গল্প:: তিতলির একদিন - দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়


তিতলির একদিন
দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

তিতলির মনে আজ খুব আনন্দ। কারণ আজ প্রথম তিতলি বাড়িতে সারাদিন একা থাকবে। আসলে তিতলিকে একা রেখে কেউ কোথাও যায় না। ও নাকি ছোটো, ভয় পাবে। এ বছর ক্লাস ফোরে উঠেছে তিতলি। এখনও মা বাবা দাদা সবাই বলবে ও নাকি ছোটোঅথচ মাত্র চার বছরের বড়ো গুবলু দাদাকে সবাই বড়ো বলে। তিতলি এতদিন ভাবত ক্লাস ফোরে উঠলেই সে বড়ো হয়ে যাবে, কারণ দাদা যখন ক্লাস ফোরে পড়ত আর তিতলি কেজিতে তখনও দাদাকে সবাই বড়ো বলত। এখন মনে হয় বাড়িতে ওর থেকে ছোটো যেহেতু আর কেউ নেই তাই ওকে সব সময় ছোটো বানিয়েই রাখা হবে।
আজ প্রথমবার তিতলি সারাটা দিন বাড়িতে একা থাকবে। বাবা অফিস ট্যুরে বাইরে গেছে, আর গুবলু দাদার আজ ক্যারাটে টুর্নামেন্ট অনেক দূরে। মা সকাল আটটায় দাদাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। তিতলির জন্য স্যান্ডউইচ করে মা মাইক্রো ওভেনে রেখে গেছে। ওকে দেখিয়ে দিয়েছে কী করে গরম করতে হয়। অবশ্য এই কাজটা তিতলি পারে‌। মাঝে মধ্যে মিও আমরে থেকে হটডগ বা পিৎজা এলে দাদা ওকেই বলে গরম করে আনতে। আর, ও আর দাদা যদি বাড়িতে থাকে তখনও দাদা ওকে দিয়েই এসব কাজ করায়। মা অবশ্য জানে না সে সব। মা ওর জন্য টেবিলে ফল কেটে রেখে গেছে। কোলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে একসেট চাবি ওকে দিয়ে মা রমিতা বলে গেছে ও যেন কাউকে দরজা না খুলে দেয়। শুধু সবিতা মাসি কাজ করতে আসবে দশটায়, আর বিকেল চারটেয়, দু-বার তাকে দরজা খুলে দিতে হবে নীচে গিয়ে। ওদের ফ্ল্যাটে নীচের গেটে তালা থাকে সব সময়।
মা আর দাদা চলে যেতেই সারা বাড়িতে এক পাক নেচে নিল তিতলি। এই দেড় হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে ও একা, ভাবতেই কেমন একটা রোমাঞ্চ জাগছে ওর মনে। আজ একদম পড়তে ইচ্ছা করছে না। বরঞ্চ তিতলি মনে মনে ভেবে নেয় আজ বেশ কিছু কাজ করে মাকে চমকে দেবে।
প্রথমেই ও ভাবতে বসে ঠিক কী কী কাজ ও করতে পারে... হঠাৎ চোখ যায় ওয়াশিং মেশিনের দিকে। ওটা ফুললি অটোমেটিক। ও জানে কাপড় দিয়ে লিকুইড সোপ দিয়ে অন করলেই মেশিনটা চলবে। সহজ কাজ। মাকে বহুবার চালাতে দেখেছে ও। ও লন্ড্রি বাস্কেটটা থেকে সব জামাকাপড় ভেতরে দিয়ে দেয়। মেপে লিকুইড ডিটারজেন্ট দেয়। জলের কল খুলে দেয়। সুইচ দিতেই মেশিন ঘটর ঘটর শব্দে চালু হয়ে যায়।
এরপর দ্বিতীয় কাজ। দাদার ঘরে ফ্যানটা চলছে একা একা, দাদা রোজ ফ্যান লাইট অফ করতে ভুলে যায়। বকাও খায়। ও ফ্যানটা অফ করে, ঘুরে ঘুরে দেখে বাড়ির কোথাও আর কিছু অন হয়ে নেই তো‌। মেইন দরজার পাশের সুইচ বোর্ডে দুটো সুইচ এমনি এমনি অন দেখেই ও অফ করে দেয়। কিন্তু কী জ্বলছিল বুঝতে পারে না। কিছুই তো অফ হল না।
এবার একটু পড়াশোনা, কিন্তু কিছুক্ষণ পড়াশোনা করলেই তিতলির খিদে পায়, অতঃপর ও ফ্রিজে হাত দেয়। একটা আধখাওয়া ডেয়ারি মিল্ক ছিল। ওটা বার করতে গিয়েই বিষয়টা দেখতে পায় তিতলিনিশ্চয় এটা সবিতা মাসির কাজ, দরজায় ছ’টা ডিমের মধ্যে তিনটেই ফাটা, প্রথমে ও ভেবেছিল সেদ্ধ ডিম। খাবে ভেবে একটা ছুলতে গিয়েই বুঝতে পারে ওটা কাঁচা। তাড়াতাড়ি ডিমটা রেখে দেয়। ফাটা ডিমগুলো দেখতে মোটেই ভালো লাগছে না। কী মনে করে বাকি দুটো ফাটা ডিমকেও উলটে দেয়। এবার দেখতে ভালো লাগছে।
তখনই ওর চোখ পড়ে কাচের বাটির দিকে। ওটা দই-এর বাটি। দই নেই, ফাঁকা দই মাখা বাটিটা না মেজে কে যেন ফ্রিজেই রেখেছে। ও বাটিটা বার করে দেয় সিঙ্কে। সবিতা মাসিটা খুব ফাঁকিবাজ হয়েছে, এখনও এলো না! ফ্রিজে দুধ ছিল এক বাটি। মা এই দুধ দিয়ে মাসিকে দই পাততে বলেছিল যাওয়ার আগে, শুনেছিল তিতলি। দই পাততে ও দেখেছে একদিন। দুধটা মাইক্রো ওভেনে একটু গরম করে সাদা সাদা কী যেন মেশাচ্ছিল সবিতা মাসি। সাদা কী হতে পারে? একটু চিন্তা করেই তিতলি বুঝতে পারে ওটা নুন। চিনিও সাদা, কিন্তু চিনি হবে না। তাহলে দইটা খেতে মিষ্টি হত। দই তো টকটক স্বাদ। ও দুধটা বার করে এক মিনিট গরম করে দু-চামচ নুন দিয়ে একটা প্লেট চাপা দিয়ে দেয়‌। মা এলে বলবে যে আজ সব কাজ ও করেছে।
স্নান করে তোয়ালেটা বারান্দায় মেলতে গিয়ে দড়িটা কীভাবে যেন ছিঁড়ে গেল! কী আর করা যাবে, এটা তো অনেক উঁচু। ওর হাত যাবে না। পাশের ফ্ল্যাটের কাকুটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। ওকে দেখে হাসল।
মা বলেছে বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে নয়। তাই ও ছুটে ঘরে চলে আসে।
কিছুক্ষণ কার্টুন দেখার পর ওর খেয়াল হয় সবিতা মাসি আসেনি। আজ বোধহয় ডুব মারবে। মা কিন্তু যাওয়ার আগে সবিতা মাসিকে বারবার বলে গেছিল তিতলি একা আছে, একটু তাড়াতাড়ি আসতে। কিন্তু মাসি না এলে ও খাবে কী? রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখল মা ডিপফ্রিজ থেকে বার করে মাছগুলো ভিজিয়ে রেখেছে। একটা বাটিতে দুধের প্যাকেট রেখেছে। তবে ওটা এখনও বরফ। আচ্ছা মাছ যখন ভিজিয়েছে, দুধটা ভেজায়নি কেন? নিশ্চয় ভুলে গেছে। ও বাটিটায় জল ঢেলে দিল। কিন্তু দুধ তো প্যাকেটে, গলবে কি? ও একটা পিন দিয়ে দুধের প্যাকেটের গায়ে ক’টা ফুটো করে দিল। এবার ঠিক গলে যাবে।
তারপর বারান্দায় গিয়ে রিমাদের ফ্ল্যাটের দিকে উঁকিঝুঁকি মারা শুরু করল, যদি রিমার দেখা পাওয়া যায়, গল্প করবে বলে। কিন্তু দেখতে পেল না।
দুপুর একটা, তিতলি ফ্রিজে দেখল একটু বাসি ভাত আর দু-পিস চিকেন রয়েছে কালকের। ও ওটাই মাইক্রো ওভেনে গরম করে খেল। দুধটা এখনও দই হয়নি। আরেকবার অল্প গরম করল ও।
এবার একটু পড়াশোনা করে টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছিল ও নিজেও জানে না।
হঠাৎ দুম দুম করে দরজা ধাক্কানোর শব্দে ও লাফিয়ে ওঠে। কাঁচা ঘুম ভেঙে ও কোথায় রয়েছে বুঝতেই কয়েক সেকেন্ড কেটে যায়। কার্টুন চলছে এখনও। আবার দরজার শব্দ। দৌড়ে গিয়ে আইহোলে চোখ রাখে সে। মা আর দাদা চলে এসেছে। দরজা খুলতেই মা বলে, “বেলের সুইচটা কে বন্ধ করল? বেল বাজছে না কেন?
তিতলি অবাক, বেলের সুইচ আবার কোনটা?
মা সুইচবোর্ডের কোণের সুইচ দুটো অন করে বেশ রাগি চোখে তাকিয়ে বলল, “এই দুটো। একটা উপরের একটা নীচের গেটের বেল‌। সবিতা এসেছিল?
“না তো,” তিতলি বলে। তারপর বলে, “তাতে আমার অসুবিধে হয়নি। ফ্রিজে ভাত ছিল, চিকেন ছিল, খেয়েছি। তোমার সব জামাকাপড় মেশিনে কেচে দিয়েছি। দই পেতে রেখেছি।”
ওর মা ব্যাগটা টেবিলে রেখে ফ্রিজ খুলতেই আঁশটে গন্ধে ছিটকে সরে আসে। ফ্রিজের দরজার গায়ে হলুদ হলুদ ডিমের কুসুম মাখামাখি।
“হে ভগবান, এই ফাটা ডিমগুলো কে উলটে রাখল?” মায়ের চিৎকারে কাঁচুমাচু মুখে তিতলি বলে, “সরি... মানে এটা আমি করেছি। দেখতে কেমন যেন লাগছিল।”
মা সসের বোতলগুলো বার করে সিঙ্কে রাখতে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “দই-এর এই বাটিটা কে নামাল? এটায় তো গরম দুধ দিলেই দই হত। সাজা রাখা ছিল।”
“খালি দই-মাখা বাসন দেখে আমিই নামিয়েছি। আর বাকি দুধটা দিয়ে দই পেতেছি।” তিতলি বিজ্ঞের মতো বলে।
মাইক্রো ওভেন থেকে দুধের বাটি হাতে নিয়ে ওর মা বলে, “দই পড়েনি! কী সাজা দিয়েছিলি তুই?
মুখটা কাঁচুমাচু করে তিতলি বলে, “সবিতা মাসি সাদা সাদা কিছু দেয়। আমি লবণ দিয়েছি দেড় চামচ।”
রমিতা আর কিছু বলার আগেই চোখ যায় একটা বড়ো বাসনে দুধের প্যাকট ভাসছে, দুধ জলে মিলে ঘোলা হয়ে আছে পাত্র। সেটা দেখাতেই তিতলি বলে, “দুধটা বরফ হয়ে ছিল। তাই জলে ভিজিয়েছি। প্যাকেটের গায়ে ক’টা ফুটো করেছিলাম যাতে তাড়াতাড়ি বরফ গলে।”
তখনই তিতলির দাদা গুবলুর চিৎকারে ওরা ছুটে যায়। ওয়াশিং মেশিনের ভেতর একগাদা কাচা কাপড়, গুবলুর দুটো সাদা গেঞ্জিতে লাল গোলাপি সবুজ ছোপ। ও চেঁচাচ্ছে, “মা দেখো। বুনু কী করেছে? আমার স্কুলের শার্ট রঙিন হয়ে গেছে। ও যেসব কাপড়ে রং ওঠে তাও মেশিনে দিয়ে কেচেছে। ওদিকে বারান্দার দড়ি ছেঁড়া।”
ওদের মা রমিতা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে, তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। সবিতার ফোন, ধরতেই সে বলে, “বউদি ফিরেছ? আমি দু-বার ঘুরে এসেছি। বেল বন্ধ ছিল মনে হয়। উপরেই উঠতে পারিনি। নীচের কোলাপসিবল বন্ধ। তাও সেটা ধাক্কালাম। কেউ খুলল না। তিতলিকে তোমরা নিয়েই গেছিলে?
“তুমি ফোন করোনি কেন যখন বেল বাজালে?” কঠিন স্বরে বলে রমিতা।
“ফোনে রিচার্জ ছিল না বৌদি। এই রামের দোকানে এসে টাকা ভরলাম।”
কী আর বলবে রমিতা। আর কী কী কাজ মেয়েটা করেছে দেখতে হবে এবার।
তখনই মনে পড়ল সিঙ্কে মাছ ভিজিয়ে গেছিল, এতক্ষণে পচে গন্ধ ছাড়ার কথা। কিন্তু... ছুটে গিয়ে সে দেখল সিঙ্ক ফাঁকা।
তিতলি বিজ্ঞের মতো বলল, “সবিতা মাসি আসেনি বলে মাছ আমি ফ্রিজে তুলে দিয়েছি‌। পচে যেত না!”
এবার হেসে ফেলে রমিতা, মেয়েটা কাজের কাজ করেছে। ছোটো বলে হয়তো কিছু ভুল করেছে, কিন্তু একা বাড়িতে একটা গোটা দিন কাটিয়ে ফেলল এভাবে। ভয় পায়নি একটুও। মেয়েকে কাছে টেনে রমিতা বলল, “তুইও বড়ো হয়ে গেছিস আজ থেকে। আর আমার চিন্তা নেই। এবার কাজগুলো একটু শিখে নিলেই চলবে।”
“তাহলে খাবারটা গরম করে ফেল এবার, মা চাইনিজ এনেছে দেখ।” গুবলু মিটিমিটি হেসে বলে ওঠে। তিতলি মনের আনন্দে খাবারের প্যাকেট নিয়ে কিচেনে ছোটে।
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী

1 comment:

  1. খুব ভাল লাগল গল্পটা। আমি তো চিন্তায় পড়ে গেছিলাম, তিতলি কি কাণ্ডই না করছে।

    ReplyDelete