দ্য মাংকিজ প
ডাব্লিউ ডাব্লিউ জেকবস
অনুবাদঃ দেবেশ মজুমদার
সেই রাতে
বাইরে ভীষণ ঝড় বৃষ্টি। হোয়াইট
পরিবারের ড্রয়িং রুমের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনের আঁচে
মিঃ হোয়াইট ও তাঁর পুত্র হার্বাট হোয়াইট দাবা খেলছেন। মিঃ
হোয়াইটের দরজার বাইরে গেটের কাছে ভারী বুটের আওয়াজ!
হার্বাট হোয়াইট বললেন, “ওই তো এসে গেছে।”
মিঃ
হোয়াইট আপ্যায়নের ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। অভ্যাগত বিনীত ভঙ্গিতে দেরি হওয়ার জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন। মিসেস হোয়াইট বললেন,
“আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওসব কথা এখন থাক।”
নবাগত
দীর্ঘকায়। পরিচয় করিয়ে দিলেন মিঃ হোয়াইট, “এই হচ্ছে সার্জেন্ট মেজর মরিস!”
হাতে হাত
ঘষে সার্জেন্ট মেজর বসলেন। কয়েক পেগ পানীয় পেটে যাবার পর সার্জেন্ট মেজর মরিস বড়ো বড়ো চোখে তাকালেন। কথাবার্তা শুরু
হল। পরিবারের সকলে আগ্রহে শুনছে তাঁর কথা। নানা রোমহর্ষক কাহিনি, যুদ্ধ, মহামারী, নানা অদ্ভুত লোকেদের বিচিত্র সব চরিত্র...।
মিঃ
হোয়াইট বললেন, “কম নয়, একুশ বছরের ইতিহাস। যখন উনি ঘর ছাড়লেন তখন প্রায় কিশোর বয়স,
ওয়্যারহাউসে কাজ করতেন। এখন ওঁকে দেখ...।”
মিসেস
হোয়াইট বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু ক্ষতি হয়নি কিছু!”
“আমি
একবার ইন্ডিয়া যেতে চাই,” মিঃ হোয়াইট বললেন।
সার্জেন্ট
মেজর মরিস মাথা নাড়লেন, “আরে যেখানে আছেন, সেখানেই
ভালো থাকুন।”
“কিন্তু
ওখানকার বুড়ো ফকির, মন্দির আর জঙ্গলগুলো দেখার খুব ইচ্ছে হয় আমার। বিশেষ করে
বানরগুলোকে। সেদিন কে যেন একটা ইন্ডিয়ান মাংকির কথা বলল। মাংকির থাবা! তাই না
মরিস?”
“না না
তেমন কিছু নয়,” সার্জেন্ট মেজর মরিস বললেন।
মিসেস
হোয়াইট অবাক, “বানরের থাবা।”
সার্জেন্ট
মেজর মরিস উত্তর দিলেন, “আরে, ওটা কিছুটা যাদুকরি ভৌতিক ব্যাপারের মতো। ম্যাজিক
বলতে পারেন।”
মিঃ
হোয়াইটের পরিবারের তিনজনের কৌতূহলের সীমা নেই। সবাই ঝুঁকে পড়ে শুনতে চাইল বানরের
থাবার রহস্যকাহিনি; কী সেই ম্যাজিক!
গেলাসে
চুমুক দিয়ে কাহিনি শুরু করতে করতে সার্জেন্ট মেজর
মরিস পকেট থেকে কী একটা বার করলেন।
ওপর থেকে দেখলে এমন কিছু নয়। একটা বানরের ছোটো থাবা, শুকিয়ে একেবারে মমি হয়ে গেছে বলা যায়। মিসেস হোয়াইটের দিকে এগিয়ে
দিলেন জিনিসটা। তিনি আতঙ্কে পিছিয়ে গেলেন। কিন্তু
মিসেস হোয়াইটের ছেলে হার্বাট থাবাটা হাতে নিয়ে ভালো করে নেড়েচেড়ে
পরীক্ষা করল। মিঃ হোয়াইট এরপর ছেলের কাছে থেকে থাবাটা নিয়ে ভালো করে দেখে টেবিলের
ওপর রেখে দিলেন।
“এর
মধ্যে বিশেষ ব্যাপারটা কী?” মিঃ হোয়াইট জিজ্ঞাসা করলেন।
“এর
মধ্যে একজন বুড়ো ফকিরের মন্ত্রশক্তি দেওয়া আছে। ফকিরসাহেব অবশ্য বেশ পবিত্র মানুষ।
তিনি প্রমাণ করতে চান, মানুষের জীবন চালায় ভাগ্য। অর্থাৎ যা হবার, তা অবধারিতভাবে
ঘটবে। কেউ রুখতে পারবে না। দুঃখ-সুখ সবই। তবে এর মধ্যে মন্ত্রের বলে ক্ষমতা দেওয়া
আছে যাতে তিনজন ভিন্ন ভিন্ন লোক এর থেকে তাঁদের তিনটি করে মনস্কামনা পূর্ণ করতে পারবে,”
সার্জেন্ট মেজর মরিস বেশ সিরিয়াসভাবে কথাটা বললেন।
“কিন্তু
স্যার, তিনজন লোক; এই শর্তটা নির্দিষ্ট হল কেন? তারও কারণ আছে নিশ্চয়,” মিঃ হোয়াইট বললেন।
প্রশ্নটা
শুনে সার্জেন্ট মেজর মরিস আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন।
মিসেস
হোয়াইট বললেন, “আপনি কি তিনটি ইচ্ছে জানিয়েছেন? সেগুলো পূর্ণ হয়েছে?”
“হ্যাঁ,
অবশ্যই,” সার্জেন্ট মেজর মরিস ঠক্ করে
গেলাসটা নামিয়ে রাখলেন। তাঁর গেলাস নামানোর ভঙ্গিমায় বোঝা গেল তাঁর বিশ্বাস কত
দৃঢ়।
“আরও
অনেকের কি এইরকম প্রার্থনায় লাভ হয়েছে?”
“হ্যাঁ,
প্রথমজনের তিনটি ইচ্ছেই ফলেছে। তাঁর প্রথম দুটো ইচ্ছে কী ছিল জানি না। কিন্তু তৃতীয়
ইচ্ছেটা জানি। সে মৃত্যু চেয়েছিল। সেটা অবশ্যই পূর্ণ হয়েছিল। তখনই আমি এই জিনিসটা
পাই। বানরের রহস্যময় থাবা; মাংকিজ প,”
সার্জেন্ট মেজর মরিসের গলার স্বর এবার ভয়ঙ্কর, গম্ভীর ও থমথমে দেখাল।
মিঃ
হোয়াইট বললেন, “কিন্তু মেজর মরিস, তোমার তিনটি ইচ্ছে যদি পূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে এখন তো আর এই জিনিসটা রেখে তোমার কোনো লাভ
নেই। এর যা কাজ, সে তো হয়েই গেছে। কিন্তু তবু তুমি এটা বয়ে বেড়াচ্ছ কেন?”
সার্জেন্ট
মেজর মরিস মাথা ঝাঁকালেন, “ধরে নাও, আমি এটা বিক্রি
করতে চাই। এর ক্ষমতা তো কম নয়। তবে এখন সত্যি বলতে, আমি এটা বিক্রি করতে চাইছি না।”
মিঃ
হোয়াইট বললেন, “তুমি যদি আর তিনটে ইচ্ছে একে জানাও, সেগুলো ফলবে?”
“জানি
না, সেটা বলা মুশকিল!”
সার্জেন্ট
মেজর মরিস এবার বানরের থাবাটা হাতে নিয়ে দু’আঙুলে ধরে ঝুলিয়ে রাখলেন। তারপর আচমকা
আগুনের দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
মিঃ
হোয়াইট অস্ফুট আর্তনাদ করলেন। তারপর ছুটে গিয়ে ফায়ারপ্লেস থেকে ওটা তুলে আনলেন।
সার্জেন্ট
মেজর মরিস বললেন, “আরে, ওটাকে পুড়িয়ে দেওয়াই ভালো।”
“মরিস,
তুমি যদি এটা ফেলে দিতেই চাও, তাহলে বরং আমাকেই দাও।”
“না, আমি
এটা কাউকেই দিতে চাই না। তাই আগুনে ফেলে দিয়েছিলাম। এখন, তুমি যদি ওটা রাখতে চাও,
রাখতে পারো, কিন্তু এরপর যা যা ঘটবে, তার
জন্য আমাকে দায়ী কোরো না। এখনও বলছি, ওটা আগুনে ফেলে দাও।”
মিঃ
হোয়াইট বললেন, “আমি ওটা রাখতে চাই। তুমি এটা কীভাবে চালিয়েছিলে, মানে পদ্ধতিটা কী?”
“অতি
সোজা। ডান হাতে এটাকে তুলে ধরো। তারপর তোমার মনের ইচ্ছেটা জোর গলায় প্রকাশ করো।
...কিন্তু, আবার বলছি, এর ফল ভালো হবে না।”
“আরব্য
রজনীর গল্পের মতো শোনাচ্ছে। বড়োই অদ্ভুত,” কথাটা বলে মিসেস হোয়াইট উঠে
রান্নাঘরে খাবার তৈরির জন্য চলে গেলেন।
মিঃ
হোয়াইট কোনও কথা না বলে নিজের পকেট থেকে একটা দশ পাউণ্ডের নোট বার করলেন। তিনজনই হেসে উঠল।
সার্জেন্ট
মেজর মরিস একটু সন্ত্রস্ত হয়ে মিঃ হোয়াইটের হাত চেপে ধরলেন, “আর আপনি যদি কিছু ইচ্ছা প্রকাশ করতেই চান যুক্তিসঙ্গত কিছু চাইবেন।”
মিঃ
হোয়াইট জিনিসটা পকেটে রাখলেন। রাতের খাবার এসে গেছে। খেতে খেতে ভারত ভ্রমণের নানা গল্প-কাহিনি শোনাতে থাকলেন সেনানায়ক সার্জেন্ট মেজর মরিস। হার্বাট হোয়াইট বললেন, “যদি এই
বানরের থাবার কাহিনিটার চেয়েও আরও অদ্ভুত কিছু
থাকে...।”
* * *
শেষ
ট্রেনটা চলে গেল। পেছনের দরজাটা বন্ধ। মিসেস হোয়াইট তাঁর স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“আচ্ছা, এটা যে নিলে, তার পরিবর্তে সার্জেন্ট মেজর মরিসকে কিছু দিয়েছ?”
“অতি
নগন্য কিছু দিয়েছি।”
“ও!”
মিঃ
হোয়াইট মজা করে বললেন, “আচ্ছা, আমরা যদি বিশাল ধনী হতে চাই, খুব সুনাম চাই।
বিখ্যাত হতে চাই!”
হার্বাট
হোয়াইট বলল, “আচ্ছা বাবা, আমরা তো রাজা বা সম্রাট হবার ইচ্ছেও প্রকাশ করতে পারি?”
মিঃ
হোয়াইট পকেট থেকে বানরের থাবাটা বার করলেন। সন্দিগ্ধ মনে দেখলেন, বললেন, “জানি না, আমি কী চাইব! কিন্তু এটা পেয়ে মনে হচ্ছে আমি যেন সবই পেয়ে গেছি।”
হার্বাট
হোয়াইট আবার রসিকতা করল, “কেন, যদি ভাড়াটেগুলোকে তাড়াতে চাও, তার জন্য মাত্র দুশো
পাউন্ড লাগবে... এটুকু চাইতে পারো।”
মিঃ
হোয়াইট বানরের থাবাটা ছেলের সামনে ঝুলিয়ে ধরলেন তারপর বললেন, “আমি দুশো পাউন্ড চাই।”
পিয়ানোটা
ঠুং ঠুং শব্দে বাজল। না, কেউ
বাজায়নি। সঙ্গে সঙ্গে মিঃ হোয়াইটের গলা দিয়ে প্রচন্ড আর্তনাদ বার হল। স্ত্রী এবং ছেলে দৌড়ে গেল তাঁর কাছে। মিঃ হোয়াইট বললেন, “আরে, বানরের থাবাটা ঘুরছিল, পাক
খাচ্ছিল, তারপর হাত থেকে ওটা পড়ে গেল।”
“কী বল!”
“এটা
সাপের মতো আমার হাতটাকে পাকে পাকে জড়িয়ে
ধরছিল।”
হার্বাট
হোয়াইট বানরের থাবাটা মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বলল, “কিন্তু দুশো পাউন্ডের চিহ্ন
দেখছি না। মনে হচ্ছে, দেখা যাবেও না কখনও! আমি বাজি রাখতে পারি।”
মিসেস
হোয়াইট বললেন, “সবই বুজরুকি কল্পনা।”
মিঃ
হোয়াইট মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “যাক গে,
তোমরা ঘাবড়িও না। কোনো ক্ষতি তো হয়নি। হ্যাঁ! একটা শক্
দিয়েছে বটে!”
ওরা আগুন
ঘিরে বসল। মিঃ হোয়াইট পাইপ ধরালেন। বাইরে ঝোড়ো বাতাস তীব্র হচ্ছে। আচমকা শোনা গেল
দরজায় কেউ যেন ধাক্কা মারছে। মিঃ হোয়াইট সন্ত্রস্ত, নার্ভাস। ওপরের সিঁড়িতে শব্দ
হচ্ছে। তিনজনে এবার চুপ, কীসের শব্দ?
* * *
পরের দিন
উজ্বল সকাল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই খোশগল্পে মত্ত। ‘বানরের থাবা’ নিয়ে গতরাতের যে
ভয় ওরা পেয়েছিল তাই নিয়ে হাসি-ঠাট্টা চলছে। ব্রেকফাস্টের পর হার্বাট হোয়াইট কারখানার উদ্দেশে রওনা দেয়।
মিঃ
হোয়াইট বললেন, “বানরের থাবাটা এখন কোথায়?”
হার্বাট
বলল, “ওই তো, নোংরা জিনিসটা একটা সাইনবোর্ডের ওপর অবহেলায় পড়ে রয়েছে!”
মিসেস
হোয়াইট বললেন, “আরে, সব সোলজারই একরকম! একটা ফালতু গল্প। এই আধুনিক যুগে এইভাবে
মানুষের ইচ্ছাপূরণ হলে তো আর কথাই ছিল না। কোথায় দুশো পাউন্ড? পাওয়া গেল?”
মিঃ
হোয়াইট তবু বললেন, “তা, সার্জেন্ট মেজর মরিস বলছিলেন এসব নাকি খুব স্বাভাবিক
স্টাইলে ঘটে। এমনভাবে হবে, তোমার মনে হবে কো-ইনসিডেন্স।”
সন্ধেবেলা পর্যন্ত মিঃ হোয়াইট তাঁর মতামতে অটল। তিনি জোর দিয়ে বললেন, “একটা কথা সম্পূর্ণ সত্যি! জিনিসটা আমার হাতে ছটফট করে নড়ছিল।
আমি শপথ করে বলতে পারি।”
মিসেস
হোয়াইট বললেন, “এখনও এই কথা বলছ?”
“নিশ্চয়ই
বলব! কোনো সন্দেহ নেই। আমি স্পষ্ট অনুভব
করলাম...।”
মিসেস
হোয়াইট দেখলেন একটা অপরিচিত লোক অদ্ভুতভাবে বাইরে গেট থেকে ঘরের ভেতরটা উঁকি দিয়ে
দেখার চেষ্টা করছে। মনে হয়, ঘরের মধ্যে আসতে চাইছে। লোকটার সুসজ্জিত পোষাক। মাথায়
নতুন সিল্কের টুপি চকচক করছে। সে গেটের কাছে একটু থামল। তারপর ঢুকে পড়ল বাগানে। হাঁটতে হাঁটতে এসে দরজায় হাত রাখল। তারপর হঠাৎ মনস্থির করে এক ধাক্কায়
দরজাটা খুলে ফেলল। ঘরের মধ্যে ঢুকে প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাপড়ের টুকরো বের করে
হোয়াইটদের বলল, “আমাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। আমি যেখান থেকে আসছি, সে জায়গাটার
নাম মস অ্যান্ড মেগিন্স।”
মিসেস
হোয়াইট চমকে উঠে বললেন, “কী হয়েছে? হার্বাট-এর কিছু
হয়েছে?”
মিঃ
হোয়াইট বললেন, “...আচ্ছা স্যার, আশা করব, আপনি কোনো দুঃসংবাদ আনেননি।”
লোকটি
শুধু বলল, “আই অ্যাম সরি, হার্বাট মারাত্মকভাবে
আহত। কিন্তু তাঁর কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না। সে সবরকম যন্ত্রণার
ঊর্দ্ধে চলে গেছে।”
বেশ
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
মিঃ
হোয়াইট বলে উঠলেন, “সে মেশিনে আহত হয়েছে। তাই তো!”
লোকটা
কাশতে কাশতে উঠে জানলার কাছে গিয়ে বলল, “ভীষণ আঘাত! সেই আমাদের একমাত্র...। আমাদের
কোম্পানি ঘটনায় মর্মাহত। আপনাদের সহানুভূতি জানাচ্ছে। আমি কর্মচারী মাত্র। খবরটা জানাতে আমার উপর আদেশ দেওয়া হয়েছে। মস অ্যান্ড মেগিন্স কোম্পানি
এর কোনো দায় নিতে রাজি নয়। কিন্তু তবু
আপনাদের পুত্রের সার্ভিসের মূল্য স্বীকার করে তারা কিছু অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসাবে
আপনাদের দিতে ইচ্ছুক।”
মিঃ
হোয়াইট ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। সংবাদবাহকের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন, “কী পরিমাণ অর্থ তারা দিতে চান?”
“দুশো
পাউন্ড!”
মিসেস হোয়াইটের
গলায় অস্ফুট আর্তনাদ। সেটার দিকে মন না দিয়ে শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে চেটে সামান্য
হাসার চেষ্টা করলেন বৃদ্ধ মিঃ হোয়াইট। তারপর জ্ঞান
হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।
* * *
দু’মাইল
দূরে কবরস্থানে মৃত সন্তানকে সমাধিস্থ করে হোয়াইট দম্পতি ফিরে এলেন। অন্ধকার ঘরে
বসে রইলেন তাঁরা। সমস্ত ঘর
নিস্তব্ধ। একটা কাহিনি ভালো করে আরম্ভ না হতেই যেন শেষ হয়ে গেল। তারা কিছুই বুঝে
উঠতে পারেননি এখনও! এত বড়ো শোক... এত আকস্মিক... সহ্য করাও
খুবই কঠিন। দিন কাটতে থাকে। বার্ধক্য তাঁদের মনকে আরও দুর্বল করে দেয়। অদ্ভুত একটা
বিতৃষ্ণা জাগে মনে। স্বামী-স্ত্রীও পরস্পরের সঙ্গে তেমন একটা কথাবার্তা বলেন না। সমস্ত জীবনটাই একটা বোঝা
মনে হয়। এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল।
এক রাতে
মিঃ হোয়াইটের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়িয়ে বুঝলেন শয্যায় তিনি একা। ঘরে নিশ্ছিদ্র
অন্ধকার। একটা চাপা কান্নার শব্দ আসছে। মিসেস হোয়াইটের
কান্না! তিনি উঠে বসলেন।
“এসো,
বিছানায় এসো। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
ফুঁপিয়ে
কাঁদছেন মিসেস হোয়াইট। বুঝিয়ে তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না।
হঠাৎ চিৎকার করে বললেন, “বানরের থাবাটা আমাকে ফিরিয়ে
দাও। আমি সেটা চাই।”
“ওটা ওই
ঘরে ব্র্যাকেটের পিছনে আছে। হঠাৎ তুমি সেটা চাইছ কেন? কী দরকার তোমার?”
মিসেস
হোয়াইট খুশিতে হেসে উঠলেন, “ওটার কথা এতক্ষণে মনে পড়ল। ওঃ! আগে কেন মনে পড়েনি? কেন ভুলে
ছিলাম?”
“কী ভুলে
ছিলে?”
“বাকি
দুটো ইচ্ছের কথা। তুমি তো মাত্র একটা ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলে। আরও দুটো জিনিস তো
চাওয়া যায়। ওই বানরের থাবার কাছে। তাই না?”
“তোমার
কি একটাতেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়নি?”
“না।
আমরা আরও চাইব। আরও দুটো প্রার্থনা জানাব। যাও, ওটা নিয়ে এসো।”
“কী
চাইবে?”
“একটা
ইচ্ছে, আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দাও।”
গায়ের
চাদর ছুড়ে ফেলে মিঃ হোয়াইট বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন, “তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?”
“আহ! তুমি তাড়াতাড়ি যাও। ওটা নিয়ে
এসো। যা বলছি, করো।”
মিঃ
হোয়াইট একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বললেন,
“বিছানায় যাও, শুয়ে পড়ো। ...তুমি কী বলছ তার মানে নিজেই বুঝতে পারছ না।”
মিসেস
হোয়াইট চিৎকার করে বললেন, “আমাদের প্রথম ইচ্ছে
পূর্ণ হয়েছে। তুমি দুশো পাউন্ড চেয়েছিলে, পেয়ে গেছ। ...তবে, তবে দ্বিতীয় ইচ্ছেটা
বলতে অসুবিধে কী?”
মিঃ
হোয়াইট বললেন, “হয়তো আগের ট্র্যাজেডিটা কাকতালীয়
ব্যাপার হয়েছিল।”
মিসেস
হোয়াইট কথাটা কানেই তুললেন না, বললেন, “যাও, দ্বিতীয় ইচ্ছেটা জানাও এই আলৌকিক
বস্তুটাকে।”
মিসেস হোয়াইটের
গলা উত্তেজনায় কাঁপছে। মিঃ হোয়াইট অগত্যা উঠে দাঁড়ালেন। তার পা কাঁপছে, গলা কাঁপছে। অনেক কষ্টে স্ত্রীকে বললেন, “আমাদের সন্তান আজ দশ দিন হল আমাদের ছেড়ে গেছে। ওর শেষ অবস্থায় আমরা ওকে দেখতে
পাইনি। শুধু তার বেশভূষা ছাড়া আর কোনো কিছুতে ওকে চেনা যায়নি... তুমি কি এখন ওকে আবার দেখতে চাও! সেটা কি অতি ভয়ঙ্কর
ব্যাপার হবে না? তাছাড়া এটা কি সম্ভব?”
“ওকে
ফিরিয়ে আনো,” চিৎকার করে উঠলেন মিসেস হোয়াইট। মিঃ হোয়াইটকে
দরজার কাছে টেনে নিয়ে গেলেন, তারপর
রুক্ষস্বরে বললেন, “তোমার কি ধারণা নিজের সন্তানকে দেখে আমি ভয় পাব? যে ছেলেকে আমি
জন্ম দিয়েছি, নিজের হাতে বড়ো করে
তুলেছি।”
মিঃ
হোয়াইট এবার অন্ধকারে চলে গেলেন সেই চাদরের
কাছে যেখানে বানরের থাবাটা লুকিয়ে
রাখা আছে। হ্যাঁ, ঠিক
জায়গাতেই আছে। তাঁর বুক ধুকপুক করছে। হার্বাট যদি আবির্ভূত হয়, তবে কী চেহারায় দেখা দেবে সে? ক্ষতবিক্ষত, রক্তাপ্লুত, বীভৎস? ইচ্ছে হল,
প্যাসেজের দিকে পালিয়ে যেতে।
শেষ
পর্যন্ত, ওই অদ্ভুত বস্তুটা হাতে তুলে নিতেই হল। তারপরে
ভেতরের ঘরে ঢুকলেন তিনি। মিসেস হোয়াইটের মুখ এখন অন্যরকম। ফ্যাকাসে,
কিন্তু তাঁর মধ্যে একটা প্রত্যাশার ছাপ! ত্রাস, আশঙ্কা - সব কিছু মিলিয়ে মুখটা অস্বাভাবিক করে
তুলেছে। এখন স্ত্রীকে দেখেও ভয় করছে মিঃ হোয়াইটের।
মিসেস
হোয়াইট বললেন, “বলো, শিগগির তোমার ইচ্ছেটা জানাও।”
“কিন্তু
সেই ইচ্ছেপ্রকাশ হবে চূড়ান্ত মূর্খামি, খুবই অশুভ!”
“যা বলছি
করো।”
এবার মিঃ
হোয়াইট বানরের থাবাটা হাতে উঁচু করে
তুললেন। স্পষ্ট উচ্চারণ করলেন, “আমার ছেলে আবার বেঁচে উঠুক।”
হাত থেকে
মেঝেতে খসে পড়ল আলৌকিক জিনিসটা। মিঃ হোয়াইট ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখছেন। এবার তিনি
চেয়ারের উপর এলিয়ে পড়লেন। কিন্তু মিসেস হোয়াইটের চোখ জ্বলন্ত। তিনি জানালার কাছে গিয়ে পর্দা তুলে ধরলেন।
মিঃ
হোয়াইট এবার উঠে বসলেন। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা! মিসেস হোয়াইট বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন। ঘরে
মোমবাতির আলো মিটমিট করছে। ঘরের সিলিং-এর দেয়ালে সব জিনিসের
ছায়া পড়ছে। একটু পরে মোমবাতির মোম ফুরিয়ে গেল। মিঃ হোয়াইট যেন হাঁফ ছাড়লেন। আলৌকিক
দ্রব্য ব্যর্থ হয়েছে। মিঃ হোয়াইট আস্তে আস্তে বিছানায় ফিরে গেলেন। দু’জনের কেউ কোনো কথা বলছেন না। ঘড়ির টিকটিক শব্দ! সিঁড়িতে শব্দ, দেয়ালের পাশ দিয়ে ইঁদুর দৌড়ে গেল।
এমন অন্ধকার অসহ্য!
একটু পরে মিঃ হোয়াইট সাহস সঞ্চয় করে নিচে গিয়ে আরেকটি মোমবাতি জ্বালালেন। কিন্তু
সিঁড়ির শেষ ধাপে আবার মোমবাতির আগুনটা নিভে গেল। তিনি আরেকটা কাঠি ধরাতে চাইলেন।
আচমকা দরজায় খুব মৃদু টোকা! মিঃ হোয়াইটের হাত
থেকে দেশলাই কাঠিটা পড়ে গেল। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি। কান খাড়া করে শব্দটা
শোনার চেষ্টা করছিলেন। শব্দটা প্যাসেজেও শোনা যাচ্ছে এবার। আওয়াজটা বার বার হচ্ছে। মিঃ হোয়াইটের দম আটকে আসছে। দৌড়ে ঘরে ঢুকেই
দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ঠিক সেই
সময়েই দরজায় বেশ জোরে কড়া নাড়ার শব্দ
পাওয়া গেল। সারা বাড়িতেই প্রতিধ্বনি শোনা গেল
শব্দটার। মিসেস হোয়াইট চমকে গেলেন, “ও কীসের
শব্দ!”
একটা
ইঁদুর সিঁড়ির উপর দিয়ে চলে গেল। এবার প্রচণ্ড শব্দে
সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করল। মিসেস
হোয়াইট উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এটা হার্বাটের টোকা। ও এসেছে,
দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে।”
দৌড়ে
দরজার কাছে গেলেন মিসেস হোয়াইট। কিন্তু মিসেস হোয়াইটকে জাপটে ধরলেন মিঃ হোয়াইট। জোর গলায়
বললেন, “এ কী করতে
যাচ্ছ তুমি? ভয়ংকর বিপদ নেমে আসবে। দরজা খুলো না একদম।”
মিসেস
হোয়াইট বললেন, “আমার ছেলে, আমার হার্বাট এসেছে। বোধহয় সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। তুমি
আমায় আটকে রেখেছ কেন? ছেড়ে দাও, আমায় দরজা খুলতে দাও।”
মিঃ
হোয়াইট এবার যেন মিনতি করছেন, “প্লিজ ঈশ্বরের দোহাই, ওকে ঘরে ঢুকতে দিও না।”
“তুমি
তোমার নিজের সন্তানকে ভয় পাচ্ছ?”
এবার
দরজায় পর পর কড়া নাড়ার শব্দ। মিসেস হোয়াইট
জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে দৌড়ে গেলেন। মিঃ
হোয়াইট তার পিছু পিছু যেতে যেতে ডাকতে থাকলেন, “যেও না, যেও না প্লিজ। একদম দরজা খুলবে না।”
মিসেস
হোয়াইট দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। দরজার
চেন খুলছে। বাইরে খট্ খট্ শব্দ, তার সঙ্গে জোরালো নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা গেল।
“ওহ!
শক্ত শেকল। তুমি এসো, আমি খুলতে পারছি না।”
মিঃ
হোয়াইট এবার হামাগুড়ি দিচ্ছেন। তিনি, সেই বানরের থাবাটা খুঁজছেন। ‘ইস্! বাইরের কেউ ঘরে আসার আগে যদি জিনিসটা পাওয়া যায়।’
এদিকে
ধাক্কার শব্দে দরজা কাঁপছে। ইতিমধ্যে একটা চেয়ার টেনে দরজার সামনে রেখেছেন মিসেস
হোয়াইট! শেকল বোধহয় খুলে গেল। বাইরের কেউ
এবার আসবে এখুনি! ঠিক সেই মুহূর্তে মিঃ হোয়াইট বানরের থাবাটা খুঁজে পেলেন। এইবার
তিনি তাঁর তৃতীয় এবং শেষ ইচ্ছেটা উচ্চারণ করলেন! সঙ্গে সঙ্গে সব শব্দ, ধাক্কার
আওয়াজ বন্ধ। যদিও এখনও ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনি চলছে। চেয়ার টানার শব্দ, দরজাও
খুলেছে। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস সিঁড়িতে পৌঁছে গেল।
সঙ্গে
সঙ্গে আর্তনাদ ও কান্না। সুতীব্র। চরম হতাশার কান্না! বাইরের গেট পর্যন্ত পৌঁছে
যাচ্ছে। “কেউ এসেছিল! কিন্তু চলে গেল। শেষ পর্যন্ত ঘরে ঢুকতে পারল না। ...কেন?”
মিঃ
হোয়াইট তাঁর তৃতীয় প্রার্থনাটা ইতিমধ্যে উচ্চারণ করে জানিয়ে দিয়েছেন বানরের থাবাকে।
“আমার
মৃত ছেলে বেঁচে উঠলেও তাকে এ বাড়িতে, এ ঘরে কোনোদিন আসতে দিও না। ও, মাই মাংকিজ্ প, দিস ইজ
মাই থার্ড উইশ্!”
--------
[‘দ্য মাংকিজ প’ গল্পটি ইংরেজ লেখক ডাব্লিউ ডাব্লিউ জেকবস-এর লেখা। গল্পটি ১৯০২ সালে তার ‘দ্য লেডি অব দ্য বার্জ’ গল্পসংকলনে প্রথম প্রকাশিত হয়]
--------
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment