কালো দাগ
আগাথা ক্রিস্টি
অনুবাদঃ দীপ্তজিৎ মিশ্র
“তাহলে তুমিই বলো, জেন মাসি,” রেমন্ড ওয়েস্ট বলল।
“হ্যাঁ মাসি। আমরা কিন্তু আশায় আশায় বসে আছি,” রেমন্ডের
কথায় সঙ্গত দিল জয়েস লেম্প্রিয়ে।
মিস মার্পল ভাবলেশহীনভাবে বললেন,
“এবার কিন্তু তোরা আমার পেছনে লাগছিস।
তোরা ভাবছিস আমি এই জনমনিষ্যিহীন জায়গায় থাকি বলে বুঝি আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।”
“আরে রাম রাম! আমি কখন তা বললাম!” রেমন্ড
তড়িঘড়ি করে বলল, “আমি একসময় গ্রামের জীবনযাপনকে সাদামাটা সিধেসাধা ভাবতাম। কিন্তু
তারপর তোমার থেকে যা সব গল্প শুনেছি! এখন তো মনে হয় তোমার এই সেন্ট মেরির চেয়ে
শহুরে জীবন অনেক বেশি শান্তির।”
মিস মার্পল বললেন, “আসলে কী বল তো,
মানুষের স্বভাব সর্বত্রই একই রকম। সে তুই
গ্রাম বলিস, বা শহর। গ্রামে থাকার সুবাদে আমি মানুষের স্বভাবচরিত্রকে
আরও একটু কাছ থেকে দেখতে পারি, এই যা।”
“সত্যিই তুমি অসাধারণ মাসি!” জয়েস বলল। তারপর ও বলল, “আচ্ছা, আমি
তোমাকে মাসি বলি বলে তুমি আবার কিছু মনে করো না তো?
কেন জানি না,
তোমাকে মাসি বলে ডাকতেই ইচ্ছে করে।”
“সে কী রে মেয়ে, সত্যিই জানিস না?”
মিস মার্পলের প্রশ্নে জয়েস তাঁর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে
থাকতেই তার দু’গাল টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠল। রেমন্ড কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরিস্থিতি
স্বাভাবিক করার জন্য গলা খাঁকারি দিল।
মিস মার্পল ওদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে হেসে আবার উল বোনায় মন
দিলেন।
“হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে আমার জীবনে ঘটনার ঘনঘটা নেই, তবে
নানা ছোটো ছোটো সমস্যার সমাধান করতে করতে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর এসব
সমস্যাগুলো সমাধান করতে খুব মাথা খাটাতে হয়েছিল। কিন্তু তোদের বলার মতো বিশেষ কিছু
নয়। মিসেস জোন্সের হাতব্যাগটা কে ছিঁড়ে দিল,
বা মিসেস সিমস কেন তাঁর নতুন পশমের কোটটা
একবার মাত্র পরেছিলেন, সে সব গল্প শুনে তোদের পোষাবে না। তবে যারা মানুষের স্বভাব
নিয়েই নাড়াচাড়া করে, তাদের কাছে ব্যাপারগুলো বেশ চমকপ্রদ। আচ্ছা দাঁড়া, তোদের
বলার তো একটা গল্প আমার ঝুলিতে আছে বটে। আমার ভাইঝি মেবেলের স্বামীকে নিয়ে গল্প।
“আজ থেকে বছর দশ-পনেরো আগের কথা। এখন সে সব বখেড়া চুকে-বুকে
গিয়েছে, সবাই ভুলেও গিয়েছে বিষয়টা। মানুষের যে কোনো কিছু বেশিদিন
মনে থাকে না, তা খুবই সৌভাগ্যের বিষয়।”
মিস মার্পল থামলেন। তারপর বিড়বিড় করে নিজেকে বললেন, “এখানটা
কীরকম হল? গুনতে ভুল করলাম নাকি?
