এক গুনিনের গল্প
এ এল শেলটন (তিব্বতি লোককথা)
অনুবাদঃ সুমন্ত্র ঘোষ
অনেক অনেক বছর আগের কথা। তিব্বতের এক উপত্যকাকে চারদিকে ঘিরে আছে অনেকগুলো পাহাড়। প্রতিটা পাহাড়ের কিছুটা জায়গার জঙ্গল কেটে এক একজন রাজা তাঁদের রাজ্য স্থাপন করেছেন। একে পাহাড়, তার ওপরে আবার চারপাশ জঙ্গলে ভরা। রাজ্যপাট চালানোই খুব ঝামেলার। খাজনা আদায়ের জন্য এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে কত যে জঙ্গল পেরতে হয় নায়েব, গোমস্তা এবং পাইকদের তার কোনো ঠিক নেই। অনেক সময় রাস্তাও হারিয়ে ফেলে তারা। এইভাবে কত লোক যে হারিয়ে গেছে তার হিসেব রাখাই ছেড়ে দিয়েছে সবাই। হয় তাদের বন্য জন্তুতে খেয়ে ফেলে, নাহলে তারা পাহাড়ি দানবদের হাতে পড়ে। তাও তো রাজাকে রাজ্য চালাতেই হবে। নতুন নতুন লোক রেখে কোনোরকমে সব কাজ সামলাতে হয়।
এরকম এক রাজ্যের রাজা তাঁর দু-ছেলেকে নিয়ে একদিন শিকারে বেরিয়েছেন। সঙ্গে লোক লস্কর আছে কিছু। জঙ্গলে দল না বেঁধে যাওয়ার সাহস কেউ দেখায় না। একসঙ্গে ঘোড়া ছুটিয়ে একটু ফাঁকা একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালেন তাঁরা। এমনিতে এইসব পাহাড়ি জঙ্গল এতটাই ঘন যে দিনের আলোও ভালোমতো ঢোকে না। মোটা মোটা গাছের গুঁড়িতে ঘন শ্যাওলার আস্তরণ, চারপাশে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, গাছের মাথায় ডালগুলোও একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে এমননিশ্ছিদ্র চাঁদোয়া তৈরি করেছে যে আকাশপ্রায় দেখাই যায় না। পাতার গা চুঁইয়ে আসা সূর্যের আলো হালকা সবজেটে ছাপ ফেলে মাটিতে। তার মধ্যেই এই জায়গাটা বেশ সুন্দর। গাছগুলো বেশ দূরে দূরে। নীল আকাশে সকালের সূর্যের চমৎকার রোদ খেলে যাচ্ছে গাছের ডালে, ঝোপে ঝাড়ে, পাথরে। দুটো গাছের ফাঁকে গায়ে রোদ মেখে দাড়িয়ে আছে খুব মিষ্টি দেখতে এক মেয়ে। তার বয়স আঠেরো উনিশ হবে। আর তার পাশে আছে অনেক বড়ো একটা চমরী গাই।
এই দৃশ্য দেখে রাজা একটু অবাক হলেন। এই গহীন জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে কে এই মেয়ে! আশেপাশে আর কোনো লোকজনও তো নেই! কোনো বনদেবী নয় তো! রাজা জিজ্ঞেস করলেন, “কে তুমি? কার সঙ্গে এসেছ?”
মেয়েটার
মুখে এই প্রথম একটু দুঃখের ছায়া দেখা গেল। সে বলল, “অনেক দূরের এক রাজ্যে বাড়ি আমার। আমি সেই রাজ্যের রাজকন্যা। আর এটা আমার প্রিয় চমরী গাই। ছোটো থেকে কতবার এর পিঠে উঠে খেলেছি, কখনও কিছু হয়নি। কিন্তু কাল পিঠে উঠতেই পাগলের মতো আমাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করল। আর থামলই না। কী যে হয়েছিল ওর কে জানে!”
রাজা জানেন যে পোষা জন্তু জানোয়ারদের কখনও কখনও এরকম হয়। এই তো কিছুদিন আগে তাঁর আস্তাবলের এক ঘোড়া হঠাৎ খেপে গিয়ে গায়ের জোরে দড়ি ছিঁড়ে পালাল। সহিস আটকাতে গেছিল বলে তাকে পেছনের পায়ের লাথি মেরে কোথায় যে চলে গেল আর কেউ তাকে খুঁজে পেল না। বড়ো পছন্দের ছিল তাঁর সে ঘোড়াটা।
মেয়েটা
আরও বলল, “সেই কাল দুপুর থেকে যে ছুটতে আরম্ভ করেছে সে আর থামেই না। কতগুলো পাহাড় যে পেরিয়ে এল তাও আমি জানি না। আমি তো পড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ বুজে ওর গলা শক্ত করে জড়িয়ে ছিলাম। এতক্ষণ পর এখানে এসে দাঁড়াল। আমাকে কিছু খেতে দেবেন? পুরো একদিন কিছু খাইনি।”
রাজা তাঁর একজন লোককে চোখের ইশারা করলেন। শিকারে তো আর খাবার না নিয়ে আসেননি তিনি। অনেক সময় শিকার পেতে সারাদিন লেগে যায়। তখন খিদে পেলে এই জঙ্গলে খাবে কী এতগুলো লোক! তাই খাবার নিয়েই বেরোতে হয়। তবে সব খাবারই সাধারণ এবং শুকনো। চিড়ে, চালভাজা এবং কড়া পাকের মিষ্টি। রাজকীয় কিছু না। সেগুলোই যখন তাকে দেওয়া হল মেয়েটা গোগ্রাসে খেতে শুরু করল।
রাজার বড়ো মায়া হল মেয়েটিকে দেখে। আহা রে, ওর বাবা-মা নিশ্চয় ওকে খুঁজে না পেয়ে কান্নাকাটি করছে। ও যে রাজকন্যা সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। এমন চমৎকার কাজ করা রঙিন পোশাকের যা দাম তা কোনো সাধারন মানুষের কেনা সম্ভব না। আর গা ভর্তি সোনার গয়নায় যেন আরও ঝলমলিয়ে উঠছে তার রূপ। এত গয়না তো একজন রাজকন্যার গায়েই থাকা সম্ভব। বরং গয়না যেন একটু বেশিই। নিশ্চয় খুব বড়ো রাজ্যের রাজা মেয়েটির বাবা। এই চমরী গাই-এর পিঠে সারা রাত থেকেও যে ও বেঁচে আছে তা ওর কপালের জোর! চমরী গাই রেগে গেলে খুব হিংস্র হয়ে যায়। সেই ভয়ে না হয় কোনো জন্তু জানোয়ার তার ধারে কাছে আসেনি। কিন্তু এই পাহাড়ের একদম উপরের দিকের গুহাগুলিতে দানবদের বাস। সন্ধে হলেই তারা খাবারের খোঁজে নেমে আসে নিচের জঙ্গলে। তাদের চোখে যে সারা রাত পড়েনি মেয়েটা সেটা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার।
ওর খাওয়া হলে রাজা আজকের মতো ফিরে যাওয়াই ঠিক করলেন। শিকার পরে একদিন হবে। সবার আগে মেয়েটার থাকার ব্যবস্থা করা বেশি জরুরি। সারা রাত এত ঝামেলার পরে নিশ্চয় খুব ক্লান্ত সে। রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘোড়ায় চড়তে পারো?”
মেয়েটা
মৃদু হেসে “হ্যাঁ” বলল। রাজার নির্দেশে একজন লস্কর নেমে দাঁড়াল ঘোড়া থেকে। বেশ ভালো জাতের ঘোড়া সেটা। তাতে চেপে রাজকন্যা যাবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। দিব্যি ধীরেসুস্থে ফিরে যাবার মতো সময় আছে হাতে। কাজেই সেই লস্কর অন্যদের সঙ্গে হেঁটে ফিরতে পারবে। যাত্রা শুরু হতে সেই চমরী গাই আসতে লাগল মেয়েটার পেছনে। তাই দেখে খুব খুশি হয়ে গেল সে। বলল, “দেখুন এখন আবার ঠিক হয়ে গেছে। কাল যে কী ভূত চেপেছিল ওর মাথায় কে জানে!” রাজা বললেন, “ওদের ওরকম হয় মাঝে-মধ্যে। তুমি ওকে নিয়ে ভেবো না। আমি প্রাসাদের পেছনে ওর থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেব।” এটা শুনে বেশ নিশ্চিন্ত হল মেয়েটা। পরের মুহূর্তেই চোখে জল এসে গেল তার। রাজাকে জিজ্ঞেস করল, “আমার বাবা-মাকে খুঁজে দেবেন তো?” রাজা গম্ভীর হয়ে বললেন, “চেষ্টা তো করব। কিন্তু কতটা সফল হব তা জানি না।”
রাজা বুঝেছিলেন কাজটা প্রায় অসম্ভব। সেটা সত্যি প্রমাণ হল প্রাসাদে ফিরে। রাজকন্যার থাকার ব্যবস্থা প্রাসাদের অতিথিশালাতে করা হল। তাকে পাহারা দেবার লোক নিয়োগ করে রাজা আলোচনায় বসলেন মন্ত্রীদের সঙ্গে। তাঁদের সবার এক কথা। অনেক দূরের রাজ্য খুঁজে বের করা অসম্ভব। নিজের রাজ্যের গ্রামে গ্রামেই খাজনা আদায়ের লোক পাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। অনেক টাকা মাইনের লোভ দেখিয়ে কয়েকজনকে রাখা হয়েছে। নিজের রাজ্যে এই অবস্থা হলে ভিন রাজ্যে যাবে কে! তাও আশেপাশের পাহাড়ের কোনো রাজ্য হলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু ও যে রাজ্যের নাম বলছে তার নাম কেউ কখনও শোনেনি। কোনদিকে কতগুলো পাহাড় পেরোলে পাওয়া যাবে সেই জায়গা তা কেউ জানে না। তাহলে একটা লোক কীসের ভরসায় এই কাজের দায়িত্ব নেবে! তার চেয়ে রাজকন্যা এখানেই থাক। তার বাবা নিশ্চয় মেয়ের খোঁজে দূরদূরান্তে লোক পাঠাবেন। তেমন যদি কেউ আসে তখন দেখা যাবে।
কাজেই রাজকন্যা সেই প্রাসাদে থেকে গেলেনবেশ কয়েক মাস। এই ক’দিনে তার প্রায় সবার সঙ্গেই পরিচয় হয়ে গেছে। তার মিষ্টি স্বভাবে সবার মন জয় করে নিয়েছে সে। বিশেষ করে রানির। সে বেশিরভাগ সময়টা কাটায় রানির সঙ্গে গল্প করে। এইভাবেই সুখে কেটে যাচ্ছিল দিন। কিন্তু সুখের পেছনে দুঃখও আসে। হঠাৎ করেই বড়ো রাজপুত্রের শরীর খারাপ হতে শুরু করল। অত সুন্দর লম্বা চওড়া পেশীবহুল ছেলেটা দিন দিন কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। রাজা অনেক বদ্যি ডাকলেন। কিন্তু কেউ কিছু বুঝেই উঠতে পারলেন না। তাও আন্দাজে তাঁরা কয়েকটা ওষুধ দিলেন ঠিকই। সেগুলো কোনো কাজে এল না। রাজা সারাক্ষণ চিন্তায় চুপ করে বসে থাকেনরাজসভায়।
একদিন মন্ত্রীরা মিলে তাঁকে বললেন, “আমরা অনেক ভেবে একটা রাস্তা বের করেছি। তাতে কোনো কাজ হবে কিনা জানি না। তবে চেষ্টা করে দেখতে তো কোনো ক্ষতি নেই।”
শুনে রাজা উৎসুক চোখে তাকালেন। মন্ত্রীরা বললেন, “রাজ জ্যোতিষী রাজপুত্রের ভাগ্যবিচার করেছেন। তাতে তাঁর আয়ু খুব কম। বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে, যদি না হঠাৎ কোনো ভালো প্রভাব তার ওপর পড়ে। এখন ভালো প্রভাব হয়তো ঐ রাজকন্যার সঙ্গে বিয়ে দিলে পড়তে পারে। ভেবে দেখুন, মেয়েটি খুবই সুলক্ষণা। সারা রাত জঙ্গলে থাকলেও দানবদের হাতে পড়েনি। এমন কপাল ক’জনের হয়? মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছে বলতে পারেন। তার সঙ্গে রাজপুত্রের বিয়ে হলে হয়তো রাজপুত্রও এবারের মতো মৃত্যুকে জয় করতে পারবে।”
তাঁদের কথা শুনে রাজা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, “সত্যিই তো। এটা তো আমার মাথায় আসেনি। ঠিক আছে আমি এখনই রানির সঙ্গে এটা নিয়ে আলোচনা করছি।” রানি সব শুনে ভারী খুশি হলেন। বললেন, “মেয়েটাকে আমারও খুব পছন্দ। এমন বিয়েতে মত না দেওয়ার কোনো কারণ নেই। ওরা দু’জনে যদি রাজি থাকে তাহলে বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি পার দিয়ে দাও।”
ওদের মত নেওয়ার অবশ্য দরকার ছিল না। কারণ বিকেলে বেড়াতে বেরিয়ে ওদের প্রায়ই প্রাসাদের পেছনের বাগানে দেখা হয়। কোনো গাছের নিচে কচি সবুজ ঘাসের গালিচায় পাশাপাশি বসে নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়। দু’জনেরই দু’জনকে বেশ ভালো লাগে। রাজপুত্রের শরীর নিয়ে ইদানিং রাজকন্যাও বেশ চিন্তিত। কাজেই যখন শুনল তার সঙ্গে বিয়ে হলে রাজপুত্র সেরে উঠতে পারে তখন সে বিনা দ্বিধায় বিয়েতে রাজি হল। তারপর এক শুভ দিন দেখে ছোট্ট অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ওদের বিয়ে হয়ে