গল্পের ম্যাজিক:: ভূতুড়ে দুর্গা - বিভাবসু দে


ভূতুড়ে দুর্গা
বিভাবসু দে

“দাদু, আমাদের বাড়ির মা দুগ্গার এমন বিচ্ছিরি নাম কেন? বেশ ব্যাজার মুখে কথাটা জিজ্ঞেস করতে করতে ঘরে এসে ঢুকল রায়ান
রায়ানের দাদু, মানে চন্দ্রেশ্বর চক্রবর্তী, সবে তখন সকালের চায়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বসে ছিলেনছোটো নাতির এমন অতর্কিত প্রশ্নে বেশ একটু চমকে উঠলেন প্রথমে, যদিও আসল ব্যাপারটা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগল নারায়ানকে কাছে ডেকে বললেন, “কেন দাদুভাই? তোমার বুঝি নামটা পছন্দ হয়নি?
“একদম নাদুগ্গা ঠাকুরের এমন নাম কখনও হয়?
হালকা এক চিলতে হাসির রেখা ছলকে উঠল চন্দ্রেশ্বরবাবুর ঠোঁটের কোণে“তা অবশ্য তুমি ভুল বলনিতবে এই নামের পেছনে কিন্তু একটা জম্পেশ কাহিনি আছে।”
“গল্প? কী গল্প দাদু? গল্পের নাম শুনেই হঠাৎ চোখদুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল রায়ানেরসঙ্গে একগাল হাসি
রায়ানের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে চায়ের কাপে আরেকবার আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালেন চন্দ্রেশ্বরবাবুরায়ানরা গতকালই এসেছেরায়ানের বাবা, মানে চন্দ্রেশ্বরবাবুর ছোটোছেলে চাকরিসূত্রে বাইরে থাকেএককালে ওঁদের বিশাল একান্নবর্তী পরিবার ছিল, আজকাল অবশ্য কাজের খাতিরে সবাইই প্রায় বাইরেকেউ বহির্রাজ্যে তো কেউ বিদেশেতবে যে যেখানেই থাকুক, বছরের এই সময়টা বাড়ির সবাইকে মুকুন্দপুরে আসতেই হয়দুর্গাপুজো বলে কথা! আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে আবার সেই আগেকার মতো সারা বাড়ি গমগম করতে থাকে পুজোর ক’টা দিনচন্দ্রেশ্বরবাবুর মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে ওঠেএবার অবশ্য রায়ানরা একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে, পুজোর এখনও পাঁচদিন বাকিতবে বাকিরাও এসে পড়বে আর কিছুদিনের মধ্যেই
রায়ানদের বাড়ির এই পুজো প্রায় তিনশো বছরের পুরোনোএককালে যখন চন্দ্রেশ্বরবাবুর পূর্বপুরুষরা এই মুকুন্দপুরের জমিদার ছিলেন তখন থেকেই চলে আসছে এই পুজোতবে চক্রবর্তী-বাড়ির পুজো মাটির মূর্তিতে হয় না, হয় পাঁচ ফুট উঁচু এক অষ্টধাতুর মূর্তিতেতিনশো বছর ধরে এই মূর্তিতেই পুজো হচ্ছেএছাড়া বাড়িতে এই মূর্তির নিত্যপুজো তো রয়েছেই
“কী গো দাদু, কী ভাবছ? বলো না গল্পটা।” আর তর সইছিল না রায়ানেরনাতির ডাকে চন্দ্রেশ্বরবাবুও একটু নড়েচড়ে বসলেনচোখের চশমাটা খুলতে খুলতে বললেন, “জানো দাদুভাই, যখন আমি তোমার বয়সি ছিলাম তখন আমার বাবার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম এই কাহিনিটাতারপর অবশ্য আরও অনেকের মুখেই শুনেছিভারী মজার কাহিনি।”
দাদুর কোলে আরেকটু জাঁকিয়ে বসল রায়ান
চন্দ্রেশ্বরবাবু শুরু করলেন “স্বাধীনতার আগে যখন জমিদার, রাজা-মহারাজাদের যুগ ছিল তখন আমাদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন এই গ্রামের জমিদারতাই দেখবে, গ্রামের অনেক বয়স্ক মানুষরা এখনও আমাদের এই বাড়িকে জমিদার-বাড়িই বলে থাকেনকিন্তু মজার বিষয়টা কী জানো, আমরা কিন্তু চিরকাল এমন জমিদার ছিলাম না
“সে আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের কথাএই মুকুন্দপুর থেকে অনেকটা দূরে, বাংলা আর বিহারের সীমান্ত লাগোয়া একটা গ্রাম ছিল - হরিদেবপুরছোটো গ্রাম, লোকজন খুব বেশি নয়বেশিরভাগ লোক চাষবাস করেই জীবন চালাততা সেই গ্রামেই থাকত এক সাধারণ ব্রাহ্মণ পরিবাররামনারায়ণ চক্রবর্তী, তাঁর স্ত্রী আর এক ছেলেমোটামুটি টেনেটুনে দিন চলে যাচ্ছিল তাঁদেরঅল্প একটু ধানিজমিতে ফসল ফলিয়ে আর কখনও কারও বাড়িতে পুজো করার ডাক পেলে সেই দক্ষিণাতেই সংসার চালাতেন রামনারায়ণ।”
এটুকু বলে একবার থামলেন চন্দ্রেশ্বরবাবুরায়ান তখনও উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে দাদুর মুখের দিকেচন্দ্রেশ্বরবাবু চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে আবার কাহিনির হাল ধরলেন
“তখন শরৎকাল চলছিলআর শরৎকাল মানেই দুর্গাপুজোচারপাশে একটা পুজো পুজো গন্ধভোরবেলা শিশিরভেজা শিউলি ফুল আর দূরের মাঠে মাঠে কাশের বনে সাদা ঢেউসেই তিনশো বছর আগে কিন্তু এখনকার মতো ক্লাব বা বারোয়ারি পুজো বলে কিছুই ছিল নাগ্রামের জমিদারবাড়িতেই শুধু পুজো হতকিন্তু তাতে সারা গ্রামের সব মানুষই আনন্দ করতপুজোর ক’টা দিন তো গ্রামে কারও বাড়িতে উনুনই জ্বলত না; সবাই রোজ জমিদারবাড়িতেই পাত পেড়ে খেতআমাদের বাড়িতেও হত আগেছোটোবেলায় দেখেছিসে এক দেখার মতো ব্যাপার - পুজোর দিনগুলোতে যে কত লোক খেত এই বাড়িতে তার ইয়ত্তা নেইআর সেসবে সবচেয়ে মজা ছিল ছোটোদেরপাতে পাতে নুন, কাঁচালঙ্কা, খিচুড়ি, ভাজা এসব তো আমরা ভাই বোনেরাই পরিবেশন করতামসেসব কী দিনই না ছিল!
“তবে এখন আর সম্ভব হয়ে ওঠে নাদিনকালও বদলে গেছেআমাদের এই ছোট্ট গ্রামেই তো এখন কত পুজো! নিজের অজান্তেই যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল চন্দ্রেশ্বরবাবুর বুক ঠেলে“যাক সেসব কথাযা বলছিলাম, সেই হরিদেবপুরের জমিদারবাড়িতেও শুরু হয়ে গেছিল সাজো-সাজো রবগ্রামের বাতাসে বাতাসে বইতে শুরু করেছে পুজোর হাওয়াবাচ্চা থেকে বুড়ো সবার মুখে তখন শুধু একটাই কথা - এবারের পুজো কেমন হবে, কে কী করবে পুজোতে, জমিদারবাড়িতে কী কী থাকবে অষ্টমীর মহাভোগে, এবারের ঢাকিগুলো গতবারের চেয়ে খারাপ বাজাচ্ছে না ভালো, এই!
“কিন্তু এসবের মাঝে রামনারায়ণের মনটা একটু খারাপজমিদারবাড়ির কুলপুরোহিতকে অনেক বলে-কয়েও সহকারী হিসেবে জায়গা পাননি তিনিআসলে জমিদারবাড়ির পুজো তো, অনেক দক্ষিণা জোটেকিন্তু এখন কী আর করা যাবে! যার যার কপাল! এই ভেবেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন রামনারায়ণভাগ্য ভালো থাকলে যদি লক্ষীপুজো আর কালীপুজোয় কিছু বরাত জোটে!
“পুজোর তখন আর মাত্র দিন তিনেক বাকিহরিদেবপুরে সবাই পুজোর তোড়জোড়ে ব্যস্ত, জমিদারবাড়িতেও লোকে লোকারণ্যএমন সময় হঠাৎ একদিন বেশ রাতে কে যেন এসে কড়া নাড়ল রামনারায়ণের বাড়িতেকী জানি কে আবার এল! ঘুম-ঘুম চোখে আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজা খুললেন রামনারায়ণঅচেনা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন - এই গ্রামের তো মোটেই ননতবে চিনতে না পারলেও সেই ভদ্রলোকের সম্ভ্রান্ত চেহারা আর গায়ের দামি পোশাক-আশাক দেখে রামনারায়ণ এটুকু অন্তত বুঝে গেছিলেন যে ইনি বেশ ধনী জমিদার গোছেরই কেউ একজন হবেনআগন্তুক ভদ্রলোক মাঝবয়সী, মাথায় সুন্দর করে আঁচড়ানো কাঁচাপাকা চুল, আর টিকালো নাকের নিচে বেশ পুরু একখানা গোঁফ
“আপনিই শ্রীযুক্ত রামনারায়ণ চক্রবর্তী? - সেই আগন্তুক হাতজোড় করে বেশ বিনয়ী গলায় জিজ্ঞেস করলেনরামনারায়ণও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন – ‘আজ্ঞে, আমিইবলুন।’ কিন্তু তারপর সেই আগন্তুক যা বললেন তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না রামনারায়ণভদ্রলোক কোনও ভনিতা না করেই বললেন যে তিনি নাকি তাঁদের বাড়ির পুজোতে প্রধান পুরোহিত করতে চান রামনারায়ণকেপ্রথমে ঠিক যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না রামনারায়ণের! তিনি কিনা দুর্গাপুজোর প্রধান পুরোহিত! একবার বোধহয় নিজেকে চিমটি কেটেও দেখে নিয়েছিলেন যা শুনছেন তা স্বপ্ন না সত্যি! ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?
“আপত্তি! না না, একেবারেই নয় - আনন্দে গলা কাঁপছিল রামনারায়ণের তো তাঁর কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিলতবে ভদ্রলোকের শুধু একটাই শর্ত যে পুজো করতে রামনারায়ণকে একাই যেতে হবে; সঙ্গে আর কেউ থাকতে পারবে না, এমনকী তাঁর স্ত্রী কিংবা ছেলেও নাসেইমুহূর্তে এতে আপত্তি করার মতো তেমন কিছুই মনে হল না রামনারায়ণের - সানন্দে রাজি হয়ে গেলেনভদ্রলোকও বেশ সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে অগ্রিম কিছু প্রণামী দিয়ে নিজের বাড়ির ঠিকানা-টিকানা সব বুঝিয়ে চলে গেলেন
“সেদিন রাতে খুশিতে আর ঘুম হল না রামনারায়ণেরপরদিন সকাল থেকেই একেবারে কোমর বেঁধে কাজে নেমে পড়লেন তিনিপাঁজি-পুঁথি ঘেঁটে দুর্গাপুজোর যত বিধিবিধান, মন্ত্রতন্ত্র আছে সব বেশ করে শিখে-পড়ে নিতে লাগলেনহাজার হোক জীবনে প্রথমবার এত বড়ো সুযোগ পেয়েছেন, খানিকটা ভয় তো থাকেই।”
“তারপর? রায়ান জিজ্ঞেস করল
“তারপর আর কী, দেখতে দেখতে পুজোর দিনও এসে গেলরামনারায়ণ সকাল সকাল উঠে সব নিয়মনিষ্ঠা মতো তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লেন দুগ্গা-দুগ্গা বলেতখন তো আর আজকালকার মতো অটো-রিকশা ছিল নাপালকি কিংবা গাড়ি শুধু ধনীলোকেদের বাড়িতেই থাকতসাধারণ মানুষ বেশিরভাগ সময় পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করততা তাঁর ঘন্টা তিনেকের বেশি লাগল না সেই ভদ্রলোকের বলে দেওয়া জায়গায় পৌঁছতেহরিদেবপুর গ্রাম থেকে খানিকটা দূরে, খড়গাই বলে একটা জায়গাযেতে যেতেই দূর থেকে ঢাক-ঢোলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন রামনারায়ণআরও কিছুটা এগোতেই সেই ভদ্রলোককেও দেখতে পেলেনতিনি নিজেই এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানিয়ে পুজোমণ্ডপের দিকে নিয়ে গেলেন রামনারায়ণকেইনিই বাড়ির কর্তা
“কাছে গিয়ে রামনারায়ণ তো একেবারে ! এ তো বিশাল আয়োজন! বাড়ি তো নয়, ঠিক যেন রাজপ্রাসাদএর সামনে ওঁদের গ্রামের জমিদারবাড়ি তো প্রায় কুঁড়ের সামিল! যেমন জৌলুস তেমনই লোকের ভিড় আর পুজোর ঘটাসেই প্রাসাদেরই উত্তরদিকে এক বিরাট সুসজ্জিত নাটমন্দিরে পুজোর সব ব্যবস্থা করা হয়েছেমন্দিরের চাতালের সামনে লোকে গিজগিজ করছেওপরে বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা, সব পুজোর কাজে ব্যস্তআয়োজনে কোনও ত্রুটি নেইআস্তে আস্তে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে ঢুকলেন রামনারায়ণ
“সেখানে পুরো ঘর আলো করে দাঁড়িয়ে আছে ফুট পাঁচেক উঁচু এক অপূর্ব সুন্দর দুর্গামূর্তিকিন্তু মাটির নয়, অষ্টধাতুর তৈরি, একেবারে যেন জীবন্ত! রামনারায়ণ এত বড়ো ধাতুর বিগ্রহ জীবনেও দেখেননিপ্রথমে বেশ ঘাবড়েই গেছিলেন - একে তো প্রথমবার প্রধান পুরোহিত হিসেবে দুর্গাপুজো করতে যাচ্ছেন, তার ওপর এই রাজকীয় ব্যাপার-স্যাপার
“যাই হোক, সব রীতি নিয়ম মেনেই পুজো শুরু করলেন রামনারায়ণফুল, নৈবেদ্য, যজ্ঞ, মন্ত্রপাঠ, আহূতি - নিখুঁতভাবে সারলেন সবকিছুইতাঁর কাজে গৃহকর্তা যে বেশ খুশি হয়েছেন, স্পষ্টই বোঝা গেল
“পরদিন বেশ সকালেই পুজো শুরু হয়ে গেলসময়মতো পৌঁছে সেদিনও সুন্দরভাবেই পুজোর সব কাজ করলেন তিনিনিয়মনিষ্ঠায় তাঁর কোনও ত্রুটি ছিল নাএভাবেই এক এক করে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, আর সবশেষে দশমীর বিসর্জনও হয়ে গেলহোম-যজ্ঞ থেকে শুরু করে বলিদান, অঞ্জলি - বিধিমতোই সম্পন্ন হল সবকিছুএবার বিদায়ের পালামানে দক্ষিণার পালাও বটে! কিন্তু সেদিনই ঘটল আসল ঘটনা।”
“কী ঘটেছিল দাদু?
“বলছি দাদুভাই, সেটাই তো বলছি,” একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে চন্দ্রেশ্বরবাবু আবার বলতে লাগলেন, “নিবিষ্টমনে দশমীর বিসর্জন মন্ত্র শেষ করে আশীর্বাদী জল ছেটাতে সবে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন রামনারায়ণকিন্তু পেছন ফিরতেই যা দেখলেন, ভয়ে যেন তাঁর সারা শরীর একেবারে থরথর করে কেঁপে উঠলআঁতকে উঠলেন রামনারায়ণচারপাশে ধু-ধু করছে ফাঁকা মাঠ! কোথায় নাটমন্দির! কোথায় লোকজন! কোথায় সেই বিশাল বিশাল গম্বুজওলা রাজপ্রাসাদ! কিচ্ছুটি নেই - মাঠের মধ্যিখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন তিনিআর সামনে জ্বলজ্বল করছে সেই সদ্যপূজিতা দশভুজা দুর্গামূর্তিগা’টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল রামনারায়ণেরআর ঠিক তখনই হঠাৎ সারাটা মাঠ কেঁপে উঠল বিকট সব অট্টহাসিতেচারদিক থেকে যেন হাহাকারের মতো ধেয়ে আসছে সেসব ভৌতিক শব্দপাগলের মতো এদিক-ওদিক তাকালেন, খুঁজলেন রামনারায়ণ, কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই
“ভয়ে বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে লাগল তাঁরকপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে গরম ঘাম; উত্তেজনায় আর আতঙ্কে হাপরের মতো উঠছে আর নামছে তাঁর বুকটাএক অস্বস্তিকর শিরশিরে কাঁপন যেন বয়ে যাচ্ছে গোটা শরীর জুড়ে - দিশেহারা হয়ে মূর্তির দিকে এগোতে গেলেন তিনিআর তখনই হঠাৎ তাঁর পায়ের কাছে কী একটা যেন ঠেকলচমকে উঠলেন রামনারায়ণকিন্তু নিচে তাকাতেই বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে গেল - পায়ের কাছে কঙ্কালের স্তূপ! হাড়গোড় আর মড়ার খুলি! যতদূর চোখ যায় আস্ত মাঠ জুড়ে এখানে-ওখানে শুধু এসবই ছড়িয়ে আছেগায়ে কাঁটা দেওয়া একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল তাঁর শিরদাঁড়া দিয়েমাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলআস্তে আস্তে সব অন্ধকার হতে হতে কোথায় যেন মিলিয়ে যেতে লাগল রামনারায়ণের চোখের সামনে থেকে।”
উত্তেজিত গলায় রায়ান জিজ্ঞেস করল, “রামনারায়ণ কি ভয়ে হার্টফেল করেছিলেন?
চন্দ্রেশ্বরবাবু হাসলেনবললেন, “না গো দাদুভাইঅজ্ঞান হয়ে গেছিলেনযখন চোখ খুলল তখন সকাল, সূর্য বেশ কড়া হয়ে উঠেছে আকাশ জুড়েচোখ রগড়ে উঠে বসতেই রামনারায়ণ দেখলেন সামনে সেই অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তিকিন্তু কী! মূর্তির পায়ের কাছে যে বিশাল এক পিতলের ঘড়ারাতে তো ছিল না এটা! কাছে যেতেই আরও চমকে উঠলেন তিনিঘড়া ভর্তি সোনার মোহর! আর তার ওপরে তুলোট কাগজে লেখা একটা চিঠিতাতে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, ‘আমাদিগকে এই অভিশপ্ত প্রেতজীবন হইতে মুক্তিদানের নিমিত্ত আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদসামান্য দক্ষিণাস্বরূপ এই মোহরের ঘড়াখানা রহিলএবং তৎসহিত আমাদিগের কুলদেবী মা দুর্গার মূর্তিখানিওএই মূর্তি আমরা আপনার হস্তেই সমর্পণ করিলামআশা করি অনাদর হইবে না।’
“বুঝতে আর কিছুই বাকি রইল না রামনারায়ণেরমোহরভর্তি ঘড়াটার দিকে তাকাতেই গত রাতের দুঃস্বপ্নগুলো আস্তে আস্তে মুছে গিয়ে একটা সোনালি ভবিষ্যতের ছবি ফুটে উঠছিল তাঁর মনেকিন্তু সেই সঙ্গে একঝাঁক চিন্তাওএই বিপুল সম্পত্তি কীভাবে সামলাবেন তিনি? গ্রামে ফিরে যাবেন নাকি...? আর ফিরতে হলেও এই ভারী মূর্তি আর এত বড়ো ঘড়াটাই বা এখান থেকে নিয়ে যাবেন কী করে?
“মাঝমাঠে দাঁড়িয়ে যখন এসব ভাবছেন রামনারায়ণ তখন হঠাৎ পেছন থেকে নিজের স্ত্রীর গলা শুনে চমকে উঠলেনফিরে তাকাতেই দেখলেন ভুল শোনেনি, সত্যিই তাঁর স্ত্রী আর ছেলে - এদিকেই এগিয়ে আসছে তারাপেছনে দু-দুটো গরুর গাড়িতিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এখানে কী করে এলে?’ রামনারায়ণের স্ত্রী ভয়জড়ানো গলায় বললেন, ‘একজন বাবু এসে বললেন তুমি নাকি পুজো শেষ করে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছ, ঘোরের মধ্যে আমার আর খোকার নাম বিড়বিড় করছওগো তোমার কী হয়েছে? গলাটা কেমন যেন কাঁদো কাঁদো হয়ে এল তার
“রামনারায়ণ বললেন, ‘আমার কিচ্ছু হয়নি, ঠিক আছিকিন্তু গাড়িদুটো কোথায় পেলে? সেই বাবুই দিয়েছেন?
“তাঁর স্ত্রী ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁতিনি সঙ্গে করে নিয়েই এসেছিলেন, কিন্তু নিজে এলেন না।’
“মনে মনে একটু হাসলেন রামনারায়ণ, আর কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন মা দুর্গাকেতাঁর সেই ভৌতিক যজমানেরা শুধু দক্ষিণাই দেয়নি, দক্ষিণা নিয়ে যাবার ব্যবস্থাও করে দিয়েছেস্ত্রী আর ছেলেকে এভাবে ডেকে আনবার কারণটাও বেশ বুঝতে পারলেন তিনিএই বিশাল সম্পত্তি নিয়ে হরিদেবপুরে ফিরে যাওয়া বোকামি হবে, তাই এই ব্যবস্থামনে মনে আরেকবার সেই ভূত-বাবুদের উদ্দেশে হাতজোড় করলেন রামনারায়ণ
“সেদিনের পর থেকে তাঁকে কেউ কোনওদিন আর হরিদেবপুরে দেখেনিসেই খড়গাইয়ের মাঠ থেকেই সোজা গাড়িতে দুর্গামূর্তি আর মোহরের ঘড়া তুলে নিয়ে স্ত্রী-পুত্রসহ তিনি চলে এলেন এই মুকুন্দপুরেতখন -গ্রাম কেমন ছিল জানি না, তবে এত লোক নিশ্চয়ই ছিল নারামনারায়ণ এখানে এসে বিশাল এক বাড়ি বানিয়ে রীতিমতো জমিদার হয়ে বসলেনএক দরিদ্র ব্রাহ্মণ রাতারাতি হয়ে উঠলেন ধনী জমিদার!
“আমরা সেই রামনারায়ণ চক্রবর্তীরই উত্তরসূরিআর তখন থেকেই সেই অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তির ‘ভূতুড়ে দুর্গা’ নামে পুজো হয়ে আসছে আমাদের বাড়িতে।”
এক বুক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে থামলেন চন্দ্রেশ্বরবাবুতারপর একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী দাদুভাই, এখন আর নিশ্চয়ই বিচ্ছিরি লাগছে না নামটা?
কিন্তু রায়ানের মুখে আর কথা সরল নাতার অবাক দুটো চোখে বোধহয় তখনও ভাসছে তিনশো বছর আগের সেই দশমী রাতের ছবি
_____

5 comments:

  1. দারুণ লাগল।

    ReplyDelete
  2. দারুণ গল্প। এমন গল্প পড়েই পুজো শুরু হওয়া উচিত।

    ReplyDelete
  3. বাঃ অভিনব চিন্তা, খুব ভালো গল্প

    ReplyDelete
  4. প্রিয় বিভাবসু, তোমার গল্প "ভূতুড়ে দুর্গা" এইমাত্র পড়ে শেষ করলাম। তোমার নামের অর্থ, তোমার সঙ্গে কলকাতা বইমেলায় দেখা হওয়ার পরে অভিধান দেখে জেনেছি। সত্যিই জানতাম না যে, "বিভাবসু" মানে সূর্য"! যাইহোক, নাম নিয়ে এত কথা বলার কারণ, সূর্যের মতোই দীপ্যমান তুমি গল্পের নির্মাণে! একটুও বাহুল্য নেই, কমও নেই কোথাও। শুধুমাত্র শিশু-কিশোররাই নয়, বয়স্কদেরও এ গল্প ভালো লাগবেই। দুর্গা নিয়ে ভূতুড়ে গল্প-রচনা অভিনব নিঃসন্দেহে। আগাগোড়া সাসপেন্স ধরে রেখেছ তুমি বিভাবসু। এমন গল্প উপহার দিলে বলে তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং আমার তরফে তোমার জন্যে থাকছে আন্তরিক শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
  5. অসাধারণ প্লট

    ReplyDelete