এক,
দুই,
তিন,
চার,
পাঁচ,
হ্যাঁ,
এরপর তিনটে ভাঁজ হবে। হ্যাঁ। এবার ঠিক
হয়েছে। কী যেন বলছিলাম? মনে পড়েছে। মেবেলের কথা বলছিলাম।
“মেবেল আমার ভাইঝি। খুবই ভালো মেয়ে,
কিন্তু একটাই সমস্যা। বড্ড নাটকীয়তা
ভালোবাসে মেয়েটা, আর মন খারাপ থাকলে দরকারের চেয়ে অনেক বেশি কথা বলে। যাই হোক, ওর
যখন বাইশ বছর বয়স, তখন ডেনম্যান নামে একটা ছেলেকে ও বিয়ে করল, কিন্তু
বিয়েটা সুখের হল না। আমি মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম যেন এই বিয়েটা না হয়, কারণ
ডেনম্যান ছিল খুব রগচটা ― মেবেলের শিশুসুলভ আচরণ যে তার পছন্দ হবে না,
সেটা খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। তাছাড়া, আমি
খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, ডেনম্যানের পরিবারে পাগল হয়ে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু মেয়েরা
এখনও যেমন একগুঁয়ে আর জেদি, সেই সময়েও তাই ছিল, হয়তো
ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। যাক সে কথা। মেবেল ডেনম্যানকে বিয়ে করল।
“বিয়ের পরে আমার সঙ্গে মেবেলের খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হত না।
এক কি দু’বার এসে ও আমার কাছে থেকেছিল ক’দিন। তবে ওরা বেশ কয়েকবার আমাকে নিমন্ত্রণ
করেছিল, ওদের বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়ে আসার জন্য। কিন্তু, আমি
অন্য কারুর বাড়িতে থাকতে বিশেষ পছন্দ করি না। কাজেই,
নানা অজুহাতে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। ওদের
বিয়ের বছর দশেক বাদে ডেনম্যান মারা গেল। কোনো ছেলেমেয়ে না হওয়ায় স্বামীর সব
সম্পত্তির মালিক হল মেবেল। আমি মেবেলকে চিঠি লিখে বললাম যে ওর যদি তেমন মনে হয়, ও
এখানে এসে থেকে যাক। কিন্তু মেবেল এল না। উত্তরে ও যে চিঠিটা পাঠাল, সেটা
এতটাই গুছিয়ে লেখা, আমি পড়ে বুঝলাম মেবেল ঘটনাটায় একটুও শোক পায়নি। আমি ভাবলাম
এটা বুঝি খুব স্বাভাবিক, কারণ কয়েক মাস ধরে ওদের মধ্যে মোটে
বনিবনা হচ্ছিল না। কিন্তু তার তিন মাস পরেই মেবেল একটা লম্বা চিঠি পাঠাল যাতে
হাউমাউ করে নানা কথা লেখা আছে। তাতে মেবেল বার বার লিখেছে যে পরিস্থিতি নাকি ক্রমশ
খারাপের দিকে যাচ্ছে, ও আর সামলাতে পারছে না। বার বার করে আমাকে যেতে অনুরোধ
করেছে মেবেল।
“অগত্যা, কী আর করা,
পত্রপাঠ রওনা দিলাম। পৌঁছে দেখি, মেবেল
খুব ঘেঁটে রয়েছে। ওদের বাড়িটার নাম মার্টল ডিন। খুব সুন্দর করে সাজানো বাড়িটা।
বাড়ির দেখভাল করার জন্য একজন কাজের লোক রয়েছে,
একজন রাঁধুনি আছে, আর
মেবেলের শ্বশুরমশাইয়ের মাথায় সামান্য গন্ডগোল থাকায় তাঁকে দেখাশোনা করার জন্যেও
একজন আলাদা লোক রয়েছে। ভদ্রলোক এমনি শান্তশিষ্ট,
কিন্তু ‘একলা বসে ঝিমঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন খেপে’-র
মতো ব্যাপারস্যাপার আর কী। এটা তো হওয়ারই ছিল। আগেই খবর পেয়েছিলাম যে ওদের পরিবারে
পাগল হয়ে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে।
“মেবেলের এই হঠাৎ পরিবর্তন দেখে আমি খুব অবাক হলাম। ওর মতো
একজন প্রাণবন্ত মেয়ের এভাবে চুপ মেরে যাওয়াটা খুব অদ্ভুত ঠেকছিল। এমনকি, কী
হয়েছে তা জানতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছিল আমাকে। বুঝলাম,
সরাসরি কিছু বলবে না। কাজেই, ঘুরিয়ে
প্রশ্ন করতে হল। আমি ওকে ওর বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। এদের কথা মেবেল প্রায়ই
ওর চিঠিতে লিখত। উত্তরে ও যা বলল, তাতে আমি বেশ অবাক হলাম। মেবেল বলল যে ওর
বন্ধুদের সঙ্গে নাকি আজকাল ওর খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হয় না। যতজন বন্ধুর নাম করলাম, সবার
ক্ষেত্রেই একই কথা শুনলাম। তখন আমি ওকে এভাবে সব বন্ধুদের থেকে নিজেকে আলাদা করে
নেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করতে ধীরে ধীরে সত্যিটা বেরোল।
“‘আমি কিছু করিনি। ওরাই আমার থেকে দূরে সরে গেছে। এমনকি, কেউই
আজকাল আমার সঙ্গে কথা বলে না। বাইরে বেরোলে ওরা এমন আচরণ করে যাতে ভুল করেও আমার
সঙ্গে ওদের কথা হওয়া তো দূরের কথা, চোখাচুখি অবধি না হয়। ওদের হাবভাব দেখে
মনে হয় আমি যেন অচ্ছুৎ। এটা আমি আর নিতে পারছি না। আমাকে এভাবে সবাই আলাদা করে
দিচ্ছে কেন? আমি তো কিছু করিনি!’
“ব্যাপারটা শুনে এতটা খারাপ লাগল যে আমি তোদের বলে বোঝাতে
পারব না। তখন বৃদ্ধা মিসেস হে-র জন্য একটা কমফর্টার বুনছিলাম। এসব
শোনার পর এতটাই মনখারাপ হল যে দুটো ভুল সেলাই করে ফেললাম,
আর কমফর্টারটা বোনা প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া
অবধিও ধরতে পারিনি ভুলটা।
“আমি মেবেলকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘কিন্তু,
এই সবের পেছনে তো নিশ্চয়ই কিছু কারণ
থাকবে! কী হয়েছে মেবেল?’
“ছেলেবেলাতেও মেবেল খুব জটিল মানুষ ছিল। কোনো কথার সোজাসুজি
উত্তর বের করতে আমার ঘাম বেরিয়ে যেত। মেবেল যা বলল,
তা খুব ধোঁয়াটে। সবাই নাকি খুব খারাপ, সবাই
খালি পরনিন্দা আর পরচর্চা করে।
“আমি বললাম, ‘সে তো বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তোকে নিয়ে
নিশ্চয়ই কোনো কথা বাইরে রটছে! কিন্তু বাইরের আর পাঁচটা লোকের মতোই তোর
নিজেরও সেই কথাগুলো জানা দরকার। আশা করি কথাগুলো তোর কানে এসেছে। নাহলে তুই এতটা
ভেঙে পড়তিস না। কী হয়েছে, আমাকে বল!’
“‘খুব ভুলভাল কথা, পিসি!’ মেবেল বলল।
“‘জানি তো ভুলভাল কথা। লোকে ওরকমই কথা রটায়। তোর চেয়ে বেশি
মানুষ তো আমি দেখেছি রে মা! কিন্তু,
কী রটাচ্ছে সেটা একটু খুলে বল দেখি!’
“এতক্ষণ সাধ্যসাধনার পর সত্যিটা জানা গেল। জিওফ্রে ডেনম্যান, মানে
আমার ভাইঝির স্বামীর মৃত্যুটা হঠাৎ করে হওয়ায় বাইরে অনেক কানাঘুষো রটছিল। গোদা
বাংলায় বললে, সবাই বলাবলি করছিল যে মেবেলই নাকি তার স্বামীকে বিষ দিয়ে
খুন করেছে।
“তোরা নিশ্চয়ই জানিস,
কথার ধার ছুরি-কাঁচির চেয়েও বেশি। আর এই কথার সঙ্গে
লড়াই করার উপায় অনেকেই জানে না। লোকে আড়ালে তোর ব্যাপারে নানা বাজে কথা বললে
সেগুলো কাটানোর কোনো উপায়ই তোর কাছে থাকবে না। তুই কোনোভাবেই তাতে বাধা দিতে পারবি
না। আর এই রটনা চলতেই থাকবে। আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। মেবেলের পক্ষে
কাউকেই বিষ দিয়ে খুন করা সম্ভব নয়। আর ওর বোকামির জন্য ওর জীবনটা এভাবে শেষ হয়ে
যাবে, সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না।
“কাজেই, মেবেলকে বললাম,
‘দেখ মেবেল,
যা রটে,
তার কিছু তো বটে!
লোকে নিশ্চয়ই এমনি এমনি এই কানাঘুষোটা
রটাচ্ছে না! কিছু একটা তো ঘটেছিল নিশ্চয়ই!
কী থেকে এই রটনার সূত্রপাত, সেটা
আমাকে বল।’
“মেবেল খুব ভাসা ভাসাভাবে যা বলল,
তাতে বুঝলাম কোনো ছোট্ট ঘটনাও ঘটেনি, যার
থেকে এই রটনার সূত্রপাত হতে পারে। খালি জিওফ্রে হঠাৎ করেই মারা গিয়েছিল। সেদিন
রাতে খাওয়াদাওয়ার সময়েও সুস্থ ছিল মানুষটা,
কিন্তু রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ডাক্তার ডাকা হয়, কিন্তু ডাক্তার আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেচারা মারা যায়।
সন্দেহ করা হয়েছিল, বিষাক্ত মাশরুম খাওয়ার ফলেই মৃত্যু হয়েছে জিওফ্রের।
“সব শুনে আমি বললাম,
‘হুম,
এরকম একটা হঠাৎ মৃত্যুতে মানুষ কৌতূহলী
হবেই। কিন্তু তার সঙ্গে নতুন তথ্যগুলো কোত্থেকে জুড়ল?
তার তো কোনো ভিত্তি থাকবে! তোর
সঙ্গে কি জিওফ্রের সম্প্রতি কোনো ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হয়েছিল?’
“মেবেল স্বীকার করল যে সেদিন সকালেই তার সঙ্গে জিওফ্রের
একচোট ঝগড়া হয়েছিল।
“‘আর সেটা চাকরবাকররা শুনতে পেয়ে যায়, তাই
তো?’
“‘ওরা কেউ ঘরে ছিল না।’
“‘তা বটে, কিন্তু ঘরের আশেপাশে ছিল হয়তো!’
“মেবেলের উচ্চগ্রামের স্বরের ব্যাপারটা আমার জানা ছিল।
তাছাড়া, জিওফ্রেও যে রেগে গেলে তার গলার স্বর ক্রমেই চড়ে, সেও
জানতাম। কাজেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল?’
“‘রোজকার ব্যাপার। একই জিনিস নিয়ে প্রতিবার ঝামেলা হত। ছোটো
ছোটো ব্যাপার নিয়ে আমাদের মধ্যে খটাখটি লেগে যেত। জিওফ্রে চটে গিয়ে নানা কথা শোনাত, আমিও
পালটা জবাব দিতাম।’
“‘তাহলে তো প্রায়ই ঝগড়া লাগত বলে মনে হচ্ছে!’
“‘আমার দোষ ছিল না ―’
“‘কার দোষ, সেটা এখানে জরুরি নয়। এরকম একটা জায়গায়
ঘরের খবর বাইরে যেতে বেশি সময় লাগে না। তুই আর তোর স্বামী প্রায়ই ঝগড়া করতিস।
একদিন সকালে ঝগড়া তুঙ্গে ওঠে, আর সেদিন তোর স্বামী হঠাৎ মারা যায়।
এটুকুই, নাকি আরও আছে?’
“‘আরও বলতে কী বোঝাতে চাইছ বুঝতে পারছি না।’
“‘আমি বলতে চাইছি যে তুই যদি কিছু বোকা বোকা কাণ্ড করে
থাকিস, তবে সেটা লুকোস না। নাহলে তোকে সাহায্য করা মুশকিল হয়ে
দাঁড়াবে।’
“‘কেউ কোনোভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। একমাত্র
মৃত্যুই আমাকে বাঁচাতে পারে।’
“‘ভগবানের ওপর আর একটু বিশ্বাস রাখ মা। আমি জানি, তুই
কিছু একটা লুকোচ্ছিস।’
“আমি সবসময় জানতাম যে ও আমাকে সব সত্যি কথা বলছিল না। এটা
ওর ছেলেবেলার অভ্যেস। অনেকক্ষণ ধরে ঝোলাঝুলির পর ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোল। মেবেল
সেদিন সকালে ওষুধের দোকান থেকে কিছুটা আর্সেনিক কিনে এনেছিল। এই ধরনের জিনিস কিনলে
একটা রেজিস্টারে সই করতে হয়। মেবেলকেও করতে হয়েছিল। আর খবরটা ওই ওষুধের দোকানির
মুখ থেকেই ছড়িয়েছে।
“আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘তোর ডাক্তারের নাম কী?’
“উত্তর এল, ‘ড.
রলিনসন।’
“ড. রলিনসনকে আমি এক-দু’বার দেখেছি। মেবেলই দূর থেকে দেখিয়ে
দিয়েছিল। লোকটার ব্যাপারে সোজা কথায় বলতে গেলে বলব,
একটা থুত্থুরে বুড়ো। ততদিনে আমার
অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে যে মানুষ মনে করে ডাক্তাররা ভুল করতেই পারেন না! এই
ধারণাকে চূড়ান্ত বলে ধরে থাকা মানুষদের কিছু লোক আবার উচ্চশিক্ষিত। তবে মজার
ব্যাপার, অর্ধেক লোক জানেও না যে তাদের কী হয়েছে। আমি বাপু ওই জন্য
ডাক্তার আর তাঁদের দেওয়া ওষুধ ― দুটোর কোনোটাকেই ভরসা করতে পারি নে।
“যাই হোক, ভাবনাচিন্তা করে ড. রলিনসনকে
ডেকে পাঠানোই সমীচীন মনে হল। ঠিক যেমন ভেবেছিলাম,
ডাক্তারবাবু ঠিক তেমনই ― একজন শান্তশিষ্ট বৃদ্ধ, দশ
হাত দূরের জিনিসও ভালো দেখতে পান না, কানে একটু কম শোনেন, আর
খুব অনুভূতিপরায়ণ লোক। ডেনম্যানের মারা যাওয়ার কথা বলতেই ভদ্রলোক সাততাড়াতাড়ি
একগাদা ছত্রাকের বর্ণনা দিয়ে গেলেন। তার মধ্যে কোনটা খাওয়া যায়, কোনটা
জিভে ঠেকলেই মরণ, সব না জানানো অবধি তাঁর শান্তি নেই। উনি নাকি বাড়ির
রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। রাঁধুনি মেয়েটা বলেছিল দু-একটা
মাশরুম নাকি তারও একটু গোলমেলে লেগেছিল, কিন্তু দোকান থেকে কেনা বলে মনের ভুল ভেবে
আর পাত্তা দেয়নি। তবে তারপর থেকে যতবার ওই মাশরুমগুলোর কথা খেয়াল হয়েছে, তত
তার সন্দেহটা আরও জোরালো হয়েছে।
“ডাক্তারের থেকে জানা গেল,
উনি আসতে আসতে ডেনম্যানের কথা বলা বন্ধ
হয়ে গিয়েছিল। কিছু গিলতে পারছিল না। ডাক্তার আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মারা যায়।
ডাক্তারের হাবভাব দেখে মনে হল মৃত্যুর কারণটা নিয়ে তার মনে কোনো ধন্দ নেই। তবে, তা
কতটা সত্য আর কতটা ঠ্যাঁটামি, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট ধন্দ ছিল।
“আমি সটান মেবেলের কাছে গিয়ে ওর আর্সেনিক কেনার কারণ
জিজ্ঞাসা করলাম।
“‘নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবে কিনেছিলি!
কী ভেবেছিলি?’
“মেবেল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি
আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমি সুখে ছিলাম না পিসি!
তাই আমি এবার ইতি টানতে চাইছিলাম।’
“‘তোর কাছে কি আর্সেনিকটা এখনও আছে?’
“‘না। আমি ফেলে দিয়েছি।’
“আমি বসে বসে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলাম।
“‘আচ্ছা, জিওফ্রে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর কী করেছিল? তোকে
ডেকেছিল?’
“‘না। পাগলের মতো ঘন্টা বাজাচ্ছিল। বেশ কয়েকবার বাজানোর পর
আমাদের ঠিকে কাজের মেয়েটা, মানে ডরোথি শুনতে পেয়ে রাঁধুনিটাকে ডেকে
তুলে নিচে নেমে আসে। ওকে দেখে ডরোথি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ও খুব ছটফট করছিল আর
প্রলাপ বকছিল। রাঁধুনি মেয়েটাকে ওর কাছে রেখে ডরোথি ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসে সব
জানাতে আমি ওর কাছে গেলাম। আমি গিয়ে দেখলাম ও ভয়ঙ্কর রকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আর
সেদিনই ব্রুস্টার, মানে আমার শ্বশুরমশাইকে যে মেয়েটি দেখাশোনা করে, সে
সেই রাতটা ছুটি নিয়েছে। কাজেই, কী করতে হবে বুঝতে না পেরে আমরা ঘাবড়ে
গিয়েছিলাম। আমি ডরোথিকে পাঠালাম ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনার জন্য। আমি আর রাঁধুনি
মেয়েটা ওর কাছে রইলাম। কিন্তু খানিকক্ষণ বাদে আর ব্যাপারটা সহ্য করতে না পেরে আমি
আমার ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।’
“‘খুব স্বার্থপরের মতো কাজ করেছিলি। তুই তো এমনটা ছিলি না! রাঁধুনি
মেয়েটা বার বার বলেছে কোনো কাজে নাকি তুই সাহায্য করিসনি। আগামীতেও একই কথাই বলবে।
খুব ভুল করেছিস!’
“এরপর আমি বাড়ির কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বললাম। রাঁধুনি
মেয়েটা আমাকে আবার মাশরুম নিয়ে বলতে যাচ্ছিল,
আমি ওকে থামালাম। এতবার মাশরুমের কথা
শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে গিয়েছিল। তার বদলে আমি ওদের দু’জনকেই সেদিন রাতে
গৃহকর্তার অবস্থা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলাম। ওরা দু’জনেই বলল কর্তামশাই নাকি খুব
কষ্ট পাচ্ছিলেন। কিছু গিলতে পারছিলেন না, একটা ঘ্যাঁসঘ্যাঁসে স্বরে কথা বলছিলেন
বটে, কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কথা বলতে গেলেই ছটফট
করছিলেন।
“আমি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘কী বলছিলেন?’
“রাঁধুনি মেয়েটা ডরোথির দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাছ
নিয়ে কী একটা বলছিলেন না?’
“ডরোথি মাথা নেড়ে বলল,
‘কী সব মাছের গাদার কথা বলছিলেন। পাগলের
প্রলাপ। আপনি দেখলেই বুঝতে পারতেন যে উনি সুস্থ মস্তিষ্কে ছিলেন না তখন।’
“ওদের কথা কিছু না বুঝে আমি গেলাম ব্রুস্টারের কাছে।
ভদ্রমহিলা মাঝবয়সি। আন্দাজ বছর পঞ্চাশ বয়স হবে!
“ব্রুস্টার বলল, ‘যেদিন আমি ছিলাম না, সেদিনই
এমন ঘটনা ঘটতে হল! ডাক্তার আসা অবধি কেউ কিচ্ছুটি করার চেষ্টা করেনি।’
“আমি প্রশ্ন করলাম,
‘জিওফ্রে সম্ভবত প্রলাপ বকছিল। টোমাইন
বিষের লক্ষণ তো তা নয়!’
“‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে।’
“আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
ওর রুগির অবস্থা কেমন যাচ্ছে। ব্রুস্টার
মাথা নেড়ে উত্তর দিল, ‘ভালো না।’
“‘দুর্বল হয়ে পড়েছেন?’
“‘না না। গায়ের জোর ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি কমে
গিয়েছে। হয়তো উনি আমাদের চেয়ে বেশিদিন বাঁচবেন,
কিন্তু স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি
বার বার করে কর্তা আর গিন্নিমাকে বলেছি যে ওঁকে কোনো ভালো হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা
করান, কিন্তু গিন্নিমা তো কথাটা কানেই তোলেন না!’
“ব্যাপারটা খটকা লাগল। মেবেলকে তো অত্যন্ত নরম মনের মানুষ
বলে জানতাম!
“যাই হোক, বেশ কিছুটা ভাবনাচিন্তা করার পর আমি
সিদ্ধান্ত নিলাম যে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটাই কাজ করা যায়। গুজবটা যেভাবে ছড়াচ্ছে, তাতে
মৃতদেহ কবর থেকে তুলে এনে ময়না তদন্ত করানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছিলাম না আমি।
একমাত্র এতেই মিথ্যেবাদীদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। এই সিদ্ধান্তে অবশ্য মেবেল
খানিকটা গাঁইগুঁই করছিল, যে মৃত মানুষটাকে শান্তি দেওয়া হোক, হেন-তেন, কিন্তু
আমার কথায় আমি অনড় রইলাম।
“এই সময়ের ঘটনা নিয়ে আমি বেশি কথা বলব না। আমরা অনুমতি
পেতেই কাজ শুরু হয়ে গেল। ফলাফল থেকে আমার ধড়ে প্রাণ এল। মৃতের শরীরে আর্সেনিকের
চিহ্নমাত্র নেই ― এটা ভালো খবর ― কিন্তু রিপোর্টে লেখা ছিল: মৃত্যুর
কারণ হিসেবে সঠিকভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
“কাজেই, ঝামেলা মিটল না। লোকজন আবারও গুজব রটাতে
শুরু করল যে এমন বিষ ব্যবহার করা হয়েছে যার এতদিন বাদে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া
অসম্ভব। আমি ময়না তদন্তকারী ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে কিছু প্রশ্ন করলাম।
ভদ্রলোক যদিও বেশিরভাগ উত্তরই কাটিয়ে গেলেন,
তবে এটা বুঝলাম যে মাশরুম খেয়ে
বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ব্যাপারটা উনি বাতিল করে দিয়েছেন। আমার মাথায় একটা ধারণা
ঘুরছিল, সে জন্যই ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
যদি বিষ ব্যবহার হয়ে থাকে, তাহলে
কী বিষ ব্যবহার হয়েছে বলে ওঁর ধারণা? তাতে ভদ্রলোক যে ব্যাখ্যাটা দিলেন, সেটা
সত্যি বলতে কী, আমার মগজে ঢোকেনি, তবে এটুকু বুঝলাম যে ব্যাপারটা সম্ভবত
হয়েছে কোনো সবজি থেকেই।
“আমি ভাবছিলাম যে জিওফ্রের রক্তে তো পাগলামির বীজ ছিলই, কাজেই, ও
নিজেই আত্মহত্যা করেনি তো! একসময় ও নিজেও ওষুধপত্র নিয়ে পড়াশোনা
করেছে, কাজেই কোন বিষে কী হয়,
তা ওর নখদর্পনে থাকার কথা।
“যদিও ব্যাপারটা খুব একটা খাপ খাচ্ছিল না, কিন্তু
এর চেয়ে ভালো কোনো ব্যাখ্যাও আমি পাচ্ছিলাম না। আমার বুদ্ধির দৌড় প্রায় শেষ হয়ে
যেতে বসেছিল। তোরা এখনকার ছেলেমেয়ে। তোরা শুনলে হয়তো হাসবি। আমার যখন কোনো সমস্যা
এসে উপস্থিত হয়, তখন আমি রাস্তা দিয়ে,
বাজারে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে একটা
প্রার্থনা করি। তাতে কাজও হয়। ইয়ে, আমি জানি যে এই রহস্যের সঙ্গে এর কোনো
যোগাযোগ নেই, তাও বলছি। ছেলেবেলায় আমি আমার বিছানায় পায়ের দিকে একটা কথা
লিখে রেখেছিলাম: প্রশ্ন করলে উত্তর আসবেই। যাই হোক,
সেদিন সকালে হাই স্ট্রিট বরাবর হাঁটতে
হাঁটতে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছিলাম। যখন চোখ খুললাম বল তো কী দেখলাম?”
ওরা পাঁচ জন সাগ্রহে মিস মার্পলের দিকে তাকিয়ে ছিল। তবে
ওদের মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওরা কেউই ঠিকঠাক উত্তর আন্দাজ করতে পারেনি।
মিস মার্পল বললেন, “চোখ খুলতেই আমার নজর গেল একটা মাছের
দোকানের দিকে। সেখানে একটা টাটকা হ্যাডক মাছ ঝুলছে।”
এই অবধি বলে উনি তাঁর শ্রোতাদের দিকে তাকালেন।
রেমন্ড বলল, “যাহ!
এত প্রার্থনার ফল একটা হ্যাডক মাছ!”
“হ্যাঁ রেমন্ড। তবে এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভগবান যা করেন
মঙ্গলের জন্য। তাঁর সব কীর্তিতেই তিনি আমাদের কোনো না কোনোভাবে পথ দেখান। এই
হ্যাডক মাছের কানকোয় একটা কালো দাগ পেলাম। যাকে উপকথায় বলে সেন্ট পিটারের বুড়ো
আঙুলের ছাপ। সে গল্প অন্যদিন বলব। তখন আমি বুঝতে পারলাম সবটা। আমার বিশ্বাসের
প্রয়োজন ছিল। সেন্ট পিটারের সেই অগাধ বিশ্বাস। তারপর দুটো ব্যাপারকে একসঙ্গে
জুড়লাম। বিশ্বাস আর মাছ।”
স্যার হেনরি একটা হাঁচি দিলেন। জয়েস ওর ঠোঁট কামড়ে ধরল।
“কিন্তু তাতে কী প্রমাণিত হল?
রাঁধুনি মেয়েটা আর ঠিকে কাজের মেয়েটা দু’জনেই
একই কথা বলেছিল। মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির মুখে শেষবারের মতো মাছের উল্লেখ। এখন আমি
বুঝলাম যে সেই কথাগুলোর মধ্যেই এই রহস্যভেদের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে। কাজেই, বাড়ির
দিকে হাঁটা লাগালাম।”
কিছুক্ষণ থেমে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, “তোরা
কখনও ভেবেছিস, একটা কথার কতরকম মানে হয়?
ডর্টমুরের কাছে একটা জায়গা আছে, তার
নাম গ্রে ওয়েদার্স। এবার তুই যদি কারুর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলার সময় গ্রে ওয়েদার্স
কথাটা উল্লেখ করিস, তাহলে সে ভাববে যে তুই হয়তো আবহাওয়ার কথা বলছিস। আবার, কেউ
ধর অর্ধেক কথা শুনল, সে হয়তো ভাবতেই পারে যে কথাটা অর্থহীন! সে
জন্যই, আমরা যখন একজনের কথা অন্যকে বলি তখন কিছু কথা এদিক ওদিক করে
দিই। যার ফলে কথার অর্থ অনেকসময় বদলে যায়।
“আমি ডরোথি আর ওই রাঁধুনি মেয়েটার সঙ্গে আলাদা করে কথা
বলেছিলাম। রাঁধুনিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তার কর্তামশাই মাছের ঢিপি কথাটাই ব্যবহার
করেছিল কিনা। সে উত্তরে বলেছিল, সে নাকি নিশ্চিত।
“আমি তা শুনে প্রশ্ন করলাম,
‘ঠিক ওই কথাটাই বলেছিলেন, নাকি
অন্য কোনো মাছের নাম নিয়েছিলেন?’
“‘ওটাই বলেছিলেন। কী একটা মাছের নাম বলেছিলেন বটে। তবে অমুক
মাছের ঢিপিই বলেছিলেন। মাছটার নামটা কী যেন ― মনে পড়ছে না। তবে খুব একটা পরিচিত মাছ নয়। আহঃ! পেটে
আসছে মুখে আসছে না। প দিয়ে ছিল কি? না,
প দিয়ে নয় মনে হয়।’
“ডরোথিও বলল যে কর্তামশাই একটা মাছের নাম করেছিলেন।
“‘কী একটা অদ্ভুত নাম। এক পাঁজা ― কী নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না।’
“‘পাঁজা বলেছিলেন? নাকি ঢিপি?’
“‘সম্ভবত পাঁজা। ঠিক কী বলেছিলেন,
তা মনে করতে পারছি না। আটকে আটকে
যাচ্ছিলেন। পাঁজা পাঁজা ― কী যেন ছিল! অ্যাদ্দিন বাদে মনে রাখাটাও বেশ চাপের। তবে মনে তো হচ্ছে
পাঁজাই বলেছিলেন। কিন্তু মাছের নামটা ― ক দিয়ে শুরু যদ্দুর মনে পড়ছে। কার্প?
না না। কার্প তো পরিচিত মাছ। পরিচিত মাছ
বলেননি।’
“এর পরের ব্যাপারটার জন্য অবশ্য আমার গর্ব হয়। তা হল
বিশ্বসংসারে যত ড্রাগ রয়েছে, তার ব্যাপারে আমি কিস্যু জানি না। ওই
নেশার ড্রাগ একেকটা বিষ। আমার একটিই নেশা ― তা হল আমার ঠাকুমার শিখিয়ে যাওয়া এক বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো
চায়ের নেশা। তবে সে বাড়িতে ওষুধের প্রচুর বই ছিল। তার মধ্যে কোনো একটাতে ড্রাগের
একটা তালিকাও যে মিলবে, সে আমি জানতাম। আমার ধারণা ছিল জিওফ্রে
নির্ঘাত একটা কোনো বিষ খেয়েছিল, তার নামই সে মরার সময় বলতে চেষ্টা করছিল।
“আমি প্রথমে হ দিয়ে দেখলাম। কিছুই পেলাম না। তারপর প দিয়ে
দেখতেই চট করে পেয়ে গেলাম। কী পেলাম?”
আবার সবাই চুপ।
“পাইলোকার্পিন। কথা জড়িয়ে যাওয়ায় ‘পাঁজা পাঁজা কার্প’ শুনেছিল
ডরোথি। সাধারণ মানুষ, যারা পাইলোকার্পিন সম্পর্কে কিছুই জানে না, তারা
তো পাঁজা পাঁজা কার্পই শুনবে! ঠিকই আছে।”
স্যার হেনরি বলে উঠলেন,
“হে ভগবান!”
ড. পেন্ডার বললেন,
“আমি থাকলে আমিও বুঝতাম না বাপু।”
মি. পেথরিক বললেন,
“তারপর?”
মিস মার্পল উত্তর দিলেন,
“আমি সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের যেখানে
পাইলোকার্পিন সম্পর্কে লেখা আছে সেখানে গিয়ে এর সম্পর্কে যাবতীয় কথা পড়লাম। কিন্তু
তার সঙ্গে এই মামলার কোনো সম্পর্ক বেরোল না। হঠাৎই একটা কথা আমার চোখ টানল: অ্যাট্রোপিন
বিষের প্রতিষেধক হিসেবে এই ড্রাগ বর্তমানে খুব ভালো কাজ করছে।
“মনের যেটুকু অন্ধকার ছিল,
সেটাও দূর হয়ে গেল। আমি কখনোই ভাবিনি যে
জিওফ্রের মতো মানুষ আত্মহত্যা করবে। তাই নিজের মনেই খটকা ছিল। কাজেই এই যে নতুন
রাস্তাটা খুলল, এটা কেবল একটা সম্ভাবনা ছিল না,
এটাই হয়েছে বলে আমি নিশ্চিত ছিলাম। কারণ
অঙ্কটা এবার মিলে যাচ্ছিল।
রেমন্ড বলল, “আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করব না মাসি।
তুমিই বলো।”
মিস মার্পল বললেন, “আমি ওষুধ সম্পর্কে বিশেষভাবে অজ্ঞ হতে
পারি, তবে এই অ্যাট্রোপিনের ব্যাপারটা আমি জানতাম। মাঝে যখন আমার
চোখ খারাপ হয়েছিল, ডাক্তারবাবু আমাকে অ্যাট্রোপিন সালফেটের ড্রপ দিয়েছিলেন
চোখের জন্য। তখনই জেনেছিলাম ব্যাপারটা। যাই হোক,
আমি সটান দোতলায় গিয়ে বৃদ্ধ ডেনম্যান
মশায়ের ঘরে ঢুকে কোনো ভূমিকা ছাড়াই বললাম,
‘মি.
ডেনম্যান,
আমি সবটাই জানি। ছেলেকে বিষ দিয়ে কেন মারলেন?’
“মি. ডেনম্যানকে দেখে বোঝা যায় যৌবনে বেশ
সুন্দর চেহারা ছিল তাঁর। কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হাসিতে
ফেটে পড়লেন। কী বিষাক্ত সে হাসি। সে হাসির দমকে আমার অন্তরাত্মাও যেন কেঁপে উঠল।
মিসেস জোন্স যখন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, তখন এরকম হাসি শুনেছিলাম।
“ওভাবে কিছুক্ষণ হাসার পর তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই
মেরেছি ওকে। ও আমাকে সরিয়ে দেওয়ার মতলব করছিল। ভেবেছিল আমাকে পাগলা গারদে আটকে
রাখবে? আমি ওদের এ ব্যাপারে কথা বলতে শুনেছিলাম। মেবেল খুব ভালো
মেয়ে। বেচারি আমার হয়ে কথা বলছিল। কিন্তু জিওফ্রের কাছে কি আর ওর কথা পাত্তা পায়? সারা
জীবন জিওফ্রে যা একবার করবে বলে ভেবেছে, তা করে তবে ছেড়েছে। সোজা আঙুলে ঘি না
উঠলে আঙুল বেঁকিয়েও ঘি তুলেছে। কিন্তু আর পারবে না ― আমি আমার পথের কাঁটা ছেলেকে সরিয়ে দিয়েছি ― হা হা হা!
সেদিন রাতে আমি চুপি চুপি নিচে নেমে
এসেছিলাম। ব্রুস্টার ছিল না। জিওফ্রে ঘুমোচ্ছিল। ওর বিছানার পাশেই এক গ্লাস জল
রাখা ছিল। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে গ্লাসের জলটা খাওয়ার অভ্যেস ছিল ওর। কিছুটা জল ফেলে
দিয়ে তার বদলে আমার চোখের ওষুধটা ঢেলে দিয়েছিলাম ওর মধ্যে!
ঘুম চোখে কিছু বোঝার আগেই ঢক ঢক করে ওটা
খেয়ে ফেলবে। ঠিক তাই করেছিল ও। ওরা সকালে এসে আমাকে ঘটনাটা জানায়। ভেবেছিল আমি খুব
দুঃখ পাব! হা হা হা হা হা!’
মিস মার্পল থামলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তো
এই হল গল্প। ভদ্রলোককে এরপর পাগলা গারদে পাঠানো হয়। তারপর ব্যাপারটা জানাজানি হতে
লোকজন মেবেলের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ে। এই লোকগুলোই ক’দিন আগে মেবেলকেই সন্দেহ
করছিল। তবে জিওফ্রে যদি ব্যাপারটা ধরতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে প্রতিষেধক আনতে
বলার চেষ্টা না করত, এই ব্যাপারটা কোনোদিনই সমাধান হত না। আমি পড়েছিলাম যে এই
অ্যাট্রোপিন বিষ আর টোমাইন বিষের প্রভাব একইরকম হয়।”
বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর মি. পেথেরিক
বললেন, “সত্যিই তুমি অতুলনীয়া!”
স্যার হেনরি বললেন,
“আমি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছে তোমার
নাম সুপারিশ করব যাতে ওরা কোনো ব্যাপার নিয়ে বেকায়দায় পড়লে তোমার কাছে আসে।”
রেমন্ড বলল, “কিন্তু মাসি,
তুমি একটা জিনিস জানো না।”
“না না! তাও জানি!
ঠিক খাওয়ার আগেই ব্যাপারটা হয়েছে, না? তখন
তুই জয়েসকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় একটু বেড়াতে বেরোলি তো!
ওই জুঁই ফুলের গাছটার কাছে বসেছিলি দু’জনে।
ওখানেই তো গোয়ালা ছেলেটা অ্যানের প্রেমে পাগল হয়ে তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল!”
“মাসি, তুমি না!
একেবারে যা তা!
আমি আর জয়েস মোটেই ওই গোয়ালা আর অ্যান নই!”
“এখানেই তুই ভুল রে বাবু!
পৃথিবীর সবাই প্রেমে পড়লে একই রকম। তবে
সৌভাগ্যক্রমে, তারা কেউ তা বুঝতে পারে না।
--------
মূল কাহিনি: The Thumbmark of St. Peter - আগাথা ক্রিস্টি
--------
ছবিঃ সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment