গল্পের ম্যাজিক:: পাতাপরী - প্রকল্প ভট্টাচার্য

পাতাপরী
প্রকল্প ভট্টাচার্য

বুবান জানে, এমন অনেক আলো আছে যেগুলো অন্ধকার না হলে দেখাই যায় না। মামমাম যখন ‘গুড নাইট ডার্লিং’ বলে লাইট অফ করে দরজা বন্ধ করে চলে যায়, কয়েক মুহূর্ত অন্ধকারটা থাকে। চোখ বুজিয়ে থাকলেও কিন্তু বুবানের ভয় করে না, কারণ মায়ের গন্ধটা ভেসে বেড়ায়। তারপর আস্তে আস্তে সেই আলোগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বইয়ের তাকের দরজায় স্টিক-অ্যাণ্ড-গ্লো স্পাইডারম্যান, সিলিং এ চাঁদ আর তারাগুলো, ইউ পি এস-টার ইন্ডিকেটর... নানারকম রঙ... নানারকম শেপ...
       বুবান ক্লাশ ফাইভে উঠেছে, তাই একা শোয়ার মতো বড় হয়ে গেছে। বাড়ির অনেক ডিসিশনের মতো এটাও তার মায়ের ডিসিশন। বাপি একটু আর্গু করবার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। বাপিরা বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে, গল্প বলতে পারে, কিন্তু আর্গু করতে পারে না। বুবান জানে চেষ্টা করে লাভ নেই, তবু বলেছিল, ‘মামমাম, আমি যে বাপির কাছে স্টোরি শুনে ঘুমোই!’
‘ও সব ট্র্যাশ স্টোরি তোমার না শোনাই ভাল। ক্লাসিকস এর বুকস এনে দিয়েছি, নিজে পড়ে নেবে।’
‘বাট ওগুলো বোরিং লাগে যে!’
‘তোমার বোরিং লাগলেই তো হবে না! হাঞ্চব্যাক অফ নোতরদাম দেব আজ, পোড়ো।’
এণ্ড অফ ডিসকাসন। তারপরেও মা গজগজ করছিল, ‘ক্লাসিকস ওনার বোরিং লাগে। যতো ভাল লাগে ওই ট্র্যাশ লালকমল নীলকমল, পান্তাবুড়ি আর হোয়াট নট। রাবিশ। যেমন আনকালচার্ড ফ্যামিলি...’
বাকিটা আর শুনতে পায়নি বুবান। শুনতে চায়ও নি।
ডিনারের পর হাঞ্চব্যাক হাতে এল। এসমারেলডা, কোয়াসিমোদো... কিছু পাতা পড়ে ভাল লাগল না। অন্য দেশের গল্প বুবান বুঝতে পারে না। তাদের ভাব, ভাষা সবই অন্যরকম। খাওয়া দাওয়া, কথার ধরণ, সবই কেমন যেন। গাছপালা, জন্তু জানোয়ার, সবই কি আলাদা? বই বন্ধ করে চোখ বুজে শুয়েছিল বুবান। কাল ছুটি, কিন্তু সকালে টিউশন আছে। প্রীতিশ একটা ছবির বই আনবে বলেছে, ফেয়ারি টেলস। মামমাম দেখলে নির্ঘাত বকবে, তাই বাড়িতে আনবে না। টিউশন ক্লাশ শেষ করে ওখানেই পড়ে ফেলবে। ফেয়ারি মানে পর, বাপি বলেছে... অনেক দূর থেকে ভেসে এল মামমামের গলা, ‘গুড নাইট, ডার্লিং’... আলো নিভে গেল, নাইট ক্রিমের আবছা গন্ধটাও মিলিয়ে গেল, সেই অন্ধকারের আলোগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেটা চোখ না খুলেও টের পেল বুবান...
আর তখনই কে যেন ডাকল ওকে।
‘সারারাত ঘুমোলে মজাগুলো দেখবে কখন, শুনি?’
চোখ কচলে উঠে পড়ল বুবান, ‘মজা? রাত্তিরে কিসের মজা?’
প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। তারপর অন্ধকারটা চোখ সয়ে গেলে দেখল বিছানার পাশে একটা হাল্কা সবুজ রঙের আলো, সেখানে দশ সেমি মতোন লম্বা, কোয়াসিমোদোর মতো হাঞ্চব্যাক কে একটা দাঁড়িয়ে। সেই কথা বলছে।
‘মজা নয়! সবাই যখন চোখ বুজিয়ে থাকে, তখনই তো আসল খেলা শুরু আমাদের!’
বুবান তখনও হতভম্ব, তবে ভয় পাচ্ছিল না একটুও। ‘তোমরা কারা গো?’
খিলখিল করে আওয়াজ। হাসল বোধহয়।
‘আমাদের চেন না? আমরা তো পরী! আমি হলুম পাতা পরী
‘পাতা পরী আবার হয় নাকি!’
‘আলবাত হয়! ফুল পরী, জল পরী হয় আর পাতা পরী হয় না! আমরা পাতায় থাকি, দোল খাই, খেলি, কিন্তু সবই রাত্তিরে।’
‘তাই! কিন্তু মামমাম যে বলে...’
আবার খিলখিল শব্দ।
‘মামমাম কিছু জানে না। শুধু ক্লাসিকস পড়লে মানুষ অমন ভোঁতা হয়ে যায়।’
বুবানের খুব হাসি পেয়ে গেল। ভোঁতা মানে ডাম্ব! মামমামের সঙ্গে আর্গু করে কেউ জেতে না, সে হলো ডাম্ব! কিন্তু পাতাপরীকেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।
‘কেমন খেল তোমরা? আমাকে দেখাবে?’
‘নিশ্চয়ই! এস আমার সঙ্গে!’
‘কোথায় যাব রাত্তিরে?’
‘এই তো, তোমাদের ব্যালকনিতেই!’
রাত্তিরে ঘর থেকে বেরোয় না বুবান। টয়লেট তো অ্যাটাচড। জানেও না অন্ধকারে তাদের ফ্ল্যাটটা কেমন লাগে। একটু দ্বন্দ্ব থাকলেও, কৌতূহলের চোটে উঠে পড়ল সে, নেমে এল পাতাপরীর সঙ্গে যাবে বলে।
‘চলো তো দেখি, কেমন তোমাদের নাচ!’
আস্তে করে দরজা খুলতেই কেমন সব অচেনা লাগলো। ঐ তো ডিভানটা... টিভির পাশে ইনভার্টারের তিনটে আলো কি অতো ব্রাইট নাকি! বাপি আর মামমামের ঘরের দরজা বন্ধ, তবু পা টিপে টিপে সে ব্যালকনিতে এল। অন্ধকার হলেও দেখতে খুব অসুবিধা হচ্ছে না তো!
পাতাপরীর তো কিছুই অসুবিধে হচ্ছে না, দিব্যি নাচতে নাচতে ব্যালকনিতে চলে এল! ব্যালকনির গ্রিল বেয়ে একটা ক্লাইম্বার আছে। মামমাম তার কী একটা বিদঘুটে নাম বলে, বাপি বলে বেগম বাহার। খুব সুন্দর ফুল হয় নাকি, মিষ্টি গন্ধ। কিন্তু তাদের গাছে এখনও একটাও ফুল ফোটেনি। পাতাপরী ওই গাছটাতেই উঠে পড়ল।
‘এবার দেখ, আমাদের নাচ!’
‘এমা, এই গাছটায় তো ফুলই হয় না!’
‘কী করে হবে!’ একটু যেন রেগেই বলল পাতাপরী, ‘ভালো করে তোমরা কেউ এর সঙ্গে কথা বলেছ কোনোদিন? তুলে এনেছ ওর বাড়ি থেকে, বাবা মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে এনেছ, তার জন্যে ওর কত্তো মন খারাপ হয় জানো? তুমিও তো ওকে একটু জিগ্যেস করতে পারো কেমন আছ, কী টিফিন খেলে আজ, মিস হোমওয়ার্ক দিল কি না?’
বুবানের খুব খারাপ লাগল। সত্যি তো, গাছটা এতদিন তাদের বাড়ি রয়েছে, ভাল করে কথাই বলা হয়নি, আলাপও হয়নি সেইভাবে! গাছটাকে ভালো করে দেখল এখন।
‘কীরে, মন খারাপ করছে? আমারও খুব একলা লাগে, জানিস! এবার থেকে রোজ আমি তোর সঙ্গে গল্প করব, কেমন?’
পাতাগুলো একটু যেন দুলে উঠল হাওয়ায়, হ্যাঁ বলল বোধহয় খুশী হয়ে! ততক্ষণে পাতাপরী আরও অনেকগুলো পরীদের ডেকে এনেছে, সক্কলে কী সুন্দর সবুজ আলোর মালা হয়ে ডান্স করছে... হাততালি দিয়ে...
---------------
‘এখন কেমন ফিল করছ বুবান?’
বুবান চোখ খুলে দেখল মামমামের মুখ, খুব যেন কান্না কান্না... কোথায় আছে ও? মামমামের ঘরে! কী করে, কখন এল! তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই মামমাম বলে উঠলো, ‘না না উঠো না, তুমি খুব দুর্বল। আর একটু রেস্ট নাও। ডক্টর আঙ্কল এসে যাবেন এক্ষুনি।’
‘আমি এই ঘরে কী করে এলাম?’
‘ভোরবেলা তুমি বারান্দায় ঘুমিয়েছিলে, বাপি এখানে নিয়ে এসেছে। ঘর থেকে কখন বেরিয়েছ?’
বুবান আর কিছু ভেঙ্গে বলে না। মামমাম বিলিভ করবে না পরীর গল্প। হঠাৎ ওর মনে পড়ে ফেয়ারি টেলস এর কথা। ওটার জন্যেই তো আজ ট্যুশনে যেতেই হবে!
‘মামমাম, ট্যুশন...’
‘আজ যেতে হবে না, রেস্ট নাও। আমিও কোথাও বেরোব না। ও হ্যাঁ, প্রীতিশ এসেছিল তোমার খোঁজ করতে, একটা বই দিয়ে গেছে, ফেয়ারি টেলস। শুয়ে শুয়ে পড়তে পারো, ভাল লাগবে।’
বুবান অবাক হয়ে বইটা হাতে নিল। তখনই বাপি এল ঘরে। ‘একটা গুড নিউজ দিই তোমাদের, এতদিন পরে আমাদের বেগমবাহার গাছে একটা কুঁড়ি এসেছে!’
পাশেই কে যেন খিলখিল করে হাসল। সক্কলে তাকাল। পাতাপরীটা জানলায় বসে কী করছে!!
বাপি বলল, ‘প্রেয়িং ম্যান্টিস, দেখেছিস! তুই বোধহয় এদের কথা জানিস না।’
বুবান মুখ টিপে হাসল।
ও যে কত কিছু জানে, মামমাম আর বাপিই বরং সেগুলো জানে না!
---------------------------
ছবি-দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

লেখক পরিচিতি - একটা বহুজাতিক মার্কেট রিসার্চ কোম্পানির এডিটিং টিমের ম্যানেজার, চেন্নাইতে বসে বাংলা/ ইংরাজী/ হিন্দী/ তামিল ভাষায় অনুবাদ করেন ও করান, দিল্লীর 'দ্য লিটল ম্যাগাজিন' (অনুবাদ করানো) এবং পরে চাঁদমামা-র (বাংলা অনুবাদক) সাথে যুক্ত ছিলেন, লিখতে  ভালবাসেন   মূলতঃ কবিতা।

2 comments: