বিজ্ঞান:: টাইম ট্র্যাভেলের রহস্যময় দুনিয়া - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


টাইম ট্র্যাভেলের রহস্যময় দুনিয়া
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

টাইম ট্র্যাভেল। সব্বাই যায়। সেই টাইম মেশিন গল্পের হিরো গেছিল সবার প্রথমে, তারপর থেকে ডক্টর হু যায়, টারমিনেটর যায়, ব্যাক টু দা ফিউচারের এমেট ব্রাউন যায়, স্টার ট্রেকের সেই আশ্চর্য যানটা তো যায়ই। সায়েন্স ফিকশানের হিরোরা হামেশাই ওই করে ফিউচারে চলে যায়, আবার পাস্টে চলে গিয়ে সেখানে কিছুমিছু বদলে দিয়ে মনের মতন ফিউচার টেনস বানিয়ে ফেলে।
বিজ্ঞানীরা প্রথম প্রথম বেজায় হাসতেন সেই নিয়ে। বলতেন ধুস, আসলে অমনটা আবার হয় নাকি? সময় চলে একটা তিরের মত অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে। তার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আমরাও যে অতীত ছেড়ে বর্তমানকে ছুঁয়ে ভবিষ্যতের পথে চলেছি সেই একমাত্র টাইম ট্র্যাভেল। ওকে বাদ দিয়ে ইচ্ছেমতন অতীত ভবিষ্যতে যাবার যন্ত্র বানানো মুশকিল।
তাঁদের আপত্তির কারণটা এইবেলা বলে নেয়া যাক। ভবিষ্যতের দিকে আমরা এমনিতেই টাইম ট্র্যাভেল করছিঅতএব সেইটে নিয়ে কিছু বলার নেই। সমস্যাটা হয় সময়ের নদীর উজানে ঠেলে পিছিয়ে যেতে গেলেই।
যেমন ধরো, দুষ্টু মানুষদের হাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মারা গিয়েছিলেন, তা জানো তো? ধরো সেই হত্যাকাণ্ডের সময় একটা ছেলে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যদি সে একটা টাইম মেশিন বানায় ভবিষ্যতে তাহলে তাইতে চড়ে এসে সে এই হত্যাকাণ্ডকে আটকাবে। সেই উৎসাহে সে ধরো অনেক চেষ্টা করে কুড়ি বছর বাদে মেশিনটা বানিয়ে ফেলল। তারপর তাতে চেপে হত্যাকাণ্ডের একটু আগে পৌঁছে সেটাকে আটকে দিল। ফলে প্রধানমন্ত্রী মারা গেলেন না। ফলে সেই ছেলেটাও আর টাইম মেশিন বানাবার প্রতিজ্ঞাটা করল না। ফলে মেশিনটা আর আবিষ্কার হ’ল না। ফলে সে-ও অতীতে ফিরে এল না।
এইবার যে সমস্যাটা তৈরি হল সেটা এইরকম।
হত্যা --> প্রতিজ্ঞা --> টাইম মেশিন সৃষ্টি --> হত্যা প্রতিরোধ --> প্রতিজ্ঞা করা হল না --> টাইম মেশিন বানানো হল না --> হত্যা আটকানো হল না --> হত্যা।
ব্যাপারটা একটা মাথামুণ্ডুহীন বৃত্তাকারে ঘুরে যাওয়া কেস। এমন সমস্যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে প্যারাডক্স।
আরেকটা প্যারাডক্স দেখঃ
