গল্প:: ভালো পাহাড়ের ছবি - শ্যামলী আচার্য


ভালো পাহাড়ের ছবি
শ্যামলী আচার্য

ছবি আঁকার সময় কাঠপেনসিল বেশি প্রিয় দীপুর। নানা রকম পেনসিলমোটা শিস, ধারালো সরু শিস। কোনোটা গাঢ় দাগ, কোনোটা হালকা আবছা আভাসের পেনসিল। কিন্তু ইরেজার একদম ভালো জিনিস নয়। ইরেজার হাতে পেলেই ওর ফসফস করে সব মুছে ফেলতে ইচ্ছে করে। আর একবার মুছে ফেললেই তো ভ্যানিশ। আগে যে কী আঁকল, কী কী দাগ দিল, সেগুলো আর রইল না। ফিরে দেখার উপায় নেই। মিলিয়ে নেওয়ার বা পালটে নেওয়ারও সুযোগ নেই।
পেনসিলের ব্যাপারে দীপু খুব খুঁতখুঁতে। এখনও অবধি যে ক’টা ছবি ও ওর পছন্দের পেনসিল দিয়ে এঁকেছে, সে ক’টা ছবি অনেক দামে বিক্রি হয়েছে। আর দীপু ঠিক বুঝতে পারে, কোন পেনসিল ওর সব কথা শুনবে।
দীপুর মনে হয়, সব দাগ, সব ছাপ হয়তো সুন্দর নয়, সবাই হয়তো নিখুঁত বা পছন্দসই হয়ে ওঠে না, কিন্তু তার একটা নিজস্ব জায়গা আছে। থাকা উচিত। সাদা কাগজের ওপর, বোর্ডে, ইজেলে যত এলোমেলো আঁকাবুঁকি কাটাকুটি হয়, সব ক’টার একটা মানে আছে। সব্বাই প্রত্যেকে একা। আর সবাই আলাদা। কাজেই তাদের খামোখা মুছে ফেললে সেই দাগের মধ্যে থেকে আর নতুন কিছু বেরিয়ে আসবে না, পুরো ছবিটাই একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।
এই যেমন পরশু একটা পাহাড়ের ছবি আঁকছিল দীপু। কিন্তু একদম ভালো হচ্ছিল না। কিন্তু মুছেও দিতে ইচ্ছে করছিল না। একটার পর একটা কাগজ টেনে নামিয়ে ফেলে দিচ্ছিল পাশে। সেই সব কাগজ একের পর এক জমতে জমতে সারা ঘরে উড়ে বেড়াতে লাগল। ওর মনে পড়ল, খুব ছেলেবেলা আঁকার ক্লাসে ভরতি হবার আগে ওরা একরকম পাহাড় আঁকত। টানাটানা কয়েকটা তিনকোনা দাগ। ত্রিভুজের ফাঁক দিয়ে আধখানা সূর্য। সূর্যের পাশ দিয়ে খাড়া দাগ। ওগুলো সূর্যের রশ্মি। আলো বলা যায়। সূর্য মানেই পর পর ছোটো বড়ো সোজা সোজা দাগ। তারপর টকটকে লাল রঙের প্যাস্টেল ঘষে ঘষে তাকে সুয্যিমামা বানিয়ে তোলা। ওপরে ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো একের পর এক পাখি। সূর্যের ঠিক ওপর দিয়ে পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে উড়ে যায় সেইসব পাখির দল। কোথায় যায়, কে জানে! পাহাড়ের নিচে যেখানে সমতল, সেখানে কিরিকিরি করে আঁকা ঝোপ। তার পাশে একটা আঁকাবাঁকা নদী আর নদীর ধারে সরু সরু তালগাছ থাকবেই। তালগাছগুলো লম্বা একঠেঙে, মাথার ওপর একটা কাটাকুটি এক্স এঁকে দিলেই দিব্যি দেখায়। আঁকার পাতার একেবারে নিচে একটা কুঁড়েঘরতার চালে হলুদ রং, পিছন দিয়ে সবুজ রঙের কলাপাতা। বাড়ির সামনের চৌকো উঠোনে খয়েরি রঙের প্রলেপ আর পাশে দুই বিনুনিওলা একটা হাসিমুখ মেয়ে আঁকতে পারলেই ছবি শেষ
এখন দীপু অন্যরকম পাহাড় আঁকে। কিন্তু সেই ছেলেবেলায় আঁকা তিনকোনা সহজ পাহাড়টা ওকে ডাকে। ঘুমের মধ্যে ওই পাহাড়টাই ওর মনে পড়ে। আর ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা ওর বিরাট স্টুডিওতে লম্বা টানা কাচের জানলার সামনে রাখা ক্যানভাসে পেনসিল দিয়ে স্কেচ করে। স্কেচ করার সময় যতবার ভাবে অমন একটা তিনকোনা পাহাড় দিয়ে শুরু করবে, ওর পেনসিল ঘুরে ঘুরে যেতে থাকে। হালকা শেড দিয়ে তৈরি হয়ে যায় পাহাড়ের খাঁজ। কিছুতেই সেই ত্রিভুজাকৃতি পাহাড়টা আর ধরা দেয় না। সব কেমন বড্ড বেশি সাজানো গোছানো। ছবি ছবি।
আজ অবশ্য সবকিছু গণ্ডগোল আর এলোমেলো। একটা ভালো পাহাড় আঁকাই যাচ্ছে না। অথচ একজন বেশ ধনী মানুষ একটা পাহাড়ের ছবি এঁকে দিতে বলেছেন দীপুকেদীপু তো এখন খুব বড়ো আর্টিস্ট, খুব নামডাক তার। ওর ছবি সবাই একজিবিশনে ভিড় করে দেখতে আসে। অনেক টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যায়। কখনও কখনও অন্যের পছন্দমতো ছবি এঁকে দিতে হয় তাকে। কয়েকদিন ধরে সেইরকম একটা ছবি নিয়েই বড়ো অস্থির হচ্ছে সে।
ধুত্তেরি বলে দীপু আঁকার ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।
তেইশতলা ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় দাঁড়ালে এখনও ওর বেশ অবাক লাগে। নিচে তাকালে সব কিছু কত পুঁচকে। সবাই লিলিপুট আর ও সেই গালিভার যেন। তেমনই আবার ওপরদিকে তাকালে মনে হয় হাত বাড়ালেই বুঝি আকাশ ছোঁয়া যাবে। সূর্য মাঝেমধ্যে মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। দু’রকম মেঘ। জলভরা মেঘ আর সাদা কাশফুলের মতো ফুরফুরে মেঘ। একটাই ক্যানভাস। আকাশের বিশাল নীল ক্যানভাস। মেঘের আনাগোনায় কোনো নিয়মকানুন নেই। ওরা ওদের খুশিমতো কেবল এদিক-ওদিকে ভেসে বেড়ায়। দীপু খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগল। এইরকম একখানা আকাশ আর তার মধ্যে দুই প্রান্তে দু’রকম মেঘ আঁকা অসম্ভব। পৃথিবীর কোনো রঙ তুলি ইজেল ক্যানভাস পেনসিল দিয়ে এই ছবি আঁকা যায় না।
দীপু কেন, পৃথিবীর কোনো আর্টিস্ট প্রকৃতির ছবি আঁকতে পারেন না। তারা শুধু চেষ্টা করেন। লোকে যখন ছবি দেখে বলে, আরেব্বাস, এ তো আঁকা ছবি বলে মনেই হচ্ছে না, একদম ঠিক মেঘ, একেবারে সেই নদী, কী অপূর্ব গাছপালা, আকাশের রং একদম আকাশেরই মতো, তখন বোঝা যায়, ছবিটা আসলে প্রকৃতির ক্যানভাসকে ঠিকঠাক আয়নার মতো ধরে ফেলতে পেরেছে। দীপু কখনও কখনও এমন তাক লাগানো ছবি আঁকে। আবার কখনও নিজের খুশিমতো রঙ ঢেলে দেয় ইজেলে। সে আরেকরকম ভালো।
আজ কিন্তু কিছুতেই ওর আঁকার কাগজে ভালো পাহাড় আসছে না।
দীপু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। কয়েকদিনের মধ্যে ছবিটা দিয়ে দিতে হবে। মানসুখানি সাহেব খুব বড়ো ব্যবসায়ী, এবং ভালো ছবির সমঝদার। তাঁর কাছ থেকে বেশ কিছু টাকা আগাম চলে এসেছে দীপুর কাছে। ছবি জমা দিলে আরও বাকি টাকা। এবং সে এক বেশ বিরাট অংকের টাকাদীপু ঠিক করে রেখেছে পাহাড়ের ছবি আঁকার টাকা নিয়ে সে একটা চমৎকার পাহাড়ে বেড়াতে যাবে। তার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইচ্ছে, চাঁদের পাহাড়।
কিন্তু ছবি এলে তো! পেনসিল কথা শুনছে না, রং-তুলি বেয়াড়াপনা করছে। কাগজগুলো ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে। ইজেল খাঁ খাঁ করছে।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীপু দেখতে লাগল নিচের রাস্তায় হুশ হুশ করে গাড়ি যাচ্ছে। লাল, ছাইরঙা, কালো, সাদা। রাস্তার ধারে নয়ানজুলি। এত উঁচু থেকেও স্পষ্ট দেখা যায় কচুরিপানা ভাসছে, তার মধ্যে বেগুনি ফুল। ছোটো-বড়ো বাড়ির টালির চাল, অ্যাসবেস্টসের ছাউনি কোথাও। আবার একটু দূরে দূরে সব আকাশছোঁয়া হাইরাইজ। দীপুর হঠাৎ মনে হয়, এর পিছনেই কোথাও একটা পাহাড় আছেআগে নিশ্চয়ই দেখা যেত, এখন শহরের ধোঁয়া-ধুলো-জটলায় আড়ালে। দীপু বেতের চেয়ার টেনে ব্যালকনিতে বসে। ওই যে একটা ছোট্ট ডোবা, তার পাশে একটা বাড়ি। ইট বেরিয়ে আছে। ওপরে টিনের ছাউনি। পেছনে একইরকম বাড়ি আরও দু-তিনটে। সামনে বাঁশের খুঁটিতে টাঙানো দড়িতে নানা রঙের, নানা মাপের জামাকাপড়। একটা ফুলগাছ। লতানো ডাঁটা বেয়ে উঠেছে। বাঁশের ঠেকনা দেওয়া। একটা পুঁচকে বাচ্চা হামা টানছে ঘরের সামনে ময়লা রাস্তায়। পাশে টিউবওয়েল। ছোটো-বড়ো বালতি বোতল জ্যারিকেন নিয়ে অনেক ভিড়দীপু এত উঁচু থেকেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে সকালের ব্যস্ত সময়ে ওদের খুব হইহট্টগোল চলছে। এর মধ্যে একটাও পাহাড় নেই। অথচ দীপু নিশ্চিত, ওই বাড়িগুলোর পিছনেই একটা বিরাট পাহাড় রয়েছে। থাকার কথা। সে ওখানেই ছিল। যখন চারদিকে টেথিস সাগর, তখন সে একটু একটু করে মাথা তুলছিল সমুদ্রের মধ্যে থেকে। পৃথিবী তখন সবে জন্মাচ্ছে। সেই মুহূর্তগুলো যেন ওর চোখের আশেপাশেই ভাসছে, কিন্তু ধরা দিচ্ছে না।
দীপু বেশ দেখতে পায়, ওই পাহাড়ের গা দিয়ে উদাসীন হয়ে গড়িয়ে পড়ছে একটা তিরতিরে ঝরনা। ঠান্ডা আর মিষ্টি জল। পাশের পাথরে ঘন সবুজ শ্যাওলা। গুঁড়ো গুঁড়ো জল উড়ে যায় পাশের হাওয়ায়। ফার্ন আর অর্কিড দুলতে থাকে একমনে। ওই পাহাড়টাকেই আড়াল করে রেখেছে একটা পঞ্চাশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। কোনো মানে হয়? ওখানেই তো সেই পাহাড়টা। রুক্ষ পাথুরে জমিতে ঘন সবুজ ঝোপ, হেঁটে হেঁটে উঠতে গেলে চোখে পড়ে গুহা, খানাখন্দঅসাবধানে হাঁটলে পা মচকে যাবে।
দীপু বড়ো বাড়িটাকে বাঁ হাতের এক ঝটকা দিয়ে সরায়। পিছন থেকে জেগে ওঠে আবছা হয়ে যাওয়া পাহাড়। শহরের চেঁচামেচি হট্টগোলে কেউ এতদিন লক্ষ্যই করেনি! আশ্চর্য! আসলে শহরে সবাই এখন এত ব্যস্ত! কোনোদিকে কারও তাকানোর ফুরসত অবধি নেই। একটা আস্ত পাহাড়কে বেমালুম ইরেজার দিয়ে মুছে দিচ্ছে একটু একটু করে। চারদিকে ইট কাঠ কংক্রিটের জঙ্গল। ধোঁয়া ধুলো আর চেঁচামেচি। ইতিমধ্যে আঁকার ঘরের মধ্যে উড়ে বেড়ানো পাতাগুলো এতক্ষণে কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছে ব্যালকনিতে। দীপু কাগজগুলো হাতে নিয়ে দেখে, একের পর এক কাগজে পাহাড়ের আভাস শুধু। আসল পাহাড় নেই। পাহাড় আসলে আবছা। আড়ালে। বেশ খানিকটা পিছনে চাপা পড়ে রয়েছে। সামনে জড়ো হয়ে আছে শহরের হাইরাইজ, ঘেঁষাঘেঁষি বাড়ি, বাঁধানো রাস্তা, লাল-নীল গাড়ি, শপিং মল। পাহাড় তো শান্ত, চুপচাপ, গম্ভীর। সে এইসব হইচই থেকে দূরে চলে গেছে।
ওকে ডেকে আনতে হবে।
দীপু পেনসিল তুলে নেয়। ছেলেবেলার মতো কুঁড়েঘরের পিছনে একটা বড়ো তেকোনা পাহাড় আর পাশে একটা বড়ো নদী আঁকতে থাকে।
ঘরের সামনে সোজা রাস্তা, পাশে গোল গোল ঝোপ, পিছনে সিধে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ, আকাশে ভি-এর মতো পাখি আর একদম গোল সূর্যওটাই সত্যিকারের ছবি।
----------
ছবি - শুভশ্রী দাস

1 comment: