ছড়া-কবিতা:: রামধনুকের রঙিন দেশে - বিভাবসু দে


রামধনুকের রঙিন দেশে
বিভাবসু দে

আয় ভাই ঘাস খাই মাঝরাতে উঠে,
বিদঘুটে জ্যোৎস্নায় ফুটফুটে চাঁদে
কটকট করে কারা চটপট বল,
পেটে মোর রাত্তিরে কেন কোলাহল?
কাঁদো কাঁদো সুর করে আধো আধো রাতে,
হঠাৎ উঠল ডেকে রাজার ঘোড়াতে
সাদা ঘোড়া হাঁদা ঘোড়া, কাঁদো কেন ভাই,
তোমার গামলা ভরা কচি ঘাস নাই?
ছিল শুয়ে ঘোড়াশালে রাজার চাকর
আর ছিল আমগাছে বেগুনি মাকড়,
ছুটে এল দু’জনেতে পড়িমরি করে
ঘোড়া ভাই কী-বা চাই, বলো তো এবারে
ঘোড়া বলে এই ঘাসে নেই মোর রুচি
লাল নীল ঘাস খাব, তার সাথে লুচি
বেগুনি মাকড় বলে, বেশ তবে খাও;
মাঝরাতে কেন ভায়া খামোখা চেঁচাও?
ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ নাক ঝাড়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে
ঘোড়া বলে একা খেয়ে মন যে না ভরে;
তাই বলি চলো ভাই রামধনু-দেশে,
সাতরঙা ঘাস খাব তিন ভায়ে বসে
খুকখুক কেশে উঠে ধুকপুক বুকে,
রাজার চাকর বলে, এই ছিল শেষে!
ঘাস খেয়ে হাঁস হব বাঁশঝাড়ে চড়ে,
ঘোড়া ব্যাটা গেছে খেপে মশার কামড়ে
মাকড় বলল তেড়ে আট ঠ্যাং তুলে,
পোকা খাই টপাটপ, গেছ বুঝি ভুলে?
ফসফস জাল বুনি ঘষঘষ করে,
আমগাছে ঝুলে থাকি জামদানি পরে
ঘাস খাব কোন দুখে মশা-মাছি ছেড়ে!
চিঁহি চিঁহি রব তুলে মিহি মিহি সুরে
ঘোড়া বলে, তবু ভায়া চলো মোর সাথে;
না- খেলে ঘাস-পাতা কিংবা রাজার ছাতা,
দেশটা তো ঘুরে আসা হবে
কথা নয় মন্দ, সব দ্বার বন্ধ, যাবেটা কেমনে আগে শুনি?
চাকরের কথা শুনে ঘোড়া বলে লেজ নেড়ে,
আগে মোর পিঠে চড়ো দেখি
ঘোড়ার পিঠে চাপল চাকর,
তার ওপরে বেগনি মাকড়,
ভেলকি লাগে দুই জনেরই চোখে!
ছিল ব্যাটা সাদা ঘোড়া, গজাল তার ডানা জোড়া
পক্ষ্মীরাজে পতপতিয়ে ওড়ে

চাঁদ ওঠে ফুল ফোটে আকাশের পথে,
উড়ে চলে সাদা ঘোড়া জ্যোৎস্নার রথে;
মিটমিটে তারা আর পিটপিটে চাঁদ,
একলাফে পার হয় কত গিরিখাদ!
সাত সমুদ্দুর তেরো নদী, চাঁদের বুড়ির সাধের গদি,
লাল পরি আর নীল পরিদের দেশ ---
ঘন্টাদেড়েক ওড়ার পরে যাত্রা হল শেষ
নামল ঘোড়া নতুন দেশে,
চাকর বলল খানিক কেশে,
তোমার ভায়া এলেম আছে বড়ো
চারপাশেতে রঙের বাহার, রামধনুকে বাজছে সেতার,
বৃষ্টিগুলো মিহিদানার মতন;
ঘাসগুলো সব ঘষঘষিয়ে রংবেরঙে উঠছে বেড়ে,
মনের সুখে ডিগবাজি খায় ঘোড়া
ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখল মাকড় গাছের ডালে,
পোকারা সব বিষম তালে
ঠুকছে তবলা ধিন তা ধিনাক তা!
চকচকিয়ে উঠল যে চোখ,
জিভের ডগায় সক-সকাসক
আটখানা ঠ্যাং আহ্লাদেতে খাড়া ---
আজকে তোদের চিবিয়ে খাব, দাঁড়া
সবাই আপন মনে, খাবারের পিছু ধরে,
রাজার চাকর ভেবে সারা;
ঘোড়া খায় কচকচ, মাকড়ের মচমচ,
আমি কি থাকব শুধু খাড়া!
তখনই উঠল কেঁপে, দখিনের ওই বনে,
তেড়ে মেরে ধাই-ধপাধপ কারা;
চাকর দেখল চেয়ে হাসতে হাসতে আসছে ধেয়ে,
হোঁৎকা মতন রামগরুড়ের ছানা ---
সেই যে যাদের হাসতে নাকি মানা!
বোম্বাগড়ের রাজাও আছে, সঙ্গে তাদের কুমড়োপটাশ,
ছুটছে সবাই হুড়মুড়িয়ে, হাসছে কিন্তু থামছে না
হকচকিয়ে চাকর বলে, দাঁড়াও দাঁড়াও, শুনছ ভাই,
হাসির বুঝি চলছে লড়াই? কার চেয়ে কে বিশ্রীরকম হাসে?
ঘাড় দুলিয়ে খিলখিলিয়ে, কুমড়োপটাশ বলল এসে,
বাঁচাও ভায়া, আসছে যে ওই খুড়ো!
খুড়ো? হাঁকেন রাজা বোম্বাগড়ের,
খুড়ো তো নয়, কাতুকুতু বুড়ো
নাগাল পেলে খপাৎ করে,
পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে,
হাসিয়ে মারে নোংরা পালক দিয়ে!
হাসতে হাসতে ফাঁসছে ভুঁড়ি,
পরাণ করে উড়ি উড়ি,
তবুও বুড়ো পেছন যে না ছাড়ে

  

মুখ থেকে যেই খসল কথা,
রাজার পেটে হাসির ব্যথা,
ল্যাগবাগিয়ে নামল এসে বুড়ো ---
চশমা-আঁটা চিমসে বদন
টাকের ওপর ঢেউয়ের মতন,
এখনও আছে কয়েক গাছা বাকি
উঠল কেঁপে তড়বড়িয়ে, কুমড়োপটাশ, গরুড়-ছানা,
দেখেই বুড়োর মধুর হাসি, গলায় যেন লাগল ফাঁসি,
রাজার বদন শুকিয়ে হল গ্রীষ্ম-রোদের আমসি-পানা;
যে যার মতো ছুটল সবাই, হাসিয়ে বুড়ো করবে জবাই,
খ্যাংড়া পালক উঁচিয়ে আছে, দেখতে যেন শকুন-ডানা!
আহা শোনো, এই যে খুড়ো, ছুটছ কেন এমন তর?
হাঁকল চাকর বুড়োর সামনে গিয়ে
নোটবইয়েতে পালক ঘষে, তাকায় বুড়ো মিষ্টি হেসে,
শুনবে নাকি গল্প দু-চারখানা? সেই যে ছিল কেষ্টদাসের পিসি ---
বেচত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি;
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ-বেরঙের আলপনা সব আঁকা
চাকর বলল, দাঁড়াও খুড়ো, গল্প শুনে পাচ্ছে না তো হাসি!
তাই তো পালক সঙ্গে রাখি, হাসির খোরাক থাকবে বাকি,
তাও কখনও হয়? বলল বুড়ো বাজিয়ে বোতল-শিশি
ঘাড় দুলিয়ে বেজার মুখে, মনের ভেতর চিকন দুখে,
চাকর বলে, পালকখানা দেখতে বেজায় কালো!
তার ওপরে নোংরা মতন, ট্যাংরা মাছের পাঁজরা যেমন,
ব্যাপার-স্যাপার লাগছে না তো ভালো
হাসব যদি হাসব সুখে, পালক আনো নতুন দেখে,
তবেই তো হে জমবে হাসির আসর
নতুন পালক কোথায় পাব? রায়বাবু যে গেছেন চলে ---
উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে বুড়ো
ওই যে দেখছ ওইখানেতে, মাঠের ধরে লালচে খেতে,
ঘাস চিবোচ্ছে ডানাওলা ঘোড়া,
যাও ছুটে যাও ওর পেছনে, চুপটি করে নিঃসাড়েতে,
ডানার পালক একটিখানা উপড়ে নিয়ে এস
ঘোড়ার অমন বাহার দেখে
আহ্লাদেতে উঠল নেচে, টগবগিয়ে বুড়োর পরাণখানা;
তাক করে সে ছুটল সোজা পক্ষ্মীরাজের ডানা
তারপরে যে ঘটল ভায়া, এমন কাণ্ড বলব কী তা,
হেঁইও বলে পালক ধরে টান!
অমনি ঘোড়া হকচকিয়ে, ভয়ের চোটে ভকচকিয়ে
মারল লাথি, করল ছত্রখান
একঘায়েতে দড়াম করে কোন দেশে যে পড়ল গিয়ে,
বুড়োর খবর কেউ পেল না আর
আপদ গেল, প্রাণ জুড়াল;
জয় মা বলে বেরিয়ে এল,
কুমড়োপটাশ, রামগরুড়ের ছা
সামলে মুকুট, গুটিয়ে কাছা,
ঝোপ ডিঙিয়ে এলেন রাজা,
বোম্বাগড়ের উড়িয়ে ধ্বজা,
রামধনুরই দেশে
বাঁচালে ভায়া আজকে জবর তুমি,
জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে, বলল রাজা
হাস্যমুখে, হাসির ঠেলায় হতেম নইলে মমি!
বিনয়মাখা মধুর হাসি, কণ্ঠে যেন বাজিয়ে বাঁশি
চাকর বলল, মানবসেবা বড়োই ভালোবাসি!
গদগদিয়ে উঠল রাজা, হঠাৎ পেয়ে এমন প্রজা,
বলল হেঁকে, চন্দ্র সূর্য সাক্ষী রেখে, সবাই যেন তাকিয়ে দেখে,
আজকে থেকে এই প্রদেশের তুমিই হলে রাজা
স্বপ্ন যেন সত্যি হল, রূপকথারই দৈত্য-দানো,
জয় হো বলে চাকর লুটায় ভুঁইয়ে
রঙিন ঘাসের রামধনু দেশ, বোম্বাগড়ের রাজার আদেশ,
চাকর হল নতুন মহারাজা
জয়ধ্বনি উঠল তেড়ে, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল ফুঁড়ে,
পতপতিয়ে উড়ল ঘোড়া হলুদ আকাশ জুড়ে;
শুভক্ষণে রঙিন দিনে সিংহাসনে চাপল চাকর,
তার মুকুটে উঠল বসে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বন্ধু মাকড়,
সাতরঙা জাল বুনল মনের সুখে
কুমড়োপটাশ সঙ্গে আছে, রামগরুড়ের ছানা,
বোম্বাগড়ের রাজা নাকি খাবেন মিহিদানা;
কাতুকুতু বুড়োও আছে অজানা কোন দেশে,
রাজার চাকর, মাকড় সহ সাজল রাজার বেশে,
ঘোড়াও আছে বেজায় সুখে রামধনুকের দেশে;
বলছি ভায়া, এবার তবে গল্প থামাই এইখানেতে এসে?
_____
ছবিঃ সুকুমার রায় এবং আন্তর্জাল

2 comments:

  1. আঁকা লেখা,দুই-ই জম্পেশ

    ReplyDelete
  2. বেশি দেরি নেই, যখন তোর লেখা বইয়ে ছাপা হবে। দারুণ লিখেছিস। এতগুলো চরিত্রকে এক ছাতার তোলার আনা মোটেই সহজ নয়। আরো লিখতে থাক।

    ReplyDelete