উত্তরণ
রাজীব কুমার সাহা
রোদজ্বলা ছাতাটা বগলদাবা করে দরজায় এসে দাঁড়াতেই পেছন থেকে জেঠিমার চাপা স্বরে ‘দুগ্গা দুগ্গা’ শব্দ কানে এল হরেন জেঠুর। চটজলদি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে একবার ডানহাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে তারপর তর্জনী দিয়ে নিজের নাকের পাটা দুটোকে পালা করে চেপে দু’বার শ্বাস ছেড়ে আজকের পদক্ষেপটা ঠিক করে নিলেন। এই তাঁর নিত্যদিনের অভ্যেস। বাঁদিকের ছিদ্রটা দিয়ে অনায়াসে ফোঁস করে এক ঝলক গরম বাতাস বেরিয়ে এলেও ডানদিকের ছিদ্রটাতে ফ্যাঁত করে একটা শব্দ হল শুধু। অর্থাৎ ডান নাক বন্ধ, আজ তবে ডান পা-টা বাড়িয়েই চৌকাঠটা ডিঙোতে হবে। মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে হরেন জেঠুর। মুখের পানটারও যেন ঝাঁঝ বেড়ে গেল এক নিমেষেই। শাস্ত্রে আছে পুরুষের বাঁ পা আর নারীর ডান পা। বিধি মতে হল না, কপালে কী আছে কে জানে আজ! কটমট করে ঘাড় বাঁকিয়ে একবার জেঠিমার দিকে তাকিয়ে রকেট বাজির মতো ছিটকে বারান্দাটা পেরিয়ে গেলেন।
উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নেমে ডানদিক ধরে বাড়ির সীমানাটা পেরিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন হরেন জেঠু। বাড়ির সীমানা লাগোয়া একফালি জমিটার দিকে চোখ পড়তেই তিরিক্ষে মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গেল। ঠোঁট দুটো যথাসম্ভব ছুঁচলো করে আর গলাটা খানিকটা আকাশমুখো করে চোখমুখ রাঙিয়ে হাঁক পাড়লেন, “অ্যাই, কে র্যা? অখানে...উউউম...”
কথাটা শেষ করার আগেই পানের রসে গলাটা বুঝে এল। পুচ করে পিকটা রাস্তার ওপাশে অবনীবাবুর টিনের বাউন্ডারির গায়ে ছিটিয়ে এগিয়ে এলেন জেঠু। মস্ত ঝোলা গোঁফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঠোঁটের কষ বেয়ে একটু পানের রস গড়িয়ে পড়ল। রসটা হাতের চেটো দিয়ে মুছে জিগ্যেস করলেন, “কি রে, কানে যাচ্ছে না কথা? ওখানে কী করছিস তোরা?”
অমু, পাপাই, তনু, রঞ্জু এরা কয়েকজন এগিয়ে এল। আর বাকিরা গুটি গুটি পায়ে এককোণে জড়ো হয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে লাগল। সবক’টির চোখমুখ এই শেষ ভাদ্রের কড়া রোদ খেয়ে থমথম করছে। হাতে গায়ে জংলার কাঁচা গন্ধ। মুখের হাসি আটকে গিয়ে আতঙ্ক উপচে পড়ছে চোখে। হরেন জেঠু একটু বিক্ষিপ্তভাবে নজর বুলিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “অ, দা খুন্তি কোদাল শাবল সবই মজুত আছে দেখছি। যা কানে এসেছিল তাই সত্যি তাহলে।”
তারপর সেকেন্ডের মধ্যেই খেঁকিয়ে উঠলেন, “এক্ষুনি এই মুহূর্তে আমার মাঠ থেকে বেরো তোরা। নয়তো কান ধরে হিড়হিড় করে... না কান-টান নয়, নির্ঘাত জুতোপেটা করব সব ক’টাকে। যতসব অপোগণ্ডের দল, করাচ্ছি তোদের দুর্গাপুজো। বেরো, বেরো বলছি। বেরোলি?”
পাড়ার ছেলেদের মধ্যে তনু বরাবরই একটু ডাকাবুকো গোছের। সামনের বছর স্কুল ফাইনাল দেবে। কনুইয়ে অমুর শক্ত করে ধরে রাখা হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল হরেন জেঠুর দিকে। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল, “এক টুকরো জমি। খালিই পড়ে আছে এ যাবত। মায়ের পুজোয় দোষ কি? আমরা তো গিলে খাচ্ছি না আপনার জমি, জেঠু! দিন কয়েকের তো ব্যাপার।”
“কি? এত বড় কথা? কে, কে? কে তোদের পারমিশন দিয়েছে শুনি?” লাফাতে লাফাতে ছাতাটা বগল বদল করলেন জেঠু। তারপর হঠাৎ কী একটা আঁচ করেই হুঙ্কার ছাড়লেন, “কাকা, বেরিয়ে আসুন। আমি জানি আপনি এখানেই আছেন। আমার কাছে আসুন।”
হরেন জেঠুর কাকা নিবারণ দাদু আস্তে আস্তে একটা আমগাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে অন্ধকার মুখে জেঠুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। জেঠুকে গেট খুলে বেরিয়ে আসতে দেখেই চট করে আমগাছটার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এবার সামনে এসে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগলেন, “এই হরেন, বাপ আমার, তুই আর অমত করিসনি বাবা। ছেলেপুলেগুলো তবে কোথায় যায় বল দিকিনি? এত বছরের পুরনো পাড়ার পুজো, তুই বাধা দিলে বন্ধ হয়ে যাবে যে! বেলতলাটা তো মাস তিনেক আগেই বেচাকেনা হয়ে গেল। তুইই তো ছিলি মুহুরি। নতুন পার্টি তো দিন দশেকের মাথাতেই বাউন্ডারি তুলে দিল। এখন এই জায়গাটা না পেলে...”
“আপনার কথা শেষ হয়েছে? নাকি আরও কিছু বলার আছে?” চোখদুটো সরু করে জিগ্যেস করলেন জেঠু।
নিবারণ দাদু করুণ চোখে একবার হরেন জেঠুর দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন। নার্ভাস প্রকৃতির মানুষ, বিয়ে থা করেননি। পাড়ার ছেলেপুলেগুলোকে নিয়েই মেতে আছেন সর্বক্ষণ। পড়তে খুব ভালবাসেন। নিজের ঘরের আলমারিতে প্রচুর বই আছে দাদুর। ভাইপোকে দারুণ ভয় করেন।
“তাহলে আমার কানে যা এসেছে তা-ই সত্যি? এখানে পুজো করার পারমিশন আপনিই দিয়েছেন?”
বোমা ফাটল যেন একখানা। সবাই নীচের দিকে তাকিয়ে পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটছে। নিবারণ দাদু একবার শুধু ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গির গিঁটটা খুলে আরেকবার শক্ত করে বেঁধে নিলেন।
একটু অপেক্ষা করে জেঠু দুপদাপ করে কোর্টের দিকে রওনা হতে হতে বলে গেলেন, “বিকেলে ফেরার পথে যেন একজনের টিকিটাও নজরে না পড়ে। এ জমি আমার, জমি নয় সোনার টুকরো। এ পাড়ায় সবচাইতে দামি জমি। এখানে ওসব চলবে না বলে দিলুম। পালা সবক’টি এখান থেকে। আর, আর এই খালি কলসিটা সামনে বসিয়ে রাখলি কেন? জানিস না অফিস বেরুচ্ছি?”
“ওটা খালি নয় জেঠু, জলে ভর্তি। আমাদের খাওয়ার জল,” হা হা করে উঠল পাপাই। একটা অগ্নিদৃষ্টি হেনে রাগে গজগজ করতে করতে এগোতে লাগলেন জেঠু। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। সকাল সকাল গিয়ে কোর্টে হাজির না হলে পুরো দিনটাই মাটি। কোর্টে দুপুর বারোটা পর্যন্তই মাহেন্দ্রযোগ চলে, তারপর অমৃতযোগ শুরু হয়ে যায়।
সকালে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গিয়ে জেঠু বিকেলে ফিরে এলেন প্রচণ্ড ফুঁসতে ফুঁসতে। বেলা এগারোটা নাগাদ চারটে নতুন মক্কেল দেখা করার কথা ছিল, এল না। নাকি অন্য কোথাও গিয়ে ভিড়েছে কে জানে। তার ওপর একটা জমির দলিলে ভুলভাল বয়ান লিখে উকিলবাবুর চোখ রাঙানিও হজম করতে হয়েছে একবার। ওই যে ডান নাক বন্ধ, ওটাই হচ্ছে মূল। ইচ্ছে করছিল একটা লোহার শিক গরম করে ঢুকিয়ে দিতে ওই নাকে তক্ষুনি।
তবে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মন থেকে একটা ভার নেমে গেল যেন। জমিটা খালিই আছে। বাঁশ-টাঁস পড়েনি, যাক। মাঝখান থেকে আগাছা-টাগাছাগুলো কেটে সাফ করে দিল ছোকরাগুলো মাগনায়। মুচকি হাসলেন জেঠু। ইয়া মোটা ঝোলা গোঁফের আড়ালে এই হাসি একমাত্র জেঠু ছাড়া আর কেউ টের পায় না। তারপর উল্টোদিকে চোখ ফেরাতেই আঁতকে উঠলেন। একি! অবনীবাবুর বাউন্ডারির টিনের বেড়া খুলে নিল কে? ওমা, এক বোঝা বাঁশও পড়ে আছে দেখছি অনেকখানি উঠোন জুড়ে! ভদ্রলোক কি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? একবার গেড়ে বসলে ও জায়গা আর ফেরত পাবেন? একটিবার পরামর্শটুকু করার প্রয়োজন মনে করলেন না! যতসব উজবুকের মেলা পাড়া জুড়ে। দুমদাম পা ফেলে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালেন হরেন জেঠু।
আজ ষষ্ঠী। প্যান্ডেলে মূর্তি এসে গেছে সন্ধ্যার আগেই। বাড়িতে বসেই ছেলেপিলেদের চিৎকার চেঁচামেচি কানে আসছে। হরেন জেঠু সেই বিকেল থেকেই ঘর বার করছেন অনবরত। জেঠিমা বার তিনেক কিছু একটা বলতে এসে ধমক খেয়ে নাক ফুলিয়ে পুজো প্যান্ডেলে গিয়ে বসে আছেন। হরেন জেঠুর অস্থির লাগছে শরীরটা। এত বছর নিজেই অযাচিতভাবে মাতব্বরি ফলিয়ে এসেছেন পাড়ার পুজোয়। এবার তিনিই ব্রাত্য। কলি কলি, ঘোর কলি। আর তুই ব্যাটা অবনী, তুইও পর্যন্ত একটিবার খোঁজ করলি না! অ্যাঁ? নিমকহারাম কোথাকার! এই এত সুন্দর রাস্তার পাশে বাড়িটা কে কিনিয়ে দিয়েছিল শুনি? এই শর্মাই তো। যা, কর গে তোদের পুজো তোরা। অভিমান করে বসে আছেন বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে হরেন জেঠু।
কিন্তু প্যান্ডেলের দমকা আলো আর ঘন ঘন ঢাকের আওয়াজের আকর্ষণে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারলেন না জেঠু। ন’টা নাগাদ আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে পাজামার ওপর একটা পাঞ্জাবি গলিয়ে পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হলেন প্যান্ডেলে। হাজির হওয়া মাত্রই নানারকম ফিসফাস আওয়াজ কানে আসতে লাগল অনবরত। ‘ওই এসেছে,’ ‘যা বানিয়েছে এই অবধি, ম’লে পাঁচ ভূতে লুঠে খাবে’, ‘দিন কয়েকের তো ব্যাপার ছিল’, ‘মায়ের কাজে বাধা! কি পাষণ্ড, কি পাষণ্ড!’ ‘নরকেও ঠাঁই হবে না দেখো...’ সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে চলছেই। চারদিক উদ্ভাসিত আলোয় ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। দুর্গা প্রতিমার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলেন জেঠু। মায়ের চোখে চোখ রাখতে পারলেন না। ঠাকুর কেমন হয়েছে দেখতেই পেলেন না ভালো করে।
নিবারণ দাদু অবনীবাবুকে কী যেন কানে কানে বলেই গা ঢাকা দিলেন। তনু অমুরা একটু আগেই বেরিয়ে গেছে যার যার সাইকেল নিয়ে। এলাকার সব কয়টি প্যান্ডেলে আজই ঘুরে আসতে হবে। এরপর আর সুযোগ মিলবে না। কাল সকাল থেকে টানা চারদিন নিজেদের পুজোতেই আটকে থাকতে হবে।
অবনীবাবু চোখ পড়তেই এগিয়ে এলেন, “আরে আসুন আসুন, আমিও রাসুকে জিগ্যেস করছিলাম। শরীর-টরির খারাপ না কি, তাই আর... হেঁ হেঁ হেঁ।”
হরেন জেঠু সেই মুচকি হেসে বললেন, “সব ঠিকঠাক এগোচ্ছে তো? পুরুত কাকে ঠিক করেছেন, সেই ভটচাজমশাই তো?”
“হ্যাঁ, এ পাড়ায় আসা পর্যন্ত তো উনাকেই দেখছি।”
“দিনক্ষণ দেখে-টেখে মায়ের মূর্তি ঢুকিয়েছেন তো? নাকিও আপনিও সেই ছেলেছোকরাদের দলে? ঢাকী কতজন এবার?”
“সে কি মশাই! আজ মহাষষ্ঠী, সারাদিনই তো ভালো দিন। আলাদা করে দিনক্ষণ আবার...”
“আরে আছে মশাই, আছে। নইলে কি আর সাধে বলছি?” বিরক্ত হলেন জেঠু। তারপর হঠাৎই সুর পালটে বললেন, “যাকগে, জানেন না বোঝেন না যখন... তা সবই তো আগের মতোই এগোচ্ছে দেখলাম। শুধুমাত্র প্যান্ডেলের জায়গাটা...। তা আপনি ভালোই করেছেন। মাকে একেবারে বাড়িতেই এনে ঢুকিয়েছেন। আমরা কিন্তু মায়ের এই অধিষ্ঠান পাকাপাকিভাবেই চাই। আমার আর কি, বয়েস হচ্ছে। এখন তো বস্তার পচা আলু।” বেশ কেটে কেটে কথাগুলো শুনিয়ে দিলেন হরেন জেঠু অবনীবাবুকে।
কে একজন দুটো চেয়ার এগিয়ে দিল। ফিরেও তাকালেন না। অবনীবাবুর থমথমে মুখটার দিকে একটা করুণার দৃষ্টি হেনে বাড়ির দিকে রওনা হলেন হরেন জেঠু।
প্যান্ডেলের আবছা আলোয় নিজের গেটের বাঁদিকে পাকা দেওয়ালটাতে হঠাৎ চোখ যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন জেঠু। কি যেন একটা পোস্টার মতো দেখা যাচ্ছে না? কই সারাদিন তো একবারও চোখে পড়েনি? এগিয়ে গিয়ে মুখটা দেওয়ালের কাছে নিয়ে দেখলেন, হ্যাঁ, একটা পোস্টারই বটে। কিন্তু পড়া যাচ্ছে না, আবছা লাগছে। দ্রুতপায়ে ঘরে ঢুকে বালিশের পাশ থেকে টর্চটা বাগিয়ে আবার ফিরে এলেন। টর্চ ফেলে দেখলেন একটা ছড়া মতো লেখা আছে সাদা কাগজে আলতা দিয়ে। বাহ, ছেলেরা বেশ লায়েক হয়েছে দেখছি! এবারের পুজো নিয়েই কোনও একটা কাব্যি-টাব্যি করেছে বোধহয়। কিন্তু প্রথম দুটো লাইন পড়েই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল হরেন জেঠুর। তাড়াতাড়ি টর্চটা বন্ধ করে এদিক ওদিক তাকালেন। না, কেউ নেই। সন্তর্পণে আবার টর্চ জ্বেলে পড়তে শুরু করলেন। একটা লাইন পড়েই টর্চটা নিভিয়ে ফেলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।
হাঁড়িপানা বদনেতে, চোখদুটো কুতকুতে
পিন থেকে হাতি তক, সবেতেই খুঁতখুঁতে
কষ বেয়ে রস পড়ে, গোঁফেতে লুকোন ঠোঁট
তারে বাঁধা চটি জোড়া, গায়ে তাঁর কোট
যক্ষের ধন নিয়ে আদেখলে অ্যায়সা
হাত গলে পড়ে নাকো, এক নয়া পয়সা
দিবারাত্র শাস্ত্র বিচার, খনার বচন
চোখ বুজলে খাবে চিলে, দেহতে পচন
একজোড়া ধুতি কিনে, দশ বছর পরেন
এ পাড়ার গোঁফো বুড়ো, নাম তার..........
পড়া শেষ করতেই মাথায় মুহূর্তে রক্ত চড়ে গেল হরেন জেঠুর। কি করবেন না করবেন কিছুই স্থির করে উঠতে পারছেন না। কাকে মারবেন, কাকে ধরবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। দেখেছ ছোঁড়াগুলোর কাণ্ড! কী এক বিটকেলে পোস্টার... তাও আবার আমারই বাউন্ডারির দেয়ালে! শেষ লাইনে কায়দা করে নামটা না লিখলে কী হল, সে কি আর বুঝবে না কেউ? আর কে কে মিলে এই কাজটা করলি তাও কি আমি ধরতে পারিনি ভেবেছিস? না, এই মুহূর্তে থানায় যাওয়া উচিত। কিন্তু বড়বাবু কি আর এত রাতে কষ্ট করে ভুঁড়ি ঠেলে আসবেন? না না, আমি সোজা কোর্টেই... সে তো কাল সকাল ছাড়া হচ্ছে না। তাছাড়া, আজকেই তো পুজোর বন্ধ পড়ে গেল। মাথার চুলগুলো নিজের হাতেই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলেন জেঠু গেটের বাইরে কিছুক্ষণ। তারপর চকিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে খাবলে আঁচড়ে পোস্টারটা যতটুকু হাতে এল তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে ড্রেনে ফেলে দিলেন। রাস্তার দিকে হঠাৎ কার যেন পায়ের আওয়াজ আসতেই চট করে আর একটু আবছায় ড্রেনের পাশে সরে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবির ঝুলটা থুতুনির নিচে গুঁজে দিয়ে পাজামার রশির গিঁটটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন একটা বিশেষ ভঙ্গিমায়। জেঠিমা গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতে মুখ বেঁকিয়ে একটা মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন, “আহ, মরণ! বাড়ির ভেতর যেন আর ব্যবস্থা নেই মিনসের। যত্তসব ভীমরতি আর কি!”
জেঠিমাকে পাত্তাও দিলেন না হরেন জেঠু। হঠাৎ কী একটা মনে পড়তেই সাবধানে টর্চ ফেলে আশপাশের দেয়ালগুলো খুঁটিয়ে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। আবারও চারদিকে একটু চোখ বুলিয়ে রেল ইঞ্জিনের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে গেট খুলে ভেতরে চলে গেলেন।
ঘড়ির কাঁটাগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে রাতদুপুরে পৌঁছে গেল। কিন্তু হরেন জেঠুর ঘুম আসছে না কিছুতেই। চোখের পাতাদুটো ভার হয়ে আছে কিন্তু ঘুমটা জুত করে লাগছে না। একটু ঝিমুনি মতো আসার পরই চটকটা ভেঙে যাচ্ছে। গিন্নিকে কতদিন বারণ করা হয়েছে, রাত-বিরেতে ওসব সর্ষেবাটা ইলিশ-টিলিশ দিও না, দিও না। কে কানে তোলে কার কথা। অবনীর দেমাক, পোস্টার, ইলিশ - সব শত্তুর যেন আজ একজোট হয়ে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়েছে হরেন জেঠুর দেহে। বারবার টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখছেন, গ্লাস গ্লাস জল খাচ্ছেন আর ঘনঘন বাইরে যাচ্ছেন। যত দেবদেবীর নাম মনে আনতে পেরেছেন সবাইকে পায়ে ধরে সেধেছেন। কিন্তু কেউই একফোঁটা ঘুম দিতে পারলেন না। বিছানাটা মনে হচ্ছে একটা আগুনের কুণ্ড। বিশেষ করে পোস্টারের জ্বলুনিটা নেভানো যাচ্ছে না কিছুতেই। না হয় তোদের প্যান্ডেল বানাতে বাধাই দিয়েছি। তা বলে এটুকুও মান্যিগণ্যি করবি না! বাপ মা কি কিছুই শেখায়নি তোদের? হারামজাদা সব! রোস, সবক’টাকে যদি জেলের ভাত না খাইয়ে ছেড়েছি আমি... আর তুমিই বা কেমন বাপের ব্যাটা হে নিবারণ কাকা? আমারই খেয়ে, আমারই পরে আবার আমার বিরুদ্ধেই গেলে! রামায়ণের পাতা খুলে চোখে আঙুল দিয়ে তোমার চরিত্রটা দেখিয়ে দিতে হবে, দাঁড়াও।
নিজের মনে গজগজ করতে করতে আর বাপ-বাপান্ত করতে করতে চোখের পাতা কখন যেন জুড়িয়ে এসেছে হরেন জেঠুর। সোনা ব্যাঙের গলার মতো নাকের আওয়াজটাও একটু একটু করে স্পীড নিচ্ছে। হঠাৎ একটা দমকা কাশির চোটে ঘুমটা কেঁচে গেল। কাশিটা থামতেই একটা পবিত্র গন্ধ পেলেন নাকে। ঠিক যেন সন্ধেবেলার পুজো প্যান্ডেলের ধূপের গন্ধের মতো।
মুহূর্তেই হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসলেন জেঠু। কে যেন একটা অদ্ভুত গলায় তাঁর নাম ধরে ডাকছে খুব কাছে থেকেই। কেমন যেন গা ছমছম করছে। কাঁপা হাতে বালিশের পাশে রাখা টর্চটা হাতড়াতে লাগলেন। পেলেন না। ওদিকে তাঁর নাম ধরে ডেকেই চলেছে ধাতব একটা স্বর। গলার স্বরটার দিকে তাকাতে সাহস পাচ্ছেন না। না তাকালেও গলাটা যে আলমারির কাছে ধারে কোথাও থেকে আসছে তা আন্দাজ করতে পারছেন। ঘন ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে সারা ঘর আস্তে আস্তে। জিরো পাওয়ারের বাল্বটা আর দেখা যাচ্ছে না স্পষ্ট। একটা আতঙ্ক যেন ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। কোনও মতে ঘাড় ফিরিয়ে একটা ঢোঁক গিলে জিগ্যেস করলেন, “কে? কে ওখানে?”
নিজের গলাটা নিজের কানেই বড় অস্বাভাবিক ঠেকল যেন। ধোঁয়ার ভেতর থেকেই আবার আওয়াজ ভেসে এল, “ওহ, জায়গা তো দিলিই না, এখন আমাকে চিনতেও অসুবিধে হচ্ছে তোর?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হতভম্বের মতো বসে রইলেন হরেন জেঠু। শরীরটা অসম্ভব গরম হয়ে উঠছে একটু একটু করে। হাতে পায়ে একফোঁটাও জোর নেই।
“হরে...ন!” দৃঢ় স্বরে আবার ডাক পড়ল।
মেয়েলি অথচ চাপা বাজখাঁই একটা গলা। জেঠু বলির পাঁঠার মতো শুধু কাঁপছেন বিছানায় বসে বসে। মুখে একটা শব্দও যোগাচ্ছে না। সব আটকে যাচ্ছে গলায়।
“তোর জায়গা সম্পত্তির অভাব কোথায় হরু? ওই ফাঁকা জায়গাটা আমার খুবই পছন্দ ছিল। গতবারই ঠিক করে রেখেছিলুম, এবার এলে ওখানেই উঠব, থাকব। ওই এক বেলতলা পেয়েছিস, প্রত্যেক বছর ধরে বেঁধে আমায় ওখানেই বসিয়ে দিস তোরা। এ নিয়ে তোদের বাবার সাথে টানা পাঁচ ছ’দিন ঝগড়া বাঁধে প্রত্যেক বছর, অশান্তি হয়। আমি থাকলে উনাকে আবার সিদ্ধি ভাঙগুলো একটু হুঁশ করে গিলতে হয় কিনা। শেষে ভেবে দেখলুম, থাক তোর বাবা তাঁর বেলগাছ নিয়ে। আমি তোর ওই আমগাছটার তলাতেই এট্টুখানি...। তা মাস চারেক আগে তোর হাত দিয়েই তো বেলতলাটাকে বেহাত করিয়ে দিলুম। বেনামে ভালো টাকা দালালি পেলি, আবার মুহুরিগিরি করেও যথেষ্ট কামালি। ভেবেছিলুম শান্তিতে তোর ওই নিরিবিলি জায়গাটুকুতে দিন কতক...। আর তুইই কিনা... এত আস্পর্ধা তোর, অ্যাঁ? নিব্বংশ হবি, নিব্বংশ হবি বলে দিলুম। হা হা হা হা...”
এবার ঘড়ঘড় করে একটু আধটু আওয়াজ বেরোচ্ছে জেঠুর গলা দিয়ে। কিন্তু সারা শরীর অবশ হয়ে গিয়ে হাত পাগুলো যেন পাথর হয়ে রয়েছে। সারা শরীরের শক্তি একত্র করে একটা ছুটে ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে যাবেন ভাবতে না ভাবতেই একটা আবছা মূর্তি ধোঁয়া ভেদ করে চোখের সামনে প্রকট হল। অবিকল দুর্গামূর্তি। সেই চোখ, সেই মুখ, সেই দশটি হাত। এলো চুল ঝাঁকিয়ে শুধু অট্টহাসি হাসছে। হাসতে হাসতে আবার ধোঁয়ার মধ্যে মিলিয়ে গেল সেই মূর্তি। জেঠু তখনও একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে রয়েছেন। চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আস্তে চাইছে। হৃৎপিণ্ডটা যেন লাফাতে লাফাতে গলায় এসে আটকে আছে। একটু সম্বিৎ ফিরে আসতেই এক ঝটকায় শরীরটা টেনে তুলে দরজা খুলে জেঠিমার শোবার ঘরের দরজায় গিয়ে দুমদাম কিল বসাতে লাগলেন।
আজ সপ্তমী। বেলা দশটা বাজে প্রায়। রোজ ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা মানুষটা এখনও অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। জেঠিমা আর থাকতে না পেরে এককাপ চা হাতে ঠেলে জাগালেন হরেন জেঠুকে। আসি-বাসি কাজ সেরে জেঠিমা সবে স্নান সেরে এসেছেন। আবছাভাবে চোখ খুলে পিঠের ওপর ভিজে চুল ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জেঠিমাকে এক পলক দেখেই আঁতকে উঠলেন জেঠু। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে লাগলেন চোখ গোল গোল করে। জেঠিমা সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এলেন। কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে খুলে বললেন রাতের সব কথা জেঠু। পোস্টার, ইলিশ, মা দুর্গার প্রকট হওয়া সব। প্রথমটায় চোখ মুখ শুকিয়ে গেলেও শেষে জেঠিমা মাথা নেড়ে বললেন, “উঁহু, এ বাপু ওই বিচ্ছুগুলোরই কাজ, সে তুমি যা-ই বলো না কেন।”
“এ কথা বলছ কেন? তুমি কি করে জানলে?”
“জানি গো জানি। ভোরবেলায় গোবরছিটে দিতে গিয়ে তোমার ঘরের পেছনের দরজাটার গায়ে দেখলুম কালি-ভুষো লেগে আছে। তারপর একটু নজর করতেই দেখলুম শুধু দরজা নয় মাটিতেও গুঁড়ো গুঁড়ো কাঠকয়লা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আগুন ভর্তি মালসা লাথি মেরে ফেলে দিলে যেমন ধারা হয়। একটু ফর্সা হতেই দেখলুম কে যেন কয়লাগুঁড়ো ছিটোতে ছিটোতে কলাবাগানের দিকে গেছে। শেষে ওই কলাবাগান থেকেই কুড়িয়ে পেলাম এটা। লুকিয়ে রাখা ছিল। খাটের নিচেই রেখে দিয়েছি এনে দেখো। ওই মালসাটাও ছিল পাশে।”
জেঠিমা ইঙ্গিত করতেই গলা বাড়িয়ে খাটের তলায় চোখ ফেললেন হরেন জেঠু। তারপর মাথায় চোঙা আর এক পাশে হাতল লাগানো একটা কল টেনে বের করে আনলেন খাটের তলা থেকে। আরে, এ তো স্যাকরার দোকানের জিনিস! গয়না গড়তে-ভাঙতে আগুনে বাতাস করতে লাগে এটা। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ কলটার দিকে জেঠু। একটু একটু মাথায় ঢুকছে গোটা ব্যাপারটা। উফ, কাল রাতের বিভীষিকাটা মনে পড়লে এখনও যেন গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। শেষে গলাটা খাদে নামিয়ে দাঁত কটমট করে বললেন, “বুঝলে গিন্নী, ওই সবক’টিকে এমন শায়েস্তা আমি করব না, দেখে নিও। তবে পুজোটা ভালোয় ভালোয় কেটে যাক আগে, বুঝলে? এখন ঘাঁটিয়ে লাভ নেই। তবে কোনও অবস্থাতেই ব্যাপারটা পাঁচকান না হয় যেন। এই সাবধান করে দিলুম তোমায়।”
জেঠিমা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেলেন জেঠু চেঁচাচ্ছেন, “আমার ঘর থেকে পাঁজিটা নিয়ে এসো তো। আজকের রাশিফলটা একবার...”
সন্ধ্যের পর সেজে গুঁজে প্যান্ডেল আলো করে এসে বসলেন হরেন জেঠু। বয়স্করা প্রায় সবাই আছেন। শুধু নিবারণ দাদু কাজের অছিলায় এদিক ওদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তনু, পাপাই, অমুরা যে যার কাজে ব্যস্ত। সন্তু বেশ কিছুক্ষণ ধরেই জেঠুকে নজরে রাখছিল। জেঠু ব্যাপারটা তত গা করেননি প্রথম দিকে। শেষে যখন দেখলেন, একেক বার একেক জায়গায় দাঁড়িয়ে এক ছোকরা জেঠুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে তখন হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। সন্তু একেই খানিকটা ক্যাবলা গোছের তায় আবার তোতলা। তনু, পাপাইরা শিউরে উঠল। সর্বনাশ, একেবারে ঘোগের পাল্লায় পড়েছে! যে যার জায়গা থেকেই একটা কান আর একটা চোখ জেঠু আর সন্তুর দিকে পেতে রেখেছে। সন্তু কাছে এসেই বলল, “জে-জেঠু ভালো আছেন তো? কাল রাতে ঘু-ঘুম টুম ভালো হয়েছিল তো?’’
কাল রাতের উল্লেখে জেঠুর চোখদুটো কুঁচকে উঠল সাথে সাথে। পরক্ষণেই ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভেবে গম্ভীর মুখে বললেন, “হ্যাঁ, হয়েছে। তা তুই সন্তু তো? পুজোটা এলেই কী যে রং চঙে জামাকাপড় পরে ঘুরিস তোরা, রাতে বিকেলে চেনাই মুশকিল হয়ে পড়ে।”
তনু পাপাইরা যে যার জায়গা থেকে সন্ত্রস্ত হয়ে আড়চোখে নজর রাখছিল ওদিকে। সবারই বুকগুলো ঢিপ ঢিপ করছে। সন্তুটা যা ক্যাবলা!
রাত নটার দিকে প্যান্ডেল থেকে বেরবার মুখে জেঠিমাকে ডেকে কী যেন গলা নামিয়ে বলে গেলেন জেঠু। জেঠিমাও কাঁই কুঁই করে কী যেন বললেন। ঘণ্টা খানেক বাদেই সন্তুর ডাক পড়ল জেঠিমার সামনে। জেঠিমা এক চিমটে জর্দা মুখে ফেলে বললেন, “আমায় একটু এগিয়ে দে না বাবা, টর্চটা আনতে ভুলে গেছি।”
জেঠিমাকে পৌঁছে দিয়ে সন্তু উঠোন থেকেই ফিরে যাচ্ছিল। জেঠিমা তিলের নাড়ুর দিব্যি দিয়ে ঘরে ডেকে আনলেন। চারটে তিলের নাড়ু গিলে ঢক ঢক করে আধা গ্লাস জল খেয়ে উঠে দাঁড়াতেই দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন জেঠু। সন্তুকে ব্যাপারটা ঠাহর করে ওঠার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ হুঙ্কার ছাড়লেন, “কাল রাতে কে কে ছিলি তোরা? আগুনের মালসাটা লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছিল কে?”
আচমকা এই আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ধপাস করে বসে পড়ল সন্তু। ছিটকিনিটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে আর কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো মনটা কেবল আকুলি বিকুলি করছে। বুকে যেন ধড়াম ধড়াম করে ড্রাম বাজছে। জেঠুর প্রশ্ন শুনে অজান্তেই ডান পায়ের পাতার দিকে হাত চলে গেল সন্তুর। জেঠুও এক নজর বুলিয়ে হিসহিসিয়ে বললেন, “ওহ, জায়গাটাতে লাল চাকলা মতো হয়ে গেছে দেখছি। কিন্তু আসল কালপ্রিটটা কে? ঘরে ঢুকেছিল কে বল।”
“বি-বিশ্বাস করুন জে-জেঠু, আমি আ-আসতেই চাইনি। ওরা জো-জো-জোর করে আ-আমায়...।”
জেঠু চোখ পাকিয়ে বললেন, “সব খুলে বল। নইলে কিন্তু সোজা থানা। বড়বাবুর সাথে কথা হয়েছে। আর সব খুলে বললে তুই বেঁচে যাবি। ঘরে কে ঢুকেছিল দুর্গা সেজে বল।”
সন্তু দুইবার ঢোঁক গিলে আবার ছিটকিনিটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, “ত-ত-তনু। পা-আপাই দরজা আগলে ছিল।”
“আর তোরা?”
“আ-আমরা মানে, আ-আমি আর র-অঞ্জু জানালার ফাঁক আর দরজার ত-তলা দিয়ে ধো-ধোঁয়া সাপ্লাই করছিলাম। ওই যে মে-মেশিনটা, যেটা দিয়ে মালসাতে বা-বাতাস দেয় স্যাকরা, ওটা ত-তনুই এনেছিল কানাই বণিকের দো-দোকান থেকে। আমায় ছে-ছেড়ে দিন জেঠু। খুব হি-হি-হিসি পেয়েছে। আর কোনোদিন ক-করব না।” কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগল সন্তু।
“চোপ! যা জিগ্যেস করছি তার জবাব দে।”
ধমক খেয়ে সন্তু এবার গ্যাঁট হয়ে বসে রইল। শক্ত ঘাড়টা আস্তে আস্তে ফুলে উঠছে। রাগ ওঠে যাচ্ছে মাথায় একটু একটু করে। জেঠু একটু থেমে বললেন, “তনু নয় দুর্গার বেশ ধরে ঢুকেছিল, বুঝলুম। কিন্তু ঢুকল কী করে?”
“স-সন্ধ্যের পরেই আপনার খা-খাটের তলায় লুকিয়ে বসেছিল।” ঘাড় ফুলিয়ে জবাব দেয় সন্তু।
“আর কণ্ঠস্বরটা? ওটা কার? এ তো তনুর নয়।”
“অ্যা-অ্যা-অ্যাপ!” তোতলামির ধাক্কায় একটু জোরেই বেরিয়ে এল শব্দটা সন্তুর মুখ থেকে। জেঠু তো রেগে কাঁই। মাথায় রক্ত চড়ে গেল তৎক্ষণাৎ। রাগের চোটে জেঠুও তোতলাতে লাগলেন, “ক-কী, এত বড় আস্পর্ধা তোর! আমাকে অ্যাপ বলে ধমক দিস? আ-আমাকে? এই হরেন মুহুরিকে?”
“এই ম-মরেছে! ওটা ধ-ধমক নয় জেঠু, মো-মোবাইল অ্যাপ। ত-তনুর মোবাইলে ই-ই-ইন্সটল করা আছে।”
“কী অ্যাপ?” একটু ঠাণ্ডা হন জেঠু।
“ভ-ভয়েস অ্যাপ। মো-মোবাইলে থাকে। ভয়েস রে-রেকর্ডিং করে যেমন খু-খুশি গলার স্বর বা-বানানো যায়। তনুও বা-বানিয়েছে।”
জেঠু একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েই আবার সামলে নিলেন নিজেকে। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “ভালয় ভালয় পুজোটা কাটুক একবার। দেখাচ্ছি মজা তোদের। ওই অ্যাপকে যদি বাপ না ডাকাই তোদের...”
হঠাৎ কী একটা মনে পড়তেই জিগ্যেস করলেন, “আর পোস্টারটা?”
“অমু। ও তো ক-কথায় কথায় ছড়া কা-কাটতে পারে।”
“আর বাতাসের কল মালসা, ওগুলো কলাবাগানে রেখেছিলি কেন?”
“প-পরে সুযোগ মতো নিন্নিয়ে যাবো বলে।”
“হুম।” গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবলেন একটু হরেন জেঠু।
তারপর সন্তুর দিকে না তাকিয়েই হাতে কাক তাড়ানোর মতো ইশারা করা মাত্রই হ্যাঁচোড়-পাঁচোড় করে কোনও রকমে দরজার ছিটকিনিটা খুলে এক দৌড়ে বারান্দা পেরিয়ে উঠোনের অন্ধকারে এসে পড়ল সন্তু। আর প্রায় সাথে সাথেই চারদিক থেকে কতগুলো হাত ওর ঘাড় ধরে রাস্তার দিকে টেনে নিয়ে গেল পাছায় কয়েকটা লাথি কষিয়ে।
তনুরা কখন এসে জেঠুর বাড়িতে ঘাপটি মেরে বসেছিল অন্ধকারে কে জানে।
আজ অষ্টমী। দুপুরে হরেন জেঠুর ছেলে কৌশিকদা বাড়ি এসেছে। শহরে হোস্টেলে থেকে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে কৌশিকদা। একটু খ্যাপাটে, তবে বাপের স্বভাব পায়নি। বন্ধুদের সাথে দু’দিন শহরের পুজো দেখে অষ্টমীতে বাড়ি ফিরে এসেছে। একবার মনে আছে, কৌশিকদা সাপের মাথায় মণি আছে বলাতে নিবারণ দাদু আচ্ছা করে কান মুলে দিয়ে বলেছিলেন, “সাপ মণি দিয়ে কী করবে রে বোকা? অবশ্য তুই একা নোস, অনেকেরই এ ধারণা আছে। আসল কথাটা বলি শোন। ওসব মণি-টনি কিচ্ছু থাকে না ওদের মাথায়। আসলে সব সাপের মাথাতেই আঁশ থাকে। আর ওই আঁশের ফাঁকে ফাঁকে এক ধরনের বুদবুদ বেরোয়। পাতলা আঁশ অথবা ওই বুদবুদে আলো ঠিকরে পড়লে মণিমুক্তোর মতো চকচক করে। আলোর বিচ্ছুরণ। বুঝলি হাঁদারাম?”
তনু, অমু, পাপাইরা দাঁত বের করে হেসেছিল সেদিন। আর কৌশিকদার গালদুটো লাল হয়ে গিয়েছিল।
অষ্টমী নবমীতে তনুরা তক্কে তক্কে থাকলেও জেঠুর তরফ থেকে কোনও রকম সাড়া পাওয়া যায়নি। এতে খানিকটা স্বস্তি পাওয়া গেলেও অশান্তি একটা লেগেই ছিল ভেতরে ভেতরে। নিবারণ দাদুর চোখে মুখেই দুশ্চিন্তার কালো মেঘ আনাগোনাটা করছে বেশি। পুজোটা এবার একদমই ভালো কাটছে না ছেলেপুলেগুলোর। ওদিকে হরেনটা যে হঠাৎ কখন কী করে বসে ঠিক নেই। হাড়ে হাড়ে চেনেন ভাইপোকে। সন্তুটা যে কবে একটু চালাক চতুর হবে!
কিন্তু হরেন জেঠু নির্বিকার। নিয়ম করে প্যান্ডেলে আসছেন। গোমড়া মুখ করে বসে থাকছেন। কেউ এগিয়ে এসে কথা বললে বলছেন, নয়তো চুপচাপ চলে যাচ্ছেন। কোনও হম্বিতম্বি করছেন না, ছেলে বুড়ো সবাইকে ডেকে ডেকে মাতব্বরি ফলাচ্ছেন না, দাঁত খিঁচোচ্ছেন না। এ নির্ঘাত ঝড়ের পূর্বাভাস ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দুদিনে ঘটনাটা পাঁচ কান থেকে পঞ্চাশ কানে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই একটা চাপা টেনশনে ভুগছে। হরেন মুহুরির কাছে থানা-পুলিশ, মামলা-মোকদ্দমা তো জলভাত।
আজ দশমী। ভোর থেকেই আকাশটা হঠাৎ মুখভার করে আছে। মাঝে মাঝে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠরা সিদ্ধান্ত করলেন, দুপুর বারোটার আগেই ভাসানটা সেরে ফেলতে হবে। আকাশের যা অবস্থা, কখন হুড়মুড় করে জল নেমে আসে ঠিক নেই। তাছাড়া দুপুর বারোটা একান্নতে আবার একাদশী লেগে যাচ্ছে। একাদশীতে বিসর্জন হয় না।
কৌশিকদাও কোমরে গামছা বেঁধে প্রতিমায় হাত লাগাল। নদীর ঘাটে প্রতিমা নামাতেই নাচার ধুম পড়ে গেল। শেষে মুরুব্বিরা তাড়া দিয়ে দিয়ে মূর্তি নামালেন জলের ঘাটে। আরও দুটো প্রতিমাও এসে নেমেছে অন্য ক্লাবের। সাউন্ড বক্স, দু’জোড়া ঢাক আর চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। ‘দুগ্গা মা কি জয়’, ‘দুগ্গা মা কি জয়’ জয়ধ্বনি শুনতে শুনতে মা দুর্গা নদীর জলে পিঠ ভাসিয়ে এবারের মতো বিদায় নিচ্ছেন। আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছেন মা। ফুল বেলপাতা আর গলার মালাগুলো ভাসতে ভাসতে ঢেউয়ের সাথে দুলছে। ছেলেরা প্রতিমার হাতের অস্ত্রগুলো পছন্দমতো সংগ্রহ করে নিতে জল দাপিয়ে হুটোপাটি করছে।
হঠাৎ একটা বুজে আসা গলার চিৎকার কানে এল অমুর। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সারা শরীর হিম হয়ে গেল ওর। একটু দূরেই একটা পাথরের আড়ালে মায়ের প্রতিমাটা ডুবছে আর ভেসে উঠছে। তনু এক হাতে কী যেন একটা টেনে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রাণপণে। রঞ্জু, পাপাইদের হাতছানি দিয়ে অমু দুরন্ত গতিতে সাঁতার কেটে চলল ওদিকে। প্রায় মিনিট সাতেক ধস্তাধস্তির পর কৌশিকদা আর তনুকে পাড়ে টেনে তুলল ওরা। জল খেয়ে কৌশিকদা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। সারা গায়ে জল কাদা আর রক্ত। তনুর ডানহাত প্রচণ্ড জখম হয়েছে।
কৌশিকদার পেট থেকে যতটা পারা যায় জল বের করে তাড়াতাড়ি প্রতিমা আনা গাড়ি করেই হাসপাতালে ছুটল সবাই। কৌশিকদাকে ভর্তি করাতে হল। তনুর হাতে ব্যান্ডেজ পড়ল।
পাঁচদিন হাসপাতালে কাটিয়ে লক্ষ্মীপুজোর পরের দিন থেকে বাড়ি ফিরল কৌশিকদা। ফুসফুস কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একমাস বেড রেস্ট দিয়েছেন ডাক্তার। এতদিন রোজ দুবেলা চোয়াল শক্ত করে হাসপাতালে আসা যাওয়া করেছেন জেঠু। কাউকে কিছু বলেননি। কেউ কিছু জিগ্যেস করলেও উত্তর দেননি। আজ কৌশিকদা বাড়ি ফিরতেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন জেঠু। সারা পাড়া কাঁপিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলেন, “অ্যাই, অ্যাই তোরা আমার বাড়িতে পা রাখবি না বলে দিচ্ছি। ভালো হবে না একদম। তোদের জন্যই আজ ছেলের আমার এই দশা। নদীর জলে ডুবিয়ে খুন করার মতলব করেছিলি, না? সব ক’টাকে যদি আমি জেলের ভাত না খাওয়াতে পারি তো আমি হরেন মুহুরি নই।”
“খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছিস কিন্তু হরেন। এই বলে দিলুম”, ভিড় ঠেলে তীক্ষ্ণ অথচ দৃঢ় একটা কণ্ঠস্বর এগিয়ে আসতেই সকলে চমকে ঘাড় ফেরাল ওদিকে। ওমা, এ যে নিবারণ দাদু! থরথর করে কাঁপছেন রাগে।
“তুই কে র্যা? কী আছে তোর? সবাই তোকে শ্রদ্ধা করে ভেবে অহংকার হয়েছে খুব, না? ও শ্রদ্ধা-টদ্ধা কিছু নয়। ভয় ভয়, স্রেফ ভয়। তোর ওই মামলা-মোকদ্দমা আর হম্বিতম্বির ভয়। দুটো কাঁচা পয়সা করেছিস আর অমনি ধরাকে সরা জ্ঞান করছিস? যা নয় তাই বলছিস?” এক শ্বাসে বলে গেলেন নিবারণ দাদু।
“আপনি এর মধ্যে আসবেন না বলে দিচ্ছি কাকা। ওই বদমাইশগুলো আমায় নির্বংশ করে ছাড়বে বলে হুমকি দিয়ে গেছে ঘরে ঢুকে, জানেন আপনি? সেই চেষ্টাটাই করেছিল দশমীঘাটে। শিং ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়েছেন, লজ্জা থাকা উচিত আপনার”, হুংকার ছাড়লেন জেঠু।
“এর মধ্যে আসব না মানে? আলবাত আসব। দেখি তুই কী করিস। ওই খুনেগুলোই তোর বংশ রক্ষা করেছে, এই খবর রাখিস? কৌশিক নদীতে নেমে পাথর আর মায়ের কাঠামোর মধ্যে আটকে গিয়েছিল। তলিয়েই যেত যদি তনু ঝাঁপিয়ে না পড়ত। তোর ছেলেকে বাঁচাতে নিজের জীবনটার পর্যন্ত তোয়াক্কা করেনি ছেলেটা। এই দেখ, দেখ চোখ মেলে। ছেলেটার হাতটার কী অবস্থা হয়েছে দেখ একবার। আর হাসপাতালে এতগুলো দিন ওই খুনেগুলোই তো পালা করে সেবা করে সুস্থ করে তুলল কৌশিককে। বয়েস বাড়ছে, একটু দয়ামায়া আন শরীরে,” বলতে বলতে তনুকে টেনে সামনে নিয়ে এলেন নিবারণ দাদু।
নিবারণ দাদুর এই মূর্তি আজ অবধি প্রত্যক্ষ করেনি কেউ। সবাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দাদুর দিকে।
হরেন জেঠু নিজেকেই যেন নিজে বললেন, “পই পই করে বারণ করেছিলুম, ওরে যাসনি, যাসনি। বারটা ভালো নয়। একে শনিবার তায় আবার একই দিনে দশমী আর একাদশী। বারবেলায় লাগা একাদশী, একটা কিছু হবেই।”
কথাগুলো যেন ফুটন্ত তেলের মতো এসে ঢুকল নিবারণ দাদুর কানে। একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে জেঠিমাকে ডেকে বললেন, “বউমা, ওই হতভাগার পাঁজিখানা কোথায় আছে শিগগির বের করে আনো। আজ যদি ফালা ফালা করে না দিই ওই পাঁজি তো আমি নিবারণ নই। বাড়িতে এই পাঁজি থাকবে নয় আমি।”
বলে নিতেই জেঠুর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন নিবারণ দাদু। জেঠিমা আলুথালু বেশে দৌড়ে যেতে যেতে হাউ মাউ করে বলতে লাগলেন, “ওমা, সে কি! কাকা, দোহাই আপনার, সব্বনাশ হয়ে যাবে! ওতে ঠাকুর দেবতাদের ছবি রয়েছে যে! আপনার পায়ে পড়ি, ও কাজ করবেন না।”
জেঠু তড়িদাহতের মতো থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চল কিছুক্ষণ। কাকার মেরুদণ্ডে হঠাৎ এত জোর এল কোত্থেকে! তারপর ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে সটান শুয়ে পড়লেন বিছানায়। উঠোনের ভিড়টা এবার আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করল।
দিন দশেক পরের কথা। তনুর রোজ ভোরবেলায় ওঠে ব্যায়াম করার অভ্যেস। আজও অভ্যেস মতো উঠে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ব্যায়াম করা তো দূর এক গ্লাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খেতে পারে না ও এখন। সেদিন নদীর ঘাটে কৌশিকদাকে টানা-হ্যাঁচড়া করতে গিয়ে ডানহাতের কবজিটা ভীষণভাবে ফ্র্যাকচার হয়েছে। কড়ে আর পাশের আঙুলটা তো থেঁতলে গেছে প্রায়। ফাইনাল পরীক্ষার আগে ঠিক হবে কি না কে জানে। টেস্ট পরীক্ষাটা কোনও রকমে ম্যানেজ করা গেছে। সবাই মিলে হেডস্যারকে ধরাধরি করাতে, বিশেষ করে তন্ময় চৌধুরী মানে তনু স্কুলের সেরা ছাত্রদের মধ্যে একজন হওয়ার সুবাদে হেডস্যার রাজি হয়েছেন যে নিচু ক্লাসের কেউ একজন তনুর পাশে বসে লিখে দিতে পারবে। তবে একজন মাস্টারমশাই তীক্ষ্ণ নজর রাখবেন যতক্ষণ না লেখা শেষ হয়।
চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এল ওর। আর ঠিক তখনই কিছুটা দূরে হরেন জেঠুর খালি জমিটার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল তনু। ওমা! একটা ফেস্টুন মতো নজরে আসছে যেন। কই, কাল সন্ধ্যার পরেও তো ছিল না। সর্বনাশ! ওই সোনার টুকরো জমিতে কে লাগিয়ে গেল ওটা? আরেকটা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধবে মনে হচ্ছে আবার। এক দৌড়ে গেট খুলে জমিটাতে পৌঁছেই হতবাক হয়ে গেল ও। চিৎকার করে একে একে ডাকতে লাগল অমু, পাপাই, রঞ্জু, সন্তু আর নিবারণ দাদুকে। আস্তে আস্তে একজন দুজন করে পাড়ার অনেকেই জমা হলেন ছেলেদের হল্লা চিৎকারে।
নিবারণ দাদু পৌঁছেই থ বনে গেলেন একেবারে। তারপর ব্যাপারটা খানিকটা আঁচ করে নিয়ে তাড়া দিলেন তনুকে, “পড় তো দাদুভাই কী লেখা আছে। ছোট হরফগুলো ঠিক নজরে আসছে না।”
তনুর চোখ দুটো চিকচিক করে উঠল। ও বড় বড় করে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়তে লাগল, “উত্তরণ। ব্র্যাকেটে একটি সামাজিক সংস্থা। তার নীচে...”
সঙ্গে সঙ্গে অমু, পাপাইরা ‘হিপ হিপ হুররে’ বলে চিৎকার করে উঠল। গুটি গুটি পায়ে হরেন জেঠু কখন এসে ভিড়ে মিশেছিলেন কেউ টের পায়নি। হঠাৎ ভিড় ঠেলে বেরিয়ে সামনে এসে বললেন, “বাকিটাও পড়। থামলি কেন?”
অপেক্ষা না করে নিজেই পড়ে শোনালেন, “এক টুকরো সোনার জমি, এক সোনার দেশের সোনার ছেলেদের জন্যে।”
বলেই তনুকে জড়িয়ে ধরলেন জেঠু। অমলিন হেসে বললেন, “কথা দে, এমনি করেই সবার সুখ দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়বি তোরা। কি রে!”
তনুর চোখ দুটো আবার ঝাপসা হয়ে উঠল। একে একে অমু, পাপাই রঞ্জুদের কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন হরেন জেঠু। তারপর তনুর হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কোনও মতে টেস্ট পরীক্ষাটা শেষ কর, ভেলোরের টিকিট বুক করব কাল পরশুই। ফাইনালটা তুই নিজের হাতেই দিবি।”
_____
ছবি - নচিকেতা মাহাত
লেখক পরিচিতি - ত্রিপুরার মন্দিরনগরী উদয়পুরে জন্ম। বেড়ে ওঠা এবং স্থিতি গোমতী জেলার কাকড়াবনে। পেশায় একজন ফার্মাসিউটিক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর। নেশা, বই পড়া, সিনেমা দেখা আর কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অনেকদিন ধরেই লেখালেখি করছেন।
ভালোই লাগল, তবে একটু বড় ৷ আমার মনে হয় যেখানে ছোটগল্পের পাঠক আন্দাজ করতে পারে না শেষ লাইনটি কি হবে, সেখানেই লেখকের সার্থকতা ৷
ReplyDeleteহ্যাঁ স্যার, আপনি যথার্থই বলেছেন। এটা ছোট আর বড় গল্পের মাঝামাঝি অবস্থান করছে। এভাবেই পাশে থেকে ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো ধরিয়ে দেবেন, আলোচনা করবেন। অনেক ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মতামতের জন্যে।
Deleteশুরুটা দুর্দান্ত ছিল। বাকিটা কিঞ্চিৎ বিচ্ছিন্ন ও টাইমিংয়ের গণ্ডগোলের ফলে বাঁধন আলগা হয়ে গিয়েছে। একই কথা ছড়াটার ক্ষেত্রেও খাটে। লিখে যান, রাজীববাবু।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এভাবেই ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন।
Delete