গেল। খুব ধুমধাম করে বিয়ে দেবার সময় ছিল না। ভালো করে বিয়ে দিতে হলে প্রতিটা গ্রামে নিমন্ত্রণ পাঠাতে হত অন্তত পনের দিন আগে, যাতে তারা সবাই আসার প্রস্তুতি নিতে পারে। তারপরে বিয়ের এক দিন আগে চারদিক থেকে দলে দলে লোক আসত রাজবাড়িতে। পরের দিন চার বেলা চলত ভোজ। তার পরের দিন সকালে আবার তারা যাত্রা দিত নিজেদের গ্রামের দিকে। সে সময় রাজার হাতে একদম নেই। সমস্ত গ্রামের প্রজারা নিমন্ত্রণ না পেয়ে হয়তো একটু রাগ করবে। তাই রাজা ঠিক করলেন ছেলে সুস্থ হলে গ্রামে গ্রামে ঢেঁড়া পিটিয়ে এক বিরাট ভোজসভার আয়োজন করবেন তিনি।
কিন্তু সে সুযোগ আর তিনি পেলেন না। বিয়ের পনেরো দিনের মাথায় রোগে ভুগে মারা গেল বড়ো রাজপুত্র। কান্নায় ভেঙে পড়ল রাজকন্যা। কপালটাই খারাপ তার। বাবা-মাকে হারিয়ে অন্য রাজ্যে এসে আছে সে। যাও বা একজনকে ভালো লাগল, নিজের মতো করে পাওয়ার ইচ্ছে হল, তাকেও বাঁচাতে পারলনা কেউ। মেয়েটার কষ্ট আর কান্না দেখে বাকি সবার চোখে জল এল। এভাবে দুঃখে কষ্টে কেটে গেল এক সপ্তাহ।
তারপর বোঝা গেল যে ছেলের শরীর থেকে অসুখ ছড়িয়েছে রানির মধ্যেও। এবার তিনি আস্তে আস্তে শীর্ণ হতে শুরু করলেন। মন্ত্রী আর বদ্যিদের মাথায় হাত পড়ে গেল। এ কেমন রোগ যার কথা কেউ আগে কখনও শোনেনি! রাজপুত্র এই রোগ বাঁধালেন কোথা থেকে! এবার কি তবে রানির পালা! ভাবতেই শিউরে উঠছেন সবাই। রাজা সিংহাসনে এসে বসেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর মন পড়ে থাকে অন্যদিকে। মাঝে মাঝে খুব করুণ চোখে তাকান মন্ত্রীদের দিকে। যেন জানতে চান কোনো ওষুধ পাওয়া গেল কিনা। মন্ত্রীরা মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
রানির মাথার কাছে সবসময় বসে থাকে মেয়েটা। তাঁর সেবা যত্ন করে। ছোটো রাজপুত্র বা রাজা কাছে এলে বলে, “আপনারা দূর থেকেই দেখুন। রোগটা ছোঁয়াচে। রানির থেকে আপনাদেরও হতে পারে।”
রাজা অবাক হয়ে বলেছিলেন, “তোমারও তো হতে পারে তাহলে?” মেয়েটা ক্ষীণ হেসে বলেছিল, “কাউকে একটা কাছে থাকতেই হবে। রোগটা এরপরে কারও হলে আমার হওয়াই ভালো। বাবা-মাকে হারিয়েছি। স্বামীকে হারিয়েছি। বেঁচে থাকার ইচ্ছে আমার এমনিও চলে গেছে।” কথাটা শুনে সবাই চুপ করে যায়। এই বাড়িতে সবার মনে এত কষ্ট যে কে কাকে সান্ত্বনা দেবে ঠিক করে উঠতে পারে না।
রানির সারাদিন খেতে ইচ্ছে করে না, ঘুম আসে না, শুধু শরীরের মধ্যে কেমন যেন একটা কষ্ট হয়। উঠে বসতে গেলে দুর্বল লাগে, খুব ভারি হয়ে থাকে মাথাটা। তাঁর বড়ো ছেলেরও এরকম হত। মাথার কাছে রাজকন্যাকে দেখে ভালো লাগে। ওকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসেছেন তিনি। কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছে করে না। চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ে মাঝে মাঝে। ঘুমোতে ইচ্ছে করলেও যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারেন না। সারা রাত বিছানায় ছটফট করে ভোরের একটু আগে চোখ লেগে আসে তাঁর। আর তখনই তাঁর মাথার কাছে বসে থাকা রাজকন্যার মুখে ফুটে ওঠে অদ্ভুত এক হাসি।
