ইতিহাস:: ইতিহাসে রহস্য: ইউ আই আ কো র ঘুমন্ত শিশুরা - রুদ্র সেন

হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার গল্প
ইউ আই আ কো র ঘুমন্ত শিশুরা
রুদ্র সেন

১৯২২ সালে ব্রিটিশ পুরাতাত্বিক হাওয়ার্ড কার্টারের তুতানখামেনের সমাধি আবিস্কার যদি বিশ্বের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে থাকে তবে তার ৭৭ বছর পরে য়োহান রেনহার্ডের চমকে দেওয়া একটা খোঁজও ইতিহাসের অনেক হিসাব উল্টোপাল্টা করে দিয়েছিল। ব্যাপারটা ঘটেছিল ইউ-আই-আ-কো নামের একটি আর্জেন্টিনিয় ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির শিখরে - অ্যান্ডিজের অন্যতম সুউচ্চ শৃঙ্গে।
আমেরিকার Pre Columbian যতগুলি সভ্যতা একসময়ে বিস্তার লাভ করেছিল তার মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার ইনকারা ছিল স্বতন্ত্র। বর্তমান সময়ে যে "খাদ্য সুরক্ষা আইন"  নিয়ে আমরা এত মাতামাতি করি ঠিক সেরকম খাদ্য সুরক্ষা বা food security র মাধ্যমে উত্তরে কলম্বিয়া থেকে দক্ষিণে চিলি পর্যন্ত বিস্তৃত বিভিন্ন জনগোষ্ঠীগুলিকে একত্রিত করে ইনকারা একটি সুবিশাল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেছিল। শুধুমাত্র যুদ্ধের সাহায্যে জমি দখল না করে বিভিন্ন সংস্কৃতিকে নিজেদের সংস্কৃতির সাথে মিশিয়ে এক অভিনব সমাজ ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলেছিল আর মাত্র ১০০ বছরে সেটি উৎকর্ষতার একটা চূড়ান্ত শিখরে উঠেছিল। বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার যত রাস্তাঘাটের বিকাশ ঘটেছে তাও ইনকাদের বানানো রাস্তার হাত ধরেই সম্ভব হয়েছে। কারণ রাজধানী কুজ্কো থেকে এই সুবিশাল সাম্রাজ্যকে চালনা করতে উন্নত সড়ক ব্যবস্থা ছিল অপরিহার্য, যদিও আশ্চর্যজনক ভাবে তারা চাকার ব্যবহার জানত না।
আধুনিক কালের বিভিন্ন অভিযাত্রীরা যখন অ্যান্ডিজের বিভিন্ন শৃঙ্গগুলি এক এক করে জয় করার উদ্দেশ্যে পা বাড়াচ্ছিল তখন দেখা গেল ৭০০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট কিছু কিছু শৃঙ্গে তাদের আগে মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে গেছে। সভ্যতার ধ্বজা উড়িয়ে বর্তমান কালের মানুষদের থেকেও ৬০০-৭০০ বছর আগে ইনকাদের বিভিন্ন বীরেরা সেইসব পর্বত গাত্রে স্থাপন করেছিল তাদের পূজা-উপাসনার বিভিন্ন বেদী। আজন্ম সূর্যের পূজারী ইনকারা ইনতি বা সূর্যদেব ছাড়াও নদী, পর্বত, জঙ্গল প্রভৃতি প্রকৃতিকে প্রতীকী রূপে পূজা করত। আর দেবতা তুষ্ট হলে ফসল এবং মানবসম্পদ যে উন্নত হবে সেই বিশ্বাস তো ছিলই।
ইনকা সভ্যতার অগ্রগতির সাথে যে বিষয়গুলিকে তারা নিজেদের জয়যাত্রার বিশেষ উপকরণ বলে মনে করত তা হল উপাসনা। আর তাদের সম্রাট হলেন ইনতির জীবন্ত সংস্করন। সেই অর্থে তিনি জীবন্ত নররূপী দেবতাও বটে। কিন্তু যেসব প্রথা সবথেকে ফলপ্রসূ হতে পারে বলে তারা মনে করত তা হল, বলি প্রথা। আর শিশুবলি হলে তো কথাই নেই।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ঘাঁটলে এটা লক্ষ্যণীয় যে যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বলি প্রথা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করত। আর বর্তমানেও এর প্রভাব থেকে কিছু কিছু সমাজ এখনও মুক্ত নয়। সমষ্টিগত যে ধর্মাচারণ আমরা বর্তমানে করে থাকি তাতে সভ্যতার ছোঁয়া লাগলেও পুরানো কিছু পাশবিক প্রবৃত্তি এখনও বজায় রয়েছে। আর আজ থেকে ৬০০-৭০০ বছর আগে ইনকা সমাজও তার থেকে মুক্ত ছিল না।
শিশু সবসময়েই নিষ্পাপ, কোনও নিদারুণ মনোবৃত্তি তাদের সেই অবস্থাতে স্পর্শ করে নাতাই তার কদর দেবতাদের কাছে সর্বোত্তম, এই বিশ্বাস থেকে ইনকা সমাজে "কাপাকোচা" অর্থাৎ শিশুবলি প্রচলিত ছিল। আর এরজন্য অ্যান্ডিজের বিভিন্ন পবিত্র চূড়াগুলি নির্বাচন করা হত, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল স্বর্গ থেকে সেই সব শৃঙ্গের দূরত্ব খুব কম ছিল। দেশের কোনও বিজয় বা আগামী বছরের ভাল ফসললাভের উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠান সাধারণত হত। আর এমনই এক কাপাকোচার সাক্ষী ছিল তিনজন, একটি কিশোরী আর তার দুই শিশু সঙ্গী।
১৯৯৯ সালে যখন এই তিনটি দেহ উদ্ধার করা হয়, একটাই প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মাথায় এসেছিল - ইনকাদের আওতায় থাকা অঞ্চলের একদম শেষ সীমায় কেন এই বলি?  ইউ-আই-আ-কো চিলি আর আর্জেন্টিনার সীমান্তে অবস্থিত। তাই মনে করা হয় এই তিনজনকে প্যারেড করিয়ে হয়তো আনা হয়েছিল সুদূর কুজ্কো থেকে, মানে আজকের দিনের ইকুয়েডর থেকে। হয়ত এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত সাম্রাজ্যে নিজেদের মহত্ত্ব বা শক্তি প্রদর্শন অথবা দেবতার আশীর্বাদ সারা সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।
বিশেষভাবে নির্বাচিত এই কুমারী কিশোরীটির বয়স ছিল আনুমানিক ১২-১৪ বছরের মধ্যে আর তার শিশু সঙ্গীদের বয়স ছিল ৬-১০ বছরের মধ্যে। যার মধ্যে একটি বাচ্চা মেয়েও ছিল। যখন দেবতাদের জন্য এদের নির্বাচিত করা হয়েছিল তাই মনে করা হয় এরা হয়ত এসেছিল কোনও ভাল অবস্থাপন্ন ঘর থেকেআর নিজেদের ভবিষ্যত সম্পর্কে হয়ত পুরোপুরি এরা জ্ঞাত ছিল। দেহপরীক্ষা করে যা জানা যায় তা হল প্রায়  দুবছর ধরে এদের আলাদা রাখা হয় কোনও পুরোহিত বা রাজ প্রতিনিধির তত্ত্বাবধানে, নিজেদের সেই চরম সমর্পণের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে। সেখানে একটি  বিশেষ খাদ্যাভাসের মধ্যে তারা জীবন যাপন করত যার মধ্যে আলু আর ভুট্টা জাতীয় খাদ্য বেশি ছিল। কিশোরীটির পাকস্থলীতে দীর্ঘদিন খাওয়া প্রানিজ প্রোটিন বা লামা মাংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তারপর হয়তো কোনও এক পুণ্যতিথিতে শুরু হয়েছিল তাদের শেষযাত্রা। সুন্দর কাপড়, গহনা, উজ্জ্বল ম্যাকাওয়ের পালকের শিরস্ত্রাণ পরিয়ে তাদের সেদিন হাজির করা হয়েছিল পর্বতের পাদদেশে। বিশেষ কিছু পূজাপাঠের পরে তাদের পর্বতারোহণ শুরু হয়। নিজেদের এই নিদারুণ পরিণতিকে ভোলানোর জন্য প্রচুর চিচা অর্থাৎ ভুট্টার তৈরী বিশেষ মদে তাদের সেদিন মাতাল করা হয়েছিল আর ক্লান্তি দূর করার জন্য তাদের চিবোতে দেওয়া হয়েছিল কোকোপাতা। অন্যান্য ক্ষেত্রে মাথায় বাড়ি মেরে বা আরো নৃশংস উপায়ে সেইসব শিশুদের হত্যা করা হত কিন্তু এখানে মৃত্যু এসেছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে। ঘুমের কোলে ঢোলে পড়ে, সেই নির্জন পর্বত শৃঙ্গের কোনও একটি কোটরে।
