গল্পের ম্যাজিক:: কূটবুদ্ধি - প্যাট্রিক লাফকাদিও হার্ন; অনুবাদ : রোহন রায়

কূটবুদ্ধি
প্যাট্রিক লাফকাদিও হার্ন
অনুবাদ : রোহন রায়

[গল্পটির সময়কাল উনিশ শতকের জাপান জাপানের একটি অতি-প্রচলিত লোকবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে গল্পটি রচিত]

নির্দেশ এসেছিল, কাজটা সারতে হবে ইয়াশিকির বাগানে। সেই অনুযায়ী লোকটাকে বাগানে নিয়ে যাওয়া হল। বালি-কাঁকড় ভরা রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসানো হল তাকে। লোকটার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। নুড়ি-ভর্তি বস্তা বেঁধে দেওয়া হল তার চারপাশে, যাতে সে নড়াচড়া না করতে পারে। পর্যবেক্ষক এলেন। সব ব্যবস্থাপনা খুঁটিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে তিনি সবুজ সংকেত দিলেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লোকটা আচমকা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে সে পর্যবেক্ষককে বলল, “আমি কাজটা ইচ্ছে করে করিনি। আমার বুদ্ধির দোষে এটা হয়েছে। আমার দুর্ভাগ্য আর বুদ্ধির দোষ। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে করিনি। নির্বুদ্ধিতার জন্য কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া কিন্তু চরম অপরাধসেই অপরাধের খেসারত আপনাদের দিতেই হবে। আপনারা আমায় হত্যা করলে আমি প্রতিশোধ নেব কারণ আমি নির্দোষ নির্দোষ মানুষকে হত্যা করলে, আপনারা জানেন, মৃত আত্মার ক্রোধ আপনাদের কাউকে রেহাই দেবে না আমি প্রতিশোধ নেবই রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই হবে
জাপানে এটা একটা প্রচলিত লোকবিশ্বাস যে, কোনো মানুষ ন্যায়সঙ্গত ঘৃণা বা ক্ষোভ নিয়ে মারা গেলে তার আত্মার ক্ষমতা থাকে হত্যাকারীর ওপর প্রতিশোধ নেবার উপস্থিত সকলেই সেটা জানে, বিশ্বাস করে লোকটার কথা শুনে সকলেই অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল পর্যবেক্ষক কিন্তু অচঞ্চল উদ্বেগের কোনো চিহ্ন নেই তাঁর মুখের রেখায় শান্ত স্বরে তিনি লোকটাকে বললেন, “মৃত্যুর পর তুমি আমাদের যত খুশি ভয় দেখাতে পারো সে ব্যাপারে কোনো বাধানিষেধ নেই কিন্তু তুমি যেটা বলছ সেটা শুধু মুখের কথায় বিশ্বাস করি কী করে? মৃত্যুর পর তুমি কি এমন কোনো ইঙ্গিত দিতে পারবে, যাতে আমরা তোমার প্রতিশোধস্পৃহা টের পেতে পারি?”
পারব অবশ্যই পারবলোকটা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল
দেখাই যাক,” পর্যবেক্ষক খাপ থেকে তাঁর লম্বা তলোয়ার বের করলেন, “আমি এখন তোমার মাথা কেটে ফেলব তোমার একদম সামনেই একটা বড়ো পাথর দেখতে পাচ্ছ? মাথা ধড় থেকে আলাদা হবার পর তুমি ওই পাথরটায় কামড় দিতে চেষ্টা করবে যদি তোমার ক্রুদ্ধ আত্মা এই কাজটা করতে পারে, আমরা ভয় পেলেও পেতে পারি এবার বল, তুমি কি পাথরটা কামড়াতে পারবে?”
হ্যাঁ আমি পারব,” সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, “আমি পারব আমি দেখিয়ে দেব তোমাদের
সামুরাইয়ের নিপুণ হাতে ঝলসে উঠল তলোয়ার বিদ্যুতের একটা চকিত ঝলক সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ শব্দ ফিনকি দিয়ে ছিটকে উঠল রক্তের দুটো ধারা মুণ্ডহীন দেহটা নুয়ে পড়ল নুড়ি-ভর্তি বস্তার ওপর কাটা মুণ্ডুটা বালি-কাঁকড়ে ঢাকা রাস্তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে বড়ো পাথরটার দিকে এগিয়ে গেল তারপরেই লাফিয়ে উঠল আচমকা সবাই সবিস্ময়ে দেখল, মুণ্ডুটা পাথরের উপরের একটা অংশ কামড়ে ধরেছে যেন প্রবল আক্রোশে দুই সারি দাঁতের মাঝখানে পাথরের অংশটা প্রাণপণে চেপে ধরে ঝুলে আছে মাত্র এক মুহূর্তের জন্যই এই দৃশ্য পরক্ষণেই মুণ্ডুটা মাটিতে খসে পড়ল টিকটিকির কাটা লেজের মতো
প্রচণ্ড আতঙ্কে সবাই অবশ হয়ে গেছে কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না পর্যবেক্ষককে কিন্তু বিচলিত বলে মনে হল না তিনি ধীরেসুস্থে তাঁর তলোয়ারটা তুলে দিলেন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আজ্ঞাবহের দিকে সে তলোয়ারটাকে জল দিয়ে ধুয়ে তুলোট কাগজ দিয়ে যত্ন করে মুছে খাপে ভরে রাখল

শাস্তিদানের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ হল কিন্তু সেখানে যারা উপস্থিত ছিল, তাদের মনে জাঁকিয়ে বসল মৃত্যুভয় মৃত লোকটা যা বলেছিল তার হুবহু প্রমাণ দিয়েছে সবাই দেখেছে সেটা আত্মার প্রতিশোধ যে শাস্তিদানকারীদের জীবনে ভয়ঙ্করভাবে নেমে আসবে, সে বিষয়ে কারও কোনো সন্দেহ ছিল না প্রচণ্ড আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে গেল তারা ঘুম উড়ে গেল নানারকম ভয়ঙ্কর দৃশ্য বা শব্দ হানা দিতে শুরু করল তাদের কল্পনায় বাঁশবাগানে হাওয়ার হাহাকার হোক বা ঘরের পাশে সন্ধের ঘনায়মান ছায়া সব কিছুই যেন আসন্ন মৃত্যুর বার্তা নিয়ে আসছিল তারা আর থাকতে পারল না তারা ঠিক করল, পর্যবেক্ষকের সঙ্গে দেখা করে মৃত লোকটির আত্মার শান্তি-স্বস্ত্যয়নের কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেই বিষয়ে আলোচনা করবে
কোনো দরকারই নেই,” পর্যবেক্ষক কথাটা শুনেই উড়িয়ে দিলেন, “সবাই জানে মরণাপন্ন একজন মানুষের প্রচণ্ড প্রতিশোধস্পৃহা ভয়ের কারণ হতে পারে, বিশেষত সে যদি সত্যিই নির্দোষ হয় কিন্তু এক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কিছু নেই
একজন ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “ভয় পাওয়ার কিছু নেই কেন?”
খুব সোজা ব্যাপার,” পর্যবেক্ষক বললেন, “মরণাপন্ন ব্যক্তির শুধুমাত্র শেষ ইচ্ছেটাই ভয়ঙ্কর হতে পারে আমি যখন ওকে চ্যালেঞ্জ করলাম যে ও ওর প্রতিশোধস্পৃহার কোনো ইঙ্গিত দিতে পারবে কিনা, ওর মনটা কিন্তু তখনই আসল ভাবনা থেকে সরে গেল ও সেই মুহূর্তে প্রাণপণে একটা ভাবনাতেই মনোনিবেশ করছিল, সেটা হচ্ছে পাথরটায় কামড় বসানো ফলে ও মারাও গেল প্রাথমিকভাবে ওই একটাই উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে আর তোমরা তো দেখলেই, ও সেই কাজটা করতেও পেরেছে কিন্তু আর কিছুই করার ক্ষমতা ওর রইল না কারণ ওর প্রতিশোধস্পৃহা ওকে যে অলৌকিক শক্তি দিয়েছিল, তার পুরোটাই খরচ হয়ে গেছে আমাদের প্রমাণ দিতে গিয়েপুরো ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে পর্যবেক্ষক সামান্য থামলেন তারপর স্মিত হেসে বললেন, “তোমাদের কী মনে হয়, আমি কি এমনি এমনি প্রমাণটা চাইলাম?”
সত্যিই কিন্তু মৃত লোকটির আত্মা আর কোনোরকম প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করল না, বা পারল না কিছুই ঘটল না আর
--------
মূল গল্প : Diplomacy - প্যাট্রিক লাফকাদিও হার্ন
ছবিঃ আন্তর্জাল
--------
লেখক-পরিচিতি : লেখক-সাংবাদিক প্যাট্রিক লাফকাদিও হার্ন (১৮৫০-১৯০৪) জন্মসূত্রে ইউরোপীয় হলেও পরবর্তীকালে জাপানের নাগরিকত্ব নেন এবং নতুন নাম নেন কইজুমি ইয়াকুমো আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর তিনি ১৮৯০ সালে একটি সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হিসেবে জাপান যান তারপর জাপানি সংস্কৃতিকে ভালোবেসে বাকি জীবনটা পাকাপাকিভাবে সেখানেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন লেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি মূলত জাপানের মিথ লোককথা-ভিত্তিক ভৌতিক বা অলৌকিক কাহিনি রচনার জন্য জাপানের মাতসু শহরে তাঁর নামাঙ্কিতলাফকাদিও হার্ন মেমোরিয়াল মিউজিয়ামপর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়

1 comment:

  1. অন্য স্বাদের গল্প। সুন্দর অনুবাদ।

    ReplyDelete