গল্পের ম্যাজিক:: কালো চিতার সন্ধানে - আশিস কর্মকার


কালো চিতার সন্ধানে
শিস কর্মকার

বন্দুক চালানোটা আমাদের বংশের রক্তেই রয়েছে,” বললেন কুমার বাহাদুর বছর পঁচিশের তাঞ্জোর যুবক আমরা সবাই অর্থাৎ আমি আর গ্রামের অন্যান্যরা কুমার বাহাদুরের সামনে বসেছি কুমার বলে চললেন, “আমার ঠাকুরদার বাবা ভারতের প্রায় সর্বত্র ব্রিটিশদের সঙ্গে শিকারে বেরিয়ে শিটা বাঘ মারেন উইলসন সাহেব তাঁকে টাইগার ইটার নাম দেন যেমন বাঘের নাম হয় ম্যান ইটার সে রকমই আর কী তাহলেই বুঝুন” আকর্ণবিস্তৃত একটা গর্বের হাসি হাসলেন কুমার বাহাদুর
গ্রাম প্রধানের উঠোন একটা চেয়ারে বাঁ পায়ের উপর ডান পা তুলে, ডান কনুইয়ে শরীরটা ঠেস দিয়ে বসে কুমার বাহাদুর চেহারাখানা যেন কচি কলাগাছ, যার ঝকঝকে তাজা শরীরটাতে ফুটে উঠেছে পূর্বপুরুষের সমস্ত গু, গরিমা বাঁ দিকে নিচে চেয়ারের হাতলে হেলান দিয়ে রাখা আছে তার বন্দুকটা সামনেই খাটিয়ায় বসে গ্রাম প্রধান তাঁর পাশে আমি আর কয়েকজন উচ্চশ্রেণীর গ্রামবাসী আমাদের দুপাশে সাধারণ গ্রামবাসীরা মাটিতেই বসে পড়েছে উচ্ছ্বাসের চোটে আমি বললাম, “কিন্তু আপনি তো এখানে সত্যি সত্যি বন্দুক চালাতে আসেননি
“কথাটা ঠিক কিন্তু ঘুম পাড়ানি ওষুধ তো বন্দুক দিয়ে ছুড়তে হয় নাকি?” একটা সাফল্যের আনন্দ মাঝে মধ্যে কুমার বাহাদুরের মনের মধ্যে রিনরিন করে বেজে উঠছে তা কুমারের মুখটা দেখলেই বোঝা যায় গ্রাম প্রধান বললেন, “বন্দুক দিয়ে গুলি করা আর ঘুম পাড়ানি ওষুধ ছোড়া একই তো। শুধু গুলির জায়গায় ওষুধ থাকে – এই যা পার্থক্য গ্রামের অন্যান্য উচ্চশ্রেণীরা মোসাহেবের মতন গ্রাম প্রধানের কথার সমর্থন করল কথাটা অবশ্য ভুল কিছু নয় কুমার বাহাদুর এখন তাদের কাছে হিরোবংশ মর্যাদায় তো বটেই আর লক্ষ্যভেদী শিকারি হিসেবেএই একশো ওয়াটের হলদেটে আলোই তার স্পটলাইট হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র ছোটে লাকড়াকে দেখলাম ততটা খুশি সে নয়মুখটা কেমন গোমড়া করে রয়েছে। পা ভাঁজ করে দুই হাঁটুপর কনুই রেখে পিটা পেছনদিকে ঠেলে দিয়ে বসেছে আমি তার দিকে তাকাতেই সে ইশারা করে বন্দুকের দিকে ইঙ্গিত করে কী একটা বলতে চাইলআমি বুঝে ওঠার আগেই গ্রাম প্রধান সবাইকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে এই জমায়েত ভেঙে দিলেন কেননা আমাদের তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে হবে কাল সকালেই আবার বেরোতে হবে কালো চিতার সন্ধানে
জমায়েত শেষ হলে গ্রামবাসীরা কুমার বাহাদুরকে কুর্নিশ জানিয়ে ছায়ার মতন একে একে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল আমরা গ্রামপ্রধানের অতিথিআজ রাতে এখানে খাওয়া-দাওয়া করে কাল সকালে বেরিয়ে পড়বখেতে যাওয়ার আগে এখন একটু বিশ্রামে ব্যবস্থা করা হল
সব ঘটনার পিছনে এবং সামনে একটা করে ঘটনা থাকে কোন ঘটনাই এককভাবে ঘটতে পারে না তাই এই ঘটনার পিছনের ঘটনাটা বলা জরুরি
কুমার বাহাদুর এই গ্রামের কেউ নন আপার অসমের ঢেমাজি জেলায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বেশ কয়েকটা পরিবার মিলে গড়ে উঠেছে জামুগুরি গ্রাম এ কথা বোধ করি অনেকেই জানে যে হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলে অসম পাহাড়ে কদাচিৎ কালো চিতা দেখতে পাওয়া যায় এরা যেমন ক্ষিপ্র তেমনই হিংস্র হয়। অস ভারতবর্ষের একমাত্র জায়গা যেখানে কালো চিতার দেখা পাওয়া যায় তাদের মধ্যে একটা চিতা নিচে নেমে এসে ঢুকে পড়েছে চা বাগানে লোকালয়ে কয়েকদিন ধরেই সকাল হলে দেখা যায় এর খামারের মুরগি বা ওর খামারে ছাগল নেই ছিঁচকে চোরের কাজ মনে করে গ্রামবাসীরা প্রথম প্রথম নিজেরাই পালা করে রাত পাহারার ব্যবস্থা করে এবং চোর ধরা পড়লে তার কী ব্যবস্থা নেবে সেও ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু দেখা গেল চোর একটা মূর্তিমান যমদূতের মতন কালো চিতা তখন তাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় কে তার মোকাবিলা করবে? গ্রামে আতঙ্ক ছড়াল। এখন প্রায় প্রতি রাতেই হানা দিচ্ছে, এরপর দিন দুপুরে যে হানা দেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
গ্রামবাসীরা গ্রামের মুখিয়ার দ্বারস্থ হলর একটা ব্যবস্থা না নিলেই নয়। মুখিয়া বন দফতরের দ্বারস্থ হ বন বিভাগ থেকে ঠিক করা হয় যে চিতাটাকে ঘুম পাড়ানি গুলি ছুড়ে ঘুম পাড়িয়ে ছেড়ে দেয়া হবে পাহাড়ের আর পরে গভীর বনে এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমি নিজে একজন বিট অফিসার আমাদের দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বন্দুকধারী আছেকিন্তু ওই যমদূতের কাছে গিয়ে বন্দুক ছোঁড়ার মতন বুকের পাটা তাদের নেই অনেক বুঝিয়েরাজি করানো যায়নি তাই কুমার বাহাদুরকে ডাকা হয় অসবনবিভাগের তরফ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে কুমার বাহাদুর এক পায়ে রাজিএই পরিবারের শিকার কাহিনি গাঁথা হয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতায় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে শৃঙ্খলায় হাত এখন বাঁধা, নইলে সে ইতিহাস আর ক্রমান্বয়িত হত
সেই পরিবারেরই বংশধর কুমার বাহাদুর নিজেই সুদূর তাঞ্জোর থেকে গাড়ি চালিয়ে অসম বনবিভাগের অনুরোধ রক্ষা করতে চলে আসেনবনবিভাগ থেকে তাকে ঘুমপাড়ানি ওষুধ দেওয়া হয়েছে বন্দুক তার নিজেরই আজ কুমার প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন বংশের ধারা জয় করে নিয়েছেন সকলের মন কাল সন্ধ্যায় এখানে পৌঁছে বনবিভাগের বাংলোয় উঠেছেন। আজ দুপুরে গ্রাম প্রধানের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন
এই গ্রামে সর্বত্র এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নিতার ওপর অপ্রতুল সাপ্লাইয়ে বিজলি বাতি জ্বললেও অন্ধকারে দাপটে সঙ্গে পেরে ঠে না ফলে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে যেন এখানে রাত্রি নেমে যায় সন্ধ্যার আগেই কুমার বাহাদুরের পরামর্শ মতন চা বাগানের মধ্য দিয়ে যে আঁকাবাঁকা পথটা গ্রামে ঢুকেছে সেই পথে মুখেই একটা ছাগল টোপ হিসেবে রাখা হয়েছিলখানিক দূরে প্রায় সমান্তরাল ভাবে বেড়ে ওঠা দুটো সেগুনগাছের মাঝখানে বাঁধা হয় মাচামাচা থেকে কুমারের বন্দুক তাক করাই ছিল
শ্রাবণের আকাশআকাশে মেঘ থাকলে তা বিক্ষিপ্তপঞ্চমী চাঁদের জোছনায় সব কিছুই দেখা যাচ্ছে অস্পষ্টভাবে আকাশের তারাগুলো সজাগ দৃষ্টিতে পাহারা দিচ্ছে প্রকৃতিকে যেন কোথাও কোন অঘটন না ঘটে। গাছের ডালপালা পাতার ফাঁফোকর দিয়ে বর্ষার ভেজা বাতাস বইছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া দ্বিতীয় কোন শব্দ নেইতখন রাত প্রায় ন’টা আমরা সব কিছু প্রস্তুত করে গাছে উঠেছিলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এতক্ষণ টানা বসে থেকে থেকে আর ঠান্ডা হাওয়া মাঝেমধ্যে ঝিমুনি চলে আসছিল কুমার কিন্তু ঠায় বসেছিলেন পাক্কা শিকারির মতন। ছাগলটাও দেখলাম গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে
হঠাৎ বন্দুকের গুলির শব্দে আমার ঘুমের চটক ভেঙে গেল চোখ খুলে দেখি কালো একটা ভীষণ মূর্তি বিদ্যুৎ গতিতে ছাগলটাকে নিয়ে অন্ধকার চা বাগানের ভেতর ঢুকে গেল, আর দূর থেকে দূরে হারিয়ে গেল ছাগলটার ‘ব্যা ব্যা’ আর্তনাদ বললাম, “লেগেছে?
“লেগেছে, কিন্তু তবুও পালিয়ে গেল,” একটু হতাশা স্বরে বললেন কুমার আমি বললাম, “তবে তো ঠিকই আছে চলুন নেমে যাই
কাল খোঁজ লাগাতে হবে নিশ্চয় কোথাও না কোথাও ঘুমিয়ে পড়বে
আমরা মাচা থেকে নেমে ফিরে এলাম মুখিয়ার বাড়িতে।
এই হল পেছনের ঘটনা কুমারের কথা শুনে গ্রাম প্রধান খুব খুশিউনিই গ্রামের অন্যান্য মুরুব্বিদের খবর পাঠালেন তারপরেই এই বৈঠক

রাতে খাওয়ার পর শুতে যাওয়ার আগে কুমার আমায় বললেন, “এই কাজের দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম কেন জানেন?
“কেন?
“বংশের গরিমার প্রদীপের সলতেটাকে একটু উসকে দিতে
পরদিন কথাটা সূর্যের প্রথম আলোর মতনই চারিদিকে ছড়িয়ে প কুমার বাহাদুরকে দেখতে গ্রাম যেন ভেঙে পড়লযেন কোন ফিল্মি হিরো গ্রামে এসেছেবয়স্করা কুমারের হাত ধরে ধরে অনেক বিনয় দেখালেনতাঁদের জীবন বাঁচানোর জন্য কুমারকে ধন্যবাদ জনালেন র কুমারের দীর্ঘ জীবন কামনা করলেন। অল্প বয়স্করা অনেকে কুমারের সঙ্গে গ্রুপফি নিল। একটু বেলার দিকে রেঞ্জার সাহেব এবং অন্যান্য বনকর্মী এলে শুরু হল খোঁজার কাজ অনেক গ্রামবাসী আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য চলল। তাদের খুব উৎসাহ, এলাকার ত্রাস এখন ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু বেলা বারোটা পর্যন্ত প্রায় দশ বর্গ একর চা বাগান জনা পঞ্চাশ লোক চষে ফেললগাছের গোড়ায় গোড়ায় ঝোপের মধ্যে ছায়া গাছের মগে - কোথাও ঘুমন্ত কালো চিতা কারও নজরে এল নাতখন বুঝতে পারলাম যে ও ওর ডেরায় ফিরে গিয়েছে, অর্থাৎ পাহাড়ে উঠে গিয়েছে কুমার বাহাদুরের মুখটা কেমন যেন হতাশায় ছেয়ে গেল। আমি বললাম, “এখন কী উপায়?
কুমার বললেন, “আমাদের পাহাড়ে উঠতে হবেসেখানে খোঁজ চালাতে হবেরেঞ্জার সাহেব বললেন, “কিন্তু এত লোক মিলে তো পাহাড়ে উঠা যাবে না, আর তাছাড়া ওর ডেরাগিয়ে মারাটা কি সম্ভব?
“কেন সম্ভব নয় খুবই সম্ভব,” জোর দিয়ে বললেন কুমার, “আর সবাইকে তো যেতে হবে না আমার সঙ্গে ওর টেরিটরিটা যে চেনে সে গেলেই চলবেঅবশ্যই যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায়” কুমারের মনে যে রোখ চেপে গিয়েছে তা ওর কথাতেই বুঝলামতাঁর কাছে এটা একটা আত্মসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বললাম, “তাতে বিপদের সম্ভাবনা অনেক বেশি নয় কি?”
“কিন্তু রোজকার বিপদ তো কাটবেগ্রামের এত লোকের দৈনন্দিন আতঙ্ক তো কাটবে আর আপনি ভুলে যাচ্ছেন কেন,ন্দুক নিয়ে আগে থাকব আমিযদি বিপদ হয় তো সবার আগে আমারই হবেসে ভয় আমার নেই,” চোয়াল শক্ত করে বললেন কুমারআমি বললাম, “তার চাইতে বরং কালকের মতন টোপ ফেলে চেষ্টা করলে কেমন হয়?
“তাতে কোনও ফল হবে বলে আমার মনে হয় না সে আগামী কয়েকদিন আর আসবে না
“তারপরেই নয় হবে
“আমি সময় দিতে রাজি নই আজকেই ওর একটা ব্যবস্থা করবআমার সঙ্গে কেউ গেলে চলুন, নইলে আমি একাই যাব রেঞ্জার সাহেবের অনুমতি তো আছেইএবার সিদ্ধান্ত আপনাদের,” বেশ জোরের সঙ্গে বললেন কুমার
এইসব কথাবার্তা মধ্যেই এগিয়ে এল ছোটে লাকড়া
“সাহেব আমি যেতে রাজিআমি চিনি ঐ চিতার ডেরা,” খর্বকায় খালি বুকটা উঁচিয়ে বলল সে।
রেঞ্জার সাহেব বললেন, “তুমি পারবে নিয়ে যেতে?
“পারব
“কিন্তু যদি কোন বিপদ হয়?
“আমার তির ধনুক আছে না? সে তার তির ধনুক উঁচিয়ে ধরল
এতে কোন কাজ হবে? সাহেব সন্দেহ প্রকাশ করলেন
“কেন হবে নাআমার কাছে বিষ মাখানো তির রয়েছে
“কিন্তু সে তিপ্রয়োগ করবে খালি বিপদের সময়আর কখনোই নয় কিন্তুমনে থাকে যেন
ছোটে লাড়া বলল, “সাহেব, লাকড়া তীরকি এ সমস্ত জাতেরা কখনও জীবজন্তু মারে না। আমাদের লাকড়া পদবি বাঘকে স্মরণ করেতীরকি পদবিতে ইঁদুরকে স্মরণ করা হয়। সুতরাং বাঘ বা ইঁদুর সমস্ত জীবজন্তু আমাদের দেবতা সমান,” কথার মধ্যে ছোটে লাকড়ার জাত্যাভিমান বেশ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেল
ঠিক হল আমরা তিন জন যাবকুমার, আমি আর ছোটে লাকড়া। কুমারকে একা পাঠানো ঠিক হবে নার সত্যি বলতে কী রেঞ্জার সাহেব বা আমি কেউই ছোটে লাকড়ার তিরের ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারলাম নাতাই সাহেবের পরামর্শ মতন আমি সঙ্গ নিলাম উনি আমাকে একটা বন্দুক দিলেন সঙ্গে রাখার জন্য
গ্রাম প্রধানের বাড়ি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাঞ্চ সেরে বেশ কিছু জলের বোতল নিয়ে রওনা দিলাম রেঞ্জার সাহেবের জিপে করে আকাশ খন বেশ পরিস্কার দিনের আলো অনেকক্ষণ থাকবে বলে মনে হচ্ছে অবশ্য বলা যায় না, বর্ষাকাল, যখন তখন আকাশের রূপ বদলে যেতে পারে
একটা বাঁকের মুখে এসে ছোটে লাকড়া বলল জিপ থামাতে আমরা নেমে এলামরেঞ্জার সাহেব বললেন, “যা করবেন সাবধানে করবেন আমি সন্ধ্যার মধ্যেই এখানে গাড়ি পাঠিয়ে দেবচলি বলে রেঞ্জার সাহেব জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আমরা রওনা দিলাম
ধীরে ধীরে পাথরের গায়ে পা রেখে চড়াই-উৎরাই ভেঙে এগিয়ে চলেছিএদিকে কোন রাস্তা নেই প্রথমে কুমার বাহাদুর, কাঁধে বন্দুক নিয়েতার পিছনে ছোটে লাকড়া – পথ নির্দেশ করছে। আর তার পিছনে আমি। ছোটে লাকড়া বলল, “পাহাড়ের গায়ে সবুজ বনভূমির মধ্যে একটা গুহা আছে, সেখানে একদিন দেখেছিলাম ব্ল্যাক প্যান্থারকে গুহার সামনে আয়েশ করে বসে একটা মে শাবক খাচ্ছিল আমি জিজ্ঞাসা করি, গুহাটা তুমি চিনতে পারবে তো? উত্তরে সে বলল, “গুহাটা একটা সরু ঝরনার পাশে ফলে চিনতে কোনও অসুবিধা হবে না সুতরাং আমাদের লক্ষ্য প্রথমে ঝরনার কাছে পৌঁছনো
সূর্য মাঝ আকাশ ছাড়িয়েছে আগেইহাতে মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় আছেত কম সময়ের মধ্যে কতটা কী করা যাবে সেটা যথেষ্ট সন্দেহের বিষয় তাও হঠাৎ যদি বৃষ্টি নেমে যায় তবে তো কোন কথাই নেই
বনের ভেতর সূর্যের আলো ঠিকমতন পৌঁছতে পারছে না বলে একটা ছায়াঘন ভাব রয়েছে দূরে নিচে দুটো পাহাড়ের সঙ্গমস্থলে সূর্যকিরণের আলোছায়া অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে আমাদের দু’পাশে পাহাড়ি গুল্মের ঝোপ আর আকাশছোঁয়া সেগুন, শিশু, গামারি গাছ
অতি সাবধানে পা ফেলে চলেছি আমরাআমাদের তিন জোড়া চোখ এখন র‍্যাডারের মতন ঘুরছে চারিদিকেগাছের উঁচু উঁচু ডালেও চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি বড়ো বড়ো পাথরের বা ঝোপের সামনে এলেই পা টিপে টিপে অতি সন্তর্পণে এগোচ্ছিকুমার বাহাদুর এতটাই উদগ্রীব যে মাঝেমধ্যে নিজেকে বিপজ্জনক দূরত্বে নিয়ে চলে যাচ্ছেন আবার ডাকলে ফিরে আসছেন। এভাবে অনেকক্ষণ চলার পর কুমার বাহাদুর শান্ত কণ্ঠে বললেন, “আমরা কিন্তু ওর টেরিটরিতে পৌঁছে গিয়েছি সুতরাং সাবধান কাঁধ থেকে বন্দুকটা নামিয়ে হাতে নিলেন তিনি
“কী করে বুঝলেন?” প্রশ্ন করলাম আমি কুমার বললেন, “কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে, কালো চিতা নিজেদের এলাকা চিহ্নিত করতে নিজেদের পায়খানা পেচ্ছাপ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখেওই দেখুন” বলে তর্জনী দিয়ে একটা জায়গায় নির্দেশ করলেন জায়গাটাতে খানিকটা উর্বর মাটির মতন কিছু পড়ে রয়েছে। বুঝলাম ওটা ওর পায়খানা কুমার বললেন, “অবশ্য ওর টেরিটরি বুঝতে হলে চাই প্রখর দৃষ্টি শক্তি এবং ঘ্রাণ শক্তিআমি এখান থেকেই ওর দুর্গন্ধ টের পাচ্ছি, আপনারা পাচ্ছেন কী?
“না,” বললাম আমি, “কিন্তু ছোটে লাকড়ার কথা অনুযায়ী ঝরনা তো এখনও এল না!
ঝরনাকাছে গুহা মানে এই নয় যে ও খালি ওখানেই বা ওর টেরিটরির চৌহদ্দিতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে কয়েক কিলোমিটার, প্রায় চার থেকে নয় বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ওদের তৈরি হয় এলাকাঐ এলাকার অধিপতি এবং শুধু তাই নয়, একটা এলাকায় একটাই মাত্র পুরুষ চিতা থাকবে অন্য কোনও পুরুষ চিতার সঙ্গে এলাকা আপস করতে চায় না যদি কোনও পুরুষ চিতা অন্য কোনও চিতার ডেরাঢুকে যায় তবে শুরু হয়ে যায় মরণপণ লড়াই অবশ্য একটা স্ত্রী চিতা অন্য স্ত্রী চিতার সঙ্গে আপস করে একসঙ্গে থাকতে পারে
কথা বলতে বলতে এগোতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেলেন কুমার বন্দুকের নলের ডগা দিয়ে মাঠের দিকে দেখিয়ে বললেন, “পাগমার্ক!
আমরা নিচু হয়ে দেখলামকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়ে এক জায়গার নরম মাটির ওপর ছাপ পড়েছেতিনটে পায়ের ছা একটা পায়ে কালকের ঘুমপাড়ানি গুলিটা লেগেছে বলে ঐ পা খুঁড়িয়ে চলেছে। ছাপগুলো ক্রমশ এগিয়ে গিয়ে মিলিয়ে গিয়েছে একটা ঝোপের পেছন দিকে
তার মানে আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছিতাই তো?” ছোটে লাকড়াকে জিজ্ঞাসা করলেন কুমার এতক্ষণে ছোটে লাকড়া মুখ খুললবলল, “হ্যাঁ সাহেব, আরও খানিকটা গেলে ওর গুহাছোটে লাকড়ার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, এমন সময় ঝোপটা হঠাৎ করে নড়ে উঠলকিতে আমরা প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম কুমার বাহাদুর বন্দুক তা করলেন ঝোপের দিকে আমিও তাগ করলামআর ছোটে লাড়া ধনুকের ছিলায় তির টেনে তৈরি
তিনজনেই স্থির ঝোপটা নড়ছে নড়াচড়াটা বেড়েই চলেছে আমার হৃদযন্ত্রের গতিও সেই তালে বেড়ে চলেছে কুমার অত্যন্ত সন্তর্পণে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছেন ঝোপটার পেছন দিকেআমার চোখ একবার কুমারের দিকে আর একবার ঝোপের দিকে ঘুরছে ছোটে লাকড়াও কুমারের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছেহঠাৎ ঝোপের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল তার মানে কি চিতাটা ওর শিকার ঠিক করে ফেলেছে! খানিক বাদেই ঝোপের ভেতর থেকে কালো কী একটা বেরিয়ে এসে সামনের দিকে এগিয়ে চলল কুমার বললেন, “নড়বেন না, একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন পাহাড়ি শঙ্খচূড় - ভয়ানক বিষধর
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম দম বন্ধ করেআর আমার হাত কয়েক সামনে দিয়ে প্রায় মিটার তিনেক লম্বা একটা লিকলিকে শরীর ঝোপ থেকে বেরিয়ে পাথরের খাঁজের মধ্য দিয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল আমরা কেউ তাকে বিরক্ত করলাম না, তাই সেও আমাদের কোনও অসুবিধা করল নাআমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন
অন্ধকার হয়ে এসেছে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি একটু কালচে আভা বোধ হয় একে একে মেঘের জমায়েত হচ্ছে রাতে আয়োজনের জন্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দিন প্রায় শেষ শুধু মেঘের কোন দোষ নেই বললাম, “এবার চলু ফেরা যাকঅন্ধকার হয়ে এসেছে, বৃষ্টিও আসতে পারেপুরোপুরি অন্ধকার নামার আগে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়াই ভালোকুমার মুখে আক্ষেপসূচক আওয়াজ করে বললেন, “সে তো ফেরা যাবে, কিন্তু চিতা? তার কী হবে?
“তার ব্যবস্থা কালকে করা যাবে,” ছোটে লাকড়াও আমার কথায় সায় দিয়ে বলল, “কালকে সকাল সকাল চলে আসব, তবে পুরো বেলাটা পাব
লুন তাহলে ফেরা যাকঅন্ধকার হয়ে এসেছে,” নিরাশ হয়ে বললেন কুমার
আমরা ফিরে চললাম রাস্তার দিকে এবার প্রথমে ছোটো লাড়া, মাঝে আমি আর আমার পিছনে কুমার চলেছেন। গাছের পাতার ভেতর থেকে ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে রয়েছে বনটা পাহাড়ের কোলে কোলে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাদূরে আকাশের গায়ে কতগুলো বড়ো ডানাওয়ালা পাখি ক্লান্ত ডানায় ভর করে সাঁজোয়া বিমানের মতন সারিবদ্ধ হয়ে ফিরছে বাসায়অন্ধকার ক্রমে বেড়ে চলেছে

পরদিন সকাল সকাল আমরা বেরিয়ে পড়লাম মুখিয়াই আজ গাড়ির বন্দোবস্ত করেন। সে গাড়ি করেই আমরা কালকের সেই বাঁকের মুখে এলাম। বিকেল বেলায় গাড়িটা আবার এখানেই অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য
আজ দুপুরে খাবার জঙ্গলেই সারবতাই আমাদের সঙ্গে খাবার রয়েছে। জল, খাবার বহন করার জন্য মুখিয়া একজন বাহক পাঠিয়েছেন
প্রকৃতি চলেছে প্রকৃতির নিয়মে সকালে কাঁচা রোদে চারিদিক যেন হলুদগোলা জলে স্নান করছে গাছে গাছে পাখিদের ব্যস্ততা আমরা খালি এসেছি প্রকৃতির নিয়মের ব্যাঘাত ঘটাতে কুমার বললেন, “ঢোকার আগে একটা কথা আপনাদের বলি অবশ্য আপনি (আমাকে দেখিয়ে) নিজে একজন বনকর্মী, আপনাকে বলাটা আমার সাজে না আমি হেসে বললাম, “না নাবলুন নাব্যাপারটা হয়তো আমার জানা নেই জানা হয়ে যাবেকুমার হেসে বললেন, “কালো চিতা বা ব্ল্যাক প্যান্থার মিশমিশে কালো বিড়ালে বৃহৎ সংস্করণ ওরা সাধার লেপার্ডের থেকে অনেকগু হিংস্র হয় আর এদের গায়ের রং পুরোপুরি কালো নয় কিন্তু একটু থামলেন কুমার, তারপর আবার বললেন, এদের প্রত্যেক প্রজাতির গায়ের ছাপ কিন্তু একই হয় না। আলাদা হয় কারও বা ডোরা ডোরা, কারও বা ফুল ফুল ছা আর এই ছাপের উপরে পাতলা কালো একটা লেয়ার থাকে, ইংরেজিতে যাকে বলে টিন্ট খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কালো টিন্টের তলায় এদের আসল গায়ে ছাপ রয়েছে এ ধরনের ছাপকে বলে ভুতুড়ে ডোরা
“ক্যামোফ্লা সবই প্রকৃতির আশ্চর্য সৃষ্টি,” বললাম আমি।
ওদের গায়ের রঙের জন্যই অন্ধকারে বা ঝোপের আড়ালে ছায়াতে এমনভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে যে টেরই পাওয়া যায় না
“ওরা শিকার ধরতে খুব পটু। এমনভাবে শিকারের সামনে আসবে যে শিকার টেরই পাবে না অথবা শিকার নিজেই তার সামনে চলে আসে
“সুতরাং আমরা শিকারি হলেও ওর কাছে কিন্তু শিকার,” হেসে বললেন কুমার
কথায় কথায় আমরা সেই ঝোপটার কাছে চলে এলাম কালকে যেহেতু এই পথে একবার এসেছিলাম তাই সময় কম লাগল এবার আমাদের এগিয়ে যেতে হবেরনার দিকে ছোটে লাড়া বলে দিচ্ছে, আর আমরা এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে। কুমার আজ ন্দুকটা হাতে নিয়ে চলেছেন
প্রায় ঘন্টা তিন বিভিন্ন চড়াই-উৎরাইয়ের পর একটা শব্দ কানে এল প্রথমে একটু ভয় পেলেও ভালো করে শুনে দেখি অনেক উঁচু থেকে পাথরের উপর জল আছড়ে পড়লে যেমন শব্দ হয় সে রকম শব্দ ছোটে লাকড়া বলল, “ঝরনা কাছাকাছি চলে এসেছিওই যে শব্দ শোনা যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পাথরের আড়াল থেকে জলের ধারা দেখতে পেলাম ছোটে লাকড়া বলল, “সাহেব, এবার আমাদের খুব সাবধানে এগোতে হবে
আস্তে আস্তে ঝরনার কাছে চলে এলাম পরদিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে যেন সাদা সিল্কের শাড়ি প্রায় খাড়াভাবে পাথরের ধাপে ধাপে পর থেকে নিচে নেমে আসছে আর পাথরে ওপর আছড়ে পড়ে মুক্তার মতো জলের কণা ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকেঝোরা নেমে গেছে পাহাড়ের আর নিচে বর্ষাকাল বলে ঝরনার জলের তোড় বেশ ভালো। ফুট দশেক চওড়া রনাটা কুমার জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন দিকে গুহাটা? ছোটে লাকড়া বলল, ঝোরাটা পেরিয়ে যেতে হবে সাহেব ঝরনাটা পেরোলে কিছুটা এগিয়ে একটা উঁচু টিলার ওপর বড়ো একটা পাথরের পাশে গুহামুখটা” আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল আমরা প্রায় ওর বাসস্থানের সামনে চলে এসেছি, সুতরাং যে কোনও মুহূর্তে মূর্তিমান যমদূতের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে
দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গিয়েছে কীভাবে যে সময়টা কেটে গেল বুঝতেই পারিনি সূর্য এখন মাথার উপর থেকে কিরণ দিচ্ছে, ফলে গাছের পাতা ভেদ করে নিচের দিকে আলো-আঁধারি ছক কেটেছে কুমার বললেন, রনা পা হওয়ার আগে লাঞ্চটা সেরে নিলে ভালো হয়। ওদিকে গিয়ে খাওয়ার সময় নাও পাওয়া যেতে পারে, আর রিস্কিও কুমার দূরবিন দিয়ে ভালো করে চারদিক দেখে নিলেন। আমিও সম্মতি জানিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে বাহককে বললাম খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে নিয়ে বাহক আর ছোটে লাকড়া মধ্যাহ্ন ভোজনের ব্যবস্থা করতে লাগল
মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে তৈরি হয়ে নিলাম এবার ঝরনা পা হওয়ার পালাছোটে লাড়ার কথামতন আমরা পাশাপাশি করে পড়ে থাকা বোল্ডারের কাছাকাছি চলে এলাম। বোল্ডারগুলোর পাশ দিয়ে তো বটেই, মাঝেমধ্যে পর দিয়ে জলের ধারা নেমে যাচ্ছে তার ওপরই পা ফেলে ঝরনার ওপারে যেতে হবেএকটু পা হড়কালেই গভীর খাদে! নিচের দিকে তাকিয়েই বুক কেঁপে উঠল! বললাম, “এছাড়া আর কোনোভাবে ওপারে যাওয়া যায় না? ছোটে লাকড়া বলল, “এটাই শর্টকাটনইলে আবার নিচে নেমেরনা পার হয়ে ওপরে উঠতে হবে
ছোটে লাকড়ার এই কথায় মনটা দমে গেলএতখানি চড়াই ভেঙে পরে উঠে আবার নিচে নেমে উপরে ওঠা মোটেই সহজ কথা নয় এদিকে কর্তব্য বড়ো বালাই তাই ই পথে যাব – এই ভেবে মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম কুমার কোনও দিকে না তাকিয়ে বোল্ডারের ওপর পা রেখে রেখে কিছুক্ষণেই পার হয়ে গেলেনএবার আমার পালা তারপর আমাদের খাবার বাহক এবং সব শেষে ছোটে লাকড়া আমার তো বুক ধুকপুক করছে পাশের বোল্ডার এক হাতে ধরে একটা বোল্ডারের গায়ে পা রাখলাম। প্রথম বোল্ডারটা কোনোক্রমে পার হলাম পরেরটাতে পা দেব, এমন সময় অন্য একটা বোল্ডারে খাঁজের পেছনদিকে চোখ গেল বুকটা ধড়াস করে উঠলকুমারে চোখে পড়েনি বোধহয়জিনিসটা একটা আধখাওয়া ছাগলের শরীরআমার পেছনেই ছিল ছোটে লাকড়া। তারও চোখে পড়েছে জিনিসটা। বলল, “সকলেই বোধহয় এখানে খেয়ে জল খেয়েছে ঝরনা থেকে” আমি কুমারকে ডাকলাম উনি দেখে গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “খুব সাবধান, কাছাকাছি কোথাও আছে হয়তোবলে উনি চোখে দূরবিন রাখলেন। আমার পা যেন বোল্ডারের মধ্যেই সেঁধিয়ে গিয়েছে। পা আর সরে না। পিছিয়ে যে যাব সে উপায় নেই। এমন সময় ঝরনার জলের আওয়াজ ছাপিয়ে চিতার ডাকের শব্দ পেলাম। শব্দটা সম্ভবত পাহাড়ের ওপর থেকেই এল কুমার বললেন, “তাড়াতাড়ি চলে আসুন ওপরে আছে
কোনোরকমে আমরা ঝরনাটা পার হলাম। কুমার পর দিকে বন্দুক তা করে এগোতে লাগলেন। এখানে জঙ্গলটা খুব ঘন বড়ো বড়ো সব সেগুন, মেহগনি, গামারি, শিশুগাছে ভর্তি অনেক মোটা মোটা তাদের গুঁড়ি বনের ভেতরটা অন্ধকার অন্ধকারএরকম পরিবেশ ওদের গা ঢাকা দেওয়ার পক্ষে দারু এখান থেকেই পাহাড়টা একটু খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছেওপর থেকে আবার হুঙ্কার কানে এল ছোটে লাকড়া বলল, “মনে হচ্ছে ও গুহার খুব কাছাকাছি আছে ওদিকে ওর গুহা আঙুল দেখিয়ে দেখাল ছোটে লাকড়া। ছোটে লাকড়ার নির্দেশ অনুযায়ী কুমার পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে তরতর করে উঠতে লাগলেন আমরা পিছন পিছন উঠতে লাগলাম পর দিকে চোখ রেখে
হঠাৎ করে ‘গোঁ গোঁ গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ হতে লাগল আর উপরের দিকে সামনের ঝোপটা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল আমরা সবাই ভয়ে মকে গেলাম বন্দুক, তির, ধনুক তাগ করলাম সে দিকেকিন্তু নাকিছুক্ষণের মধ্যেই বড়ো বড়ো গাছের মাথাগুলোও দেখলাম চঞ্চল হয়ে উঠল। তারা এদিক ওদিক মাথা নাড়াচ্ছেমুহূর্তে দেখলাম একটা প্রচন্ড হাওয়ার বেগ ওপর থেকে নিচের দিকে ধেয়ে আসছে ছোটে লাকড়া বলল, সাহেব, নেমে আসুন। ঝড় উঠেছে কুমার তাড়াতাড়ি একটা গাছের আড়াল নিয়ে নিলেন আর আমরাও আমাদের কাছাকাছি গাছের গুঁড়ির আড়াল নিয়ে নিলাম তারপর চোখের সামনে যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য ঝড়-দানব যেন বনে পাহাড়ে লুটতরাজ করতে এসেছে ঝড়ের দাপটে গাছেরা সব নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না আমাদের একটু দূরেই একটা শিশুগাছের বেশ বড়োসড়ো একটা ডাল ট্‌ মট্‌’ শব্দ করতে করতে ঝুলে গেল কত রকমের পাতা, ডাল ঝড়ের সঙ্গে খড়কুটোর মতো ভেসে আসছে কখন যে কী বিপদ ঘটে কিছুই বলা যায় না
গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে একেই কালো চিতার ভয় তার মধ্যে এই পাহাড়ি ঝড় মনে মনে ভাবলাম, কেন যে কুমারে কথায় আসতে গেলাম। তার চাইতে ওকে একা পাঠিয়ে দিলেই ভালো হত একটা বন্ডে সই করিয়ে নিলেই হতওর জন্য আরও তিনটে জীবন কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে! এখন এখান থেকে সুস্থ শরীরে ফিরতে পারলেই হয়
হঠাৎ করে ঝরনার দিক থেকে একটা অদ্ভুত আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি কয়েকটা বড়ো পাথর ঝরনার পাথরের ধাপে ধাপে স্রেফ বলের মতন লাফাতে লাফাতে নিচের দিকে নেমে আসছে। বেশিক্ষণ সময় নেনি মিনিট পাঁচ-সাতের ঝড়ই যথেষ্ট ভয়ংকর বনে বোধহয় এ ধরনেঝড়ের দাপটে খুব একটা কিছু পালটায় না, যদি না দাবানল হয় আকাশে একটা কালো মেঘের উদয় হয়েছিল ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটাও বিদায় নিয়েছে ভেবেছিলাম বৃষ্টি আসবে, কিন্তু তার হয়নিআবার সূর্য উঁকি দিচ্ছে গাছের ডাল-পাতা ফাঁক থেকে আমরা আবার রওনা দিলাম বেশ কিছুটা চড়াই-এ গিয়ে একটা খাড়াই টিলার গায়ে গুহাটা দূরবি দিয়ে চারদিকটা একটু ভালো করে দেখে নিলামতারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন কুমারদুপুরে পরের তির্যক আলো গুহাদ্বারটা ছাড়িয়ে ভেতরের দিকে বেশ কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে সেখানে বাঘটাকে দেখতে পাওয়া গেল না কুমারের সাহসিকতার তারিফ করতে হয় বললেন, “আপনারা সবাই টিলার আড়ালে দাঁড়ান” আমরা যাওয়ামাত্রই কুমার একটা পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে ছুড়ে মারলেন গুহা দ্বারে তারপর বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রইলেনকিন্তু বাঘটার তরফ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া না আসায় তিনি আরও একটা পাথরের টুকরো ছুড়ে মারলেন গুহা দ্বারেএবারও কোনও প্রতিক্রিয়া হল না এবার কুমার গুহার ভিতর একটা পাথর ছুড়লেন তাতেও কোন প্রতিক্রিয়া হল না
“ভেতরে নেই বোধহয়,” বললেন কুমার ছোটে লাকড়া বলল, “ও কি আর এক জায়গায় থাকে? তারপর যখন একবার গুলি খেয়েছে?
“আরেকটু উপরে উঠে দেখি, কী বল?
চলুন
টিলার পাথরে পা রেখে উঠতে শুরু করলাম আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই টিলার মাথায় উঠে গেলাম সেখান থেকে চারিদিক দেখে নিয়ে ক্লান্তি কাটাতে বসে পড়লাম
এখান থেকে দূরে পাহাড়ের গায়ে থাকা গাছগুলো মাথা খালি দেখা যাচ্ছেআর পাহাড়ে ধূসর শিখনিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায় একটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে আরেকটা পাহাড় দাঁড়িয়ে রয়েছে পাদদেশে গভীর ভি সৃষ্টি হয়েছে মনে মনে ভাবলাম, এত গভীর অরণ্যে কোথায় যে চিতাটা রয়েছে তা অনুধাবন করা চাট্টিখানি কথা নয়
এরপর আমাদের পরিকল্পনা কী হবে তা জানি না কুমারকে জিজ্ঞাসা করতে উনি বললেন, “অপেক্ষা করা যাক কিছুক্ষণ ও হয়তো ফিরে আসবে মনে মনে ভাবলাম ভালোই হল, আর চড়াই-উৎরাই ভালো লাগছে নাকিছুক্ষণ দেখে ফেরার প্রস্তাব দেব, কেন না এখন বিকেল হয়ে এসেছেএকটু অন্ধকারাচ্ছন্ন ভাব হয়েছেসন্ধ্যা নামতে খুব দেরি নেই
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও চিতার দেখা পেলাম না কুমার বললেন, “এভাবে ডেরায় এসে বামারাটা ভাগ্যের ব্যাপারকখন যে তার দেখা পাওয়া যায় তা ঠিক নেই! একটা হতাশার স্বর ফুটে উঠল কুমারের গলায়
“তবে কি দিনকয়েক পর আবার সেই টোপের ব্যবস্থা করব? প্রশ্ন করলাম আমি
“সেটা করলেই বোধহয় ভালো হবে কুমারের কথা শেষ হবার পর পরই হঠাৎ পেছন থেকে একটা শব্দ চমকে উঠে ফিরে তাকাতেই আবার চমকে উঠলাম - কালো চিতা! কখন যে আমাদের কথার ফাঁকে আমাদের প্রায় পেছনে টিলার ওপর চলে এসেছে তা টেরই পাইনিকুমারকে বন্দুক তোলার সময় না দিয়ে চিতাটা গর্জন করেই এক ঝাঁপ দিল কুমারের ঘাড় বরাবর আর প্রায় বিশ ফুট উঁচু টিলা থেকে কুমারকে নিয়ে পড়ল একসঙ্গেতার বন্দুকটা গেল ছিটকে তারপর সে দৃশ্য চোখে দেখার মতন নয় আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগল কুমারের শরীর। কুমার প্রাণপণ চেষ্টা করেও ওর হাত থেকে রেহাই পেলেন না, না পারলেন পালটা আক্রমণ হানতে। দেখতে দেখতে রক্তে রাঙা হয়ে গেল কুমারের শরীর আমি বন্দুক হাতে তাগ করলাম ঠিকই কিন্তু হাত এত কাঁপছে যে ঘুম পাড়ানি ওষুধ চিতার গায়ে না লেগে কুমারের গায়ে লেগে যেতে পারে। আর তাছাড়া দু’জনের অবস্থান বার বার পরিবর্তন হচ্ছে। এই অস্থির সময়ে বন্দুক চালানোটা পাকা শিকারির কাছেও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় এমন সময় ছোটে লাকড়ার ছোড়া একটা তীর গিয়ে বিঁধল চিতাটার গায়ে। চিতাটা ক্রমশ নিস্তেজ হতে হতে মিনিট কয়েকের মধ্যেই নেতিয়ে পড়ল
চিতাটার কী হল তা দেখার সময় আমাদের নেইকুমারকে পাঁজাকোলা করে ছোটে লাকড়া ছুটে চলল রাস্তার দিকেঅবাক হয়ে দেখলাম ছোটে লাকড়ার ছোটোখাটো শরীরে কী ভীষণ শক্তি! প্রায় সাড়ে ছ’ফুটের বলিষ্ঠ দেহটা কাঁধে ফেলে তরতরিয়ে নির্দিষ্ট একটা ছন্দে এগিয়ে চলেছেআমরা তার পিছনে পিছন চললাম
অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন কুমার সারা শরীরে যেন ধারালো ছুরি চালানো হয়েছে এমন ফালা ফালা হয়ে কেটে মাংস ঝুলছে তার শরীরের রক্তে ভিজে গিয়েছে ছোটে লাকড়া শরীরও
রেঞ্জার সাহেবকে ফোন করে দিয়েছিলামউনি এম্বুলেন্স আর বেশ কিছু কর্মী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। আমরা রাস্তায় ওঠার আগেই ওঁরা পৌঁছে যান আমাদের কাছে তারপর মেডিকেল টিম কুমারকে এম্বুলেন্স করে হাসপাতালে রওনা দিলআরেকটা দল চলল চিতাটাকে কয়েদ করতে
চলার পথে ঝরনার জলে শরীরের রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলল ছোটে লাকড়া রেঞ্জার সাহেব বললেন, “তুমি তাহলে চিতাটাকে মারলে? সাহেবের এই কথায় বিস্মিত হয়ে সাহেবের দিকে তাকাল ছোটে লাকড়া। তারপর বলল, “আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন স্যারমারলে কুমার বাহাদুর মারতেন কিন্তু চিতাটা সেই সুযোগ তাকে দেয়নি
“কুমার বাহাদুর? সে তো ঘুম পাড়ানি ওষুধ মারত
“চলুন দেখাচ্ছি
বেশ কিছুটা এগিয়ে চিতা তিরবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকা দেহটা দেখা গেল কিছুটা দূরেই কুমারের বন্দুকটা। বনকর্মীরা চিতার মুখে জাল আটকে পা বাঁধতে লাগল ছোটে লাকড়া কুমারের বন্দুকটা তুলে নিয়ে এসে রেঞ্জার সাহেবে হাতে দিয়ে বলল, “গুলিগুলো বার করুন স্যার, তাহলেই বুঝবেন
রেঞ্জার সাহেব বন্দুকের গুলিগুলো বার করে অবাক হয়ে গেলেনবললেন, এ তো বুলেট। ঘুমের ওষুধ কোথায়!
“সেটাই তো বলছি স্যর। কুমার বাহাদুর পরশু সন্ধ্যায় যে গুলিটা করেছিলেন সেটাও ঘুম পাড়ানোর ছিল না, ছিল গুলি আর সেই গুলিতেই চিতার পিছনে ডান পায়ে জখম হয় আমি অবাক হয়ে বললাম, “সে জন্যই ও ঘুমায়নি আর ঘুমপাড়ানি ওষুধ যদি খুলে পড়ত তবে তো খুঁজে পাওয়া যেত সেটাও তো পাওয়া যায়নি! এতগুলো লোকের কারও না কারও চোখে পড়ত ঠিকই
রেঞ্জার সাহেব চিতার পেছনে ডান পা দেখলেন দেখলাম আমরাগুলিটা এখন রয়ে গিয়েছে সাহেব বললেন, “কুমার আমাদের ধোঁকা দিয়েছেন
ছোটে লাকড়া বলল, “আমি স্যার প্রথম দিনই বন্দুকের মুখে বারুদের গন্ধ পেয়েছিলামতখনই এই স্যারকে (আমাকে দেখিয়ে) বলার চেষ্টা করি, কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনিতাই আমিও তিরে ঘুমের ওষুধ মাখিয়ে নিয়েছিলাম, বিষ নয় ভেবেছিলাম উনি গুলি করার আগেই আমি তির ছুড়বঅবশ্য করতে হল তাই চিতাটা কুমারকে চিনতে পেরেছে এই কারণে আমরা তিন জন থাকা সত্ত্বেও কুমারকে চিতাটা আক্রমণ করেছে জঙ্গলে নিয়ম ভেঙেছেন উনি, খেসারত তো ওঁকেই দিতে হবে
কথায় কথায় চিতাটা বাঁধা-ছাদা হয়ে গেল একটা লম্বা বাঁশের মাঝখানে চার পা একজায়গায় করে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাইরে খাঁচা-গাড়ি দাঁড় করানো আছে আমরা রওনা দিলাম স্যার চিন্তিত হয়ে বললেন, “কিন্তু কুমারকাজ করলেন কেন? আমা মনে পড়ে গেল কুমার পরশু রাতে শুতে যাওয়ার আগে কী বলেছিলেনবললাম, “ওর বংশের গৌরবময় শিকার কাহিনি সুপ্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে
“কিন্তু আমরা তো ওকে শিকার করতে ডেকে পাঠানিআমরা তো চিতাটাকে ঘুম পাড়ানোর কথাই বলেছি
“পরে হয়তো ভুল স্বীকার করে নিতেন আইনের ফাঁক থেকে ছাড়া পেয়ে যেতেন, কিন্তু চিতা মারার ইতিহাস তো থেকে যেত
ঘটনা এখানেই শেষ নয় চিতাটাকে সুস্থ করে কয়েকদিন পর আর উপরে গভীর অরণ্যে ছেড়ে দেওয়া হয় দু’দিন প্রাণপণ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে শেষে কুমার বাহাদুর হার মানলেন মারা যাওয়ার আগে ওঁর সমস্ত শরীরে সেপটিক হয়ে যায়
কুমারের এই মৃত্যুতে আমরা তো বটেই সারা গ্রাম শোকাহত হয়ে পড়ে কুমারের শরীর শেষে এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে তার মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নিএখানে তাকে দাহ করা হয় চোখের জলে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিল আপামর গ্রামবাসী
রেঞ্জার সাহেব নির্দেশ দিয়েছিলেন আসল ঘটনা যেন কেউ জানতে না পারেগ্রামবাসীর মনে কুমারের সম্পর্কে যে শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়েছে সেটা যেন অন্তত অটুট থাকেকারণ, অরণ্য তো তা হিসেব মিলিয়ে নিয়েছে, আমরা আর না- বা নিলাম...
_____

1 comment:

  1. দারুণ রোমাঞ্চকর আখ্যান! খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete