ঈশানী রায়চৌধুরী
যদিও দিব্যি গেলে বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না জানি, আমি এখন আটমণী লাশ বটে... কিন্তু বছর পাঁচেক বয়সে মোটেও এমনটি ছিলাম না। বিশেষ করে টাইফয়েড থেকে ওঠার পর এমন বিচ্ছিরি পেঁচোয় পাওয়া চেহারা হয়ে গিয়েছিল যে কী বলব। লিকলিকে হাত পা, ন্যাড়ামুন্ডি, চোখ দুটো ঢ্যাবলাপানা, সারাক্ষণ মা ঠাম্মার পায়ে পায়ে ঘোরা অতি অসহ্য টাইপ।
আর সেই সঙ্গে বিশ্ব –হ্যাংলা। ট্যালটেলে ঝোল খাই আর টুকটুকে লাল তেলঝোলে সাঁতার কাটা চর্বিওয়ালা পাঁঠার "ব্যা ব্যা" শুনি। ইস্কুলে যেতে হাঁপ ধরে, খেলাধুলো করতে আরোই "হ্যা হ্যা" করে হাঁপাই। জ্বর ছেড়ে গেছে বটে, কিন্তু চলে যাবার আগে আমাকে নাকে কান্না, বায়না আর জেদের নেশার বড়িটি ধরিয়ে দিয়ে গেছে।
যখন অসুখ করেনি, খানিক দূরে মণিমেলার মাঠে যেতাম বিকেলে। অসুখের পর থেকে তো সে পাটও চুকেছে। জানলার শিক ধরে পাঁচিলের ওপারে সবজেটে পানাপুকুরের দিয়ে চেয়ে থাকি। তাতে বেগুনী কচুরিপানার বাহার আর ওপারের মেথরপট্টির ক'টা খিটখিটে ঝগড়ুটে পাতিহাঁস আর তাদের তুরতুরে ছানাপোনার ভিড়।
আর সেই সঙ্গে বিশ্ব –হ্যাংলা। ট্যালটেলে ঝোল খাই আর টুকটুকে লাল তেলঝোলে সাঁতার কাটা চর্বিওয়ালা পাঁঠার "ব্যা ব্যা" শুনি। ইস্কুলে যেতে হাঁপ ধরে, খেলাধুলো করতে আরোই "হ্যা হ্যা" করে হাঁপাই। জ্বর ছেড়ে গেছে বটে, কিন্তু চলে যাবার আগে আমাকে নাকে কান্না, বায়না আর জেদের নেশার বড়িটি ধরিয়ে দিয়ে গেছে।
যখন অসুখ করেনি, খানিক দূরে মণিমেলার মাঠে যেতাম বিকেলে। অসুখের পর থেকে তো সে পাটও চুকেছে। জানলার শিক ধরে পাঁচিলের ওপারে সবজেটে পানাপুকুরের দিয়ে চেয়ে থাকি। তাতে বেগুনী কচুরিপানার বাহার আর ওপারের মেথরপট্টির ক'টা খিটখিটে ঝগড়ুটে পাতিহাঁস আর তাদের তুরতুরে ছানাপোনার ভিড়।
বনি এসে বলল, মণিমেলার মাঠে নাকি স্পোর্টস হবে। রবিবার। বনি আমার মণিমেলার সাথী।
আমি শুনেই বললাম, "আমিও যাব।"
এদিকে মাথা টালুমালু করে। এত দুর্বল! কিন্তু ওই যে! জেদ আর কান্না। ঘেঙিয়ে ঘেঙিয়ে কান্না। বাড়ির লোকের কানের সব পোকা বেরিয়ে দেশান্তরী হয়ে গেল, তবু আমি ক্ষান্তি দিই না।
শেষে মাঝামাঝি রফা হল। আমি মাঠে যাব, কিন্তু শুধুই দেখতে।
আমি শুনেই বললাম, "আমিও যাব।"
এদিকে মাথা টালুমালু করে। এত দুর্বল! কিন্তু ওই যে! জেদ আর কান্না। ঘেঙিয়ে ঘেঙিয়ে কান্না। বাড়ির লোকের কানের সব পোকা বেরিয়ে দেশান্তরী হয়ে গেল, তবু আমি ক্ষান্তি দিই না।
শেষে মাঝামাঝি রফা হল। আমি মাঠে যাব, কিন্তু শুধুই দেখতে।
স্পোর্টসের দিন থিন এরারুট বিস্কুট আর ফোটানো জলের বোতল আঁকড়ে মা আর ঠাম্মার সঙ্গে মাঠে গেছি। কী রোদ্দুর, বাপ রে বাপ! বেলমুন্ডি ঢেকেছি গোলাপী রেশমি রুমালে। সেদিন একটা সাদা লিনেনের ফ্রক পরেছিলাম। পাঁচ বছরের বাচ্চার এত খুঁটিনাটি মনে থাকে? তেমন তেমন কারণ থাকলে থাকে বৈকি!
একটা করে ইভেন্ট হচ্ছে। ছেলেদের, মেয়েদের। তারপর প্রাইজ। রংপেন্সিল, খেলনা, ক্রিকেট ব্যাট, গল্পের বই... সবার হাতে কিছু না কিছু.... শুধু আমার মুঠি খালি। আমার দু চোখে জল। শরীর শক্ত হয়ে গেছে কষ্টে।
কে একজন এসে বলল, "এই, ওকে একটা প্রাইজ দে না! আহা রে, ছেলেমানুষ!"
আমি সেই বয়সে প্রাইজ বুঝি খুব। কিন্তু "কন্সোলেশন" শব্দের বানান জানি না, মানেও অজানা। "আহা বেচারি" বুঝি। নিজের মতো করে চিনে নিতে পারি সহানুভূতি। চাই না আমার ওই ছাইয়ের প্রাইজ।
মা তাকিয়ে আমার দিকে। পড়তে চেষ্টা করছে আমাকে।
কে একজন এসে বলল, "এই, ওকে একটা প্রাইজ দে না! আহা রে, ছেলেমানুষ!"
আমি সেই বয়সে প্রাইজ বুঝি খুব। কিন্তু "কন্সোলেশন" শব্দের বানান জানি না, মানেও অজানা। "আহা বেচারি" বুঝি। নিজের মতো করে চিনে নিতে পারি সহানুভূতি। চাই না আমার ওই ছাইয়ের প্রাইজ।
মা তাকিয়ে আমার দিকে। পড়তে চেষ্টা করছে আমাকে।
লাস্ট ইভেন্ট। প্রায় বিকেল তখন। মরা রোদ্দুর। মায়েদের মানে মহিলাদের ফ্ল্যাট রেস। নাম নেওয়া হচ্ছে। “হা হা হি হি”, গা ঠেলাঠেলি।
মা উঠে দাঁড়াল। ঠাম্মাকে বলল, "টুকটুক রইল।"
মা উঠে দাঁড়াল। ঠাম্মাকে বলল, "টুকটুক রইল।"
তারপর দেখি মা কোমরে আঁচল জড়িয়ে স্টার্টিং লাইনে, খড়ির দাগে পা। ফট করে খেলনা পিস্তল গর্জে উঠল। মা... বিদ্যুতবল্লরী যেন... চোখের পলকে দুটো পা কেমন হরিণের পা.... উড়ে গিয়ে ছুঁয়ে দিল ও প্রান্তের লাল টুকটুকে ফিতেটা।
মা ফার্স্ট হয়ে গেল। সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে।
মা ফার্স্ট হয়ে গেল। সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে।
কিছুই না, ফার্স্ট প্রাইজ ছিল একটা ঝকঝকে ঘন নীল অদ্ভুতদর্শন মস্ত গ্লাস আর লাল টুকটুকে রাংতার প্যাকেটে ব্রুক বন্ড চা। গ্লাসটা কোনো মিশ্র ধাতুর তৈরি।
মা এসে প্রাইজ তুলে দিল আমার হাতে।
বলেছিল, "এই নাও। ফার্স্ট প্রাইজ।"
মা এসে প্রাইজ তুলে দিল আমার হাতে।
বলেছিল, "এই নাও। ফার্স্ট প্রাইজ।"
সেই বিকেল, সেই গোধূলি, সেই ফার্স্ট প্রাইজ আর সেই প্রথম চিনে যাওয়া, মনে রাখা, ইচ্ছের চারাগাছে জল দিতে শেখা... ও প্রান্তের ফিতে প্রথম ছুঁতে পারার জৌলুস হাতের মুঠিতে ধরার। ওই নীল গ্লাসটা এখনো আছে আমাদের বাড়িতে। রংটা ম্যাটমেটে এখন। জায়গায় জায়গায় নীল রংটা মুছে মুছে গেছে।
আসলে মুছে যায়নি। ঠাঁই বদল করেছে।
আসলে মুছে যায়নি। ঠাঁই বদল করেছে।
এই সব ফিরে দেখার বর্ণালীর দ্বিতীয় রং হিসেবে।
-------------
No comments:
Post a Comment