কী গেরো!
অপর্ণা গাঙ্গুলী
বিশাল মানুষ বিপুলবাবু। কিন্তু ছোটবেলাতেই তো আর বিশাল বপুর ছিলেন না, তবুও বাবা মা, কি জানি কী ভেবে, ওই নামটিই রেখেছিলেন তাঁর। কলকাতায় তিনতলা বাড়ি, নিচে বৈঠকখানা ঘর, গেরাজ আর রান্নাঘর আর উপরে সার সার শোবার ঘর। বাড়িতে থাকার লোক বলতে বিপুলবাবু, তাঁর গিন্নি মণিমালা দেবী, দুই নাতি নাতনি, তাতাই আর টিকলু, ফাই ফরমাস খাটার মানুষ ভজুয়া আর একটা ইয়া বড় জিভ লকলকে জার্মান শেফার্ড কুকুর, কালিচরণ। এই নাম রাখার উদ্দেশ্য আছে। ছোট করে কালী বলে ডাকলেও সে সাড়া দেয়। তাই দিনরাত কালীনাম জপ করা হয়ে যায় বিপুলবাবু আর তাঁর গিন্নির। বিপুলবাবুর ছেলে থাকেন দিল্লি, বৌমার সাথে। কিছুদিন হল বদলি হয়েছেন। কিন্তু নাতি নাতনিরা দাদু ঠাম্মার কাছ ছাড়া হতে চায়নি বলে এখানেই থেকে গেছে যমজ ভাইবোন। তাতে অবশ্য বিপুলবাবু মহা খুশিতেই আছেন। দিব্যি ওদের সাথে হেসে খেলে সময় কাটান। ইস্কুলের বাসে তুলে দেওয়া, ওদের সাথে বিকেলে পার্কে যাওয়া, ছোটাছুটি করা, এতেই সময় খুব ভালো ভাবে কেটে যায়। সঙ্গে থাকেন বিপুল গিন্নি। উনি খুব মোটাসোটা মানুষ, তায় হাজারটা রোগ ওঁর শরীরে। ডাক্তার হাঁটতে বলেছেন বলে হেঁটে আসেন পার্কে। সেইসময় দাদু আর নাতি নাতনিরা খেলে। আর কালিচরণও ছোটাছুটি করে ওদের খেয়াল রাখে।
এই বাড়িটি বিপুলবাবুর প্রাণ। গিন্নি ও নাতি নাতনিদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে গেলে, তাঁর বাড়ি ফেরার জন্যে মন ছটফট করে। কখন ফিরবেন, ছাদের গাছগুলোকে আবার দেখাশোনা করবেন। যদিও ভজুয়াকে বলে এসেছেন দেখতে, তবু, ও ব্যাটা সুযোগ পেয়ে নির্ঘাত ঘুমিয়ে কাটাবে, এই সব সাতসতের ভাবতে থাকেন। নিচের বাগান জুড়ে খালি গাছ আর গাছ। নাতি নাতনিদের সেখানে কেমন করে গাছ মানুষ, পশু, পক্ষী সবার উপকার করে, গাছ কেটে ফেলার ফলে কী কী ক্ষতি হচ্ছে পৃথিবীর, এই সব কেবল বোঝাতে থাকেন। টিকলু আর তাতাই হাঁ করে শোনে দাদুর কথা আর বলে, ‘তোমার কোনও চিন্তা নেই দাদু, আমরা আমাদের গাছ ছাড়াও যত গাছ আছে সবার জন্য ভাবব, সেবা করব আর কোথাও গাছ কাটা হচ্ছে দেখলেই আপত্তি জানাব।’
খুশি হন বিপুলবাবু। যাক, এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মনে গাছের প্রতি, পশুপক্ষীর প্রতি ভালবাসা যোগাতে পেরে তাঁর মন ভরে যায়। খুব ছোটবেলাতে, তাঁর মাও তাঁকে ঠিক এমন ভাবেই শেখাতেন, মনে পড়ে। ছাদের উপর রবিবার সকালে যখন তাঁরা প্রাতরাশ করতে বসেন, সবাই, তখন অনেক পাখি আসে ওদের কাছে। মণিমালা দেবী, টিকলু আর তাতাই ওদের দানা, গম, ছড়িয়ে দেন, ওরা খেয়ে যায়। কালিচরণ দূরে বসে, এক চোখ বুজে সব দেখে। কী জানি কী ভাবে। কিছু পরে, উঠে এসে চেটে দেয় সবাইকে। এই ওদের ভালোবাসা জানানোর উপায়। টিকলু আর তাতাই তো গাছদের ভালোবাসাও বেশ বুঝতে পারে, আজকাল। খুব রোদ্দুর উঠলে নিচের বাগানে যখন ওরা খেলে তখন দুলে দুলে সব গাছেরা ওদের ছায়া দিয়ে যায়। কত ফুল ফেলে ওদের মাথায়। ঠাম্মা বলেন ওসব গাছদের আশীর্বাদ। ওরা কথা বলতে পারে না তো কী হয়েছে ... এই ভাবেই ওরা ভালোবাসা জানায়।
তা সেদিন হল কী, ছাদে সবে খবরের কাগজটি খুলে বসেছেন বিপুলবাবু আর বিশাল আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘কী গেরো!’ কোনও কাজ উল্টোপাল্টা বা একটু অন্যরকম হলেই বিপুলবাবু এই শব্দ দুটি ব্যবহার করেন - কী গেরো! এ কিছু নতুন না টিকলু তাতাইদের কাছে। ওরা ভাবল, দাদুর চায়ে হয়ত দুধের সর ভেসে উঠেছে, কিম্বা বাজার থেকে কিছু আনতে দিতে ভুলে গেছেন ভজুয়াকে। দাদু আবার বলে উঠলেন – ‘কী গেরো রে বাবা!’ এবারে বেশ বিকট গলায়, আর তাই শুনে ঠাম্মা চোখ কপালে তুলে এই দিকে ছুটে আসতে গিয়ে প্রায় পড়ে গিয়ে আছাড় খান আর কি! টিকলু আর তাতাইয়ের কাছে এ সব ঘটনা মোটেও নতুন না, তথাপি ওরাও দুই জনে বেশ শঙ্কিত হয়ে উঠলো ঘটনার ঘনঘটায় আর তাতাই স্পষ্ট দেখতে পেল, কালিচরণ বসে ফিক ফিক করে হাসছে। তবে তো বড্ড গোলমেলে ব্যাপার, ভাবল তাতাই।
আর তক্ষনি দাদু মুখ খুললেন। ‘কী সব্বনাশ, এত জানি, আর এই কথা জানতাম না! আহা, আমার সাধের বাড়ির কি হবে গো!’ ঠাম্মা এইবার ভীষণ ক্ষেপে উঠলেন। বললেন, ‘তখন থেকে ভণিতা না করে বলবে তো, কী হয়েছে কী?’ টিকলু এর মধ্যে ফোড়ন কাটল – ‘ভণিতা মানে কী?’ ওর বেশ ভালো লেগেছে শব্দটা। রনিতাদি ওদের বাড়ির ম্যাম। তার সাথে দারুণ মিল আছে শব্দটার। সে সব দিকে অবশ্য কেউ পাত্তাই দিল না। দাদু বললেন, ‘এখন কী করা যায়? দিল্লি চলে যাব? অভি আর বৌমার কাছে? কিন্তু সেই বা ক'দিন .. ভূমিকম্প তো আর কলকাতা ছেড়ে যাবে না।’ ভজুয়া ততক্ষণে বাজার থেকে এসে পৌঁছেছে। বাবু আর গিন্নিমার বাক্যালাপের কোনও কিছু সে বুঝতে পারছে না। এমনিতেও যে সে খুব বোঝে তা নয়। সে বলে উঠল, ‘বাবু গো আমারেও নিয়া যান, আমার তিন কূলে কেউ নাই, আমি আর কিসের আশায় কলকেতায় পইড়া থাকুম।’ ওদিকে টিকলু বা তাতাই কেউ রাজী নয়। ওদের সব বন্ধুবান্ধব এখানে, পার্কের আর ইস্কুলের।
নাহ, দাদু মনে হচ্ছে পাগলই হয়ে গেছেন। হঠাৎ কী হলো, ছুটে নেমে গেলেন দোতলায়। পিছে পিছে ঠাম্মা, কালিচরণ, টিকলু, তাতাই আর ভজুয়া। দেখা গেল দোতলার ঘরে ঢুকে পড়ে দাদু বড় ঘরের খাটের তলায় সেঁধুতে চাইছেন। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকছেন দাদু আর খালি বলে চলেছেন, ‘এই জন্যে বলি, গাছ কেটো না, গাছ কেটো না, পৃথিবী গরম হয়ে উঠলে সব্বনাশ হবে, এখন কী গেরো....’ দাদুর পেছনে পেছনে হামাগুড়ি দিয়ে ঠাম্মা, টিকলু, তাতাই, ভজুয়া... শুধু কালিচরণ খুব হতচকিত হয়ে জোরে জোরে লেজ নাড়াচ্ছে। খাটের তলায় ঢুকে আবার দাদু বেরিয়ে এলেন, পেছনে পেছনে সবাই। হাতের ধুলো ঝেড়ে ঠাম্মাকে খুব এক চোট বকে উঠলেন – ‘কী গেরো, আবার তুমি ওর তলায় ঢুকতে গেলে কেন বল তো?’ হয়েছে কী, সব্বাই বেরিয়ে এসেছে শুধু ঠাম্মা গেছেন আটকে। যাক, তাঁকে খুব আস্তে, ধীরে বের করা হল।
আসল ব্যাপারটা জানা গেল, একটু পরেই। দাদু ততক্ষণে আর এক রাউন্ড চা খেয়ে শান্ত হয়ে বসেছেন। বললেন, আজ খবরের কাগজে লিখেছে কলকাতা নাকি ভূমিকম্পের জন্যে ডেঞ্জার জোন কারণ কলকাতার তলা দিয়ে ফল্টলাইন না কিসের কী লাইন গেছে আর তার ফলে কলকাতায়ও নেপালের মত প্রবল ভূমিকম্পের আশংকা রয়েছে। সে সব হলে খুব শক্ত কোনও টেবিল বা কিছুর তলায় ঢুকে থাকতে হতে পারে। দাদুর মতে, দিনের বেলা ভূমিকম্প হলে, জানা বোঝা যায় আর ঘরের বাইরেও চলে যাওয়া যায় ফট করে কিন্তু যদি রাতের বেলাতে হয়, ঘুমের মধ্যে আর কেউ যদি বুঝতে না পারে, তখন তো বাড়ি চাপা পড়ে মরতে হবে। কী গেরো! টেবিলের থেকেও শক্ত হল দাদুর ঠাকুরদার পালঙ্কখানি আর তাই দাদু টেস্ট করে দেখলেন তার তলায় ঢোকা যাবে কিনা। এখন অবশ্য সেই পেল্লায় খাট খানায় আর কেউ শোয় না। দরকার পড়লে ওই উঁচু খাটের নিচেই বিছানা করে শুতে হবে, কী আর করা যাবে! কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকলু তাতাই-এর বাবা মা ফোন করলেন দিল্লি থেকে, ওদের কুশল সংবাদের জন্য। দাদু এই প্ল্যান বললেন ছেলেকে। শুনে অভি আর বৌমা খুব এক চোট হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলেন। টিকলু আর তাতাইও খেলতে চলে গেল, যে যার নিজের মত। কেবল কালিচরণ বসে বসে ভাবতে লাগল - মানুষ কী বিচিত্র জীব ! সবাই তো ভয়েই কাঁপে, কুকুররাও তাই, তা না এরা কাঁপার ভয় পাচ্ছে !
সেদিন সারাদিন ধরে দাদু ভজুয়াকে দিয়ে খাটের তলা পরিষ্কার করিয়ে, মশা মুক্ত করিয়ে, ঝুল ঝাড়িয়ে একাক্কার কান্ড বাঁধালেন। ঢালাও বিছানা করা হল খাটের নিচে। পাশের ঘরে ভজুয়াও কালিচরণকে নিয়ে শোবে অন্য একটি খাটের তলায়। মাথার উপর খাট, ছাদ ভেঙ্গে পড়লে তেমন লাগবে না। ঠাম্মা এক পাশে কষ্ট করে ঢুকে শোবেন, মাঝে টিকলু তাতাই, আর এক পাশে দাদু। আর বলব কী, সেই রাতেই ভূমিকম্প এল। দাদু তখন সবে চক্ষুটি বুঝেছেন বুঝি। আর সবাই উসখুশ করছে, মাটি কেঁপে উঠল, দুই ধারে দুই টেবিল ফ্যান মাটির উপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঠাম্মার মাথার কাছে শাঁখ রাখাই ছিল, ঠাম্মা অমনি পো পো করে শাঁখ বাজিয়ে দিলেন। সব স্তব্ধ আবার, দাদুর নাক ডাকল ঘ্র্র্র ঘরর ঘ্র্র্র ঘ্র্র্র ঘরত আর তক্ষুনি মড়মড় করে সেই পেল্লাই খাট ভেঙ্গে পড়ল ওদের চারজনের ঘাড়ের উপর। তার কারণ ওই রাত দুপুরে শাঁখের আওয়াজে ভীষণ ভয় পেয়ে কালিচরণ তার তাগড়াই শরীর নিয়ে খাটের উপর এক লাফে উঠতেই পুরনো খাট একবারে পপাত চ মমার চ ...
অমনি ভজুয়ার তত্পরতায় সারা পাড়া ভেঙ্গে পড়ল এঁদের বাড়িতে। তারপর ডাক্তার, এম্বুলেন্স, হাসপাতাল।
দাদু পরে বলেছিলেন, ‘কী গেরো, মাঝে মাঝে প্রবল ঝাঁকুনি খেলে মনে হয় আদপে বেঁচে আছি।’
আর টিকলু, তাতাই আর ওদের ঠাম্মা স্পষ্ট শুনেছিলেন, কালিচরণ বলছে - গররররর অর্থাৎ কী গেরো!!
--------------------
ছবি - পুস্পেন মণ্ডল
লেখক পরিচিতি - অপর্ণা এক ব্যক্তিত্বের নাম। একদিকে যাদবপুর থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, এম এ, বি এড. অন্যদিকে অ্যাপটেক অ্যারেনা, সিমবায়োসিসের থেকে এমবিএ ও আইটি ডিপ্লোমা। একহাতে সুনিপুণ গৃহিণী অন্য হাতে Internet Advertising Marketing নিয়ে কর্মরতা। একাধারে গল্পকার, কবি, শিল্পী ও আবৃত্তিকার অপর্ণার ইংরেজি ও বাংলা উভয় সাহিত্যের অঙ্গনে অনায়াস, বলিষ্ঠ যাতায়াত গত পাঁচ বছর ধরে। তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
কি গেরো...এ তো দারুণ গল্প!
ReplyDelete