
ভুলের মজা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
শুক্রবার এলে ঋকের
মনের ভেতর খুশি মাপার যে যন্ত্রটা আছে, সেটার
রিডিং একটু একটু করে বাড়তে থাকে। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে যে সে খুশি থাকে না তা
নয়, তবে সেসব দিনগুলোতে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে।
প্রথমেই হচ্ছে
স্কুলের কথা। স্কুল মানেই তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা, চটপট
স্নান সেরে গপাগপ খেয়ে নেওয়া, ফটাফট ইউনিফর্ম পরে রেডি হওয়া
এবং স্কুলবাসের জন্যে ঝটাঝট বাসস্ট্যান্ডে যাওয়া।
এ তো গেল স্কুল
পর্ব। এরপর স্কুল থেকে ফিরে কিছু খেয়েই কোনোদিন ক্রিকেট কোচিং তো কোনোদিন সাঁতার
বা কোনোদিন টিউশন স্যারের কাছে পড়া। এসব মিটলে স্কুলের হোমওয়ার্ক করা। দিনটা যেন
আলোর গতিবেগে পার হয়ে যায়। ঋক যখন রাত্রে শুতে যায় তখন ওর মনে হয় এবার বড়ো করে
শ্বাস নেওয়া যাবে। এতক্ষণ যেন শ্বাস আটকে ছিল।
ঋককে সবাই ভালো
ছেলে বলে, কারণ ও বড়োদের কথা শোনে। ঠাম্মা যদি বলে, “ঋকুবাবু,
বাইরে থেকে ঘুরে এসে হাত তো ধোবেই, তার সঙ্গে
পাও ধোবে, কেমন?” ঋক সেটা শোনে।
বাবা খুব একটা সময়
পায় না, তাই ঋকের সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন রাত্তির হয়ে যায়। তাই বাবা খুব একটা কিছু
বলে না। কেবল পড়ার খবর নেয়। “স্যারের পড়ানো বুঝতে তোর অসুবিধে হয় না তো?
কোথাও অসুবিধে হলে বলবি।” কোনোদিন জানতে চায়, “পরীক্ষা
কবে থেকে?” একদিন ওর বাবা বলেছিল, “ঋক,
সময় পেলে দাবা খেলবি। ব্রেন খোলে এই খেলায়। চিন্তাশক্তি, ধৈর্য সব বাড়ে। আমি তোকে শিখিয়ে দেব।” দাবা খেলা শিখিয়েছে বাবা, কিন্তু
কিছু কিছু চাল ঋকের কঠিন লাগে।
ঋকের সব থেকে বেশি
কথা হয় মায়ের সঙ্গে। “ঋক উঠে পড়, ঋক স্নানে যা, ঋক খেতে আয়, ঋক স্কুল ব্যাগ গুছিয়ে নে, টিফিন বক্স ঢোকা, ওয়াটার বটল নিয়েছিস? মোজা বারান্দায় মেলা আছে, নিয়ে পরে নে...” সারাদিন
চলতেই থাকে মায়ের নির্দেশ। ঋক মায়ের বলা কথাগুলো শোনে। ও দেখেছে, কথা শুনলে বকা খেতে হয় না, কিছু চাইলে পাওয়াও যায়।
ওর বন্ধু সৌমিত বলে,
“বাড়িতে সবাই আমাকে বকে। আমার ভাল্লাগে না।”
“কেন বকে?” ঋক জানতে চায়।
“খালি খালি এই কর
ওই কর বলে, সব কি করা যায়? তাই
বকে।”
ঋক বলে,
“তুই যদি বড়োদের কথা শুনিস, তাহলে আর কেউ বকবে
না দেখবি।”
শুক্রবার এলেই যে
ঋক খুশি হয় তার কারণ হল, পরের দু-দিন ছুটি। শনিবার আর
রবিবার। শনিবারটা খারাপ লাগে না ঠিকই, তবে স্কুল ছাড়া বাকি কাজগুলো থাকে। স্কুল
থাকলে যে সময়ে ঘুম থেকে ওঠে, শনিবারও সেই একই সময়ে উঠে পড়ে
ঋক। ওর বাবা মর্নিং ওয়াকে যায়, ঋকও যায় সঙ্গে। সেখান থেকে
ফেরার পথে ওর বাবা বাজার করে, ঋকও শিখছে কীভাবে সবজি বাছতে
হয়, দরদাম করতে হয়। ভালোই লাগে ওর।
বিকেল সাড়ে তিনটেয়
সাঁতারে যায় ঋক। এখন আর নভিস নেই ও, বড়ো পুলেই
সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটতে খুবই ভালো লাগে ঋকের, কিন্তু তার পরে যা খিদে পায়,
সেটা সহ্য হয় না ওর। মনে হয় সামনে যা পাবে, তাই
খেয়ে নেবে।
এরপর বাড়ি ফিরে
অঙ্ক স্যারের কাছে পড়া। স্যার খুব ভালো অঙ্ক করান। কিন্তু ভীষণ রকম ব্যস্ত থাকেন
বলে কেবল শনিবার দিনই ঋককে পড়াতে আসেন। টানা দু-আড়াই ঘণ্টা অঙ্ক করান।
অঙ্ক স্যার চলে
গেলে মা খেতে দেয়। খাওয়া হয়ে গেলে হোম ওয়ার্ক নিয়ে বসে ঋক। রবিবারের জন্যে কিচ্ছু
ফেলে রাখে না ও। রবিবার দিনটা খুব স্পেশাল ওর কাছে। শনিবার তাই ঋকের খুশির রিডিং
বেশ উঁচুর দিকেই থাকে।
রবিবার দিনের
পুরোটাই ঋকের ইচ্ছেমতো কাটানোর দিন। ওর মা বাবা আগেই বলে রেখেছে,
“সোমবার থেকে শনিবার যদি তুই সব কাজকর্ম ঠিকঠাক করিস, তাহলে রবিবারটা নিজের মতো করে কাটাবার পারমিশন দিয়ে রাখলাম। সেই দিন তোর
যা ইচ্ছে, যেভাবে ইচ্ছে কাটাস।”
রবিবার তাহলে ঋক কী
করে? একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। বেশি দেরি করে না,
তাহলে সুন্দর দিনের অনেকটা চলে যাবে। অন্যদিনের থেকে আধঘণ্টা দেরিতে
ওঠে। তারপর ও ছাদে যায়। ছাদে অনেক গাছ আছে। ঠাম্মা খুব গাছ ভালোবাসে, নিজে
হাতে যত্নও করে। সেই গাছে অনেক রকমের ফুল ফোটে। প্রজাপতি, ফড়িং
ঘোরাঘুরি করে। ঋকের ভারি মজা লাগে দেখতে।
রবিবার ঋকের
পছন্দমতো খাবার খাওয়ার পারমিশন আছে। তবে দিনে একবারই এবং একই খাবার মাসে একবারের
বেশি নয়। ঋক কথা শোনে। বিরিয়ানি, মিক্সড চাউ, পিৎজা
আর ধোসা... এই চারটে পছন্দের খাবার চার রবিবার খায় ঋক। আর যদি কোনো মাসে পাঁচ
নম্বর রবিবার পায় তাহলে বোনাস পাওয়া। সেই রবিবার এগ চিকেন রোল খায়।
এ তো গেল খাবারের
কথা। রবিবারে আর কী করে ঋক? একটা সিনেমা দেখার পারমিশন থাকে।
ওর দেখার উপযুক্ত সিনেমার লিস্ট বাবা করে দিয়েছে। সেগুলোর থেকে একটা করে সিনেমা
দেখে ঋক। তাছাড়া, রবিবার যদি ফুটবল বা ক্রিকেটের
ইন্টারেস্টিং খেলা কিছু থাকে, বাবার সঙ্গে বসে ঋকও খেলা
দেখে। উফ, রবিবারের মজাই আলাদা!
শনিবার রাত থেকেই
আনন্দের গুড়গুড়ানি শুরু হয় ঋকের মনে। রবিবার রাতে শুতে যাবার সময় দিনটাকে থ্যাঙ্ক
ইউ জানিয়ে পরের রবিবারের অপেক্ষায় থাকে সে।
এর মধ্যে ঋকের পিসি
পিসা আর রাকাদিদি এল ওদের বাড়িতে। ওরা লক্ষ্ণৌতে থাকে। ঋকের জন্যে জামা নিয়ে
এসেছে। বাবা আর মায়ের জন্যেও গিফট এনেছে। বাড়িতে হই হই। বাবা অনেক রকম মাছ আনছে
বাজার থেকে। পিসি যা যা খেতে ভালোবাসে, মা সেসব
রান্না করছে। খাওয়াদাওয়া ভালোই হচ্ছে। তবে ঋকের ডেইলি রুটিনে একটু গড়বড় হয়ে
যাচ্ছে।
কাল অনেক রাত অবধি
গল্প হয়েছে। রাকাদিদির সঙ্গে দাবা খেলতে খেলতে ঋকেরও ঘুমোতে দেরি হয়ে গেছে। নানা
রকম আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখে যখন ঋকের ঘুম ভাঙল, মনটা হঠাৎ
খারাপ হয়ে গেল ওর। ইস, আজ রবিবার!
অন্য সময়ে শনিবার দিনই
ও সোমবারের জন্য ব্যাগ গুছিয়ে, ইউনিফর্ম বের করে,
জুতো পালিশ করে গুছিয়ে রেখে দেয় যাতে রবিবার ওকে এসব নিয়ে ভাবতেই না
হয়। কাল হই হই-এর চক্করে কিছুই করা হয়নি। তাছাড়া কী খাবে না খাবে, কোন মুভি দেখবে, সেও ঠিক করে রাখা হয়নি। আজকের দিনের
অনেকটা নষ্ট হবে। মন খারাপ হয়ে যায় ঋকের।
মুখ ধুয়ে ডাইনিং
রুমে এসে ঋক দেখল বাবা আর পিসা বসে গল্প করছে। পিসি আর রাকাদিদিকে দেখতে পেল না ও।
মনে হয় ঘুমোচ্ছে। ঋক ঠিক করল, আজ ধোসা খাবে।
রাকাদিদি যদি খায় তাহলে দুটো আনাবে। এখন খাবার আনানো খুব সহজ। কত অ্যাপ আছে। বাবার
মোবাইলে খাবারের দুটো অ্যাপ ইনস্টল করা আছে। তার একটা থেকেই খাবার আনায় ঋক। আজ
সকালে ছাদেও যাওয়া হল না ওর। ধুস...।
রান্নাঘরের দিকে
গেল ঋক। মাকে জিজ্ঞেস করতে হবে রাকাদিদির জন্যে ধোসা আনবে কিনা। সেখানে গিয়ে দেখল
মা আর পিসি গল্প করতে করতে কাজ করছে। মা চিঁড়ের পোলাও করছে। এ বাবা,
রবিবার তো লুচি হবার কথা!
“আরে ঋকবাবু যে,
গুড মর্নিং!”
“রাকাদিদি কি ধোসা
খাবে পিসিমণি?”
“একদম খাবে,
খুব খুশি হয়ে খাবে। আবার চিঁড়ের পোলাও খেতেও ভালোবাসে রাকা। বৌদি
চিঁড়ের পোলাও করছে, তুই খাবি না?”
“মা,
আজ লুচি করছ না কেন? আজ তো রবিবার।”
“আজ কেন রবিবার হবে,
আজ তো শনিবার। কাল লুচি হবে। তোর দিন গুলিয়ে গেছে ঋকুসোনা।” মা হেসে উঠল।
আজ শনিবার?
মনের মধ্যে কোথাও যেন খুশি-ময়ূরটা পেখম মেলার তোড়জোর শুরু করল।
আরেব্বাস! তাহলে তো আজ চিঁড়ের পোলাও খাবে, কাল বিরিয়ানি অর্ডার
দেবে। ওহ, কী মজা লাগছে যে বলার না। কিন্তু আজ বাবার সঙ্গে
মর্নিং ওয়াকে যাওয়া হয়নি। বাবা কি একাই ঘুরে এসেছে? ওকে
ডাকেনি?
“বাবা,
তুমি মর্নিং ওয়াকে গেছিলে আজ?”
“নাহ,
আজ যাইনি। কতদিন পর সায়ন্তনদারা এসেছে, গল্প
করছি। আজ তোকেও আর সাঁতারে যেতে হবে না। রাকা বোর হবে।”
“কী মজা,
কী মজা... আজ হোমওয়ার্ক শেষ করে, সব গুছিয়ে
রেখে রাকাদিদির সঙ্গে দাবা খেলবে। ওহ, আজ বড্ড ভুল হয়ে
গেছিল। শনিবারকে ভাবছি রবিবার! ওহ, যেন ডবল মাটন বিরিয়ানি
খাচ্ছি মনে হচ্ছে। ভুলেরও মজা আছে।”
“ঋক,
রাকাদিদিকে ডেকে নিয়ে খেতে আয়।” মা ডাকছে। লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে
উঠে রাকাকে ডাকতে গেল ঋক। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে ওর আজ।
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত
খুব সুন্দর, মন ভাল করা গল্প। আর এমন ভুল আমার তো হরহামেশাই হয়। আমার আবার কখনও কখনও উল্টোটাও হয়, যেমন সোমবারকে রবিবার ভাবা। তখন সে এক বিপত্তি। ছবিটাও খুব সুন্দর।💝💝
ReplyDelete