৫০০ বছর পরে যখন সেই কোটরের দরজা Reinhard খুলেছিলেন, তিনি স্তব্ধ হয়ে দেখলেন উজ্জ্বল পোষাক পরিহিত একটি কিশোরী দেওয়ালে হেলান দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। উচ্চতা আর শুষ্ক আবহাওয়া কোনও বিকৃতি ঘটায়নি তার মৃত্যু পরবর্তী দেহে। অবিকৃত তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটা ঠেলা মারলেই সে উঠে পবে তার বিগত ৫০০ বছরের গভীর নিদ্রা থেকে! কিন্তু বাকী দুজন শিশুর মধ্যে বাচ্চা মেয়েটির দেহ বিকৃত হয়েছিল বজ্রপাতের কারণে আর বাচ্চা ছেলেটির মৃত্যু মনে হয় সুখের হয়নি। হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতে তার দেহটা দিল বাঁধা। আর জামাকাপড়ে ছিল রক্ত আর বমির দাগ। সম্ভবত উচ্চতাজনিত কষ্ট সে সহ্য করতে পারেনি। তাই নিচেই তাকে হত্যা করে বেঁধে দেহটা সেই বলিস্থানে আনা হয়েছিল। তাদের সাথে ছিল বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য আর ধর্মীয় দিক থেকে প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী।
বাতাসের শুষ্কতা বা কম তাপমাত্রার কারণে সেইসব দেগুলি ছিল প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত মমি আর তাদের মস্তিষ্ক তখনও একটুও নষ্ট হয়নি। পাকস্থলীতে শেষ খাওয়া খাদ্য তখনও বর্তমান আর ঠোঁটের নীচে থেকে গেছে চিবোতে থাকা কোকো পাতার অবশিষ্ট। "La Doncella" বা "Ice Maiden" হল সেই কিশোরীটির বর্তমান নাম যাকে কিনা বিশেষ সম্মানের সাথে সেখানে রাখা হয়েছিল। আর বজ্রপাতে নষ্ট মেয়েটির নাম হল "La Nina del Rayo" বা "Lighting Girl" যাকে কিনা ডি এন এ পরীক্ষা করে কিশোরীটির বোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অপর শিশুটি হল "El Nino" যাদের কিনা কিশোরীটির সেবা করার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়েছিল।
আজও Carrier র তৈরি বিশেষ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের মধ্যে তাদের দেহ সংরক্ষিত আছে আর্জেন্টিনার Museum of High Altitude Archeology তে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের দেহ থেকে সেই সময়ে নানা বিষয়ে জানা যায়। বিশেষ করে তখনকার বিভিন্ন অসুখ বিসুখ সম্পর্কে। কিশোরীটির ফুসফুস পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমনের ঈঙ্গিত পাওয়া গেছে। তাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংরক্ষিত মমি হিসেবে তাদের ধরা হয়।
মায়ের কোল খালি করে চির অমরত্বের পথে পা বাড়ানো বিভিন্ন শিশু তথা কিশোর কিশোরীদের Johan Reinhard এখনও খুঁজে চলেছেন অ্যান্ডিজের বিভিন্ন পর্বতগাত্রে।

1 comment:

  1. Asadharon, Rudra da, tumi Jodi konodin itihas r patai otha ei sob bishoy niye boi lekho, ami obosyoi kinbo, ager lekhatao asadharon chilo, etao, porer tar opekhai roilam

    ReplyDelete