গল্পের ম্যাজিক:: স্বর্ণ কলম - দীপিকা মজুমদার


স্বর্ণ কলম
দীপিকা মজুমদার

দিনের বেলায় তবুও ঠিক আছে, কিন্তু রাত হলেই ট্রেনে চড়ার মজাটা নেতিয়ে যায় কুট্টুসেরপর্দার আড়াল সরিয়ে বাইরের চলন্ত দৃশ্য দেখা, ছোটো ছোটো স্টেশন এলে ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক ট্রেন জার্নির একটা আলাদা আমেজ এনে দেয়। প্লেনে যাতায়াত করলে সময় বাঁচে ঠিকই, কিন্তু ট্রেন জার্নির মতো মজাটা আসলে হয় না। কিন্তু ঐ দিনেই, রাতটা ট্রেনে বড্ড বোরিং।
পুজোর ছুটিতে এবার কোথাও যাওয়ার প্ল্যান ছিল না কুট্টুসদের বাবার অফিসে ছুটি নেই, মা-ও স্কুল থেকে এক বাণ্ডিল খাতা নিয়ে এসেছে। তবে ডিসেম্বরে মণিমাসির বিয়ের ব্যাপারটা না থাকলে একটা না একটা ছোটো ট্রিপ হতই এবছর ব্যতিক্রম। কিন্তু মহালয়ার আগে হঠাৎ করেই ছোটকাই এসে বলল, “কুট্টুস, রাজস্থান যাবি?” কুট্টুস কি আর না করতে পারে? সোনার কেল্লা, হাওয়ামহল, মরুভূমি দেখার ওর কতদিনের শখ।
হঠাৎ করেই প্ল্যান, প্লেনের বদলে ট্রেনের টিকিট। সমস্যা হল, টিকিটগুলো এক কামরায় হলেও এক জায়গায় পাওয়া গেল না এই যা। কিন্তু তাতে কি আর ঘোরার মজাটা কমে যায়! স্কুলে ছুটি পড়ার আগে দিনগুলো বেশ মজায় কাটছিল কুট্টুসের। কিন্তু শেষদিনই যত গোলমাল হয়ে গেলকেন যে ও সোহমকে চ্যালেঞ্জ করে বলতে গিয়েছিল, “আমার একটা সোনার কলম আছে।” ব্যস। বলে তো ফেলেছ। এবার সেটা না দেখাতে পারলে কুট্টুসের ইজ্জত থাকবে না। দেখিয়েও ছিল কুট্টুস। সোনার কলম ঠিক নয়, ঝরনা কলমের সোনার নিবদাদু দিয়েছিল বাবাকে, পরে ওটা কুট্টুসেরই হবে। কিন্তু এখন ওটা কুট্টুসের নাগালে থাকে না, মায়ের গয়নার বাক্সে রাখাস্কুল যাওয়ার তাড়ায় চাবির গোছাটা আলমারিতে ঝুলিয়েই মা স্নান করতে চলে গিয়েছিল। সেই সুযোগে লকার খুলে সোনার নিবটা বের করে নেয় কুট্টুস। একদিনের তো ব্যাপার! সোহমকে দেখিয়েই ফিরে এসে আবার সুযোগ বুঝে লকারে চালান করে দেবে।
গোলমালটা হল গেমস পিরিয়ডের পর। ক্লাস-রুমে ব্যাগ রেখে সবাই মাঠে গিয়েছিল। ক্লাস শেষে কুট্টুস ফিরে এসে দেখে সব ঠিক আছে, শুধু ওর কলমের সোনার নিবটাই নেই। সোহম ছাড়াও অনেকেই দেখেছিল কুট্টুসের সোনার কলম। কে যে এমন করল কুট্টুস ভেবে পায় না। মাকে বলতে পারেনি কুট্টুস, বাবাকেও না। দুটো দিন আর বাকি ছিল ট্রেনে চড়ার। পুরোনো নিবটাই কলমের সঙ্গে জুড়ে পকেটে রেখে দেয় কুট্টুস। বেড়াতে গিয়ে তো বাবা-মায়ের মনটা খুশি খুশি থাকবে, তখনই না হয় সত্যি কথাটা বলার সুযোগ নেবে সেবাইরে গিয়ে বেশি বকাবকিও করতে পারবে না কেউ, আবার ফিরে আসার পর রাগ এমনিতেই পড়ে যাবে। তাই কলমটাও সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছে।
ট্রেনে চড়ার পর থেকেই বেশ ভদ্র আচরণ করছে কুট্টুস। এটা সেটা খাওয়ার বায়না করেনি, জানালার ধারে বসতেও চায়নি। প্রিন্সদাদার পাশে ভালো ছেলের মতো বসে আছে কুট্টুস। তবে মনে মনে ফন্দি আঁটছে, কথাটা বাবা-মাকে কখন জানানো যায়। মা, বাবা, ছোটকাই আর কাকিমা এই কামরাতেই দুটো ক্যুপ আগে সিট পেয়েছে। কুট্টুস আর প্রিন্সদাদা পরের ক্যুপে লোয়ার আর মিডল বার্থে। আগের দিন রাতে যখন হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল, কুট্টুসের তখন খেয়াল ছিল না এখন তো পৌঁছাতেও বেশি সময় বাকি নেই। এদিকে রাত নামতেই প্রিন্সদাদাও একটা পুজোবার্ষিকী নিয়ে বসে পড়েছে, দাদাটা একটা পাক্কা বইপোকা। মা, বাবা, ছোটকাই, কাকিরা গল্পে মশগুল। কী যে বোরিং লাগছে কুট্টুসের! তার উপর আবার ঐ সত্যি কথাটা বলার ঝামেলা। সিটের ওপর পা তুলে বসে ছিল কুট্টুস।
ওদের উলটোদিকের বার্থে একজন বয়স্ক লোক বসে ছিলেনগতকাল ভোরের দিকে যখন সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, তখনই ট্রেনে চড়েন লোকটা। কোন স্টেশন ছিল জানা নেই, তবে কুট্টুস দেখেছিল ট্রেনে চড়েই চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধসকালে সেই একভাবে জানালার ধারে বসে আছেনমাঝে মাঝে কাঁধের ঝোলাটা হাতড়ে কীসব দেখছেন, আবার রেখে দিচ্ছেনসকাল থেকে বৃদ্ধকে একটাও কথা বলতে দেখেনি কুট্টুস। বেশ লম্বাচওড়া স্বাস্থ্যবান বৃদ্ধ, বয়স ষাট বা তার বেশিমাথার একটা চুলও আর কালো নেই। চামড়ার রঙ রোদে পুড়ে তামাটে, নাহলে বেশ বোঝা যায় বৃদ্ধর গায়ের রঙ ফর্সা কুট্টুস যখন নিব হারানোর ঘটনাটা ওর প্রিয় বন্ধু তীর্থকে ফোনে জানাচ্ছিল, তখন মাঝে মাঝেই বৃদ্ধর সঙ্গে কুট্টুসের চোখাচোখি হচ্ছিল, মনে হল ওর কথাটা উনি শুনেছেনতখনই দেখেছে কুট্টুস, বৃদ্ধর চোখের মণি নীলচে ধূসর, যা সাধারণত ভারতীয়দের মধ্যে বিরল।
যখন থেকে প্রিন্সদাদা পত্রিকাটা খুলে বসেছে তখন থেকে বৃদ্ধর নজর পত্রিকার উপরে ঘোরাফেরা করছে। কুট্টুস একবার পত্রিকার প্রচ্ছদটা দেখল, মা দুর্গার ছবির উপরে লেখক-লেখিকাদের নামআর বড়ো বড়ো হলুদ অক্ষরে লেখা আছে ‘স্যার আইজাক নিউটনের ভ্রান্ত বিজ্ঞান সাধনা।’ লোকটার নজর ঐ লেখাটার উপরেই ঘুরছে।
কুট্টুসের খেয়াল ছিল না, প্রিন্সদাদা কখন যেন পত্রিকাটা সিটের ওপর নামিয়ে উঠে গেছে, বৃদ্ধ সেই সুযোগে পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়েছেনকেমন লোক রে বাবা, কুট্টুসকে একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলেন না!
কুট্টুসকে ফ্যালফ্যাল করে ওঁর দিকে চেয়ে থাকতে দেখে ভুলটা বুঝতে পারেন বৃদ্ধ। পত্রিকাটা বন্ধ করে সিটের উপর রাখতে গিয়ে কুট্টুসের দিকে চেয়ে হেসে বলেন, “আজকাল কত ভ্রান্ত ধারণার উপর ভিত্তি করে পত্রিকায় লেখালেখি হয়। লোকে এসব পড়ে আর সত্যি ভাবে।” তারপর খানিক থেমে বলেন, “না বলে তুলে নিয়েছিলাম ওটা। সরি। আসলে স্যার আইজ্যাক নিউটনের নামটা দেখে পড়ার ইচ্ছা হচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকে
“কী ভ্রান্ত ধারণা?” কুট্টুস বিস্ময়ে প্রশ্ন করে বৃদ্ধকে।
“এই যে অধিরসায়ন, মানে অ্যালকেমি। এটা নাকি ভ্রান্ত বিষয়। একজন বিজ্ঞানী জীবনের চল্লিশটা বছর যে বিষয় নিয়ে সাধনা করে গেলেন আজ আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতে সেটা ভ্রান্ত!”
কুট্টুস কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। স্যার আইজ্যাক নিউটনের নাম সে জানে, আপেল গাছের তলায় বসে আপেল মাটিতে পড়ার ঘটনা দেখেই যিনি মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু এই অধিরসায়নটা কী বস্তু? ভাগ্যিস প্রিন্সদাদা টয়লেট থেকে ফিরে এসে হালটা ধরল, না হলে কুট্টুস তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না। বৃদ্ধের কথা শুনে প্রিন্স বলল, “ভ্রান্তই তো। স্পর্শের দ্বারা একটা ধাতুকে সোনায় পরিবর্তন করা সম্ভব? ওগুলো স্রেফ বুজরুকি ছাড়া কিছুই নয়
বৃদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, “তোমার সত্যি মনে হয় যিনি মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মতো অসাধারণ কিছু সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি জীবনের চল্লিশটা বছর একটা বুজরুকির পেছনে ছুটে জীবন শেষ করে দেবেন? আর্টিকেলটা আমি পড়লাম। ওখানে শুধু স্যার আইজ্যাক নিউটনের অধিরসায়ন সাধনা সম্পর্কে লেখা আছে। শুধু নিউটনের জীবন দিয়ে অধিরসায়নকে বোঝা সম্ভব নয়।”
“আপনি জানেন?” সিটের ওপর পা তুলে বসে প্রিন্স। ক্লাসে বরাবর প্রথম হওয়া ছাত্র সে মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক দুটো বড়ো পরীক্ষাতেই নব্বই শতাংশ নম্বর পেয়েছে সে। পাঠ্য বইয়ের বাইরেও যথেষ্ট জ্ঞান রাখে কুট্টুসের প্রিন্সদাদা। যেমন তেমন ব্যাপার নয়, একেবারে হবু কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারবাবুর পাল্লায় পড়েছেন তিনি। কুট্টুস ভাবল, প্রিন্সদাদা এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়।
“কিছু কিছু জানি,” পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন বৃদ্ধ। বললেন, “অ্যালকেমি শব্দটার উৎপত্তি আল-কিমিয়া নামক আরবি শব্দ থেকে। আর এই বিদ্যার উৎপত্তি প্রায় ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরে। মিশর থেকেই এই বিদ্যা ক্রমশ ইতালি, ফ্রান্স, গ্রীস ইত্যাদি দেশে ছড়িয়ে পড়েমারিয়া নামের এক ইহুদি নারীই প্রথম অ্যালকেমিস্ট ছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি সোনা বানাতে পারতেন। অ্যালকেমির ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঘাঁটলে ডেমোক্রিটাস, জাবির ইবনে হাইয়ান, অ্যালবারটাস ম্যাগনাস, সেন্ট থমাস অ্যাকিনাস প্রভৃতি অ্যালকেমিস্টদের নাম উঠে আসে। তবে অ্যালকেমিস্ট হিসেবে একজনের নাম না নিলে এই প্রসঙ্গ-চর্চা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর নাম বলতে পারবে?”
প্রিন্স আর কুট্টুস মুখ চাওয়াচাওয়ি করে দু’জনে। ওদেরকে দেখে বৃদ্ধ যেন মজা পেলেন। বললেন, “নিকোলাস ফ্লামেল। কিছু মনে পড়েছে ইয়ং বয়?” বৃদ্ধর দৃষ্টি সোজা কুট্টুসের দিকে।
নিকোলাস ফ্লামেল! নামটা খুব চেনা লাগছে কুট্টুসের। কিন্তু মনে পড়ছে না।
প্রিন্স বলল, “হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য সসার্স স্টোন-এর নিকোলাস ফ্লামেল? যিনি ফিলোজফার্স স্টোন বানিয়েছিলেন?”
“একদম তাই। তিনি কিন্তু কোনও কাল্পনিক চরিত্র নন। তিনি সত্যিই ছিলেন এবং অকাট্য প্রমাণ না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয়, তিনি ফিলোজফার্স স্টোন বা পরশমণি বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সেটা একমাত্র সম্ভব হয়েছিল অধিরসায়ন চর্চার মাধ্যমেই।”
কুট্টুস দেখল প্রিন্সদাদাও সোজা হয়ে বসেছে, বিষয়টা মনোযোগ আকর্ষণ করার মতোই। ইশ, এতবার সিনেমাটা দেখেছে কুট্টুস, বইটাও পড়েছে, কিন্তু নিকোলাস ফ্লামেল নামটা কেন সে মনে করতে পারল না?
বৃদ্ধ বলে চলেছেন, “নিকোলাস ফ্লামেলের জন্ম আনুমানিক ১৩৩০ সালে, ফ্রান্সের পন্টয়েজে। প্রথম জীবনে নিকোলাস ফ্লামেল সাধারণ একজন বই বিক্রেতা ছিলেন। ব্যাবসার কাজে পুরোনো বই কিনে নিয়েও বিক্রি করতেন। একদিন এক ফেরিওয়ালা এসে কিছু দুষ্প্রাপ্য বই বিক্রি করে গেলেন তাঁর কাছে। সেই বইয়ের মধ্যে থেকেই একটি বই নিকোলাস ফ্লামেলের জীবন বদলে দিয়েছিল। চমৎকার বাঁধাই করা পার্চমেন্ট কাগজের অদ্ভুত বই যার কোনাগুলো ছিল সোনা দিয়ে বাঁধানো। ভেতরে ছিল অদ্ভুত সব চিত্র, তবে বইয়ের ভাষা ছিল প্রাচীন হিব্রু, যা নিকোলাসের দুর্বোধ্য। লেখকের নাম আগেই দেখেছেন, ইহুদি যুবরাজ আব্রাহাম ইলিয়েৎসার। কিছু সংকেত দেখে নিকোলাস বুঝলেন বইটি অ্যালকেমির প্রাচীন পাণ্ডুলিপি।
“এই বই পড়া নিকোলাসের কাছে যেমন অসম্ভব ছিল তেমনি ছিল অধিরসায়ন চর্চাও। সেই সময় অতিপ্রাকৃত বা জাদুবিদ্যা চর্চা ছিল অসামাজিক কাজ। থেমে রইল সেই বই পড়া কিন্তু নিকোলাস হার মানলেন না। প্রায় একুশ বছর পর মায়েস্ত্রো কানশেস নামের স্পেনের এক ইহুদি জাদুবিদ্যা কাব্বালায় পারদর্শীর সন্ধান পেলেন যিনি প্রাচীন ইহুদি ভাষা পড়তে পারতেনসেই ইহুদি জাদুকরকে তৎকালীন ইহুদি বিরোধী ফ্রান্সে নিয়ে আসার জন্যে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করলেন নিকোলাস ফ্লামেল। বৃদ্ধ মারা যাওয়ার আগে বইটার কিছুটা পাঠোদ্ধার করে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই নিকোলাস বাকি বই পাঠোদ্ধার করেন। হাতে কলমে গবেষণার কাজ করে চলেছিলেনআনুমানিক ১৩৭৯ সালে নিকোলাস ০.২৩ পারদকে রুপোয় রূপান্তরিত করেন এবং ১৩৮২ সালে সোনায়।”
“কীভাবে?” কুট্টুসের মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছিল। এইভাবে সোনা তৈরি করা যায় নাকি?
“বই পড়ে,” কুট্টুসের দিকে চেয়ে উত্তর দিলেন বৃদ্ধ। তারপর হেসে বললেন, “আসলে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। অ্যালকেমির দুটো মূল ভাগ। এক, ধাতুকে সোনায় রূপান্তর করার পদ্ধতি আবিষ্কার, যেটাকে ফিলোজোফার্স স্টোন বলি। দুই, ‘এলিক্সির অফ লাইফ’ বা অমৃত-সুধার সন্ধান। অর্থাৎ, ‘লাইফ পোশন’ বা ‘জীবনদায়ি আরক’ সন্ধান।”
“ইম্মর্টালিটি?” প্রিন্স প্রশ্ন করে।
বৃদ্ধ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানান। বললেন, “ধারণা করা হয় নিকোলাস একধরনের লালচে গুঁড়ো আবিষ্কার করেছিলেন যার দ্বারা তিনি যে কোনও ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করতে পারতেন। তিনি শেষের দিকে বেশ ধনীও হয়েছিলেন কিন্তু।”
“সে সব গেল কোথায়? পেটেন্ট নিলেন না?” কুট্টুসের প্রশ্ন।
“তখন কি আর পেটেন্টের প্রচলন ছিল? আর অধিরসায়নের মতো অতিপ্রাকৃত ব্যাপারে চর্চা করাও ছিল অপরাধ। তাই গোপনেই করতে হয়েছিল পুরো ব্যাপারটা। রাজার কান বাঁচিয়ে গবেষণা করতেন নিকোলাস। তবে তিনি বেশ দানশীলও ছিলেন বলে শোনা যায়। দাতব্য চিকিৎসালয়, গরিবদের পুনর্বাসন দেওয়া, চার্চ ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন ফ্লামেল। একজন সাধারণ বই বিক্রেতা কীভাবে এত খরচা করতে পারেন? এই বিষয়টা তৎকালীন রাজা ষষ্ঠ চার্লসের চোখ এড়ায়নি। কিন্তু চতুর নিকোলাস এ ব্যাপারে সাবধান ছিলেন। অ্যালকেমি নিয়ে প্রচুর বই লিখলেও তাঁর মৃত্যুর পর সেই লাল গুঁড়োর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। অকাট্য প্রমাণ না থাকায় নিকোলাস ফ্লামেল কিংবদন্তী হয়েই রয়ে গেলেন। তবে অ্যালকেমি চর্চা সেখানেই থেমে থাকেনি, পরে অনেকেই এই বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। মূল ধারার বিজ্ঞানীরা এই বিদ্যাকে কোনওদিনই সুনজরে দেখেননি।”
“শুধু লাল গুঁড়ো আবিষ্কার করার দিকেই ঝুঁকলেন কেন? তিনি যদি অমৃত-সুধা বানাতে পারতেন তাহলে তো আরও বড়ো ব্যাপার হত। তখন তো সব বিজ্ঞানীদেরই ব্যাপারটা মানতে হত।” প্রিন্স জানতে চায়।
প্রিন্সের প্রশ্ন শুনে বৃদ্ধর মনে ঠিক কী পরিবর্তন হল বোঝা গেল না। তিনি ওদের কাছে এসে ঝুঁকে বললেন, “করেননি? আমার তো মনে হয় করেছিলেন।”
কুট্টুস বা প্রিন্স কেউই কোনও প্রশ্ন করতে পারল না। বৃদ্ধ বললেন, “শেষের দিকে বেশিরভাগ সময়ে কবরস্থানে কাটাতেন নিকোলাস ফ্লামেল। তাঁকে কীভাবে কোথায় কবর দেওয়া হবে সব নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রত্যেকটা স্থাপত্যে বিশেষ চিহ্ন খোদাই করা থাকত, যার সম্পূর্ণ অর্থ আজও কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। তিনি মারা গেলেন ২২শে মার্চ, ১৪১৮ সালে। নিভৃতে, খুব স্বল্প লোকের মাঝে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হল। বহুবছর ধরে তাঁর লিখিত বই, দলিল, খোদিত চিহ্নগুলোর উপরে গবেষণা চালানো হল, এমনকি তাঁর বাড়িও তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালানো হল। না উদ্ধার হল তেমন কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য, না পাওয়া গেল কোনও লাল গুঁড়ো। তাঁর মৃত্যুর প্রায় দু’শো বছর পর ডাকাতের দল তাঁর কবরে হানা দেয়। কিন্তু সেই কবর ছিল সম্পূর্ণ ফাঁকা। আসলে মনে করা হয় নিকোলাস ফ্লামেল কোনওদিন মারা যাননি, অথবা যদি মারা গিয়েও থাকেন তাহলে তাঁর কবর অন্য কোথাও আছে।”
প্রিন্স এবার হেসে বলে, “ও! আর তাই ধারণা করা হচ্ছে যে নিকোলাস ফ্লামেল এলিক্সির অফ লাইফ বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি আজও সেই অমৃত-সুধা পান করে বেঁচে আছেন?”
“হতেও তো পারে। বেঁচে থাকলেই বা কী? কেউ চিনবে কীভাবে?”
কুট্টুস দেখল ওর প্রিন্সদাদা বেশ বিরক্ত হয়েছে নিকোলাস ফ্লামেলের বেঁচে থাকার তত্ত্বটা মোটেই বিশ্বাস করেনি। কুট্টুসেরও মনে হয় না এতদিন একজন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। পারলে সে নিজের আবিষ্কার সবার সামনে আনবে না?
বৃদ্ধ চুপ করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। প্রিন্স কুট্টুসকে বলল, “আমি ওদিকে যাচ্ছি, খাওয়ার সময় হয়ে গেল” কথাটা বলেই প্রিন্স সিট ছেড়ে উঠে চলে গেল
কুট্টুসও চলেই যাচ্ছিল, সিটের উপর পত্রিকাটা দেখে বৃদ্ধকে প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, সেই যুবরাজ আব্রাহামের বইটার কী হল? পাওয়া গিয়েছিল?”
বৃদ্ধ নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “নাহ্‌! পাওয়া যায়নি। শোনা গিয়েছিল, নিকোলাস তাঁর ভাগ্নে পেরিয়ারকে সেই বই দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পেরিয়ারের কোনও খোঁজ ইতিহাস দিতে পারে না।”

রাত তখন ক’টা বাজে জানা নেই। কামরা অন্ধকার করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সবাই। নিকোলাস ফ্লামেল, লাল গুঁড়ো, জীবন-সুধা সব ভুলে কুট্টুস আবার নিজের সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে। সোনার নিবটা হারিয়েছে সে, কেউ চুরি করে নিয়েছে। কথাটা কীভাবে মা-বাবাকে জানাবে সে? আপার বার্থে উঠে কলমটা হাতে ধরে শুয়ে ছিল কুট্টুস, ট্রেনের দুলুনিতে কখন চোখ লেগে গেছে। হঠাৎ ট্রেনের গতি ধীরে হয়ে আসায় ঘুমটা ভেঙে গেল কুট্টুসের। ওর ঠিক নিচের লোয়ার বার্থেই প্রিন্সদাদা ঘুমিয়ে। প্রিন্সদাদার সামনের লোয়ারে সেই বৃদ্ধর সিট। তবে বৃদ্ধ এখন সিটে নেই, মনে হয় টয়লেটে গিয়েছেন। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে হলদে আলো এসে সিটের উপরে পড়ছে, নিশ্চয়ই কোনও স্টেশনে ঢুকছে ট্রেন।
আপার বার্থ থেকে ধীরে ধীরে নেমে আসে কুট্টুসএকটু হালকা হওয়া দরকার ওর। ঘুম ঘুম চোখে এগিয়ে যায় টয়লেটের দিকে। দরজার কাছে গিয়েই দেখে সেই বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন, কাঁধে ঝোলা। কুট্টুসকে দেখে বললেন, “ঐ পত্রিকায় একটা খবর কিন্তু ভুল আছে। স্যার আইজ্যাক নিউটন কিন্তু শেষ বয়সে পাগল হয়ে যাননি। তাঁর সহকারী জন লক নামের একজন অ্যালকেমিস্ট তাঁকে বিবাহের জন্য চাপ দিতে শুরু করেন, সেই কারণে তিনি পাগলামির অভিনয় করেছিলেন মাত্র।”
ট্রেন গতি কমিয়ে একটা ছোটো স্টেশনে থেমেছে। কথাগুলো শেষ করেই বৃদ্ধ ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমে ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোতে থাকলেন। ছোটো অনামী স্টেশন, মিনিট দুয়েকও দাঁড়ায় না ট্রেন এখানে। কুট্টুস চলন্ত ট্রেন থেকে বৃদ্ধের চলে যাওয়া দেখছিল।
“কী দেখছিস? পড়ে যাবি তো! ভেতরে আয়।” হঠাৎ প্রিন্সদাদার গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে কুট্টুসের।
ইশ, সেই লাল গুঁড়ো যদি আজ থাকত ওর কাছে... বাবার শক্ত হাতের চড় কল্পনা করেই মুখ শুকিয়ে যায় কুট্টুসের।
টয়লেট থেকে ফিরে এসে নিজের বার্থে উঠে বসে কুট্টুসবালিশটা টেনে মাথার কাছে আনতে হাত লাগে ওর ঝরনা কলমে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। কেন যে ও সোনার নিবটা স্কুলে নিয়ে গেল সেদিন! কলমের ঢাকনিটা সরিয়েই অবাক হয় কুট্টুসএ কী! নিবটা এমন চকচকে সোনালি হল কীভাবে? এই নিবটা তো সাদাটে রঙের ছিল।
মোবাইলের টর্চের আলো জ্বালে কুট্টুস। কলমের নিবটা সোনার, হুবহু আগেরটার মতো ঝলমল করছে সোনা রঙ। শিরদাঁড়া দিয়ে একটা স্রোত বয়ে যায় কুট্টুসের। বার্থ থেকে তড়িঘড়ি নামতে গিয়েই বালিশের তলায় রাখা চিরকুটটার উপর নজর পড়ে। ভাঁজ খুলে দেখে স্পষ্ট বাংলায় লেখা আছে, ‘লাল গুঁড়ো কিন্তু সত্যিই আছে।’
বিস্ময়ে কথা ফোটে না কুট্টুসের মুখে।
প্রিন্সও ফিরে এসেছে কুট্টুসের কাছে। খাপ খোলা কলম হাতে ভেবলে যাওয়া কুট্টুসকে দেখে এগিয়ে আসে প্রিন্সবলে, “এ কী! এটা সোনার নিবটা না? তুই এটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিস? জেঠু-জেঠিমা জানে?”
কুট্টুসের চোখে মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে তখন। কলমটার ঢাকনা বন্ধ করে পকেটে চালান করে দেয় কুট্টুস। গায়ে চাদরটা ঢাকা দিতে গিয়ে বলে, “প্রিন্সদাদা, লাল গুঁড়ো কিন্তু সত্যি আছে রে।”

*                           *                          *

কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে ধীর পায়ে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন সতীনাথ বক্সি। শরৎকালের মাঝামাঝি এই সময়টায় রাতের দিকে হিম পড়ে বেশ ঠাণ্ডা থাকে রাজস্থানের পাথুরে অঞ্চল। দিনের আলো ফোটার আগেই এই গ্রামের ভৈরবদেও নামের এক পুরোনো গুনিনের বাড়িতে পৌঁছাতে হবে তাঁকে। এই গুনিনই বলতে পারবেন সেই মুসলিম ফকির বাবাকে কোথায় পাওয়া যাবেগুনিন জানিয়েছিলেন, বিকানেরের দিকে কোন গ্রামে থাকেন সেই ফকির বাবা। লোকে বলে ফকিরের বয়স পাঁচশো বছরেরও বেশি, দেখলে মনে হয় চল্লিশ-পঞ্চাশ মাত্র। ফকির বাবা আরব, ইরান, মিশর ঘুরে এসে এই থর মরুভূমিতে থিতু হয়েছেন। তবে দেখতে গেলে বয়েস তো সতীনাথেরও কম হল না। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের সময়েই সতীনাথ স্কুলপড়ুয়া। বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, গান্ধীজির হত্যা, ক্ষমতা বদল, একাত্তরের যুদ্ধ এসব তো নিজের চোখে দেখা। বাবা ব্রিটিশ, মা ভারতীয়। খাঁটি বাঙালি না হলেও অবিভক্ত বাংলায় জন্ম সতীনাথের। বংশপরম্পরায় পাওয়া একটা অর্ধসমাপ্ত বই সতীনাথের জীবনটা বদলে দিয়েছিল শৈশবেই। তাঁর বাবা বলেছিলেন, ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুই-এর দরবারে দুবো নামের একজন লোক এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই লোক নাকি লালচে গুঁড়োর সংস্পর্শে সীসার বলকে সোনায় রূপান্তর করে দেখিয়েছিলেন। রাজা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন দুবো একজন দাগী আসামী। তারপর বাকি জীবনটা তাঁর কারাগারেই কেটেছিল দুবোর সেই কারাবাসের সময় কোনো কারারক্ষীকে তিনি লাল গুঁড়ো বানানোর পদ্ধতি বলে দিয়ে যান সেই গুঁড়ো তিনি বানিয়েছিলেন পেরিয়ার নামক এক লোকের কাছ থেকে পাওয়া একটি বইয়ের কয়েকটা ছেঁড়া পৃষ্ঠা দেখে
সতীনাথের বাবার পূর্বপুরুষই ছিলেন ফ্রান্সের সেই কারারক্ষী। বিদ্যাটি অর্জন করার পর তিনি ফ্রান্স ছেড়ে চলে আসেন ইংল্যান্ডে। তিনি লাল গুঁড়ো বানাতে পারেননি ঠিকই, তবে দুবোর বলে দেওয়া পদ্ধতির পুঙ্খানুপুঙ্খ একটি বিবরণ লিখে যান। সেই বিবরণই হাতে পেয়ে কাজ শুরু করেছিলেন সতীনাথ। অধিরসায়ন নিয়ে আরও নানারকম বই পড়ে আরও উন্নত মানের লাল গুঁড়ো বানাতে পেরেছিলেন, যা শুধু সীসাকেই নয়, বরং যে কোনও ধাতু এমনকি সংকর ধাতুকেও স্পর্শের মাধ্যমে সোনায় রূপান্তর করতে পারে। এই পদার্থটির ভর সোনার চেয়ে বেশি। এরপর তিনি থেমে থাকেননি, খোঁজ চালিয়ে গিয়েছেন ‘এলিক্সির অফ লাইফ’ নামক জীবন-সুধার। কিছুটা সক্ষম তিনি হয়েছেন অবশ্য। নাহলে এই দেড়শো বছরের উপরের বয়স অবধি আজ কয়জন বেঁচে থাকে? তাঁর আবিষ্কৃত আরক শুধু মানুষের শরীরের রোগ নিরাময়ে সক্ষম, বয়স কমিয়ে তরতাজা যুবক বা যুবতী বানানো সেই আরক দ্বারা সম্ভব নয়।
সতীনাথ শুধু আধিরসায়ন চর্চাই করেননি। এই বিষয় নিয়ে কে কোথায় গবেষণা করছেন পাশাপাশি তার খোঁজও করে চলেছিলেন বহুদিন ধরে। আর খোঁজ করতে করতেই এই ভৈরবদেও গুনিনের কাছে ফকির বাবার খবর পান। সত্যি যদি এই ফকির বাবার বয়স পাঁচশো বছরের বেশি হয়ে থাকে তাহলে সতীনাথের অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়বেই।
একজন রিকশাওয়ালাকে ভৈরবদেও গুনিনের বাড়ির ঠিকানা বলে দিয়ে সিটের উপর সোজা হয়ে বসলেন সতীনাথ। ব্যাগের ভেতরে হাত চালান করে দেখলেন লাল গুঁড়োর কৌটোটা ঠিক আছে কি না। গুঁড়োর স্পর্শে সোনায় রূপান্তরিত জিনিসগুলো শুধু ভেলকি দেখাতেই নয়, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উপঢৌকনের কাজেও লাগে। ঠিক যেমন একটু আগে ছোটো ছেলেটার কলমের নিবটা সোনায় রূপান্তরিত করে এসেছেন সতীনাথ।
_____
ছবিঃ লেখক

3 comments:

  1. বাঃ খুব সুন্দর। বেশ অন‍্যরকম গল্প

    ReplyDelete
  2. Khub bhalo laglo pore! Khub shundor.

    ReplyDelete