অপরাজিত:: পাহাড় যখন ডাকে - সুদীপ চ্যটার্জী

রেইনহোল্ড মেসনার

পাহাড় যখন ডাকে
সুদীপ চ্যটার্জী

পায়ের পাতায় রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছেনিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এবার রীতিমতোএক পা ফেলতে গিয়ে মনে হচ্ছে লাংস যেন ছিঁড়ে যাবেধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে চোখের সামনেমাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণাক্ষীণ হয়ে আসছে অনুভূতিগুলোমৃত্যু তার অপেক্ষায় আছে আট বছর ধরেএখানে সে মরতেই এসেছে

(১)

১৯৫৩রেইনহোল্ড-এর বয়স তখন নয় বছর খবর এল হারমান বুল নাঙ্গা পর্বত শিখর জয় করেছেনমুহূর্তের মধ্যে সেলিব্রেশন আরম্ভ হয়ে যায় মেসনার ভাইদের মধ্যেইতালিতে থাকা এই পরিবারের সবাই পাহাড় পাগলমাসে একবার আল্পস-এ না যেতে পারলে এরা অস্থির হয়ে ওঠেরেইনহোল্ড আর গুন্টুর ইতিমধ্যেই পাকা পর্বতারোহী হয়ে উঠেছেইতালির উত্তর-পশ্চিমে ডোলামাইটস রেঞ্জের অনেকগুলো শিখর তারা জয় করেছে দশ বছরে পড়ার আগেইরেইনহোল্ড এমনিতেও হারমান বুলের অন্ধ ভক্ততার হিরোর এই কৃতিত্বে সে সবচেয়ে খুশিএত বছর ধরে কেউ জয় করতে পারেনি যে নাঙ্গা পর্বত, বুল তা করে দেখালেনসম্পূর্ণ নিজস্ব ক্লাইম্বিং টেকনিকের ওপর ভরসা করেবুল এমনিতেই সেই সময়ের পর্বতারোহী জগতের রেবেলআলপাইন স্টাইল-এর প্রবল সমর্থকএক্সপিডিশন স্টাইল বা সিজ স্টাইল-এর ক্লাইম্বিংকে খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন বুলতার মতে হাজারটা ইকুইপমেন্ট, আর রোপের ওপর ভরসা করে পাহাড়ে যাওয়া পাহাড়কে অপমান করার সামিলযে সত্যিকারের পর্বতারোহী, সে যাবে ভারমুক্ত হয়ে, নিজের ভরসায়, পাহাড়কে সম্মান করে না হলে নিজেকে mountaineer বলে পরিচয় দেওয়াই ভুলওয়াইনের চুমুক আর সেলিব্রেশনের আড়ালে রেইনহোল্ড ঠিক করে নিল, তার প্রথম হিমালয় expedition হবে নাঙ্গা পর্বতেকে জানত, ৩ জুলাই ১৯৫৩-এর সেই সন্ধে জীবন বদলে দেবে রেইনহোল্ড মেসনারের!

(২)

১৯৭০নাঙ্গা পর্বত-এর বেস ক্যাম্প-এ বসে হিমালয়ের দিকে চেয়ে আছে রেইনহোল্ডসঙ্গে আছে তার ছোটভাই গুন্টুর নয় বছরের রেইনহোল্ড আজ ছাব্বিশ বছরের যুবকইতিমধ্যেই সে ভাই গুন্টুরের সঙ্গে জয় করেছে আল্পসের বেশিরভাগ চূড়াঅভিজ্ঞ পর্বতারোহী বলে তাদের স্বীকার করা হয় সারা ইউরোপেকিন্তু হিমালয় এই প্রথমরেইনহোল্ড ভোলেনি তার নিজেকে করা প্রমিসপ্রথম হিমালয় expedition হিসেবে সে বেছে নিয়েছে নাঙ্গা পর্বতকেআল্পসকে সে হাতের রেখার মতনই চেনে কিন্তু হিমালয়ের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই হয় না৮০০০ মিটারের বেশি উচ্চতায় থাকা প্রতিটি পর্বত শিখর, যাকে popularly eight thousanders বলে ডাকা হয়, প্রত্যেকটা অবস্থিত এই বিশাল হিমালয়ান রেঞ্জেশুধু একটা পর্বতশৃঙ্খলা নয়, হিমালয় একটা জীবনদর্শন
২৭ জুন সকালবেলা থেকে ওয়েদার খারাপ হতে শুরু করেরেইনহোল্ড একা এগিয়ে গেছে রুপাল ফেস দিয়ে পিকের উদ্দেশ্যে তার আগেইসে এই অবসর হেলায় হারাতে রাজি নয়গুন্টুরও একটু পরে এগিয়ে যায় তার ভাইকে সঙ্গ দিতে তারা অভিজ্ঞ mountaineer, আর আলপাইন স্টাইল-এ ক্লাইম্ব করলে এমনিতেও সময় কম লাগে কিন্তু পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়ে নিজের ওপরগুন্টুর কোনওদিন আগে হিমালয়ে আসেনি, কিন্তু প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে সে দ্রুত এগিয়ে যায় রেইনহোল্ড-এর দিকেপিকের একটু আগেই তাদের দেখা হয়ে যায়সাবধানে এগোতে থাকে দু’জনেএকসময়ে পৌছে যায় নাঙ্গা পর্বত পিকেদারুণ আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে তারাস্বপ্ন আর স্বপ্ন নেই, তারা আজ জয় করেছে নাঙ্গা পর্বতমেসনার ভাইরা আকাশের দিকে চোখ তুলে ভগবানকে ধন্যবাদ দেয়
এবার ফেরার পালাসবদিক চিন্তা করে তারা নামা শুরু করে দিয়ামির ফেস দিয়েএইদিক দিয়ে নামলে সময় বেশি লাগে, কিন্তু কিছু করার নেইরুপাল ফেসের দিকে ধ্বস নেমেছেচারদিকে বরফ আর বরফতার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নাঙ্গা পর্বতের চূড়া হিমালয়ের শীতার্ত হাওয়াকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ জীবনের দিকে দু’দিন ধরে নেমে চলেছে তারা অনবরতএদিকে ওয়েদার ক্রমাগত খারাপ হয়ে চলেছেশুরু হয়ে গেছে ব্লিজার্ডএইরকম সময়ে বরফের ক্রিভাসগুলোতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়
রেইনহোল্ড আর গুন্টুর নামতে থাকে একটু একটু করে গুন্টুর-এর শরীর খারাপ হতে শুরু করেছেহিমালয়ের এত উচ্চতায় আলপাইন স্টাইল-এ বেশিক্ষণ ক্লাইম্ব করলে এরকম হবেইব্লিজার্ড-এর জোর বেড়েই চলেছেআর কোনওমতেই এগোনো যাবে নাবরফের ঝড়ে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে নাতাপমাত্রা চলে গেছে অনেক নিচেএমন সময় avalanche-এর শব্দ শুনতে পাওয়া যায়রেইনহোল্ড এগিয়ে গেছিল বেশ খানিকটা সে চিৎকার করতে থাকে গুন্টুরকে সাবধান করার জন্যকিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছেহিমবাহ আছড়ে পড়েছে অবসন্ন গুন্টুর-এর ওপররেইনহোল্ড-এর চোখের সামনে তার সারাজীবনের পাহাড়ের সঙ্গী, তার ভাই হারিয়ে যায় নাঙ্গা পর্বতের বরফের মধ্যে, চিরতরের জন্যেবেহুঁশ হওয়ার আগে রেইনহোল্ড শুনতে পায় বুলের একটা কথা, "Mountains have a way of dealing with overconfidence."
ছয়দিন পর রেইনহোল্ড বেস ক্যাম্পে পৌঁছয় মরণাপন্ন অবস্থায়, এক গা জ্বর নিয়েগুন্টুর-এর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নারেসকিউ পার্টির লোকেরা একসময় হাল ছেড়ে দেয় গুন্টুর মেসনারের দেহ উদ্ধার করারঅবসন্ন দেহ ও ভাইয়ের স্মৃতি নিয়ে রেইনহোল্ড ফিরে আসে দেশেফ্রস্ট বাইট হওয়ার দরুন তার পায়ের ছ’টা আঙুল বাদ দিতে হয়পায়ের আঙুল না থাকলে রক ক্লাইম্বিং করা অসম্ভব কিন্তু higher mountain-এ কোনও সমস্যা হয় নানিজের অজান্তিতেই রেইনহোল্ড-এর জীবনের দিক ঠিক হয়ে যায়হিমালয়

রেইনহোল্ড এবং গুন্টুর মেসনার

(৩)

১৯৭১রেইনহোল্ড আবার ফিরে যায় নাঙ্গা পর্বত, উদ্দেশ্য গুন্টুর-এর দেহটা খুঁজে বের করাকিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হয়ে ওঠে নাপরের বছরে সে আবার ফিরে যায় নাঙ্গা পর্বত জয় করতে কিন্তু ভাগ্য রেইনহোল্ড-এর ওপর সদয় ছিল নাব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় সেকিন্তু রেইনহোল্ড-এরও জেদ চেপে গেছেসে আবার ওই চূড়ায় উঠবেই১৯৭২-এ মানালসু আর ১৯৭৫-এ হিডেন পিক জয় করে সে কিন্তু তার লক্ষ্য নাঙ্গা পর্বতসে প্রতিবছর ফিরে যায় সেখানে, যদি কোনওভাবে অবসর পাওয়া যায়
১৯৭৮রেইনহোল্ড এতদিনে বেশ কয়েকবার হিমালয়ান এক্সপিডিশানে এসেছেআগের চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ সেআবার নাঙ্গা পর্বত-এ ফিরে আসে সেরেইনহোল্ড-এর বিশ্বাস, সে একা না গেলে কোনওদিন উঠতে পারবে না নাঙ্গা পর্বতেগুন্টুর শুধু তাকেই দেখা দেবেআলপাইন স্টাইল-এ সোলো ক্লাইম্বিং আরম্ভ করে সেএবারেও ১৯৭০-এর মতন অবস্থাওয়েদার যে কোনও মুহূর্তে খারাপ হতে পারেকিন্তু আগের বারের মতো রুপাল ফেস দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে না সেরেইনহোল্ড পথ ধরে দিয়ামির ফেস-এর, যেখান থেকে আগেরবার গুন্টুর আর সে নেমে আসছিলএই পথ দিয়ে চড়াই করা প্রায় অসম্ভবকিন্তু তাকে যেতেই হবেযদি সে খুঁজে পায় গুন্টুরকে! তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেছেকে যেন রেইনহোল্ড-এর সমস্ত শক্তি, সমস্ত আত্মবিশ্বাস শুষে নিয়েছেচোখের সামনে ভেসে উঠছে আগেরবারের ঘটনা ভয়ে শিথিল হয়ে যায় বুকের ভেতরটা তার পায়ের পাতায় পাথর পড়ে চোট লেগেছেরক্ত চুঁইয়ে পড়ছে কাটা আঙুলগুলোর পাশ দিয়েনিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এবার রীতিমতো পায়ের পাতায় রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছেএক পা ফেলতে গিয়ে মনে হচ্ছে লাংস যেন ছিঁড়ে যাবেধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে চোখের সামনেমাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণাক্ষীণ হয়ে আসছে অনুভূতিগুলোমৃত্যু তার অপেক্ষায় আছে আট বছর ধরেএখানে সে মরতেই এসেছেকিন্তু এর শেষ দেখে যাবে সেযতক্ষণ শ্বাস চলছে সে হার মানবে নামৃত্যু যদি হয় হোকতাকে উঠতেই হবে
রেইনহোল্ড উঠছেএকাআরও এক পাআরও এক পাসময়ের বোধ হারিয়ে যায় একসময়একসময় রেইনহোল্ড চমকে ওঠে গুন্টুর! তার সঙ্গে সঙ্গে উঠছে তার ভাইমুখে হাসিতাকে দেখে বলে ওঠে, “C’mon Rainee! 100 meters more! We will do this.”
গুন্টুর-এর প্রতিমূর্তি হারিয়ে যায় রেইনহোল্ড দেখে সে চূড়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেসে উঠতে থাকেগুন্টুর আর তার সঙ্গে নেইকিন্তু তাকে উঠতেই হবেনিজের জন্যেসে থামবে না
রেইনহোল্ড মেসনার কোনওদিন থামেনি এরপরদিয়ামির ফেস দিয়ে প্রথম সে নাঙ্গা পর্বত জয় করে সোলো ক্লাইম্বিং করে১৯৭৮-এই সে এভারেস্ট জয় করে প্রথম supplementary অক্সিজেন না নিয়েতার অভিযান কোনওদিন থামেনিপৃথিবীর ১৪টি উচ্চতম পিকে সে পা রেখেছে একাধিকবারকেউ তার আগে এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেনিসে কোনওদিন supplementary oxygen নিতে রাজি হয়নিপাহাড়ের সম্মানহানি হতে সে দেবে নাসে পাহাড়কে ভালোবাসেতারই কথায়, “The wonderful things in life are the things you do, not the things you have.
২০০৫ সালে নাঙ্গা পর্বতে গুন্টুর মেসনারের দেহ উদ্ধার করা হয়

নাঙ্গা পর্বতশীর্ষে রেইনহোল্ড মেসনার, ১৯৭৮
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

5 comments:

  1. দারুণ লেখা,সবার পড়া উচিত।

    ReplyDelete
  2. দারুণ লেখা। পায়ে পায়ে অনেক পাহাড় ডিঙোনোর উৎসাহ দেয় এমন লেখা।

    ReplyDelete