কেউ জানে না যে এই রাজকন্যা আসলে এক দানবী। আর ঐ চমরী গাই-এর রূপ নিয়ে আছে এক দানব। তারা যে কোনো সময় যে কোনো রূপ নিতে পারে। আর তাদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো আনন্দ যখন মানুষকে বোকা বানাতে পারে। মানুষ নিজেকে বড়ো বুদ্ধিমান ভাবে। কিন্তু কত সহজেই ওর একটু অভিনয় দেখে বোকার মতো ওকে বিশ্বাস করে নিল। যা খুশি বানিয়ে বলল আর ওরা সব মেনে নিল। ঠিকঠাক অভিনয়ের কাছে মানুষ বড়ো অসহায়। এখানে এসে থেকে ভারী মজায় কাটছে তার। মানুষকে খেতে অনেক দানবের ভালো লাগে ঠিকই। কিন্তু ওর মনে হয় সেটা বিরাট কোনো ব্যাপার না। একটা মানুষের শরীরকে মেরে ফেলা তো ভারী সোজা কাজ। কঠিন কাজ হল তার আত্মাটাকে রোজ কষ্ট দিয়ে দিয়ে মারা। একটু একটু করে ভেতরের আত্মাটাকে কবজা করতে খুব মজা হয় তার। মানুষ বুঝতেই পারে না সে কেন ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এইভাবেই বড়ো রাজপুত্রকে মেরেছে সে। রোজ একটু একটু করে তার আত্মার দখল নিয়েছে দু-মাস ধরে। এখন সেই একই কাজ করছে রানির সঙ্গে। এই কাজ তো সহজ নয়। অনেক সাহস আর মনোযোগ লাগে।
রানি ঘুমোতে ও জানালা গলে ঘর থেকে বেরোল। রোজ এই সময়টা দেখা করতে যায় দানবী সেই চমরী গাই-রূপী দানবের সঙ্গে দেখা করতে। রাজা কথা রেখেছেন। তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন প্রাসাদের পেছনের এক ছোটো আস্তাবলে। এরা দু’জনে যে ঠিক করেছে এইভাবে পুরো রাজ-পরিবারকে শেষ করে দেবে তা কেউ জানতেও পারল না।
একদিন রাজজ্যোতিষী এসে রাজাকে বললেন, “রানির আয়ু ফুরিয়ে আসছে। একটা গুনিনের সন্ধান পেয়েছি। আপনার রাজ্যের এক গ্রামেই থাকে। তাকে একবার আনিয়ে দেখুন কী হয়।” রাজা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনার কথার কোনো মাথামুন্ডু নেই। যখন আমার ছেলেরা জন্মেছিল তখন আপনি বলেছিলেন যে তারা দীর্ঘজীবী হবে। রানি যখন বিয়ে করে এল এ রাজ্যে তখন আপনি বললেন সেও নাকি অনেক বয়স অবধি বাঁচবে। আর যখনই কারও শরীর খারাপ হচ্ছে পুরো উলটো কথা বলছেন এখন। আপনার জ্বালায় জ্যোতিষে আমার বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।” রাজার রাগ দেখে জ্যোতিষী চুপ করে গেলেন।
কিছুক্ষণ
পরে রাজা ভাবলেন, সব রকম চেষ্টা যখন চলছে তাহলে এটাই বা বাদ যায় কেন! নিয়ে আসা যাক সেই গুনিনকে। দেখা যাক না কী হয়। রাজার আদেশে লোক লস্কর দৌড়ল সেই গ্রামে। গুনিনকে আজকেই ধরে আনতে হবে। তারা যখন দুপুর নাগাদ গিয়ে পৌঁছল তার বাড়িতে আর সব খুলে বলল তাকে তখন গুনিন চমকে উঠল। মনে ভারী ভয় লাগলেও মুখে হাসিটা ধরে রাখল সে। তার চেয়ে ভালো কে জানে যে এসব ঝাড়ফুঁক তুকতাক বলে কিছু হয় না। গ্রামের বোকা লোকগুলো এসবে বিশ্বাস করে বলে ওর দিব্যি চলে যায় সবাইকে ভুলভাল কথা বলে ঠকিয়ে। কিন্তু সেটা কি আর রাজার সঙ্গে করা যায়! রাজবাড়িতে বুদ্ধিমান লোকের অভাব নেই। একবার যদি তাঁরা বুঝতে পারেন ওর বুজরুকি তাহলে হয়তো মাথাটাই কেটে নেবেন! কিন্তু যেতে তো হবেই। রাজার আদেশ অমান্য করা অসম্ভব।
ঝুলি গুছিয়ে নিতে ঘরের মধ্যে ঢুকে বউকে খুব চিন্তিত মুখে বলল, “এবার কী হবে?” বউ রেগে বলল, “কতবার বলেছি এই মানুষ ঠকানোর কাজ ছেড়ে দাও। শুনেছ আমার কথা?” গুনিন বলল, “এবারে যদি বেঁচে ফিরতে পারি তাহলে এসব ছেড়ে দেব। ঈশ্বরের দিব্যি সৎ ভাবে কিছু করব।” তারপর ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।
দীর্ঘ যাত্রার পরে সন্ধের সময় রাজবাড়িতে পৌঁছল সে। তার উজ্জ্বল লাল রঙের পোশাক, কপালে হাতে সিঁদুরের লাল তিলক আর রাগি রাগি মুখ দেখে রীতিমতো ভয় লাগে। একটা কথা গুনিন খুব ভালো করে জানে। মনে যতই চিন্তা হোক না কেন সেটা বাইরে দেখালে চলবে না। মানুষকে চমকে দিলে তাদের মন দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন তাদের যা খুশি বিশ্বাস করানো সোজা। রাজসভায় রাজা তাকে অভিবাদন করে খাতির যত্ন করতে চাইলেন। গুনিন গম্ভীর মুখে বলল, “আগে রানিমা-র কাছে আমাকে নিয়ে চলুন। আমি এখানে খেতে ঘুমোতে আসিনি। আরামের জীবন সাধকের জন্য নয়।” তার কথা শুনে সবাই অভিভূত হয়ে পড়লেন।
রাজা নিজে গুনিনকে নিয়ে গেলেন রানির ঘরে। তাঁর পেছনে পেছনে ছোটো রাজপুত্র এবং মন্ত্রীরা ভিড় করে গেলেন। গুনিন খাটের পাশে দাঁড়িয়ে রানিকে দেখল ভালো করে। রানির চোখে-মুখে কোনো অনুভূতি নেই। নতুন একটা লোক যে ঘরে ঢুকল তাকে দেখে রানির চোখে-মুখে কোনো প্রশ্ন নেই। অবাক হওয়ার ছাপ নেই। অভিব্যক্তিহীন মুখে তিনি তাকিয়ে থাকলেন চুপ করে। মাঝে মাঝে শুধু চোখের পাতা পড়তে লাগল। গুনিন ঝোলা থেকে একটা লাল কাপড় বার করে বেশ ভালো করে পাতল রানির মাথার কাছে। তার উপরে রাখল একটা নর করোটি। তার কপালে ভালো করে সিঁদুর মাখিয়ে ধুপ জ্বালাতে লাগল। রাজা একটু এগিয়ে এসে রাজকন্যাকে দেখিয়ে বললেন, “ও হল আমার বড়ো বউমা। রানির দেখাশোনা ওই করছে। আপনার কিছু জানার থাকলে ওকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।” গুনিন গম্ভীর মুখে রাজকন্যার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল, “হুম।”
গুনিন নিজেও জানত না এরপরে তার কী করা উচিত। এদিকে এতগুলো লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে যে সে বেশ ঝামেলায় পড়ে গেল। ধুপ জ্বালা হলে সে রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা সবাই বাইরে যান। আমার এখন গভীর মনোযোগের দরকার। কেউ থাকলে অসুবিধে হবে।” ওর কথা শুনে সবাই তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। ওর হাবভাব দেখে সবাই একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে। রানির হয়তো এবার একটা সুরাহা হলেও হতে পারে। রাজকন্যাকে রাজা বললেন, “তুমি যাও তো মা। নিজের ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। আমরা সবাই এখানে আছি। তেমন হলে তোমাকে ডাকব। এ কাজে হয়তো অনেক সময় লাগবে গুনিনের।”
রাজকন্যারূপী
দানবী নিজের কক্ষের দিকে চলল। তার মুখে চিন্তার ছায়া। এই গুনিনকে দেখে তার বেশ ভয় লেগেছে। যদি সব কিছু বুঝে ফেলে গুনিন, তাহলে কী হবে সেটাই ভাবছিল ও। ভয় পেলে যে চলবে না সেটাও সে জানে। ভয়ে দানবের ক্ষমতা কমে যায়। সামান্য ভয়েই অন্যের আত্মাকে কষ্ট দেওয়ার ক্ষমতা চলে যায়। বেশি ভয় পেলে যে কোনো রূপ ধারণের ক্ষমতাও চলে যাবে। দানবী ঠিক করল একবার দানবের সঙ্গে দেখা করে আসবে। ওর মতামত নেওয়াটা জরুরি।
এদিকে রানির হঠাৎ করে মনে হল যে তাঁর শরীরটা একটু যেন ভালো লাগছে। ব্যাথাটা যেন একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে কোথাও। শরীরে মনে একটু সাড় ফিরে আসছে। আর তাঁর মন শান্ত হতেই গোটা শরীর জুড়ে নেমে এল ঘুম। কতদিন ভালো করে ঘুমোননি তিনি! খিদেও পাচ্ছে খুব। কিন্তু ঘুমের ঘোরে বাকি সব ভুলে গেলেন তিনি। আরামে চোখ বন্ধ হয়ে এল তাঁর। রানির এই পরিবর্তন অবশ্য গুনিন দেখতে পেল না। সে নিচু হয়ে ঝুলির মধ্যে কিছু শিকড়-বাকড় খুঁজছিল। অনেক শিকড় নানারকমের অসুখে ওষুধের কাজ করে। ও কোন শিকড়টা বেটে রানিকে খাওয়াবে সেটাই ভাবছিল। চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী! একটা শিকড় বেছে নিয়ে রানির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল ও। একটু আগেই রানি দিব্যি চোখ খুলে শুয়ে ছিলেন। এখন হঠাৎ কী হল! এতটুকু সময়ের মধ্যেই কি একটা মানুষ ঘুমিয়ে পড়তে পারে! নাকি এই ধুপের গন্ধে আর নর করোটি দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন রানি!
