গল্প:: লাটুর দাদামশাই - সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়


লাটুর দাদামশাই
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়

লাটুদের বাড়িটা দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন একটা টোপর লাটু বলে জঙ্গলের মধ্যে দূর থেকে যাতে দেখা যায় সে জন্য অমন সাদা রং করা
কিন্তু ওরকম গোল গম্বুজের মতো গড়ন কেন?
ওরকম বাড়ি আমার দাদামশাই সাগরপারে দেখে এসেছিল যে কোনো কোনাচ নেই দেয়ালে এক্কেবারে গোল গম্বুজ সমুদ্রের ধারে অমনধারা গোল বাড়ি হয় সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়লেও গোটা বাড়িতে তার আঘাত লাগে না,লাটু বুঝিয়ে দেয়
বিল্টুর অবাক লাগে ভালোও লাগে বিজ্ঞানভিত্তিক ডিজাইনের বাড়ি তার মানে
স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে লাটু একদম মেশে না একমাত্র বিল্টুই ব্যতিক্রম লাটু বলে বিল্টুকে দেখলেই বোঝা যায় বদমানুষ হবে না কখনও বদমানুষে ভারী ভয় লাটুর তবে বিল্টুর মনে হয় লাটু কাউকে ওদের বাড়ি দেখাতে চায় না বিল্টুকেও কি পুরো দেখায়? ওই দূর থেকেই যা এক এক দিন খেলতে খেলতে যদি বাড়ির কাছে চলেও গেছে তো লাটু চেঁচায়, “ওদিকে যেও না বিল্টু, দাদামশাই ঘুমোচ্ছেন এখন
কখনও লাটুর মা বেরিয়ে আসেন বাড়ি থেকে হাতে একটা ঝুড়ি আর গামছা লাটুকে ডেকে বলেন, “যা লাটু, নদী থেকে অল্প চারটি মাছ ধরে আন দেখিস, বেশি ধরিস নে যতটা পেটে আঁটে তার চেয়ে বেশি প্রকৃতির কাছ থেকে নিতে নেই
বিল্টু কয়েকবার নদীতে গেছে লাটুর সঙ্গে নদী আর কী! বড়ো বড়ো পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জল এদিকটা আসলে শাখা মূল নদীটা জঙ্গলকে পাশে রেখে চলে গেছে সাগরে মিশতে
লাটু গামছা ফেলে মাছ ধরে ছোটো ছোটো হরেকরকম মাছ বিল্টুদের বাড়িতে জগু কাহার যেমন বড়ো মাছ আনে তেমন না লাটু বলে মরা মাছ খেলে মাছের মৃত্যুর কারণটা যে খেয়েছে তার গায়ে লেগে যায় বিল্টু ফাগুয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল সত্যি কিনা ফাগুয়া শুকনো পাতা সাফ করছিল বাগানে বলল,সে যদি বল বেল্টুদাদা, এই যে পাতাগুলো শুকিয়ে পড়েছে, এদের মরণ তো কালের নিয়মে হল সব মেত্যুই কালের নিয়মেই হয়তারপর আবার একটু ভেবে বলল,তবে হ্যাঁ, কোনো মাছ যদি রোগে মরে তো সেই মাছ খেলে তোমারও সে রোগ হতে পারে
ফাগুয়া সব নাম ভুলভাল বলে বিল্টুকে বেল্টু, লাটুকে নাটু তবে সে লাটুকে খুব পছন্দ করে বলে, নাটুদাদার জীবজন্তুতে মায়া আছে বেল্টুদাদা ওরকম মানুষদের বিপদ হয় না কোথাও ভগবান কোনো না কোনো জন্তুর রূপ ধরে এসে বাঁচিয়ে দেন
বিল্টু লাটুকে বলেছিল কথা লাটু হেসে বলল, “সে ভালো কথা তবে কিনা আমার বিপদ-আপদ হতেই পারবে না দাদামশাই আছেন না?”
বিল্টু ভয়ে ভয়ে বলেতোর দাদামশাইকে একদিন দেখাবি?”
দাদামশাইকে? আচ্ছা…” বলে লাটু চুপ করে যায়

এখন স্কুল ছুটি সকালে বিল্টু একটা আলু-পরোটা আর একটা ক্ষীরের পরোটা খেয়ে অঙ্ক নিয়ে বসে মা বলেছে এই ছুটিতে মামারবাড়ি যাওয়া হতে পারে যদি বাবা ছুটি পায়
বাইরে থেকে ফাগুয়ার গলা শোনা যায়,বেল্টুদাদা, দেখ নাটুদাদা এসেছে কোলে আবার বাঘের বাচ্চা
লাটু অবশ্য বলল, “ধুত, বাঘ না, বনবেড়াল ওর নাম জগাই ওর একটা ভাই আছে, মাধাই দু’জনে মারামারি করে জখম হয়েছে মাধাইটা গুন্ডা, অল্প জখম হয়েছে জগাইটা অত চালাক নয় আঁচড় লেগেছে বেশি চোখের ওপরের দিকের মাংস উঠে গেছে
ঠাকুমা বলল, “বুনো জন্তুরা নিজেরাই নিজেদের চেটে চেটে চিকিৎসা করে তবে এইটুক প্রাণী, জিভই বা কতটুকু চোখের ওপর অবধি যায় নাকি?
এসব সময়ে ফাগুয়াই কাজে আসে বলল,চোরবাজারের পিছনে হরিপদ গুণিন আছে জীবজন্তুদের বিপদে আপদে, কী বলব লেটুদাদা, যেন সাক্ষাৎ ভগবান তবে কিনা এই জখম দেখে তো আঁচড়ানোর জখম মনে হচ্ছে না বরং যেন কেউ এক লপ্তে ধারালো কিছু দিয়ে খুঁচিয়ে দিয়েছে
লাটু বিরক্ত হয়,মিথ্যে বলি না আমরা ফাগুয়া আমাদের মিথ্যে বলা বারণ জান না?”
কেন কেন? বারণ কেন?” ফাগুয়া এক ডাঁই সবজির খোসা ভাতের ফ্যান চায়ের পাতা সব পিছনের বাগানের গর্তে ফেলতে যাচ্ছিল বালতি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল
কেন আবার? মা বলেছেন মিথ্যে বললে বিষগাছ হতে হবে আমাদের
ফাগুয়া বিড়িপাতা চিবোনো দাঁত বার করে হাসে

চোরবাজার কিছু চোরাই জিনিস বাজার নয় আসলে পাহাড়ের কোলে এমন একটা জায়গায় বাজারটা বসে যে পাহাড়ে আসা পর্যটকেরা এখানে পৌঁছোতে পারে না রাস্তা থেকে নেমে কিছুটা পায়ে চলা পথে হেঁটে জঙ্গলে ঢুকে পাথর টপকে জল ডিঙিয়ে গাছের ঝুড়ি ধরে ধরে হেঁটে এখানে আসতে হয়
লাটু জগাইকে কাঁধে বসিয়ে ঝুরি ধরে ঝুলে ঝুলে জল পেরোল বিল্টু জলে পা দিয়ে দিয়ে খানিক বালির ঘূর্ণি করল, তারপর দু’জনে হরিপদ গুণিনের কাছে পৌঁছোল
হরিপদ তো লাটুকে দেখেই তড়বড় করে এগিয়ে এল, কী, আপনি!”
লাটু চমকে সরতে যাচ্ছিল ফলে জগাই ঘাড় থেকে মাটিতে পড়ল ঠাস করে পড়েই এক দৌড়ে সোজা বাইরে বিল্টু আর লাটু কোনোরকমে তাকে খুঁজে ধরে পাঁজাকোলা করে যতক্ষণে আবার ভেতরে নিয়ে গেছে ততক্ষণে হরিপদ দুটো মাটির ভাঁড়ে গুড়ের সরবত আর সুজির বিস্কুট সাজিয়ে বসে আছে
ওরা ঢুকতেই হরিপদ ঝপ করে নেপালি দারোয়ানের মতো অর্ধেক কোমর ঝুঁকিয়ে সেলাম করল তারপর ওর বিদঘুটে নোংরা চামচিকের গন্ধওয়ালা বিছানার নিচ থেকে একটা গোল মোড়া বার করে ঝেড়েঝুড়ে লাটুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,বসেন বড়োকত্তা চেহারাটা এমন ছোটো দেখাচ্ছে কেন?”
লাটু ভুরু কুঁচকে বলল,আমি লাটু বড়োকত্তা আবার কে? আমার এই জগাইয়ের চোখের ওপরে চোট লেগেছে দেখ তো সারাতে পার কিনা
ঘরটা বড্ড অন্ধকার দুটো জানলা আছে বটে, কিন্তু বন্ধ চোখ সইয়ে নিয়েও দেখা যায় না ভালো কোণ থেকে একটা কালো তেলচিটে প্রদীপ তুলে জ্বালিয়ে আনল হরিপদ জগাই অনেকক্ষণ ধরেই বিরক্ত, তায় একবার পড়েও গিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই কাছে গেলেই ফ্যাঁশহহ্করে তেড়ে উঠছে রকম দেখে হরিপদ এক ডেলা কপ্পুর চিমটে দিয়ে ধরে একটু জ্বালিয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল তারপর সেই ধোঁয়াটা জগাইয়ের মুখের কাছে ধরতেই জগাই এমন ঝিমিয়ে গেল, যেন ঘুমিয়েই যাবে বুঝি
এবার পোড়া ওই কপ্পুরের কালির সঙ্গে কী যেন এক পাতার রস মিশিয়ে কাটা ঘায়ে লাগিয়ে দিল যত্ন করে লাটুকে বলল ভয় নেই, “ ঘা আর পাকবে না কিন্তু বড়োকত্তা, আপনি এত বছর পরে কোথা থেকে এলেন বলুন দেখি!”
লাটু অবাক হয়ে বলল,বড়োকত্তা কে? বললাম না আমি লাটু
হরিপদ মাথা নেড়ে চশমার কাচটা ফ্রেম থেকে পটাং করে খুলে, মুছে আবার সেট করে নিয়ে বলল, “সে বললে কি হয়? হুবহু বড়োকত্তা সেই কবে, আমি তখন এক কুড়ি চার কি পাঁচ বছরের, তখন দেখেছি, কিন্তু তা বলে কি ভুলে যাব চেহারা?
জগাইকে কোলে জাপটে নিয়ে লাটু উঠে দাঁড়াল, তারপর হেসে বলল,তোমার এক কুড়ি চার বছরে মানে চব্বিশ বছর বয়সে আমি তো জন্মাইনি কাকা কী যে বলছ!”
হরিপদ কী যেন বিড়বিড় করে, মাথা নাড়ে
বিকেলে ঠাকুমা গোলারুটি বানিয়ে দিল ডিম দিয়ে লাটু একটা রুটি জগাইকে খাওয়াল যাওয়ার সময় বলে গেল কাল আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন সকাল সকাল আসিস দেরি করিস না যেন
ফাগুয়া রাতে মশারি লাগাতে এসে বলল,তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো রাতে বৃষ্টি হবে খুব বেশি বৃষ্টিতে বাড়ির আশেপাশে জংলি কুকুরগুলো এসে মাটি শোঁকে দেয়াল আঁচড়ায় তাতে ভয় পেও না যেন আমি আজ ঢাকা বারান্দায় খাটিয়া পেতে শোব ’খন খোলা উঠোনে শুলে ভিজতে হবে

পাহাড়ে এই এক মজা সারা রাত বৃষ্টির পর সকালে ঝলমলিয়ে রোদ উঠল বাড়ির সামনের রাস্তার পাথরগুলো ঝকঝক করছে ফাগুয়া বাড়ির বাগানে কোনো পুরোনো মরা গাছের ডাল, কাণ্ড সব আলাদা করে কেটে কেটে রাখছে বিল্টু খাতা বার করে খানিক হাতের লেখা প্র্যাকটিস করল ওর স্কুলের বন্ধুরা প্রায় সবাই স্কুল হোস্টেলে থাকে এখন ছুটি, তারা কেউ কেউ বাড়ি গেছে কেউ এক-দু’দিনেই যাবে মুকুল পিঠে একটা বড়ো ব্যাগ নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাবার সঙ্গে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল বিল্টুকে দেখে বলল, “যাবি স্টেশনে? স্টেশনের রাস্তার লাল বাড়ির জাম গাছে এত্ত জাম হয়েছে আমাদের হাত যাবে না, কিন্তু বাবাকে বললে পেড়ে দেবে
লালবাড়ির জাম খুব মিষ্টি, কিন্তু না বলে নিলে লাটু বড়ো বিচ্ছিরি করে ঘাড় নাড়ে বলে, যাঁদের গাছ তাঁদের খারাপ লাগল কিনা কে জানে এই জন্যেই লাটুর বন্ধু নেই কোনো ক্লাস সেভেনে এত জ্যাঠা ছেলেদের বন্ধু হয় নাকি?

জঙ্গলের ভেতরে খানিকটা এগিয়ে বিল্টুর মনে হল লাটুদের বাড়ির দিক থেকে ধোঁয়া উঠে আসছে আগুন! ধক করে ওঠে বুকের ভেতরটা যদিও বনে আগুন লাগার সময় এখন না আরও গরমে কিংবা শীতের মুখে কখনও-সখনও আগুন লাগে শুকনো পাতায় বিল্টু দুদ্দাড় দৌড়োতে থাকে তারপর কাছাকাছি গিয়ে দেখে আগুনই বটে অনেকখানি জায়গা জুড়ে কাঠকুটো জ্বেলে লাটুর মা, লাটু আর ক’জন মহিলা আর একটা ছোটো মেয়ে সেই আগুনে বড়ো মাটির হাঁড়িতে কী যেন রান্না করছে হাঁড়ির ধার ঘেঁষে অনেকরকমের আলু সাজানো মেটে, রাঙা, মিঠে, সাদা সব রকমের আলুই ওই মিটমিটে আগুনে পুড়ছে বাড়ির ভেতর থেকে একটা বড়ো মেয়ে থালায় ভরে খানিক কুমড়োর ফালি নিয়ে এসে ওই হাঁড়িতে ঢেলে দিল
লাটু বিল্টুকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “এদিক দিয়ে আয় বিল্টু
দেখতে দেখতে জায়গাটায় আরও অনেক লোক জড়ো হচ্ছিল ওরা জংলি মানুষ চকচকে কালো শরীর কারও হাতে তির-ধনুক, কারও হাতে একটা খরগোশ কি বুনো হাঁস একজনের হাতে ইয়াব্বর এক বন মোরগ
লাটু বিল্টুর হাত ধরে টান দিল “আজ ওদের সবার নেমন্তন্ন এখানে আয় তোকে আমার পড়ার ঘর দেখাই
বাড়ির ভেতরে ঢুকে বিল্টুর তো চোখ ছানাবড়া একটা বিরাট বড়ো গোল ঘর যেটা বাইরে থেকে দেখা যায় তার চারপাশ দিয়ে চারটে সিঁড়ি মাটির নিচে নেমে গেছে বিল্টু জানে, এরকম মাটির নিচের ঘরকে বেসমেন্ট বলে লাটুর পিছন পিছন একটা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল বিল্টু কিছুটা নেমে পৌঁছোল আর একটা ঘরে এই ঘরটা চার চৌকো কোথাও কোনো জানলা নেই ভেতরে লন্ঠন জ্বলছে দিন-দুপুরেও মাটির ঢিবি কি নিখুঁত করে চৌকির মতো বানানো তার ওপর লাটুর বইখাতা গুছিয়ে রাখা একদিকে জগাই চোখ বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিল বিল্টুকে দেখে লাফ দিয়ে কুঁজো উলটে জল ফেলল লাটু কুঁজোটা সোজা করে বসিয়ে আর একদিকে টানল বিল্টুকে এই ঘরের মধ্যে দিয়েই পাশের ঘরে যাওয়ার দরজাও বিল্টু এত অবাক জীবনেও হয়নি
লাটু বোধহয় বুঝতে পেরেছিল বলল, “এইভাবে বাড়ি বানানোর বুদ্ধি দাদামশাইয়ের এইরকম আরও দুটো ঘর আছে আমাদের দাদামশাই এখানে নানারকম এক্সপেরিমেন্ট করতেন পরে স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধে অনেক সংগ্রামী পালিয়ে এসে এই ঘরগুলোতে থেকেছেন একবার চারজন বিপ্লবী এসে ঘাঁটি গেড়েছেন দাদামশাই ছিলেন বিজ্ঞানী পুলিশ অনেকবার ওঁকে নাজেহাল করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছিল তা সেবার বিপ্লবীরা এসেছেন দিদিমা তাঁদের খিচুড়ি, আলুভাজা, আতার পায়েস খাইয়ে-দাইয়ে নিজের ঘরে গিয়ে একটু শুয়েছেন এমন সময় হাতে বড়ো বড়ো কেঠো বন্দুক নিয়ে দুদ্দাড় করে এক ঝাঁক পুলিস এসে দরজা ধাক্কা দিল দিদিমা তো ভয়েই কাঁটা দাদামশাই মিনিটের মধ্যে নিচে চলে গেছেন, কিন্তু নিচের ঘরেও পুলিশ তো হানা দেবেই দিলও খটমট করে বড়ো দারোগা দরজা দিয়ে নিচে গেল সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও পিছন পিছন দিদিমাও গিয়ে নেমেছেন এইখানে এই মাটির চৌকির ওপর আসনপিঁড়ি হয়ে দাদামশাই কীসব বার্ণারে ঢালছেন, মেশাচ্ছেন গোটা ঘরে ধোঁয়া আর বিকট গন্ধ
“দারোগা এক হাতে নাক চাপা দিয়ে অন্য হাতে মাথার টুপি সামলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার এখানে চারজন স্বদেশী গুন্ডা লুকিয়ে আছে খবর পেয়েছি তারা সব কোথায়?
“দাদামশাই মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ খবর তো আমিও পেয়েছি সায়েব তবে এই যে যা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছি ছাড়া আর কিছুতেই মন দিতে পারছি না তুমি যখন এসেছ, নিজেই খুঁজে নাও না কেন? থাকলে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাও
“দারোগা বলল, ‘কীসের এক্সপেরিমেন্ট করছ শুনি?
“দাদামশাই বললেন, ‘চারপেয়ে জন্তুদের মানুষ করার এক্সপেরিমেন্ট মানুষগুলো সবাই যে হারে জন্তু হয়ে যাচ্ছে, দিন দিন পৃথিবীতে মানুষ কমে যাবে তো না হলে বলতে বলতেই ভেতরের ঘর থেকে একটু লেংচে একটু লাফিয়ে লাফিয়ে একটা ছোটো ছেলে বেরিয়ে এল অবিকল বাঁদরের মতো অঙ্গভঙ্গি হাত চুলকোয়, পা চুলকোয়, মাথা চুলকোয়, কান থেকে একটা লাল বড়ো পোকার মতো কী যেন বার করে মুখে পুরে দিল ওদিকে ঘরে তখন সেই ধোঁয়া আর গন্ধ বেড়েই চলেছে দারোগাসমেত সব পুলিশ নাকে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ জ্বলে ঝাপসা লাগছে অন্ধকার ঘরের ভেতরটা
“দাদামশাই বলল, ‘দেখেছেন? বাইরে কলাঝোপে এসে রোজ অনিষ্ট করছিল ধরে ওষুধটা খাওয়ালাম আপনাদের বউমার হাতে হাতে কাজ করার একটা ছোটো ছেলের বড়ো দরকার বলছিল তা দেখতে হয়েছে বটে মানুষের মতো, কিন্তু স্বভাবটি পালটাতে পারিনি জানি না আদৌ পারব কিনা
“দারোগা তাও বোধহয় ধোঁয়ার মধ্যেই দু’পা এগোতে যাচ্ছিলেন কিন্তু মেঝে ভর্তি তেল আর জল ঢালা আছাড় খেয়ে পড়লেন মাটিতে কাঁধের বন্দুকের কুঁদোটা নিজের মাথার পিছনেই ঠুকে গেল ঠক করে
“সেবার আর দাদামশাইকে না ঘাঁটিয়ে সরে পড়েছিল দারোগার দল
আর সেই বাঁদরের মতো মানুষটা?”
“আরে ধুর বাঁদর কেন হবে? ওই ছেলেটা বেঁটেখাটো একটা বাচ্চা ছেলে বিপ্লবীদের দলেরই পায়ে চোট পেয়েছিল পালাতে পারত না দাদামশাই ওদের পাশের ঘরেই থাকতে দিয়েছিলেন দু’জন আদিবাসীকে নিয়ে নিজে ঘরের মাটি কেটে সুড়ঙ্গ বানিয়েছিলেন নদীর মুখ অবধি একবার সুড়ঙ্গ ধরে যেতে পারলেই সোজা নদীতে গিয়ে পড়বে, তারপর সাঁতার কেটে যদ্দূর পারো যাও কিন্তু ওই ছেলেটি পায়ে চোট নিয়ে সাঁতার কাটতে পারবে না বেশি দূর দাদামশাই তাই ওকে ঘরেই আটকে রাখেন তারপর ঘরে গ্যাস আর হাইড্রোজেন সালফাইড দিয়ে আর মেঝেতে তেল-টেল ঢেলে এক বিচ্ছিরি কাণ্ড করে রাখেন বুঝতে পারছিস? কী অদ্ভুত সাহসী মানুষ ছিলেন দাদামশাই! চল চল, সবাই খাওয়াদাওয়া করবে দাদামশাই তদারকি করবেন তো জুতোজোড়া দিয়ে আসিঘরের কোণ থেকে একজোড়া পুরোনো চামড়ার জুতো তুলে নিয়ে লাটু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে
বিল্টু আড়চোখে পাশের ঘরটা দেখে সুড়ঙ্গ কি এখনও আছে? কে জানে! যাক, আগে তো দাদামশাইকে দেখি পরে জিজ্ঞেস করব ওসবভেবে লাফাতে লাফাতে বিল্টুও উঠে আসে
বাইরে লাটুর মা আর জনে মিলে বড়ো হাঁড়িতে খিচুড়ি ঘুঁটছে একটা মেয়ের হাতে লম্বা দড়িতে ছোটো ছোটো রঙিন কাপড়ের টুকরো লাগানো মেয়েটা দড়িটা দিয়ে বাড়ির দেয়াল সাজাচ্ছে ছোটো ধুতি মালকোঁচা দিয়ে পরা একজন লোক ওই গরম আগুন থেকে কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আলু বার করে আনছে একপাশের বিরাট শিরীষ গাছটার নিচে একটা কাঠের চেয়ার বিল্টুর জেঠামশায়ের ইজিচেয়ারের মতো গড়ন চেয়ারটার পাশে ছোট্ট টুলে জলের গেলাস, কুঁজো গাছে হেলান দিয়ে রাখা কাঠের ছড়ি একখানা
লাটু চেয়ারের সামনে চটিজোড়া নামিয়ে রাখে বিল্টু জিজ্ঞেস করে,দাদামশাই কোথায় রে? আর এসব খাওয়াদাওয়া কীসের জন্য?”
লাটু হেসে বলে,আছেন তো দেখতে পাচ্ছিস না বুঝি? খাওয়াদাওয়া তো ওই উপলক্ষ্যেই আজ দাদামশাইয়ের জন্মদিন কিনা!”
বিল্টু এদিক ওদিক তাকায় বুড়োমানুষ যারা আছে সবাই আদিবাসী এর মধ্যে দাদামশাইকে খুঁজে পায় না

একটু বেলা বাড়লে সবাই একসঙ্গে খেতে বসে খিচুড়ি, মিষ্টি, আলুর ভর্তা আর ছাগলের দুধে মকাই আর গুড় মেশানো পায়েস খাওয়ার আগে সব্বাই ওই চেয়ারের পাশের শিরীষগাছের কাছে গিয়ে ভুট্টা, আখের আঁটি, বনমোরগ আর যা যা এনেছে নামিয়ে রাখে বনমোরগগুলোর পায়ে দড়ি বাঁধা লাটু এগিয়ে গিয়ে দড়ি খুলে দেয় ওরা মাথা উঁচু করে ঝুঁটি নাড়িয়ে এদিক ওদিক ঘোরে
একটা মিষ্টি মতন দিদি গোছের মেয়ে হাঁক দেয়,লাটুউ, তোর বন্ধুকে নিয়ে খেতে বোস এবার!”
দিব্যি এক বনভোজন শেষে বেলা পড়ে আসে
বিল্টু খেয়েদেয়ে উঠে আর একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “দাদামশাইকে দেখতে পেলাম না তো রে!
লাটু বলল,ওই যে লাল ফুলের শিরীষ গাছটা দেখলি! ওইই তো!”
মানে?” বিল্টু যারপরনাই অবাক হয়
“দাদামশাই বেঁচে থাকলে একশো আঠারো বছর বয়স হত রে এখন আমার জন্মের অনেক অনেক আগেই দাদামশাই মারা গেছেন মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, মৃত্যুর পর শরীরটা না পুড়িয়ে বাড়ির হাতায় মাটির মধ্যে যেন শুইয়ে দেওয়া হয় আর মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর যেন বড়ো কোনো গাছ লাগিয়ে দেওয়া হয় দিদিমার প্রিয় ফুল ছিল শিরীষ পাশের হলুদ শিরীষ গাছটা দেখছিস, ওটাই দিদিমা দাদামশাই বলতেন, এই শরীর পুড়িয়ে প্রকৃতিতে পলিউশন মিশিয়ে কাজ নেই, তার চেয়ে মাটিতে শরীর মিশলে মাটি উর্বর হবে, সেই-ই তো ভালো।”

বাড়ি ফেরার পথে বিকেল ঘন হয়ে এসেছিল মা ফাগুয়াকে পাঠিয়েছিল যাতে ভয় না লাগে একা একা
লাটু বলে, ভয়ের কিছু নেই জঙ্গলে দাদামশাই সবসময় পাশে পাশেই থাকেন
বিল্টু অবশ্য সে কথা ফাগুয়াকে বলেনি যা ভীতু! খামোখা দাদামশাইকে ভূত ভেবে বসে আর-কি!
----------
ছবি - শ্রীময়ী

1 comment:

  1. কি সুন্দর শেষটা... একটা না থেকেও থাকার রেশ পেলাম; আর প্রকৃতিকে যে আমাদের আরও বেশি দরকার দৈনন্দিনকার দুঃখ ভোলাতে, সেটা আবার মনে হল।

    ReplyDelete