আমার ছোটবেলা:: আমার কৈশোর - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

আমার কৈশোর
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

আজকে আমি আমার কৈশোর নিয়ে লিখছি, যার প্রভাব আমার লেখকজীবনে খুব বড় ভাবে এসেছে।
কিছুদিন আগে আমার এক স্কুলের বন্ধু আমার ছবিতে পোস্ট করেছিল যে সে নাকি কখনও গোমড়ামুখো অভিজ্ঞানকে দেখে নি। সবসময় হাসতাম কিনা জানি না, তবে সবসময় আনন্দের মধ্যে  থাকতাম। এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর একটা বড় সময় হারিয়ে যেতাম নিজের কল্পনার জগতে যেখানে খোলা আকাশের নিচে গল্প প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয়, আবার হারিয়ে যায়।
আমার বাবা খুব আধ্যাত্মিক মানুষ ছিলেন। তা ওনার সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যে গীতা-বেদ নানান ধর্মগ্রন্থ পড়তাম আর বিভিন্ন ধর্মসভায় যেতামউনি বলতেন ঈশ্বরের কাছে কখনও শুধু নিজের ভালো চাইতে নেই। মন থেকে সবার ভালো চাইতে হয়। আমিও তাই চাইতাম। রোজ রোজ সবার জন্য এই চাওয়ার মধ্যে যে কত বড় আনন্দ আছে তখন তা বুঝি নি। আর ওটাই বোধহয় ছিল আমার সবসময়ের আনন্দের অজানা উৎস। পুজোর ভিড়ে আমি একাত্ম হয়ে অনুভব করতে পারতাম রাস্তার সেই ছেলেটার কথা, যার গায়ে জামাও নেই। নিজের খারাপ লাগা, বেদনা তার পাশে অনেক ছোট হয়ে যেত।
ধর্মের প্রতি আমার যে খুব বেশী আগ্রহ গড়ে উঠেছিল তা নয়, তবে খুব ভালো কিছু মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেরেছিলাম, যার মধ্যে অবশ্যই আমার বাবাও ছিলেনতাদের মূল্যবোধ, উদারতা, আত্মত্যাগ, আদর্শ, সৎসাহস আমাকে ছোটবেলা থেকে খুব প্রভাবিত করেছিল।
আমি মনে করি একজন লেখক তার লেখার মধ্যে ঠিক ধরা পড়ে যায়। তার চরিত্রের প্রতিফলন তার লেখাতে পড়তে বাধ্য।  আর তাই আমি নেতিবাচক কিছু লিখতে পারি না, যদিও জানি অনেকক্ষেত্রে সেটাই বাস্তব। এর জন্যই হয়ত কিশোরসাহিত্য আমার অনেক বেশি পছন্দ, যেখানে কল্পনার রঙে অন্ধকারের মধ্যেও আলো দেখানো যায়
আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন বিভিন্ন কারণে আমাদের পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। আর তাই বাইরে থেকে বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারের কথা অনেকে জানলেও এটা তাদের জানা ছিল না যে আমাদের ড্রয়িংরুমে ঝাড়বাতির তলায় শুধুই ছায়া, শুধুই অন্ধকার তার মধ্যে বাবার অসুস্থতা শুরু হল।
ঘরের সেই অন্ধকার কোণের নির্জনতাই ছিল আমার কৈশোর। তাই কখনও স্কুলে পড়ার নতুন বই পাই নি। যার কাছ থেকে পেতাম, সেও তার আগের বছরের আরেকজনের কাছে পেত। তাই পরীক্ষার আগে মাঝে মধ্যে খুব মুস্কিলে পড়তাম, যখন দেখতাম বেশ কিছু অংশ আমার পড়া পুরনো বইতে নেই।
বুঝতেই পারছ গল্পের বই তাই কখনও পাই নি। আমি কখনও নিজের মুখে কিছু চাইতে পারতাম না। তাই আমার যা বই পড়া তা ছিল স্কুলের উলটো দিকের রাস্তার বইয়ের দোকানেকিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো আর পুরো গল্প পড়া যায় না! পুজোর পরে কারুর বাড়ীতে দু-এক ঘণ্টার জন্য গিয়ে শারদীয়ার দু একটা গল্প পড়েছিকিন্তু আমি বাড়ীর বাইরে খুব কমই থাকতাম। তাতে একটা মুস্কিল হয়েছিল। খুব কম উপন্যাসই পুরো পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। যদ্দূর মনে পড়ে একটাও না। সুনীলদার ‘নীল মানুষ’ প্রথম চার পাতা, সত্যজিৎ রায়ের  ‘বাদশাহী আংটি’ প্রথম পাঁচ পাতা এরকম।
এমন কি আমার প্রথম লেখা যখন আনন্দমেলায় বা কিশোর ভারতীতে বেরিয়েছিল, তার আগে আমি সত্যজিৎ রায়েরও কোন উপন্যাস পুরো পড়ি নি। গল্পও খুব কম পড়েছিলাম। আর সেখানেই ছিল মজা।
ছোটবেলা থেকেই আমি ছোট বাচ্চাদের গল্প বলতে খুব ভালোবাসতাম। আর আমার মেজমাসীর দুই নাতনী ছিল, যারা আমার গল্প শুনতে খুব ভালোবাসত। কিন্তু তারা পরে বড় হয়ে জেনেছে যে আমি তাদের ‘বাদশাহী আংটি’ বা অন্য উপন্যাসের যে গল্প শুনিয়েছি তা আসল উপন্যাসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আসলে সে গল্পের প্রথম দশ মিনিটে যদি সত্যজিৎ রায় বা প্রেমেন্দ্র মিত্র থাকত তো তার পরের দেড়–দু ঘণ্টাতে থাকত নিখাদ অভিজ্ঞান আর সেই ককটেল যে খুব খারাপ হত তা নয়। সেটা বুঝেছি কারণ তারা আজও সেই গল্প মনে রেখেছে আর তা ভেবে আজও খুব মজা পায়তোমরা এবারের শারদীয়া কাকলির ‘চড়াই এর গল্পে’ এরই প্রতিফলন পেয়েছ। আসলে কোন কিছু পুরোটা না পাওয়ার মধ্যে একটা অসম্পূর্ণতা থাকে, যেখানে মন শূন্যস্থান পূরণ করার চেষ্টা করেসেখানেই বোধহয় আমার গল্প লেখার শুরু। আর তাই ‘লোকটার ডানহাতটা ছোট’ বা ‘মূর্তি’র মতো গল্পে শিল্পী খুঁজে বেড়ায় সেই সম্পূর্ণতা। আজও যার খোঁজ আমি করে চলেছি।
আজকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে আমার লেখার সত্যিকারের অনুপ্রেরণা কি, তাহলে বলতেই হবে তা হল আমার প্রিয় লেখকদের অসমাপ্ত গল্প। আজকে খানিকটা লজ্জার সঙ্গেই স্বীকার করে নিই লেখক অভিজ্ঞানের সম্বন্ধে অনেকের না জানা সবথেকে বড় রহস্য। আমি এখনও সত্যজিৎ রায়ের, প্রেমেন্দ্র মিত্রের, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ও আরও অনেক নামকরা সাহিত্যিকের বেশীরভাগ উপন্যাস পড়ি নি। পরে আমি চাই নি আমার সে কল্পনার জগৎটা হারিয়ে যাক। আজকেও যখন মেঘলা আকাশ দেখি, তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তারাখচিত আকাশ ভেবে নিতে আমার কষ্ট হয় না। ভয় হয় ঘরের বাড়তি আলোয় ওই কল্পনার আকাশটা যেন হারিয়ে না যায়। আমার নিজস্বতা যেন হারিয়ে না ফেলি। অনেকে যখন বলে আমার লেখাগুলো কেন একদম অন্যরকম, তার একটা কারণ আমার উপরে অন্য লেখকদের লেখার প্রভাব খুব কম পড়েছিল। আজ আমি যখন পড়ি, তখন অবশ্যই বিভিন্ন লেখকদের লেখার স্টাইল, গল্প বলার ভঙ্গী এসব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করি, আর শেখার চেষ্টা করি। একসঙ্গে এটাও বুঝি যে নিজস্ব একটা ভাষা থাকা প্রত্যেক লেখকের খুব দরকার।
মনে পড়ে স্কুল ফেরার পথে এক বুড়ো হজমীওয়ালার কাছে মাঝে-মধ্যে হজমী খেতাম। মাঝে একবার বেশ কিছুদিন তার কাছে খাই নি। আসলে টাকা ছিল না। আর আমার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই আত্মমর্যাদাবোধ খুব বেশী থাকায়, কখনই কোন ধরণের বিনা পয়সায় খাওয়ার কথা বা কোন ধরণের অকারণে সুযোগসুবিধে নেওয়ার কথা ভাবতে পারতাম না। তা একদিন স্কুল ফেরত তার সঙ্গে পথে হঠাৎ দেখা। আমাকে সে জোর করে হজমী খাইয়ে হিন্দিতে সেদিন যা বলেছিল তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় - হজমী বিক্রি করে ও কোনদিন বড়লোক হবে না, আর দু- একজনকে বিনা পয়সায় খাওয়ালেও এর থেকে বেশি গরীবও হবে না। শুধু কেউ যখন খেয়ে মুগ্ধ হয়ে ওর কাছে আবার ফিরে আসে,তাতেই ওর আনন্দ। আমি সেদিন খেয়েছিলাম, কিন্তু তারপরে যাতে তার বেশি ক্ষতি না করি তাই অন্য পথে আসতে শুরু করেছিলাম। চাকরি পাওয়ার পরে সে হজমীওয়ালাকে খুঁজতে আমি  কলকাতার সেই পুরনো পাড়ায় বেশ কয়েকবার গেছি। খুঁজে পাই নি। আজও তাকে খুঁজে চলেছি আমার লেখায়।
মনে হয় হয়ত আমার মতোই আরও অনেকে আছে, যারা গল্প পড়তে চায়, কিন্তু হাতের কাছে গল্পের বই পায় না। আর তখনই মনে হয় তাদের জন্য বাতাসে ভাসিয়ে দিই আমার সেরা গল্পটা। আমার সবথেকে ভালো লেখাটা যেন বিনামূল্যে তার কাছে পৌঁছে যায়। তার কৈশোরে পাওয়া সেরা উপহার হয়ে থেকে যায়। আর ঈশ্বরের কাছে আবার প্রার্থনা করি – সবার ভালো হোক।
------------

13 comments:

  1. Touched and mesmerized!

    ReplyDelete
  2. লেখাটা পড়ে যে অনুভূতি হল, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না| শুধু এটুকুই লিখি যে এমন এক চিরসবুজ মনের মানুষের লেখা পড়ার সুযোগ পাচ্ছি, এ আমার পরম সৌভাগ্য|

    ReplyDelete
  3. বড় ভাল লাগল। আপনার লেখার এমন উচ্চতা সত্ত্বেও আপনি যে মাটি ছাড়েননি তা দেখে ভারী আন্তরিক হলাম। ছোটবেলায় আপনার পড়ার অপূর্ণতা হুবহু আমার সঙ্গে মিলে যায়। তাই আপনার জায়গায় নিজেকে রেখে দেখার আস্বাদ পেলাম। যদিও আপনার মতো বড় লেখক হওয়া এক অলীক স্বপ্নই বটে।

    ReplyDelete
  4. লেখাটা পড়ে আমি অভিভূত, সত্যি এই লেখা পড়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

    ReplyDelete
  5. মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

    ReplyDelete
  6. মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

    ReplyDelete
  7. এ আখ্যান পড়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলাম। উপলব্ধি করলাম ভিতরের অতৃপ্তি আর অসম্পূর্ণতা কিভাবে একটা পরিপূর্ণ অভিজ্ঞান দিয়ে গেল বাংলা কল্পসাহিত্যে।

    ReplyDelete
  8. এবারের পূজাবার্ষিকী শুকতারায় আপনার "প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অভি" উপন্যাসটি পড়লাম। খুবই ভালো লেগেছে। আপনাকে অভিনন্দন!

    ReplyDelete
  9. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  10. প্রিয় অভিজ্ঞান, ২০১৬-সালের লেখা পড়ে মনে হল, তোমার কৈশোরের স্মৃতিচারণ প্রকাশের গুণে গল্প হয়েছে। হ্যাঁ, এটা অবশ্যই উত্তরণ...পুরোপুরি বাস্তবের গল্প হয়ে ওঠা কঠিন। তুমি অসাধ্য সাধন করেছ!তোমার জন্যে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

    ReplyDelete
  11. অসাধারণ ।মন ছুঁয়ে গেলো।

    ReplyDelete
  12. অসাধারণ ।মন ছুঁয়ে গেলো।

    ReplyDelete