বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ
দীপক দাস
এক
“ভাত আর আলুসেদ্ধটা তুলে দাও
তো দিদি।” কাজের পিসিকে শুধু বলেছিল সমুর মা। ব্যস! সমু অমনি সুট করে লুকিয়ে পড়ল। লুকিয়ে
পড়ল মানে একেবারে উবে গেল যেন। খাবার হাতে মা এ ঘর খুঁজল, ও ঘরে গেল। কিন্তু
কোথাও সমু নেই। আজ রবিবার। মা স্কুলে যাবে না। অন্যদিন হলে কাজের পিসিই খাওয়ানোর
জন্য সমুর পেছনে পেছনে ছুটত। কিন্তু ছেলেটা গেল কোথায়? ভয় পেয়ে মা কাজের পিসিকে
ডাকল। খোঁজাখুঁজির খবর পেয়ে ছুটে এল ঠাম্মা, জেম্মাও। বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে পাশের
প্রশান্তদের বাড়ি গেল কাজের পিসি। কিন্তু সমু নেই। পাড়ার ঘরে ঘরে খোঁজ নিল বাড়ির
লোক। কিন্তু সমুকে পাওয়া গেল না। অনেকে পরামর্শ দিল, জগন্নাথ পালের কাছ থেকে জাল
নিয়ে এসে পুকুরে জাল ফেলতে। কেউ একজন বলল, সমুর বাবার অফিসে ফোন করে ওকে চলে আসতে
বলা হোক। এইসব কথা শুনে সমুর মা তখন থরথর করে কাঁপছেন।
পাড়ার ছেলেরা পুকুরে জাল
ফেলার তোড়জোড় করছে। ঠিক সেই সময়েই ইঁদুরের ভয়ে হাঁউমাঁউ করে কাঠের মাচার নিচ থেকে
বেরিয়ে এল সমু। একটা ইঁদুর ওর গায়ের উপর দিয়ে চলে যাওয়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছে। ওখানে
সারা বছরের রান্নার কাঠ জমানো থাকে। সমুদের বিশাল একটা বাগান আছে। সেখান থেকেই আসে
এই কাঠ।
সমুর এটা অবশ্য প্রথম শয়তানি
নয়। এর আগে খাঁচা খুলে টিয়াপাখি ছেড়েছে। উনুনে ওর জন্য নেওয়া দুধ বসানো ছিল। সমু
লুকিয়ে লুকিয়ে তাতে চা পাতা ফেলে দিয়েছে। দুধ চা হয়ে গেলে ওকে আর খেতে হবে না। ঠাম্মা
আর জেম্মা খেয়ে নেবে। ওরা তো চা খেতে ভালোবাসে! তারপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে কার কী
রান্না হয়েছে, ঘোষাল কাকিমা কেন কালো আর ওর জেম্মা কেন ফর্সা সেসব খতিয়ান নেওয়ার
পাকামো তো আছেই।
সব শয়তানির যোগফলে সমুর মা
ঠিক করলেন, ছেলেকে এবার পড়াতে বসাতে হবে। অভ্যাসটা তৈরি করা উচিত। না
হলে ওর শয়তানির সঙ্গে আর পাল্লা দেওয়া যাবে না। আর ওর পড়ার ইচ্ছেটাও তৈরি হবে না।
লুকিয়ে পড়ার সন্ধে থেকেই
ভারতীদেবী সমুর শিক্ষা শুরু করলেন। প্রথমে শ্রুতি শিক্ষা। কাজের
ফাঁকে ফাঁকে সকাল-সন্ধে ‘হাট্টি মাটিম টিম/ তাদের খাড়া দু’টো শিং’, তারপর ‘দাদাভাই চালভাজা খায় ময়না মাছের মুড়ো’,
‘পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল’ ইত্যাদি ছড়াগুলো শেখালেন। পাড়ায় সমুর বয়সি বাচ্চারা অনেকে
ইনফ্যান্টে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সমুর বাবা-মা এত তাড়াতাড়ি ছেলের ওপরে পড়াশোনার
বোঝা চাপাতে চাননি। ওরা বাড়িতেই ছড়া, বর্ণপরিচয়, এবিসিডি শিখিয়ে ঠিক পাঁচবছর বয়স
থেকে স্কুলে পাঠাতে চান।
সেইমতোই
শিক্ষা শুরু হল। সমু দুলে দুলে, হাঁটতে হাঁটতে, খেলতে খেলতে ছড়াগুলো মুখস্থ করল।
ছেলের কতটা মুখস্থ হয়েছে জানতে ভারতীদেবী ‘হাট্টি মাটিম’ বলে থেমে যান। সমু দু’বার
লাফিয়ে নিয়ে বলে, ‘টিম’। তারপর মায়ের শেখানো মতো মাথার দু’পাশে হাতদু’টো নিয়ে গিয়ে শিং
তৈরির অঙ্গভঙ্গি করে বলে, ‘তাদের খাড়া দু’টো শিং’। বাড়িতে কেউ এলে তাঁদের গোটা গোটা
ছড়া শুনিয়ে মুগ্ধ করে দেয় সমু।
ছড়ার
পরে মা বর্ণপরিচয় শুরু করলেন। স্লেটে বড়ো বড়ো করে ‘অ’
লিখে সমুর হাতে পেনসিল ধরিয়ে দিলেন। তারপর পেনসিল ধরা হাতটা হাতেখড়ি দেওয়ার মতো করে ধরে ‘অ’-এর
উপরে বুলিয়ে সুর করে বললেন, “অ লিখ-ও-ও-ও।” বেশ কয়েকবার বুলিয়ে দিতে ‘অ’-টা একটা
গাবদা-গোবদা জিলিপির মতো হয়ে গেল। পাশে আরেকটা ‘অ’ লিখে সমুকে বোলাতে দিলেন
ভারতীদেবী। তখনই সমুর আরেক রূপ প্রকাশ পেল।
সমু
বোলাতে শুরু করল বটে। কিন্তু কখনও ‘অ’-এর লেজের দিক থেকে। কখনও হাতের দিকে। ‘অ’-এর
পেটটাকেও আচ্ছা করে বুলিয়ে দিল। ফলে সেটা হরিণ গেলা অজগরের মতো দেখতে হয়ে গেল।
বোলাতে বোলাতে সমু মুখ দিয়ে ‘কোঁ-কি-কোঁ, না-নি-নো’ এরকম কত আওয়াজ করছিল। কিছুতেই
‘অ লিখো’ বলল না। ভালো করে বোলালোও না।
রান্নার
দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে ভারতীদেবী উঠে পড়লেন। সমুকে শেখাতে এল জেঠুর ছেলে সুজয়। ও
আঁকা শেখে। তাই আঁকার স্টাইলে ‘অ’ শেখানোর চেষ্টা করল। বলল, “এই দ্যাখ ভাই, একটা
লোক কুণ্ডুলি পাকিয়ে সামনের পাদু’টো জড়ো করে তুলে বসে আছে। আর একটা লোক চেয়ার হয়ে
বসার মতো করে ওর গায়ে পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস, অ হয়ে গেল।” সুজয় কুণ্ডুলি
পাকিয়ে পা তুলে বসাটা কেমন সেটা মেঝেয় শুয়ে করেও দেখাল। ভাইয়ের সামনে চেয়ারও হল।
তারপর ভাইকে বলল, “এবার তুই আঁক।”
সমু
প্রথমে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে আঁকল। মানে ‘অ’-এর হাতটাকে। তার ডানদিকে আঁকল
কুণ্ডুলি পাকানো লোকটাকে। মানে একেবারে উল্টো ‘অ’ হল। সুজয় সমুর উল্টো ‘অ’ মুছে
দিল। আবার আঁকতে বলল। এবার সমু কুণ্ডুলি পাকানো লোকটাকে উপুড় করে দিল। চেয়ার হয়ে
দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে উপুড় হয়ে থাকা লোকটার উপরে চাপিয়ে দিল। সুজয় বিরক্ত হয়ে উঠে
পড়ল। ওর স্কুলের পড়া আছে।
পরেরদিনও
সমুর একই রূপ। এরকম পরপর তিনদিন চলল। চারদিনের দিন মা রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে সমুকে কোলে বসিয়ে
জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি অ লেখা শিখতে চাইছ না কেন, সোনা?”
সমু
মায়ের গলা জড়িয়ে বলল, “অ-টা শিখলেই তো তুমি তার পরের আঁকাটা শেখাতে। বইটাতে কত
আঁকা!”
সাড়ে
তিনবছরের ছেলের মুখে এমন কথা শুনে ভারতীদেবী থ হয়ে গেলেন।
দুই
“বড়দা,
এই ক’বছরে গ্রামের রূপই তো বদলে গিয়েছে!” বিস্মিত হন লেখক সৌমেন্দু রায়। একটু থেমে
আবার বলেন, “গ্রামের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা। একটা কিন্ডারগার্টেন দেখলাম আগেরদিন। তার সামনে স্কুলগাড়ি
দাঁড়িয়ে। মায়েরা মাঠে বসে গল্প জুড়েছেন। আমাদের সময়ে কী ছিল!”
কর্মসূত্রে
এখন বিদেশে থাকেন লেখক সৌমেন্দুবাবু। অনেক বছর পরে বাড়ি ফিরেছেন। তাই তাঁর অধ্যাপক
দাদা সকালবেলা ভাইকে গ্রাম দেখাতে বেরিয়েছেন। ছোটোবেলার গল্প করতে করতে তাঁরা
এগোচ্ছেন। মণ্ডলা ছাড়িয়ে বাগপাড়া। তারপর মজুমদারপাড়া। লোকজনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
কুশল বিনিময় চলছে। দত্তপুকুরের কাছে এসে দুই ভাই থমকে দাঁড়ালেন। একটা বাড়ি থেকে
চিৎকার ভেসে আসছে, “তখন থেকে অ লেখা শেখাচ্ছি। কিছুতেই শিকবে নে! খালি
ত্যাঁদড়ামি!” চিৎকার শেষের পরেই দুমদুম আওয়াজ। তারপরেই একটা বাচ্চা ছেলের চিল
চিৎকার।
দাদার
দিকে একবার তাকালেন লেখক। তারপর দু’জনেই মুচকি হেসে ঢুকে পড়লেন সেই বাড়িতে। ঢুকেই দাদা
কোলে তুলে নিলেন বাচ্চাটিকে। সক্কালবেলায় গ্রামের দুই গণ্যমান্যকে উঠোনে দেখে
হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন বাচ্চাটার মা। সেটা বুঝতে পেরে অধ্যাপক বললেন, “ছেলেকে
বর্ণপরিচয় করাচ্ছ। তা মারছ কেন?”
“দেখুন
না দাদা, কত চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই শিকছে নে।”
“শিখবে
শিখবে। সময় হলে ঠিক বই নিয়ে বসে যাবে।”
“আপনি
জানেন না দাদা, ও কীরকম বদমাইশ। শুধু সারা বাড়ি দাপিয়ে বেড়াবে। পাকা পাকা কথা
কইবে। কিন্তু বই নিয়ে বসালেই অন্যরূপ।”
“তুমি
চিন্তা করো না বোন। আমি এমন একজনকে জানি যাকে ছোটবেলায় বর্ণপরিচয় করাতে গিয়ে ওর
মা-দাদার চোখের জলে, নাকের জলে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওরা বাচ্চাটাকে এক ঘা-ও
মারেনি। সেই ছেলেটি এখন বড়ো হয়ে এত অ-আ-ক-খ লেখে যে লোকে পড়ে শেষ করতে পারে না।
তবে বড়োদের কথা না শোনায় সেই বাচ্চাটার একটা মুশকিল হয়েছে। অ-আ ভালো করে বোলায়নি
বলে হাতের লেখাটি বেশ খারাপ। প্রায় বোঝা যায় না। এখন কম্পিউটারের যুগ বলে তার একটু
বাঁচায়ো।”
দাদার
কথা শুনে লেখকভাই হাসতে হাসতে বলেন, “তা যা বলেছ দাদা। অটোগ্রাফ দিতে গেলে সেই
বাচ্চাটা এখন যা লজ্জায় পড়ে না!”
শিশুটির
মা বুঝতে পারেন দু’জনে কার কথা বলছেন। এত বড়ো মানুষ দু’জনে। কিন্তু এখনও শিশুর মতো
সরল। মায়ের ভালো লাগে। তিনি বলেন, “বসুন দাদা। চা বসাই।”
সৌমেন্দুবাবু
বলেন, “চা খেয়েই বেরিয়েছি গো। আজ থাক। আরেকদিন এসে জেনে যাব, তুমি অ লেখা শেখানোর
জন্য ছেলেকে মেরেছ কি না। সেদিন চা খাব, কেমন?”
অধ্যাপক
শিশুটিকে মায়ের কোলে তুলে দেন। চোখে জল নিয়ে এতক্ষণ সে অচেনা দু’জন লোকের কথা
শুনছিল। মায়ের কোলে ফিরে বলে, “বাচ্চাটা কোথায় গো জেঠু? আমার সঙ্গে খেলবে?”
“সেই
বাচ্চাটা?” বলে অধ্যাপক একবার ভাইয়ের দিকে তাকান। তারপর হেসে উঠে বলেন, “ভালো করে
অ-আ শিখে নাও। তাহলেই চিনে যাবে বাচ্চাটাকে। আর চিনে গেলেই অনেক খেলার সঙ্গী পাবে।”
_____
ছবিঃ সুজাতা
চ্যাটার্জী
অসাধারণ স্যার।
ReplyDeleteভাল লাগল আপনার বার্তায়।
Deleteranida
ReplyDeletebes jomeche...
ReplyDeleteভাল লাগল।
ReplyDeleteআচ্ছা।
ReplyDelete