অস্ত্র
ফ্রেডরিক ব্রাউন
অনুবাদঃ সৌভিক চক্রবর্তী
শেষ বিকেলের বিষণ্ণ আবছায়ায়
নিস্তব্ধ একটা ঘর। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রোজেক্টের প্রধান বিজ্ঞানী ডঃ জেমস গ্রাহাম
সেই ঘরে বসে রয়েছেন, তাঁর প্রিয় আরামকেদারায় গা এলিয়ে আকাশপাতাল চিন্তা করছেন।
চারদিক এতটাই নীরব যে পাশের ঘর থেকে কাগজের খসখস আওয়াজটাও কানে আসছে। গ্রাহাম-এর ছেলে, ছবির
বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে।
জীবনের সেরা সৃজনশীল
কাজকর্ম, সবচেয়ে গভীর ভাবনাগুলোর বাস্তবায়ন এতদিন এভাবেই করে এসেছেন গ্রাহাম,
দিনের সব কাজের শেষে, অন্ধকার, নিশ্চুপ ঘরের এক কোণে বসে। কিন্তু আজ তাঁর মাথা
পরিষ্কারভাবে কাজ করছে না। বার বারই তাঁর মনে উঁকি দিচ্ছে তাঁর মানসিক
জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে—পাশের ঘরে বসা তাঁর একমাত্র ছেলে হ্যারি—সম্পর্কে দুর্ভাবনা। স্নেহের আবেগে ভেজা সেই
চিন্তাস্রোতে তিক্ততার লেশমাত্র নেই, নেই সেই যন্ত্রণা যা অনেক বছর আগে ছিল, যখন প্রথমবার তিনি
ওর অসুস্থতা সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন।
তাঁর ছেলের অবশ্য এজন্য কোনো
দুঃখ ছিল না। এটাই কি যথেষ্ট নয়? আর ক’জন বাবা এত ভাগ্যবান হয়? ক’জন এমন সন্তান
পায় যে হঠাৎ একদিন বড়ো হয়ে যায় না, বাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যায় না, বরং চিরকাল শিশুর
মতোই সরল, নিষ্পাপ হয়ে থেকে যায়? গ্রাহাম বুঝতে পারছিলেন তিনি ছেঁদো যুক্তি সাজিয়ে
নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কিন্তু যুক্তি সাজানো তো আর অপরাধ নয়---
কলিং বেলের শব্দ শোনা
গেল। উঠে দাঁড়ালেন গ্রাহাম, ঘরের আলো জ্বালালেন, তারপর হলঘর পেরিয়ে দরজার দিকে
গেলেন। বিরক্তির কোনো অনুভূতি তাঁর মনে উদয় হল না। এই মুহূর্তে, এরকম একটা
পরিস্থিতিতে, মনটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যান তিনি।
দরজা খুললেন গ্রাহাম। অচেনা একজন লোক বাইরে দাঁড়িয়ে
ছিল। “ডঃ গ্রাহাম? আমার নাম নিমান্ড,” বলে উঠল লোকটা, “আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।
আমি কি ভেতরে আসতে পারি?”
গ্রাহাম ভালো করে একবার
দেখলেন ওকে। ছোটোখাটো চেহারা, সাদামাটা, নিরীহ — নির্ঘাত কোনো সাংবাদিক, অথবা
ইনশিওরেন্স এজেন্ট।
“অবশ্যই, মিঃ নিমান্ড,”
প্রত্যুত্তরে বললেন গ্রাহাম, “ভেতরে আসুন।” ভদ্রলোকের সঙ্গে মিনিট দশেক কথা
বললে এমন কিছু ক্ষতি হবে না, ভাবলেন তিনি। বরং মনটা একটু হালকা হবে।
“বসুন,” বসার ঘরে একটা চেয়ারের
দিকে ইঙ্গিত করলেন গ্রাহাম, “কিছু নেবেন? কফি, অথবা---”
“কিছু লাগবে না, ধন্যবাদ,”
চেয়ারে বসতে বসতে বলল নিমান্ড। গ্রাহাম ওর উলটোদিকের সোফায়
বসলেন।
হাতে হাত রাখল ছোটোখাটো
চেহারার লোকটা, সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, “ডঃ গ্রাহাম, আপনি এমন একজন বিজ্ঞানী যার
আবিষ্কার মানবসভ্যতার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে।”
আবার একটা পাগল এসেছে,
বুঝে গেলেন গ্রাহাম। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। লোকটাকে ঘরে ঢোকানোর আগেই জেনে
নেওয়া উচিত ছিল, ও কী জন্য এসেছে। আগামী দশ
মিনিটের বাক্যালাপ তাঁর পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিকর হতে চলেছে—স্পষ্ট বুঝলেন তিনি।
লোকজনের সঙ্গে রুক্ষ ব্যবহার করতে তাঁর ভালো লাগে না, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে রুক্ষ
হওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা খোলা থাকে না।
“ডঃ গ্রাহাম, আপনি যে অস্ত্র
নিয়ে কাজ করছেন—”
কথার মাঝখানে থেমে গেল
লোকটা, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ভেতরের ঘরের দরজাটা খুলে বেরিয়ে এল বছর পনেরোর একটা
ছেলে। নিমান্ড-কে লক্ষ না করেই একছুটে গ্রাহাম-এর কাছে এসে দাঁড়াল ও।
“বাবা, আমাকে গল্প পড়ে শোনাবে
না?” চার বছরের শিশুর মতো খিলখিলিয়ে হেসে উঠল কিশোরবয়সি ছেলেটা।
এক হাতে ছেলেকে জড়িয়ে
ধরলেন গ্রাহাম, তারপর চেয়ারে বসা আগন্তুকের মুখের দিকে তাকালেন। লোকটা কি ওর ব্যাপারে সব জানে?
নিমান্ড-এর মুখে বিস্ময়ের কোনো ছাপ খুঁজে পেলেন না তিনি। হয়তো আগে থেকেই খবর নিয়ে
রেখেছে।
“হ্যারি,” আদরভরা নরম
গলায় বললেন গ্রাহাম, “বাবা এখন একটু ব্যস্ত আছে সোনা। তুমি নিজের ঘরে গিয়ে বসো।
একটুক্ষণের মধ্যেই আমার কাজ হয়ে যাবে, তারপর আমি তোমাকে গল্প পড়ে শোনাব। কেমন?”
“চিকেন লিটল? তুমি আমাকে
চিকেন লিটল পড়ে শোনাবে, বাবা?”
“আচ্ছা বেশ, তাই শোনাব।
এখন তুমি ঘরে যাও। আচ্ছা শোনো, ইনি হলেন মিঃ নিমান্ড।”
চেয়ারে বসা লোকটার দিকে
তাকিয়ে লাজুকভাবে হাসল হ্যারি।
“হ্যালো, হ্যারি,” পালটা
হাসল নিমান্ড, হ্যারি-র দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। গ্রাহাম নিশ্চিত হলেন, লোকটা
তাঁর ছেলের ব্যাপারে জেনেই এসেছে। লোকটার হাসি, ওর ভাবভঙ্গি থেকে স্পষ্ট বোঝা
যাচ্ছিল ও হ্যারি-র
মানসিক বয়সের সঙ্গে তাল মেলাতে চাইছে।
বাড়ানো হাতটা ধরে
হ্যান্ডশেক করল হ্যারি। এক মুহূর্তের জন্য গ্রাহাম-এর মনে হল, ও হয়তো নিমান্ড-এর
কোলে গিয়ে বসবে। আলতোভাবে ছেলেকে পেছনে টানলেন তিনি, বললেন, “আলাপ করে নিয়েছ,
হ্যারি, এবার নিজের ঘরে যাও।”
লাফাতে লাফাতে নিজের ঘরে
ফিরে গেল ছেলেটা, কিন্তু দরজা বন্ধ করল না।
গ্রাহাম-এর চোখে চোখ রাখল
নিমান্ড। “মিষ্টি ছেলে। ওকে আমার পছন্দ হয়েছে।” ওর গলার স্বরে অদ্ভুত
সততা ছিল। “ওর প্রিয় গল্প, যেটা আপনি ওকে পড়ে শোনাবেন, সবসময় সত্যি হোক এই কামনাই
করি।”
গ্রাহাম কথাটা ঠিক বুঝতে
পারলেন না। নিমান্ড আবার বলল, “চিকেন লিটল-এর কথা বলছি। চমৎকার একটা গল্প। চিকেন
লিটল ভুল করে ভাবে আকাশ ভেঙে পড়ছে। সেটাই যেন হয়... ভুলটা যেন ভুলই থাকে।”
নিমান্ড-কে এতক্ষণ খারাপ
লাগেনি গ্রাহাম-এর। হ্যারি-র সঙ্গে ভালো ব্যবহারও করেছে লোকটা। কিন্তু এবার এই কথোপকথনটা
তাঁকে থামাতেই হত। হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
“আমার মনে হয় আপনি বৃথা
সময় নষ্ট করছেন, মিঃ নিমান্ড। আপনার সময়, এবং আমার সময়। আপনি যা বলবেন, যা যা
যুক্তি দেবেন সবই আমি আগে শুনেছি। কয়েক হাজার বার। হয়তো আপনি বা আপনারা যা ভাবছেন
তার মধ্যে কিছু সারবত্তা রয়েছে, কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি একজন
বিজ্ঞানী, এবং বিজ্ঞানচর্চাই আমার উদ্দেশ্য। আমি মানছি আমি অস্ত্র নিয়ে কাজ
করছি... ভয়ঙ্কর এক মারণাস্ত্র নিয়ে, কিন্তু সেই বিষয়ে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নই।
একজন বিজ্ঞানী হিসেবে আমার একমাত্র লক্ষ্য হল বিজ্ঞানের অগ্রগতি। আমি এই নিয়ে অনেক
ভেবেছি, এবং শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে লোকে যাই বলুক তাতে আমার কিছু আসে
যায় না।”
“কিন্তু মানবসভ্যতা কি
এমন ভয়ঙ্কর একটা মারণাস্ত্রের জন্য আদৌ প্রস্তুত, ডঃ গ্রাহাম?”
ভুরু কোঁচকালেন গ্রাহাম। “আমার
দৃষ্টিভঙ্গি তো আমি আগেই আপনার সামনে রেখেছি, মিঃ নিমান্ড।”
চেয়ার ছেড়ে ধীরে ধীরে উঠে
দাঁড়াল নিমান্ড। “বেশ,
আপনি যদি এই নিয়ে আর আলোচনা করতে না চান, আমিও কিছু বলব না,” কপালে হাত বুলিয়ে ঘাম
মুছে নিল ও। “আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু... এতক্ষণ কথা বলে গলা শুকিয়ে গেছে। যদি
কিছু...”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই,”
গ্রাহাম-এর সব বিরক্তি এক নিমেষে দূর হয়ে গেল। “হুইস্কি চলবে?”
“দৌড়োবে।”
রান্নাঘরে গেলেন গ্রাহাম,
দুটো গ্লাস, হুইস্কির বোতল, জলের জাগ আর বরফের ট্রে নিয়ে ফিরে এলেন কিছুক্ষণের
মধ্যেই।
বসার ঘরে এসে তিনি
দেখলেন, হ্যারি-র ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে নিমান্ড। “গুডনাইট, হ্যারি,” হাত
নাড়ল লোকটা। “গুড নাইট, মিঃ নিমান্ড,” হ্যারি-র খুশি খুশি গলা শুনতে পেলেন তিনি।
হুইস্কিতে জল মিশিয়ে, বরফ
ঢেলে নিমান্ড-এর দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। এক চুমুকে গ্লাস খালি করে উঠে দাঁড়াল
লোকটা।
“আরেকটা নিন।”
“না, আর নয়, এবার আমাকে
যেতে হবে,” বলল নিমান্ড, “আপনার ছেলের জন্য একটা উপহার এনেছিলাম, ডঃ গ্রাহাম। আপনি
যখন রান্নাঘরে গিয়েছিলেন, তখন হ্যারি-র হাতে ওটা দিয়েছি। আশা করি আপনি কিছু মনে
করবেন না।”
“না না, মনে করার প্রশ্নই
নেই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুভরাত্রি।”
লোকটা চলে যাওয়ার পর দরজা
বন্ধ করলেন গ্রাহাম, তারপর হ্যারি-র ঘরে ঢুকলেন। “এই তো আমি এসে গেছি, হ্যারি। এবার তোমাকে গল্প পড়ে
শোনাব---”
আচমকাই গ্রাহাম-এর কপালে
ঘাম জমতে লাগল। কোনোরকমে নিজেকে সামলালেন তিনি, এক পা এক পা করে এগিয়ে হ্যারি-র
কাছে এলেন। গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললেন, “দেখি হ্যারি, ওটা কী।”
জিনিসটা নেওয়ার সময় তাঁর
হাত কেঁপে উঠল।
‘লোকটা নিশ্চয়ই উন্মাদ,’
মনে মনে ভাবলেন তিনি, ‘নাহলে নির্বোধ শিশুর হাতে কেউ গুলিভরা রিভলভার তুলে দেয়!’
--------
মূল কাহিনিঃ ফ্রেডরিক ব্রাউন রচিত ‘দ্য ওয়েপন’ (১৯৫১)
ছবিঃ রাজা আক্তার
No comments:
Post a Comment