ইতিহাস:: রাজকাহিনী:: সমুদ্রগুপ্তের খাতা (সম্রাট অশোক) - সহেলী চট্টোপাধ্যায়

সমুদ্রগুপ্তের খাতা (সম্রাট অশোক)
সহেলী চট্টোপাধ্যায়

আমি সমুদ্রগুপ্ত আর একবার হাজির হয়েছি তোমাদের জন্য। নিজের পুরানো খাতার পাতা উল্টে বার করছি কিছু হারিয়ে যাওয়া চরিত্র। আগের বার তোমাদের বলেছি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-র কথা। আজ বলব ওঁর নাতি মহামতি অশোককে নিয়ে কিছু জানা অজানা কথা। তোমরা নিশ্চয় জান অশোক হলেন পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। গোটা বিশ্বের ইতিহাস খুঁজলেও তাঁর মত উজ্জ্বল চরিত্র আর একটাও পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে আকবর-কেও মহান রাজা বলা হয়। আকবরের আগেও অনেক মহান রাজা এদেশে জন্মেছেনতবু অশোকের আগে কাউকেই রাখা যাবে না। প্রজাকল্যাণকামী রাজাদের কাছে তিনি ছিলেন উদাহরণস্বরূপ। নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন প্রজাদের সুখের জন্য। শুধু তাই নয় তাদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি বিধানের জন্য তিনি নানা রকম চেষ্টা করে গেছেন আজীবন।
আশ্চর্যের কথা হল ছোটবেলায় তিনি ছিলেন খুব নিষ্ঠুর স্বভাবের। বাবা ছিলেন বিন্দুসার। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বিন্দুসার মগধের রাজা হয়েছিলেন। তিনিও বাবার মত গ্রিকদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তাঁর রাজসভায় ডেইমেকস এবং ডায়োনিসাস নামে দুজন গ্রিক রাজদূত এসেছিলেন। তিনি ছিলেন শান্তিকামী, শিক্ষা-সংস্কৃতির অনুরাগী।
অশোকের মায়ের নাম ছিল ধম্মা (মতান্তরে সুভদ্রাঙ্গী) তিনি ছিলেন চম্পাদেশীয় এক ব্রাহ্মণ কন্যা। শোনা যায় যে সুভদ্রাঙ্গী অসুখী ছিলেন। কারণ বিন্দুসারের সঙ্গে তাঁর তেমন ভাল সম্পর্ক ছিল না। অশোক জন্মাবার পর তাঁর সেই দুঃখ বা শোক দূর হয়েছিল, তাই ছেলের নাম রেখেছিলেন অশোক। অশোক তাঁর মাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু খুব রাগী ছিলেন তাই অনেকে তাকে বলত চণ্ডাশোক। তাঁরা একশ জন ভাই ছিলেন। বড় দাদা সুশিমের সঙ্গে তাঁর বিরোধ লেগেই থাকত। তিনি ছিলেন মেজো, তাঁর পরের ভাই ছিলেন তিস্য।
বলা হয়ে থাকে যে তিনি নিরানব্বই জন ভাইকে হত্যা করে মগধের সিংহাসনে বসেন। খ্রীস্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ্যাভিষেক হয়েছিল আরও চার বছর পর (২৬৯ অব্দে)। অনেকেই মনে করেন যে এই চার বছর তিনি ব্যস্ত ছিলেন নিজের ভাইদের পরাস্ত করতে। তবে সত্যিই যে তিনি নিজের ভাইদের হত্যা করে রাজা হয়েছিলেন তার কোনও প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব-এর কথা আছে বৌদ্ধ কিংবদন্তীগুলোতে।
মাত্র আঠারো বছর বয়সে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। বিন্দুসার তাঁকে প্রথমে উজ্জ্বয়িনী ও পরে তক্ষশীলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তক্ষশীলায় প্রজা বিদ্রোহ দমন করায় বিন্দুসার তাঁর ওপর বেশ খুশিও হয়েছিলেন। উজ্জয়িনীতে থাকার সময় তিনি মহাদেবী নামে এক শ্রেষ্ঠী কন্যাকে বিয়ে করেন। তাঁর আরেক রানি ছিলেন কারুবাকি। পরবর্তী কালে তিনি এই জায়গাতেই বিশ্ব বিখ্যাত সাঁচি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। এই উজ্জ্বয়িনীতে তাঁর আসা যাওয়া ছিল।
সিংহাসনে বসে তিনি ‘দেবানাম-পিয়-পিয়দাসী’ অর্থাৎ দেবতাদের প্রিয় প্রিয়দর্শী এই উপাধি ধারণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি শিবের উপাসক ছিলেন। যুদ্ধ, বিগ্রহ, আমোদ-প্রমোদ, মৃগয়া (শিকার) খুব পছন্দ করতেন। বিদেশীদের সঙ্গে দাদু ও বাবার মতই তিনিও ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তুসাস্পা নামে তাঁর এক পারসিক কর্মচারী ছিল।
খ্রীস্টপূর্ব ২৬০ অব্দে নিজ রাজত্বের নবম বছরে তিনি কলিঙ্গের (ওরিষ্যার) বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কলিঙ্গ ছিল বেশ শক্তিশালী একটা রাজ্য। দক্ষিণ ভারতের জলপথগুলি ছিল কলিঙ্গের দখলে। তাই কলিঙ্গ দখল করার প্রয়োজন ছিল অশোকের কাছে। অশোক জয়লাভ করেন। দেড় লক্ষ কলিঙ্গবাসী বন্দি ও প্রায় এক লক্ষ মানুষ মারা যায় এই যুদ্ধে।
কলিঙ্গের মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে অশোকের মনে যুদ্ধের প্রতি বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হল। এক একটা খারাপ ঘটনা থেকেও অনেক সময় অনেক ভাল কিছু ঘটতে পারে। যুদ্ধের এই বীভৎস হত্যালীলার জন্য অশোক নিজেকেই দায়ী করতে থাকেন। হাতের তরোয়াল টান মেরে ফেলে দিলেন অনেকটা নিচে। সেটা যেয়ে পড়ল দয়া নদীর বুকে। দয়া নদী সেদিন কলিঙ্গের মানুষের রক্তে লাল হয়ে গেছে। তাঁর তরোয়ালটা ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল দয়া নদী। তোমরা ধবলগিরিতে গেলে দেখতে পাবে ছোট একটা টিলার ওপর খুব সুন্দর একটা বৌদ্ধ স্তূপ। আর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে দয়া নদী। পুরী থেকেই সবাই যায় বেড়াতে।
অনুতপ্ত মনে অশোক বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তের কাছ থেকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিলেন। ঠিক করলেন জীবনে আর কখনই যুদ্ধ করবেন না। উপগুপ্তের সঙ্গে তিনি সারনাথ, কপিলাবস্তু, লুম্বিনি, কুশিনগর, বুদ্ধগয়া ইত্যাদি জায়গাগুলো ঘুরে দেখলেন ভাল করে। তাঁর পিতামহ বা দাদুর সময় থেকে যে দিগ্বিজয়ের রীতি (যুদ্ধ করে পর পর রাজ্য গ্রাস) চলে আসছিল তিনি তার পরিবর্তন করে ধর্মবিজয়ের রীতি গ্রহণ করেন।
বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি রাজ্যের নানা জায়গায় স্তূপ, স্তম্ভ ও পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের বাণী সহজ ভাষায় লিখে রাখার ব্যবস্থা করেন। দেশের ভেতরে তো বটেই এমন কী বিদেশেও ধর্ম প্রচারক পাঠান। সিরিয়া, মিশর, এপিরাস, সিংহলে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয় তাঁরই একান্ত চেষ্টায়। সিংহলে নিজের মেয়ে সংঘমিত্রা আর ছেলে মহেন্দ্রকে পাঠিয়েছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য। আর তাঁর এই প্রচেষ্টার জন্যই এখনও বিশ্বের বহু মানুষ এই ধর্মে বিশ্বাসী। তিনি না থাকলে বৌদ্ধ ধর্ম বিশ্বের দরবারে কখনই পোঁছতে পারত না।
তিনি কিন্তু অন্য ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতেন না।  ‘আজিবক’ নামে এক ধর্মীয় সম্প্রদায়কে তিনি প্রচুর উপহার দিয়েছিলেন। শুধু মানুষ বা পশু পাখি নয়, গাছপালাকেও যত্ন করতেন। বিশ্বের প্রথম পশু চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি করেন তিনিই। তিনি অনেকগুলো চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। আর তার ঠিক পাশেই বিশাল এলাকা জুড়ে ভেষজ উদ্ভিদের উদ্যানও তৈরি করান যাতে তাড়াতাড়ি ওষুধ তৈরি করে মানুষ বা পশু-পাখির চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়। দেশের বাইরে সুদূর গ্রিসেও তিনি মানুষ ও পশুদের জন্য চিকিৎসালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
অহিংসা নীতি গ্রহণ করলেও প্রয়োজন বোধে তিনি অহিংস নীতি থেকে সরে আসতেন। নিজ রাজ্যের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য তিনি কখনও অহিংস নীতি গ্রহণ করেননি। সেনা বাহিনী সর্বদা সুগঠিত ছিল। উপজাতি বিদ্রোহ দমন করার ব্যাপারে তিনি অহিংস নীতি থেকে সরে আসেন।
পেশোয়ার থেকে বাংলাদেশ এবং কাশ্মীর থেকে মহীশুর পর্যন্ত বিশাল এক অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এই বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র একই ভাষা ও এক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তাঁর  বানানো স্তূপ এবং স্তম্ভগুলো দেখার জন্য প্রচুর মানুষ বিদেশ থেকে ভারতে আসেন। তাঁর শিলালেখ নিয়ে এখনও ঐতিহাসিকরা কাজ করে চলেছেন। আরও বহু যুগ পরেও তাঁকে নিয়ে প্রচুর গবেষণা হবে। কালের নিয়মে মানুষ এক সময় হারিয়ে যায়, সে অমরত্ব লাভ করে নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে। 
বৌদ্ধধর্মের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য রাজধানী পাটলিপুত্রে তিনি এক বৌদ্ধ ধর্ম সম্মেলনের আহ্বান করেন। আফ্রিকা মহাদেশেও তিনি ধর্ম প্রচারক পাঠিয়েছিলেন। তাঁর নির্মিত অশোকস্তম্ভ ভারতের জাতীয় স্তম্ভ। তাঁর বলে যাওয়া অনেক কথাই ভারতের সংবিধানে স্থান পেয়েছে।

এবার আমরা তাঁর শিলালিপিগুলো সম্বন্ধে কিছু জানব। ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপিতে সে গুলো লেখা হত।
১) গৌণ প্রস্তর-লেখ --- জয়পুর, মহীশুর, বিহার, জব্বলপুর, হায়দ্রাবাদ
২) ভাবরু লিপি ---
৩) চতুর্দশ প্রস্তর লিপি --- প্রাপ্তিস্থান হল সীমান্ত প্রদেশ
৪) কলিঙ্গ লিপি --- ধৌলি ও জৌগড়
৫) বরাবর গুহালিপি --- গয়ার কাছে পাওয়া গেছে
৬) রুমিনদেই স্তম্ভলিপি --- প্রাপ্তিস্থান নেপাল
৭) সপ্তম স্তম্ভলিপি --- মিরাট, পাঞ্জাবের আম্বালা ইত্যাদি জায়গায়।
৮) ক্ষুদ্র স্তম্ভলিপি --- সাঁচি, সারনাথ, কৌশাম্বী
শিলালিপিগুলির পাঠোদ্ধার করেন জেমস প্রিন্সেপ।

সম্রাট অশোকের গল্প একবার শুরু হলে তা একদিনে থামবে না। বহু কিছু এখনও অজানা রয়ে গেছে। অনেক কথা আজ বলা হল না। তোমরা সবাই ইতিহাসকে ভালবেসো, চেষ্টা করো নতুন কিছু জানানোর, হয়ত তোমরাও একদিন রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত সমস্ত পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেবে। ভাল থেকো বন্ধুরা।
-------------------
ছবি- অভিনব সাহা

2 comments:

  1. সমুদ্রগুপ্ত আকবরের কথা জানলেন কি করে?

    ReplyDelete
  2. Eai muhurte tini sob kichui janen ja ghote geche :)

    ReplyDelete