টালিসমেন
সুস্মিতা কুণ্ডু
(১)
ক’দিন ধরেই লাল টয়োটা
ক্যামরিটা পার্কিং লটে দেখছে অ্যাবিগেইল। বেশ অনেকদিনই জায়গাটা খালি ছিল। হলুদ রঙের কালি দিয়ে লেখা ৩১৩ নম্বরটা দেখা যেত কংক্রিটের কালচে
রুক্ষ মেঝেটায়। দু’দিকে হলুদ রঙের মোটা দুটো লাইন টেনে সীমা নির্দেশ করা। অ্যাবির
হোণ্ডা সিটিটা থাকে ঠিক ওর উল্টোদিকে ২১৩ নম্বর স্লটটায়।
যাদের দুটো করে গাড়ি আছে, একটা এই বেসমেন্টের পার্কিং লটে রাখা থাকে, আরেকটা
বাইরের খোলা জায়গায় বানানো পার্কিং লটে থাকে। অনেকেই চায় ভেতরে জায়গা থাকলে সেখানে রাখতে। এরকম অবস্থায় এতদিন যে
কেন খালি পড়েছিল জায়গাটা সেটাই আশ্চর্য। লাল গাড়িটা আগে বাইরে রাখা থাকতে দেখেছে
কিনা ঠিক মনে করতে পারল না।
প্রায় ছ’মাস হল এই নতুন
ব্লুমন্ড অ্যাপার্টমেন্টটায় শিফট করেছে অ্যাবি। বেশ ভালোই জায়গাটা, যদিও ভাড়াটা
একটু বেশি আগের অ্যাপার্টমেন্টটার তুলনায়। খুব ভালো হয় যদি একটা রুমমেট পাওয়া যায়।
কিন্তু এত ব্যস্ত থাকে যে, রুমমেটের সন্ধান আর করা হয়নি। রিসার্চের কাজে
অস্বাভাবিকরকমের চাপ যাচ্ছে। তার ওপর টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজও করতে হয়। সব
মিলিয়ে দম ফেলার ফুরসত থাকে না। এই কমিউনিটির ম্যানেজমেন্ট অফিসে অনেকদিন আগেই বলে
রেখেছে, সেরকম কেউ যদি রুম শেয়ার করে থাকতে ইচ্ছুক মেয়ে আসে যেন অ্যাবিগেইলকে মেইল
করে দেয় ওরা। কিন্তু এখনও কোনও খবর দিল না। ক্রেইগলিস্টে একটা অ্যাডভার্টাইজমেন্ট
দিয়েছিল এখানে আসার কিছুদিন পরেই, সেও প্রায় মাস পাঁচেক হয়ে গেল, কোনও রেসপন্স
আসেনি।
গাড়িটা রিভার্স করতে
গেল অ্যাবি গ্যারাজ থেকে বার করার জন্য। রিয়ার ভিউ মিররে উলটোদিকের গাড়িটায় ফের
চোখ গেল। এক মুহূর্তের জন্য শিউরে উঠল। ঐ গাড়িটার রিয়ার ভিউ মিররে একজোড়া চোখ।
তীব্র জিঘাংসা নিয়ে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। তড়িঘড়ি গাড়িটা ঘুরিয়ে অটোমেটিক গ্যারাজ
ডোরটা খুলতে না খুলতেই জোরে চালিয়ে বেরিয়ে গেল। একপলক শুধু দেখল, একটা কালো রঙের পোশাক পরা কেউ গাড়িটার স্টিয়ারিংয়ের
পেছনে বসেছিল। মাথাতেও কালো টুপি বা হুড জাতীয় কিছু ছিল, তাই মিররে শুধু জ্বলজ্বলে
চোখদুটো ছাড়া সব অন্ধকার লাগছিল। মুখেও মনে হয় মাস্ক ছিল নাকি কে জানে।
(২)
আজ ইউনিভার্সিটিতে কোনও
কাজেই মন বসল না। বারবার সকালের অদ্ভুত কাণ্ডটা মনে আসছে। হয়তো এমন হতে পারে, ওই
গাড়ির লোকটা গাড়ি বার করার জন্যই উঠে বসেছিল গাড়িতে। হয়তো অ্যাবি বেরোনোর পরেই
বেরিয়েছে। অনেক কিছু যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করে ও। কিন্তু বারবার ওই দৃষ্টিটা মনে
ভেসে উঠলেই যুক্তিগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, কেনই বা কেউ অচেনা কারোর দিকে
ওভাবে তাকাবে?
সারা দিনটা লাইব্রেরিতে
টুকটাক বই পড়েই কাটিয়ে দিল। ক’দিন পর মিউজিয়ামে একটা বড়ো এগজিবিশন আছে। মাস তিনেক ধরে
প্রস্তুতি চলছে তার। রিসার্চ এবং টি.এ.-র কাজ ছাড়াও আরেকটা কাজ করে ও উইকএন্ডে। ডাউনটাউনে একটা মিউজিয়াম আছে। খুব বড়ো নয় আবার নেহাতই ছোটো নয়।
ওখানে ও টাকার প্রয়োজনে কাজ করে না, করে নিজের আনন্দের জন্য। মিউজিয়াম ব্যাপারটা
বেশিরভাগ মানুষের কাছে বোরিং হলেও অ্যাবির মতো ইতিহাসের ছাত্রীর কাছে ভীষণই
ইন্টারেস্টিং। ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটারে বসে বিভিন্ন আর্টিফ্যাক্টগুলো নিয়ে
পড়াশোনা করে। তাদের বৈশিষ্ট্য, কোন যুগের জিনিস, ঐতিহাসিক গুরুত্ব এসব সম্পর্কে
নোটস লিখে কিউরেটর মিঃ রিচার্ড বেনসনের কাছে জমা দেয়। উনি সেগুলো মিউজিয়ামের
অনলাইন রেকর্ডে তুলে রাখেন।
আরেকটা কাজও অ্যাবি
করে, মানে শিখতে শুরু করেছে সবে, অথেন্টিকেশন। সংগ্রহে থাকা বা উত্তরাধিকারসূত্রে
প্রাপ্ত বিভিন্ন পারিবারিক অ্যান্টিক জিনিস অনেকেই মিউজিয়ামে দেয়, কেউ বিক্রিও
করতে চায়। এই জিনিসগুলোর সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য বিশেষ পড়াশোনার দরকার হয় -
ট্রেনিং, প্র্যাকটিস সবই লাগে। কিছু ডিগ্রিও লাগে। ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় খুব শিগগিরই
থিসিস সাবমিট করতে চলেছে অ্যাবিগেইল। কাজেই
ডিগ্রি ওর এমনিই আছে, কিন্তু শুধু পুঁথিগত বিদ্যা সম্বল করে এ-কাজ করা যায় না।
আলাদা প্যাশন লাগে, ভালোবাসা লাগে। মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের নিজস্ব লোক আছে যাঁরা
অথেন্টিকেশনের কাজটা করে দেন। তাঁদেরই একজন ছিলেন মিস লিডিয়া। উনি বেশ হাতে ধরে
যত্ন করে সব শেখাতে শুরু করেছিলেন অ্যাবিকে। ষাটোর্দ্ধ বয়স্কা একাকী মহিলা,
অ্যাবির নতুন অ্যাপার্টমেন্ট যে কমিউনিটিতে উনিও সেখানেই থাকতেন।
এটাও আরেকটা কারণ ছিল
অ্যাবির বেশি টাকা দিয়ে হলেও এই কমিউনিটিতে শিফট করার। ইউনিভার্সিটির কাজ সেরে
অনেকদিনই ও যেত মিস লিডিয়ার বাড়ি আড্ডা মারতে। ওঁর হাতে বানানো কুকি আর অ্যাপল পাই
খেতে খেতে কফির মাগে চুমুক দিয়ে হাজারো গল্প শুনত অ্যাবি। কিন্তু মাসখানেক আগে মিস লিডিয়া
হঠাৎই...
অ্যাবির যা রোজগার তাতে
একটু বেশি ভাড়া দিতে ওর কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু সমস্যাটা হয় অন্যখানে।
ওর আসলে অ্যান্টিক জিনিস কেনার ভীষণ শখ। একটা কিউরিও শপের খোঁজ কেউ দিলে হয়েছে
একবার, সঙ্গে সঙ্গে ছুটবে সেখানে। আর নিজের পকেটের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে রাজ্যের
জিনিস কিনে আনবে। ওর লিভিং রুমে ডাঁই করা রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাব-অরিজনালদের
ট্রাইবাল অ্যান্টিক বুমেরাং, ইণ্ডিয়ানদের অষ্টধাতুর নটরাজ মূর্তি, ইজিপ্টের
শেয়ালদেবতা, আনুবিসের প্রস্তরমূর্তি, চাইনিজ জেড পাথরের বুদ্ধমূর্তি, ফ্রেঞ্চ
স্যান্ডেলিয়র, এল্ম কাঠের তৈরি জাপানিজ তান্সু, আফ্রিকান ভু-ডু পুতুল, ভেনেজিয়ান
মাস্ক, আরও আরও কত কী!
(৩)
দিনের শুরুটা খুব একটা
স্বস্তিকর না হলেও ধীরে ধীরে সকালের ঘটনাটা ভুলতে বসেছিল অ্যাবি। কিন্তু বিকেলে
গ্যারেজে গাড়িটা ঢোকাতে গিয়ে ফের গা’টা ছমছম করে উঠল। নাহ্, লাল ক্যামরিটা নেই ৩১৩-তে।
ঝটপট ব্যাকপ্যাকটা পাশের সিট থেকে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে স্যুইচ টিপে গাড়িটা রিমোট-লক
করে লিফটের দিকে পা বাড়াল। নিজের
ফ্ল্যাটে ঢুকতে যেন খানিকটা শান্ত হল মনটা। হঠাৎ লক্ষ করল, ওর দরজার তলা দিয়ে কে
যেন সাদা একটা কাগজ গলিয়ে দিয়ে গেছে। খামের মুখটা ছিঁড়ে কাগজটা বার করল। তাতে লেখা
– ‘টালিসমেন-টা তার ন্যায্য উত্তরাধিকারীকে অবিলম্বে ফেরৎ না দেওয়ার শাস্তি
মৃত্যু।’
লাল গাঢ় রঙে লেখা
চিঠিটা, ইন ফ্যাক্ট কেমন যেন শুকনো রক্তের মতো কালচে লাল রঙটা। অ্যাবি হাত থেকে
ফেলে দিল চিঠিটা। সোফাটায় বসে হাঁপাতে লাগল খানিকটা। কে এইধরনের রসিকতা করছে ওর সঙ্গে, কেনই বা করছে?
শাওয়ার কিউবিকলে ঢুকে
মাথার ওপর ঠাণ্ডা জলের ফোয়ারা চালাল অ্যাবি। কেমন যেন অসুস্থ লাগছে। কী, হচ্ছেটা
কী ওর সঙ্গে! পুলিশে জানাবে, নাকি প্রপার্টি ম্যানেজারকে বলবে? কারণ, এই
অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ভেতরে অবাধে যে কেউ ঢুকতে পারে না, হয় চাবি লাগে অথবা
ফ্ল্যাটের কারোর সঙ্গে দেখা করতে হলে সেই ফ্ল্যাট নম্বরের লাগোয়া স্যুইচ টিপে রিং
করতে হয়। কেউ খুললে তবেই বাইরের লোক ঢুকতে পারবে। এমনকি মেলম্যানকেও বড়ো কিছু
ডেলিভারি সহ ভেতরে আসতে গেলে একই নিয়মে আসতে হয়, অথবা বাইরের পোস্ট বক্সে চিঠিচাপাটি
ফেলতে হয়। এই চিঠিটা দরজার তলা দিয়ে কে দিল তবে?
হঠাৎ করে শিরদাঁড়া দিয়ে
একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় অ্যাবির। ৩১৩ নম্বর ঘরটা ঠিক ওর মাথার ওপরে। সেই
ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ওই প্রতিহিংসাপরায়ণ চোখদুটোর মালিকেরই কাজ নয় তো?
