ইতিহাস:: হারানো শহরের খোঁজে:: তক্ষশিলার পথে পথে - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

তক্ষশিলার পথে পথে
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রাচীন ভারতে সাহিত্য, শিল্পকলার উৎকর্ষ ও ভারতীয় দর্শন-সৃষ্টি আর্যদের মহান অবদান। তাঁদের এই জ্ঞান চর্চার কাল প্রায় দেড় থেকে দু’হাজার বৎসর। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে নানান সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে তাঁদের স্বাধীন ও সবল চিন্তা ধারার বিকাশ ঘটে। বেদ, বেদাঙ্গ, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি সাহিত্যাদি সে যুগে মূলতঃ ধর্মের উপর ভিত্তি করে রচিত হলেও ফাঁকে ফাঁকে বৈদিক ঋষিগণের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীরও পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের রচিত গণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন, ব্যাকরণ, ছন্দ প্রভৃতি রচনার মধ্য দিয়ে।

     বৈদিক সাহিত্যের প্রথম দিকে আর্য ঋষিদের যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় পরবর্তীকালে তা আর তেমন দৃষ্ট হয় না। যজ্ঞবেদী নির্মাণের প্রয়োজনে গণিতের অগ্রগতি ও কাল নির্ণয়ের প্রয়োজনে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতি অব্যাহত থাকলেও চিকিৎসাশাস্ত্রের অবনতি বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। সম্ভবত শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বই এর কারণ। ক্ষাত্রধর্মকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে ও নিজেদের বর্ণশ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে গিয়ে ব্রাহ্মণরা সমাজে চালু করেন অত্যাধিক যাগ-যজ্ঞ, নিষ্প্রাণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পশুবলি, নির্ভীক সমালোচকদের প্রতি উৎপীড়ন ইত্যাদি। বাধ্যতামূলক ব্যবহুল অনুষ্ঠানসর্বস্ব ও যাগ-যজ্ঞপূর্ণ বৈদিক ধর্মাচরণ-পদ্ধতি একসময় সাধারণ মানুষের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি করে। অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে পশুবলির নিষ্ঠুর বিধি মানুষের মনে বেদনার ও ঘৃণার উদ্রেক করে। সমাজে আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বৈদিক ব্রাহ্মণরা তাঁদের ক্ষমতার অপব্যবহার করায় সমাজে নানা দুর্নীতি প্রবেশ করে। ফলে একসময় বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে সমকালীন হিন্দু সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।
     খ্রিস্ট পূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ধর্ম-সংস্কারকদের আন্দোলনের ফলে ধীরে ধীরে নৈরাশ্যজনক অবস্থার অবসান ঘটে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির রুদ্ধ দ্বার আবার উন্মুক্ত হয়। যুক্তিগ্রাহ্য সুচিন্তিত মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সমাজে আবার প্রতিষ্ঠিত হয়।
     প্রাচীন ভারতে আর্যাবর্তের সীমানা ছিল কাবুল উপত্যকা থেকে গোদাবরী নদী পর্যন্ত। এই বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে ষোলটি রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হল, অঙ্গ (পূর্ব বিহার), মগধ (দক্ষিণ বিহার), বৃজি (উত্তর বিহার), কাশী, কোশল (অযোধ্যা), মল্ল (গোরখপুর জেলা), চেদী (যমুনা ও নর্মদার মধ্যবর্তী অঞ্চল), বৎস (এলাহাবাদ), কুরু (থানেশ্বর, দিল্লী ও মিরাট), পাঞ্চাল (বেরিলি, বুদায়ুন, ফারুকাবাদ), মৎস্য (জয়পুর), শুরসেন (মথুরা), অশ্মক (গোদাবরী তীরে অবস্থিত), অবন্তী (মালওয়া), গান্ধার (পেশোয়ার ও রাওয়ালপিণ্ডি) ও কম্বোজ (দক্ষিণ-পশ্চিম কাশ্মীর)।
     প্রাচীনকালে ভারতের অন্তর্ভুক্ত গান্ধার প্রদেশের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা। মহাকাব্যের যুগ থেকেই তক্ষশিলার সঙ্গে আমরা পরিচিত। রামায়ণের কৈকেয়ী তনয় ভরতের পুত্র ‘তক্ষ’-র নামানুসারে এই নগরীর নাম হয় তক্ষশিলা। মহাভারতেও তক্ষশিলার উল্লেখ আছে। গান্ধার রাজ সুবলার কন্যা গান্ধারী ছিলেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী। পরবর্তীকালে বৌদ্ধযুগেও তক্ষশিলা ছিল গান্ধার প্রদেশের রাজধানী।
     প্রাচীন ভারতে ঋষিদের আশ্রম ছিল জ্ঞান-চর্চার পীঠস্থান। নিজ নিজ আশ্রমে ঋষি তথা হিন্দু পণ্ডিতগণ ছাত্রদের শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষাদানের ব্যাপারে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের উৎসাহ প্রদানের জন্য সে যুগের রাজারা নানাভাবে তাঁদের সাহায্য করতেন। বিদ্যা ছিল বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। ফলে যৌথ প্রচেষ্টায় কোনো বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সে যুগে গড়ে ওঠে নি।
     শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বদরবারে প্রাচীন ভারতের স্থান ছিল প্রথম সারিতে। অধুনা রাওয়ালপিণ্ডির অনতিদূরে অবস্থিত তক্ষশিলা নগরটি ছিল সে যুগের শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটি প্রধান কেন্দ্র। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকেই তক্ষশিলা একটি বিশিষ্ট শিক্ষাকেন্দ্ররূপে পরিগণিত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তা প্রাচীন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্রের মর্যাদা পায়।
     তক্ষশিলা ছিল সে সময় ভারতের প্রাচীনতম জ্ঞানপীঠ। কাশী, মিথিলা, রাজগৃহ, উজ্জয়িনী, অবন্তী প্রভৃতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও চিন, গ্রিস, ইরান, মিশর প্রভৃতি দেশ থেকেও বহু শিক্ষার্থী শিক্ষালাভের জন্য তক্ষশিলায় আসতেন। বেদ, ব্যাকরণ, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য, শিল্প, ধনুর্বিদ্যা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে এখানে শিক্ষালাভ করা যেত। তবে ধনুর্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে তক্ষশিলার হিন্দু পন্ডিতরা ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।
     আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতীয় চিকিৎসাজগতে আত্রেয়, পুনর্বসু ও সুশ্রুতের নাম উল্লেখযোগ্য। ঋষি অত্রির পুত্র আত্রেয় সম্ভবত তক্ষশিলায় চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যার উপর তিনি অনেকগুলি বই লেখেন। এগুলির মধ্যে পাঁচখন্ডে সমাপ্ত আত্রেয় সংহিতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আত্রেয় ভেষজ চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী হলেও শল্যবিদ্যাবিশারদ ছিলেন না। সে ব্যাপারে সুশ্রুতের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
     আত্রেয় এবং সুশ্রুতের পর প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তিনি হলেন জীবক কোমারভচ্চ (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ — ৪৮৬)। জীবকের জন্মস্থান রাজগৃহ। চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার জন্য তিনি সুদূর রাজগৃহ থেকে তক্ষশিলায় আসেন। এখানে আত্রেয়র নিকট তিনি আয়ুর্বেদশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তবে আত্রেয় পুনর্বসু তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিৎ করে কিছু বলা যায় না। কারণ অত্রি পুত্র আত্রেয় ছাড়া কৃষ্ণাত্রেয় ও ভিক্ষু আত্রেয় নামে আরও দু’জন চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষক সেখানে ছিলেন। জীবক তক্ষশিলায় সাত বছর ছিলেন। শিক্ষা শেষে তিনি রাজগৃহে ফিরে যান এবং চিকিৎসকের কাজ গ্রহণ করেন। সুচিকিৎসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি অচিরেই ছড়িয়ে পড়ে। জীবক ভেষজ চিকিৎসা ও শল্যচিকিৎসা উভয় বিদ্যাতেই পারদর্শী ছিলেন। শুধু তাই নয় শিশু চিকিৎসায়ও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কাশ্যপ-সংহিতা নামে তিনি একটি চিকিৎসাগ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটিতে সূত্র স্থান, নিদান স্থান, বিমান স্থান, শারীর স্থান, ইন্দ্রিয় স্থান, চিকিৎসা স্থান, সিদ্ধি স্থান, কল্প স্থান ও খিল স্থান এই ন’টি অধ্যায় আছে। জীবকের চিকিৎসাখ্যাতি শুধু রাজগৃহেই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে পরিব্যাপ্ত ছিল।
     বিশ্ববিদ্যালয় বলতে যা বোঝায় সেরকম কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তক্ষশিলায় ছিল কিনা সে বিষয় সন্দেহ আছে। বহু শিক্ষক ও পণ্ডিত এখানে বসবাস করতেন। দূরদূরান্ত থেকে বহু ছাত্র তাঁদের নিকট অধ্যয়ন করতে আসতো। তাই বহু ছাত্রের সমাবেশ হত এখানে। সম্ভবত এই কারণেই অনেকে তক্ষশিলাকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে ড. আল্‌তেকারের বক্তব্যঃ
……..Takshasila did not possess any college or university in the modern sense. It was simply a centre of education. It had many famous teachers to whom hundreds of students flocked for higher education from all parts of northen India.”
     ভাবতে অবাক লাগে যে, আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ ও শল্য চিকিৎসার প্রচলন ছিল। আর এ বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন তক্ষশিলার চিকিৎসকরা। শোনা যায় গৌতম বুদ্ধ (৫৬৩-৪৮৩ খ্রিস্টপূর্ব) একবার গুরুতর অসুস্থ হন। স্থানীয় চিকিৎসকদের চিকিৎসায় বিশেষ কোনো ফল না পাওয়ায় উদ্বিগ্ন শিষ্যদের মধ্যে কয়েকজন তক্ষশিলায় যান উপযুক্ত চিকিৎসকের সন্ধানে।
     প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের অতুল ঐশ্বর্যের কাহিনী বিদেশীদের প্রলুব্ধ করে এসেছে। সেই ঐশ্বর্য লুন্ঠনের অভিপ্রায়ে বার বার তারা এদেশ আক্রমণ করেছে। গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডটাস্‌ এর গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, পারসিক সম্রাট কাইরাস কাবুল উপত্যকা ও সিন্ধুনদের মধ্যবর্তী অঞ্চল অ্যাকিমিনীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীকালে কাইরাস বংশের তৃতীয় সম্রাট প্রথম দরায়ুস-এর (৫২২-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্ব) রাজত্বকালে অ্যাকিমিনীয় সাম্রাজ্য গান্ধার, সিন্ধু উপত্যকা ও পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বিশাল পারসিক সাম্রাজ্যের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম ভারতের এই সব নতুন অধিকৃত অঞ্চল ছিল সমৃদ্ধতম অঞ্চল। পারস্য সাম্রাজ্যের এই বিস্তৃতির ফলে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতবর্ষ ও পারস্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় শুরু হয়।
     আলেকজাণ্ডার ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপের পুত্র। খ্রিস্ট পূর্ব ৩৩৫ অব্দে ফিলিপের মৃত্যু হলে তিনি কুড়ি  বছর বয়সে ম্যাসিডনের সিংহাসনে আরোহন করেন। খ্রিস্ট পূর্ব ৩৩১ অব্দে তিনি পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করেন। পারস্য সম্রাট তৃতীয় দরাযুসকে যুদ্ধে পরাজিত করলে ভারতে পারসিক প্রভুত্বের অবসান ঘটে। এরপর ৩২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে আলেকজাণ্ডার ভারত আক্রমণ করেন। সে সময় উত্তর-পশ্চিম ভারতে অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। এদের মধ্যে কতকগুলি ছিল রাজতান্ত্রিক এবং কতকগুলি ছিল গণতান্ত্রিক বা অভিজাতগণ কর্তৃক শাসিত রাজ্য। এদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। ফলে আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তারা কখনই সমর্থ হননি। বিতস্তা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত ছিল তক্ষশিলা। কয়েকটি ছোট পার্বত্য জাতিকে পরাজিত করে আলেকজাণ্ডার সিন্ধু অভিমুখে অগ্রসর হলে তক্ষশিলার রাজা অম্ভি প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়ে বিনা যুদ্ধে গ্রিক বীরের বশ্যতা স্বীকার করেন। গ্রিক ঐতিহাসিক মেগাস্থিনিসের (৩৫০-২৯০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) বিবরণ থেকে জানা যায় যে সে সময় তক্ষশিলা ছিল একটি সুশাসিত ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র। জ্ঞান-গরিমায় ছিল অদ্বিতীয়। আলেকজাণ্ডারের এই অভিযানের সময়-সীমা ছিল মাত্র দু’বৎসর। ভারত ত্যাগের পর ৩২৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ব্যাবিলনে আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এদেশে ম্যাসিডোনীয় গ্রিক শাসনের অবসান ঘটে।
     আলেকজাণ্ডারের আক্রমণের ফলে ভারতের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয়-ঐক্যের পথ প্রশস্ত হয়। বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি নিজেদের মধ্যে সংহতি বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর এক দশকের মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উত্তর ভারতে এক অখণ্ড সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এই সময় তক্ষশিলা তাঁর এই বিশাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
     ভারত অভিযানে আলেকজাণ্ডার সম্পূর্ণ সফল হতে পারেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর সিরিয়াকে কেন্দ্র করে সেলিউকস যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন তা খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকের মধ্যভাগে ভেঙে পড়ে। এই সময় সেলুকিড সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পার্থিয়া, ব্যাক্‌ট্রীয়া (বা বহ্লীক) প্রভৃতি অঞ্চলের ঔপনিবেশিক গ্রিকরা স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। অক্সাস বা অক্ষু নদী থেকে হিন্দুকুশ পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের (অধুনা উত্তর আফগানিস্থান) প্রাচীন নাম বক্তৃয়া বা ব্যাক্‌ট্রীয়া, আর খোরসান ও ক্যাম্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলকে বলা হত পার্থিয়া। সিরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাক্‌ট্রীয় ও পার্থিয়ান বা পহ্লবদের অভ্যুথানের নায়ক ছিলেন যথাক্রমে প্রথম ডিওডোটাস ও অর্সকেস।
     খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হলে সমগ্র আর্যাবর্ত আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত  হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে ব্যাক্‌ট্রীয়রা হিন্দুকুশ অতিক্রম করে পাঞ্জাব ও পশ্চিম ভারতের এক বিরাট অংশ দখল করে। অধিকৃত অঞ্চলগুলির মধ্যে তক্ষশিলা অন্যতম। উত্তর-পশ্চিম ব্যাক্‌ট্রীয় গ্রিকরা প্রায় দু’শ বছর রাজত্ব করে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঐক্যের একান্ত অভাব ছিল। পরস্পরের মধ্যে অবিরত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে ব্যাক্‌ট্রীয়-গ্রিক শক্তি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে ভারতের সীমান্তে পার্থিয়ানরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং কাবুল উপত্যকা, তক্ষশিলা ও পাঞ্জাবের কিয়দংশ পর্যন্ত তাদের রাজত্ব বিস্তার করে। পার্থিয়ান বা পহ্লব রাজাদের মধ্যে সর্বাধিক পরাক্রমশালী ছিলেন ‘গণ্ডোকার্নেস’।
     উত্তর-পশ্চিম ভারতে গ্রিক শাসনের অবসান ঘটাতে যে সকল বৈদেশিক আক্রমণকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে শক ও ইউ-চি বা কুষাণ জাতি অন্যতম। শক বা সিথিয়ানদের আদি নিবাস ছিল মধ্য এশিয়ার সির-দরিয়া নদীর উত্তরাঞ্চলে। নান শান পর্বতের সানুদেশে পশ্চিম কান্‌সু অঞ্চলে ইউ-চি নামে অপর এক প্রাচীন জাতির বসবাস ছিল। এরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ১৭৫ অব্দের কিছু পরে হূণদের আক্রমণের ভয়ে ইউ-চি রা নিজ বাসভূমি পরিত্যাগ করে শক অধ্যুষিত অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়। শকদের যুদ্ধে পরাজিত করে তারা সেখানে নতুন রাজ্য স্থাপন করে। পরাজিত শকরা কালক্রমে সিন্ধু উপত্যকায় এবং পশ্চিম ভারতে বসতি স্থাপন করে।
     ভারতের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কুষাণযুগ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শক-পহ্লবদের পর কুষাণরাই উত্তর ও পশ্চিম ভারতে রাজ্য বিস্তার করে। ভারতীয় কুষাণরা ইউ-চি জাতির একটি শাখা। আনুমানিক ৫০ খ্রিস্টাব্দে ‘কুজুল’ বা ‘কদফিসিস’ গ্রিক, পহ্লব অধিপতিদের পরাভূত করে কাবুল ও কান্দাহার অধিকার করেন। এরপর ‘বিম’ বা দ্বিতীয় ‘কদফিসিস’ তক্ষশিলা থেকে পাঞ্জাব ও গাঙ্গেয় উপত্যকার এক বিরাট অংশ জয় করে কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। আফগানিস্থান, সিন্ধুর এক বিরাট অংশ, পাঞ্জাব ও পার্থিয়া এবং ব্যাকট্রীয়ার কিয়দংশ নিয়ে যে বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন কুষাণ বংশজাত কণিষ্ক। পরবর্তীকালে কাশ্মীর সহ বহু রাজ্য জয় করে তিনি তা কুষাণ সাম্রাজ্যভুক্ত করে এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন। তাঁর রাজত্বকাল প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক গৌরবময় যুগ।
     আনুমানিক ৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘কণিষ্ক’ কুষাণ সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হন। তাঁর রাজধানী পুরুষপুরের (অধুনা পেশোয়ার) নিকটেই ছিলক্ষশিলা। শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে তক্ষশিলা সে সময়ও এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। কুষাণ আমলে বৌদ্ধধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্মের ও ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার কুষাণদের আরেক অবদান। কণিষ্ক ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তাঁর আমলে তক্ষশিলা ছাড়াও রাজধানী পুরুষপুর ছিল বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র। কণিষ্কের উৎসাহে তাঁর সভাসদ অশ্বঘোষবুদ্ধচরিত’ ও  ‘সৌন্দরনন্দ’ নামে দু’খানি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। এছাড়াও কণিষ্কের রাজ বৈদ্য চরক ‘আয়ুর্বেদ সংহিতা’ নামে অপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থগুলি সংস্কৃত সাহিত্যের এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
     বহু বিশিষ্ট চৈনিক বৌদ্ধ বিভিন্ন সময় ভারতবর্ষে এসেছিলেন এদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞান-চর্চা ও বৌদ্ধ দর্শন সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে। এই সকল চৈনিক পরিব্রাজকদের মধ্যে ফা-হিয়েন, হুই-সেং, সুং ইউন, ইউয়েন-সাঙ এবং ইৎ সিং-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে ফা-হিয়েন (৩৯৯-৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) ভারত পরিভ্রমণে আসেন। তিনি এদেশে প্রায় পনেরো বছর ছিলেন। তাঁর বিবরণী থেকে জানা যায়, ভারত পরিক্রমার সময় তিনি পুরুষপুর, তক্ষশিলা, কান্যকুব্জ, কুশীনগর, রাজগৃহ, বোধগয়া প্রভৃতি নগরগুলি পরিদর্শন করেন।
     সপ্তম শতাব্দীতে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাঙ (৬২৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ) ভারত পরিভ্রমণে আসেন। চিনের হুনান প্রদেশে এক অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। তিনি এদেশে চোদ্দ বছর অতিবাহিত করেন এবং বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণ করেন। তিনি যখন তক্ষশিলা পরিদর্শনে যান তখন সেই নগরী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সুপ্রাচীন সমৃদ্ধশালী তক্ষশিলার এই শোচনীয় অবস্থার কারণ পঞ্চম শতাব্দীতে হূণ-রাজ মিহিরকুলের ক্রমাগত আক্রমণ। এইভাবে শেষ হয়ে যায় ভারতীয় শিক্ষা জগতের এক অধ্যায়। চিরকালের জন্য হারিয়ে যায় ভারতের বিশিষ্ট শিক্ষাকেন্দ্র তক্ষশিলা।
     তক্ষশিলার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে অধুনা পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের ৩৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ‘সরাইখেলা’ নামক স্থানে খনন কার্য চালিয়ে। এই কৃতিত্বের অধিকারী ভারতীয় প্রত্নতত্ব বিভাগের প্রথম ডিরেক্টর স্যার আলেকজাণ্ডার কানিংহাম। কানিংহামের পর এই কাজ অব্যাহত রাখেন স্যার জন মার্শাল এবং তারপরে স্যার আর-ই-মার্টিমার হুইলার।
     পায়ে পায়ে হেঁটে চলুন ‘মারগুলা’ পাহাড় ঘেরা সবুজ মাঠের দিকে যেখানে দেখা যাবে সুপ্রাচীন নগরী তক্ষশিলার ধ্বংসাবশেষ। তারই মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বক্তৃতামঞ্চ, গবেষণামন্দির, পাঠকক্ষ, ছাত্রাবাস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন ভারতে শিক্ষা জগতে তক্ষশিলার খ্যাতির নীরব সাক্ষী। পাহাড় ঘেরা এই ভাবগম্ভীর পরিবেশে মনে পড়ে যায় বৈয়াকরণ পাণিনি, কাত্যায়ণ, পতঞ্জলি, চাণক্য, চরক, সুশ্রুত, জীবক প্রমুখ স্বনামধন্য মনীষীদের কথা যাঁরা একদিন এই শিক্ষাকেন্দ্রে অধ্যয়ন অথবা শিক্ষাদান করতেন। তক্ষশিলা থেকে চলে আসার আগে আসুন তাঁদের উদ্দেশ্যে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।

তথ্যসূত্রঃ
১) University life in Ancient India, P.K.Acharya; Science & Culture.
২) Education in Ancient India, A.S.Alterkav.
৩) বিজ্ঞানের ইতিহাস, সমরেন্দ্রনাথ সেন; শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ।
৪) ভারতের ইতিহাস, শ্রী অতুল চন্দ্র রায়; মৌলিক লাইব্রেরী।
৫) ভারতের ইতিহাস কথা (প্রাচী যুগ), ডক্টর কিরণচন্দ্র চৌধুরী; মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড।
৬) হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী, সম্পাদনা ও ভূমিকা তুষারকান্তি পাণ্ডে; গ্রন্থনা।

লেখক পরিচিতি - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জনপ্রিয় লেখক এবং শিক্ষাবিদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। তাঁর লেখা বইগুলি পাঠক মহলে ইতিমধ্যে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ এবং রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের আজীবন সদস্য। বর্তমানে তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সহ সভাপতি। জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য। এছাড়াও তিনি আরও অনেক পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। আকাশবানী কলকাতা কেন্দ্রে বিজ্ঞানের অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত অংশ গ্রহণ করে থাকেন। দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০০৫ সালে ‘গোপাল ভট্টাচার্য স্মৃতি’ পুরষ্কার প্রদান করেন। লেখকের সম্পর্কে আরও জানতে হলে এই ব্লগে যেতে হবে Blogsite: kbbwriter.wordpress.com

No comments:

Post a Comment