বিজ্ঞান:: দুরন্ত ছক্কা - অমিতাভ প্রামাণিক

দুরন্ত ছক্কা
অমিতাভ প্রামাণিক

মহাভারতের গল্প মনে আছে? সেই যে যুধিষ্ঠিরকে কৌরবরা ভুলিয়ে ভালিয়ে পাশা খেলতে বসিয়ে দিত, আর তাদের শকুনি মামা পাশা চেলেই বলত, এই যে আমি জিতে গেছি। একের পর এক খেলায় জিততেই থাকত শকুনি। পাশা খেলায় হেরেই তো পান্ডবেরা তাদের জেঠতুতো ভাইদের কাছে ধনসম্পদ মানসম্মান সব হারাল, বনবাসে গেল, আর শেষমেষ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হল।

পাশা খেলতে হয় একটা ডাইস চেলে, যে রকম লুডোতেও। মনে করো, ঘুঁটি-ফুটি কিছু নেই, লুডোর চাল যার বেশি সেই জিতবে, এ রকম ব্যাপার হলে কাউকে কি শকুনির মতো বলে বলে হারানো সম্ভব?

লুডো খেলেছ নিশ্চয়, যেখানে একটা ছক্কা চালতে হয় লুডোর ঘুঁটি এগোনোর বা প্রতিপক্ষের ঘুঁটি কাটার জন্যে। সেই ছক্কা একটা আদর্শ ঘনক, যার ছ’খানা বর্গাকার তলে ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ বিন্দু আঁকা থাকে। ছক্কা চাললে যতগুলো বিন্দু আঁকা তল ওপরে থাকবে, চালের মান তত, আর ঘুঁটি ততঘর এগোবে।

সাধারণ ছক্কা, যার ছ’পিঠে এক থেকে ছয় এই রকম বিন্দু আছে, যে রকম লুডোর ছক্কা হয় আর কী, তাতে কাউকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উপায় নেই। সেগুলো চাললে পুট (মানে এক) পড়ার সম্ভাবনা যত (ছয়ে এক, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ষোলো শতাংশ), ছক্কা পড়ারও তাই কিন্তু এক রকমের স্পেশ্যাল ছক্কা বানানো যেতে পারে, যার সাহায্যে বলে বলে অন্যকে হারানো সম্ভব।

কেমন সেই ছক্কা?

একটা না, তিনখানা স্পেশ্যাল ছক্কা বানানো হলো, যাদের গায়ে লুডোর প্রচলিত ছক্কার বদলে আলাদা রকমের বিন্দু আঁকা আছেএদের আলাদা করার জন্যে ছক্কা তিনটেকে তিনটে আলাদা রঙ করে দেওয়া যাক – লাল, নীল আর সবুজ। মনে করা যাক, এদের ছ’খানা তলে বিন্দুগুলো এইভাবে আঁকা হয়েছে –

লাল ছক্কা– ৫, ৫, ৫, ২, ২, ২ (মানে তিনটে তলে পাঞ্জা আর বাকি তিনটেতে ২)
নীল ছক্কা– ৪, ৪, ৪, ৪, ৪, ১ (মানে পাঁচখানা তলে ৪ আর বাকিটাতে পুট)
সবুজ ছক্কা– ৬, ৩, ৩, ৩, ৩, ৩ (মানে একটাতে মোটে ছক্কা আর বাকি পাঁচটাতে তিন)

খেয়াল করে দেখো, সবগুলো তলে নম্বরগুলো যোগ করলে মোট দাঁড়াচ্ছে একুশ। এর মানে হচ্ছে, মনে করা যাক, ছক্কাগুলো এক একটা ছাত্র, তারা তিনজনে ছ’খানা সাবজেক্টে পরীক্ষা দিয়েছিল। এক একটা সাবজেক্টে ফুল মার্ক ছয়, মানে তাতে খুব বেশি হলে ছয় নম্বর পাওয়া সম্ভব। প্রত্যেকেই ছত্রিশের মধ্যে মোট একুশ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু বিভিন্নজন বিভিন্ন সাবজেক্টে আলাদা আলাদা নম্বর পেয়েছে। এমন তো হতেই পারে, তাই না? মোট নম্বর যেহেতু সমান, সবাই বলবে, তিনজন ছাত্রই হরেদরে একই।

এর মানে কি তিনটে ছক্কাই সমান? সবুজ ছক্কায় একটা ৬ আছে, অন্য কোনটাতে নেই, যদিও ৬ মাত্র একটা সাইডেই, যা পড়ার সম্ভাবনা ছ’বারে একবার নীল ছক্কার পাঁচটা সাইডে ৪ আছে, মানে ওটা চাললে চৌকা পড়ার চান্স ছয়ে পাঁচ। লালে তিনখানা ৫ আছে, মানে ওটা চাললে অর্ধেকবার ৫ পড়বে, যা নীল আর সবুজের অধিকাংশ চালের মানের চেয়ে বেশি।

যদি দুজনে এই ছক্কা চালাচালি করে জিততে চায়, কোনটা পছন্দ করলে জিতবে, বলতে পারো? তোমাকেই যদি এই তিনটের মধ্যে পছন্দ করতে বলা হয়, কোনটা নেবে? তুমি যেটা নেবে, আমাকে নিতে হবে বাকি দুটোর মধ্যে থেকে একটা। তারপর তুমি তোমার ছক্কা চালবে, আমি চালব আমার ছক্কা।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, তুমি এদের মধ্যে যেটাই নাও, আমি তোমাকে হারিয়ে দেব। চ্যালেঞ্জ করে। শর্ত একটাই, ছক্কাটা চালতে হবে বেশ কিছু বার। ধরে নাও, দশবার। তবে বেশিবার করলেই ভাল। মানে, দশ বা তার বেশিবার ছক্কাদুটো চালা হবে। এক এক বার চালার পর দেখা হবে কার ছক্কার দান বেশি, সে সেই চালার জন্যে জিতবে। এ রকম দশ বা তার বেশিবার চালার ফলে যে বেশিবার জিতবে, তাকেই একটা গেমে জয়ী ঘোষণা করা হবে। ধরে নাও, এক্ষেত্রে আমরা দুটো ছক্কাই একশোবার করে চালাচালি করব। তুমি তোমারটা, আমি আমারটা।

তুমি এর মধ্যে যেটাই পছন্দ করো না কেন, তুমি হবে যুধিষ্টির। আমি ঠিক এমন একটা বেছে নেব তোমার পছন্দ হয়ে গেলে যে দুটো পড়ে থাকবে তাদের মধ্যে থেকে, যে আমি হয়ে যাব শকুনি।

কেমন করে জিতব? ভাল করে খেয়াল করে নীচের যুক্তিগুলো বুঝে নাও, তাহলে দেখবে ধাঁধাটা বেশ ঘোরালো। আর ভীষণ মজার।

মনে করা যাক, লাল আর নীলের মধ্যে খেলা হচ্ছে। লালের যতবার ৫ পড়বে, ততবারই জিতবে, কেননা নীলের সব চালই হবে ৫-এর চেয়ে কম। লালের যদি ২-ও পড়ে, তাও জিতবে যদি নীলের ১ পড়ে।

লালের কতবার ৫ পড়বে? ছখানা সাইডের তিনটেতে ৫, মানে ৩/৬ অর্থাৎ ০.৫ অংশ (মানে, একে ১০০ দিয়ে গুণ করলে শতকরা ৫০ বার)। এতবার লাল জিতবেই, নীলের ৪ বা ১ যাই পড়ুক। লাল ২ পড়লেও জিততে পারে, যদি নীলের পড়ে ১। লালের ২ পড়ার সম্ভাবনা ৩/৬ অর্থাৎ ০.৫, কিন্তু তার মধ্যে সে জিতবে যখন নীলের পড়বে ১, যার সম্ভাবনা ১/৬ বা ০.১৭। এর মানে লালের ২ পড়া সত্ত্বেও জেতার সম্ভাবনা মোট চালের ০.৫ গুণ ০.১৭ বা ০.০৮। এর মানে নীলের বিরুদ্ধে লালের জেতার মোট সম্ভাবনা ০.৫ + ০.০৮ = ০.৫৮ ভাগ, বা শতকরা ৫৮

লাল আর নীল ছক্কার সব দানই আলাদা, কেননা দুটোর কোনোটাতেই কমন নাম্বার নেই। মানে কোনো দানেই ড্র হবে না, কেউ না কেউ জিতবেই। তার মানে, লালের বিরুদ্ধে নীল জিতবে ১০০ – ৫৮ বা ৪২ শতাংশ। সেটাকেও একই নিয়মে পরখ করে নিতে পারো। নীলকে জিতবে যখন তার ৪ পড়বে, যার সম্ভাবনা ৫/৬ বা ০.৮৩ আর বিপক্ষে লালের পড়বে ২ যার সম্ভাবনা ৩/৬ বা ০.৫। অর্থাৎ নীলের জেতার মোট সম্ভাবনা ০.৮৩ গুণ ০.৫ বা ০.৪২ অর্থাৎ ঐ ৪২ শতাংশ। তার মানে লাল আর নীলের খেলায় লাল জয়ী। একশোটা গেম হলে স্কোর লালের পক্ষে ৫৮-৪২।

নিয়ম জেনে গেলে বাকি খেলাগুলো অর্থাৎ নীল-সবুজ আর লাল-সবুজের জেতার সম্ভাবনা বের করতে সময় বেশি লাগবে না। দেখা যাক।

নীল-সবুজে খেলা হলে নীল জিতবে যখন তার ৪ পড়বে (সম্ভাবনা ৫/৬) আর সবুজের পড়বে ৩ (সম্ভাবনা ৫/৬)। এর মোট সম্ভাবনা ৫/৬ গুণ ৫/৬ বা ০.৬৯ (৬৯ শতাংশ)। সবুজ জিতবে প্রতিক্ষেত্রেই যখন তার ৬ পড়বে (সম্ভাবনা ১/৬), অথবা ৩ পড়বে (সম্ভাবনা ৫/৬) আর নীলের পড়বে ১ (সম্ভাবনা ১/৬)। সুতরাং সবুজ জিতবে মোট ১/৬ + ৫/৬ গুণ ১/৬ বা ০.৩১ ভাগ (৩১ শতাংশ)। নীল-সবুজে একশো চাল খেলা হলে সুতরাং নীলের পক্ষে স্কোর ৬৯-৩১।

বাকি রইল লাল-সবুজ। এখানে লাল জিতবে যখন লালের পড়বে ৫ (সম্ভাবনা ৩/৬) আর সবুজের পড়বে ৩ (সম্ভাবনা ৫/৬)। তার মানে লালের জেতার মোট সম্ভাবনা ৩/৬ গুণ ৫/৬ বা ০.৪২ (৪২ শতাংশ)। সবুজ জিতবে প্রতিক্ষেত্রেই যখন তার পড়বে ৬ (সম্ভাবনা ১/৬) অথবা ৩ (সম্ভাবনা ৫/৬) আর লালের পড়বে ২ (সম্ভাবনা ৩/৬)। মানে, সবুজের জেতার মোট সম্ভাবনা ১/৬ + ৫/৬ গুণ ৩/৬ বা ০.৫৮ (৫৮ শতাংশ)। একশো চালের খেলায় সবুজ ৫৮, লাল ৪২।

মানে কী? লাল নীলকে হারাবে, নীল সবুজকে হারাবে, সবুজ লালকে হারাবে। মানে এদের মধ্যে কেউ সেরা নয়। সুতরাং, এই তিনটে স্পেশ্যাল ছক্কার মধ্যে তুমি যেটাই পছন্দ করো না কেন, বাকি দুটোর মধ্যে একটা থাকবে, যেটা এই নিয়ম জানার জন্যে আমি পছন্দ করে তোমাকে বলে বলে হারাব। তুমি লাল পছন্দ করলে আমি নেব সবুজ, তুমি সবুজ নিলে আমি নেব নীল, তুমি নীল নিলে আমি নেব লাল। তুমি যাই নাও, যদি আগে পছন্দ করে নাও, তাহলে জিতব আমিই, কেননা আমি এই ব্যাপারটা জেনে গেছি। তুমি এখন জেনে গেলে, তোমায় আর হারাবে কে?

তাহলে তোমার আর শকুনি হওয়া আটকাচ্ছে কে? যাও বানিয়ে ফেলো ছক্কা এই রকম। তাক লাগিয়ে দাও বন্ধু বান্ধবদের।
------------

2 comments:

  1. আপনার জিতের প্রোব্যাবিলিটি বেশি, কিন্তু জেতবার নিশ্চয়তার যুক্তিটা তো বুঝলাম না?

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রবাবিলিটির হিসাবেই বলা হয়েছে বেশিবার খেলার কথা। যাতে জিত নিশ্চিত করা যায়। হ্যাঁ এখন পরের পর যদি ৬ পড়ে যায় তাহলে আলাদা। কিন্তু প্রবাবিলিটি দিয়েই সমস্ত প্রতিপাদ্য চলে।

      Delete