নাইটগাউনটা গায়ে গলিয়ে
অ্যাবি লিভিং রুমে ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারগুলো হাঁটকাতে শুরু করে।
এই তো! এই তো সেটা।
কাঠের কারুকার্য করা
বক্সটা ড্রয়ার থেকে তুলে আনে অ্যাবি। আলতো হাতে ঢাকনাটা খোলে। ভেতরে ভেলভেটে মোড়া
প্রকোষ্ঠটায় একটা গোলাকৃতি কালচে পাথরের টুকরো। তার চারপাশটা সেই আদি অকৃত্রিম
বহুমূল্য সোনালি ধাতুতে বাঁধানো এবং বিভিন্ন রঙয়ের ঝলমলে প্রস্তরখণ্ড-খচিত। মাঝে
একটা ছাপ, হ্যাঁ ছাপই, যেটা ঐ ধাতুতে খাঁজ কেটে বানানো একটা পেন্টাক্যল। একটা সুষম
বৃত্তের ভেতর আবদ্ধ একটা পঞ্চমুখী তারা, যার প্রতিটা শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে আছে
বৃত্তের পরিধিকে, সমান সমান দূরত্বে।
(৪)
চিঠিটায় কি এরই কথা
লেখা? হ্যাঁ, এটা একটা টালিসমেন, যেটা প্রায় মাস ছয়েক আগে কিনেছিল ও এই নতুন
অ্যাপার্টমেন্টে শিফট করার পরে পরেই। কথায় কথায় একটা নতুন কিউরিও শপের সন্ধান
দিয়েছিলেন ওকে মিস লিডিয়া। কথায়
কথায় একদিন উনিই বলেছিলেন, “ওহ্ অ্যাবি, ইউ মাস্ট ভিজিট দ্য কিউরিও শপ ইন রোজউড
স্ট্রিট, ইন ডাউনটাউন। ইট হ্যাজ গট আ ফ্যাবিউলাস কালেকশন। সাম অফ দেম আর জাস্ট
এক্স্যাক্ট রেপ্লিকা অফ দ্য ওরিজিনাল ওয়ানস।”
শোনামাত্র আর দেরি
করেনি অ্যাবি। পরেরদিন বিকেলেই ছুটেছিল দোকানটায়। একবিন্দুও বাড়িয়ে বলেননি মিস
অ্যান। দোকানটা অ্যান্টিকের খনি। দোকানের মালিক মিঃ লি কিয়াং অ্যাবি ইতিহাসের
ছাত্রী শুনে বেশ আগ্রহভরে ওকে অনেক আইটেম দেখালেন। মিং ভাস থেকে শুরু করে, সিল অফ সলোমন,
ইজিপ্সিয়ন স্ক্যারাব, আরও কত কী!
অ্যাবির আগ্রহ দেখে মিঃ
কিয়াং ওকে বললেন, “ওয়েট ইয়ং লেডি, তোমার মতো কাস্টমার রোজ রোজ আসে না। আই হ্যাভ
দ্য পারফেক্ট থিং ফর ইউ।”
ছোট্ট একটা দরজার
ক্রিস্টাল বিডেড কার্টেনের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল মিঃ কিয়াং এর শরীরটা। কিছুক্ষণ পর
হাতে একটা সুদৃশ্য কাঠের বক্স নিয়ে ফের দোকানের ভেতর এলেন উনি। “দিস ইজ আ
ভেরি পাওয়ারফুল টালিসমেন। টালিসমেন কী জানো তো?”
“অফ কোর্স জানি। পাথর
বা ধাতু দিয়ে গড়া ম্যাজিকাল অবজেক্ট। যেটা পরলে নাকি সৌভাগ্য আসে। লাকি চার্ম, আর
কিছুই না।” উত্তর দিয়েছিল অ্যাবি।
একটু হেসে বলেন মিঃ
কিয়াং, “আরবিক শব্দ ‘টালসাম’ (talsam) থেকে এসেছে টালিসমেন (talismen) কথাটি। গ্রিক
অভিধানেও এই শব্দটি আছে, ‘টেলেসমা’ (telesma), যার অর্থ হল ‘completion, religious rite’। মূল শব্দ ‘teleō’-তে যার অর্থ ‘I complete, perform a
rite.’ অর্থাৎ ‘ধর্মীয় রীতি সম্পন্ন করলাম’।”
কিছুটা
অধৈর্য হয়ে অ্যাবি বলে, “হ্যাঁ, ও
তো ইন্টারনেটেই লেখা আছে এসব কথা।”
একটা দুর্বোধ্য হাসি
খেলে যায় মিঃ কিয়াংয়ের ঠোঁটের কোণে। বলেন, “মোটের ওপর তাই হলেও ব্যাপারটা এত
সাদামাটা নয়। আরও অনেক বেশি ক্ষমতা আছে এই ছোট্ট অ্যাম্যুলেটটার।” এই বলে বক্সটা
খুলে ধরলেন অ্যাবির সামনে উনি।
ওই বক্সটাই এই মুহূর্তে
অ্যাবির হাতে।
ভেতরের টালিসমেনটার গল্পটা বলেছিলেন ওকে মিঃ
কিয়াং। টালিসমেনটা শুধু সৌভাগ্যই বহন করে আনে তাই নয়, এটার অধিকারী যে হয় সে
নাম-যশ-খ্যাতির শিখরে পৌঁছয়, এমনই ক্ষমতা এই পাথরের টুকরোর।
কিয়াংয়ের দোকান থেকে
এটিই মাস ছয়েক আগে সেদিন ৫০০০ ডলারের মতো চড়া দামে কিনে এনেছিল অ্যাবি। যদিও একটা
ধাতব টুকরো কতটা ভাগ্য বদলাবে সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল ওর। তবুও এমনই একটা খারাপ
সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল যে নিজেকে আটকাতে পারল না।
(৫)
এরপর সময়ের নিয়মে আরও
মাস তিনেক কেটে যায়। টালিসমেনটার কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিল ও। মিউজিয়ামের নানা আর্টিফ্যাক্ট ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেশ কিছু অকাল্ট
