ম্যাজিক ল্যাম্প:: শারদীয় ২০২৫

একাদশ বর্ষ।। প্রথম সংখ্যা।। অক্টোবর ২০২৫
শারদ সংখ্যা ১৪৩২
-------------------
  
প্রচ্ছদ: মৃণাল শীল
----------

সম্পাদকীয়:: শারদ সংখ্যা ২০২৫


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,
কেমন আছ সবাই?
এখন তো মন ভালো করারই সময় শারদ উৎসবে মেতে ওঠার সময় আমরা যারা এখন অনেকটা বড়ো হয়ে গেছি তাদের কাছে পুজো মানে ছিল নীল আকাশ, পেঁজা মেঘ, ঢাকের বাদ্যি, সমস্ত পরিবার এক ছাদের তলায় হই হই আড্ডা, দেদার মজা এখন দূষণের কারণে আকাশটা সবসময় শরতের নীল মেখে থাকে না সেই আকাশটা আমি বড্ডো মিস করি তবে দূরের গ্রামের পুজোয় এখনও তোমরা প্রকৃতির সেই রূপ দেখতে পাবে হয়তো সেখানে শহরের মতো এত জাঁকজমক নেই, কিন্তু আনন্দ আছে ঢের বেশি
আরেকটা জিনিসের কথা তোমাদের মনে করিয়ে দিই বাঙালিদের কাছে কিন্তু পুজোর একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল শারদ পত্রিকাগুলো ওগুলো না হলে পুজো পুজো মনেই হয় না কিন্তু দেশে বিদেশে সব জায়গায় তোমার মনের মতো শারদ পত্রিকাগুলো পাবে না সেক্ষেত্রে দুঃখ কোরো না মোটেই ম্যাজিক ল্যাম্প আছে তো আছে মন ভালো করা সব দুর্দান্ত গল্প ছড়ার সম্ভার
আমাদের কিন্তু জানাতে ভুলো না, কেমন লাগছে তোমাদের ম্যাজিক ল্যাম্প
এই শারদ সংখ্যাটি সাজিয়ে গুছিয়ে তোমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন তাপস মৌলিক আর ম্যাজিক ল্যাম্পের অনবদ্য প্রচ্ছদটি এঁকেছেন শিল্পী মৃণাল শীল
তাহলে আর দেরি নয় পড়তে শুরু করে দাও তোমাদের প্রিয় ওয়েব ম্যাগাজিন ম্যাজিক ল্যাম্প
শারদ শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিও বন্ধুরা
ইতি,
জিনি
----------
ছবি - আন্তর্জাল

গল্প:: লাঠি - সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত


লাঠি
সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত

চারদিকে চারটে ছোটো খুঁটি পুঁতে কাপড়ের একটা ছোটো তাঁবুমতো তার মধ্যে লোকটা ঝিমোচ্ছিল
দোষের মধ্যে শুধু উঁকি মেরেছিলাম তারপর গদগদভাবে বলেছিলাম,ইয়ে স্যার, মানে ভবিষ্যৎ বলেন? মানে...”
তড়াক করে লোকটা উঠে হাতের কাছে একটা বড়ো লাঠি তুলে বলল,এই... বেরো... বেরো... বেরো বলছি হতভাগা... না হলে...”
একে ওইরকম কাপালিকের মতো চেহারা প্রায় এক মিনিট ছুটেছিলাম তারাপীঠ শ্মশানের আর কাউকে ঘাঁটানোর সাহস পাইনি কোনোদিনএসব কলেজ-জীবনের ঘটনা
আসলে বড়ো জানতে ইচ্ছে করে কী হবে শুধু তা নয়, আগে কী হয়েছিল জন্মান্তরে বিশ্বাস করব না কেন? স্বামীজি বলেছেন, আছে বুদ্ধ অমন যুক্তিবাদী, তিনিও জাতকে আটকা পড়লেন তবে আমি জানতে চাইলে দোষ হবে কেন? আমি সামান্য মানুষ বলে? চেহারা, আকৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, লেখাপড়া, চাকরি, রোজগার, সব সাধারণ বলে? এটা কোনো কথা? বেশ আগের জন্মেও না হয় কেরানি ছিলাম, কোথায় ছিলাম সেটা জানতে দোষ কী? যত সব...
বাবা মারা যাওয়াতে বিপদে পড়েছিলামভাগ্যের জোরে চাকরি একটা জুটল সাধারণ বটে, তবে বেঁচে থাকা যায় মা-ছেলেতে মা কয়েকদিন বাদে বলে দিল, “এবার বিয়ে করতে হবেআমি তো অবাক এই রোজগারে বিয়ে? মা মেজাজ করল, তারপর বলল,একমাত্র বিয়ে করলেই তবে আগের জন্মের কথা মনে পড়বে এটা কোনো কথা? মা আগের জন্মের ব্যাপারটা জানত
বিয়ে-শাদি বেশ ভয়ের ব্যাপার আমার কাছে অতি নিরীহ বলে বন্ধুবান্ধবও বিশেষ জোটেনি আমার কোনোকালে যেটুকু জুটেছিল, সব ম্যাদামারা আর স্বার্থপর লোকজন মূলত এড়িয়েই চলি আমিবইপড়া আর সিনেমা দেখা ছাড়া জীবনে আর কোনো কিছুতেই আগ্রহ নেই আমার এভাবে যদি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি কোনোমতে, আমাকে আর পায় কে? মা চেঁচামেচি করে, আমি কানে তুলো গুঁজে কোনোমতে খেয়ে অফিস দৌড়োই বাড়িতে সময়টুকু বই মুখে থাকিদিব্যি কাটছিল কিন্তু
পাগলিকে দেখেছিলাম খন্যান স্টেশনে ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে হাসছে আমাকে ইশারায় ডেকেছিল পাঁচটা টাকা নিল কম করল না তারপর বলল, “...! এদিক নেই ওদিক আছে যা ভাগ, নইলে লাঠির বাড়ি মারবসত্যি হাতে একটা লাঠিমতো ছিল তবু ইয়ার্কি মেরে বললাম,কী ছিলাম গো?” বলেই ছুট
ট্রেন যখন ছাড়ছে, তখন দাঁত বের করে হেসে বলল,আচ্ছা, নালন্দায় যাস একবার... যদি কিছু হয়
মা না থাকলে হয়তো চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়তাম কোনোমতে সামলালাম বর্ধমানে যাচ্ছিলাম মামাতো বোনের বিয়েতে বিয়ের আনন্দ মাথায় উঠল সারাক্ষণ মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করল,নালন্দা... নালন্দা...তাহলে নালন্দায় ছিলাম? নাকি পাগলের পাগলামি? পাগলির বয়েস বেশি বলে মনে হয়নিঅন্য কেউ?” ফেরার সময়ে রীতিমতো জ্বর এল তেড়ে

নালন্দায় একটা গাইড নিয়েছিলামঘুরে-টুরে সব দেখাল যত্ন করে পাভাপুরীতে মহাবীরের সমাধি দেখা হলে তার টাকা মিটিয়ে দিলাম রাতে হোটেলে ফিরে এসে আকাশ-পাতাল চিন্তা এল সবই দেখলাম তো বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম, হিউয়েন সাং মেমোরিয়াল, অশোকের করা স্তূপ আঁতিপাঁতি করেও মনের কোণে কিছু এল না কেন এল না? হতচ্ছাড়ি, পাগলি কোথাকার! ফালতু ভোগাল জায়গা একটা দেখা হল বটে, কিন্তু আসল কাজ হল কই?
দূর, সব মিথ্যে ওসব হলেও জানা আমার কর্ম নয় সেসব পুণ্যাত্মা মহাপুরুষদের ব্যাপার কোনো মানে হয় না এর পেছনে পড়ে থাকার
রাতে হিউয়েন সাং-এর লেখা পুথি, পাগলি, নালন্দার সিঁড়ির ধাপ সব একাকার হয়ে দেখা দিল পাগলি আবার দেখি লাঠি তুলে শাসাচ্ছেবলছে,আয় একবার...”
পরের দিন আর গাইডের চক্করে গেলাম না নিজেই ঘুরে ঘুরে সব দেখছি কিছুই মনে হচ্ছে নামিউজিয়ামও ফের একবার গেলাম শেষে ক্যান্টিনের ভেজ থালি খেয়ে হতাশ হয়ে ধ্বংসাবশেষের সিঁড়িতে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম এই সময়েই সে এল
চটকা আচমকা ভাঙতে দেখি, সে হাসছে আমার দিকে তাকিয়েবৌদ্ধ শ্রমণের পোশাক মেরুন রঙের ন্যাড়া মুন্ডি বেশ লম্বা-চওড়া, কিন্তু বয়স্ক মিটিমিটি হাসছে খুদি খুদি চোখ মেলে
এখানে অবশ্য কমতি নেই এদের এদেশ, বিদেশ, সব দেশেরই রয়েছেদু-একজনের সঙ্গে তো আসা-ইস্তক টুকটাক কথাও বলেছি এর সঙ্গে যদিও বলিনিএকে নতুন দেখছি
বললাম, “হিন্দি? ইংলিশ?”
সে হাসল তারপর দূরে দেখাল আঙুল তুলে
তাকালাম সেদিকেকিছুই নেই নালন্দার ধ্বংসাবশেষ কিছু ট্যুরিস্ট এক-দুটো বৌদ্ধ ভিক্ষু আজ কেন জানি না, লোক কম
আবার তাকালাম এদিক-ওদিক কোথাও কোনো কিছুর সাড়া নেই একই শান্ত, নিস্তব্ধ পরিবেশ উৎসুক হয়ে তার মুখের পানে তাকালাম
বললাম, “কী বলতে চাও?”
সে হাসল আবার একইভাবে আঙুল তুলল সামনের দিকে
না, পাগলের কাণ্ড নয় একটা কিছু হচ্ছে, এবার টের পেলাম একটা আওয়াজ
অনেক লোকের পায়ের শব্দ? মৃদু গুঞ্জন? যা আস্তে আস্তে বাড়ছে?
আরও একটা আওয়াজ ঠক, ঠক, ঠক,... ঠক... ঠক... ঠক...’
কোথায় শুনেছি আওয়াজ? কোথায়?

ঠক, ঠক, ঠক…’
আওয়াজ করছে চণ্ডাল চণ্ডাল আহই শ্মশানে তার বাস
এই মহাজনপদটি অতি স্পর্শকাতর বৈদিক ধর্মকে ইদানীং যারা আঘাত হানছে, সেই জৈন মুনির দল আর সর্বোপরি ওই নাস্তিক শ্রমণ গোতমের বাহিনী তার প্রভাব এখনও পর্যন্ত এই জনপদটিকে স্পর্শ করতে পারেনি তাই চণ্ডাল যখন পথে হাঁটে, তাকে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে পথ চলতে হয় তার ছায়া যদি কারও গায়ে পড়ে, তাহলে তো সে হতভাগ্য মানুষটির জাত যাবে কাজেই, তাকে নিজেই তার ঘৃণ্য উপস্থিতির জানান দিয়ে চলতে হয় নইলে মৃত্যুদণ্ড
নগরীর মূল অংশে তার ঢোকা বারণকিছু জায়গায় সে যেতে পারে মাত্র, তাও লাঠি ঠুকতে ঠুকতে কাউকে স্পর্শ করা বারণ, এমনকি তার নিশ্বাসের বায়ুও ত্যাজ্য কিন্তু আজ আর তার উপায় নেইলাঠি ঠুকতে ঠুকতে সে ছুটছে
শ্মশানের ডোম সে রাত্রিশেষে ঘরে ফিরে এসে সে দেখছে, তার চার বছরের কন্যাটি অজানা রোগে ছটফট করে মরতে বসেছে মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে চোখের মণিদুটি ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে উঠতে বিলীন হয়ে যেতে বসেছেশ্মশানে যে -ঘর ডোম প্রতিবেশী, তারা ছুটে এসে জড়িবুটি, উষ্ণ স্নানযে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেকিছু ফল হয়নি অবশেষে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা শুরু করেছে সবাই
নগরীর দ্বার ভোর হতেই খুলে দেওয়া হয় তখন প্রান্তিকরাও ঢুকতে পারেআহই আর দেরি করেনি লাঠি ঠকঠকিয়ে সে ছুটেছে কারও বারণ শোনেনি
আহই ছুটছে সবাই তটস্থ কী আপদ! ভোরবেলা এতটুকু শুচি থাকার উপায় রইল না? পাগল কী চায়? দাও... দাও... দিয়ে দাও রাজার মুকুট চাইলে অবশ্য কারাগারে ভরো রাজকন্যাকে চাইলেও
নাগরিকদের কটূক্তি, উপহাসের জবাব দেবার পরিস্থিতি নেই আহই-এর সে ছুটছে পূর্বদিকে রাজবৈদ্য চক্রায়ুধের গৃহ যদি তাকে আনা যায় কোনোভাবে সেটা যে কত অসম্ভব, সে হুঁশ আর তার নেই
চক্রায়ুধ বর্ষীয়ান ব্রাহ্মণ গঙ্গাস্তব, সূর্যস্তুতি সেরে সবে গৃহদেবতার অর্চনা শুরু করেছেন, আহই এসে আছড়ে পড়ল দুয়ারে
একে পুজায় বাধা, তায় সাতসকালে চণ্ডালের দর্শন ব্রাহ্মণের ক্রোধ সীমা ছাড়াল
তুই দূর ... দূর …”
ঠাকুর, একটু ওষুধ, একটু চিকিৎসা... বেঁচে যাবে মেয়েটা সারাজীবন খেটে দেব
সামনে রাজপরিবারে বিবাহ এখন যদি সমাজ একঘরে করে, অত দানসামগ্রী, অত দক্ষিণা সব ভন্ডুল হয়ে যাবে সর্বোপরি, -পাপের প্রায়শ্চিত্ত-বিধি-বিধান করতে করতে জীবন কেটে যাবেরাজপরিবারের অনুগ্রহের বলয় থেকে চিরতরে বিতাড়িত হবেন -বয়সে দুটি সংসার, এতগুলি সন্তান...
ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠে লাঠি তুললেন চক্রায়ুধ মর মর, সব মর... ঝাড়েবংশে পাপের দল... তোর মেয়ে মরবে না তো কার মেয়ে মরবে...”
এটুকুরই দরকার ছিল আহই চণ্ডাল তার লাঠি তুলল

*            *            *

সারারাত মহামন্ত্রী চরের সঙ্গে গোপন আলোচনা ছিল আমার মগধরাজ তার রাজধানী নির্মাণ করতে চান অন্য নগরীতে, গঙ্গার তীরে কেন? রাজগৃহ কী দোষ করল? কি কোনো যুদ্ধের প্রস্তুতি? তাই রাজধানীকে কোনো সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে নিচ্ছেন বিম্বিসার?
আমাদের জনপদটি অপেক্ষাকৃত ছোটো সামরিক শক্তিতে দুর্বল তা জেনে আমরা গান্ধার রাজ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলি অর্থাৎ গুপ্তচরের অন্তর্জালিকাটি সুদৃঢ় করেছি দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে আমাদের চর যখন কোনো চর কোনো বিশেষ সংবাদ নিয়ে আসে, তখন রাজা হিসেবে আমার আর মহামন্ত্রী উদয়নের ঘুম চলে যায় একে বৈদিক ধর্ম যায়-যায় তায় যদি প্রজারা অসন্তুষ্ট হয় কোনো কারণে... তাহলে রাজ্য আর বংশানুক্রমিক রাজ্য থাকবে না লিচ্ছবিদের মতো মণ্ডলীপ্রধান গণরাজ্যে পরিণত হবে হয়তো আমার মুণ্ডটি যাবে
সকালে আলোচনা শেষে উদ্যানে সূর্যপ্রণাম সেরে অন্তঃপুরে যাব ভাবছি, সে-মুহূর্তেই নগর কোটাল এসে সমীপে দাঁড়াল উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি বেশবাস অসংলগ্ন

*            *            *

প্রাসাদ সংলগ্ন উদ্যান যেন ভরে গেছে গোটা রাজ্যবাসীতে এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি চণ্ডালের হাতে ব্রাহ্মণের নিগ্রহ তায় রাজবৈদ্য স্বয়ং? উত্তেজিত জনতা চায়শিরশ্ছেদ, এই মুহূর্তে
আমার মন মানে না ব্রাহ্মণ গুরুতর আহত কিন্তু মরেননি অপরপক্ষে চণ্ডালেরও সংযম হারানোর কারণ রয়েছে দ্রুত কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেবার পক্ষপাতী আমি নই পিতা ছিলেন উগ্রচণ্ড শাসক মশানে বহু মাথা গড়াগড়ি গেছে এর থেকে লঘু অপরাধে আমি সে-পথে হাঁটি না, এই জন্য রানি আমার পুরুষকার কম বলে বিদ্রুপ করেন
মহামন্ত্রী এলে বুঝলাম, পরিস্থিতি গম্ভীর এখন এটি আর তুচ্ছ অপরাধ নয় এর প্রভাব গভীরভাবে বিস্তার করেছে রাজ্যেঅপরাধ ক্ষমা হলে বা লঘু শাস্তি হলে প্রজাদের মনে ভয় ঢুকবে বৈদিক ধর্ম যায়-যায় এখন -অবস্থায় যদি সেই শ্রমণ গোতমের ক্ষমাধর্ম প্রয়োগ করে বসি, তো রাজ্যে গোলযোগ দেখা দিতে পারে -রাজ্য গোঁড়া বৈদিক, সেই প্রাচীনকাল থেকেই
মানুষ বড়ো স্পর্শকাতর মহারাজ... প্রাণ যাবে, তবু জাতধর্মে আঁচ পড়তে দেবে নাবললেন উদয়ন
তাহলে সর্ব ধর্মসমন্বয় শুধু মগধ, কাশী, কোশলে? আর সাকেতে?”
উদ্ভ্রান্তের মতো আমি অন্তঃপুরে আসি রানি দিজিতা ভক্তিধর্মে অটল বলে পিতা তাঁকে নির্বাচন করেছিলেন রাজবধূ হিসেবে, হিমা রাজ্য থেকে সে-রাজ্য বৈদিক ধর্ম বাদে আর কিছু কখনও শোনেনিআবার রানির উগ্র, হিংস্র স্বভাবটি যেন পিতাঠাকুরের ছাঁচে বসানো
শিরশ্ছেদ হয়ে গেল চণ্ডাল আহই-এর আমি ঠেকাতে পারলাম না

দিন কেটে যায়, মাস
বর্ষায় খবর এল, মহামারি এসেছে বৈশালীতে
বৈশালীর দুর্দশায় সবাই খুশি মহামন্ত্রী তো বটেই, রানি দিজিতাও কেন-না, বৈশালী বুদ্ধের শরণাগত কী হল তা বলে? বলি, ঠেকাতে পারলে?”
আমি অসহায়ভাবে বলি, “তাহলে রোগ-অসুখ হয় কেন? তো থাকবেই মন্ত্রী চুপ করে যান রানির মুখ বিদ্রুপে, হিংস্রতায় আরও বক্র হয়ে যায় সন্তান না হয়ে তিনি এখন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন দিনে দিনে
বুদ্ধ যাবেন বৈশালী তিনি এখন আছেন কোশলরাজ প্রসেনজিতের কাছে তিনি অনুমতি চাইলেন আমাদের রাজ্যের ভেতর দিয়ে যাবার তাতে অতি দ্রুত পৌঁছোনো যাবে বৈশালীতে দূত পাঠিয়েছেন স্বয়ং রাজা প্রসেনজিৎ
রানি অনড় ওই বিধর্মীকে তিনি নিজ রাজ্যে প্রবেশ করতে দেবেন না নানা বুঝিয়েও যখন পারা গেল না, তখন বাধ্য হয়ে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম বললাম,বলে দাও, ওই সময় রাজ্যে বিবাহ আছে রাজা দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করবেন সময়ে তাই গোলযোগ ক্রুদ্ধ রানি ফুঁসতে ফুঁসতে অবশেষে মানলেন কথা বন্ধ করে দিলেন যদিও
সেদিনটি ছিল গুরুবার রাজদরবারে বসে তখন আমি তখনই আওয়াজটি পেলাম
গুমগুম... গুম... গুম...’ একসঙ্গে যেন সহস্র মাদলে ঘা পড়ছে মন্ত্রী উদয়নকে বললাম,কিছু শুনছেন?”
আওয়াজ এগিয়ে আসছে রাজদরবারে দৌড়ে এসে সেনাপতি খবর দিল,তথাগত বুদ্ধ এসেছেন তিনি রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাবেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই
উদয়ন শুনে বললেন,যাক, বাঁচা গেল আপদ যত তাড়াতাড়ি বিদেয় হয়!”
আমি চিন্তিত মুখে বললাম, “কিন্তু, আওয়াজটা কীসের?”
মন্ত্রী বললেন, কীসের আওয়াজ? , ওইটা? ওটা ওদের পায়ের আওয়াজ রাবণের গুষ্টি চলেছে না?”
আর কিছুক্ষণের মধ্যে আওয়াজটা কাছে এসে গেল কী মনে হল, আমি রাজপ্রাসাদ থেকে নেমে এলাম নীচে একবার দেখব না? এত নাম শুনেছি লোকে বলছে,যুগপুরুষ
সহস্র শ্রমণ চলেছে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে নির্বাক, নিশ্চুপ শুধু হাতের লাঠিটি ঠুকছে মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে আসছে তারা এই আওয়াজই পাচ্ছিলাম দূর থেকে
লাঠির আওয়াজে এত জোর? নাকি, আমার বিকার? মনমধ্যে এখনও সেই চণ্ডালের লাঠির আওয়াজ শুনতে পাই আমি ঘুমের ঘোরে আমি নাকি কেঁদে উঠি, বলেছে রানি চণ্ডালের নাম নিয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়লাম আমি? অচ্ছুত চণ্ডালের কন্যাকে বাঁচাতে পারিনি রাজা হয়েওসেই কারণে?
হাজার শ্রমণের লাঠির আওয়াজ কাছে চলে এসেছে বুক ফেটে যাচ্ছে যেন এত ঘা সহ্য হয়? ভিক্ষুর যষ্টির এত তেজ? জাতপাত, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সব ভেদ দূর করে কে এসেছে ভারতের বুকে? ঢাল নেই, তরওয়াল নেই, ন্যাড়ামাথা কতগুলি ভিক্ষুএত সাহস হয় কী করে তাদের? কে দিল এত সাহস? অস্পৃশ্য চণ্ডাল লাঠি বাজিয়ে পথ চলে, পাছে তার ছায়ায় অন্য উঁচু জাতের ধর্ম নষ্ট হয় কিন্তু এই দিব্যকান্তি মহামানব লাঠির ঘা মেরে আজ পথ চলেছেন কোন ভয়ংকরকে নষ্ট করতে?
ওই যে... ওই যে তিনি দীর্ঘ দেহ, বলিষ্ঠ বাহু, প্রশস্ত বক্ষ... কি ভিক্ষুর দেহকান্তি? বয়সের ছাপ নেই প্রায় কোঁকরা চক্রাকার কেশরাশি আহ্, চণ্ডাল আহই, তুমি দৃশ্য দেখে গেলে না? তোমার জন্য কে চলে এসেছেন অবশেষে? কে রুখে দাঁড়িয়েছেন, কোন সে লাঠি হাতে তোমার হয়ে প্রতিবাদ করতে? ধন্য তুমি, চণ্ডাল! স্বর্গের দেবতা আজ পথে নেমে এসেছেন তোমার জন্য
কে যেন পেছন থেকে ডাকছে আমায় নারীকণ্ঠ রানি?
মন্ত্রীও ডাকছেন ব্যাকুলভাবে আরও কারা ডাকছে পেছন থেকে বারণ করছে যেতে
যেতে তো আমাকে হবেই আর পিছু ফিরে যাওয়া যায় না
মুখোমুখি দাঁড়ালাম আমি তিনি থামলেন
পিছনে সহস্র যষ্টির আওয়াজ অবিরত

*            *            *

তাঁকে আমি দেখেছি তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত দেখেছিলাম তাঁকে তাঁর নির্বাণের দিনটিতে একধারে দাঁড়িয়েছিলাম আমি তখন আমি আর রাজা নই ভিক্ষু শ্রমণ আমরা সবাই সে চিতার আগুন একসঙ্গে জ্বালিয়েছিলাম
তিনি বলেছিলেন,আমার মৃত্যুর পরে আমার মূর্তি গোড়ো না কিন্তু আমি কেউ নই নিজের বুদ্ধির দীপ নিজ অন্তরে জ্বালিয়ো আত্মদীপ ভব...”
তাই তিনি কেমন দেখতে ছিলেন, তা এঁকে দেখাতে পারলেও দেখালাম না তোমাদের
----------
ছবি - সুকান্ত মণ্ডল