দেশবিদেশের গল্প:: হরলাল - অ্যালভিন শোয়ার্টজ (অনুবাদঃ অনন্যা দাশ)

হরলাল
অ্যালভিন শোয়ার্টজ
অনুবাদঃ অনন্যা দাশ

খুব গরমের দিনগুলোতে উপত্যকা খন তেতে পুড়ে ওঠে তখন গোপাল আর অনন্ত নিজেদের গরুগুলোকে পাহাড়ের সবুজ জমিতে চরাতে নিয়ে যায়। সেটা অনেকটা পথ, তাই ওরা মাস দুয়েক পাহাড়ের ওপরেই ছোট একটা কুঁড়ে ঘরে দিন কাটায়; তারপর গরমটা কমলে আবার নিচে উপত্যকায় ফিরে আসে। ওরা যে ভারি গরিব, আর গরুগুলোই ওদের একমাত্র সম্বল। তাই গরমে উপত্যকার ঘাস শুকিয়ে গেলে গরুদের খাবার জোটে না, তখন পাহাড়ের ওপরের ঘাসই ভরসা।
কাজটা শক্ত কিছু না, কিন্তু বড্ড একঘেয়ে। পাহাড়ের ওপর লোক বসতি একেবারেই নেই। ওরা দুজন সারাদিন ধরে শুধু গরুগুলোর দেখাশোনা করে। বেলা পড়লে ছোট কুঁড়ে ঘরে ফিরে আসে। বাগানে একটু আধটু কাজ করে সবজি ফলাবার চেষ্টা করে, তারপর খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ে। এই ভাবেই চলে রোজ।
তারপর একদিন গোপালের মাথায় একটা বুদ্ধি খেললসে অনন্তকে বলল, “চল আমরা দুজনে মিলে একটা পুতুল বানাই। সেটাকে মানুষের আকারেই বানাবকিছু একটা সৃষ্টি করার সুখটাও হবে আর বাগানে রাখলে কাকতাড়ুয়ার কাজও করবে।”
“বাহ, বেড়ে কথা বলেছিস! তবে শোন পুতুলটাকে দেখতে যেন হরলালের মতন হয়!” অনন্ত বলল।
হরলাল চাষিকে ওরা দুজনেই দু’চক্ষে দেখতে পারে না, অসম্ভব ঘৃণা করে ওকেতাই অনন্তর প্রস্তাবে গোপাল এক কথায় রাজি। ওদের দুজনকে একেবারে জ্বালিয়ে খায় ব্যাটা হরলাল!
পুরনো চটের বস্তার মধ্যে খড় পুড়ে ওরা পুতুলটাকে তৈরি করতে লাগল। মানুষের মতন আকার দিতে চেষ্টা করল। শেষে হরলালের লম্বা তোতা পাখির মত নাক আর কুতকুতে চোখ যোগ করে দিল। আর সবশেষে জুড়ে দিল এক গোছা কালো চুল আর রাগি রাগি মুখ। ব্যাস পুতুল তৈরি, নাম তার অবশ্যই হরলাল।
রোজ সকালে গরু নিয়ে বেরোবার আগে ওরা হরলালকে বাগানে একটা কাঠের থাম্বার সাথে বেঁধে চলে যায় যাতে পাখিরা এসে বাগানের ফল সবজি নষ্ট না করে। রাতে ফিরে এসে আবার তাকে ঘরে ঢোকায়। বৃষ্টি পড়লে অবশ্য পুতুলটা ঘরেই থাকে।
ঠাট্টা ইয়ার্কির মেজাজ হলে হরলালের সঙ্গে কথা বলে ওরা, একজন জিজ্ঞেস করে “কী হরলাল? বাগানে সবজিপাতি কেমন হচ্ছে?” অন্যজন হরলালের মতন গলা করে বলে, “খুবই ধীরে ধীরে হচ্ছে বাপু সব! যতদিনে ফল ধরবে তত দিনে আমার কালো চুল সাদা হয়ে যাবে মনে হয়!” তারপর ওরা দুজনে নিজেদের রসিকতায় হো হো করে হাসে, হরলাল অবশ্য হাসে না।
মাঝে মাঝে খারাপ কিছু ঘটলে হরলালের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়তাকে কিল, চড়, ঘুসি আর গালাগাল সবই খেতে হয়। অনেক সময় একই খাবার রোজ রোজ খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে ওরা কিছুটা হরলালের মুখে মাখিয়ে দিয়ে বলে, “কী হরলাল? রান্না কেমন হয়েছে? চটপট খেয়ে ফেলো, নাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে বলে দিচ্ছি!” বলে আবার হ্যা- হ্যা করে হাসে দুজনে।
তারপর একদিন কী একটা ব্যাপারে প্রচন্ড রেগে গিয়ে হরলালকে বেদম পেটাচ্ছিল গোপাল। এমন সময় হঠাৎ ওর মনে হল হরলাল যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল!
অনন্ত শুনতে পেয়ে বলল, “ওটা আবার কী? কে দীর্ঘশ্বাস ফেলল?”
“হরলাল, আবার কে! আমি দেখলাম, কিন্তু সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না!”
“অ্যাঁ! তা কী করে হয়? হরলাল তো খড় আর চটের তৈরি!”
“ওকে তাহলে এখুনি পুড়িয়ে ফেলি,” গোপাল ভয় পেয়ে বলল।
“না, না, অতটা বোকামি করা ঠিক হবে কী? কত কষ্ট করে ওকে তৈরি করলাম। তাছাড়া আমরা তো কয়েকদিন পরই এখান থেকে চলে যাব। তখন ওকে এখানে ফেলে রেখে গেলেই হবে। আপাতত ওর ওপর নজর রাখলেই হবে। তুই কী শুনতে কী শুনেছিস!”
এর পর কয়েকদিন ওরা হরলালকে ঘরেই ফেলে রেখে দিল। পুতুলটা মাঝে মাঝে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করত মনে হত কিন্তু আর কিছু না। সব দেখে শুনে ওদের মনে হল খড়ের বস্তাতে মনে হয় ইঁদুর বা ছুঁচো ঢুকে পড়েছে তারাই ওই সব শব্দ টব্দ করছে। শব্দ রহস্যের সমাধান করতে পেরে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে ওরা আবার আগের ব্যবস্থাতেই ফিরে গেল। সকালবেলা যাওয়ার সময় পুতুলটাকে বাইরে ছেড়ে দেওয়া আর রাতে ফিরে টেনে ঘরে ঢোকানো। ঠাট্টা তামাশা করতে ইচ্ছে হলে ওর সঙ্গেই করা আর রাগ হলে সেই কিল, চড়, গালাগালি!
হঠাৎ একদিন অনন্ত বাড়ি ফিরে বলল, “এই গোপাল, হরলালকে দেখতে একটু বড় লাগছে না?”
গোপাল দেখে বলল, “হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, আমারও তাই মনে হচ্ছে!”
“আমাদের চোখের ভুলও হতে পারে অবশ্য। আমরা বড্ড বেশি সময় একা একা পাহাড়ে পড়ে রয়েছি, আর পারছি না। এবার লোকালয়ে ফিরে যেতে হবে। একা একা থাকতে থাকতে মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমাদের!” অনন্ত বলল।
পরদিন সকালবেলা ওরা যখন খাচ্ছিল তখন হঠাৎ হরলাল উঠে দাঁড়িয়ে ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল! ঘোড়া যেমন দু’পায়ে হাঁটে কতকটা সেই রকম ভাবে। হাঁটতে হাঁটতে সে ওদের গরু চরাবার জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। গোপাল আর অনন্ত তো ভয়েই জড়সড় হরলাল এর পর কী করবে সেই ভেবেই।
“আর এখানে থাকা চলবে না। আমরা এখুনি এখান থেকে নিচে চলে যাই।”
যেমন ভাবা তেমনি কাজ ওরা দুজনে গরুটরু নিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। তখন আর হরলালকে কোথাও দেখতে পেল না ওরা, তাই বাড়ি ফেরার আনন্দে গান টান গাইতে গাইতে চলল ওরাকিছু দূর গিয়ে অনন্তর মনে পড়ল ওদের যন্ত্রপাতির বাক্সটা কুঁড়ে ঘরে পড়ে রয়েছে। দুজনের কেউই ফিরে যেতে রাজি নয়, কিন্তু যন্ত্রপাতির বেশ দাম, আর ওগুলো ছাড়া তো চলেও না।
ওরা একে অপরকে বলতে লাগল, “আরে ওখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। একটা পুতুল আমাদের কোন ক্ষতি করতে  পারবে না!” কিন্তু তাও কেউ যেতে চায় না।
শেষে একটা পয়সা বার করে ওরা টস করে দেখল। গোপাল হারল, অগত্যা তাকেই যেতে হল। সে আবার পাহাড়ের ওপরের দিকে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমি ছুটতে ছুটতে যাচ্ছি। একটু বাদেই যন্ত্র নিয়ে এসে তোকে ধরে ফেলব।” অনন্ত উপত্যকার দিকে পা বাড়াতে গিয়েও কী ভেবে থেমে অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও গোপাল আসছে না দেখে সে একটা উঁচু পাথরের ওপর উঠে পাহাড়ে ওদের কুঁড়ে ঘরটাকে দেখতে চেষ্টা করতে লাগল। ওমা, গোপালকে দেখতে পেল না সে কিন্তু হরলালকে দেখতে পেল। পুতুলটা ওদের ঘরের ছাদে উঠেছে! অনন্তর চোখের সামনে হরলাল আস্তে আস্তে হাঁটু মুড়ে বসে একটা রক্তমাখা চামড়া রোদে শুকোতে দিতে লাগল
পাগলের মতন অবস্থায় উপত্যকায় নেমে এসে অনন্ত জেনেছিল যে ওরা পাহাড়ে উঠে যাওয়ার পরের দিনই ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় হরলালের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল ওর বাড়ি থেকে, খুনি কিন্তু ধরা পড়েনি।
-------------------
ছবি—তন্ময় বিশ্বাস

লেখক পরিচিতি - অ্যালভিন শোয়ার্টজ (Alvin Schwartz, April 25, 1927-March 14, 1992) কিশোর এবং অল্পবয়সী পাঠকদের জন্যে প্রাচীন উপকথা, লোককথা ঘেঁটে গল্প লিখতে ভালবাসতেন যাতে তারা সেই সব গল্প জানতে পারে। নিজের পছন্দ মত একটু আধটু বদল অবশ্য উনি করে দিতেন‘হরলাল’ গল্পটা ওনার লেখা ‘হ্যারল্ড’ গল্পটার অনুবাদ। এই গল্পটা নিয়ে লেখক যা বলেছেন সেটাও এখানে দিলাম – “লোককথা, উপকথাতে পুতুলের জীবন্ত হয়ে ওঠার অনেক গল্পই আছে ইহুদিদের একটা প্রচলিত লোককথা আছে যেখানে একজন ইহুদি ধর্মযাজক নিজের আশ্চর্য ক্ষমতাবলে একটা মাটির মূর্তিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা ওনার নিয়ন্ত্রণে থাকেনি, তাই উনি শেষমেশ ওটাকে নষ্ট করে ফেলেন, ঠিক মেরি শেলির ফ্রাঙ্কেন্সটাইন মন্সটারের মতন।
একটি গ্রীক রূপকথাতে এক রাজকন্যা মনের মত পাত্র না পাওয়ায় কাজু, বাদাম, চিনি ইত্যাদি মিশিয়ে নিজের মনের মতন এক পুরুষকে তৈরি করে। গল্পের নাম ‘দা জেন্টেলম্যান মেড অফ গ্রোটস’ বা ‘মিস্টার সিমিগ্যাল্ডি’। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর ভগবান নাকি খুশি হয়ে সেই পুতুলে প্রাণ দিয়ে দেন এবং রাজকন্যা ও তার স্বামী মনের সুখে জীবন যাপন শুরু করে।
‘হ্যারল্ড’ গল্পটা একটি অস্ট্রিয়ান-সুইস উপকথা থেকে নেওয়া।”

5 comments:

  1. Jani na kotodin Ei anubad gulo korbe, kintu Amar moto pathok Ei anubad gulo pore khub upokrito hoi, tai dhonyobad ta janiye rakhlam

    ReplyDelete
    Replies
    1. Dhanyabad Arnab...aro kichu korte chesta korbo

      Delete
  2. দারুন একটা অনুবাদ গল্প পড়লাম !!!
    সাথে লেখক পরিচিতি পেয়ে আরও ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  3. ছোটোর মধ্যে বেশ ভালো লাগল গল্পটা। অনুবাদ এতটাই সাবলীল যে মনেই হয়না যে ভাষান্তরিত হয়েছে।

    ReplyDelete