ছড়া ও কবিতার সম্পর্ক এবং সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই মনে আসে যে এই দুটি মাধ্যমই মানুষের
মধ্যে সৌন্দর্যবোধ ও রুচির উত্তরণ ঘটায়। ছন্দ হচ্ছে গতিসৌন্দর্য। গতি যদি অনিয়ন্ত্রিত হয় তবে তা কখনোই সুন্দর হয়ে উঠতে পারে
না।
গতিসৌন্দর্য
যেমন রূপগত তেমনি ধ্বনিগতও হতে পারে। রূপসৌন্দর্য উপভোগ করা যায় চোখে, আর ধ্বনিসৌন্দর্য কানে। মনে
রাখতে হবে সাহিত্যের ছন্দ কিন্তু রূপগত নয়, ভাষাগত ধ্বনি প্রবাহের সৌন্দর্য। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে কবিতা ও ছড়ার গতিসৌন্দর্য
কি একই?
নাকি ভিন্ন প্রকৃতির? এই দুটি কি স্বতন্ত্র সাহিত্যশাখা?
এদের মধ্যবর্তী অবস্থানে আবার রয়েছে পদ্য। আমাদের এইরকম
কয়েকটি জিজ্ঞাসা চিহ্নের প্রায়ই মুখোমুখি হতে হয়। বয়স্কজনপাঠ্য ছন্দোবদ্ধ রচনার ক্ষেত্রে সমস্যা কিছুটা কম। সে ক্ষেত্রে পদ্য হলেও আমরা কবিতা বলে অভিহিত করি। কিন্তু শিশুতোষ রচনায় বেশ ধাঁধায় পড়তে হয়। সুধীসমাজ ছন্দোবন্ধ সব শিশুরচনাকে ছড়া বলে থাকেন। কেউ আবার বেশি মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করে বলেন কবিতা। এ এক বহুল প্রচলিত ব্যাপার। আমার বিনীত নিবেদন, এর জন্য শিল্পবোধের অস্বচ্ছতা হয়তো কিছুটা দায়ী।
আমার আপত্তির কারণ ছন্দোবদ্ধ ছড়া ও কবিতার উৎপত্তিগত, গঠনগত এবং কাঠামোগত দিকগুলি লক্ষ্য করে। মোটা দাগের এই অভিধায় হয়তো অনেকের আপত্তি নেই, কিন্তু সূক্ষ্ম সচেতনতায় ভিন্ন রূপসৌকর্য ধরা পড়ে ছড়া এবং কবিতার। কবিতার কথায় আগে আসি। এই নিয়ে বিস্তর আলোচনায় না গিয়ে অতিসরলীকরণ করে বলি, হৃদয়ের শুদ্ধ অনুভূতি এবং আবেগের প্রকাশ হল কবিতা। কবির কল্পনা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি বা উপলব্ধি যখন সুনির্বাচিত শব্দ-সম্ভারে ছন্দোবদ্ধ অবস্থায়
রসমণ্ডিত রূপ লাভ করে তখনই জন্ম নেয় কবিতা। সুতরাং কবিতার প্রধান উপাদান ভাব, ভাষা, ছন্দ ও রস। ভাবের প্রকাশ হয় ভাষার মাধ্যমে। আর এই ভাষাকে শ্রুতিমধুর ও রসমণ্ডিত করে তোলে ছন্দ। ভাষা ও ছন্দের সমন্বয়ে কবির কোনও অনুভূতি যখন রসাত্মক বাক্যে রূপ পায় তখনই ভূমিষ্ঠ হয় সার্থক কবিতা। কাজেই উৎকৃষ্ট কবিতার রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে ছন্দের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ছন্দ যেমন কবিতার
ভাষাকে শ্রুতিমধুর করে তোলে তেমনি কবির ভাবকে করে তোলে হৃদয়গ্রাহী। কবিতার
জন্মলগ্ন থেকেই ছন্দ তার পরিস্ফুটনের বাহন। কবিতার আদি নিদর্শন চর্যাপদেও এর
প্রমাণ আমরা বারে বারে পেয়েছি। সুতরাং কবিতার অন্যতম উপাদান যদি ভাব হয় তবে ভাবের আশ্রয় ভাষা। আর ভাষা হলো শব্দের
সমষ্টি। তাই কবিতায় শব্দচয়নের গুরুত্ব অনেকখানি। ভাবকে বহন করার জন্য উপযুক্ত শব্দ ছাড়া কবিতা হয় না। ধরা যাক কোনও রচনার শব্দগুচ্ছে ছন্দ, অন্ত্যমিল
সবই আছে,
কিন্তু কাব্যময়
অনুভূতির ছোঁয়া নেই। শব্দগুলোও আক্ষরিক অর্থের বাইরে বিশেষ কিছু প্রকাশ করে না। ফলে সেই সৃষ্টিকে কিছুতেই কবিতা বলা যাবে না। কবিতা হয়ে ওঠার জন্য বাক্যের শব্দসমষ্টির একটি বিশেষ গুণ
প্রয়োজন। তার নাম কাব্যগুণ। কাব্যগুণ শব্দের সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। কবিতার ভাবকে মূর্ত করার জন্য সুষম মাত্রায় শব্দের পর শব্দ গেঁথে উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্প যোজনার মাধ্যমে কবিকে সৌন্দর্য নির্মাণ করতে হয়। শব্দগুলো আক্ষরিক অর্থের খোলস ভেদ করে আমাদের সামনে এমন ছবি হাজির করে যা আমরা চোখ বন্ধ করলেও দেখতে পাই এবং সেই ছবির ঔজ্জ্বল্য ও বিশালতা আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। শব্দের শৈল্পিক সহযোগ অর্থের নবতর রূপান্তর ঘটায়। কথার পিঠে অর্থের দোলা লেগে প্রকাশ পায় একটি পরিপূর্ণ ভাব বা বিষয়। ছবি ও অর্থের ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে দেয় এক অপূর্ব মুগ্ধতা। তখন কবিতাটি আমাদের কাছে গভীর আবেদনময় হয়ে ওঠে। আমার কাছে এটাই কবিতা। কবিতার চারিত্রবৈশিষ্ট্য যদি এমন হয় তবে পদ্য কী বস্তু? সাধারণ কথায় ছন্দোবদ্ধ পদ সমূহের নাম পদ্য। কিন্তু পদ্যের আকারে রচনা মানেই কবিতা নয়। পদ্যের
ছন্দোবদ্ধ বাক্যে যখন ভাবানুভূতির গভীরতা প্রকাশ পায় তখনই সৃষ্টি হয় কবিতার। কবিতা হয়ে ওঠে আলংকারিক এবং পদ্য চাকচিক্যহীন সাদামাটা। অর্থাৎ, ছন্দকৌশল যতই নিখুঁত হোক না কেন কাব্য-অলঙ্কার এবং রসের অভাবে সেই রচনা পদ্য নামেই চিহ্নিত হবে। কবিতার বিষয়বস্তুতে যদি কোনও ভাবানুভূতি না থাকে, শুধুমাত্র তথ্য বা তত্ত্ব প্রচারিত হয় সেটা তখন পদ্য পদবাচ্য। মিলের কারিকুরি থাকতে পারে, উচ্চারণে ছন্দিত শ্রুতিসুখও পাওয়া যায়, বক্তব্যের বেণিও সরাসরি খুলে যায়, কিন্তু শব্দগুচ্ছের
কোনও অনির্বচনীয়
আনন্দ দেবার ক্ষমতা থাকে না। এগুলি পদ্যই, কবিতার আওতায় কিছুতেই আনা যায় না। ছড়ার গঠন-কৌশল আরও ভিন্ন, ছন্দ-মিল ছাড়া কবিতা এবং পদ্যের সঙ্গে রূপগত তেমন সাদৃশ্য নেই। ছড়ার প্রচলন চর্যাপদেরও আগে, মানুষের মুখে মুখে কাল থেকে কালান্তরে।
সাহিত্যের এই প্রাচীনতম ধারার এক একটি
পঙক্তিতে ঝিলিক দিয়ে যায় এক একটি ছবি, টুকরো টুকরো ছড়ানো। এই ছড়ানো ছবির ছন্দিত কাঠামোই ছড়া। সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ যাকে মেঘের সঙ্গে তুলনা দিয়েছেন। বলেছেন, গাম্ভীর্য নয়, অর্থের মারপ্যাঁচ নয়,
সহজ কথায় লেখা। পদ্য বা কবিতার সঙ্গে প্রধান বৈসাদৃশ্য হল ছড়া সবসময় দৃঢ়বদ্ধ এবং সংক্ষিপ্ত। সেই তুলনায় পদ্যের বাঁধুনি অনেকটা আলগা। ছড়া কিন্তু কবিতার মতো অনুভূতিঘন নয়। কবিতা যেখানে রহস্যময়, ছড়া বেশ অগভীর ও হালকা। অনেক
কথা বলার পরও যেন কবিতা কিছু কথা বলে না, উহ্য রেখে দেয়। শেষ পর্যন্ত সেই না বলা কথাটিই কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতার
মূলভিত্তি কল্পনা বা আবেগ হলেও তা সত্য কিংবা যুক্তিকে অস্বীকার করে না। যেমন কবিতা বিজ্ঞানের তথ্যপ্রবাহের উপর পা ফেলে আনন্দ,
সৌন্দর্য ও জীবনের সুগভীর তাৎপর্যকে ব্যক্ত করে, ছড়ার ক্ষেত্রে এটা খাটে না। যেমন দেখতে পাই সুকুমার রায়ের উদ্ভট কল্পরাজ্যে বিজ্ঞানের বাস্তব যুক্তি-বুদ্ধি সম্পূর্ণ অচল। অবাস্তব খেয়ালরসই সেখানে মুখ্য। কবিতা জীবনপ্রকৃতি এবং সমাজ বাস্তবতার সবকিছুকে ধারণ করে অবলীলায় প্রকাশ করতে ব্যাকুল। কবিতার আছে সর্বগ্রাসী অন্বেষা। ছড়াও কিন্তু পিছিয়ে থাকে না। মানুষের
দৈনন্দিনতায় ছড়াও একাত্ম। ছড়া নিয়মিত সমাজ-বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। আনন্দ-দুঃখ,
শোক-দ্রোহ প্রকাশে ছড়া এক অনিবার্য মুখর মাধ্যম। নেরুদার কথা প্রাসঙ্গিক মনে
হচ্ছে। তিনি বলেছেন, যে কৰি বাস্তববাদী নন, তিনি মৃত। আর যে কবি শুধুই
বাস্তববাদী, তিনি ততোধিক মৃত। সুতরাং প্রকৃত ছড়া বা কবিতা হল কল্পনা আর বাস্তবের
শৈল্পিক মিশ্রণ যা সুনির্বাচিত শব্দবিন্যাসে হদরগ্রাহী হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের কয়েকজন
তথাকথিত পণ্ডিত আবার ছড়াকে সাহিত্য বলে মানতে নারাজ। অথচ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে
যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমণির ছড়া’-র ভূমিকা লিখতে গিয়ে লিখিত ভাষ্যে ছড়াকে
সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। তবুও কবিতার
দাপটে ছড়ার জন্য নির্ধারিত আসন ছিল শিশুতোষণের জন্যই সীমাবদ্ধ। অন্নদাশংকর লিখছেন, ছড়া দিয়ে
মিটবে না কবিতার স্বাদ/ তবু তো যায় না ভোলা বচন প্রবাদ/ খোকা ঘুমাবে না যদি না
পায় এর স্বাদ/ পাড়া ঘুমাবে না যদি এটা পড়ে বাদ। সুতরাং বোঝাই যায় ছড়ার প্রভাব
কত গভীরে, একেবারে শিকড়ে। ছড়া মানে কিছু মিলের কারসাজি নয়। আল মাহমুদ লিখছেন, ছড়া
সেও কাব্যকথা হৃদয়ভাঙা মিল/ ঠিক দুপুরে উড়তে থাকা পাখ ছড়ানো চিল/ নেইকো ছড়ার
মালমশলা নেইকো কথা মিল/ এই শহরে কোথায় পাব নীলপরীদের ঝিল? সাহিত্যের এই আদি মাধ্যমটির
সাময়িকতার দিকে উন্মুখতা দুর্নিবার। কৌতুকের বক্রতায় এবং ছন্দমিলের বিন্যাসে
আমাদের কৌতূহলকে উদ্দীপিত করে। ছড়া যেন ঝলসে ওঠে আগুনের ফুলকির মতো। এই ছড়াগুলির
স্থায়িত্ব এবং শিল্পগুণ সম্পর্কে সংশয় থাকতে পারে। সাময়িকতার সংকীর্ণতা মেনে
নিলেও মনে হয় সাম্প্রতিকতার আমেজ কেটে গেলে তরতাজা ঘটনার এই চিত্রায়ণ কালের
ইতিহাস হিসেবে নির্ণিত হবে। কবিতার ক্ষেত্রেও এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। তাৎক্ষনিকতাকে
প্রশ্রয় দিয়ে অচিরতার আশঙ্কায় ভুগতে হয়েছে অজস্র কবিতাকেও। আবার কালের চাকার
আড়াল থেকে প্রকাশ্যে এসেছে নতুন উপস্থাপনায় সময়ের গতিময়তা তোয়াক্কা না করে। এ
যেন সময়ের সঙ্গে ঐতিহ্যের নবায়ন।
ইদানীং
কাব্যসাহিত্যে বিরাজ করছে একধরণের স্থবিরতা। কবিতার মতো ছড়াও সময়ের চাকায় পিষ্ট।
কবিতা না হয় নতুনভাবে বাঁক নিতে পারে, কিন্তু ছড়া একই আঙ্গিকে ক্রমান্বয়ে নির্মিত
হতে থাকবে। কবিতার যেমন প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ, আধুনিক, উত্তর আধুনিক যুগ আছে,
ছড়ার এই বিভাজন নেই কেন? তবে কী ছড়া এখনও আধুনিক হয়ে ওঠেনি? আমার ধারণা ছড়া
সূচনাপর্ব থেকে আজ অবধি আদ্যন্ত আধুনিক। সাম্প্রতিক ছড়ার চেহারায় সময়ের সৌন্দর্য
লেগেছে, শুধুমাত্র শিশুতোষ ভাবার দৃষ্টিভঙ্গি বদল হয়েছে. বক্তব্যের বলিষ্ঠতা এসেছে,
তাও আদি-অকৃত্রিম উদ্দেশ্য ও ইঙ্গিত কিন্তু একই থেকে গেছে। আমরা যারা এখন ধরাকে
ছড়া জ্ঞান করি, সেই পরিশীলিত নির্মাতারা কি অতিক্রম করতে পেরেছি ছেলেভোলানো
ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলি? বাংলা সাহিত্যের এই সম্পদগুলি কার রচনা তাও জানি না, কিন্তু
হদয়-সঞ্জাত ছড়াগুলি স্থান কালের সীমাহীন রাজ্যে চিরস্থায়ী বসতি গেড়েছে
কাব্যকলার নন্দনতাত্ত্বিকতায়। কখনও বা হয়ে উঠেছে শাশ্বত প্রতিবাদের শব্দচিত্র।
স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিকুশলতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেগবান করেছে ছড়াকে, যেখানে কৃত্রিমতা বা
চাতুরির কোনও স্থান নেই। নতুন সহস্রাব্দে আমরা যতই এগোই না কেন, ছন্দের বন্ধনে সমষ্টিগত
লোকমনের সৃষ্টি সেই ছড়া চিরনতুন এবং সর্বজনীন। দম নিতে জানে, বাঁক নিতে
জানে না! আর যদি বাঁক নিতেই থাকে তখন সেটি আর ছড়া থাকে না! অন্য রূপ ধারণ করে।
_____
অসাধারণ অসাধারণ দাদা।
ReplyDeleteকী অসাধারণ আলোচনা প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে দীপদার তুলনা দীপদা নিজেই।
একমেবাদ্বিতীয়ম।
ভালো লাগল।
ReplyDelete