দৃষ্টিহীনদের দেশ
এইচ জি ওয়েলস
অনুবাদঃ অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
চিম্বারাজো থেকে তিনশো মাইলেরও বেশি, বরফে ঢাকা
কোটাপাক্সির থেকে একশো মাইল দূরে, সবচাইতে বুনো এলাকায় আছে ইকুয়াডরের এন্ডিস পর্বতমালার সেই
রহস্যময় উপত্যকা — সভ্যসমাজের গোচরের বাইরে লুকিয়ে থাকা দৃষ্টিহীনদের দেশ। অনেক
অনেক বছর আগে, সে উপত্যকা বাইরের পৃথিবীর কাছে ছিল উন্মুক্ত। ভয়ঙ্কর বরফে ঢাকা
গিরিখাদ পেরিয়ে, এই উপত্যকার তৃণভূমিতে একদল মানুষ এক নিষ্ঠুর, লোভী স্পেনীয়
শাসকের শাসনের হাত থেকে পালিয়ে প্রথম পা রেখেছিল। তারপর তারা সংসার পেতে
বসেছিল এখানেই।
তারপর এল সেই বিস্ময়কর মিন্ডোবোম্বার দাপট। কুইটোতে
একটানা সতের রাত ছিল রাতের অন্ধকারে ঢাকা। ইয়াগুয়াচিতে জল এমন গরম হয়ে ফুটতে শুরু
করেছিল যে, জলের উপর মারা যাওয়া মাছেদের শব ভেসে বেড়াচ্ছিল। প্যাসিফিক ঢাল জুড়ে
নেমেছিল ধ্বস। দ্রুত সব বরফ গলে গিয়ে প্রলয় বান আসায় আরাউকা পর্বতশৃঙ্গ
প্রবল শব্দে ভেঙে পড়েছিল। পৃথিবীর বুকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল দৃষ্টিহীনদের সেই
দেশ। কোনোদিন আর বাইরের মানুষ সেখানে পা রাখতে পারেনি।
বিভীষিকাময় সেই ঘটনায় যখন পৃথিবী ভীষণভাবে নড়েচড়ে
গেল, সেদিন দুর্ভাগ্যবশত এক হতভাগ্য মানুষ সেই দেশ থেকে গিরিখাদের অপরদিকে চলে
এসেছিল। এরপর
উপত্যকা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আর স্ত্রী-পুত্র পরিবার থেকে
আলাদা হয়ে লোকটা হয়ে যায় একেবারে একা। তারপর সে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। কিন্তু মারা
যাওয়ার আগে সে জানিয়ে যায় সেই দেশের কথা, দৃষ্টিহীনদের উপত্যকার কথা, এন্ডিস
পর্বতমালার কন্দরে কন্দরে আজও যে কাহিনি মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়।
সে দেশে নাকি সব ছিল, যা যা মানুষ চায় — মিষ্টি জল,
সবুজ তৃণভূমি, মনোরম জলবায়ু, সুফলা বাদামি মাটিতে জন্মানো সুস্বাদু ফল। একদিকে উঁচু
পাহাড়ের চূড়ায়, আকাশের গায়ে মাথা উচু করে দাঁড়ানো পাইনের ঘন বন, আর তিন দিকে কালচে
সবুজ পাথরের সুউচ্চ পাহাড়ের মাথা টুপির মতো বরফের আস্তরণে ছিল ঢাকা। সৌভাগ্যক্রমে
পাহাড়ের মাথায় হিমবাহ তাদের দেশে না পড়ে, বয়ে গিয়েছিল অন্য দিকে। কখনও কখনও অবশ্য
বরফের চাঙড় ভেঙে পড়ত উপত্যকায়, তবে তাতে বড়ো ক্ষতি হত না। চারিদিকে পাহাড়ের বর্ম
থাকায় সারা বছরই সেখানে ছিল মনোরম বসন্তকাল, বৃষ্টি আর তুষারপাত সেখানে প্রায় হত
না বললেই চলে।
উপত্যকার বাসিন্দারা বেশ সুখেই জীবন কাটাত। তাদের
পশুরাও যত্নে ছিল, বছর বছর তাদের সংখ্যা বেড়েই যেত। কিন্তু একটা ঘটনায় তাদের পুরো
জীবনটাই গিয়েছিল বদলে। হঠাৎ এক বিচিত্র অসুখে তাদের সব নবজাত শিশু দৃষ্টিহীন হয়ে
জন্মায়। এমনকি অনেক ছোটো ছোটো বাচ্চারাও তাদের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে।
হতভাগ্য লোকটা অন্ধত্বের প্রতিষেধক খুঁজতে, সেই
দুর্যোগের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গিরিখাদ অতিক্রম করে নেমে এসেছিল উলটো দিকে।
মহামারীর কারণ যে জীবাণু সংক্রমণ, তা তখন ছিল অজ্ঞাত। মানুষ মনে করত, সব অসুখের
পিছনে আছে তাদের পাপ আর কর্মফল। লোকটার মনে হয়েছিল, উপত্যকায় বাস করা মানুষেরা
প্রার্থনা আর উপাসনার জন্য একটাও মন্দির না বানানোর কারণেই ঈশ্বর তাদের অন্ধত্বের
শাস্তি দিয়েছেন। তাই সে ভেবেছিল ঈশ্বর আরাধনার জন্য একটা মন্দির যে করেই হোক
বানাতে হবে। ঈশ্বর বিশ্বাসের উপযুক্ত প্রাচীন সব বস্তু রাখা হবে সেই মন্দিরে,
জোগাড় করতে হবে রহস্যময় সব বস্তু, যাতে মানুষ বিশ্বাসী হয়। তার ঝোলায় ছিল খুব পুরোনো
একটা রুপোর খণ্ড, যেটা সে আড়ালে লুকিয়ে রেখে সবাইকে বলেছিল, “যার কাছে যা সোনাদানা
আছে, সব আমাকে দাও। এগুলো এই দেশে কোনো কাজে আসবে না, বরং বাইরে বিক্রি করে ঈশ্বরের
আশীর্বাদ কিনতে হবে। তবেই ঘটবে রোগমুক্তি।”
আমার মনে হয়, মারা যাবার আগে সেই ক্ষীণদৃষ্টি, রোদে
তামাটে হয়ে যাওয়া, পথকষ্টে আর জ্বরে ধুঁকতে থাকা যুবকটি নিশ্চয়ই তার মনের কথা
মন্দিরের কোনো পূজারিকে বলে গিয়ে থাকবে। হয়তো গিরিখাদ পেরিয়ে আসার সেই ভয়ঙ্কর
অভিজ্ঞতাও সে জানিয়ে গিয়েছিল। তবে এরপর তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল, সে কথা আমার জানা
নেই। শুধু জানি, কয়েক বছর পর রোগে ভুগে তরুণটি মারা যায়।
নদীটার স্রোতের বেগের ফলে গিরিখাদ তৈরি হয়েছিল, সেই
নদী এখন এক পাহাড়ি গুহার মুখ ফাটিয়ে বয়ে চলেছে বাইরের দুনিয়ায়। অজ্ঞাত সেই
দৃষ্টিহীনদের দেশ রয়ে গিয়েছে তরুণের মুখশ্রুত গল্প হয়ে।
বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে যাওয়া সেই দেশে অদ্ভুত রোগটা কিন্তু তার খেল দেখিয়ে দিয়েছিল। বড়োরা ড্যাবডেবে
চোখে চেয়ে থাকত, আর তাদের সন্তানরা ছিল জন্মান্ধ। কিন্তু সেই বরফ ঘেরা দেশের স্বচ্ছন্দ
আর সরল জনজীবন বাকি পৃথিবীর কাছে রয়ে গিয়েছিল অজ্ঞাত। সেখানে না ছিল কোনো বিষাক্ত
কাঁটাঝোপ, না কোনো হিংস্র পশু — শুধু বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, গিরিখাদ, আর নদীর পাড়ে
চড়ে বেড়ানো শান্তশিষ্ট ভেড়ার পাল। বড়োরা, যারা চোখে দেখত, তারা প্রথম প্রথম অন্ধ
বাচ্চাদের পথ চলতে আর জীবনযাপন করতে সাহায্য করত, যতদিন না পুরো উপত্যকার প্রতিটি
কোনা তাদের চেনা হয়ে যায়। আস্তে আস্তে সবাই তাদের দৃষ্টিহীনতার বিষয়টা এত
স্বাভাবিকভাবে মেনে নিল, কবে যে চোখে দেখার ব্যাপারটা তারা বেমালুম ভুলে গেছে, কেউ
লক্ষই করেনি। তারপর একসময়ে দৃষ্টিহীনতা নিয়েই বেঁচে থাকতে শুরু করে সেই উপত্যকার
বাসিন্দারা।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম এইভাবে বাঁচতে বাঁচতে সেই
দেশের মানুষ খানিকটা হারিয়ে যাওয়া পেরুর সংস্কৃতি আর বাকিটা স্পেনীয় সভ্যতা বহন
করে চলে। অনেক কিছুই তারা ভুলে যায়, আবার অনেক নতুন নতুন আবিষ্কারের আনন্দে মেতে
যায় তারা। যে সভ্যতা বুকে নিয়ে তারা উপত্যকায় বাস করতে শুরু করেছিল, আস্তে আস্তে
তার রঙ হয়ে যায় পৌরাণিক, অনিশ্চয়তায় ভরা। দৃষ্টিশক্তি ছাড়া জীবনের অন্য সব দিকে
তারা বেশ মজবুত ছিল। ছোট্ট এক প্রজাতি এমন ভাবেই শুধু সংখ্যায় নয়, বোধবুদ্ধিতেও
বিকশিত হতে থেকে নিজেদের সামাজিক আর অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করতে থাকে।
তারপর এক শিশু জন্মায়, উপত্যকা থেকে বাইরের দুনিয়ায়
রুপোর খণ্ড নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সেই লোকটা – যে আর কোনোদিন নিজের মাটিতে ফিরে যায়নি। তার পনের প্রজন্ম পরে জন্ম
নেওয়া আর এক তরুণ, একদিন দৃষ্টিহীনদের সেই উপত্যকায় বাইরের পৃথিবী থেকে হঠাৎ এসে
উদয় হয়, যাকে নিয়ে এই গল্প।
লোকটা ছিল কুইটোর কাছের এক দেশে জন্ম নেওয়া
পর্বতারোহী। পেটে তার কিছু বিদ্যেবুদ্ধি ছিল। পাহাড় থেকে সমুদ্র, সব
জায়গাতেই তার অবাধ বিচরণ তাকে করে তুলেছিল এক পুরোপুরি উদ্যোগী মানুষ। ইকুয়াডরের পাহাড় চড়তে আসা একদল
ইংরেজের দলে সে ভিড়েছিল। আসলে সেই দলে এক সুইস গাইড হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ইংরেজ
অভিযাত্রীরা লোকটাকে দলে নেয়। এন্ডিস পর্বতমালার এক গিরিশৃঙ্গে চড়তে গিয়ে লোকটা
বহির্বিশ্ব থেকে হারিয়ে যায়। এই দুর্ঘটনার গল্প ডজনখানেক বার লেখা হয়েছে বিভিন্ন
জায়গায়। তার মধ্যে পয়েন্টারের লেখা গল্পটা সবচাইতে চিত্তাকর্ষক। সে বর্ণনা করেছে,
কীভাবে ছোটো সেই দলটা অতি কষ্টে পর্বতের চুড়োয় পৌঁছয়, কেমন ভাবে তারা বরফের মধ্যে একটা
চ্যাটালো পাথরের উপর তাদের রাতের আশ্রয় বানায়, আর নাটকীয়ভাবে হঠাৎই ন্যুনেজ নামের
লোকটা তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায়। ওরা চিৎকার করে হারিয়ে যাওয়া লোকটার নাম ধরে
ডেকেছিল, মুখে সিটি বাজিয়েছিল, কিন্তু ন্যুনেজ নামের লোকটা আর সাড়া দেয়নি।
সকালের আলো ফুটতে, ওর পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার
চিহ্নরেখা দেখেছিল পর্বতারোহীরা। তাদের মনে হয়েছিল, লোকটা মরে
যাওয়ার আগে সামান্য আওয়াজ করার পর্যন্ত সময় পায়নি। পাহাড়ের পূবদিকে, অজ্ঞাত জায়গায়
গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল সে। বরফের ঢালের একটা খাঁজে আটকে আরও নিচে আছড়ে পড়েছিল
হিমবাহের বয়ে যাওয়া খাতে। তারপর কিছুই তাদের গোচরে আসছিল না। দূরে আরও নিচে এক সংকীর্ণ
উপত্যকায় ভাসা ভাসা নজরে আসছিল ঘন নিবদ্ধ গাছের সারি সারি মাথা। কিন্তু আর পাঁচটা
সাধারণ উপত্যকার সঙ্গে সেই উপত্যকার কোনও পার্থক্য খুঁজে পায়নি তারা, জানতেই
পারেনি সেটা ছিল পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই দৃষ্টিহীনদের দেশ। ন্যুনেজকে খুঁজে
বার করার চেষ্টা বৃথা বুঝতে পেরে, আশাহত হয়ে বিকেলের দিকে অভিযাত্রীরা ফিরে এসেছিল
ক্যাম্পে, বাতিল হয়েছিল তাদের পাহাড়শৃঙ্গ অভিযান।
কিন্তু পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে পড়ে গিয়েও ন্যুনেজ নামের
লোকটা বেঁচে গিয়েছিল। ঢাল বেয়ে হাজার ফুট গড়িয়ে গিয়ে তার শরীর বরফের সমুদ্রে আছড়ে
পড়ে, আরও খাড়া ঢালানে নিচে নামতে নামতে, ঘুরতে ঘুরতে, নিচে সজোরে নেমে আসে। তারপর
এক নরম বরফের পুঞ্জে তার দেহ ডুবে যায়। নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে
যায় সে। এই মারণাত্মক পতনে কিন্তু তার দেহের একটা হাড়ও ভাঙেনি। হুঁশ
ফিরে পেতেই তার মনে হয়েছিল, সে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের নরম বিছানায় শুয়ে আছে। তারপর
যখন আকাশের টিমটিমে তারারা তার দৃষ্টিগোচর হল, তখন পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা দিয়ে
বুঝতে পেরেছিল যে, সে পাহাড়ের খাদে গড়িয়ে পড়েছে। চেতনা ফিরে আসতে ধীরে ধীরে নিজের
হাত-পা খুঁজে পেয়ে ও দেখেছিল সব ক’টা বোতাম ছিঁড়ে গিয়ে কোটটা গা থেকে খুলে মাথার
উপর আটকে আছে। উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে পকেট হাতড়ে দেখল — চাকুটা হারিয়ে গেছে, আর মাথার
টুপিটাও উধাও, যদিও শক্ত করে চিবুকের সঙ্গে সেটা বাঁধা ছিল। যতদূর তার মনে পড়ল,
পাহাড়ের মাথায় রাতের আশ্রয় বানানোর জন্য সে আলগা পাথর খুঁজতে বেরিয়েছিল। তারপর?
হাতের তুষার কুঠারটাও হারিয়ে গেছে কোথায় কে জানে?
অন্ধকারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড়ের দিকে সে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল
কিছুক্ষণ। তারপর প্রতীক্ষা করতে থাকল কখন রাতের আঁধার কেটে যায়। অনেক পরে সে বুঝতে
পারল — হিমবাহের একেবারে নিচে সে পড়ে আছে, একেবারে একা। দুই পায়ে ভর করে উঠে
দাঁড়াতে গিয়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল ন্যুনেজ। তারপর কোনোরকমে নিজেকে সামলে
নিয়ে, চারধারের বরফের উপর ভারসাম্য বজায় রাখতে রাখতে, টলতে টলতে পা রাখল তৃণভূমিতে। পকেটে জলের বোতল খুঁজে
পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঘাসের উপর শুয়ে পড়তেই ক্লান্ত শরীর জুড়ে নেমে এল ঘুম।
সকাল হতে পাখিদের মিঠে কলরবে ন্যুনেজের ঘুম ভেঙে
গেল। তারা
অনেক নিচে গাছের মাথায় মাথায় ভিড় করেছে। চোখ মেলতেই সে নিজেকে খুঁজে পেল ভয়ঙ্কর
গিরিসংকটের মধ্যে। দু’দিকে প্রকাণ্ড পাথুরে পাহাড়, তার মাঝ দিয়ে অনেক অনেক নিচে
নেমে গেছে গভীর গিরিখাদ। একদিকের পাহাড় ভেঙে পড়ে নামার রাস্তা গিয়েছে বন্ধ হয়ে।
যতটা কঠিন খাড়া বরফে ঢাকা পাহাড় তার মাথার উপর বিরাজমান, ততটাই খাড়া পাহাড় নিচে নেমে
গেছে, যা অতিক্রম করা যে কোনো দক্ষ পর্বতারোহীর পক্ষেও কঠিন। একটু ভালো করে
পর্যবেক্ষণ করতেই নজরে এল চিমনির মতো সরু এক পাথুরে ফাটল, বরফ গলা জল সেখান থেকে
চুইয়ে পড়ছে। তার মতো ওস্তাদ পর্বতারোহীর পক্ষে খুব একটা কঠিন হল না সেই পথ বেয়ে
নিচে নামা। নিচে নামতেই নজরে এল বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা পাথুরে
কুঁড়েঘর। ঠিক তখুনি মাথার উপর সূর্যের আলো গেল সরে। পাখিদের ডাক কমে আসতে
লাগল। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে দিনের বেলাতেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে এল। খিদেয় তার
পেটে জ্বালা ধরছিল। সামনেই পাথরের ফাটলে বিচিত্র এক গুল্মলতা দেখে হাত বাড়িয়ে লোকটা
তার কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে চিবোতে শুরু করল। খালি পেটে মন্দ লাগল না। খিদের বোধ কমে
এল।
দুপুর নাগাদ ন্যুনেজ গিরিখাদের কণ্ঠ ধরে নেমে এল উপত্যকার
সবুজ গালিচায়। সূর্যের আলো তখন প্রখর। অবসন্ন শরীরে বিরাট এক পাথরের ছায়ায় সে বসল
দু’দণ্ড বিশ্রাম নিতে। পাশে বয়ে চলা ঝরনা থেকে ভরে নিল নিজের জলের বোতল। তারপর জল
খেয়ে সামনের কুঁড়েঘরের দিকে হেঁটে চলল। অচেনা জায়গাটা খুব শান্ত, অনাজ্ঞাত। তবে
যেদিকে দু’চোখ যায়, শুধু সবুজ তৃণভূমি, রঙবেরঙের ফুলের গাছ। আবার কারা যেন সযত্নে
সেচের ব্যবস্থা করে নানা ফল আর শস্য ফলিয়েছে। উপত্যকা ঘিরে আছে সুউচ্চ পাথুরে
দেয়াল, যেখান থেকে বিভিন্ন জলের ধারা বেরিয়ে এসে জমি সিঞ্চিত করছে। উপত্যকার ঢালু
উঁচু জমিতে চড়ে বেড়াচ্ছে ভেড়ার পাল। সীমানার প্রাচীরের মাঝে মাঝে রয়েছে ভেড়াদের
আস্তাবল। জলের সব ধারা এসে মিশে গেছে উপত্যকার ঠিক মাঝে এক নীল হ্রদে। পরিকল্পিত
ভাবে সাজানো সাদা-কালো পাথর দিয়ে তৈরি পথ উপত্যকা চিরে চলে গেছে। প্রধান পথের দু’ধারে
সাজানো সব পাথরের তৈরি সার সার ঘর। ঘরগুলোর বিচিত্র এলোমেলো রঙের বাহারি
পলেস্তরা দেখে ন্যুনেজের মনে হল, কারিগরদের রঙ মেলানোর দক্ষতার অভাব। তাদের দৃষ্টি
যেন বাদুড়ের মতো ক্ষীণ।
একটা ঢালু জায়গায় এসে সন্তর্পণে সে নামল দেয়ালের
ধার বরাবর, যেখান দিয়ে জলের ধারা উপত্যকার সবুজ গালিচায় মিশে গেছে। ঘাসের উপর অনেক
নারীপুরুষ শুয়ে। যেন
তারা এই ভরদুপুরে লম্বা ঘুম দিয়েছে। হঠাৎ ন্যুনেজের চোখে পড়ল, একটু দূরে তিনটি লোক
হেঁটে চলেছে। গায়ে তাদের ভেড়ার চামড়ার পোশাক, পায়ে চামড়ার জুতো, কোমরে চামড়ার
বেল্ট, মাথায় কাপড়ের তৈরি কান-ঢাকা টুপি। একে অপরকে অনুসরণ করে তারা ধীরে ধীরে
হেঁটে চলেছে। চলতে চলতে এমনভাবে হাই তুলছে, যেন সারা রাত তারা দু’চোখের
পাতা এক করতে পারেনি। একটু ইতস্তত করে ন্যুনেজ একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশে
এত জোরে চিৎকার করে হাঁক পাড়ল, যে সেই শব্দ প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ে বাজতে লাগল
গোটা উপত্যকা জুড়ে।
ন্যুনেজের চিৎকার শুনে লোকগুলো দাঁড়িয়ে পড়ে শব্দের
উৎস খুঁজতে লাগল। ঘাড় এদিক ওদিক ঘুরতে থাকলেও ন্যুনেজকে তারা আবিষ্কার করতে পারল
না। পাহাড়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে লোকগুলো প্রতি উত্তর দিলেও, সরাসরি তার দিকে ফিরে
তাকাল না। আরও দু-একবার চেঁচিয়ে কোনো ফল না পেয়ে রেগে গিয়ে ন্যুনেজ
নানা অঙ্গভঙ্গি করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হল। একটা মাত্র শব্দ তার মাথায় খেলা
করে গেল – ‘অন্ধ’। তার বোধ বলল — এই বোকা
লোকগুলো অন্ধ না হয়ে পারে না।
পাথরের দেয়াল টপকে, জলের ধারার উপর পাতা সেতু বেয়ে,
উপত্যকার দরজা পেরিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ন্যুনেজ একবারে স্থিরনিশ্চয় হয়ে গেল
যে, লোকগুলো একেবারে অন্ধ! সে বুঝে গেল, এই হচ্ছে সেই দৃষ্টিহীনদের দেশ, যার কথা
লোককথায় শোনা যায়। লোক তিনটে তাকে দেখতে না পেলেও কান খাড়া করে শুনতে লাগল অপরিচিত
পায়ের শব্দ। পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বন্ধ চোখের পাতার নিচে তাদের চোখের মণি
নাড়াচাড়া করতে লাগল। তাদের মুখের অভিব্যাক্তিতে ফুটে উঠল এক অজানা ভীতি।
“একটা মানুষ!” স্প্যানিশ ঘেঁষা ভাষায় বলে উঠল
তিনজনের একজন। “মানুষ নাকি কোনো আত্মা? পাহাড় থেকে নেমে এল মনে হচ্ছে!”
দৃষ্টিহীনদের দেশ নিয়ে যা কিছু এতদিন শুনে এসেছে ন্যুনেজ,
সেই সব কথা মনে ভিড় করে এল। প্রাচীন এক প্রবাদ তার স্মরণে এল – “অন্ধ দেশে কানা
রাজা।”
তিনজনের একজন তার পাশের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, “পেড্রো, কোথা থেকে এল এই
অচেনা মানুষটা?”
“পাথর ফাটিয়ে খুব সম্ভব কোরিয়া!”
“না, আমি ওই আস্ত পাহাড়টা ডিঙিয়ে এসেছি এই দেশে। ওই দূর দেশ থেকে... যেখানে
মানুষ চোখে দেখতে পায়, সে দেশের নাম বগোটা... শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে মানুষ সেখানে
থাকে... শহরের একদিক থেকে আর একদিক দেখা যায় না...।”
“চোখে দেখা! চোখে দেখা…” বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে পেড্রো।
ওরা তিনজন হাত বাড়িয়ে ন্যুনেজকে স্পর্শ করতে চাইল। ছোঁয়া
বাঁচাতে পিছিয়ে যায় ন্যুনেজ।
“এদিকে এসো!” কড়া গলায় আদেশ করে ন্যুনেজের পদক্ষেপ
বুঝে নিয়ে তার হাত ধরে তৃতীয় জন। তারা সবাই ন্যুনেজকে হাত দিয়ে অনুভব করতে থাকে।
“দ্যাখো, এ একজন মানুষ, যে কথা বলতে পারে,” তৃতীয়
জনের গলায় বিস্ময়।
“তুমি তাহলে এই পৃথিবীরই এক মানুষ!” পেড্রো জিজ্ঞেস
করে ন্যুনেজকে।
“না, অন্য পৃথিবীর, অনেক দূরের ওই পাহাড়... পাহাড়
পেরিয়ে, হিমবাহ পেরিয়ে... যেখান থেকে পাহাড় পেরিয়ে সমুদ্রে যেতে বারো দিন লেগে
যায়...।”
ওরা ন্যুনেজের কোনো কথাই যেন বুঝতে পারে না। কোরিয়া নামের লোকটা বলতে থাকে,
“আমাদের বাপ-জ্যাঠারা বলত মানুষ নাকি প্রকৃতির দান... গরম... বাস্প দিয়ে তৈরি...
পচে যাওয়া জিনিস সব...।”
“চলো একে বরং বড়োদের কাছে নিয়ে যাই,” পরামর্শ দেয়
পেড্রো।
“দাঁড়াও! আগে চিৎকার করে বাচ্চাদের সাবধান করে দাও। এর কথা হঠাৎ জানতে পারলে
ওরা ভয় পেয়ে যাবে,” উত্তেজিত গলায় বলে কোরিয়া।
চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করে দেয় ওরা। ন্যুনেজ নিজের হাত ছাড়িয়ে
নেবার চেষ্টা করে বলে, “আমি চোখে দেখতে পাই।”
“চোখে দেখতে পাও? দেখা... দেখা মানে?” পেড্রো জানতে
চায়। হাত ছাড়াতে গিয়ে রাস্তায় হোঁচট খায় ন্যুনেজ।
“ওর অনুভূতিগুলো এখনও অপরিণত। দেখছ না, কেমন হোঁচট
খাচ্ছে! ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখো দেখি!” মন্তব্য করে কোরিয়া।
ন্যুনেজ মনে মনে হেসে উঠে ভাবে, সময় এলে ধীরে ধীরে
এদের সব শিখিয়ে নিলেই হবে। ব্যাটারা মহা আহাম্মক, চোখে না দেখতে পেয়ে ওকে ভুল
বুঝছে।
অনেক লোক রাস্তার মাঝে ভিড় করে এক আজব জীবকে অনুভব
করার জন্য, তাকে পরখ করার জন্য হুড়োহুড়ি ফেলে দেয়। ন্যুনেজের ধৈর্যে ভাঁটা পড়ে। আশানুরূপ সব ঘটনা ঘটছে না
বলে কমতে থাকে তার আত্মবিশ্বাস। বাচ্চা-বুড়ো-নারী-পুরুষ, সবাই হাতের স্পর্শে ন্যুনেজকে
পরখ করে দেখতে চায়।
এই দেশের সব মানুষ বড়ো নরম গলায় কথা বলে, তাই নিজের
গলার স্বর নিজের কাছেই কেমন কর্কশ ঠেকে ন্যুনেজের। কেউ তার গায়ের গন্ধ
শুঁকতে চায়, কেউ দূরে দাঁড়িয়ে থেকে কান খাড়া করে নুনেজের প্রতিটি পদক্ষেপ মাপতে
থাকে। তিনজন লোক তার গায়ের সঙ্গে লেগে আছে, তাকে সযত্নে ধরে আছে,
যেন সে পাহাড় থেকে পাওয়া এক মহামূল্যবান সম্পত্তি।
একজন সবার দিকে ফিরে উচ্চস্বরে বলে, “এর নাম বগোটা। পাথর ফাটিয়ে ওই
পাহাড়চূড়া থেকে আসা এক বিচিত্র মানুষ।”
“বনমানুষ! ও বন্য ভাষায় কথা বলে,” পেড্রো উক্তি
করে। তারপর ন্যুনেজের উদ্দেশে গলা নামিয়ে বলে, “তুমি কি বুঝতে পারছ বগোটা?” আবার
গলা তুলে অন্য সকলের উদ্দেশে বলে, “ওর বুদ্ধি এখনও পরিণত হয়নি। সবে কথা বলা শিখেছে
মাত্র...”
পেড্রোকে থামিয়ে দিয়ে ন্যুনেজ চিৎকার করে ওঠে,
“এইও! আমি শহরের মানুষ... একটা বিরাট পৃথিবীর সভ্য মানুষ... যেখানে সবার
দৃষ্টিশক্তি আছে... তোমাদের মতো দৃষ্টিহীন নয় সেখানকার মানুষ।”
“ওর নাম বগোটা, ও হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খায় এখনও...”
বলতে বলতে ওরা ন্যুনেজকে একটা ঘরের খোলা দরজা দিয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়।
ধাক্কা খেয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ন্যুনেজ। অন্ধকারে নিজের চোখ সইয়ে
নিয়ে দেখে, ঘরের এক কোনায় ঢিমে আগুন জ্বলছে, আর সামনে বসে আছে একজন বৃদ্ধ। পিছু নেওয়া জনতা ঘরের
দরজা বন্ধ করে দেয়। অন্ধকারে নিজেকে সে খুঁজে পায় বসে থাকা মানুষটার পায়ের সামনে।
অনেক মানুষ একসঙ্গে হাত দিয়ে ন্যুনেজের গায়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকে, তাকে স্পর্শ
করে পরখ করে। ন্যুনেজ চিৎকার করে ওঠে, “আমি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না,
মাটিতে পড়ে গেছি।”
ন্যুনেজের চিৎকার শুনে সবার গলার আওয়াজ থেমে যায়
কিছুক্ষণের জন্য। মনে হয়, ঘর ভর্তি লোক যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়ে তার কথা বোঝার
চেষ্টা করছে। তারপর কোরিয়ার গলা শোনা যায়, “ও এইমাত্র জন্মেছে। হাঁটতে গিয়ে হোঁচট
খায়, এখনও ওর কথা স্পষ্ট নয়, নিরর্থক কথা বলে।”
অন্যরা ফিসফিস করে তার সম্পর্কে যে সব কথা বলে, তার
অনেকটাই দুর্বোধ্য ঠেকে ন্যুনেজের কাছে। উঠে বসতেই ন্যুনেজকে প্রশ্ন করা শুরু করে
বয়স্ক অন্ধ মানুষটি। প্রত্যুত্তরে সে বুঝিয়ে বলতে থাকে — সে এক বিশাল পৃথিবীর সভ্য
মানুষ, কেমন করে সে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়েছিল, হিমবাহের পিচ্ছিল পথ বেয়ে নিচে পড়ে
গিয়েছিল তার শরীর, কেমন করে সৌভাগ্যক্রমে নির্ঘাত মৃত্যু থেকে সে বেঁচে যায়।
কিন্তু হায়, ন্যুনেজের কথার বেশিরভাগটাই তাদের
বোধগম্য হয় না। লোকগুলোকে বোঝানো যায় না সব কথা। চোদ্দ পুরুষ ধরে দৃষ্টিহীন মানুষ
চক্ষুষ্মানদের দেশ থেকে বহুকাল বিচ্ছিন্ন থাকায় দৃশ্যমান জগতের বেশিরভাগ জিনিসের
নাম আজ ভুলে গেছে। স্মৃতিতে ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে সে জগত সম্বন্ধে যা কিছু এরা
আজ জানে, সবই যেন ছেলেভুলানো রূপকথা। এই পাথুরে পাহাড়ের দেয়ালের মাঝে এই ছোট্ট
উপত্যকার বাইরের জগতের সম্পর্কে তারা উদাসীন, অনভিজ্ঞ।
এই দেশে অনেক বুদ্ধিমান দৃষ্টিহীনের জন্ম হয়েছে। কিন্তু তারাও চোখে দেখা
সময়ের সব স্মৃতি পৌরাণিক গল্প কথা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তি দিয়ে প্রমাণ
করেছে – চোখে দেখতে পাওয়া এক চরম ভ্রম। তারা নতুন নতুন আবিষ্কার করে গড়ে তুলেছে
তাদের জগত। গোটা গোষ্ঠী তাদের মনের কোনায় এক অদ্ভুত কল্পনার জগৎ গড়ে তুলেছে,
দৃষ্টিহীনতায় যা অনেকটাই সঙ্কুচিত। কিন্তু অনেক বেশি সংবেদনশীল কান আর আঙুলের
সাহায্যে তারা উদ্ভাবনী হয়ে উঠেছে, একেবারে অন্যভাবে।
ধীরে ধীরে ন্যুনেজ বুঝতে পারল, নিজের দুনিয়া নিয়ে
যা কিছু সে এদের বলেছে, যা কিছু নিয়ে তার গর্ব, সে সব তার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা
জাগাতে পারেনি দৃষ্টিহীনদের কাছে। সে বুঝল — দৃশ্যমান জগতের যাবতীয় বর্ণনা এই
দেশের মানুষের কাছে নিছক নবজাতকের অসংলগ্ন চিন্তার প্রকাশ। সবচাইতে বৃদ্ধ মানুষটা ন্যুনেজকে
জীবন, দর্শন আর ধর্ম সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে লাগল। সে জানাল, কেমন করে পাথরের বুকে
ফুটো করে তৈরি হয় পৃথিবী (তাদের উপত্যকা), কারও হাতের স্পর্শ ছাড়াই এক এক করে জড়
বস্তু তৈরি হতে থাকে, জীবন আসে আরও পরে, ভেড়া আর অন্য প্রাণীরা কেমন করে জন্মায়, তারপর
জন্ম নেয় মানুষ। আর সবশেষে আসে দেবদূতেরা — যাদের গানের আওয়াজ শোনা যায়, কিন্তু
তাদের ছোঁয়া যায় না। ন্যুনেজ দেবদূতদের কথা শুনে হকচকিয়ে যায়, তারপর অনুমান করে,
দৃষ্টিহীনেরা পাখিদের কথা বলছে।
বৃদ্ধ বকবক করতে থেকে রায় দেয়, “মানসিক বৈষম্য আর
ভারসাম্যহীন শরীর নিয়ে বিশেষভাবে প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট এই বিচিত্র জীব জন্ম
নিয়েছে কেবল আমাদের সমস্ত আহরিত জ্ঞান শেখার জন্য।”
বৃদ্ধের কথায় সায় দিয়ে অন্ধকারে উপস্থিত সব
উপত্যকার বাসিন্দা গুঞ্জন করে ওঠে।
বৃদ্ধ বোঝাতে থাকে, এক একটা দিন কেমন ভাবে গরম আর
ঠাণ্ডা সময়ে ভাগ করা (দৃষ্টিহীনদের কাছে দিন আর রাত এইভাবেই ধরা দেয়)। যেহেতু রাত (দিন হল
দৃষ্টিহীনদের রাত) শেষ হয়ে এসেছে, এখন সবার উচিত কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া। তারপর সে
ন্যুনেজের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে, ঘুমানো কাকে বলে সে কথা তার জানা আছে কিনা। ন্যুনেজ
সায় দিয়ে বলে, “আমি ঘুমোতে জানি, তবে ঘুমানোর আগে কিছু খেতে চাই।”
ন্যুনেজের জন্য ওরা এনে দেয় ভেড়ার দুধ আর নোনতা
রুটি। তাকে নিয়ে যায় এক নিভৃত জায়গায়, যেখানে ওর খাবার খাওয়ার আওয়াজ কারও কানে
পৌঁছবে না। তারা ন্যুনেজকে ছেড়ে ঘুমোতে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে
রাত নামে। রাত আসন্ন হলেও ন্যুনেজ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে না। মেঝেতে হাতের
উপর ভর করে আধশোয়া হয়ে সে ভাবতে থাকে তার বর্তমান পরিস্থিতির কথা। নিজের কথা ভেবে
শব্দ করে হেসে উঠে পরক্ষণে প্রবল ক্রোধে ফেটে পড়ে ভাগ্যকে দোষ দিতে থাকে ন্যুনেজ।
“হতভাগা মন!” সে বিড়বিড় করে, “কোনো মানে আছে? ওরা
জানে না, ওরা ঈশ্বরপ্রদত্ত এক রাজা... এক প্রভুকে পেয়েছে। ওদের আমাকে মানুষ করে
তুলতে হবে, এজন্য ভাবতে হবে... আরও ভাবতে হবে...”
হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে সে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়
তাকে দৃষ্টিশক্তি দেবার জন্য।
কে যেন দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “ওহে বগোটা, এদিকে এস
তো!”
ডাক শোনামাত্র ন্যুনেজ উঠে দাঁড়ায়। সে ঠিক করে — দৃষ্টি
মানুষকে কী ক্ষমতা দেয়, এবার এদের দেখিয়ে দিতে হবে। ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে
হবে। তারা ওকে ধরতে চাইবে, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি না থাকায় হাতের নাগালে তাকে না পেয়ে
বোকা বনে যাবে। কিন্তু তার জানা ছিল না, দৃষ্টির চাইতেও তীব্র ছিল ওদের অনুধাবন
শক্তি।
“একদম নড়ো না বগোটা,” ধমকে উঠল একটা লোক।
ন্যুনেজের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। শব্দ না করে চকিতে
চুপিসারে রাস্তা থেকে দুই পা সরে গিয়ে ঘাসের গালিচায় নেমে গেল সে।
“ঘাস মাড়িয়ে দিও না বগোটা, এমন করা নিষেধ!”
ন্যুনেজ নিজেকে সংযত করে নিতে নিতে চমকে গিয়ে আবার
রাস্তায় উঠে পড়ল। এবার লোকটা তার দিকে দৌড়ে এল। ন্যুনেজ এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“এই যে আমি!”
রেগে গিয়ে ধমকে উঠল লোকটা, “ডাকছি, অথচ তুমি আসছ না
কেন? তোমাকে কি বাচ্চা ছেলের মতো রাস্তা বাতলাতে হবে? হাঁটলে তুমি রাস্তায় তোমার
পায়ের শব্দ শুনতে পাও না?”
হাসতে হাসতে ন্যুনেজ বলে, “কী লাভ তাতে? আমি দেখতে
পাই যে!”
“‘দেখা’ বলে কোনও শব্দ হয় না। বোকা বোকা কথা না বলে
আমাকে অনুসরণ কর।”
রাগে গরগর করতে করতে ন্যুনেজ লোকটার পিছনে পিছনে
হেঁটে যেতে যেতে বিড়বিড় করতে লাগল, “সময় এলে আমিও মজা দেখাব, একটু অপেক্ষা কর
তোরা।”
“শেখো শেখো, শেখার অনেক কিছু আছে। তুমি পারবে,” ন্যুনেজকে
আশ্বাস দেয় লোকটা।
“তোমাদের কেউ বলেনি যে, অন্ধদেশে কানা রাজা?”
ন্যুনেজের ঠোঁটের কোনায় ফুটে ওঠে ব্যাঙ্গের হাসি।
“অন্ধ বলতে কী বোঝায়?” ঘাড় ঘুড়িয়ে জিজ্ঞেস করে
লোকটা।
জোরে জোরে হেসে ওঠে ন্যুনেজ। কানে হাত চাপা দেয়
সবাই।
চার দিন কেটে গেল। পঞ্চম দিনেও ‘অন্ধ দেশের কানা
রাজা’ একই রকম অজ্ঞাত, অপরিচিত রয়ে গেল। অকেজোই রয়ে গেল সে তার প্রজাদের কাছে। নিজের আভিজাত্য প্রমাণ করা আরও
কঠিন হয়ে দাঁড়াল তার কাছে। দৃষ্টিহীন দেশে বিদ্রোহ করার সব প্রচেষ্টা তার ব্যর্থ
হল। কিন্তু সে শিখে ফেলল দৃষ্টিহীনদের দেশের সব প্রথা, সব আদবকায়দা। রাত জেগে কাজ
করাটা তার কাছে সব চাইতে অস্বস্তিজনক মনে হল। তাই সে ভাবল – এই প্রথাটাই সবার আগে
বদলানো দরকার।
দৃষ্টিহীন মানুষেরা ছিল সরল ও পরিশ্রমী। জীবনের
জন্য প্রয়োজনীয় সব সুখ শান্তি তাদের ছিল। তারা চাষ করত, কিন্তু শোষণ করত না। তাদের
প্রয়োজনীয় জামাকাপড় আর খাদ্যের অভাব ছিল না। তারা গান গাইত, বাজনা বাজাত। তাদের
মধ্যে অপ্রতুল ছিল ভালোবাসা। দেখার মতো ছিল তাদের আত্মবিশ্বাস, কী নিখুঁত দক্ষতায় তারা
তাদের পৃথিবীতে গড়ে তুলেছিল শৃঙ্খলা। যা কিছু তারা সৃষ্টি করেছিল, সে সবই ছিল
তাদের প্রয়োজনমাফিক। উপত্যকার প্রতিটি ঝলমলে রাস্তা একে অপরের সঙ্গে সমান কোণে
বিছানো হয়েছিল। রাস্তার অসমান জায়গাগুলো ভরাট করা হয়েছিল প্রবল সৌন্দর্যবোধ থেকে। জীবনযাপনের
সব পদ্ধতিই ছিল তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী, সহজাত। তাদের অনুভূতির তীব্রতা ছিল অনবদ্য।
বারো হাত দূরে মানুষের সামান্য নড়াচড়ার শব্দ পর্যন্ত তারা শুনতে পেত। নিজের
হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ অবধি তাদের কানে পৌঁছে যেত। খুরপি আর কোদাল দিয়ে তারা অসামান্য
চাষ-আবাদ করত দক্ষতার সঙ্গে। কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি দিয়ে তারা
পাহাড়ে চড়ে বেড়ানো ভেড়াদের দেখভাল করত প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
অসহায় ন্যুনেজ বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলল, “ওহে
নির্বোধের দল। আমার যা কিছু গুণ আছে, তা বোঝা তোমাদের কম্ম নয়, কারণ তোমরা চোখে
দেখতে পাও না। আমি তোমাদের কোনও কথাই শুনতে চাই না।”
এক-আধবার কেউ কেউ ন্যুনেজের কাছে বসে কান খাড়া করে
তার কথা শুনে দৃষ্টি ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করল। চোখে দেখতে পাওয়ার কী
সুখ, সে ওদের যথাসাধ্য বোঝাতে চেষ্টা করল। পাহাড়ের বিশালত্ব, আকাশের নানা
রঙ, ডুবে যাওয়া সূর্যের অপার্থিব সৌন্দর্য বর্ণনা করল। কিন্তু তার সব কথা
অবিশ্বাস্য বলে উড়িয়ে দিয়ে দৃষ্টিহীনেরা মজা পেয়ে ওকে উপহাস করা শুরু করল।
ন্যুনেজকে তারা বলল — পাহাড় বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই, যেখানে ভেড়ারা চড়ে বেড়ায়,
সেটাই হচ্ছে পৃথিবীর শেষ সীমা। তার ওপারে আছে ব্রহ্মাণ্ডের ছাদ,
যার গর্ত দিয়ে শিশির ঝরে পড়ে, তুষারপাত হয় পৃথিবীতে। ন্যুনেজ তাদের কথা কেটে
যেই বলল পৃথিবীর না আছে ছাদ, না আছে তার সীমারেখা — ওমনি তারা তীব্রভাবে তার প্রতিবাদে
সোচ্চার হয়ে বলল, “তোমার চিন্তাভাবনায় শয়তান বাসা বেধেছে।”
দৃষ্টিহীনদের বিশ্বাসের জায়গা জুড়ে ছিল পৃথিবীর
কল্পিত ছাদ, যা অত্যন্ত মসৃণ। ন্যুনেজ সেই মিথ্যে বিশ্বাস ভেঙে দিতে গিয়ে দেখল,
কোনোভাবেই তাতে বিন্দুমাত্র চিড় ধরানো সম্ভব নয়। চোখে দেখার ক্ষমতার অসামান্য
ব্যবহারিক দিক সে তাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতে লাগল।
একদিন সকালে সে পেড্রোকে একটা রাস্তা ধরে হেঁটে
আসতে দেখল। পেড্রোর পায়ের আওয়াজ বা গায়ের গন্ধ পাবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না, কারণ
সে অনেকটা দূরে ছিল। ন্যুনেজ তার চারিপাশের লোকদের শুনিয়ে বলল, “ওই যে পেড্রো
এদিকেই আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে এখানে পৌঁছে যাবে। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি,
কিন্তু তোমরা?”
একজন বয়স্ক লোক ন্যুনেজের কথা উপেক্ষা করে বলল,
“পেড্রো কখনোই এখানে আসবে না। অনর্থক বোকা বানাবার চেষ্টা করছ তুমি।”
আশ্চর্য! কোন মন্ত্রবলে যে লোকটা জেনে গেল পেড্রোর
এদিকে আসার সম্ভাবনা নেই? অনেক অপেক্ষা করে পেড্রোর দেখা না পেয়ে, হতাশ হয়ে অন্য
খেলা শুরু করল। সবাইকে সে বোঝাল — উপত্যকার দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়েও সে গ্রামে কী কী
ঘটছে সব দূর থেকে দেখে হুবহু বলে দিতে পারে। উপত্যকার দেয়ালের কাছে গিয়ে অনেক কিছু
নজরে এলেও গ্রামের ভিতরের কোনো দৃশ্য তার চোখে পড়ল না। অথচ তার সঙ্গীটি কোনো এক
অজ্ঞাত পারদর্শিতায় গ্রামের ভিতরে ঘটে যাওয়া দৃশ্যের হুবহু বিবরণ দিতে লাগল।
দৃষ্টিহীনদের কাছে হেরে গিয়ে ন্যুনেজ এক ভয়ঙ্কর
খেলার মতলব করল। সে ঠিক করল খেতে কাজ করার সময় নিঃশব্দে শাবল দিয়ে দু-একজনকে আঘাত
করে দেখিয়ে দেবে তার দৃষ্টিশক্তির কত ক্ষমতা। হাতে শাবল তুলে নিল সে নিঃশব্দে। কিন্তু
অবশ হয়ে গেল তার হাত। শাবল তার হাতেই রয়ে গেল। অন্ধ মানুষদের উপর আঘাত হানতে তার
মন সায় দিল না। আশ্চর্যজনকভাবে দৃষ্টিহীনরা তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে গেল। একজন
কঠিন গলায় ন্যুনেজকে আদেশ করল, “শাবল নামিয়ে রাখো, এখুনি।”
অসহায় ন্যুনেজ ভীষণরকম ভয় পেয়ে হাত থেকে শাবল
নামিয়ে দিয়ে কাঁপতে লাগল। তারপর একজনকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে ছুটে গ্রাম থেকে
পালিয়ে উপত্যকার পাঁচিলের দিকে চলে গেল। ঘাসের গালিচায় তার পায়ের সুস্পষ্ট
ছাপ রয়ে গেল। পাঁচিলে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল ন্যুনেজ। ভয়ার্ত নয়নে এবার সে
দেখতে পেল হাতে বেলচা, শাবল আর লাঠি নিয়ে দলে দলে মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে চারিদিক
থেকে। বাতাসে ন্যুনেজের গায়ের গন্ধ শুঁকে ধীরে ধীরে তারা এগিয়ে এল। ঘাসের উপর ন্যুনেজের
পদচিহ্ন অনুভব করে তারা নিখুঁতভাবে তার অবস্থান বুঝে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল।
বগোটা, কোথায় তুমি? হাতের শাবল ফেলে দাও!” কে যেন
দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল।
রাগে আর অজানা আশঙ্কায় কাঁপতে কাঁপতে ন্যুনেজ উত্তর
দিল, “ফেলব না শাবল। আমি চোখে দেখতে পাই। ওরে অন্ধের দল, আমায় ধর দেখি!”
পিছন ফিরে ন্যুনেজ দেখল খাড়া দেয়াল উঠে গেছে অনেক
অনেক উপরে, যা পার হওয়া কোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব। সে পালাবার পথ খুঁজতে ছুট লাগাল।
কিন্তু বেরোনোর রাস্তা সে খুঁজে পেল না। ওরা তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল। হিংস্র
হয়ে শাবল তুলে নিয়ে ন্যুনেজ একজনের গায়ে সজোরে ঘা বসিয়ে দিল। আর্তনাদ করে লোকটা
মাটিতে পড়ে গেল। পিছন থেকে আরও মানুষ ছুটে এসে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরল তাকে। হাত
থেকে শাবল ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করার জন্য তারা তাকে চিৎকার করে নির্দেশ দিতে
লাগল। কিন্তু ন্যুনেজের মাথায় তখন খুন চেপেছে। ভাগ্যক্রমে ছুটতে ছুটতে
সে পেয়ে গেল বাইরে বেরোনোর ছোট্ট দরজা। দরজা পার হয়ে সে পাহাড়ে চড়তে লাগল। একটা
ভেড়া ঘাস খেতে খেতে তার দিকে মুখ তুলে চাইল, তারপর আবার ঘাস খেতে লাগল। অনেক
মানুষের চিৎকার শোনা যেতে লাগল নিচ থেকে। ন্যুনেজ আরও, আরও উপরে ছুটতে লাগল,
যেখানে ওর নাগাল কেউ পাবে না।
শেষ হল ন্যুনেজের বিদ্রোহের কাল। দৃষ্টিহীনদের
উপত্যকার পাঁচিলের বাইরে দুই দিন দুই রাত সে পড়ে রইল — ক্ষুধার্ত, অভুক্ত। তার
চিন্তনে শুধু একটাই প্রবাদ বারে বারে ফিরে এল — অন্ধের দেশে কানা রাজা। বারে বারে নানা
মতলব তার মাথায় উঁকি দিল — কী উপায়ে তাদের বাধ্য করবে তার বশ্যতা স্বীকার করে
নিতে, কীভাবে তাদের শাসন করবে। কিন্তু কোনো উপযুক্ত উপায় তার
মাথায় এল না। চিন্তা করতে করতেই ন্যুনেজের ক্লান্ত শরীর ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।
ঘুম থেকে উঠে পাইনের বনে খাবার খুঁজতে গেল ন্যুনেজ,
কিন্তু একটাও খাবার মতো বস্তু তার নজরে এল না। হতোদ্যম হয়ে পাহাড়ের গায়ে
চড়ে বেড়ানো ভেড়ার পালে পাথর ছুঁড়ে মেরে ভেড়া মারার চেষ্টা করল। কিন্তু ভেড়াগুলো সন্দেহজনক
অবিশ্বাসী বাদামি চোখে তাকে দেখতে দেখতে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। এবার ভয়
ন্যুনেজকে গ্রাস করল। মনে হল, না খেতে পেয়ে মরার চাইতে দৃষ্টিহীনদের গ্রামে
ফিরে যাওয়াই শ্রেয়।
হামাগুড়ি দিয়ে স্রোতস্বিনী জলের ধারা পেরিয়ে,
ক্লান্ত শরীরে উপত্যকার দরজা পর্যন্ত কোনোক্রমে পৌঁছে গেল ন্যুনেজ। তারপর চিৎকার
করে দৃষ্টিহীনদের ডাকতে লাগল। ওর কাকুতি মিনতি শুনে দু’জন দৃষ্টিহীন মানুষ
উপত্যকার দরজায় এসে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। বাঁচার শেষ অবলম্বন সম্বল করে
ডুকরে কেঁদে উঠল ন্যুনেজ। বলল, “আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তো আমি সবে
জন্মেছি, আমার বোধবুদ্ধি কিছুই ছিল না। আমায় বাঁচাও।”
তারা বলল, “এই ভালো। তবু যা হোক, তোমার
বুদ্ধিশুদ্ধি ফিরে এসেছে!”
“আমি আগের চাইতে আর একটু বেশি জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছি।
আমার কৃতকর্মের জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। অনুশোচনায় আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে,” হাউ হাউ
করে কাঁদতে কাঁদতে একেবারে ভেঙে পড়ে ন্যুনেজ।
তার কান্না শুনে ক্ষমা করে দেয় দৃষ্টিহীনেরা। তারা প্রশ্ন করে, “এখনো
তুমি ভাবো যে তুমি চোখে দেখতে পাও?”
“না, আর ভাবি না। সব আমার ভ্রম ছিল। ‘দেখা’ বলে
কোনও শব্দ হয় না, নিরর্থক বললেও কম বলা হয়।”
“তোমার মাথার উপর কী আছে?”
“একশো মানুষ সমান দূরত্বে, আমার মাথার উপর আছে
পৃথিবীর ছাদ, পাথরের তৈরি মসৃণ ছাদ, খুব খুউব মসৃণ, সেখান থেকে চুইয়ে পড়ে শিশির,
ঝরে পড়ে বরফ। এবার আর প্রশ্ন কোরো না, বরং কিছু খেতে দাও, নইলে আমি মরে যাব,”
কান্নায় ভেঙে পড়ে ন্যুনেজ।
ন্যুনেজের মনে হয়েছিল তার অপরাধের কঠিন শাস্তি হবে।
কিন্তু দৃষ্টিহীনেরা তার বিদ্রোহকে নিছক বোকামো আর সংকীর্ণতায় আক্রান্ত মানসিক
বৈকল্য বলে মেনে নিয়েছিল। শুধু দশ ঘা চাবুকের আঘাত করে শাস্তি দিয়ে তাকে বহাল করা
হয়েছিল সবচাইতে সরল সাম্প্রদায়িক যৌথ কাজে। তারপর থেকে ‘অন্ধদেশে কানা রাজা’ হতে
চাওয়া মানুষটা সারা জীবন কাটিয়ে দেয় দৃষ্টিহীনদের দেশে, স্বাধীনভাবে।
--------
মূল গল্পঃ এইচ জি ওয়েলস-এর The City of Blinds
--------
লেখক পরিচিতিঃ উনবিংশ শতাব্দীতে গ্রেট ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ করেন
এইচ জি ওয়েলস। ষাট বছরের অসামান্য সাহিত্যিক জীবনে প্রচুর গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ
লিখে যান তিনি। সায়েন্স ফিকশনের জনক বলে তাকে আখ্যা দেওয়া হলেও অনেক মানবধর্মী
গল্প লিখে যান এই সাহিত্যিক। এই গল্পটি তার মধ্যে অন্যতম।
--------
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment