আচানকমারের প্রবেশ দ্বার |
আচানকমারে আচমকা
অরিন্দম দেবনাথ
ছত্তিশগড়ের ‘আচনকমার টাইগার রিসার্ভ’ পর্যটকদের কাছে
খুব একটা পরিচিত নয়। কিন্তু এখানে বাঘের সংখ্যা ৪২। এই জঙ্গলের গল্প শুনিয়েছেন অরিন্দম দেবনাথ।
“রাসেল ভাইপার...।”
“কোথায় কোথায়...।”
‘আচানকমার টাইগার রিসার্ভ’-এর শাল, মহুয়া
আর বাঁশ গাছের ঝরা পাতায় ঢাকা পাহাড়ি মেঠো রাস্তায় আচমকা হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়ল গাড়িটা। ড্রাইভ করতে থাকা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার বিলাসপুরের রিশলু লাহিড়ী
সামনে রাস্তার
দিকে আঙ্গুল দেখাল।
গাড়ির পেছনের আসনে বসে ভালো
করে কিছু বোঝার আগেই হলুদের ওপর কালো চাকা চাকা দাগওয়ালা সাপটার অর্ধেক শরীর রাস্তা
পার হয়ে পাতার স্তুপের আড়ালে চলে গেছে। শুধু ডাইনে বাঁয়ে নড়তে থাকা ছিপছিপে লেজের
খানিকটা অংশ নজরে এল। মাটিতে পড়ে থাকা শাল আর বাঁশ পাতার নাড়াচাড়া দেখে সাপটার
বাঁশ ঝাড়ে ঢুকে যাওয়াটা আন্দাজ করতে পারলাম।
রিশলু বলল, “ফুট চারেক লম্বা হবে ভাইপারটা, ইশশশশ ছবিটা...।”
সাপটা এত দ্রুত রাস্তা পার
করল যে ক্যামেরা তোলার সময় পাইনি কেউ। খানিক আগে এক বাঁশের ঝোপে কয়েকটা শাল গাছের
ফাঁকে এক মস্ত বাইসন দেখেছি। ক্ষণিক দেখা দিয়েই গাছের আড়ালে চলে গেছিল বাইসনটা। গাড়ি
চালাতে চালাতে বাইসনদের নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে এই জঙ্গলে ওঁর অভিজ্ঞতার কথা
শোনাচ্ছিল রিশলু।
বাইসন |
“তখনও আচানকমার ‘টাইগার রিসার্ভ’ বলে ঘোষিত হয়নি। জঙ্গলে ঘোরাফেরায় খুব একটা বাধানিষেধ ছিল না। গাছপালা আর
জন্তু জানোয়ারের টানে আমি জঙ্গলে বন দফতরের একটা ছোটো ট্যুরিস্ট রিসর্ট ইজারা নিয়ে
চালাই। পরিচিতির অভাবে খুব বেশি ট্যুরিস্ট এই জঙ্গলে আসত না। সামান্য যে কয়েকজন
আসত তাদেরকে কখনও সখনও আমিও জঙ্গলে গাড়ি চালিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেতাম। একবার এক
ফটোগ্রাফার বন্ধুর সঙ্গে জঙ্গলের এক ওয়াচ টাওয়ারের কাছে শেষ বিকেলে হরিণের পালের
ছবি তোলার আশায় গাড়িতে বসে জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন মাঝ রাত্তির। অন্ধকারে চোখটা খানিক ধাতস্ত হতে দেখি
গাড়িটাকে ইংরেজি ‘সি’ অক্ষরের মতো ঘিরে অসংখ্য কাচের চকচকে গুলি নড়ে
বেড়াচ্ছে। ভাবলাম হরিণের দল আমাদের গাড়ি ঘিরে আছে। আমার গাড়িতে একটা খুব শক্তিশালী সার্চলাইট রাখা থাকে সবসময়। আমার
ফটোগ্রাফার বন্ধুটা জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে যেই না সার্চলাইটটা জ্বালিয়েছে, দেখি
হরিণ কোথায়! আমাদের গাড়ি ঘিরে অগণিত সাদা পায়ের বাইসন। অধিকাংশ বাইসন মাটিতে বসে
থাকলেও কয়েকটা দাঁড়িয়ে। সার্চ লাইটের আলোই বিপদ ডেকে আনল। আলোটা জ্বলতেই বসে থাকা শান্ত
বাইসনের দল ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে একটা দুটো করে উঠে দাঁড়াতে শুরু করল। অজস্র
বাইসনের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর দর্শন বিশাল আয়তনের বাইসন আচমকা মাটিতে পা ঠুকে ধুলো
ওড়াতে শুরু করল। দেখাদেখি আরও কয়েকটা। বুঝলাম বিপদ আসতে আর বেশি দেরি নেই। ঘাড়
ঘুরিয়ে দেখি গাড়ির পেছনটা খালি। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে এক্সিলারেটর দাবিয়ে
ব্যাক গিয়ারে গাড়িটাকে চালিয়ে দিলাম। গাড়িটা দ্রুত পেছনে এগোতে লাগল। গাড়ির আওয়াজে
বাইসনের দল একসঙ্গে পা ঠুকে ঠুকে ধুলো ওড়াতে শুরু করেছে। কোনোরকমে গাড়ি ঘুরিয়ে জঙ্গলের
মাটির এবড়োখেবড়ো রাস্তায় যত জোরে সম্ভব চালিয়ে দিলাম ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি। মাটি
কাঁপিয়ে আমাদের তাড়া করে আসছে বাইসনের দল। প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা পার হয়ে এসে
যখন থামলাম তখন গাড়ি ও আমাদের ঘামে ভেজা শরীরে লাল ধুলোর পুরু আস্তরণ জমে গেছে। বাইসনের
দল আর একটু হলেই আমাদের গাড়িসুদ্ধু উলটে খুর আর শিঙের খোঁচায় কিমা বানিয়ে দিত!”
এখন এই জঙ্গলে গাড়ি থেকে
নামা নিষিদ্ধ। গাড়িতে বসে থাকা ফরেস্ট গাইড কোনো ভাবেই গাড়ি থেকে নামতে অনুমতি দিল
না। তাই গাড়ি থেকে নেমে বাঁশের ঝোপে ঢুকে ভাইপারের ছবি তোলার স্বপ্ন মন থেকে মুছে
দিতে হল। রাসেল ভাইপার, যাকে বাংলায় চন্দ্রবোড়া বলে, তার একটা ছোবল মানে সাক্ষাৎ
মৃত্যু।
ভোর সাড়ে চারটের সময় ছত্তিশগড়ের
বিলাসপুর শহর থেকে রওয়ানা দিয়ে ষাট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আচানকমার টাইগার রিসার্ভের
গেটে সকাল ছ’টায় পৌঁছে দেখি, জঙ্গলে ঘোরার জন্য নির্দিষ্ট একটিও জিপসি গাড়ি পাওয়া
যাবে না। অগত্যা রিশলু লাহিড়ীর সুজুকি বেলিনো গাড়িই ভরসা। যদিও এই জঙ্গলে ঘোরার
উপযুক্ত গাড়ি এটা নয়।
আচানকমারের জঙ্গল পথ |
মে মাস। সকালেই প্রচণ্ড
গরম। বৃষ্টির দেখা নেই এখনও পর্যন্ত। ৯১৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জঙ্গলের গেটে টাকা
জমা দিয়ে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি নেবার পর আমাদের আরও দুই সঙ্গী দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
ও শান্তনু বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে এক ফরেস্ট গাইড সহ জঙ্গলে ঢুকল রিশলু। নিয়ম অনুযায়ী
বন দফতরের কোনো ফরেস্ট গাইড ছাড়া জঙ্গলে প্রবেশ করা যাবে না। নভেম্বর থেকে জুন মাস
পর্যন্ত পর্যটকদের জন্যে খোলা থাকে এই জঙ্গল। বাঘ, লেপার্ড, ভাল্লুক, বুনো কুকুর, বাইসন,
হাইনা, কয়েক প্রজাতির হরিণ, ফ্ল্যাইং স্কুইরেল এসব ছাড়াও আছে ১৫০টিরও বেশি
প্রজাতির পাখি। আছে অনেক জাতের সাপ। নেই খালি হাতি। মানিয়ারি নদী বয়ে গেছে সাতপুরা
পর্বতমালায় অবস্থিত এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এই নদীই এই জঙ্গলের জীবনস্রোত। ছত্তিশগড়ের
সুন্দাবেদা মালভূমির একটি লেক থেকে উৎপন্ন এই নদীতে সারা বছরই খানিক জল থাকে। গিরধাস
নালা নামে আর একটি উপনদী এসে মিশেছে এই মানিয়ারি নদীতে। বর্ষাকালে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ
করে এই নদী। মানিয়ারি নদী জঙ্ক নামেও পরিচিত। এছাড়া এই জঙ্গলে বেশ কিছু পুকুর আছে
জন্তু জানোয়ারদের জল খাবার জন্য।
ইন্ডিয়ান রোলের |
ইন্ডিয়ান পিটটা |
জঙ্গলে ঢোকার খানিক পরেই
হরিণের পাল এসে এক ঝলক দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল গাছপাতার ঝোপে। একটা কালো লম্বা চেরা
লেজওয়ালা ‘ফরক টেইল্ড’ পাখি ক্যামেরা ফোকাস করার কোনো সুযোগ না দিয়ে, গাছের
এক ডাল থেকে আর এক ডালে পিরিং পিরিং করে উড়ে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট নীল রঙের ‘ইন্ডিয়ান পিটটা’ পাখি তীরের মতো উড়ে এসে আমাদের গাড়ির সামনের রাস্তা
থেকে একটা কিছু ঠোঁটে কামড়ে নিয়ে উড়ে গিয়ে বসল একটা গাছের ডালে। খানিক দূর দিয়ে তিনটে
ময়ূর লাইন দিয়ে কেকা কেকা করে ডাকতে ডাকতে হেলে দুলে রাস্তা পার হয়ে গেল।
একাকি হরিণ |
সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৪২টা
বাঘ আছে এই টাইগার রিসার্ভে। একটা সময় চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম ছিল এই জঙ্গলে।
বিভিন্ন ভাবে চোরাশিকার হয়েছে। কখনও অস্ত্র দিয়ে, কখনও বা বিষ প্রয়োগ করে। ২০০৯
সালে বিলাসপুর নেচার ক্লাবের কিছু সদস্যের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আচানকমারে
বাঘ গণনা অভিযানে যোগদান করেছিল রিশলু। সেবার জঙ্গলে ঢুকে স্বেচ্ছাসেবীরা কয়েকটি
পুকুরের ধারে বেশ কিছু মৃত জীবজন্তু দেখতে পায়। বিশেষ করে চাপারওয়া রেঞ্জে, কুম্ভিপানি
নামক ‘ওয়াটার হোলের’ ধারে মরা লেপার্ড, খরগোশ,
হরিণ পরে থাকতে দেখেন স্বেচ্ছাসেবীরা। পুকুরের জলে অসংখ্য মরা ব্যাঙ ভেসে ছিল।
কিন্তু দুর্বোধ্য কারণে জলে বিষক্রিয়া পরীক্ষা করার জন্য নমুনা সংগ্রহ করতে দেননি
বনকর্মীরা।
অ্যান্টি পোচিং পেট্রোলিং ক্যাম্প |
যেহেতু আমাদের গাড়িটা ফোর হুইল
ড্রাইভ গাড়ি নয়, তাই রিশলুকে খুব সাবধানে পাথরের বড়ো আলগা টুকরো এড়িয়ে ধীরে ধীরে চালাতে
হচ্ছিল। ঘণ্টা তিনেক জঙ্গলে ঘোরার অনুমতি আছে আমাদের। এই জঙ্গলের মাত্র এক
চতুর্থাংশ খোলা পর্যটকদের জন্যে। গাড়িতে চলতে চলতে কথা হচ্ছিল জঙ্গলের সব অংশে
পর্যটক ঢুকতে দেওয়া উচিত কি উচিত না এই বিষয়ে। জঙ্গলে এক দিকে গাড়ি ও পর্যটকের দল
ঢুকলে যেমন বন্য প্রাণীদের শান্তি নষ্ট হতে পারে, আবার ঠিক উলটোটাও হতে পারে।
জঙ্গলে পর্যটক ঢুকলে চোরাশিকারিদের গতিবিধি থাকলে নজরে এসে যেতে পারে। বেআইনি গাছ
কাটা হলে জানাজানি হতে পারে। জঙ্গল বাঁচাতে পর্যটকদের ভূমিকা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায়
না।
ঢালু মাটি পাথরের রাস্তা
বেয়ে মাটি কামড়ে আস্তে আস্তে গাড়ি পৌঁছল জলদা নামে এক উপত্যকায়। পাহাড়ে ঘেরা বিশাল
সমতল ঘাস জমি একটা। গাইড ছেলেটি আকাশের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, “দেখিয়ে সাব।” দেখি আমাদের থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে একটা ধূসর
রঙের বাজ পাখি মাথা নিচু করে ঘাস জমি থেকে ফুট দশেক ওপরে আকাশে এক জায়গায় স্থির
হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পরে দু’পাশে ডানা ছড়িয়ে মাটিতে ঝাঁপ দিয়ে পায়ের
নখে একটা শিকার আঁকড়ে শাঁ শাঁ করে উড়ে গিয়ে বসল বহু দূরের এক গাছের মাথায়।
শিকার ধরতে ঝাঁপ দিয়েছে বাজ |
শিকারের প্রতীক্ষায় ঈগল |
একটা ছোটো নালা চলে গেছে
ঘাস জমিটার মাঝ বরাবর। আরও বেশ কয়েকটা ঈগল দেখতে পেলাম গাছের ডালে। আমাদের গাড়ি
থেকে ফুট পঞ্চাশ দূরত্বে একটি ঈগল গাছ থেকে উড়ে এসে ঘাস জমি থেকে একটা সাপ ধরে ঠোঁটের
এক আঘাতে ছিঁড়ে নখ দিয়ে ফালাফালা করে একটু একটু করে খেল। গাইড ছেলেটি বলল বিকেল
বেলা প্রায় দিনই দলে দলে বাইসন আর হরিণ আসে এখানে ঘাস আর জল খেতে। আসে জঙ্গলের আরও
অনেক জন্তু। চোরাশিকারিদের জন্য লোভনীয় চারণভূমি। ঘাস জমির শেষ প্রান্তে জঙ্গলের কিনারায় মেঠো রাস্তার ধারে বন দফতরের
কতগুলো ঘরবাড়ি আছে। তার গায়ে বড়ো বড়ো করে হিন্দিতে লেখা ‘অ্যান্টি পোচিং
পেট্রোলিং ক্যাম্প।’
পর্যটকদের অপেক্ষায় গাইডের দল |
এই জঙ্গলে বাঘ থাকলেও সহজে
দেখা মেলে না। তবে প্রায়শই লেপার্ডের দেখা পাওয়া যায়। অনেক জঙ্গলের মতো এই জঙ্গলেরও
অনেক নরখাদক বাঘের গল্প আছে। মূল জঙ্গলের বাইরে রাস্তার ধারে একটা পাথরের ফলকের
কাছে এনে গাড়ি থামিয়ে দিল রিশলু। ফলকে লেখা আছে এরকমই একটি নরখাদক বাঘের গল্প।
জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কোথাও ঝরা
পাতা বা শুকনো গাছে আগুন লাগল কিনা দেখার জন্য একদল বনকর্মী থাকে। এদের বলে ‘ফায়ার ওয়াচার’। শুকনো পাতা জড়ো করে এরা মাঝে মাঝে আগুন লাগিয়ে দেয়
জঙ্গলকে বড়ো দাবানলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। এরকমই একজন ছিল মাইকু গোন্ড। ১৯৪৯
সালের ১০ এপ্রিল জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত গ্রাম বিন্দাওআল’এর ফায়ার ওয়াচার
মাইকু গোন্ড জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর সময় এক বাঘিনীর খাদ্য হয়। তার তিনদিন পর ১৩
এপ্রিল, কোটা রেঞ্জের রেঞ্জ অফিসার এম.ডবলু.কে.খক্কার সেই নরখাদক বাঘিনীকে মাইকু গোন্ড-এর আধ খাওয়া
শরীরের ওপর বসে থাকা অবস্থায় গুলি করে মারে।
জঙ্গলে তিন ঘণ্টা থাকার
মেয়াদ শেষ। জঙ্গল ছেড়ে এ’যাত্রার মতো বেরিয়ে আসতে হল।
মাইকু গোন্ডকে এখানে বাঘে খেয়েছিল |
_____
ফোটোঃ অরিন্দম দেবনাথ
অপূর্ব লেখা, তেমনই ছবি
ReplyDelete