বুড়ো আর হরিণের গল্প
কিপলিং-এর গল্পের ছায়া অবলম্বনে
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
তাঁর নাম কী ছিল কে জানে! অনেক কাল আগে কোনও এক রাজার দরবারে তিনি ছিলেন এক বেজায় হোমরাচোমরা দেওয়ানজি। তাঁর প্রতাপে রাজ্য কাঁপত। চোর ডাকাতরা তাঁর নাম শুনে ভয়ে সে দেশের সীমায় পা দিত না। রাজপ্রাসাদের পাশেই ছিল তাঁর সাতমহলা বাড়ি। বাড়ির ভেতর সোনারুপোয় মোড়া সাতটা মহল, খেলার মাঠ, স্নানের পুকুর, গোটা একটা চিড়িয়াখানা—কী না ছিল! দেশের মানুষ তাঁকে ভক্তি করত, ভয় পেত আবার ভালোও বাসত প্রাণ দিয়ে। রাজা তাঁকে সম্মান করতেন। তাঁর কথা অমান্য করতেন না কখনও।
তবু, একদিন কী যে হল তাঁর কে জানে! সারাটা দিন রাজপ্রাসাদের কঠিন কঠিন কাজকর্ম শেষ করে চার ঘোড়ায় টানা সোনাজলের গিলটি করা জুড়িগাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরে এসে ছেলেদের বারমহলে ডাকলেন তিনি। ডাক পেয়ে ছেলেরা সবাই বাবার কাছে হাজির। এসে দেখে দেওয়ানজি তাঁর মলমলের ধুতি, মাথার তাজ, গায়ের সোনামুক্তোর গয়না সব খুলে রেখে একটা পাতলা গেরুয়া কাপড় পরে দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের মাঝখানে। মাথার চুলে বটের আঠা দিয়ে জটা পাকিয়েছেন। গায়ে মেখেছেন ছাই, হাতে রুদ্রাক্ষের মালা।
তাদের দেখে দেওয়ানজি বললেন, “আমি আজ সংসার ছেড়ে অনেকদূরে চলে যাব। এখন থেকে আকাশ বাতাস বন আর বনের পশুপাখিরাই আমার আত্মীয়। তোমাদের জন্য রেখে গেলাম এই বিরাট প্রাসাদ আর আমার সমস্ত ধনরত্ন। তোমরা ভাগ করে নিও।”
ছেলেরা কত বোঝাল তাঁকে। শহরের লোকেরা এসে ভেঙে পড়ল তার দরজায়। শেষে রাজামশাই নিজে চলে এলেন প্রাসাদ ছেড়ে তাঁর প্রিয় বন্ধু দেওয়ানের বাড়িতে। কিন্তু কারো কথায় কোনও কাজ হল না। দেওয়ানজি মিষ্টি হেসে সবাইকে বললেন, “আকাশ, বাতাস, আলো, হাওয়া, বন আমাকে ডাক দিয়েছে। এতদিন আমি ইট, কাঠ, পাথর আর মানুষদের মধ্যে থেকেছি, এইবার আমি আমার সেই বন্ধুদের কাছে যাব। তোমরা আমাকে বাধা দিও না।”
শেষে সব্বাই হার মানল। গভীর নিশুতি রাতে দেওয়ানজি প্রাসাদ ছেড়ে একলা একলা পথে নামলেন। তাঁর লম্বা শরীরটা ছায়াঘন পথে হাঁটতে হাঁটতে রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে দেয়ালের মত আকাশে মাথা তুলে দাঁড়ানো মহান হিমালয়ের কোলে হারিয়ে গেল।
বহু পথ পার হয়ে সন্ন্যাসী একদিন এসে থামলেন একটা পাহাড়ি গ্রামের কাছে। ছোট্ট গ্রামটা। তার চারপাশে কোল ঘেঁষে উঠে গেছে অতিকায় পর্বতরাজের দল। তাদের মাথায় তুষারের মুকুট সকালসন্ধ্যা ঝিলিক দেয়। গ্রামের পুবদিকের সীমানা ছাড়িয়ে জঙ্গল। পাইনের সুগন্ধে ভরা সেই জঙ্গলের পথ ধরে সন্ন্যাসী চললেন পর্বতরাজের গা বেয়ে - তার নির্জন চুড়োর দিকে।
চলতে চলতে হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন তাঁর গেরুয়া ধরে টান দিল। ফিরে তাকিয়ে তিনি দেখেন একটা ছোট্ট হরিণছানা তাঁর সঙ্গ ধরেছে। তার কাজলকালো চোখদুটিতে কী যে মায়া ছিল! সন্ন্যাসী তাকে মানা করতে পারলেন না। নিজের ঘরবাড়ি লোকজন সকলের মায়া কাটিয়ে এসে তিনি বাঁধা পড়ে গেলেন ছোট্ট সেই হরিণের মায়ায়।
পাহাড়ের অনেক উঁচুতে এক হালকা জঙ্গলের ভেতর আস্তানা নিলেন সন্ন্যাসী। গাছের পাতা দিয়ে গড়ে নিয়েছেন ছোট্ট এক কুটির। সেইখানে বসে বসে আকাশ ,বাতাস, পাহাড়, বনের শব্দ শুনে আর ছবি দেখে তাঁর দিন যায়। সঙ্গী হরিণছানাটা দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে উঠে এখন এক পূর্ণবয়সের হরিণ। তার হলদে সাদায় ছোপানো শরীর আর বাহারি শিং দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
পায়ের অনেক নীচে গ্রামটার জীবনও বয়ে চলে। সন্ন্যাসী কখনও তাদের গ্রামে আসেননি। তাদের কেউ কেউ কখনো সন্ন্যাসীর আশ্রমের কাছে এসে প্রণাম করলেও তিনি কোনও জবাব দেননি। চুপ করে বসে থেকেছেন শুধু।
তাঁর হরিণটা দিনমানে বনে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় খাবারের খোঁজে। সন্ধেবেলা কুটিরে ফিরে আসে, বনের সুগন্ধি লতাপাতা, কখনো বা একটি দুটি ফল মুখে করে। সেই খেয়েই দিন কাটে সন্ন্যাসীর।
গ্রামের মানুষেরা কিন্তু সে কথা জানত না। তারা ভাবত সন্ন্যাসী বোধ হয় মানুষ নয়। কোনও ভিনদেশি জাদুকর হবে। নইলে কিচ্ছুটি না খেয়ে একটা মানুষ বছরের পর বছর বেঁচে থাকে কী করে? তারা দেখেছে সন্ন্যাসীর বন্ধু সেই হরিণকে। দেখেছে বনের সমস্ত পশুপাখি কেমন তাঁর কুটিরের সামনে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়। সন্ন্যাসী তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেও কেউ কিচ্ছু বলে না। জাদুকর না হলে এমনটা হয় কেমন করে?
জাদুকরদের কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই তাদের মন্দ লোক ভাবে। গ্রামের লোকেরাও তাই সন্ন্যাসীকে মন্দ লোক ধরে নিয়েছিল। সবসময় তারা ভাবত এই বুঝি সন্ন্যাসী তাদের কোনও ক্ষতি করে দিতে এল।
সেবার, বর্ষাকালে বৃষ্টির ঠাকুর ভারী রেগে উঠলেন সেই পাহাড়ি জায়গাটার ওপর। দিনের পর দিন বৃষ্টি চলল একটানা। জলের ঘায়ে গ্রামকে ঘিরে থাকা আকাশছোঁয়া সেই পাহাড়দের গায়ের মাটিপাথর গেল নরম হয়ে। তারপর, একদিন গভীর রাতে, পাহাড়ের মাটিপাথরে মৃদু কাঁপুনি জাগল।
ঘুম ভেঙে গেল সন্ন্যাসীর। বনপাহাড়ের ভাষা তিনি বোঝেন। কান পেতে শুনলেন সেই কাঁপুনির গুরুগুরু সংকেত। বুঝতে পারলেন, পাহাড় ক্ষেপে উঠেছে। এইবারে নেমে আসবে ভয়ংকর ধ্বস। মাটিপাথরের অতিকায় স্তূপেরা মৃত্যু বয়ে নিয়ে ধেয়ে যাবে নীচের ঘুমন্ত গ্রামের দিকে।
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল সন্ন্যাসীর। ওই গ্রামে অনেক মানুষের বাস। তাদের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর! তাদের বাঁচাতে হবে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে তিনি দেখলেন, কখন যেন তাঁর শরীর দুর্বল হয়েছে। এই ঘন বর্ষার রাতে পিছল পাহাড় বেয়ে নিচে গ্রামের দিকে নেমে যাবার শক্তি আর নেই শরীরে।
ঠিক তখন ফের কে যেন তাঁর গেরুয়ার খুঁট ধরে টানল। ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী দেখলেন তাঁর হরিণ বন্ধু, সেই ছোট্টোবেলার মতন ফের এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর গা ঘেঁষে। তাঁকে ফিরে চাইতে দেখে সে নিচু হয়ে বসে পিঠ পেতে দিল তাঁর সামনে। তাঁর মনের কথাটি ঠিকই বুঝতে পেরেছে সে।
কুটিরের মধ্যে জ্বলন্ত প্রদীপ থেকে আগুন নিয়ে মশাল জ্বাললেন সন্ন্যাসী। পাহাড় তখন দুলে উঠেছে ফের। ঘন ঘন মাথা নাড়ছে। গুমগুম শব্দ ভেসে আসছে তার চূড়ার কাছ থেকে। সেইদিকে মশালের আলো তুলে তিনি দেখতে পেলেন, পাহাড় জেগে উঠেছে। ঢেউয়ের মতন গড়িয়ে আসছে কালান্তক ধ্বস। সন্ন্যাসী আর দেরি করলেন না। জ্বলন্ত মশালটা হাতে ধরে উঠে বসলেন হরিণের পিঠে। তাঁকে নিয়ে, ছুটে আসতে থাকা ধ্বসের আগে আগে বাতাসের মতন ছুটতে লাগল হরিণ।
গ্রামের মানুষেরা শান্তিতে ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ তারা দেখতে পেল, পাহাড়চূড়ার সেই মৌনি জাদুকর হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে অতিকায় এক হরিণের পিঠে চেপে ছুটে আসছেন তাদের গ্রামের দিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে এল তারা। আজ বুঝি জাদুকর দুর্যোগের রাতে তাদের গ্রাম ছারখার করে দিতে আসছে। ভীষণ রাগে তারা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “আজ এই শয়তানকে মৃত্যুদন্ড দেব আমরা।”
অমনি ঘরে ঘরে জ্বলে উঠল আলো। হাতে হাতে শয়ে শয়ে মশাল নিয়ে বাইরে বের হয়ে এল গোটা গ্রাম। আর তারপরই তারা দেখতে পেল সন্ন্যাসীর পেছনে গুম গুম শব্দ করে তাড়া করে আসা ধ্বসের ঢেউকে। আস্তে আস্তে সন্ন্যাসীর সঙ্গে দূরত্ব কমছে তার। ছুটতে ছুটতেই সন্ন্যাসী তাদের ডেকে বললেন, “পালাও, পালাও সব। উলটো দিকের পাহাড় এখনো শক্ত আছে। আশ্রয় নাও তার গায়ে।”
এইবার গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল, তাদের বাঁচাবার জন্যই তবে মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে আসছিলেন ওই সন্ন্যাসী। প্রাণপণে ছুটল তারা উল্টোদিকের পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। তারপর, সেই নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে গিয়ে তারা অসহায় হয়ে দেখল, অনেক নীচে মিটমিট করে জ্বলতে জ্বলতে এগিয়ে আসছে একটুকরো আলো, আর তার পেছনে অন্ধকার চলন্ত পাহাড়ের মত ধেয়ে আসছে মরণ ধ্বস। তারপর একসময় সেই ধ্বসের নীচে চাপা পড়ে নিভে গেল সন্ন্যাসীর মশাল।
**********
এখনো যদি তোমরা হিমালয়ের বুকে লুকোনো সেই গ্রামের দিকে কখনো যাও তাহলে দেখতে পাবে ছোট্ট গ্রামটিকে ঘিরে তার পুবপাড়ে যে পাহাড় উঠে গেছে, তার মাথায় একটা মন্দির। ছোট্ট, তবে খুব সুন্দর সাজানোগোছানো তা। তার ভেতরে রয়েছে এক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী আর তার হরিণের মূর্তি। গ্রামের মানুষরা তাঁদের ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, পুজো করে, আর বছর ঘুরে যখন সেই ধ্বসের দিন আসে তখন গোটা গ্রাম মিলে তাঁর সেই মন্দিরে গিয়ে চোখের জলে নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে তারা।
------------
ছবি- লেখক
ভালো লাগলো পড়ে :)
ReplyDelete