গুনিন হালকা করে একবার ধাক্কা দিল রানিকে। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেল না। তাই রানিকে দু’হাতে ধরে বেশ জোরে ঝাঁকুনি দিল সে। কিন্তু রানি তখন ঘুমের অতলে এত সুখে তলিয়ে গেছেন যে কিছু বুঝতেই পারলেন না। রানি অজ্ঞান হয়ে গেছেন ভেবে আতঙ্কে ঘেমে উঠল গুনিন। এবার কী হবে! ও তো ভেবেছিল রানিকে দু-একটা শিকড় বেটে খাইয়ে দেখবে অবস্থার উন্নতি হয় কিনা। না হলে রাজার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে চলে যাবে। কিন্তু ও আসার কিছুক্ষণের মধ্যে রানির শরীর খারাপ হয়েছে জানলে রাজা কি আর ওকে ছেড়ে দেবেন! ওর ইচ্ছে হল দৌড়ে পালিয়ে যায়। কোনোরকমে গ্রামে পৌঁছতে পারলে বউকে নিয়ে চলে যাবে অন্য রাজ্যে। কিন্তু সে উপায়ও তো নেই। দরজার ওপারে রাজা দাঁড়িয়ে আছেন অনেক লোক নিয়ে। রানির মাথার কাছে একটা জানালা আছে অবশ্য। আর সেই জানালার ধারে একটা গাছও দেখা যাচ্ছে। গুনিন বুঝল তাকে জানালা গলেই পালাতে হবে।
ঐ ছোটো জানালাটা দিয়ে বেশ কসরত করেই গুঁড়ি মেরে নামতে হল তাকে। অন্ধকারে লাফ দিয়ে সামনের মোটা ডালটা ধরতে গিয়েও থেমে গেল সে। গাছের ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে একটা প্রদীপের আলো দেখতে পেল। মনে হল যেন রাজার বড়ো বউমাকে দেখা গেল একবার। এত রাতে ওখানে কী করছেন উনি! পাশে আরও কেউ একটা আছে। কোনো এক পুরুষের গলা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু গাছের পাতার আড়াল হচ্ছে বলে তাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ওদের কথা। টুকরো টুকরো কিছু কথা ভেসে এল। মেয়েটা বলছে, “মনে হয় গুনিন সব বুঝে ফেলেছে। আমার দিকে কীরকমভাবে একটা তাকাল! সেরকম যদি অবস্থা খারাপ দেখি আমরা কিন্তু পালিয়ে যাব।” লোকটা বলল, “পালিয়ে তো এখনও যেতে পারি। কিন্তু দিব্যি আছি এখানে। খাওয়ার চিন্তা নেই। মাঝখান থেকে লোকগুলোকে বোকা বানিয়ে দিব্যি সময় কাটছে। যেতে ইচ্ছে করছে না।” মেয়েটা দুঃখ পেয়ে বলল, “ইচ্ছে কি আর আমারও করছে? কিন্তু খুব ভয় পেয়ে আছি। রানির আত্মার ওপর থেকে আমার দখল চলে গেছে। কতক্ষণ রূপ ধরে রাখতে পারব জানি না।” লোকটা বলল, “হয়তো তুমি এমনিই ভয় পাচ্ছ। হয়তো কিছু জানতে পারেনি তেমন। তাও তুমি যদি দেখ কিছু ঝামেলা হতে পারে, আমার কাছে চলে এসো তাড়াতাড়ি। দু’জনে পালিয়ে যাব।” মেয়েটা রাজি হল। বলল, “ঠিক আছে। চলো তোমাকে আবার আস্তাবলে বেঁধে রেখে আমি ফিরে যাই। কী হচ্ছে নজর রাখি গিয়ে।”
এটুকু শুনেই গুনিনের বুঝতে আর কিছু বাকি থাকল না। কোনো এক দানবী রাজকন্যা সেজে এই রাজবাড়িতে অভিনয় করে বেড়াচ্ছে! কিন্তু মানুষের অভিনয়ের কাছে হার মানতে হল তাকে। গুনিনের হাবভাব দেখে ভয় পেয়ে গেল। গুনিন কিছুক্ষণ ঘরে বসে ভেবে নিল কী করা উচিত। তারপরে নর করোটিটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরোল। দরজার বাইরে রাজা, মন্ত্রীরা এবং রাজপুত্র চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছিলেন। ওকে দেখেই সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গুনিন গম্ভীর মুখে বলল, “গোপনে কিছু সৈন্য ডাকুন। আপনাদের এই ক’জনের বাইরে যেন কেউ জানতে না পারে।” রাজা এক মন্ত্রীর দিকে তাকাতেই তিনি নিঃশব্দে চলে গেলেন। গুনিন গম্ভীর মুখে চোখ বুজে দাড়িয়ে রইল। কেউ ভয়ে কোনো কথা বললেন না। একটু পরে মন্ত্রী সাত-আট জন রক্ষী নিয়ে এলেন। গুনিন তখন রাজাকে নির্দেশ দিল, “আপনার বউমার কক্ষে আমাকে নিয়ে চলুন।” রাজা চমকে উঠে বললেন, “বউমার ঘরে! কেন?” অন্যরাও অবাক হয়ে গেছেন রীতিমতো। রাজকন্যাকে নিয়ে সন্দেহ কারও মনে আসেনি। গুনিন কিছু না বলে শান্ত চোখে রাজার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। রাজা তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে চললেন রাজকন্যার ঘরের দিকে।
দানবী সবে ফিরে এসেছে বাগান থেকে। একটু বিশ্রাম নিয়ে রানির ঘরের দিকে যাবে ঠিক করল সে। এমন সময় সজোরে দরজা খুলে তার ঘরে ঢুকল সেই গুনিন। তার পেছনে রাজা এবং আরও অনেকে। ভয় পেয়ে গেল দানবী। সে জানে সবাইকে বোকা বানাতে স্বাভাবিকভাবে হেসে কথা বলা উচিত তার। কিন্তু মুখে হাসি এল না কিছুতেই। গলা শুকিয়ে গেল আশঙ্কায়। গুনিন একটা বাঁকা হাসি হেসে তীব্র চোখে তাকিয়ে সেই নর করোটিটা তুলে ধরল তার মুখের সামনে। ভয়ে রূপ পালটে যেতে থাকল দানবীর। সেই সুন্দর মায়াভরা মুখের জায়গায় বিকৃত পশুর মতো দেখতে একজন দাঁড়িয়ে রইল। রাজা সেটা দেখে প্রচন্ড রাগে চিৎকার করে উঠলেন, “নিজের মেয়ের জায়গা দিয়েছিলাম তোকে! তুই সব এভাবে শেষ করে দিলি রাক্ষুসী? এই প্রতিদান দিলি তুই আমার? মারো ওকে। মেরেই ফেলো একদম।” রাজার আদেশে সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপরে।
গুনিন জিজ্ঞেস করল, “রানির কক্ষের জানালার পাশে যে গাছটা আছে তার নিচের আস্তাবলে কে থাকে?” রাজা বললেন, “এই দানবীর সঙ্গে একটা চমরী গাই এসেছিল। তাকেই রেখেছি ওখানে।” গুনিন বলল, “সৈন্য পাঠান। ওটা চমরী গাই-রূপী এক দানব। ওটাকেও মেরে ফেলুন।”
সেই রাতেই দানবী আর চমরী গাই-কে মেরে ফেলা হল। পরের দিন সকালে রানির ঘুম ভাঙল একটু দেরিতে। চোখ খুলেই তিনি পরম শান্তিতে খাটের পাশে রাজাকে দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কাল কি আমার ঘরে কোনো গুনিন এসেছিল? আমার শরীর সারল কীভাবে? আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।” রাজা বললেন, “তুমি আগে ভালো করে কিছু খাও। তারপরে সব বলছি।”
রাজা গুনিনকে অনেক মোহর দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গুনিন সে সব কিছু নেয়নি। বলেছে, “রানিকে দানবীর প্রভাব থেকে বাঁচাতে অনেকটা শক্তিক্ষয় হয়ে গেছে আমার। তাই আমি আর গুনিনের কাজ করতে পারব না কখনও। আমার ঘরের কাছে যা জমি আছে তাতে ফসল ফলিয়ে চলে যাবে আমার দিব্যি।” সেই শুনে রাজা তার খাজনা মাফ করে দিয়েছিলেন আজীবন। গুনিন তার বউকে কথা দিয়েছিল আর কখনও কাউকে ঠকাবে না বেঁচে ফিরতে পারলে। সেই কথা রেখেছিল সে।
--------
(A. L. Shelton-এর Tibetan Folk Tales বইটির ‘The Story of the Two
Devils’ থেকে অনুদিত ও অনুলিখিত।)
--------
ছবিঃ অতনু দেব
No comments:
Post a Comment