ঋক আর রুপোলি মানুষ
অদিতি সরকার
ঋকের মাথা আজ ক’দিন ধরে সাংঘাতিক গরম।
না হয় ইন্টার্নাল অ্যাসেসমেণ্টে অংকে সি মাইনাসই পেয়েছে, তাই বলে এরকম ব্যবহার কেউ করে? ছোঃ৷ যেন ঋক একটা মানুষই নয়। একটা তুচ্ছ অংক পরীক্ষার নম্বর সারা বাড়ির লোকজনকে যে এরকম পালটে দিতে পারে ভাবা যায়? এই যে ধরো বাবা, তিনি তো চিরকালের গম্ভীর মানুষ, তবু ঋকের সঙ্গে বাবার অন্যরকম ব্যাপার স্যাপার ছিল। সেই যেবার ঋকের সপাটে মারা ক্রিকেট বল উড়ে গিয়ে চৌধুরি আংকলের গাড়ির কাচ ভেঙে দিল, কই, বাবা তো ঋকের ওপর একটুও রাগ করেন নি। বরং আংকলকেই নরম করে বলেছিলেন, ‘ছোটোদের খেলার জায়গার পাশে গাড়িটা না রাখলেই নয়?’ এমনিতেই কারোর ওপর খুব অসন্তুষ্ট হলেও বাবা বকাবকি করেন না, শুধু চশমার ওপর দিয়ে এমন করে তাকান, তাতেই রক্ত ঠাণ্ডা। কিন্তু ঋকের দিকে কখনও বাবা ও ভাবে তাকান নি, মানে আগে আর কি। এই প্রথম, রিপোর্ট কার্ড থেকে চোখ তুলে বাবার গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে গেল। চোখদুটো ওইভাবে কিছুক্ষণ ঋকের চোখে স্থির হয়ে রইল, তারপর নেমে গেল। একটু বকলেও তো হত, তাহলে ওরকম বিচ্ছিরি গলাব্যথা করত না ঋকের।
আর তারপর থেকে তো আর কেউ তাকাচ্ছেই না ঋকের দিকে। মা অবধি এমন কান্না কান্না মুখ করে ঘুরে বেড়াতে লেগেছেন যে বলার নয়৷ তাও যদি দিদার কাছে মা’র ক্লাস সেভেনের অংকখাতা না দেখা থাকত৷ যাক গে সে সব তুচ্ছ কথা। গুরুজন সম্বন্ধে ও সব বলতে নেই৷ জানলেও বলতে নেই৷ এ দিকে ফুটকিটাকেও সবাই মিলে এমন শিখিত-পড়িত করেছে যে ভাবা যায় না৷ ওইটুকু একফোঁটা মেয়ে, বলে কি না, ‘তোমার সঙ্গে খেলতে নেই, মা বলেছে মুখখুদের সঙ্গে খেললে আমিও মুখখু হয়ে যাব৷ মুখখু কাকে বলে গো দাদাভাই? তুমি কি মুখখু?’
এর উত্তরে দাঁত কিড়মিড় করা ছাড়া আর কি করার থাকতে পারে? যদিও খুবই ইচ্ছে করেছিল ফুটকির চুলের ঝুঁটিটা ধরে আচ্ছা করে নাড়িয়ে দিতে, কিন্তু ঋক সামলে গেল৷ একেই এখন সময় খারাপ যাচ্ছে, শেষটায় কী থেকে কী হয়ে যাবে৷ কাজ নেই বাবা ঝামেলা বাড়িয়ে৷
ঠিক হ্যায়, ঋকও কারোর পরোয়া করে না৷ কথা বলবে না তো বলবে না, ভারি বয়েই গেল৷ বড়দের কথা মানেই তো ওই ‘ওরে পড়তে বোস রে, ওরে অংক কর রে, ওরে সারাদিন অত গল্পের বই পড়িস না রে, ওরে অষ্টপ্রহর খেলা ছেড়ে একটু পড়াশোনায় মন দে রে,’ - দুত্তোর৷ অমন কথা বলার চেয়ে না বললেই ভাল৷
মুশকিলটা হয়েছে অন্যখানে৷ ঋকের সব গল্পের বইগুলো পোঁটলা বেঁধে শোওয়ার ঘরের আলমারির ওপর চালান হয়ে গেছে, ওই নাকি তার সি মাইনাস পাওয়ার শাস্তি৷ শুধু বইগুলো তুললেও না হয় একটা কথা ছিল, ক্রিকেটের কিটশুদ্ধু টঙে তোলে কেউ? আচ্ছা কোনও মানে হয় সত্যি? নামিয়ে নিতে যে পারে না ঋক তা নয়৷ মার ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে বেঁটে টুলটাকে এনে খাটের ওপর চাপালেই কেল্লা ফতে৷ ওর ওপর চড়লেই আলমারির মাথায় আরামসে হাত পৌঁছে যাবে৷ তারপরে পোঁটলা নামাতে কতক্ষণ? সারা দুপুর তো বলতে গেলে ঋক বাড়িতে একলাই। দিব্যি ক’টা গল্প পড়েটড়ে তারপর আবার যেমনকার পোঁটলা তেমন তুলে রেখে দিলেই তো হল। ক্রিকেট কিটও কি আর নামানো যায় না?
কিন্তু সেটা ঋক করবে না৷ অংকে গোল্লা পেতে পারে ঠিকই, কিন্তু চোট্টামি ঋকের ধাতে নেই৷ বাড়ির সকলেও খুব ভালো করে জানে ঋক অমন কাজ কখনোই করবে না৷ না হলে ওরা ওরকম ঋকের চোখের সামনে দেখিয়ে দেখিয়ে বইগুলোও রাখত না, ক্রিকেটের জিনিসপত্রও রাখত না৷
অতএব এই পুরো ছুটিটা ঋককে এমনি ভাবে কাটাতে হবে। পার্কে খেলতে যাওয়া বারণ, বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া বারণ, বই পড়া বারণ, শুধু বারণ আর বারণ। যেন ক্রিকেট না খেললে, গল্পের বই না পড়লেই একেবারে আইনস্টাইন হয়ে যাবে। রোজ শুধু সকাল থেকে রাত অংকই কষে যাবে। আবদার আর কি। চেনে না তো ঋককে, যত ওরা চেপে ধরবে তত ফসকে পালাবে ঋক। কী হবেটা কী অংক করে, শুনি। বড় হয়ে হবে তো ঋক ক্রিকেটার, তার জন্য অংক করতে হবে কে কবে শুনেছে? প্র্যাকটিসে ফাঁকি দিলে তখন বলতে এসো, হ্যাঁ। কাকেই বা বলবে এ সব ঋক, কে-ই বা বুঝবে।
দুপুরবেলা ঘরে বসে বসে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল, তাই ছাদে এসে এইসবই ভাবছিল ঋক। বাবা অফিসে, মা কলেজে। ঝর্নামাসি ফুটকিকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এখন বাইরের ঘরে বসে টিভি দেখছে। ঋকের দিকে কারো খেয়ালই নেই। সে না থাক, ঋকও একা একা দিব্যি থাকে। যত কম এদের সঙ্গে কথা বলা যায় ততই শান্তি। ছাদে একটু রোদ ঠিকই, তা জলের ট্যাংকটার তলা ঘেঁষে বসলে আর তত রোদ-টোদ লাগে না। বেশ সুন্দর হাওয়াও আছে।
ডান হাতের সব ক’টা আঙুলের নখ দাঁত দিয়ে পরিষ্কার করে কেটে সবে বাঁ হাতটা শুরু করতে যাবে, হঠাৎ মনে হল পাশে যেন কেউ এসে বসল। যাঃ বাবা, এই ভর দুপুরে এই ছ’তলার ছাদে আরও লোক ওঠে জানা ছিল না তো। বড়ো কেউ নাকি? তাহলেই তো এক্ষুনি আবার উপদেশ দিতে শুরু করবে। একা একা এই সময়ে ছাদে কেন এসেছ, কোন ফ্ল্যাটে থাকো, লেখাপড়া না করে এখন ছাদে কেন - আরও কে জানে কত কী। বড়দের উপদেশের কি আর শেষ আছে?
দেখব না দেখব না করেও আড়চোখে একবার তাকাল ঋক। ও বাবা, এ আবার কে রে! এরকম চেহারার কাউকে আজ পর্যন্ত দেখে নি ঋক। এ বাড়ির কোনও ফ্ল্যাটের কেউ নয়, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কারু সঙ্গে দেখা করতে এসেছে কি? ছাদে এল কেন বাবা ঋককে জ্বালাতে? উফ, কোথাও কি একটু শান্তিতে থাকার উপায় নেই? চুপচাপ গম্ভীর মুখে বসে থাকে ঋক, বিরক্তি চেপে। হয়তো কথা না বললে লোকটা নিজে থেকেই উঠে যাবে।
‘কী ব্রাদার, মন খারাপ মনে হচ্ছে?’ লোকটা ভুরুদুটো নাচাল দু বার। কেমন মোছামোছা ভুরু, ‘তা পরীক্ষাটা ভালো করে পড়াশোনা করে দিলেই তো হত।’
বাবা, এ কি ম্যাজিশিয়ান না থট রীডার? চেহারাটাও যেমন অদ্ভুত, পোশাকও তেমনি। এ রকম পোশাক ঋক অন্তত কোনোদিন কাউকে পরতে দেখে নি। যারা সার্কাসে ট্র্যাপিজের খেলা দেখায় তারা অনেকটা এই ধরনের ড্রেস পরে বটে, কিন্তু এই লোকটার জামাকাপড় আরও চকচকে, আরও আঁটোসাঁটো। যেন কোনও ধাতু গলিয়ে গায়ের সঙ্গে তুলি বুলিয়ে লেপে দেওয়া হয়েছে। শুধু মুখটাই যা দেখা যাচ্ছে। সেও যা মুখ। চুলটুল কিচ্ছু নেই, চোখের পাতাও প্রায় নেই, মোছামোছা ভুরু। গলা থেকে পা পর্যন্ত ওই চকচকে রুপোলি জিনিসের আস্তরণ। এই দুপুরবেলা এ রকম জামাকাপড় পরে লোকটা রাস্তা দিয়ে এল? আর এল তো এল, কথা নেই বার্তা নেই একেবারে সটান ছাদে উঠে ঋকের পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন? নাঃ, আর তো চুপ করে থাকা যায় না।
‘আপনি কে কাকু? কী করে জানলেন আমার পরীক্ষা খারাপ হয়েছে?’
লোকটা উত্তর দিল না। কীরকম মিটমিটে চোখে ঋকের দিকে চেয়ে মুচকি হাসল। কটা কটা চোখের মণি দুটো চকচক করে উঠল।
‘তা ব্রাদার, এখন কী প্ল্যান, শুনি? এখানে বসে বসে নখ কামড়ালেই হবে?’
‘আর কী করব। আমার সঙ্গে তো আজকাল কেউ কথাই বলে না,’ বলতে না চেয়েও ঋক বলেই ফেলল। লোকটার চোখদুটো কেমন যেন, ওদিকে তাকালে পেটের লুকোনো কথাও সরসর করে বেরিয়ে পড়ে।
‘সে না বলে না বলুক। এখন চলো তো দেখি,’ লোকটা তাচ্ছিল্যের হাত নাড়াল, ‘ওসব নিয়ে অত ভাবে না।’
‘কোথায়?’ ঋক আশ্চর্য হয়ে তাকাল লোকটার দিকে।
‘আরে চলোই না। তোমাকে নিয়ে যেতেই তো এলাম।’
‘মানে? কোথায় নিয়ে যাবেন? আপনি আমায় চেনেন?’ লোকটার কাণ্ডকারখানা যত দেখছিল ততই অবাক হচ্ছিল ঋক।
‘আঃ, অত প্রশ্ন করতে নেই, নিজের চোখেই দেখতে পাবে কোথায় যাওয়া হচ্ছে। ওঠো ওঠো, উঠে পড়ো, সময় বেশি নেই,’ বলতে বলতে নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা।
কিসের সময়, কোথায় যাবে, কেনই বা যাবে ঋক? অথচ লোকটা এমন ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গি করে ঋকের দিকে তাকিয়ে আছে যেন খুব দরকারি কাজে দেরি হয়ে যাচ্ছে। অচেনা লোক বলে একটু ইতস্তত করছিল ঋক, মা বারবার বলেছেন যার তার সঙ্গে কোথাও না যেতে। এমন কি বাবা কিংবা মা-র নাম করে বললেও না। কিন্তু লোকটার ফিচেল হাসি দেখে রাগ হয়ে গেল। কী ভেবেছে কি লোকটা ঋককে? সে কি বাচ্চা ছেলে নাকি একটা, অ্যাঁ? আর ঋক হারিয়ে গেলেই বা কার কী! যাবে ঋক, এই অদ্ভুত লোকটার সঙ্গেই যাবে, দেখবে কোথায় নিয়ে যায়। এরকম বন্দীদশায় বাড়িতে পচার থেকে অন্তত একটা অ্যাডভেঞ্চার তো হবে।
লোকটা ঋকের হাত ধরতেই সারা শরীরের মধ্যে কেমন একটা ঝিনঝিন করে উঠল। ঋক অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকাল, কিন্তু সে তখন খুব গম্ভীর হয়ে উলটো দিকে তাকিয়ে আছে। কী হল ব্যাপারটা ঠিক বুঝল না ঋক।
কোথায় যেতে হবে না বুঝেও দাঁড়িয়ে উঠেছিল ঋক, হঠাৎ মনে হল লোকটা ওকে নিয়ে ছাদের পাঁচিলের দিকে যাচ্ছে। কী হচ্ছে ভালো করে বোঝার আগেই দিল এক লাফ। ঋকের ডান কবজিটা ওর হাতে শক্ত করে ধরা বলে সেই সঙ্গে ঋকও। গলা দিয়ে আঁক করে একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল ঋকের, পেটের মধ্যে খালি খালি। এই জন্যে মা অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলতে বারণ করেন। বিনা দোষে একটা পাগলের পাল্লায় পড়ে শেষটায় বেঘোরে মরে যাবে সে? এখন না হয় কেউ তাকে পাত্তা টাত্তা দিচ্ছে না, কিন্তু তাই বলে এরকম দুম করে মরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কত বই পড়া হয় নি এখনও, কত সবুজ মাঠে কত না খেলা ক্রিকেট ম্যাচ এখনও অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। এখনই মরে গেলে সেগুলো হবে না যে আর। হয়ত ফুটকি কত কাঁদবে, মা কত কষ্ট পাবেন হয়ত। আর বাবা। ঋককে ছাড়া বাবা থাকতে পারবেন? এই সবই মাথায় ঘুরছিল ঋকের পড়তে পড়তে। কিন্তু এতক্ষণ ধরে পড়ছেই বা কেন? ঋকদের বাড়িটা তো মোটে ছ তলা। সেখান থেকে লাফালে তো মাটিতে পড়তে এত সময় লাগার কথা নয়।
চেপে বন্ধ করা চোখদুটো অল্প একটু ফাঁক করতেই চমকে গেল ঋক। এ কোথায় এসে পড়ল সে? এ তো তাদের চেনা পাড়া নয়। ঋকের দু পাশ দিয়ে সোনালি বেগুনি মেঘ ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে। অনেক নিচে কমলা রঙের মাটি। মানে মাটি বলে ভাবল মনে মনে ঋক, আসলে যে কী তা আদৌ জানা নেই। চারদিকে কেমন একটা অন্য রকম আলো। তার মধ্যে দিয়ে ঋক আর লোকটা সাঁ সাঁ করে উড়ে চলেছে, ডানা টানা ছাড়াই।
‘ভয় পেয়ো না, আর একটুখানি। পৌঁছে গেছি প্রায়।’
লোকটার ঠোঁট টোঁট কিচ্ছু নড়ে নি, ঋক স্পষ্ট দেখেছিল, অথচ ওর গলা ঋকের মাথার মধ্যে পরিষ্কার গমগম করে বেজে উঠল। উত্তর দিতে গিয়ে ঋক দেখল সে মুখ খুলতে পারছে না, অথচ মনে মনে দিব্যি কথা বলতে পারছে। অদ্ভুত তো। কী যে সব হচ্ছে সেই দুপুর থেকে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কী আর করবে ঋক, বন্ধ মুখেই লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
‘সে কথা বলার হুকুম নেই আমার। দেখতেই পাবে। চোখ বন্ধ করো।’
‘কেন?’
‘উফ, বড্ড জ্বালাও তো তুমি। এত প্রশ্ন করো কেন। চোখ বন্ধ করতে বলেছি করো। বড়দের কথা শুনতে হয়।’
হয়ে গেল। এর মুখেও সেই একই কথা। আচ্ছা বড়োদের কথা শুনবে না তো বলে নি ঋক, কিন্তু কেন শুনতে হয় সেটা একটু বুঝিয়ে বলা যায় না? ছোটদের যেন বুদ্ধিশুদ্ধি বলে কিচ্ছু নেই। দুচ্ছাই। রাগের চোটে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেলল ঋক। ভারি তো একটা পেণ্টবক্সের মত রঙিন আকাশ, না দেখলে কী হয়?
কতক্ষণ অমনি করেই উড়ল ওরা কে জানে, একসময় ঋকের যেন মনে হল পায়ের নিচে নরম মত কী ঠেকছে।
‘নাও এবার চোখ খোলো। কই, খোলো চোখ।’
ঋকের এত রাগ হচ্ছিল যে ভেবেছিল চোখ বন্ধ করেই রাখবে, কিন্তু কৌতূহলও আটকানো যাচ্ছিল না। তাই খুলেই ফেলল চোখদুটো। আর খুলে তো একেবারে হাঁ! এ কোথায় এসে পড়ল রে বাবা!
সেই কমলা রঙের মাটিটার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মাটি ঠিক না, কেমন গোল গোল দানা দানা জিনিস, স্বচ্ছ কাচের গুলির মত। তার ভেতর থেকে কমলা রঙের আলো বেরোচ্ছে। যত দূর চোখ যায় ওই কমলা আলো। কোথাও কোন গাছপালা নেই, ঘাসটাস কিচ্ছু নেই। পাহাড়, পর্বত, বাড়ি, ঘর, কুকুর, বেড়াল পাখি টাখি কিছুই নেই। শুধু ওই স্বচ্ছ কমলা নুড়ি বেছানো মাঠ ধু ধু করছে। আর মাথার ওপরে সেই সোনালি বেগুনি মেঘ। ব্যস। অদ্ভুত লোকটা ঋকের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। চুপ করে। বাধ্য হয়ে তার দিকেই ফিরতে হল।
‘এটা কোন জায়গা, কাকু?’
‘তুমি চিনবে না।’
সে তো দেখতেই পাচ্ছে ঋক, অচেনা জায়গা। চেনা হলে আর জিজ্ঞেস করবে কেন। কী প্রশ্ন আর তার কী উত্তর। রাগটা যা ধরছিল। সবে তেড়ে উঠতে যাবে বলে মনের মধ্যে বেশ জুতসই ক’টা কথা গোছাতে শুরু করেছিল ঋক, এমন সময় সামনের দৃশ্যটা দেখে ওর মুখটা আপনিই হাঁ হয়ে গিয়ে রাগ টাগ সব মাথা থেকে উড়ে গেল। ভীষণ অবাক হয়ে ঋক দেখল ওর সঙ্গের লোকটার মতই অদ্ভুত পোশাক পরা অনেকগুলো লোক লাইন করে ওদের দিকেই আসছে। এরা আবার কারা রে! সবার আগের লোকটা বিরাট লম্বা চওড়া, কিন্তু এমন ভাবে হাঁটছে যেন মাটিতে পা দুটো ঠেকছেই না। ওই কমলা নুড়িগুলোর ওপর দিয়ে কী রকম একটা ভেসে ভেসে এগিয়ে আসছে।
মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা গুনগুন শব্দ হচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে, ঋক অবাক হয়ে আজব মিছিলটাকে দেখছিল বলে বিশেষ খেয়াল করেনি। হঠাৎ শব্দটা খুব জোরদার হয়ে ওঠায় ওটার দিকে একটু মন দিতেই হল।
‘মাথা নিচু করো, মাথা নিচু করো,’ কে যেন বলেই যাচ্ছে। ও হো, এ তো ঋকের সঙ্গের লোকটার গলা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল ঋক, তার পাশে লোকটা মাথা একদম ঝুঁকিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর ঋকের মনের মধ্যে সমানে সংকেত পাঠিয়েই চলেছে - মাথা নিচু করো।
‘খামখা মাথা নিচু করতে যাব কেন? বাবা বলেছেন যার তার সামনে মাথা না ঝোঁকাতে,’ ঋক শান্তভাবেই জবাব পাঠায়, যদিও তার বেজায় রাগ হচ্ছিল।
‘আমাদের প্রমুখের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়ম নেই,’ লোকটার গলা তীক্ষ্ণ হয়।
‘প্রমুখ মানে?’
‘মানে আমাদের নেতা। ওই যে সবার আগে যিনি আসছেন। আঃ, নিচু করো না মাথাটা।’
‘আমি কেন মাথা নিচু করতে যাব। আপনাদের নেতা, আপনাদের নিয়ম, আপনারা মানুন গে যান। একে তো জোর করে ধরে নিয়ে এসেছেন, তারপর আবার যত উদ্ভট নিয়ম মানতে বলছেন। জানেন, আপনাকে পুলিশ ধরবে ছেলেধরা বলে?’ এবার আর রাগ আটকাতে পারে না ঋক। ফোঁস করে ওঠে।
লোকটা কী রকম একটা অদ্ভুত আওয়াজ করে হাসল ঋকের মাথার মধ্যেই।
‘পুলিশ ধরবে, আমাকে? তোমাদের ওই পৃথিবীর পুলিশ? আচ্ছা, যখন ধরবে তখন দেখা যাবে’খন।’
ঋকের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল লোকটার কথা শুনে। ও অমন করে পৃথিবীর পুলিশ বলল কেন? তার মানে এই জায়গাটা কি পৃথিবী নয়? সত্যিই মরে গেল নাকি ঋক? কেন যে গোঁয়ার্তুমি করে লোকটার হাত ধরতে গিয়েছিল।
লোকটা মাথা নিচু করেই রেখেছে এতক্ষণ ধরে। ঋক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল যারা আসছে তাদের। যদিও তার ভেতরে ভয় গুড়গুড় করছিল, তবু সে মাথা নামায় নি কিছুতেই। বাবা যে সব সময় তাকে বলেন, ভয়ের কাছে কক্ষনো হার মানতে নেই। নিজেকে জিজ্ঞেস করবে কেন তুমি ভয় পাচ্ছ। দেখবে আসলে কোনও কারণই নেই ভয়ের। অংকে ভয় তোমার, আরও বেশি করে অংক প্র্যাকটিস করো। অজানাকে ভয় পাও তুমি, তাহলে তাকে জানো। ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেই দেখবে ভয় টয় সব কোথায় পালাবে।
বাবার কথা মনে পড়তেই গলাটা আবার একটু ব্যথা করে উঠল ঋকের। জোর করে ঢোঁক গিলে ব্যথাটাকে গলার নিচে পাঠিয়ে দিল সে। এখন ও সবের সময় নয়। সামনের অজানার মোকাবিলা করতে হবে এখন তাকে। বাবার সেই বার বার শেখানো কথাগুলোই মনে মনে বিড়বিড় করছিল ঋক, দাঁড়িয়ে ছিল চোয়াল শক্ত করে সটান। আসুক না ওরা, দেখাই যাক না।
এতক্ষণে অনেকটাই কাছাকাছি এসে পড়েছে সবাই। সামনের লম্বা চওড়া লোকটার মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল ঋক এখন। তাকে যে এখানে নিয়ে এসেছে অনেকটা তারই মতন দেখতে, কিন্তু এর চোখগুলো আরও জ্বলজ্বলে। মনে হচ্ছে যেন চোখের ভেতর থেকে আলো জ্বলছে, আর সেই আলোয় লোকটা ঋকের মনের একদম ভেতর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। খুব হালকা একটা হাসি লোকটার মুখে।
‘কেমন আছ ঋক?’
এ কী, এ তো ঋকের নাম পর্যন্ত জানে। এত হকচকিয়ে গিয়েছিল যে উত্তর দিতেও ভুলে যাচ্ছিল ঋক। লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছিল। খেয়াল হতে কোনরকমে বলল ঋক, ‘ভালো।’
‘আসতে কোনোরকম অসুবিধে হয় নি তো?’
এটার আর কী উত্তর দেওয়া যায়, ঋক চুপ করেই রইল।
বাকি লোকগুলোও এতক্ষণে এসে পড়েছে। ঋককে যে নিয়ে এসেছিল সে আর তার পাশে নেই এখন, ওদের সঙ্গেই মিশে গিয়েছে। এখন শুধু ঋক আর ওই নেতা গোছের লোকটা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, আর ওদের দুজনকে গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বাকি সবাই। ঋক সত্যিই কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কী যে হচ্ছে। লোকটাও দুটো কথা বলে আর কিছু বলছে না, চুপ করে দাঁড়িয়ে ওই অদ্ভুত আলোজ্বলা চোখদুটো দিয়ে ঋককে দেখছে শুধু।
‘এই জায়গাটার নাম কী? আপনারা কারা? আমাকে এখানে কেন এনেছেন?’ আর থাকতে না পেরে একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করেই ফেলল ঋক। কৌতূহলে তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠছিল।
‘নাম? তুমিই একটা পছন্দমত দিয়ে দাও না,’ লোকটা আবার হাসল একটু।
‘সে আবার কী? আমি নাম দেব মানে? জায়গাটার কোনও নাম নেই?’ ঋকের বুকটা ধড়াস করে ওঠে। পৃথিবী নয়, নামও নেই জায়গার, এ কোথায় এসে পড়ল সে?
‘আছে, কিন্তু সে নাম তুমি উচ্চারণ করতে পারবে না। আমাদের ভাষা তুমি জানো না যে।’
‘আপনাদের ভাষা কি আলাদা? এই তো আমার সঙ্গে কী সুন্দর বাংলায় কথা বলছেন।’
‘আমরা যা পারি তুমি তা পারবে না।’
সব আরোই কেমন গুলিয়ে গেল। লোকটার বোধহয় ঋকের হতভম্ব অবস্থা দেখে একটু করুণা হল, নিজে থেকেই এগিয়ে এসে ঋকের হাতটা ধরল। আবার সেই ঝিনঝিন, কিন্তু এটা আরও জোরালো। হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেও পারল না ঋক। আলতো করেই ধরে রেখেছে লোকটা ঋকের কবজি, অথচ অজগরের পাকের মত শক্তিশালী সে বাঁধন ছাড়ানো ঋকের পক্ষে অসম্ভব।
‘তুমি অনেক দূর পাড়ি দিয়ে এসেছ, এসব আলোচনা থাক এখন। চলো আমার সঙ্গে।’
জানে ঋক, কোথায় জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই চুপচাপ লোকটার সঙ্গে সঙ্গেই চলতে শুরু করল। হ্যাঁ, ওইরকম ভেসে ভেসেই।
একটা ঘরের মধ্যে ঋককে বসিয়েছে ওরা। ঘরই বলতে হচ্ছে, যদিও দেওয়াল টেওয়াল কিছুই নেই, মানে দেখা যাচ্ছে না, কীরকম স্বচ্ছ মত। কিন্তু ভেদ করে বেরোতে গেলে ধাক্কা খেয়ে বোঝা যাবে যে ওইখানটায় একটা কিছুর বাধা আছে। কে জানি কী দিয়ে তৈরি দেওয়াল। ঋক ধাক্কা খেয়েই বুঝেছে। তার চার দিক ঘিরে একটা অদেখা দেওয়াল তাকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রেখেছে।
যে চেয়ারে বসে আছে ঋক সেটাও দেখা যাচ্ছে না। ঋককে অন্য কেউ দেখলে ঠিক ভাববে সে হাঁটু টাটু মুড়ে কিছু একটা বিদঘুটে এক্সারসাইজ করছে। যখন লোকটা ঋককে বলল বসতে, সে তো দিব্যি ওই কমলা নুড়ির ওপরেই বসতে যাচ্ছিল। ও বাবা, সবাই কীরকম একটা হাঁহাঁ করে উঠে তাকে টেনেটুনে এই অদৃশ্য টুল না খাট না চেয়ার কী জানি কী একটার ওপর বসিয়ে দিল।
সেই তখন থেকে এই ঘরটাতেই বসে আছে ঋক। ওকে রেখে সবাই কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণের জন্য। একা একা বসে বসে কত কী যে ভাবছিল ঋক। বেশিটাই মা আর ফুটকির কথা অবশ্য।
ঋকের অজান্তে কমলা আলোটা ক্রমশ আরও গাঢ় হচ্ছিল। পায়ের নিচের নুড়িগুলো থেকে জোরালো কমলা আলো উঠে আসছিল, ঋককে ঘিরে ফেলছিল ধীরে ধীরে। তাকাতে অসুবিধে হচ্ছিল, চোখ ব্যথা করছিল ঋকের। মায়ের জন্য কষ্ট, আর কমলা আলোর কাঁটা মিলে তার চোখ থেকে জল গড়াতে আরম্ভ করল। বাচ্চাদের মত কাঁদছে বুঝেও ঋক চোখ মুছতে পারছিল না। তার হাত পা কেমন যেন লোহার মত ভারি হয়ে গেছে। একটা আঙুল পর্যন্ত নড়াতে পারছিল না ঋক। কমলা আলোর ঘেরাটোপে বসে বসে চোখের পাতা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছিল তার।
‘তুমি তো ক্রিকেটার হতে চাও, তাই না ঋক?’ হঠাৎ তার মাথার মধ্যে প্রশ্নটা বেজে উঠল। খুব কষ্ট করে চোখ খুলল ঋক। তার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এদের সেই প্রমুখ। অন্যরাও রয়েছে, তবে একটু দূরে।
‘খেলবে নাকি, ক্রিকেট?’ লোকটার চোখদুটো আগের থেকেও জ্বলজ্বল করছে। সেই চোখেও কমলা দ্যুতি। তাকানো যায় না বেশিক্ষণ।
অত অস্বস্তির মধ্যেও ঋকের হাসি পেল। বলে কী রে লোকটা। মাঝদুপুরে কোথায় একটা নিয়ে এসে এখন বলে ক্রিকেট খেলাবে। এ কথার কোনো উত্তর হয়।
লোকটা ঋকের দিকেই তাকিয়ে ছিল। কোনও জবাব না পেয়ে ঋকের সামনের দেওয়ালটার (মানে যেখানে দেওয়াল আছে বলে ঋক ভাবছিল আর কি) দিকে একটা আঙুল তুলল।
আরে, এ কী! এ তো ঋক নিজেই।
ঋকের সামনে এখন একটা আস্ত সিনেমার পর্দা। সেখানে চলছে ক্রিকেট ম্যাচ। কারা যে খেলছে ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না, টিম লোগোও পড়া যাচ্ছে না, কিন্তু একজন ব্যাটসম্যান যে ঋক নিজে সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষের মাথা। একটা দুর্ধর্ষ ছয় উড়ে গেল ঋকের ব্যাট থেকে, হাততালির শব্দে কান পাতা দায়।
ঋক অবাক হয়ে দেখছিল, মাথার মধ্যে হাসি শুনে লম্বা লোকটার দিকে তাকাল।
‘চাও, ঋক্, এই জীবন’?
ঋক অনেক কষ্টে মাথার মধ্যে একটা একটা করে শব্দ সাজায়। কেন যে এরকম লাগছে তার কে জানে। নিজের শরীরটা যেন নিজেরই বশে নেই। তবু জোর করে নিজেকে গোছায় সে, স্পষ্ট করে উত্তর দেয় লোকটাকে, ‘একমাত্র এটাই তো চাই, সে তো আপনি জানেনই মনে হচ্ছে।’
‘বাঃ। চাইলেই পাওয়া যায়, জানো তো।’
এবার ঋকের সত্যি রাগ হচ্ছিল। তখন থেকে লোকগুলো শুধু হেঁয়ালি করে চলেছে। সেই কখন নিয়ে এসেছে, কিছু খেতে পর্যন্ত দেয় নি। খিদেতে হাত পা এলিয়ে পড়ছে। খিদেতেই নিশ্চয়ই, নইলে এমন গা ছেড়ে দেওয়া অবস্থা ঋকের হবে কেন? নেহাত মা বলেছেন অচেনা কারো বাড়ি গিয়েই হ্যাংলার মত খাইখাই করতে নেই, তাই চুপ করে ছিল ঋক।
‘ক্রিকেট কেন, যা চাইবে তাই। আমরা সব দিতে পারি, সব। বই পড়তে ভালোবাসো?’ লোকটা আবার আঙুল দেখাল। অমনি ঋকের স্তম্ভিত চোখের সামনে ক্রিকেটের সিনেমাটা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ভেসে উঠল ছাদ পর্যন্ত উঁচু বইয়ের তাক। ঋকের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত হাসল লোকটা, ‘আর কী কী ইচ্ছে আছে তোমার ঋক? ভাবো, ভেবে দেখ ভালো করে। সব পেয়ে যাবে।’
ঋকের মাথা ঝিমঝিম করছিল। কী যে বলছে লোকটা ঠিকমত বুঝতেও পারছিল না সে। কী এক ক্লান্তিতে তার মস্তিষ্ক অবশ হয়ে আসছিল। জোর করে নিজেকে সোজা করতে চেষ্টা করে ঋক। কমলা আলো তাকে ঘিরে পাক খায় আরো দ্রুত। শেকল হয়ে বসে হাতে, পায়ে। লোকটা হাসে।
‘অত ছটফট কেন করছ ঋক? বোসো, শান্ত হয়ে বোসো।’
‘কিন্তু, আপনারা কী করে জানতে পারলেন যে আমি ক্রিকেটার হতে চাই?’
‘সব তোমাকে বোঝালেও তুমি বুঝবে না, সোজা করে বললে বলা যায় যে কারো যদি কোনও একটা বিষয় নিয়ে প্রবল ইচ্ছে থাকে, সেই ইচ্ছের তরঙ্গ আমরা অনুভব করতে পারি।’
খুব একটা যে বুঝল ঋক তা নয়, কিন্তু বললেই আবার বলবে আগেই তো বলেছিলাম বুঝবে না। তাই আর কিছু বলল না। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে খোঁচা মারছিল, সেটা চেপে রাখতে পারল না ঋক, করেই ফেলল।
‘এখানে স্পেশাল কোচিং করাবেন বুঝি আপনারা?’
‘কোচিং?’ লোকটা এত জোরে হাসল ঋকের মাথার মধ্যে যে ঘিলু পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠল, ‘কোচিং কেন? তোমার স্বপ্ন তো পূরণ হয়েই যাচ্ছে।’
‘মানে? আমি কিছু না শিখেই ওরকম বড়ো ম্যাচ খেলব নাকি?’
‘আহা কী মুশকিল। সত্যি সত্যি খেলতে হচ্ছে নাকি। এখানে থাকলেই তো হল। যেমন চাও নিজেকে তেমনটি দেখতে পাবে। আজ না হয় তোমাকে বাইরে থেকে দেখালাম, কিন্তু আমাদের কথায় রাজি হলে নিজেকে ওই স্বপ্নের মধ্যেই দেখতে পাবে। বুঝতেই পারবে না ওটা যে স্বপ্ন,’ লোকটার কমলা চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলে। চোখ সরিয়ে নেয় ঋক।
‘এখানে থাকলে মানে? বাড়ি যাব না? স্টেডিয়ামে খেলব না?’
‘ওসব ফালতু পরিশ্রম করতে যাবে কেন? আচ্ছা বোকা ছেলে তো তুমি। তোমার স্বপ্ন তো নিজেকে ক্রিকেটার দেখা, সে তো দেখতেই পাচ্ছ। শুধু একটাই শর্ত, এখানেই তোমাকে থেকে যেতে হবে সারা জীবন। তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধে নেই। তোমার পুরোনো স্মৃতি তো সব আমরা মুছেই দেব। তোমার স্মৃতিটা যে আমাদের দরকার ঋক।’
‘মানে’? ঋক শিউরে ওঠে।
‘সব কথার মানে জানতে চেও না ঋক। জানলেও বুঝবে না,’ লোকটার গলা এবার গম্ভীর শোনায়, ‘শুধু এইটুকু জেনে রাখ, তোমার বেঁচে থাকার জন্য যেমন ডাল ভাতের দরকার হয়, আমাদেরও তেমনি দরকার হয় মানুষের স্মৃতি। যে স্মৃতিতে যত বেশি স্নেহ, যত বেশি ভালোবাসা, ততই আমাদের তৃপ্তি, ততই পুষ্টি। তোমার ওই স্মৃতিটুকু আমাদের দিয়ে দিলেই হবে।’ লোকটা কেমন যেন লোভীর মত তাকায় ঋকের দিকে, ‘বিনিময়ে তোমার সবথেকে জোরালো ইচ্ছেগুলো আমরা মিটিয়ে দেব।’
‘ইচ্ছে মেটাবেন না ছাই। সব তো মিথ্যে, সব ফাঁকি। সারা দিন ধরে দেখে যাব দারুণ ক্রিকেট খেলছি, কিন্তু আসলে সত্যিকারের খেলছি না,’ রাগে ঋকের মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল, ‘মা বাবাকে ভুলে গিয়ে, ফুটকিকে ভুলে গিয়ে এই বিচ্ছিরি গাছ নেই পাখি নেই কুকুর, বেড়াল নেই জায়গাটায় নকল ক্রিকেট খেলার জন্য থেকে যাব। ইয়ার্কি পেয়েছেন।’
ঋক সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে তার শরীর মনের এই অদ্ভুত জড়তা কাটানোর। এবং আশ্চর্য হয়ে দেখে তার প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গেই কমলা আলোর শেকল আস্তে আস্তে কমজোর হয়ে আসছে। অসহ্য রাগে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সবাই দৌড়ে এল ওকে আবার বসিয়ে দিতে। ঋকও প্রাণপণে হাত পা চালাতে শুরু করল। আঁচড় কামড় লাথি ঘুঁষি যা পারে।
‘আমার সবথেকে জোরালো ইচ্ছে মেটাবেন, তাই না? মেটান তাহলে, দেখি কেমন পারেন। আমার ইচ্ছে কপালে মা’র ঠাণ্ডা হাত, আমার ইচ্ছে বাবার গায়ের রোদ রোদ গন্ধ। আমার ইচ্ছে ফুটকির হাতে ভাইফোঁটা, ঝর্ণামাসির হাতের পায়েস। কই, মেটান?’ অন্ধের মত বাতাস খামচায় ঋক, হাঁপায়।
এই মারামারির মধ্যেই হঠাৎ যেন অনেক লোকের হট্টগোল কানে এল। তার মধ্যে বাবার গলাও পেল মনে হল ঋকের। তার মানে? বাবাকেও কি ধরে নিয়ে এসেছে নাকি এই লোকগুলো। কপালে টপ করে একটা গরম জলের ফোঁটা পড়তেই চোখটা খুলে গেল তার। চোখ খুলেই দেখতে পেল মার কান্নামাখা মুখ। বাবাও আছেন, ফুটকি আর ঝর্নামাসিও আছে। আরও কত লোক। এ মা, কী লজ্জা। ঘুমিয়েই পড়েছিল ঋক ট্যাংকের ছায়ায়।
‘ওই তো, ওই তো চোখ খুলেছে,’ একটা বিরাট হইচই উঠল।
‘বাব্বাঃ, কী ছেলে সত্যি বউদি আপনার। দিন গড়িয়ে সন্ধে হল, হিরো ট্যাংকের নিচে ঘুমোচ্ছে। এদিকে বাড়িশুদ্ধু লোক খুঁজে খুঁজে হয়রান। এই যে, মিস্টার হিরো, বেরোন এবার ওখান থেকে।’
এটা তো চৌধুরি আংকলের গলা। ইস্, উনিও এসে পড়েছেন। ঋক ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাল। বাবা তখন খুব মন দিয়ে চশমার কাচ মুছতে লেগেছেন।
মা আস্তে আস্তে হাতটা বাড়ালেন ঋকের দিকে।
‘একটু বকেছি বলে এত রাগ করেছ সোনা?’
ঋকেরও চোখটা কেমন জানি জ্বালা করে উঠল। মার বাড়ানো হাতটা ধরে সাবধানে বেরিয়ে এল সে ট্যাংকের নিচ থেকে। স্বপ্নেও মা বাবা ফুটকিকে ছেড়ে থাকা তার দ্বারা হবে না, বুঝতে পেরে গেছে ঋক। বরং এবার থেকে মন দিয়ে অংক করবে, ঠিক।
ফুটকির সরু গলার চিৎকারে দাঁড়াতে হল।
‘তোমার হাতে ওটা কী গো দাদাভাই?’
ঋক অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল তার ডান হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে ধাতুর মত চকচকে, রবারের মত নরম, ফিনফিনে পাতলা একটা রুপোলি মত কী জিনিসের যেন টুকরো।
---------------
ছবি - নচিকেতা মাহাত
লেখক পরিচিতি - অনেককাল আগে পড়াশোনা হয়েছিল ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। এখন পেশা বাণিজ্যিক অনুবাদ, আর নেশা পড়া, পড়া। আরও, আরও পড়া। তারই সঙ্গে নামী অনামী নানা পত্রিকায় লেখালেখি, ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য। শখ বলতে অনেক কিছুই, কিন্তু সবথেকে বড় শখ নানারকম কেক, কুকিজ তৈরি করা।
ভালো লাগল। আরও চাই কিন্তু।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
ReplyDeleteBhishon shundor!
ReplyDeleteভারী মিষ্টি গল্পটা। সাধারণত এই ধরনের গল্প যেভাবে শুরু হয় আর বেশিরভাগই যেভাবে শেষ হয় তার সব কিছুই পেলাম।
ReplyDelete