সিনেমা - ‘দ্য গুড ডাইনোসর'
রিভিউ - কেয়া মুখোপাধ্যায়
পৃথিবী থেকে ডাইনোসররা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক কাল আগে। মানুষের কোনও অস্তিত্বই ছিল না তখন! কিন্তু এমন কি হতে পারে, গভীর জঙ্গল আর উঁচু উঁচু দুর্গম পাহাড়-ঘেরা গা-ছমছম এক পরিবেশে কোনও একদিন হঠাৎ এক বড়োসড়ো ডাইনোসরের মুখোমুখি হল একরত্তি একটা ছেলে? তারপর কী হবে বলো তো! নিশ্চয় তোমরা ভাবছ, ওই খুদে ছেলেটা ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে। মোটেই না। ঠিক তার উলটো। ডাইনোসরের সঙ্গে একটু একটু করে বন্ধুত্ব হবে খুদে ছেলেটার। তারপর দুই বন্ধু মিলে পা বাড়াবে অচেনা পৃথিবীতে। নতুন অ্যাডভেঞ্চারে।
ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স-এর পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিয়োর নতুন উপহার থ্রি-ডি অ্যানিমেটেড ছবি ‘দ্য গুড ডাইনোসর'। এ গল্প সাহসের। উদারতার। বন্ধুত্বের। মানুষ আর ডাইনোসরের বন্ধুত্ব। কেমন করে সম্ভব হল, সে গল্প বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক মিলিয়ন বছর।
আজ থেকে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে এক অ্যাস্টরয়েডের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল পৃথিবীর। তাই দুনিয়া থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল সব ডাইনোসর। ধরে নাও, সেই অ্যাস্টরয়েডের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে লাগতেও কোনও ক্রমে বেঁচে গেল পৃথিবী। তাই বহাল তবিয়তে বেঁচেবর্তে রইল সব ডাইনোসর। আরো কয়েক মিলিয়ন বছর পার করে আস্তে আস্তে তারা শিখছে কথা বলতে। থাকবার আস্তানা কি অসময়ের খাবার-দাবার জমিয়ে রাখার মত ছোটখাট ঘর বানাতে। হাঁস-মুরগী পালতে। এমন কি, চাষবাস করতেও।
এই গল্পের শুরু দুর্গম ক্ল-টুথ মাউন্টেন-এর কোলে এক ভয়াল-সুন্দর উপত্যকায়। সেখানে থাকে এক অ্যাপাটোসরাস পরিবার। অ্যাপাটোসরাস বাবা হেনরি আরমাইডা চাষবাস করে। তিন ছেলেমেয়েকে যত্ন করে শেখায় কী করে জল দিতে হয় মাঠে, কেমন করে পাহারা দিয়ে হয় মাঠ-ভরা শস্য, শীত এসে পড়ার আগেই কী ভাবে সঞ্চয় করে রাখতে হয় শস্যদানা, অসময়ের জন্যে। দাদা বাক্ আর দিদি লিবি সবই শিখে ফেলে চটপট। মুশকিল হয় শুধু ছোট্ট আর্লোর। একে তো চেহারাতে ছোটখাটো। তার ওপর না আছে দাদার মত গায়ের জোর, না আছে দিদির মত বুদ্ধি। সবেতেই ভয় পায় সে। এমন কি পোষা মুরগিগুলোকে খাবার দিতে গিয়েও সে নাকানি-চোবানি খেয়ে একেবারে একশা। দেখে শুনে দাদা হাহা করে হাসে। মা ভরসা দেয়, আর বাবা গম্ভীর হয়ে ভাবতে থাকে কী করে ভীতু আর্লোকে সাহসী করে তোলা যাবে। তবেই না একদিন কাজের মত কাজ করে দুনিয়ায় একটা ছাপ রেখে যাবে সে!
একদিন সেই সুযোগ এল। শীতকালের জন্যে জমিয়ে রাখা শস্যদানা চুরি করে খেয়ে যাচ্ছিল একটা পুঁচকে ছেলে। খুদে এক গুহা-শিশু। আর্লোকে বাবা শিখিয়ে দিল কেমন করে ফাঁদ পেতে ধরতে হবে তাকে। তাহলেই একটা কাজের মত কাজ করা হবে আর্লোর। কিন্তু ফাঁদে পড়া অসহায় ছেলেটাকে দেখে কিছুতেই আঘাত করতে পারল না আর্লো। ছেড়ে দিতেই হুড়মুড়িয়ে পালাল ছেলেটা। বাবা এসে দেখল সব। প্রথমটা একটু হতাশ আর গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর আর্লোকে সাহসী করে তুলতে তাকে সঙ্গে নিয়ে ছুটতে লাগল এবড়োখেবড়ো পাথরভরা দুর্গম পথ দিয়ে। নদীর পাশে পাশে। আর্লো ভয় পায়। বাবা সাহস দেয়। এমনি করেই চলছিল। আচমকা এসে পড়ল ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সেই বিপর্যয়েই বাবার থেকে আলাদা হয়ে গেল আর্লো। কোনওরকমে প্রাণে বাঁচল। কিন্তু তখন সে তার নিজের চেনা-জানা পরিবেশ থেকে অনেক দূরে। পরিবারের আর সকলের থেকে আলাদা। এক্কেবারে একা। ঘরে ফেরার তাগিদেই অজানা পথে আর্লোর অ্যাডভেঞ্চার। ভরসা শুধু বাবার কথাটা, ‘ফলো দ্য রিভার!’ প্রথমে খুঁজে পেতে হবে নদীটা। তারপর নদীর ধার ঘেঁষে চলতে চলতে, ওই দিগন্তে ক্ল-টুথ মাউন্টেন-এর তিনটে চুড়ো দেখতে পেলেই আর চিন্তা নেই! আর্লো ঠিক খুঁজে পাবে তার নিজের বাড়ি। এই অভিযানের পথেই আর্লোর সঙ্গে আবার হঠাৎ দেখা সেই পালিয়ে যাওয়া খুদে গুহা-শিশুর। আর্লো তার নাম দিল ‘স্পট’।
উদার প্রকৃতি। ভালবাসায় ভরা খুশিয়াল জীবন। সে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া রূঢ় বাস্তব। পরিবারের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবার কষ্ট। সেই কষ্টে কাছাকাছি এসে পড়া এক ডাইনোসর আর ছোট্ট ছেলের বন্ধুত্ব। আর সেই বন্ধুত্বের ভরসায় পেরিয়ে যাওয়া দুর্গম সব পথ। একের পর এক রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য ছবি জুড়ে।
এই ছবিতে প্রকৃতি শুধু ব্যাকড্রপ হয়ে থাকেনি। প্রকৃতিই এ ছবির প্রাণ। এ ছবির বিস্ময়। দিগন্তে গোলাপি থেকে কমলারঙা ম্যাজিক-আলো ছড়ানো সূর্য, দুর্গম পাহাড়ের বাঁক থেকে দেখা টুকরো আকাশে মেঘের আনাগোনা, পাতার ওপর ঝকঝকে হীরেকুচির মত ঝরে পড়া বৃষ্টিধারা, স্বচ্ছতোয়া নদী কিংবা নদীর ধার ঘেঁষে ছুটে চলা আর্লোর মাথার ওপর উজ্জ্বল সবুজ চাঁদোয়া হয়ে থাকা বিশাল বিশাল পাইন – সব যে কি জীবন্ত! কি অবিশ্বাস্যরকম বাস্তব! একটা অ্যানিমেটেড ছবিতে যে আলোর এমন অনবদ্য ব্যবহার হতে পারে – এই ছবিটা না দেখলে ভাবাই যাবে না। সেই সঙ্গে কি অপূর্ব ব্যবহার রঙের! প্রকৃতি তার সবটুকু রঙরূপ নিয়ে ধরা দিয়েছে এই অ্যানিমেটেড ছবিতে।
শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের দিক থেকে দেখলে ‘দ্য গুড ডাইনোসর’ নিঃসন্দেহে পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিয়োর সেরা ছবি। কিন্তু তবু চিরকালের সেরা অ্যানিমেশন ছবির তালিকায় একে ফেলা মুশকিল। বিশেষ করে ২০১৫-তে ঠিক এই ছবির আগেই যখন পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিয়ো উপহার দিয়েছে 'ইনসাইড আউট'-এর মত সংবেদনশীল এক অ্যানিমেটেড ছবি। এর একটা কারণ অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় আর বিক্ষিপ্ত কিছু দৃশ্য। স্টির্যাকোসরাস ‘পেট কালেক্টর’ আর তার পোষ্যগুলো এ গল্পে কোনও আলাদা মাত্রা যোগ করে না। তেমনি টির্যানোসরাস ‘বুচ্’ আর তার দলবল এটা নিশ্চয়ই বোঝাতে পারে, ভয়ঙ্কর চেহারা মানেই যে সে আদতে খারাপ – এমন নয়, সে ভাল বন্ধুও হতে পারে। কিন্তু গোটা গল্পের নিরিখে এই অংশটা জরুরি ছিল না। বরং খুব দরকার ছিল ছোট্ট গুহাশিশু স্পট-এর চরিত্রটা আরও যত্ন নিয়ে গড়া। কোথা থেকে এল স্পট? কেমন করে একেবারে একলা হয়ে গেল সে? স্টির্যাকোসরাস বা টির্যানোসরাসের টুকরো টুকরো আরোপিত গল্পগুলো মূল কাহিনিতে ঢুকে পড়ে আর্লোর সঙ্গে একটু একটু করে স্পট-এর সম্পর্ক তৈরি, ক্রমশ গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার যে ধারাবাহিক ঘটনা পরম্পরা – তাকে খানিকটা বাধা দিয়েছে। অথচ মানুষ আর ডাইনোসরের আপাত অসম্ভব সেই বন্ধুত্ব – যেটা সব ছোটদের কল্পনার রাজ্যে থাকেই থাকে – সেটাই কিন্তু এ গল্পের প্রাণভোমরা। সবচেয়ে সুন্দর ভাবনা। এইদিকে আর একটু নজর দিলেই ‘দ্য গুড ডাইনোসর’ শেষ অবধি ‘গ্রেট ডাইনোসর’ হয়ে উঠতে পারত।
‘দ্য গুড ডাইনোসর’ ছবির মূল ভাবনা বব পিটারসনের (Bob Peterson)। ২০০৯ নাগাদ একসঙ্গে ছবির কাজ শুরু করেছিলেন বব পিটারসন আর পিটার সন (Peter Sohn)। ২০১৪-তে বব পিটারসনের পরিবর্তে ডিরেক্টর হিসেবে ছবিটা সম্পূর্ণ করলেন পিটার সন।
অ্যানিমেটেড ছবি মানে শুধু কন্ঠ দিয়েই চরিত্রে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করা। তাই ছবির ভয়েস-কাস্টিং কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই। সে কাজে একশোভাগ সফল অভিনেতারা। আর্লো যখন একেবারে ছোট্ট, সে চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন শিশু অভিনেতা জ্যাক ম্যাকগ্র। তারপর আর্লোর বছর এগারো বয়স হতে, সে চরিত্রে এসেছেন রেমন্ড ওচোয়া। স্পটের চরিত্রটির কন্ঠ-অভিনয়ে জ্যাক ব্রাইট। আর্লোর বাবা জেফ্রি রাইট আর মা-র চরিত্রে ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড।
‘দ্য গুড্ ডাইনোসর’ ছোটবন্ধুদের তো ভাল লাগবেই। ভাল লাগবে সেইসব বড়দেরও, যাঁরা মনে মনে এখনও ছোটদেরই দলে, ডাইনোসর আর মানুষের বন্ধুত্বের আশ্চর্য রসায়ন যাঁদের ঠোঁটের ফাকে এঁকে দেয় এক চিলতে হাসি। আর একটা কথা বলতেই হবে। এই ছবির রেটিং কিন্তু PG, Parental Guidance suggested। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিংবা সেই বিপর্যয়ে মৃত্যু – এমন কয়েকটি দৃশ্যের জন্যে।
নভেম্বরের শেষে থ্যাঙ্কস গিভিং-এ ছবিটা মুক্তি পেয়েছে বিদেশে। ভারতেও কিছু শহরে এসে পড়েছে ডিসেম্বরের শেষাশেষি কিংবা জানুয়ারিতে। তোমাদের শহরে এলেই, বাবা মা-কে সঙ্গে নিয়ে দেখে ফেলো চটপট্। বাড়িতে বসে দেখতে চাইলে আর একটুখানি অপেক্ষা! ওয়াল্ট ডিজনি হোম ভিডিও এন্টারটেইনমেন্ট-এর মাধ্যমে ব্লু রে আর ডিভিডি এসে পড়বে ২৩-শে ফেব্রুয়ারি। ততক্ষণ এক টুকরো ট্রেইলার দেখলে মন্দ হয় না, কী বল?
‘দ্য গুড ডাইনোসর’ সিনেমার ট্রেলার দেখতে হলে নিচের লিংকে ক্লিক করো -
আহা, রিভিউখানা পড়েই তো সিনেমাটা দেখতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু পাই কই? জোকস্ অ্যাপার্ট, চমৎকার রিভিউ-এর জন্যে ধন্যবাদ কেয়া।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ ঋজু! ফিল্ম রিভিউ আগে লিখিনি। তোমার কথায় উতসাহ পেলাম। দিল্লি, ব্যাঙ্গালোরের ক'জন বন্ধু দেখে ফেলেছেন ইতিমধ্যেই। পুবদিকে কবে আসে - এখন তারই অপেক্ষা!
Delete