টাইম মেশিনের কারখানার এক ইঞ্জিনিয়ারের মেশিনটা বানাবার সব কায়দা মুখস্থ। সে একবার ঠিক করল অতীতে গিয়ে টাইম মেশিনের আবিষ্কারকের সাথে দেখা করবে। অতএব টাইম মেশিনে চড়ে সে অতীতে গিয়ে আবিষ্কারকের ল্যাবে ঢুকে দেখে সে লোকটা এমন ভুলভাল সব জিনিস করছে যে তার পক্ষে কিছুতেই জিনিসটা আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না।  যেহেতু ইঞ্জিনিয়ার বইতে খুব ভালো করে মেশিন বানাবার কায়দাটা জেনেছে তাই সে সব জানে। সে তখন আবিষ্কারককে ধরে তার ভুলগুলো শুধরে দিয়ে তাকে ঠিকঠাক করে যন্ত্রটা বানাবার কায়দা দেখিয়ে দিয়ে ফের ভবিষ্যতে ফিরে গেল। তারপর সেই আবিষ্কারক সেই জ্ঞান নিয়ে টাইম মেশিন বানিয়ে ফেলল। এখন প্রশ্ন হল, কায়দাটার আবিষ্কারক তাহলে কে? একে বলে বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স।


এ তো গেল টাইম ট্র্যাভেলের একটা সমস্যা। দু’নম্বর সমস্যাটা হল সময়ের চরিত্র। নিউটন যে বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তার মতে সময়ের গতি বদলায় না। বিশ্বজোড়া তা সবসময় একই থাকে এবং একই অভিমুখে চলে। পৃথিবীতেও এক সেকেন্ড যতটা, সিরিয়াস নক্ষত্রেও তাই। সে কখনও পালটায় না। কাজেই কোনও যন্ত্র চেপে তার গতির থেকে বেশি গতিতে ভবিষ্যতের দিকে ধেয়ে যাওয়া বা তার গতির উল্টোমুখে অতীতে ধেয়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে।
এই দ্বিতীয় সমস্যাটার সমাধান ছিল আইনস্টাইনের আবিষ্কারেতাঁর তৈরি আপেক্ষিকতার সমীকরণ একটা নতুন কথা শোনাল। বলল, সময়ের স্রোতের গতি সবজায়গায় এক নয়। বিশাল ভরের বস্তুর কাছে তার গতি পালটে যায় ভরের পরিমাণ অনুসারে। ভর বাড়লে সময় ধীরে চলে। আবার তিনি এ-ও দেখালেন, আলোর গতির যত কাছে তুমি যাবে তত তোমার ভর বাড়বে। এই দুটো জিনিস মেলালে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটবে। ধর তুমি একটা রকেটে চাপলে যেটা আলোর কাছাকাছি গতিতে ছুটছে। তাহলে তখন তার ভর যাবে বেজায় বেড়ে। ফলে তার ভেতরে সময় চলবে আস্তে। ওদিকে বাইরের দুনিয়ায় তো সময় ধেয়ে যাচ্ছে নিজের গতিতে। ফলে রকেট যখন থামবে তখন বাইরের দুনিয়ায় কেটে গেছে একশো বছর কিন্তু তার ভেতরের দুনিয়া এগিয়েছে মাত্রই পাঁচ মিনিট। অর্থাৎ পাঁচ মিনিটে তুমি স্বাভাবিক বিশ্বের একশো বছর পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে চলে গেলে।। অর্থাৎ টাইম ট্র্যাভেল করা গেল।
তবে এ টাইম ট্র্যাভেলও খুব আশ্চর্য বিষয় নয়। এমনিতেই তো আমরা ভবিষ্যতের দিকে চলেছি। কৌশলে সে যাবার গতিটা বাড়িয়ে নেওয়া হল শুধু।
কিন্তু গোডেল নামে এক বিজ্ঞানি কিছুকাল বাদে করলেন কী, আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর একটা অন্য সমাধান বের করলেন। সে সমাধানটা দেখাচ্ছে সময় শুধু তিরের মত একদিকেই এগোয় না, সে মাঝেমধ্যে গোল হয়ে বৃত্তাকারেও ঘোরে। সময়ের নদীতে ঘূর্ণি ওঠে। আর তার মানে হল সেই ঘূর্ণিপথের সন্ধান পেয়ে তাইতে গা ভাসালে তোমার সময় সোজা উলটো দু পথেই চলতে পারে! আর তার মানে অতীতে ফেরাও সম্ভব।
মানছি, অঙ্কে দেখানো গেলেও সে আলোর গতিতে ছোটাছুটি করবার মতন যন্ত্র এখনও বহুদূর অস্ত্‌। কিন্তু তবু, অংক যদি ঠিক হয় তাহলে ওই প্যারাডক্সগুলোর ব্যাখ্যা কী হবে? এই নিয়ে চলল হাজারো চ্যাঁচামেচি। শেষমেষ ১৯৬৩ সালে এসে আরেকখানা মোক্ষম আবিষ্কার ঘটল। রয় কের নামের এক গণিতজ্ঞ আইনস্টাইনের সমীকরণদের আরেকখানা অদ্ভুতুড়ে সমাধান বের করলেন। সে সমাধান কী দেখাল তা বুঝতে গেলে আগে ব্ল্যাক হোল কাকে বলে সেটা জানতে হবে। ব্ল্যাক হোল হল মহাকাশের সবচেয়ে ভারী জিনিস। যখন কোনও বিরাট ভরের তারা মরে যায় তখন তার ভয়ংকর মাধ্যাকর্ষণ তাকে টেনে ছোটো করে ফেলতে থাকে। যতই সে ছোট হয় ততই সে ভয়ংকর ভারী হতে থাকে আর তার চারপাশে স্থান আর সময় এই দুটোকেই সে তুবড়ে দিতে থাকে। তার মধ্যে সময় প্রায় থেমেই আসে একরকম। এই নতুন সমাধানগুলো বলল, ছোটো হতে হতে একসময় একটা বিন্দুতে না বদলে গিয়ে ঘুরন্ত ব্ল্যাকহোলটা একটা ফাঁপা আঙটির মত দেখতে হয়ে যায়তার মধ্যে অসীম ভরের জন্য সময়ের গতি শূন্য, মানে সময় অস্তিত্বহীন, আর, যেহেতু স্থান আর সময় একে অন্যকে জড়িয়ে টিকে থাকে তাই সময় অস্তিত্বহীন হওয়ায় স্থানও অস্তিত্বহীন।
কের-এর সমাধান গণিতের পথে এবারে আরও আজব জিনিস বলল। সে বলল, যেহেতু ওইখানটায় স্থান আর কালের কোন ধর্মই নেই, কাজেই ওর দুটো পাশে, যখন ফের স্থান আর কালের ধর্ম গজিয়ে উঠতে থাকবে তখন সেগুলো একরকমের হবে না। ফলে সেই ফুটোটার দুপাশে যে দুটো বিশ্ব হবে তাদের স্থানকাল, ধর্মটর্ম হয়ে যাবে আলাদা। এই দুই সমান্তরাল দুনিয়ার মধ্যে সেতু হিসেবে থাকবে স্থানকালহীন ওই আঙটির ফুটো। বিজ্ঞানিরা তার নাম রেখেছেন ওয়ার্ম হোল।
এবারে ধরো ওর মধ্যে একটা বিশ্বে সময় হল ২০১৬ সাল, আর অন্যটায় সময় আছে ১১২০ সাল। গর্ত পেরোলেই এ সময় থেকে ও সময়ে যাতায়াত করা যাবে তাহলে।
অথবা একটা বিশ্বে ওর এপাশে জায়গাটা আমেরিকা, আরেকটা বিশ্বে সময়টা একই কিন্তু জায়গাটা আফ্রিকা। গর্ত পেরোলেই এক মুহূর্তে আমেরিকা থেকে আফ্রিকায় চলে গেলে।
আরেকটা, তিন নম্বর সম্ভাবনা আছে এর। সেইটে বলি।
ধরো তুমি এই লেখাটা খুলেছ। এখন তুমি এটা পড়বে বা পড়বে না এই দুটো সম্ভাবনাই আছে। যদি তুমি পড়ো তাহলে হয়ত দেখা গেল তাতে করে তোমার বিজ্ঞানে আগ্রহ এমন বাড়ল যে বড়ো হয়ে তুমি বেজায় বিজ্ঞানী হয়ে গিয়ে টাইম ট্র্যাভেল আবিষ্কার করে ফেললে। সেটা একরকম বিশ্ব। সেখানে টাইম ট্র্যাভেল ঘটে। সেখানে তুমি নোবেল লরিয়েট পদার্থবিদ।
আবার যদি তোমার না পড়ার সম্ভাবনাটা বাস্তবায়িত হয় তাহলে হয়ত তুমি আর বিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে উঠলে না। তুমি হয়ত বড়ো হয়ে জীবনের নানাপথ ঘুরে হয়ে গেলে এক বাঁশিওয়ালা। টাইম ট্র্যাভেলের বিজ্ঞানটাই হয়ত আর তোমার অভাবে আবিষ্কার হল না। সেটা হয়ে যাবে আরেকটা বিশ্ব। আরেকরকম। পোকার গর্তটার (ওয়ার্ম হোলের) দু’ধারে এইরকমভাবে আলাদা দুটো জগতও হতেই পারে।
আর এইটে হলেই প্যারাডক্সগুলোরও একটা সমাধান মিলছে। কীরকম?
ধরো ছেলেটা টাইম মেশিনে চড়ে অতীতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর খুনটা আটকাল।
তখন খুনের মূহূর্তটা থেকে সময়ের ধারা দুটো পথে বইতে থাকবে। একটা পরিচিত, আমাদের বিশ্বের পথ। তাতে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা আটকানো যায়নি। সেটা ঘটেছে ও আমাদের পরিচিত পথে ইতিহাস বইতে থাকছে।
অন্যটায়, ছেলেটার কাজটার ফলে ইন্দিরা গান্ধী বেঁচে রইলেন ও সময় অন্য পথে বইতে লাগল, তৈরি হ’ল আর একটা সমান্তরাল বিশ্ব, যেখানে সময় ও ইতিহাস অন্যখাতে বয়।
এই দুই বিশ্বের প্রত্যেকের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘুরেফিরে ঘুরে চলবে আলাদা আলাদা সময়ের রেখা। প্রতিটা ধারাই আবার আপেক্ষিকতার নিয়ম মেনে কোথাও আস্তে কোথাও জোর চলবে, কোথাও বা আবর্তিত হয়ে চলবে অতীত-ভবিষ্যত-অতীত বৃত্তে। তার কোনটায় সময় ভ্রমণ ঘটবে, কোনটায় ঘটবে না। সেই অসংখ্য সমান্তরাল বিশ্বদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলেছে আংটি চেহারার ব্ল্যাক হোলরা।
তাহলে রাস্তা তো মিলেই গেল। এবারে এমন একটা সমান্তরাল বিশ্বে চলে গেলে কেমন হয়, যেখানে ইস্কুল নেই? সারাবছর ছুটি? যেখানে বড়োরা সর্বদা ছোটোদের নতুন নতুন গেম এর মোবাইল অ্যাপ নামিয়ে দেয় হাসিমুখে?
সেইটে করতে হলে বাকি রইল দুটো কাজ — এক, ওই ওয়ার্ম হোলদের মহাবিশ্বে খুঁজে বের করা আর তার কাছে পৌঁছে তার মধ্যে দিয়ে যাবার যান তৈরি করা। সে যান চালাবার মত ও ওয়ার্ম হোলটাকে ঠিকঠাক রাখবার মত শক্তির উৎস খোঁজা।
দ্বিতীয় কাজটা অবশ্য একটু মুশকিল। অগুণতি ওয়ার্ম হোলগুলোর মধ্যে সেই ওয়ার্ম হোলটাকে খুঁজে বের করা যেটার ওপাশে আছে ঠিক সেই সমান্তরাল বিশ্বটা যেমনটা তুমি চাইছ। ওতে ভুল হলে হয়ত দেখলে এমন একটা সমান্তরাল বিশ্বে ঢুকেছ যেখানে ইস্কুলে পড়তে হয় আশি বছর ধরে, আর ছোটোরা মোবাইল ছুঁলে তাদের বাবারা কানে কেরোসিন তেল দিয়ে দেয়। তখন ভারী বিপদ হয়ে যাবে যে!
আমাদের বিশ্বটা বড়ো আজব জায়গা, তাই না?
_____
ছবিঃ লেখক

2 comments: