অনুবাদ গল্প:: আশ্চর্য সুন্দর - সিসিলিয়া ব্যুচাট (চিলি) :: অনুবাদঃ শর্বরী গরাই


আশ্চর্য সুন্দর
মূল গল্প: Una verdadera maravilla ।। লেখক: Cecilia Beuchat (Chile)
ভাষান্তর: শর্বরী গরাই

সে বছর বসন্ত এসেছিল অন্যান্য বছরগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে, খুব তাড়াতাড়িই গাছপালা, মাঠঘাট আর বাগানগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল
বৃষ্টি আর ঠান্ডার একঘেয়ে ঋতুগুলোর পর এই সময়টা ছোট্ট ছোট্ট জিনিদের খুব প্রিয় পেছনে পড়ে রইল শীতের অন্ধকার দিনগুলো, ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজেদের কাজে, মৌমাছি আর পাখিদের খবর দিতে হবে যে বসন্ত এসে গেছে, নেমন্তন্ন করতে হবে ভোমরাদের, বাতাসে খবর পাঠাতে হবে হামিংবার্ডদের এরকম আরও অনেককে, যারা ফুলেদের হারিয়ে যেতে দেবে না, সাহায্য করবে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসতে
সুন্দর এক বাগানের কাছেই ছিল একটা সূর্যমুখীর গাছ আর সেখানে থাকত সূর্যমুখীর জিনিদের এক পরিবার ফুলটার বিশাল মাঝখানটা ঝকমক করত, চারিপাশ ঘেরা হলুদ পাপড়ির মুকুট দিয়ে
সূর্যমুখীর জিনি পরিবার ওখানে বাস করার জন্য গর্বিত ছিল, আর সেটা অকারণে নয় যে বাড়িটায় ওরা থাকত, মানে সূর্যমুখী ফুলটার পুরোটাই ছিল দেখার মতো, বড়ো বড়ো শিল্পীরা তাঁদের ক্যানভাসে ওর ছবি এঁকেছেন সূর্য, যে কিনা এই পরিবারের পুরোনো বন্ধু, সেও বলেছে সূর্যমুখী নাকি অ্যাজটেকদের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক ছিল
এইসব কথা শুনতে জিনিদের খুব ভালো লাগত ওদের গর্ব হত কারণ প্রতিবছর ওরা যত্ন করে যে বীজগুলোকে তৈরি হতে সাহায্য করত, তারা পাখিদের খাবার জোগাত, গরুরাও ওই বীজ খেলে অনেক বেশি দুধ দিত কিছুদিন আগে ওরা জেনেছে মানুষেরাও নাকি ওই বীজ দিয়ে বিশেষ ধরণের কিছু তেল বানায়
সবাই খুব খুশি ছিল, শুধু সব্বার ছোটো জিনি সূর্যমুখী ছাড়া এইরকম একটা ফুলের মধ্যে থাকতে ওর ভয় করত সারাদিন এই নিয়ে বকবক করলেও, সবার সামনে এসব বলতে তার ভয় করত, পাছে বাবা-জিনি খুব রেগে যায়
যখন সে বাড়ির কাছেই গুবরে পোকা পরিবারের তৈরি ফুলেদের স্কুলে ভর্তি হল, প্রাণপণ চেষ্টা করত যাতে কোথায় থাকে সেটা কেউ জানতে না পারে, কক্ষনো কাউকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করত না, অন্য জিনিরা ডাকলে তাদের বাড়িতেও যেত না
ইস, যদি আমরা অন্য একটা ফুলে থাকতাম!” এটাতে অনেক বেশি পাপড়ি, এর মাঝখানটা এত এবড়োখেবড়ো যে রোঁয়া উঠে যায় আর ওর পাতলা ডানাদুটোয় ঘষা লাগে তাছাড়া ফুলটা লম্বা আর কাঁটাওলা, আর সেটা বেয়েই প্রতিদিন সকালে স্কুলে যাবার জন্য ওকে নামতে হয়, সেটা তো বলেইনি
রোজ রোজ ছোটো মেয়ের একই অভিযোগ শুনতে শুনতে বাবা-জিনি একদিন ধৈর্য হারিয়ে ফেলল
“ঠিক আছে, বলল বাবা-জিনি, “আমরা আর একটা ফুল খুঁজব, হয়তো তুমি ঠিকই বলছ কোন ফুলে তুমি থাকতে চাও, সেটা তুমিই আমাকে বলবে
মা-জিনি বলল, “সেই ভালো আমাদের বাপ-ঠাকুরদারা সবসময় সূর্যমুখী ফুলেই থেকেছে, এটা বদলানোর সময় এসেছে
এভাবেই, ছোট্ট জিনি এতদিন ধরে যারা ওকে নেমন্তন্ন করে এসেছে, তাদের সবার বাড়ি যাবে ঠিক করল
প্রথমে সে গেল গোলাপ কুঁড়ির জিনিদের বাড়ি এই জিনিটা খুব ভালো, থাকত পুরোটাই লাল রঙের, খুব নরম ভেলভেটের মতো পাপড়িতে মোড়া খুব সুন্দর একটা গোলাপ কুঁড়ির মধ্যে সূর্যমুখীর ছোট্ট জিনি হাঁ হয়ে গেল জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর কিন্তু যখনই সেই ভেলভেটের মতো পাপড়িগুলো ছুঁতে গেল, গোলাপ কুঁড়ির মা-জিনি সাবধান করে দিল, “দেখে, ওগুলোকে নষ্ট করে দিও না
খুব তাড়াতাড়িই সূর্যমুখীর ছোট্ট জিনি বুঝে গেল, এখানে থেকে কোনো মজা নেই ফুলের ডাঁটি বরাবর স্লিপ খেতে গেলে কাঁটার খোঁচা লাগার ভয় থাকে ছোট্ট জিনিরা আধবোজা পাপড়ি খুলে খুলে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গেলে গোলাপ কুঁড়ির বাবা-জিনি অধৈর্য হয়ে একেবারে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, “সাবধান, ফুলের গন্ধ উড়ে যাবে গোলাপ কুঁড়ির ছোট্ট জিনি ওখানে আনন্দে ছিল, কিন্তু সূর্যমুখীর ছোট্ট জিনি অন্য বন্ধুদের কাছে যেতে চাইল
এরপর সে গেল নীল হাইড্রাঞ্জিয়া ফুলের জিনির কাছে সে তো তক্ষুনি ওকে শনি রবি দু’দিনের জন্যই নেমন্তন্ন করে ফেলল সূর্যমুখীর ছোট্ট জিনির খুব ভালো লাগল কুট্টি কুট্টি ফুল দিয়ে গড়ে ওঠা তার বন্ধুর বাড়িটা কিন্তু সেখানেও এক সমস্যা রাতের বেলায় একেকজন একেকটা ফুলে ঘুমাতে গেল সূর্যমুখীর ছোট্ট জিনির নিজেকে কেমন একা একা মনে হচ্ছিল
কয়েকদিন পর সে ড্যান্ডিলায়ন ফুলের মধু খাওয়ার ডাক পেল ড্যান্ডিলায়ন ফুলের ছোট্ট জিনির কাছ থেকে, যে কিনা ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল ছাত্রী
ওখানে পৌঁছে মনে হল সে যেন এতদিনে নিজের স্বপ্নের ঘর খুঁজে পেয়েছে, কিন্তু যখনই দমকা হাওয়া বইল আর সবাইকে নিজের নিজের প্যারাশ্যুট খুলতে হল অন্য আর একটা ফুলের খোঁজে উড়ে যাবার জন্য, তার মত বদলে গেল
“সব সময় এই এক ঝামেলা,” বলল ড্যান্ডিলায়ন ফুলের মা-জিনি, তাও ভালো যে বছরের কিছুটা সময়েই এটা হয়
পরের সপ্তাহে ছোট্ট জিনি ঠিক করল সে তার ক্লাসের সবচেয়ে শান্ত, চুপচাপ মেয়ে ‘ফরগেট মি নট’ ফুলের জিনির বাড়ি যাবে ওদের বাড়িটা খুব সুন্দর কিন্তু বড্ড ছোটো ওরা বেশ গাদাগাদি করে থাকে, আর ওর নিজের পরিবারের মতো অত বড়ো পরিবার এতে আঁটবেই না
একটা ঠিকঠাক বাড়ি খুঁজে পাওয়া কত ঝামেলার! সব বাড়িই সুন্দর, সেখানকার বাসিন্দাদের দেখেও সুখীই মনে হয়, তাও ছোট্ট জিনি একটা না একটাকিন্তুদেখতে পায় পিটুনিয়ারা খুব চ্যাটচেটে, লিলিরা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, ম্যাডোনা লিলিতে সে পিছলে যাচ্ছিল, ভায়োলেটরা প্রায় অন্ধকার, সবসময়ই কোনো না কোনো সমস্যা
তার বাবা মেয়েকে প্রতিদিন বেরোতে দেখে একটু চিন্তায় ছিলেন একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, কী ঠিক করল ছোট্ট জিনি হতাশ হয়ে বলল, “কোনো উপায় নেই, আমাকে চিরটাকাল এখানেই থাকতে হবে
মা-জিনি কথার মাঝেই বলে উঠল, “সে ঠিক আছে, কিন্তু আমার মনে হয়, এবার তোমার পালা সব বন্ধুদের বাড়িতে ডাকার ওরা তোমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছে
ছোট্ট জিনি নাক চুলকাতে লাগল কী ভাববে ওর বন্ধুরা!
মা-জিনি ওর বন্ধুদের জন্য ফুলের রেণু দিয়ে সুস্বাদু স্যুপ বানাতে বসল অতএব ওদের বাড়িতে ডাকা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না
বন্ধুরা সানন্দে রাজি হল এবং সেই বিকেলে সবাই মিলে ওর বাড়িতে বেড়াতে এল ছোট্ট জিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল, যখন দেখল ওর বাবা সব বন্ধুদের স্বাগত জানাচ্ছে, খুব বিনীতভাবে তাদের সাহায্য করছে ফুলের ওপর নেমে আসতে সে ওদের সতর্ক করে দিল, “এটা একটু এবড়োখেবড়ো”, কিন্তু ওর বন্ধুরা পাত্তাই দিল না মা-জিনি সবাইকে স্যুপ খেতে দিল, নিমেষের মধ্যে সব চেটেপুটে সাফ তারপর শুরু হল লুকোচুরি খেলা
খুব খুশি হয়ে গোলাপকুঁড়ির জিনি বলল, “এই বাড়িতে লুকোচুরি খেলতে খুব মজা
ড্যান্ডিলায়ন জিনি বলল, “আমার তো পাপড়ি থেকে পাপড়িতে লাফাতে খুব ভালো লাগছে
তারপর যখন সবাই ভাবল অন্ধকার হয়ে আসছে, এবার খেলা বন্ধ করতে হবে, তখন সেই ঘটনাটা ঘটল, যেটা রোজ ঘটে বাবা-জিনি ওপর দিকে তাকাল, আর খুব আস্তে আস্তে গোটা ফুলটা সূর্যের দিকে ঘুরে গেল
“আমরা খেলা চালিয়ে যেতে পারব, সবাই খুব খুশি হয়ে বলল, “সত্যিই তোর ফুলটা অসাধারণ
বন্ধুরা অনেক দেরিতে বিদায় নিল, আর বাড়ি ফেরার আগে সবাই ছোট্ট জিনিকে এমন মজার একটা বিকেল উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ জানাল
ওরা অনুরোধ করল, “আমাদের মাঝে মাঝেই নেমন্তন্ন করিস এখানে, তোর এই বাড়িতে সন্ধ্যা পর্যন্ত খেলা যায়, কারও কোনো ক্ষতি হওয়ার ভয় থেকে না ছোট্ট জিনি খুব খুশি হল, আর বুঝতে পারল, এমন একটা আশ্চর্য ফুলে বাস করা সত্যিই এক অসাধারণ ব্যাপার
----------
ছবি - আন্তর্জাল

2 comments:

  1. কী অপূর্ব অনুবাদ, গল্পটাও ভীষণ মিষ্টি। দুর্দান্ত লাগল। এই লেখিকার অনুবাদের আমি ফ্যান 😍😍

    ReplyDelete
  2. ভীষণ মিষ্টি গল্প। তেমনি চমৎকার অনুবাদ!

    ReplyDelete