চাই না। বৌদ্ধ ধর্মের
পবিত্র মূর্তি ওটা। আমাদের তিব্বতি এক ধর্মগুরু নিজে হাতে বানিয়েছিলেন বহুযুগ আগে।
ফিরে পেলে পুনরায় এই মঠে পূজিত হবেন ভগবান। হরেন জানাল,
জিনিসটা এখন আছে মনোজের বাড়িতে। ওর কাছে
গিয়ে প্রস্তাবটা দিতে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেল। আসলে দু’জনেই মনে হয় ছোটোবেলার খারাপ
স্মৃতিগুলি মুছে ফেলতে চাইছিল। মনোজ বলল, মূর্তিটা ব্যাঙ্ক থেকে এনে রাখবে।
তারপরেই শুনলাম, ও মারা গেছে বিষাক্ত গাছের ছোঁয়ায়। কিছুদিন পরে হরেনও মারা গেল
একইভাবে। তখন বুঝলাম, বলা প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
একজন
অল্পবয়সী সন্ন্যাসী এসে কানে কানে কী বলে গেল ওঁকে। তিনি
প্রত্যুত্তরে মাথা নেড়ে কিছু বলে আমার দিকে তাকালেন। “চলুন, আপনাকে নেওয়ার জন্য
পুলিশ এসেছে। আসলে আমিই খবর পাঠিয়ে ছিলাম সকালে।”
সিঁড়ি
দিয়ে নেমে নিচে এসে দেখি সিকিম পুলিশের সেই দলে লালবাজারের ডি.সি. রণজিৎ গাঙ্গুলির
সঙ্গে তানিয়াও রয়েছে। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরল আনন্দে। “তোকে বলেছিলাম সাবধানে
থাকতে।”
আমি
হেসে বললাম, “এখনও পর্যন্ত সেজন্যই বেঁচে আছি রে!”
“অরিন্দমবাবু
ধরা পড়েছেন পুলিশের হাতে। দু’দলের গ্যাং ওয়ারে গুলি লেগেছে হাতে। খুব জোর প্রাণে
বেঁচে গিয়েছেন।”
আমি
হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “একটা দল অরিন্দমবাবুর সেটা তো জানি। দ্বিতীয় দলটা কার?”
“গৌরাঙ্গ
সমাদ্দারের। আর্কিওলজিতে কাজ করতেন ভদ্রলোক। পুরাতাত্ত্বিক
বিষয়ে অগাধ জ্ঞান। চাকরি ছাড়ার পর থেকে এইসব জিনিসেরই ব্যাবসা শুরু করেছিলেন।
ঐতিহাসিক বস্তু বিক্রি করতেন বিদেশিদের কাছে। ঐ মূর্তির লোভেই এসেছিলেন এখানে।”
আমি
অবাক গলায় বললাম, “তিনি তো হরেন আর মনোজবাবুর বন্ধু ছিলেন!”
“জানি
তো। তিন নম্বর টার্গেট।”
“তাহলে
মূর্তিটা কে চুরি করল?”
“রমেনবাবু।
আবার তিনিই বিষাক্ত গাছ নিয়ে গিয়ে রাখেন মনোজবাবুর ঘরে। হরেনবাবুকেও তিনিই দিয়ে
এসেছিলেন লামা সেজে। কৈলাসের বাড়িতেও তিনি ভাড়া ছিলেন
চেহারা পালটে।”
“রমেনবাবু!
মানে ওদের কাজের লোক? তার সঙ্গে তো পরশু রাতেও আমার কথা হয়েছে আরিটারে।”
তানিয়া
বলল, “হ্যাঁ, সেকথাও বলে গেছেন তিনি মারা যাবার আগে।”
আবার
হোঁচট খেলাম। “তিনি মারা গেছেন? কে মারল তাঁকে?”
“আত্মহত্যা
করেছেন। সেই বিষাক্ত গাছের ফুলের ছোঁয়ায় কাল
রাতে হোটেলের ঘরে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। তার আগে
ফোনে রেকর্ডিং করেছিলেন নিজের বক্তব্য। এই যে শোন।”
জ্যাকেটের
পকেট থেকে ফোনটা বের করে ভয়েস রেকর্ডটা চালিয়ে দিল তানিয়া।
‘আমি
বলরাম দাস বলছি। চরম গ্লানি বয়ে বেড়িয়েছি সারা জীবন। আমার বাবা নাকি ছিল এক ডাকাত। দু’মুঠো
খাবারের জন্য মা আর ছোটোবোনকে মারা যেতে দেখেছি চোখের সামনে। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,
যদি সুযোগ পাই এ জন্মে বদলা ঠিক নেব। বহু বছর পর হঠাৎ গ্যাংটকে শৈল্যর সঙ্গে দেখা
হতে ওকে বললাম মনের কথা। অবশ্য দেখলাম, ওর জীবনের প্রতি আর কোনও অভিযোগ নেই।
কিন্তু নিজের অজান্তে আমার হাতে তুলে দিল একটি সাংঘাতিক মারণাস্ত্র। একটি ছোটো
গাছের শরীরে এত বিষ থাকে যে এক ছোঁয়াতেই মেরে ফেলতে পারে জলজ্যান্ত মানুষ। নিজের
চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। তবে আসল জায়গায় প্রয়োগের আগে এর ক্ষমতা যাচাই
করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অহেতুক কারও প্রাণ নেওয়ার আমি পক্ষপাতী নই। মনে পড়ল
বিষ্ণু পাওয়ারের কথা। এক সময়ে দীর্ঘ দিন কাজ করেছি ওঁদের বিভিন্ন হোটেলে। লোকটা
একটা চামার। টাকার জন্য মানুষকে দিয়ে কত নোংরা খারাপ কাজ করাত। অসহায় গরীব
ছেলেমেয়েদের পাচার করত বিদেশে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কৈলাস নামে একটি ছেলে ওদের অফিসে
কাজ করে। তাকেও অনেকদিন ধরে ঠকিয়ে চলেছে। আর
সেই জন্য লোকটিকে প্রাণে মারতেও ছেলেটি পিছপা হবে না। কৈলাসের হাত দিয়েই পাঠালাম
প্রথম মৃত্যুবাণ। অব্যর্থভাবে কাজ করল বটে, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। মারা গেল ওর
ছেলে। ভাবলাম, এও বিধাতার একরকম বিচার। ওর জন্য কত পরিবার কষ্ট পেয়েছে। এখন বুঝুক
পুত্রশোক কেমন হয়। পরিকল্পনামাফিক বছর তিনেক কাজ করেছি
সরকারদের বাড়িতে। সেদিন আড়াল থেকে শৈল্যকে দেখে আর ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হল,
মনু যদি ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে দেয় মূর্তিটা তাহলে হয়তো ওকে প্রাণে মারার প্রয়োজনীয়তা
আর থাকবে না। কিন্তু না, আমি ভুল ভাবছিলাম। মূর্তিটা মনু বাড়িতে নিয়ে এল ঠিকই। তবে
সেটা শৈল্যকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। সেটা বিক্রি করে টাকাটা শেষপর্যন্ত ভাইকেই
দেবে ঠিক করল। আমাকে বলেছিল সেই কথা। তখন বুঝলাম, হাতে সময় আর বেশি নেই। যা করার
এবারে করে ফেলতে হবে। মূর্তিটা সরিয়ে ফেললাম প্রথমে। তারপর মনোজ আর হরেন, দু’জনের
কাছেই নির্দিষ্ট দিনে পাঠালাম বিষাক্ত গাছটি। ঐ গাছের ফুল ফোটার রাতে ওর শরীরে
বিষের মাত্রা থাকে সর্বাধিক। অদ্ভুত সুন্দর এক সুবাস আকর্ষণ করে মানুষকে। ফসফরাসযুক্ত
সাদা ফুলটির গায়ে থাকে একরকম রোঁয়া যেটা হাতে লাগলেই সাংঘাতিক নিউরোটক্সিনের
প্রভাবে কোনও রক্তক্ষরণ ছাড়াই শেষ হয়ে যায় জীবন।
মনোজ আর হরেনের পর বাকি রইল আর একজন। যে সব কিছু জানত। অথচ প্রতিবাদ করেনি। অন্যায়
যে করে, আর যে সবকিছু জেনে চুপ করে থেকে তাদের প্রশ্রয় দেয়, দু’জনেই সমান দোষী।
ওদের তিন নম্বর বন্ধু গৌরাঙ্গ সমাদ্দার। সে আবার এখন অ্যান্টিক জিনিস বিদেশে
চোরাচালান করছে। মূর্তিটির লোভ দেখিয়ে তাকে সহজেই টেনে আনলাম আরিটারে। এখানেই তার
ভবলীলা সাঙ্গ হবে বিষাক্ত গাছের ছোঁয়ায়। আর শৈল্যকে ফিরিয়ে দেব তাদের দেবতা। কিন্তু
অরিন্দম এসে পড়ে গুলিয়ে দিল হিসেবটা। ও চাইছিল মূর্তিটা নিজের দখলে রাখতে। গতরাতেই
আমাকে মেরে ফেলত। অভিজিৎ না আমাকে বাঁচালে এই সত্য জানতে পারত না কেউ। আজ রাতে
আমার সঙ্গে গৌরাঙ্গও চলে যাবে পরলোকে। তার হোটেলের ঘরেও পৌঁছে দিয়েছি একটা টবসমেত
গাছ। আহা, কী শান্তি! আমার সামনে এখন ছোট্ট টবে জ্বলজ্বল করছে গাছটির সাদা ফুলগুলি।
মাদকতা মেশানো সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে। এবার আঙুলগুলি বাড়িয়ে দিই...’
কিছুক্ষণ
নিস্তব্ধতার পর একটা গোঙানির আওয়াজ। তারপর আবার শান্ত।
ফোনটা
বন্ধ করে প্রশ্ন করলাম, “গৌরাঙ্গবাবুও কি মারা গেছেন?”
“না।”
উত্তরটা দিলেন গাঙ্গুলিদা। “তানিয়ার উপস্থিত বুদ্ধিতে শেষমুহূর্তে বাঁচানো গেছে
ওঁকে। তিনি এখন পুলিশ কাস্টডিতে।”
আমি
হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “ভালো। বিনা বিচারে কারও প্রাণ নেওয়া উচিত নয়।”
“সে
তো বটেই। তবে প্রথম থেকে পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার হয়নি। একটু বুঝিয়ে
বলো তো ভাই।”
গাঙ্গুলিদাকে
বোঝানোর জন্য তানিয়া আরেকবার শুরু করল গোড়া থেকে।
“মেদিনীপুরের তমলুক শহরের কাছে রঘুনাথপুর গ্রামে থাকতেন অবস্থাপন্ন ঘরের তিন
বন্ধু। মনোজ, হরেন আর গৌরাঙ্গ। স্কুলে এঁদের ক্লাসেই পড়াশোনা করত আরও দুই ছেলে।
নাম শৈবাল আর বলরাম। পড়াশোনায় ভালো হলেও নিচু জাতের জন্য বাকিরা এঁদের বাঁকা চোখে
দেখত। প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। গ্রামের প্রান্তে একটা মন্দির ছিল বহু পুরোনো।
সেখান থেকে কাকতালীয়ভাবে শৈল্য আর বলা উদ্ধার করে একটি বহু মূল্যবান মূর্তি। বৌদ্ধ
ধর্মে ইনি হলেন শক্তির দেবতা, বজ্রপাণি। অর্থাৎ যাঁর এক হাতে থাকে বজ্র।
“এরপর
সেই মূর্তিটি নিয়েই গণ্ডগোল বাধে এবং শৈল্যবাবুর বাবাকে হরেনবাবুর বাবা প্রাণকেষ্ট
চক্রবর্তী গুলি করে হত্যা করেন। আর গ্রামে রটিয়ে দেন ওরা ডাকাতি করতে এসেছিল।
বলরামবাবুর বাবার জেল হয়। সেখানেই মারা যান তিনি। এরপর দুটো পরিবারই তছনছ হয়ে যায়।
শৈল্যবাবুর ভাগ্য ভালো ছিল তাই এক সন্ন্যাসীর হাত ধরে চলে আসেন এখানে। শুরু হয়
নতুন জীবন। কিন্তু বলরামবাবু সারা জীবন ধাক্কা খেতে খেতে শেষ হয়ে যান। যত কষ্ট আসে
জীবনে, তত রাগ বাড়তে থাকে। যারা এর জন্য দায়ী, সেই ছোটোবেলার বন্ধুদেরই মারার জন্য
তৈরি করেন নতুন ধরনের এক মৃত্যুবাণ। এটা বিশেষ ধরনের অর্কিড। যদিও সেই বিষাক্ত
গাছের সন্ধান যিনি দিয়েছিলেন, মানে শৈল্যবাবু এসব কিছুই জানতেন না।”
আমি
বললাম, “নাম পালটে ডঃ মনোজ সরকারের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন। প্রথম এই অর্কিডের
ছোবলে মারা যায় রাহুল পাওয়ার। যদিও টার্গেট ছিলেন বিষ্ণু পাওয়ার। তারপর ডঃ সরকার
মূর্তিটি লামাজীকে দেবে বলে কথা দিয়েও শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন ভাইয়ের হাতেই তুলে
দেবেন জিনিসটা। ঠিক সেই সময়েই ডাক্তারবাবু বিষাক্ত অর্কিডের ছোবলে মারা যান।
মূর্তিটা সরিয়ে ফেলেন বলরামবাবু। এদিকে সেন্টের শিশিতে বিষ মিশিয়ে ওঁকে মেরে ফেলার
পরিকল্পনা আগেই করেছিলেন ওঁর ছোটো ভাই অরিন্দম সরকার। সেটা যদিও কাজে লাগেনি।
এরপরের শিকার হরেন চক্রবর্তী। শেষে টার্গেট ছিলেন গৌরাঙ্গ সমাদ্দার। এঁকে মারার
জন্য পুরনো দামী মূর্তির টোপ দিয়ে বলরামবাবু আরিটারে ডেকে আনেন।
এদিকে অরিন্দমবাবুও মূর্তিটি উদ্ধার করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন। কারণ, নতুন
হসপিটাল তৈরি করতে গিয়ে প্রচুর টাকা ধার করতে হয়েছিল বাজার থেকে। যদি মূর্তিটা
বিদেশে পাচার করা যেত তাহলে অনেকটা সুরাহা হত। সেই সময়ে এক বন্ধুর মাধ্যমে দিল্লীর
অ্যান্টিক জিনিসের এক দালালের কাছ থেকে খবর পান মূর্তিটা আরিটারে আসছে। তারপরেই
কিছু গুণ্ডা ভাড়া করে নিয়ে আসেন এখানে। খবর সম্ভবত গৌরাঙ্গবাবুর কাছ থেকে লিক হয়েছিল।
এই লাইনের পুরোনো লোক উনি। আগে কাজ
করতেন পুরাতত্ত্ব বিভাগে। স্থানীয় অ্যান্টি-সোশ্যালদের সঙ্গে রেখেছিলেন। যদি কোনও
গণ্ডগোল হয়, তাহলে তারাই সামলে দেবে এই ভেবে। এরপর পরশু রাতে মূর্তিটাকে নিয়ে দু’দলের
মধ্যে শুরু হয় গ্যাং ওয়ার।”
আমি
থামতে তানিয়া বলল, “তবে অভিজিৎ এদের মধ্যে নাক গলিয়ে সব হিসাব গুলিয়ে দেয়।”
গাঙ্গুলিদা
মুখ দিয়ে কিছুটা ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “আচ্ছা, এবার অনেকটা পরিষ্কার হল। তবে একটা
জিনিস খেয়াল করো, এরা সবাই ছোটোবেলার বন্ধু। আশ্চর্য বিষয় হল, বলরামকে শৈল্যবাবু
এত বছর পরে গ্যাংটকে একবার দেখেই চিনতে পারলেন। কিন্তু ডঃ সরকারের কাছে তিন বছর
কাজ করল লোকটা, তিনি বুঝতেও পারলেন না!”
তানিয়া
মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে বলল, “আমাদের মস্তিস্ক ভারি অদ্ভুত জিনিস, স্যার! কোনও স্মৃতি যদি
আমরা মনে রাখতে চাই, তাহলে হয়তো সেটা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত থেকে যায়। আর যদি ভুলতে
চাই কোনও খারাপ স্মৃতি, তবে সেটা হারিয়ে যায় বছর ঘোরার আগেই।”
শৈবাল
লামা হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, “ভগবান ফিরে এসেছেন। আজ আমাদের মঠে উৎসব হবে। আপনারা
প্রসাদ নিয়ে তবেই যাত্রা করবেন।”
দূরে
পাহাড়চূড়ার মাথায় মেঘের আস্তরণ সরে যেতে ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝলমল করে উঠল পৃথিবীর
তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমরা
বিস্ময়ভরা আনন্দে তাকিয়ে রইলাম সেইদিকে। মনে হল, ভগবান ‘বজ্রপাণি’ দু’হাত তুলে
আশীর্বাদ করছেন আমাদের।
_____
অলঙ্করণঃ
পুষ্পেন মণ্ডল
Darrruuunnn...
ReplyDelete