স্টাডিজ-এর প্রাচীন পাণ্ডুলিপি হাতে এসেছিল - টালিসমেন কী করে বানাতে হয়, কীই বা
তার নিয়মকানুন, কী জাদু করতে পারে এই ম্যাজিকাল বস্তুগুলো। তখন খুব একটা মন দিয়ে
এগুলো দেখেনি। কিন্তু যখন পরে মিউজিয়ামে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন শতাব্দীর নানাধরনের
টালিসমেন নিয়ে এগজিবিশনের প্রস্তুতি শুরু হল তখন ফের ওই পুঁথিগুলো ঘাঁটতে শুরু করল
অ্যাবি।
প্রাচীন ভাষায় লেখা
পুঁথিগুলোর সবটা না হলেও একটু একটু রহস্য উদ্ধার করতে পারছিল ও। এদের মধ্যে একটি
পুঁথি ছিল অ্যানসিয়েন্ট ওয়েলশ ভাষায় লেখা, যার পাঠোদ্ধার করার জন্য অ্যাবি বইটা
লুকিয়ে মিউজিয়ামের বাইরে এনেছিল এবং নিয়ে গেছিল মিস লিডিয়ার কাছে।
‘দ্য হারমেটিক অর্ডার
অফ দ্য গোল্ডেন ডন’ নামের একটি সংস্থা লণ্ডনে মিস্টিক ফোর্সেস, সুপারন্যাচরাল
পাওয়ার, অ্যালকেমি, ব্ল্যাক ম্যাজিক এসবের চর্চা করত। উনবিংশ শতকের শেষদিকে আর
বিংশ শতকের গোড়ার দিকটায় এদের এই অকাল্ট স্টাডিজ ভীষণ বিখ্যাত ছিল। শোনা যায়,
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, ব্রাম স্টোকার প্রমুখ এই সংস্থার সদস্য ছিলেন, যদিও এই
দাবির সত্যাসত্য নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা
তিনজনের মধ্যে অন্যতম ডঃ রবার্ট উইলিয়াম উডম্যান। সবচেয়ে কম
প্রচারের আলোয় তিনিই এসেছিলেন। সম্ভবত এই কারণে, যে ‘গোল্ডেন ডন’-এর দ্বিতীয়
‘অর্ডার’ তৈরি হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয় এবং তাঁর কোনও উত্তরসূরী নিয়োজিত হয়নি।
ডঃ উডম্যানের সংগ্রহে থাকা এই পুঁথিটিই কোনওভাবে এসে পড়ে অ্যাবির লাইব্রেরিতে।
এদিকে অদ্ভুতভাবে ওই
টালিসমেনটা হাতে আসার পর একটু একটু করে ওর জীবনের সমস্যাগুলোও দূর হতে শুরু করছিল।
বহুদিন ধরে আটকে থাকা থিসিসের কাজ গড়গড়িয়ে এগোতে থাকে। একটা ক্রনিক শারীরিক সমস্যা
থেকে রেহাই পায়। দূর-সম্পর্কের এক গ্র্যানির সম্পত্তির কিয়দংশ আকস্মিকভাবেই হাতে
এসে পড়ে ওর আর্থিক অবস্থার বেশ কিছুটা উন্নতি ঘটে। হয়তো পুরো ব্যাপারটাই কাকতালীয়,
ওর কল্পনা, কিন্তু তবুও যেন কেন অ্যাবির মনে হতে থাকে, এসবের মূলে ওই ৫০০০ ডলার
দিয়ে কেনা চাইনিজ অ্যান্টিক শপের টালিসমেনটা।
পুঁথিটার অনেকটা অংশেরই
অর্থ উদ্ধার করেন মিস লিডিয়া। মাস দেড়েক আগেই একদিন ওঁর অ্যাপার্টমেন্টে বসে
ট্রান্সলেটেড কাগজগুলো অ্যাবির হাতে তুলে দেন তিনি। তখনও অবধি মিস লিডিয়া জানতেন
যে বইটি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে এনেছে অ্যাবি। অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞাসা
করেছিলেন, “এ পুঁথি লাইব্রেরিতে থাকা তো বেশ আশ্চর্যজনক ব্যাপার। সাধারণত
মিউজিয়ামেই থাকে এসব!”
অ্যাবি এড়িয়ে গেছিল
প্রসঙ্গটা। ওঁকে বলেনি যে বিনা অনুমতিতে মিউজিয়ামের প্রপার্টি ও বাইরে এনেছে।
সেইদিনটার কথা আজও মনে
পড়ে অ্যাবির। বাড়িতে এসে রুদ্ধশ্বাসে পড়ছিল মিস অ্যানের অনুবাদ করা পাতাগুলো।
কীভাবে তন্ত্রবিদ্যার সাধনার মাধ্যমে প্রকৃতির নানা শক্তিকে আবদ্ধ করা হয়
টালিসমেনের ভেতর। নানাধরনের রিচ্যুয়ালস-এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন স্পিরিটকে ধরে রাখা
হয় ওই টালিসমেনের ভেতর। কখনও তা সৎ উদ্দেশ্যে, কখনও বা অসৎ। সাধারণত যিনি প্রস্তুত
করেন টালিসমেনটি তিনি নিজের জন্যই করেন। বংশানুক্রমে তাঁর রক্তের সম্পর্কের
উত্তরপুরুষরাও এই টালিসমেন ধারণ করতে পারেন। একমাত্র তাদেরই অধিকার আছে ওই
জাদুক্ষমতার অধিকারী হওয়ার।
নোটসগুলো পড়তে পড়তে
হঠাৎ একটা পাতায় চোখ আটকে যায় অ্যাবির। মিস লিডিয়ার হাতে আঁকা একটা আউটলাইন, খুব
চেনা। সঙ্গে সঙ্গে আসল পুঁথির পাতাটা ওল্টায়। একটা ছবি, পেন্টাক্যল, ধাতব দামি
রত্নখচিত। সেটা বসানো আরেকটা কালচে পাথরের টুকরোর ওপর। কালচে পাথরের ওপর খাঁজ কেটে
একটা পেন্টাগ্রাম বানানো, তার ভেতর ধাতব ওই পেন্টাক্যলটা খাপে খাপে বসানো। তার
মানে ওর কাছে যে টালিসমেনটা আছে সেটা গোটা টালিসমেনটা নয়, এর আরেকটা অংশও আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে
নিয়েছিল অ্যাবি ওর পরবর্তী পদক্ষেপ। মিউজিয়ামে এগজিবিশনের জন্য আসা
আর্টিফ্যাক্টগুলোর মধ্যে যে ওই পেন্টাক্যলটা ও দেখেছে তাতে ওর কোনও সন্দেহ ছিল না।
ওটা অ্যাবির চাই-ই। তবেই সম্পূর্ণ হবে ওর টালিসমেনটা। না জানি আরও কত সৌভাগ্য বয়ে
আনবে ওর জন্য। যেন কোনও দুরাত্মা ভর করেছিল ওর ওপর।
এগজিবিশনের জন্য
বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বিভিন্ন লোকের দেওয়া আর্টিফ্যাক্টগুলো এনলিস্ট করার সময়
অ্যাবি কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক থেকে উড়িয়ে দেয় একটি বিশেষ এন্ট্রি, ওই ধাতব
পেন্টাক্যলটির। তারপর মিস লিডিয়ার কাছে নিয়ে আসার নাম করে অন্য কতকগুলো
আর্টিফ্যাক্ট দেখায় কিউরেটর মিঃ বেনসনকে। যেহেতু মিস লিডিয়া শারীরিক অসুস্থতার
কারণে ক’দিন মিউজিয়ামে আসতে পারছেন না, তাই তাঁর কাছে অথেন্টিকেশনের নামে ওগুলো
নিয়ে যেতে চায় অ্যাবি। ওর মিষ্টি ব্যবহার এবং শেখার আগ্রহ - এগুলোর কারণে মিঃ
বেনসন আর মিস লিডিয়া দু’জনেই ওকে স্নেহ করতেন। তাই এভাবে আর্টিফ্যাক্ট সাধারণত
বাইরে না পাঠানো হলেও মিঃ বেনসন অমত করেননি। ওগুলোর সঙ্গে মিশিয়েই ওই তালিকার
বাইরের পেন্টাক্যলটাও নিয়ে আসে অ্যাবি এবং মিস লিডিয়াকে ওটা বাদে বাকিগুলো দেখিয়ে
ফেরত দিয়ে আসে মিউজিয়ামে।
(৬)
চুরি করা ধাতব
পেন্টাক্যলটা অ্যাবির কাছে থাকা পাথরের বাকি অংশটার ওপর বসাতেই খাপে খাপে আটকে
গেছিল একদম। এতদিনে সম্পূর্ণ হল টালিসমেনটা। চোখদুটো ঝিকিয়ে উঠেছিল অ্যাবির।
আজ এক এক করে সব মনে
পড়ছে অ্যাবির। হাতে ধরা কাঠের কারুকার্য করা বক্সের মধ্যে থেকে টালিসমেনের পাথুরে
অংশটা তুলে টেবলে রাখে। নিচের ভেলভেটমোড়া অংশটার এককোণে হাতে করে চাপ দিতেই খুট
করে একটা শব্দ হয়। নীল ভেলভেটটা তুলতেই তলায় আরেকটা ছোটো প্রকোষ্ঠ, তার মধ্যে
জ্বলজ্বল করছে রত্নখচিত ধাতব পঞ্চমুখী তারকাটি। একটা হলুদ সোনার চেনে লকেটের মতো আটকানো। হাতে করে ওটা তুলে ঘুরিয়ে
দেখতে থাকে অ্যাবি। এই টালিসমেনটার জন্যই কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে ওকে। টাকা খরচ থেকে শুরু করে মিউজিয়ামে চুরি, এমনকি...
লাল রঙে লেখা চিঠিটা
পেপার শ্রেডারে ঢুকিয়ে যন্ত্রটা চালু করে। একটা যান্ত্রিক আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে কুচি
কুচি হয়ে যায় কাগজগুলো। চেনে আটকানো পেন্টাক্যলটা সযত্নে ফের লুকোনো প্রকোষ্ঠে
রাখে, ভেলভেট চাপা দিয়ে টেবলের ওপর থেকে পাথুরে অংশটাও ভেতরে ঢোকায়। তারপর কাঠের
বাক্স বন্ধ করে টেবলের ড্রয়ারটা টেনে তার মধ্যে রাখতে যায় অ্যাবি। হঠাৎ কী মনে
করে ওটা ড্রয়ারে না রেখে হাতে নিয়ে লিভিং রুমের আলো বন্ধ করে বেডরুমে চলে যায়।
আরও একজোড়া সতর্ক চোখও
যে ওদিকে লিভিংরুম লাগোয়া বাইরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উইন্ডো ব্লাইন্ডসের ফাঁক দিয়ে
এতক্ষণ দেখছিল অ্যাবিকে এবং ওর হাতে ধরা কাঠের বক্সটাকে, সেটা অ্যাবির অগোচরেই
থেকে যায়।
অ্যাবি চলে যেতে ছায়ামূর্তিটি
ধীরে ধীরে ওপরের ফ্লোরের ব্যালকনি থেকে ঝোলানো দড়িটা বেয়ে উঠে যায় তিনতলার
বারান্দায়। তারপর কাচের দরজা সরিয়ে ঢুকে যায় ভেতরে, ৩১৩ নম্বর ফ্ল্যাটের ভেতরে।
(৭)
পরেরদিন সকালে অ্যাবির
একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। তড়িঘড়ি করে রেডি হতে
লাগল ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য। এমন সময় ঘরের ডোর অ্যানসারিং মেশিনটা বেজে উঠল।
স্যুইচটা টিপে অ্যাবি জিজ্ঞাসা করল, “হু’জ দ্যাট?”
একটা মেয়ের গলা ভেসে
এল, “হাই! দিস ইজ মেলিসা। আয়্যাম হিয়ার বিকজ অফ ইওর অ্যাড ইন ক্রেইগলিস্ট।”
ওহো! ভুলেই গেছিল
অ্যাবি অ্যাডভার্টাইজমেন্টটার কথা। রুমমেট চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল বটে মাস পাঁচেক
আগে। ফের স্যুইচ
টিপে বিল্ডিংয়ের বাইরের গেটটা খুলে অপেক্ষা করতে লাগল মেয়েটির দোতলার ২১৩ নম্বর
ঘরে আসা অবধি।
যে সময় বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিল
তখন অবশ্য টাকার প্রয়োজন ছিল। তারপর টালিসমেনটার প্রভাবে অ্যাবি বেশ মোটা অঙ্কের
অর্থের অধিকারিণী হয়েছে। কাজেই এই মুহূর্তে এই মেয়েটিকে বিদেয় করে দেওয়াটাই শ্রেয়।
ঠিক দেড় মিনিটের মাথায়
দরজায় মৃদু টোকা শুনে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। সামনে একটা লম্বা মেয়ে দাঁড়িয়ে - গায়ে ওভারকোট, চোখে সানগ্লাস।
লিভিংরুমের সোফায় বসা
মেয়েটাকে দেখে যেন কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল অ্যাবির। ওকে এই মুহূর্তে পত্রপাঠ
রুমমেটের প্রয়োজন নেই বলে পথ দেখাতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু মেয়েটি যেন একটু
নাছোড়বান্দা। বলতে লাগল, এই মুহূর্তে একটা ঘরের ওর খুব দরকার, অন্তত মাস দুই-তিনের
জন্যও যদি অন্তত সাব-লিজ নিতে পারে অ্যাবির ২-বি.এইচ.কে. অ্যাপার্টমেন্টের
এক্সট্রা বেডরুমটা।
মাস দেড়েক আগে হলেও হয়ত
অ্যাবি রাজি হয়ে যেত, প্রয়োজন না থাকলেও। কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য কাউকে নিজের
সঙ্গে রাখাটা একেবারেই নিরাপদ নয় অ্যাবির জন্য।
মেয়েটা হঠাৎ একটা
অদ্ভুত প্রস্তাব করল, “তোমার ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে তুমি অ্যান্টিক কালেক্ট করতে ভালোবাসো।
যদি কিছু মনে না করো তোমায় একটা জিনিস দেখাতে চাই।”
এমন কথা শুনে না করে কী
করে অ্যাবি! বলল, “হ্যাঁ, আমি এই নিয়ে একটু আধটু চর্চা করি বৈকি। তোমার কাছে কীধরনের
অ্যান্টিক আছে জানতে পারি কি, মেলিসা?”
মেয়েটা একটু হেসে
ওভারকোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা জিনিস বার করে হাতের তালুতে নিয়ে এগিয়ে ধরল
অ্যাবির দিকে। জিনিসটা দেখামাত্র অ্যাবি সোফা থেকে ছিটকে উঠে পড়ল।
“এ-এ-এটা তোমার কাছে
ক্-কী করে!”
“কেন? এটা তোমার কাছে
থাকার কথা ছিল বুঝি, মিস অ্যাবিগেইল স্পেন্সার?”
“হ্যাঁ, মানে ন্-না...
মানে...”
“মানেটা আমি বলছি। ইউ
আর আন্ডার অ্যারেস্ট ফর থেফট অফ ভ্যালুয়েবল প্রপার্টি অফ দ্য মিউজিয়ম অ্যান্ড...”
“আমি চুরি করিনি! এটা
তো অথেন্টিকেশনের জন্য...”
“লেট মি ফিনিশ। অ্যান্ড মার্ডার অফ মিস লিডিয়া টাইলর।”
ধপ করে সোফায় বসে পড়ল
অ্যাবি। সামনের মেয়েটির হাতের মুঠোয় ধরা টালিসমেনটা সামনের সেন্টার টেবিলটায় রাখা।
হ্যাঁ, সেই টালিসমেনটা যেটা কাল রাত্রেই ও বেডরুমের লকারে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল।
মেলিসার এক হাতে ততক্ষণে উঠে এসেছে সার্ভিস রিভলবার, অন্য হাতে পরিচয়পত্র। তাতে
সোনালি ঝিলিক দিচ্ছে, ‘ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’।
(৮)
এরপরের ঘটনা পুরোটাই
ঘটল মিউজিয়মের কিউরেটর মিঃ বেনসনের সামনে। ওঁকে ফোন করে ডেকে আনা হয়েছে।
বলতে শুরু করে মেলিসা,
এফ.বি.আই. অফিসার, “আজ থেকে প্রায় মাস ছয়েক আগে মিস অ্যাবিগেইল স্পেন্সার ব্লুমন্ড
অ্যাপার্টমেন্টসে ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। অ্যাবি ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের ছাত্রী,
রিসার্চও করছে। সেই সাথে স্থানীয় মিউজিয়মে পার্ট টাইম কাজও করে। শখের অথেন্টিকেশন,
সেই সূত্রেই অ্যাবির পরিচয় হয় মিঃ বেনসন এবং মিস লিডিয়ার সঙ্গে।”
এই বলে একবার চেয়ারে হ্যান্ড
কাফ পরে বসা অ্যাবির দিকে মুখটা ফেরায় মেলিসা। মিঃ বেনসনও একরাশ ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে
তাকিয়ে নতমস্তক অ্যাবির দিকে। ফের বলতে শুরু করে মেলিসা।
“মিস লিডিয়ার কাছে
প্রায়শই যেত অ্যাবি এবং ওঁর থেকে সন্ধান পেয়েই ওর সংগ্রহে আসে একটা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ টালিসমেনের অর্ধেক অংশ। এটা প্রায় ছ’মাস আগে, এই বিল্ডিংয়ে শিফট করার
পরেরই ঘটনা। মাসতিনেক পর মিউজিয়মে হঠাৎই অ্যাবির হাতে পড়ে একটি অমূল্য পুঁথি যেটা
বিনা অনুমতিতে লুকিয়ে বাইরে এনে মিস লিডিয়াকে দিয়ে অনুবাদ করায় অ্যাবি। মিঃ বেনসন
যেহেতু মাঝেমাঝে মিস লিডিয়া শারীরিক কারণে মিউজিয়ম আসতে না পারলে অ্যাবিকে দিয়ে
টুকটাক জিনিস ওঁর কাছে পাঠাতেন অথেন্টিকেশনের জন্য, তাই সন্দেহ করেননি অ্যাবিকে
মিস লিডিয়া। পুঁথির অনুবাদ থেকে অ্যাবি জানতে পারে টালিসমেনটির গুরুত্ব এবং এও
জানতে পারে টালিসমেনটির আরেকটি অংশ মিউজিয়মেই এগজিবিশনের জন্য এসেছে। নিজের
সাম্প্রতিক কিছু কাকতালীয় সৌভাগ্যে কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে অ্যাবি ভাবে সত্যিই
টালিসমেনটির অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা আছে। ফের চুরি করে পেন্টাক্যলটি।”
সারাঘরে পিন পতনের
নিস্তব্ধতা। মেলিসা, অ্যাবি, মিঃ বেনসন ছাড়াও আরও দু’জন লোকাল পুলিশ
ডিপার্টমেন্টের লোকও ঘরে উপস্থিত। সবাই শুনছে মেলিসার কথা। গলা ঝেড়ে আবার বলতে
থাকে মেলিসা, “মাসখানেক আগেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটায় অ্যাবি। পেন্টাক্যলটি
খুঁজে না পেয়ে সন্দেহ হয় মিঃ বেনসনের, উনি মিস লিডিয়াকে ফোন করেন। মিঃ বেনসনের সঙ্গে
কথা হওয়ার পর মিস লিডিয়া সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন অ্যাবি কিছু খারাপ একটা কাজ করছে।
ওঁর ইনট্যুশন হয়তো বলে - সামথিং ইজ রং। আর তাই উনি হয়তো কনফ্রন্ট করেন অ্যাবিকে।
তখনই অ্যাবি সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে। কী, তাই তো, অ্যাবি?”
যার উদ্দেশ্যে বলা সে
মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, “সৌভাগ্য না ছাই, ওই টালিসমেনটা শয়তানের গয়না। ওটা সম্পূর্ণ
হওয়ার পরই আমার ওপরেও শয়তান ভর করে। নাহলে আমি কী করে মিস লিডিয়াকে...”
মুখ চাপা দিয়ে কান্নায়
ভেঙে পড়ে অ্যাবি। মেলিসা বলে, “বাকিটা কি আমি বলব, না তুমি বলবে? মিথ্যে বলে
বা লুকিয়ে কোনও লাভ নেই। তুমি সবকিছু বড়ো যত্নে করলেও একটা জিনিস তোমার আয়ত্বে ছিল
না। মিস লিডিয়ার ফ্ল্যাটের উলটোদিকের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা লুকাস ইটালির ত্রিয়েস্তে
শহরের বাসিন্দা। তুমি যখন ভোরবেলায় সব সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করে ফিরে যাচ্ছিলে তখন
ও ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে যাচ্ছিল ভোরের ফ্লাইট ধরে ইটালিতে ছুটিতে বাড়ি ফিরবে বলে।
বেরোনোর মুহূর্তে নিজের ঘরের দরজার আই-হোল দিয়ে ও তোমায় দেখে মিস লিডিয়ার
ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে বেরোতে এবং দরজার বাইরের হাতলের ওপর থেকে রুমাল দিয়ে নিজের
হাতের ছাপ মুছতে। নিয়মিত মিস লিডিয়ার ফ্ল্যাটে যেহেতু তুমি যাতায়াত করতে লুকাস
তোমায় চিনত। কিন্তু দিন কুড়ির জন্য দেশে ফিরে যাওয়ায় ও জানতে পারেনি যে মিস
লিডিয়ার মৃত্যু হয়েছে। ফিরে এসে সেটা জানামাত্র ও যোগাযোগ করে লোকাল পুলিশ স্টেশনে
এবং তারপর আমার কাছে ও স্টেটমেন্টও দিয়েছে। কাজেই...”
(৯)
কাঁপা কাঁপা গলায়
অ্যাবি শুরু করে, “মিস লিডিয়া আমায় সরাসরি প্রশ্ন করেন যে পুঁথিটা আমি না জানিয়ে
এনেছিলাম কি না। এরপর পেন্টাক্যলটার কথাও জিজ্ঞাসা করেন। আমি ওঁর সামনে তখনকার মতো
নিজের দোষ স্বীকার করি। উনি আমাকে বলেন, ওগুলো মিউজিয়ামে ফেরত দিতে আর ভবিষ্যতে
এরকম কিছু না করতে। তাহলে উনি মিঃ বেনসন বা পুলিশ কাউকে কিছু বলবেন না।” মাথা নীচু
করে বলে চলে অ্যাবি, “তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ওঁকে সরাতে হবে পথ থেকে। মিস লিডিয়ার
ইনসমনিয়া ছিল, মাঝেমাঝে তাই প্রেসক্রাইবড ঘুমের ওষুধ খেতেন। আমার ওঁর বাড়িতে
অবারিত দ্বার ছিল। টয়লেটে যাওয়ার নাম করে আমি কাচের আয়নার পেছনের মেডিসিন
ক্যাবিনেট থেকে বার করে আনি ঘুমের ওষুধের শিশি। মিস লিডিয়া যেহেতু নিয়মিত ওষুধ
খেতেন না তাই ওষুধটা খুঁজে না পেলে বিশেষ বিচলিত হওয়ার কথা নয় বা নিজের ভুলো মনের
কারণেই হারিয়েছেন ভাববেন। এটা খুব সহজেই আঁচ করতে পারি। তারপর মিস লিডিয়ার অন্যমনস্কতার
সুযোগে গল্প করতে করতে ওঁর হট চকোলেটের মধ্যে মিশিয়ে দিই একমুঠো ঘুমের ওষুধ। আমি জানতাম,
প্রতি রাত্রে উনি শোয়ার আগে হট চকোলেট খান। উনি আমাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন
যে ফ্ল্যাটের একটা চাবিও আমার কাছে দিয়ে রেখেছিলেন। ভোররাত্রে ফের ঢুকি ওঁর ঘরে।
হট চকোলেটের গ্লাসটা ধুয়ে রেখে দিই। জলের গ্লাসের পাশে খালি ঘুমের ওষুধের শিশিটা
রেখে দিয়ে সতর্কভাবে নিজের সমস্ত হাতের ছাপ মুছে দিয়ে চলে আসি। আর চাবিটাও রেখে
দিয়ে এসেছিলাম, যাতে সন্দেহের তির আমার দিকে না আসে। এই সমস্ত প্ল্যান ওইদিন করার
যে কারণ ছিল সেটা হল মিস লিডিয়ার অ্যাপার্টমেন্টের সিকিওরিটি ক্যামেরাগুলোর
রিপ্লেসমেন্ট চলছিল গত দু’দিন ধরে। তাই বিল্ডিংয়ে আমার আসা বা যাওয়ার কোনও রেকর্ড
হবে না ভেবেছিলাম। কিন্তু লুকাস...”
রাগত কণ্ঠে মিঃ বেনসন
বলেন, “পাপ কখনও চাপা দেওয়া যায় না, অ্যাবি, ছিঃ! এত মেধাবী ছাত্রী তুমি। তোমার ভেতর
কত সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তুমি এভাবে মিথ্যে কুসংস্কারের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বনাশ
ডেকে আনলে! একটা পাথরের টুকরো বা একটা ধাতুর টুকরো তোমার ভাগ্য বদলায়নি, বদলাতে
পারে না। তুমি নিজেই এর জন্য দায়ী।”
মেলিসা বলে, “যদিও
আপাতদৃষ্টিতে মিস লিডিয়া একাকীত্বের ডিপ্রেশনে আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে হবে
ঘটনাটা, তাও অনেকগুলো খোলা সূত্র থাকায় লোকাল পি.ডি. হোমিসাইডের মামলা দায়ের করে।
কিন্তু ফাইনালি এটা ইনভেস্টিগেট করে এফ.বি.আই। তার কারণ, মিস লিডিয়া বহুবার
বিভিন্ন প্রাচীন ভাষার তথ্য অনুবাদে সাহায্য করেছেন সরকারকে, যেগুলো ক্লাসিফায়েড
ডক্যুমেন্ট মানে, কনফিডেনসিয়াল ইনফর্মেশন বহন করে। কাজেই ওঁর খুন হওয়ারও অনেক গোপন
কারণ থাকতে পারত। কিন্তু ফাইনালি তদন্তে মিস অ্যাবিগেইল দোষী প্রমাণিত হবেন এটা
আমরাও এক্সপেক্ট করিনি।
“সন্দেহটা মিঃ বেনসনেরই
হয় শুরুতে কারণ, মিস লিডিয়া অ্যাবির মিউজিয়ম থেকে পুঁথি চুরির ঘটনাটা ওঁকে জানান।
তারপর মিঃ বেনসনও লক্ষ করেন পেন্টাক্যলটা মিসিং। যদিও কম্পিউটারের সব তথ্য অ্যাবি
উড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু ও জানত না যে উনি পেপার ফাইলেও রেকর্ড রাখেন। সেটাই অ্যাবির
কাল হল।”
(১০)
দ্য প্রাইম সাসপেক্ট অফ
মিস লিডিয়া টাইলর মার্ডার কেস অ্যান্ড থেফট অফ প্রাইসলেস মিউজিয়ম আর্টিফ্যাক্টস, মিস
অ্যাবিগেইল স্পেন্সারকে লাল নীল আলো জ্বলা পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয় মেলিসা। এবার
যা করার কোর্ট করবে।
ব্লুমণ্ড
অ্যাপার্টমেন্টের অ্যাবির ২১৩ নম্বর রুমটা ‘ডু নট ক্রস’ লেখা হলুদ টেপের পুলিশ
লাইন দিয়ে ঘিরে দেয়। তারপর উঠে যায় তিনতলার ৩১৩ নম্বর ঘরে। ব্যালকনিতে
কুণ্ডলী পাকিয়ে রাখা দড়িটা তুলে ঘরে এনে রাখে। জিপলক প্লাস্টিক ব্যাগের মধ্যে রাখা
টালিসমেনটা ওভারকোটের পকেট থেকে বার করে টেবিলে রাখে, প্লাস্টিকটার গায়ে স্টিকার
লাগানো এভিডেন্স।
তারপর অন্য পকেট থেকে
আরেকটা ছোটো কাপড়ের থলি বার করে। তার মধ্যেও রাখা একদম একরকমের আরেকটা টালিসমেন।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে ওটা। বহুদিন ধরে পাগলের মতো খুঁজেছে এটাকে। বিভিন্ন অ্যান্টিক
শপ থেকে শুরু করে সমস্ত নামী অনামী মিউজিয়ম, সব জায়গায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে।
অ্যাবিকে ধরা নয়, এই টালিসমেনটাকে ধরাই ওর আসল উদ্দেশ্য ছিল। ওটাকে
এভিডেন্সের ব্যাগের টালিসমেনটার সঙ্গে বদলে দেয়।
দুটোর মধ্যে একটাই তফাত,
অ্যাবির কাছে যে টালিসমেনটা ছিল, যেটা এই মুহূর্তে মেলিসার পকেটের কাপড়ের থলিতে
আছে, তার পেন্টাক্যলটার এককোণে খোদাই করা একটা নাম, যার ইংরাজি হরফে অনুবাদ করলে
দাঁড়ায় P. Davies. মেলিসা ডেভিস-এর গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যাণ্ডফাদার, প্যাট্রিক
ডেভিস।
লিফটে করে নিচে নেমে
লাল টয়োটা ক্যামরিটায় বসে মেলিসা। পাশের সিটে ছুড়ে দেয় এভিডেন্সের জিপলক ব্যাগটা।
এটার আর অথেন্টিকেশন হবে না। বহু এভিডেন্সের তলায় চাপা পড়ে থাকবে কোনও লকারে। মিঃ
বেনসনও আর ফেরত চান না অভিশপ্ত টালিসমেনটা।
আর যেটায় মেলিসার
বংশানুক্রমিক অধিকার সেটা ওর ওভারকোটের পকেটে সুরক্ষিত আছে। সানগ্লাসটা চোখ থেকে
খুলে ড্যাশবোর্ডে রেখে তাকায় রিয়ার ভিউ মিররে। ঠিক সেই জ্বলন্ত একজোড়া চোখ ভেসে
ওঠে স্ফটিক স্বচ্ছ আয়নায়, যে দুটো অ্যাবি ক’দিন আগেই দেখেছিল উলটোদিকের গাড়িতে
বসে।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment