গল্পের ম্যাজিক:: ঠাকুরদার আলখাল্লা - অদিতি ভট্টাচার্য্য

ঠাকুরদার আলখাল্লা
অদিতি ভট্টাচার্য্য

বুড়ো বয়সে মানুষের যে কত উদ্ভট শখ হয় তা ভাবলেও হাসি পায়। শখ না বলে পাগলামিও বলা যেতে পারে। সুদর্শনের তো অন্তত তাই মনে হয়। আরও বেশি করে মনে হচ্ছে সুশোভন মানে ওঁর বড়দার কীর্তি দেখে। গত রবিবার থেকেই। সেদিন সকালে একখানা মিষ্টির বাক্স নিয়ে হঠাৎ সুশোভন এসে হাজিরসুদর্শন আর সুশোভনের পাশাপাশিই বাড়ি। পৈতৃক জমি পেয়েছিলেন, দু’ভাগ করে দু’জনে পাশাপাশি বাড়ি করেছেন। যাতায়াত তাই লেগেই থাকে কিন্তু তাই বলে সাতসকালে হাসি হাসি মুখে মিষ্টির বাক্স নিয়ে আসা! মিষ্টির বাক্স ছাড়া হাতে একখানা বইও রয়েছে অবশ্য।
সুদর্শনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে মিষ্টির বাক্সটা টেবিলের ওপর রেখে আর বইটা ওঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “অবাক হচ্ছিস তো খুব? নে, এটা দেখ, তাহলেই বুঝবি সব।”
একটা শিশু-কিশোরপাঠ্য পত্রিকা, মোটামুটি নামকরা। সেটা দেখে কী বোঝা যাবে সুদর্শন বুঝলেন না তাই বললেন, “এতে কী আছে?”
“আরে বাবা, বইটা খোল না! সূচিপত্রটা দেখ ভালো করে, সব একেবারে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে,” বললেন সুশোভন
অগত্যা খুলতেই হল বইটা। সূচিপত্র দেখে সুদর্শন কিন্তু সত্যিই আশ্চর্য হলেনযত আশ্চর্য মিষ্টির বাক্স হাতে সক্কাল সক্কাল সুশোভনের আগমনে হয়েছেন তার থেকেও বেশিসূচিপত্রে বেশ বড়ো বড়ো করে ভৌতিক গল্প প্রতিযোগিতায় প্রথম তিনে থাকা তিনটি গল্পের নাম রয়েছে। তার মধ্যে এক নম্বর মানে প্রথম পুরস্কার পাওয়া গল্পটির লেখক আর কেউ নয়, স্বয়ং সুশোভন দাশগুপ্ত।
“তুমি আবার গপ্পো-টপ্পো কবে থেকে লিখতে শুরু করলে? এসব দিকে ঝোঁক আছে বলে তো কোনওদিন শুনিনি। এই জন্যেই এত সকালে মিষ্টি নিয়ে চলে এলে!” সুদর্শন বললেন।
“বাহ, এরকম একটা ব্যাপার সেলিব্রেট করতে হবে না? এ যে কোনওদিন ঘটবে তাই কি ভেবেছি কখনও? তোর তো আবার ডায়বিটিস, যেকোনও মিষ্টি কিনে আনলেই তো আর হবে না। তাই হরিমোহন সুইটসে গেলাম তোর জন্যে ডায়বিটিস সন্দেশ আনতে,” সোফার ওপর বেশ আয়েস করে বসতে বসতে বললেন সুশোভন
“ভোরবেলাতেই তুমি সেই হরিমহন সুইটসে ছুটলে? অত দূর?” আজকে যেন সুদর্শনের শুধু আশ্চর্য হওয়ারই দিন।
“সে আর কী করা যাবে? ওদের এই সন্দেশটা ভালো, তুই খাস, তাই গেলাম। কোনও অসুবিধে হয়নি, অটোতে গেলাম এলাম। কী যেন বলছিলিস বেশ? আমার গপ্পো লেখার শখ হল কবে থেকে? আরে ধুর, সেরকম কোনও শখ-টখই নয়। কোনওকালে লিখেছি নাকি? তাছাড়া গপ্পো লেখা কি চাট্টিখানি কথা? ওই দু’একটা পুজোসংখ্যা-টংখ্যা পড়ি – ওই পর্যন্তই। হঠাৎ করে এরকম গপ্পো লিখে ফেলাটাও খুব রহস্যময় ব্যাপার কিন্তু, গপ্পোটাও তাই।”
সুদর্শন ততক্ষণে মিষ্টির বাক্সটা খুলে ফেলেছেন একটা সন্দেশও মুখে পুরে দিয়েছেন সেটা খেয়ে নিয়ে বললেন, “কেন, তোমার গপ্পো লেখাটা রহস্যময় ব্যাপার কেন? আর তোমার গপ্পোটাই বা কী? সেটাও বলে ফেলো। আমার যে অত পড়ার ধৈর্য নেই জানোই তো, তাও আবার এসব ছেলেভুলোনো গপ্পো!”
“শোন তবে। এটা প্রায় মাস চার-পাঁচ আগের ঘটনা। একদিন সকালে খবরের কাগজে দেখি একখানা বই দিয়ে গেছে। এই পত্রিকারই একটা সংখ্যা। তখন একটা নতুন ছেলে সবে কাজে ঢুকেছিল, মানে এই বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ দেওয়ার কাজে। সেই ভুল করে অন্য কোনও বাড়ির বই দিয়ে গেছিল আমাদের বাড়িতে। আমি দু’একবার উলটেপালটে দেখলাম বইটা তারপর রেখে দিলাম পরের দিন ফেরত দেব বলে। তোর বৌদিকেও বললাম, ‘দাগ-টাগ লাগিও না যেন’ ওর আবার রান্নাঘর থেকে এসে খালি এটা ওটা ধরার অভ্যেস। যাই হোক, এই ভৌতিক গল্প প্রতিযোগিতার বিজ্ঞপ্তিটা তখনই দেখেছিলাম। পরের দিন সকালেই আবার ছেলেটা বইটা নিয়ে গেল। এর দিন দুই পরেই হঠাৎ করে পুরনো ট্রাঙ্কটা বেরোল। তোর বৌদি ঘরদোর সব ঝাড়পোঁছ করছিল পয়ালা বৈশাখ আসছে বলে। স্টোররুমের এককোণে রাখা ছিল। ট্রাঙ্কটা জং ধরে গেছে, একখানা তালা আটকানো আবার!”
“তালা আটকানো? জং ধরা ট্রাঙ্কে? কী সম্পত্তি ছিল ওর মধ্যে?” সুদর্শন জিজ্ঞেস করলেন হাসতে হাসতে।
“সম্পত্তিই বটে!” সুশোভনও হেসে ফেললেন, “তালা ভাঙলাম। ভাঙা ছাড়া আর গতি ছিল না, চাবি আছে নাকি? বেরলো একখানা রঙচঙে সিল্কের আলখাল্লা। ওই বড়ো ট্রাঙ্কটাতে ওই একটি মাত্র জিনিসই ছিল!”
“আলখাল্লা? দাদুর নয় তো?” সুদর্শনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, হাসি উধাও।
“তাই মনে হয়। ম্যাজিশিয়ানরা যেরকম পরে। আমার তো মনে হয় এটা সেই আলখাল্লাটাই, বুঝলি? যেটা পরে দাদু সব অদ্ভুত অদ্ভুত ম্যাজিক দেখাত, অদ্ভুত ক্ষমতা হত দাদুর, এমন ম্যাজিক দেখাত যা কেউ দেখেনি
“উফ বড়দা, ওইসব গাঁজাখুরি গপ্পো তুমি এখনও মনে রেখেছ? শুধু মনে রাখোনি, বিশ্বাসও তো করো মনে হচ্ছে,” সুশোভনের কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন সুদর্শন, “যত্তসব বাজে কথা। সকালবেলাই দিলে আমার মেজাজটিকে নষ্ট করে।”
“আরে চটছিস কেন? দাদুর নাম শুনলেই যে তোর মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তা কি আর আমি জানি না? বিলক্ষণ জানি। আমি সে কথা বলছি না। আমি বলছি যে ওই আলখাল্লাটা দেখেই আমার সেইসব কথা মনে এল যেগুলোকে তুই গাঁজাখুরি গপ্পো বলিস। দাদুর সেইসব ম্যাজিকের কথা...”
“ম্যাজিক না ছাই! শুধু লোক ঠকানো! আর লোকজন সেইগুলোকে অতিরঞ্জিত করে ছোটোবেলায় আমাদের বলত। যাক গে, তুমি বলো তারপর।”
“তুই বলতে দিলে তো!” এবার সুশোভন একটু বিরক্ত, “তুই রাগই কর আর যাই কর। ওই আলখাল্লাটা দেখেই আমার সেই গপ্পোগুলো মনে পড়ল আর লেখারও একটা আইডিয়া পেলাম। শুধু ম্যাজিকের বদলে ভূত। কী লিখলাম বল তো? লিখলাম আলখাল্লা পরা একটা লোকের কথা। খুবই অদ্ভুত প্রকৃতির লোক। সে মারা যাবার পর ভূত হয়ে ঘোরাঘুরি করত। লোকে দেখত শুধু আলখাল্লাটাই ঘুরে বেড়াচ্ছে রাতবিরেতে! কী ভয়ংকর ব্যাপার ভাব তো? এই হল আমার গপ্পো। ভালো হয়নি?”
“ভালো তো হয়েছে বটেই না হলে কি আর এমনি এমনিই একেবারে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে? আরও একটা ভালো জিনিস হল, তবুও ওই আলখাল্লাটা থেকে কিছু উপকার হল। না হলে দাদু আর দাদুর ব্যাপারে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো,” সুদর্শন বললেন।
“এবার উঠি, বাজারে যেতে হবে। দেরি হলে আবার তোর বৌদি রাগ করবে,” সুশোভন উঠে পড়লেন।
এরপর কিন্তু ওই আলখাল্লাটা নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গেল। সুদর্শনের দুই ছেলেমেয়ে সুশোভনের বাড়ি থেকে ওটাকে নিয়ে এল। ওটা নাকি অ্যান্টিক জিনিস। এমন কী, সুদর্শনের ছেলে ওটাকে গায়ে চাপিয়েও ফেলল। সুদর্শন তো হাড়ে চটলেন। ধমকে-ধামকে ওটা খোলালেন, তারপর একটা খালি সুটকেসে ভরে চাবি দিয়ে রাখলেন। চাবিটা নিজের কাছেই রাখলেন। এসব আদিখ্যেতা সুদর্শনের একেবারে নাপসন্দ। যত জ্বালা তো ওঁরই। ফেলেও দিতে পারছেন না। হাজার হোক পূর্বপুরুষের জিনিস, ওরকম হুট করে ফেলে দেওয়া যায় না আবার সুশোভনকে ফেরতও দিতে পারছেন না। ওঁর ছেলেমেয়েরা ওখানে গিয়ে ওটাকে নিয়ে পড়বে। নিজেরা পরবেন, আলখাল্লা পরা অবস্থায় নিজেদের ছবি তুলবেন, ঘটা করে সবাইকে জানাবেন যে এই আলখাল্লা দেখেই ওনাদের জেঠুর মাথায় গল্পের প্লট এসেছিল। জেঠু, জেঠিমা যে কিচ্ছু বলবেন না তা বলাই বাহুল্য এই দু’টিকে যে ওঁরা বলতে গেলে চক্ষে হারান।

সত্যি কথা বলতে গেলে নিজের ঠাকুরদা মানুষটিকে সুদর্শন মোটে পছন্দ করেন না। ঠাকুরদা তো কবেই মারা গেছেন কিন্তু সুদর্শনের অপছন্দটা বিন্দুমাত্র কমেনি। খুব একটা দোষও অবশ্য দেওয়া যায় না সুদর্শনকে এই জন্যে। ঠাকুরদা ঠিক সংসারী লোক ছিলেন না। বিয়ে থা করেছিলেন, ছেলেপিলে ছিল – কিন্তু সেদিকে ভদ্রলোকের কোনও মনোযোগ ছিল না। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যেতেন। জাদু শিখতে নাকি। একবার কোন আদিবাসী পল্লীতে অবধি গিয়ে থেকেছিলেন ভানুমতীর খেলের গুপ্তবিদ্যে শিখবেন বলে। চাকরি একটা করতেন বটে, কিন্তু এই হঠাৎ হঠাৎ উধাও হওয়ার জন্যে সেটাকে খোয়াতে হয়েছিল। ওঁর অবিশ্যি বিশেষ ভ্রূক্ষেপ ছিল না তাতে। ঠাকুমা অনেক কষ্টে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছিলেন। পরের দিকে এদিক ওদিক হুট-হাট চলে যাওয়াটা অনেক কমেছিল ঠিকই, কিন্তু ওই জাদুর ভূত মাথা থেকে নামেনি। কোনও কাজকর্মের ধার ধারতেন না একখানা ঢিলেঢোলা আলখাল্লা পরে রাস্তার মোড়ে ছেলেপিলেদের ম্যাজিক দেখাতেন। বাঁচেননি বেশিদিন। শরীরের ওপর অত্যাচার কম করেননি শরীরও তাই অকালেই কাজে জবাব দিয়েছিল।
ঠাকুরদার কথা তাই সুদর্শন এড়িয়েই যান আজ একা বাড়িতে বসে সব মনে এল। আসলে গত এক সপ্তাহ ধরে যা হচ্ছে! আজ রবিবার, সুদর্শন একাই আছেন। সুদর্শনের এক আত্মীয়র মেয়ের বিয়ে ছিল পরশুদিন। সুদর্শনও গেছিলেন সেদিন, অফিসে ছুটি নিয়েই। কিন্তু আজ রবিবার হলেও বৌভাতে গেলেন না। ছেলের বাড়ি অনেক দূরে, নেমতন্ন তাই দুপুরবেলাতেই। সুদর্শনের কোমরের ব্যথাটা ভালোই চাগাড় দিয়েছে। অতটা রাস্তা বাসে গেলে আরও বাড়তে পারে। সামনের সপ্তাহে অফিস কামাই করা যাবে না কিছুতেই, কাজের চাপ খুব। তাই ‘তোমরা ঘুরে এসো, আমি থাকি’ বলে রয়ে গেছেন। বাজার-টাজার গতকাল সেরে ফেলেছেন রান্নাবান্নাও করা আছে, শুধু গরম করে নিলেই হবে। না গিয়ে ভালোই হয়েছে দিব্বি আয়েস করে একটা দিন কাটানো যাবে।
বাড়ির কাছের দোকানটা থেকে পান কিনে এনে রেখেছিলেন। খাওয়ার পর সেটা চিবোতে চিবোতে নতুন কেনা মোবাইল ফোনটা নিয়ে পড়লেন। শুধু ফোন তো আর নয়, ফোন ছাড়া আরও কত কিছু যে করা যায়! ছেলেমেয়ের পাল্লায় পড়ে ফেসবুকে একখানা অ্যাকাউন্টও খুলতে হয়েছে। মাঝেমাঝে আজকাল যান ফেসবুকে। সেখানে যা সেলফি পোস্ট করার হিড়িক! আজ কী হল কে জানে, সুদর্শনেরও সেলফি তোলার শখ হল। সেদিন ওঁর ছেলে ওই আলখাল্লাটা পড়ে সেলফি তুলতে চাইছিল সুদর্শন এক ধমকে সেটাকে খুলিয়েছিলেন বেচারার আর আলখাল্লা পরে সেলফি তোলা হয়নি। আজ কিন্তু সুদর্শনের নিজেরই ইচ্ছে হল আলখাল্লা পরে সেলফি তোলার। এই ভালো সময়, কেউ বাড়িতে নেই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আলমারির মাথা থেকে সুটকেসটা পেড়ে আলখাল্লাটা বার করলেন। সিল্কের, রঙচঙে। জায়গায় জায়গায় ছিঁড়েও গেছে। পায়ের কাছে, পিঠের দিকে। তা হোক গে, সেলফিতে ওসব কিছুই দেখা যাবে না।
আলখাল্লাটা পরে তো সুদর্শন অবাক। এ তো মনে হচ্ছে একেবারে ওঁর মাপে মাপেই করা! আয়নায় নিজেকে দেখে একটু চমকালেনও। ঠাকুরদার মতো লাগছে না অনেকটা? আত্মীয়স্বজনরা অবশ্য বলে যে সুদর্শনের সঙ্গে ওঁর ঠাকুরদার মুখের মিল প্রবল। শুধু তাই নয়, ঠাকুরদা বেশ লম্বা ছিলেন। সুদর্শনের দুই দাদা কেউই লম্বা নন তেমন, লম্বা সুদর্শনভালো হাইট ওঁরএসব শুনলে অবশ্য সুদর্শন চটে যান। আজ কিন্তু খারাপ লাগল না। ভালো করে চুল আঁচড়ালেন, চশমা ঠিক করলেন তারপর ফটাফট ক’টা সেলফি তুললেন। বাহ, বেশ ভালো হয়েছে তো! ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরাটাও বেশ ভালো। এক্ষুণি আর ফেসবুকে আপলোড করে কাজ নেই অবশ্য পরে আপলোড করলেও সমস্যা আছে ছেলেমেয়েরা দেখতে পেলে ঝামেলা হবে। যাক গে, তোলার ইচ্ছে হয়েছে তুলেছেন। কী করবেন ফটোগুলো নিয়ে সে পরে ভাবলেও চলবে। ভাতটা বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে, বড্ড ঘুম পাচ্ছে। ছুটির দিনের ভাতঘুমটা কোনওভাবেই ছাড়া যায় না। আলখাল্লাটা খুলে আবার সুটকেসে পুরে শুয়ে পড়লেন সুদর্শন

এত আওয়াজ কীসের? কলিং বেলের? না, শুধু কলিং বেল তো নয়, ফোনও তো বাজছে। মোবাইল, ল্যাণ্ডলাইন দুটোই! দুমদুম করে শব্দ হচ্ছে, কেউ দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে? সুদর্শন বেশ কষ্ট করেই চোখ খুললেন। এত অন্ধকার কেন ঘর? সন্ধ্যে হয়ে গেছে? এতক্ষণ ঘুমোচ্ছেন নাকি উনি? মোবাইলটা বিছানাতেই ছিল। বড়দার নম্বর। ওদিকে কলিং বেল বেজেই যাচ্ছে ছেলেমেয়ের গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে, ‘বাবা বাবা’ বলে তারা দুজন পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। সুদর্শন বিছানা থেকে উঠলেন সারা গায়ে এত ব্যথা কেন? কপালটার একদিকটা এত জ্বালা-জ্বালাই বা করছে কেন? যাক গে, এখন আগে দরজাটা খোলা দরকার। ওরা মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করছে। কোনওমতে ঘরের আলোটা জ্বেলেই সুদর্শন ছুটলেন সদর দরজাটা খুলতে।
দরজা খুলতেই একগাদা প্রশ্ন উড়ে এল ওঁর দিকে।
“কী গো, এত ঘুমিয়ে পড়েছিলে? এদিকে তো এক কাণ্ড করে বসে আছ!”
“সাংঘাতিক সাহস বাবা তোমার! ওইগুলোর সঙ্গে লাগতে গেলে!”
“না না, খারাপ কিচ্ছু করিসনি বরং ভালো কাজই করেছিস। লোকের উপকারই হয়েছে। কিন্তু যদি বেশি কিছু হতো তোর? চোখমুখের অবস্থা দেখেছিস? কপালটা তো কেটেছে, ওষুধও লাগাসনি?”
দরজার বাইরে যে শুধু সুদর্শনের স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, বড়দা, বৌদি দাঁড়িয়ে তা নয়, পাড়ার কিছু মানুষও আছেন। ছোটোখাটো একটা ভিড়ই জমে গেছে বলতে গেলে বাড়ির সামনে।
“তখনই সুদর্শনদাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বললাম, কিন্তু উনি শুনলেনই না। কিছু হবে না বলে হনহন করে চলে এলেন। আমরা ভাবলাম বিশ্রাম করছেন, তাই আর বিরক্ত করিনি। নইলে সবাই তো ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। এত বড়ো খবরটা যাতে কালকের কাগজে বেরোয় আমরা সে চেষ্টাও করছি,” ওখানে উপস্থিত একজন বললেন, সুদর্শনদের পাড়ারই বাসিন্দা।
সুদর্শনের মনে হল উনি স্বপ্ন দেখছেন কারণ, এদের কথার বিন্দুবিসর্গ উনি বুঝতে পারছেন না। উনি তো দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন এই যা। সারা গায়ে ব্যথা হল কী করে আর কপালটা জ্বালা জ্বালা করছে কেন সেটা বুঝতে পারছেন না ঠিকই, কিন্তু এরা যা বলছে তা আরও বেশি হেঁয়ালি। সুদর্শন দরজার কাছ থেকে সরে এসে সোফায় বসে পড়লেন। নাহ, শরীরটা যেন কেমন লাগছে, মনে হচ্ছে যেন খুব ধকল গেছে।
“কী রে, তুই তো মনে হচ্ছে কিচ্ছু জানিস না এমন করে তাকাচ্ছিস,” সুশোভন বললেন।
“আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না কী বলছ তোমরাআমি তো খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছিলাম,” সুদর্শনের গলাটাও ক্ষীণ শোনাল।
এবার সুশোভনরাই সবাই আশ্চর্য হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকালেন। বলে কী এ!
“এদিকে আমরা চৌমাথার কাছে আসতেই লোকে ছেঁকে ধরে তোর কাণ্ডকারখানা বলল। আলখাল্লা পরে তোকে নাকি একেবারে অন্যরকম লাগছিল। এই কীর্তি যে তুই করবি তা কে জানত বাবা!” বললেন সুশোভন
“আলখাল্লা!” সুদর্শন চমকালেন।
আলখাল্লাটা তিনি পরেছিলেন ঠিকই কিন্তু সে তো সেলফি তোলার জন্যে। তোলা হয়ে গেলে সেটা খুলে আবার সুটকেসে পুরে রেখে দিয়েছিলেন – সেটা খুব ভালোই মনে আছে ওঁরতাছাড়া এসব কিছু হয়েছে বাড়ির ভেতর বাইরের লোক দেখল কী করে ওঁকে আলখাল্লা পরা অবস্থায়! বাড়ির বাইরে যাওয়া দূরের কথা উনি তো শোওয়ার ঘরের বাইরেই যাননি আলখাল্লা পরে। তাছাড়া কাণ্ডকারখানাই বা কী করলেন? কীসব বলছিল না পাড়ার লোকজন, আগামী কালের খবরের কাগজে যাতে বেরোয় তার চেষ্টা করছে? এসব কী ব্যাপার?
সুদর্শনের বিমূঢ় অবস্থা দেখে সুশোভনই সব খুলে বললেন।
ওঁদের বাড়ি রেল স্টেশনের কাছেই। রেল লাইনের ওপারে একটা বস্তি আছে। বস্তির লাগোয়া শিব মন্দির। সম্প্রতি সেখানে এক বাবাজী মাঝে মাঝে উপস্থিত হচ্ছিলেন মানুষকে ধর্মের বাণী শোনাতে। থাকেন অন্যত্র, এখানে আসেন সপ্তাহে দু’তিনদিন। বেশ ভালোই জমিয়ে বসেছিলেন। বাবাজীর কথামৃত শোনার লোকের অভাব নেই লোকের মঙ্গল কামনায় পুজো-আচ্চা, যাগযজ্ঞও করেন তাতে নাকি অনেকের প্রভূত উপকার হয়েছে। বাবাজীর অনেক অলৌকিক ক্ষমতাও আছে। শূন্য থেকে মিষ্টি এনে কাউকে খেতে দিচ্ছেন তো কাউকে হঠাৎ করেই মুঠোভর্তি সুগন্ধী ফুল দিচ্ছেন মন্ত্রপূত করে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইদানীং বাবাজীর দর্শনার্থীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছিল। মাঝে মাঝেই মন্দিরের পাশের মাঠে শামিয়ানা খাটাতে হচ্ছিল। বাবাজীর প্রণামীর পরিমাণও যে দিন কে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা তো বলাই বাহুল্য।
আজকে দুপুরেও মাঠে শামিয়ানা খাটিয়ে যজ্ঞ হচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে সুদর্শনের আগমন। আলখাল্লা পরে যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই নাকি সবাই হাঁ করে দেখছিল। মাঠে গিয়ে সুদর্শন রীতিমতো ভেলকি দেখাতে শুরু করলেন। হাওয়া থেকে মিষ্টি, ফুল উনিও আনলেন, এনে বাবাজী আর তার চেলাদেরই দিলেন বাবাজীর গলার মোটা মোটা দুটো সোনার হার বাবাজীর গলা থেকে আপনা আপনিই খুলে এসে হাওয়ায় ঝুলতে লাগল! সুদর্শনের শুধু হাত চলছিল না, মুখও চলছিল সমান তালে। বাবাজী যে কত বড়ো ভণ্ড সে কথা বলছিলেন। অলৌকিক ক্ষমতা বলে যা চালানো হয় তা যে আসলে জাদু ছাড়া আর কিছুই নয় সে কথা বোঝাচ্ছিলেন উপস্থিত জনতাকে, বাবাজীর সব কারসাজির পর্দা ফাঁস করছিলেন। সুদর্শনের এই কীর্তিতে বাবাজীর প্রতি অনেক লোকেরই সন্দেহ জন্মাল তাছাড়া সুদর্শন ওখানকার পরিচিত মুখ লোকে ওঁকে অবিশ্বাস করার আগে দু’বার ভাববে। তবে বাবাজীর চেলা-চামুণ্ডার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তারা কি আর অত সহজে ছেড়ে দেয়? ফলে সুদর্শনকে মারধোরও খেতে হয়েছে প্রথমটা সুদর্শনের হয়ে কেউ এগোয়নি যজ্ঞস্থলে পোঁতা একটা বড়ো ত্রিশূল উপড়ে নিয়ে নিজেই আত্মরক্ষা করেছেন। পরে অবশ্য অনেকে এগিয়ে এসেছিল এবং পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল।
বাবাজীর নকল গোঁফদাড়ি খুলে ফেলতে যে মুখটা বেরোল সেটা দেখে পুলিশও অবাক। এনাকে অনেকদিন ধরেই খোঁজা হচ্ছে। ইনি একেক জায়গায় যান, একেক রকম ভেক ধরেন, অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করে লোকের টাকাকড়ি, গয়নাগাটি হাতান, তারপর সেখান থেকে কেটে পড়েন। এই এনার পেশা, এনার ব্যবসা।
“ত্রিশূল হাতে আলখাল্লা পরে তোমাকেও নাকি একদম রাগী রাগী সন্ন্যাসীর মতো লাগছিল বাবা, সব্বাই বলছে,” সুদর্শনের মেয়ে বলল।
সুদর্শন কটমট করে মেয়ের দিকে তাকালেন। একে তো এই উদ্ভট ঘটনার কোনও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছেন না, তার ওপর এই বিচ্ছিরি তুলনা।
“অনেকে ফটো তুলেছে, দেখতে হবে। ইশ! বৌভাতে না গেলেই হত, এত বড়ো ঘটনাটা মিস করলাম,” মেয়ে বলেই যাচ্ছে।
সুদর্শনের ছেলে ইতিমধ্যে ঘরে গেছিল ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, “এ কী! আলখাল্লাটার এ কী দশা! এ তো একেবারে ছিঁড়ে গেছে।”
সবাই ঘরে গেলেন। সুদর্শনও। সত্যি আলখাল্লাটার একেবারে জীর্ণদশা। সুদর্শন আলমারির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সুটকেসটা আলমারির মাথাতেই রয়েছে। ওঁর খুব ভালো মনে আছে সেলফি তোলা হয়ে গেলে উনি আলখাল্লাটা খুলে সুটকেসে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। তাহলে? আবার এতগুলো লোকও তো আর মিথ্যে কথা বলতে পারে না। কপালটাই বা কাটল কী করে?
“পুরনো জিনিস, মারামারি টানাটানিতে ছিঁড়ে গেছে। এ আর রাখা যাবে না,” সুদর্শনের স্ত্রী বললেন।
“তুই এই আলখাল্লাটা পরলি এটাই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। দাদুর নাম শুনলেই তো চটে যেতিস। আর এসব ম্যাজিক-ট্যাজিকই বা শিখলি কবে? যদিও শুনি ওসব খুব সাধারণ হাতসাফাইয়ের ব্যাপার, ভণ্ডরা লোক ঠকানোর জন্যে করে, কিন্তু সেসবও তো তুই জানিস দেখছি। যাই বল বাবা, সে তুই রাগই কর, তোর সঙ্গেই দাদুর মিল সবচেয়ে বেশিওসব ম্যাজিক-ট্যাজিক তোরও রক্তে আছে। আজ তো তার প্রমাণই পাওয়া গেল,” বললেন সুশোভন।
সুদর্শন গম্ভীর মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন কিচ্ছু বললেন না। বুঝলে তো বলবেন!
-------
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

4 comments: