নীল প্রজাপতি
পুষ্পেন মণ্ডল
জ্যোৎস্নার রূপালী আলোয় ঝিকমিক করছে বিশাল বড় লেক। তার ওপারে পাহাড়। আরও দূরে অন্ধকারের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপ। জলের পাশে ভিড় করে আছে কত হাজার রকমের পাখী। আকাশে বড় গোল পূর্ণিমার চাঁদ। হঠাৎ শিস দেওয়ার মত সুরেলা আওয়াজ শুরু হল। আর জলের মধ্যে থেকে একটা নীলাভ আলোর স্তম্ভ সাপের মত এঁকেবেঁকে উপরে উঠতে লাগল। ধীরে ধীরে চলে গেল মেঘের উপরে। আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে। মিমো অবাক হয়ে গেল। আলো কি কখনও এঁকে বেঁকে উঠতে পারে? সেই নীল আলোর জৌলুসে আর সুরেলা শব্দের মোহে লক্ষ লক্ষ পাখীরা ডানা মেলে আকাশে উড়তে লাগল। তারা যেন আনন্দে মোহিত হয়ে নাচছে।
তারপরেই ঘুমটা ভেঙে যায়। প্রতিবারই এরকম হয়। স্বপ্ন যে এতটা প্রখর হতে পারে মিমো সেটা জানত না। কী করে জানবে? এরকম স্পষ্ট রঙিন স্বপ্ন এর আগে সে কোনও দিন দেখেনি। একদিন মাকে জানাল। মা প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও যখন শুনল স্বপ্নটা বারংবার ফিরে আসছে, তখন বাবাকে বলল। বাবা মন দিয়ে স্বপ্নটা শুনে বলল, “এর মধ্যে ভয়ের তো কিছু নেই। এটা তো ভালো স্বপ্ন। তা মিমো নিশ্চয়ই এরকম কোনও গল্প পড়েছে।”
“না আমি এরকম কোনও গল্প পড়িনি। কোনও সিনেমাও দেখিনি,” সে মাথা নেড়ে বলল।
তার সপ্তাহ দুয়েক পরে বাবা অফিস থেকে ফিরে এক গোছা কাগজ টেবিলে রেখে বললেন, “মনে হচ্ছে, মিমোর স্বপ্নের রহস্য কিছুটা সমাধান করেছি। আমার এক বন্ধু সঞ্জীবন শিকাগোতে আছে। ও সাইকোলজির প্রফেসার। তাকে আমি ইমেইলে জানিয়ে ছিলাম। সে উত্তর পাঠিয়েছে। প্রায় দু বছর আগে সাইকোলজিক্যাল জার্নালে একটা চিঠি বেরিয়েছিল। একজন জার্মান বিজ্ঞানী বেশ কিছু দিন থেকে প্রায় ঐ একই রকম স্বপ্ন দেখছিলেন। অনেক খোঁজ খবর করে উড়িষ্যার চিল্কাতে এসে দেখেন যে ছবিটা তাঁর স্বপ্নের সাথে পুরো মিলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই সেই সুরেলা শব্দ আর আলোর রহস্য উদ্ধার করতে পারেননি। তবে চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই বিজ্ঞানীর নাম, ঠিকানা, ফোন নং সব পাঠিয়েছে। আর ও নিজেও তাকে মিমোর কথাটা জানিয়ে দিয়েছে। শীতকালে পরিযায়ী পাখীরা সুদূর রাশিয়া আর সাইবেরিয়া থেকে চিল্কায় উড়ে আসে বাচ্চা পাড়ার জন্য। ডিম হবে, বাচ্চা বড় করবে, সেই বাচ্চাদের নিয়ে আবার তিনমাস পরে ফিরে যাবে। এই পাখীদের ছবি তোলার জন্যও অনেক লোক জড়ো হয়। আমারাও ভাবছি এবার শীতের ছুটিতে ওখানেই ঘুরে আসব।”
এর মধ্যে স্বপ্নটা মাঝে মাঝেই ঘুরে ফিরে এসেছে। মিমো চিল্কার উপরে বেশ কয়েকটা বই পড়ে ফেলল। বাবাই এনে দিয়েছে। পুরী আর গোপালপুরের মাঝখানে দয়া নদীর মুখে সমুদ্র লাগোয়া ১১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে প্রাকৃতিক হ্রদ। বাচ্চা হবার সময়ে হিমালয়, লাদাখ, মধ্য আর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাস্পিয়ান সাগর, আরব সাগর, বৈকাল হ্রদ থেকে প্রায় ১৬০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখী কম বেশি ১২ হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এখানে প্রতি বছর আসে। পাখী ছাড়াও এখানে ডলফিন, সামুদ্রিক সবুজ কচ্ছপ ও অন্যান্য অনেক রকম জীবজন্তু রয়েছে। এই বিশাল হ্রদে অনেকগুলি দ্বীপ আছে। তাদের নামগুলিও ভারি অদ্ভুত। বেকন আইল্যান্ড, হানিমুন আইল্যান্ড, বার্ডস আইল্যান্ড, ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড, সোমোলো, পারিকুদ, ইন্দ্রপ্রস্থ, কালিজাই, সতপদা, বরুণকুদা প্রভৃতি।
সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই এক শীতের সকালে মিমোরা ট্রেন থেকে নেমে বেহেরামপুরে দুপুরের খাওয়া সেরে গাড়ি করে রওনা হল রম্ভা চিল্কার উদ্দেশ্যে। ও.টি.ডি.সি.র পান্থনিবাসে যখন ওরা পৌঁছল, তখন পড়ন্ত রোদ। রুমে লাগেজ রেখে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে দারুণ ভালো লাগল মিমোর। মাকে বলল, “আমি নিচে থেকে ঘুরে আসছি।” তারপর দৌড়ে একেবারে লেকের ধারে। সত্যিই প্রচুর পরিযায়ী পাখী আর অনেক ফটোগ্রাফার জড়ো হয়েছে। এক দু’ফুট লম্বা লেন্স লাগানো ভারী ভারী ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা ক্যামেরা দেখলে মনে হয় রকেট লঞ্চার। বিদেশীও অনেক রয়েছে। এরা কি সবাই পাখীর ছবি তুলতে এসেছে?
“হ্যালো, গুড আফটারনুন,” বয়স্ক মাঝারি হাইটের ছিপছিপে ফর্সা লোক হাত বাড়িয়েছেন হ্যান্ডসেক করার জন্য। চুল, দাড়ি, গোঁফ সব সাদা। মাথায় গোল টুপি, কাঁধে ব্যাগ আর সেই রকম লম্বা লেন্স লাগানো একটা ক্যামেরা। মিমোও হাত বাড়িয়ে দিল।
“হ্যালো।”
“ইউ আর মিমো, রাইট? আর ইউ এলোন?”
“না, বাবা-মা হোটেলের রুমে আছেন। আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?”
“তোমার ছবি আমি দেখেছি। ইমেইলে তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে। আমিই বলেছিলাম এই সময়ে এখানে আসতে।”
“আপনি ফটোগ্রাফার?” মিমো ক্যামেরাটা দেখে প্রশ্ন করল।
তিনি হেসে উত্তর দিলেন, “আমি এন্টোমলজিস্ট। আমার নাম রিচার্ড মুর। জার্মানির ডুসেলডর্ফে থাকি। এন্টোমলজিস্ট মানে জানো তো? মানে যারা কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করে।”
আরও কিছুক্ষণ আলাপ পরিচয় হওয়ার পর রিচার্ডকে বেশ ভালো লেগে গেল মিমোর। তিনি বললেন, “সারা পৃথিবী থেকে অনেক পক্ষীবিজ্ঞানী আর ফটোগ্রাফার এখানে এসেছেন। সবাই অবশ্য পাখী নিয়েই ব্যস্ত। পাখী, কীট-পতঙ্গের ছবি তোলার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছি। এখানে প্রথম এসেছিলাম পাঁচ বছর আগে। যদিও স্বপ্নটা আমি দেখছিলাম তারও কিছুদিন আগে থেকে। কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম এটাই সেই স্বপ্নে দেখা জায়গা। তারপর একটা বিশেষ ঘটনা আমার মনকে খুব নাড়া দেয়। তুমি কি জানো, প্রাগৈতিহাসিক সময়ে, নিওলিথিক থেকে লৌহ যুগের কিছু মানুষ এই চিল্কা হ্রদের গুহার ভিতরে বাস করত? তাদের আঁকা গুহাচিত্রও পাওয়া গেছে।”
মিমো এসব তার ইতিহাস বইতে কিছু কিছু পড়েছে। বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলল, “তাই নাকি! না, আমি তো জানি না।”
হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ওরা একটা বেঞ্চে বসল। লেকের ধারটা সুন্দর করে সাজানো। বাহারি গাছ, আলো আর পর পর বসার ডিজাইন করা বেঞ্চ। সন্ধ্যা হতেই ঠাণ্ডাটা পড়ছে আস্তে আস্তে। গাটা শিরশির করছে। রিচার্ড আবার শুরু করলেন, “আদিম মানুষরা তো ভাষা জানত না। তারা ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করত। চিল্কার মধ্যে কালিজাই নামে যে দ্বীপটি রয়েছে তার মধ্যে একটি গুহায় অনেক কষ্টে আমি ঢুকেছিলাম। মুখটা এতই সরু যে বেশ অনেকটা প্রায় শুয়ে শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। অত কষ্ট করে ঢুকে আমার খুব লাভ হল। গুহার ভিতরটা একটা বড় ঘরের মত। তার দেয়ালে আর ছাদে অসংখ্য গুহাচিত্র। এবং সেগুলি দেখে আমার মনে হয়েছিল যে শুধু গাছপালা, পশু, পাখী ছাড়াও হয়ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। তার মধ্যে সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্রের ছবি রয়েছে। সারা দিন লেগে গেল সব কটার ছবি তুলতে।”
“হ্যালো মিঃ রিচার্ড!” মিমোর বাবার গলা, “মিমোর দেরি দেখে আমি ভেবেছিলাম যে আপনার সাথে নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে।”
“গুড ইভনিং মিঃ বাগচি। আপনার বাচ্চা খুবই ইনটেলিজেন্ট। ওকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছি। আসুন আপনিও যোগ দিন আমাদের সাথে।” বাবা পাশে এসে বসতে রিচার্ড আবার শুরু করলেন, “তুমি আর আমি একই স্বপ্ন কেন দেখলাম? আমি নিজে এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। এর সম্ভাব্য কারণ একটাই হতে পারে। আমার ধারণা আমাদের দুজনের মস্তিষ্কের ফ্রিকোয়েন্সি একদম এক। যেমন প্রতিটা মোবাইলের নম্বর আলাদা, তাদের ফ্রিকোয়েন্সিও আলাদা। ধর একই নম্বরের দুটো ক্লোন চিপ আলাদা আলাদা মোবাইলে চালু করলে যদি কোনও মেসেজ বা কল আসে তাহলে দুটো মোবাইল থেকেই সেটা রিসিভ করা যাবে। আমার মনে হয় মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও হয়ত এরকম কোনও লেভেল আছে, যেটা বাই চান্স তোমার আর আমার মিলে গেছে। হয়ত এই স্বপ্নটা কোনও মেসেজ। কিন্তু কীসের মেসেজ? কে পাঠাচ্ছে এই মেসেজ?”
“আপনি গুহাচিত্র নিয়ে কিছু বলছিলেন। এর সাথে কোনও সম্পর্ক আছে কি?” রিচার্ড থামতে বাবা প্রশ্ন করলেন।
“আমি মনে করি সম্পর্ক অবশ্যই আছে। অনেক অনুসন্ধান করার পরে আমার একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। যে ছবিগুলি আমি তুলেছিলাম, সেগুলিকে নিয়ে আমি আর্কিওলজিস্টদের সাথে কথা বলেছি। সেগুলিকে বিশ্লেষণ করে সবাই অবাক হয়ে গেছেন। বেশ কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানের অবাক করা তথ্য পাওয়া গেছে। অত লক্ষ বছর আগে গুহাবাসী আদিম মানুষদের পক্ষে মহাকাশের তথ্য এত নির্ভুল ভাবে কি দেওয়া সম্ভব? সঠিক সময় জানার জন্য কার্বন টেস্ট করার চিন্তা মাথায় এসেছিল। কিন্তু প্রকৃতির এমনই খেয়াল যে তার দু’বছর পরে আমি যখন আবার এলাম এখানে, ঐ গুহাটা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।”
“কী করে?” মিমো প্রশ্ন করল।
“ভূমিকম্প বা সুনামির ধাক্কায় সেই গুহা সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে। আমার কাছে থেকে গেছে শুধু ছবি গুলি,” জানালেন মিঃ রিচার্ড।
“হ্যালো, গুড ইভনিং রিচার্ড।”
আওয়াজটা পিছন দিক থেকে আসতেই রিচার্ড উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে বললেন, “ওয়েলকাম মিঃ হুডসন। ওয়েলকাম টু চিল্কা।” মিমো দেখল লম্বা চওড়া একজন কোট প্যান্ট পরা ইউরোপিয়ান লোক, বয়েস আনুমানিক রিচার্ডেরই কাছাকাছি হবে।
“পরিচয় করিয়ে দিই, ডঃ হুডসন ইউ.কে.র আর্কিওলজিকাল সার্ভের প্রাক্তন ডিরেক্টর। আমার অনেক দিনের বন্ধু। উনি এই গুহাচিত্রগুলিকে পাঠোদ্ধার করতে সাহায্য করেছেন।”
ভুরুটা উপরে তুলে তিনি বললেন, “তোমার প্রস্তুতি সব হয়ে গেছে? বাকিরা সবাই পৌঁছে গেছে?”
“আমি আর মিস সিরিন কালকে রাতেই পৌঁছে গেছি। ঐ তো সিরিন এদিকেই আসছে।”
জিনস আর জ্যাকেট পরা বছর চল্লিশের স্বল্প উচ্চতার এক জাপানী মহিলা এগিয়ে এসে সবাইকে সম্বোধন করে বিনয়ী গলায় বললেন, “গুড ইভনিং জেন্টলম্যান। এই কি সেই সুইট বয় মিমো? যার কথা বলেছিলেন। নাইস টু মিট ইউ।” মিমো হ্যান্ড সেক করল।
মিঃ রিচার্ড পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ও হচ্ছে নাসার সিনিয়র প্রোজেক্ট ম্যানেজার। সিরিন, মাস্টার মিমো খুবই বুদ্ধিমান। ওকে তুমি ধূমকেতুর ব্যাপারটা বুঝিয়ে বল।”
“নিশ্চয়ই, মিমো আজকে হল পূর্ণিমা। আকাশে গোল চাঁদ উঠেছে। কিন্তু আজকের বিশেষ দিনে চাঁদ আর পৃথিবীর দূরত্ব সব থেকে কম থাকবে, প্রায় ৩,৬৩,১০৪ কিলোমিটার। আর চাঁদের সাথে একই সরলরেখায় একটা ধূমকেতু এসে হাজির হয়েছে। এখন সেটা রয়েছে ঠিক চাঁদের পিছনে। এই ধূমকেতুটা একদম নতুন। এর গতিপথ সম্পর্কে আমরা এখনও কিছুই জানি না। হ্যালির ধূমকেতুর নাম কি তুমি শুনেছ?”
“হ্যাঁ বইয়ে পড়েছি। সব থেকে বড় লেজওলা ধূমকেতু।”
“বাঃ ওটা প্রায় ৭৫ থেকে ৭৬ বছর ছাড়া আমাদের পৃথিবীর কাছে আসে। আজ পর্যন্ত যত ধূমকেতু আবিষ্কার হয়েছে তাদের মধ্যে ‘সি./২০০৬পি.১’ নামের ধূমকেতুটি প্রায় ৯২ হাজার ৬০০ বছর ছাড়া পৃথিবীর কাছে আসে। এখন এই নতুন ধূমকেতুটির ব্যাপারে নাসার বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। এটা কী দিয়ে তৈরি? তার ঘনত্ব কত? এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর পেতে এখনও বাকি। শুধু জানা গেছে উপরিভাগে কঠিন ধাতু মিশ্রিত পাথর জমাট বেঁধে আছে। তবে স্পেস স্টেশন থেকে যে ছবিগুলি পাঠিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে এর কোনও লেজ নেই। বাদামের মত দেখতে ধূমকেতুটির উপরের পৃষ্ঠ কঠিন আবরণে মোড়া আর কয়েকটি বড় বড় গর্ত রয়েছে।”
ডঃ হুডসন বললেন, “পৃথিবী, চাঁদ আর এই ধূমকেতু যে একটা সরলরেখা তৈরি করবে, এই কথাটা ঐ গুহাচিত্রে লেখা ছিল। যদিও তখনকার মানুষ মনে করত যে পৃথিবীই মহাকাশের কেন্দ্র। অবশ্য এই সরলরেখা অন্য ধূমকেতুর সাথেও তৈরি হতে পারে। কিন্তু তখন চাঁদের দূরত্ব সব থেকে কম থাকবে, এই ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম।”
মিমো জিজ্ঞাসা করল, “সেই আলোর স্তম্ভ আর শব্দটার কথা নেই?”
“সব গুহাচিত্রের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য ধোঁয়াশা থেকে গেছে। আশা আছে আজ কালের মধ্যে এ রহস্যের সমাধান হবে। আর এই স্বপ্নটা কেন তোমাদেরকে তাড়া করছে সেটারও একটা কারণ হয়ত বের হবে। রিচার্ড, এবার তোমার প্ল্যানটা বল।”
“আমরা দুটো মোটর বোটে করে যাব ইন্দ্রপ্রস্থ আইল্যান্ডে। ওখানে তাঁবু খাঁটিয়ে অস্থায়ী সেলটার তৈরি হয়েছে। আমরা দুটো রাত ওখানেই কাটাব। চিল্কা ডেভেলপমেন্ট অথরিটির অনুমতি নেওয়া আছে। আশা করা যায় যদি কিছু ঘটে সেটা রাতেই ঘটবে।”
মিঃ বাগচি প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, ঐ দ্বীপে গিয়ে রাত কাটালে কি বিশেষ কিছু সুবিধা হবে?”
“প্রথমত, ফটোগ্রাফারদের জন্য এখানে ভিড় একটু বেশি। আর দ্বিতীয়ত, হ্রদের মাঝামাঝি ঐ নির্জন দ্বীপটিতে থাকলে, যদি কিছু ঘটে সেটা কাছ থেকে বোঝার সুবিধা হবে।”
“বেশ তাহলে কখন যাত্রা শুরু হচ্ছে?”
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।”
মিমো ইন্দ্রপ্রস্থ বা নলবন নামে দ্বীপটিতে নেমেই বুঝল, সব ব্যবস্থা আগে থেকে নিখুঁত ভাবে আয়োজন করা। রম্ভা পান্থনিবাসের জেটি থেকে স্পিড বোটে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। জলপথে দেড় ঘণ্টা লাগল এখানে পৌঁছাতে। ঠাণ্ডাটা এখানে আরও বেশি। মা কানে, গলায় ভালো করে মাফলার জড়িয়ে দিল। নৌকা থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে গেলেই একটা ফাঁকা জায়গায় বড় বড় অনেকগুলি আধুনিক তাঁবু খাটানো হয়েছে। ভিতরে শোয়ার খাট, বসার চেয়ার টেবিল, প্রত্যেকের সাথে অ্যাটাচ বাথরুম। আলাদা কুকিং আর ডাইনিং রুম। এখানে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই সাউন্ড প্রুফ জেনারেটরের সাহায্যে আলো জ্বলছে। আলোর ব্যবস্থা এমন ভাবে করা হয়েছে যাতে তাঁবুর বাইরে কোনও ভাবেই আলো না যায়। এখন শুধু অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রতীক্ষা। খোলা জায়গায় বড় ছাতা দেওয়া আরামদায়ক চেয়ারে বসার আয়োজন হয়েছে।
বসতে না বসতেই চা আর স্ন্যাক্স এল। একটা লিকার টি-এর কাপ তুলে নিয়ে মিঃ হুডসন বললেন, “ঐ গুহাচিত্রের মধ্যে আমার সব থেকে আশ্চর্য লেগেছে তিনটে প্রজাপতির ছবি। অন্য ছবিগুলির মধ্যে ওটা একটু বেমানান।”
“তোমার মনে হচ্ছে ওটা বেমানান, কিন্তু আমার কাছে ওটা বেশ অর্থবহ।” মিঃ রিচার্ড বললেন।
“তাই নাকি! কী রকম?”
রিচার্ড বললেন, “প্রজাপতির জীবন চক্রটা জানা আছে তো? প্রজাপতি প্রথমে ডিম পাড়ে। তারপর ডিম ফুটে বের হয় শুঁয়োপোকা। শুঁয়োপোকা কিছুদিন পরে নিজের লালা দিয়ে একটা খোলস তৈরি করে তার মধ্যে ঢুকে পড়ে। কিছুদিন পর খোলস কেটে বেরিয়ে আসে সুন্দর প্রজাপতি। ভাব একবার, খোলসের মধ্যে ঢুকল বিচ্ছিরি একটা শুঁয়োপোকা আর বের হল সুন্দর একটা প্রজাপতি। প্রকৃতির কী অদ্ভুত নিয়ম, তাই না? একই জীবনে সে দু বার দুটি আকৃতিতে বাঁচে।” চায়ে একটা চুমুক দিয়ে আবার বললেন, “আমার মতে ঐ স্বপ্নটা একটা মেসেজ, যেটা কেউ পাঠাচ্ছে। এবং এর পিছনে নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। আমার সাথে আর একজন রাশিয়ান ডাক্তার যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি নাকি আমারও আগে থেকে স্বপ্নটা দেখছেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য আজকে তিনি আসতে পারেননি। আমি প্রথমের দিকে অতটা খেয়াল করিনি। কিন্তু গুহাচিত্রে ঐ তিনটি প্রজাপতির ছবি দেখার পরে আবার যখন স্বপ্নটা দেখলাম, তখন আমার মনে হয়েছে ঐ আলোর যে স্তম্ভটি এঁকে বেঁকে আকাশে উঠে যায়, সেটি জীবন্ত প্রাণী।”
“হোয়াট! কী বলছ তুমি? একি কোনও প্রাগৈতিহাসিক চিনা ড্রাগনের মত ব্যাপার! যার সারা গায়ে আলো জ্বলে?” সিরিন এগিয়ে এসে বড়ো বড়ো চোখ করে অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল।
“সে বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমার মনে হয়েছে ওটা হয়তো কোনও জীবন্ত প্রাণীর শুঁড়ের মত। আর সেই আওয়াজটা ঐ প্রাণীরই।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডঃ হুডসন বললেন, “আচ্ছা রিচার্ড, শুনলাম তুমি নাকি ডিনামাইট নিয়ে এসেছ? সেটা কোনও কাজে লাগবে?”
“কাজে যে লাগবেই তার কোনও গ্যারান্টি নেই। তবে আমার থিওরি যদি পুরোপুরি মিলে যায় তাহলে হয়ত কাজে লাগতেও পারে। এখনও কোনও ঠিক নেই।”
মিমো যত এসব শুনছে তত উত্তেজনায় চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। গল্প করতে করতে রাত বাড়ছে। যথা সময়ে রাতের খাবার এল। খাওয়ার পর আবার শুরু হল বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ। মিমোর এই আলোচনা আর ভালো লাগছে না। কখন যে কিছু একটা ঘটবে? তবে কিছু না ঘটলেও ক্ষতি নেই, রবিনসন ক্রুসোর মত ফাঁকা দ্বীপের মাঝে তাঁবুতে রাত কাটানোর গল্প বলে বন্ধুদের চমকে দেবে। উত্তেজনায় আজকে ঘুমও আসছে না। তাঁবুর বাইরে বের হলেই ঠাণ্ডাটা একে বারে হাড়ে গিয়ে ঢুকছে। সবাই যখন আলোচনায় ব্যস্ত, মিমো বাইরে এসে দাঁড়াল। চারপাশটা জ্যোৎস্নার আলোয় দারুণ লাগছে। রাত কত হল, খেয়াল নেই। মিঃ রিচার্ড বলেছেন, আজকে সারা রাত জেগে কাটাতে হবে। পরিষ্কার আকাশ। তার মধ্যে মস্ত বড় গোল চাঁদ। অত বড় চাঁদের পাশে নক্ষত্ররা যেন মিইয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে লেকের ধারে চলে এল। নিস্তব্ধতারও নিজস্ব একটা ভাষা থাকে। যদিও পুরোপুরি নিস্তব্ধ এটা বলা যায় না। যত ছোট বড় গাছ আছে সবার ডালপালাতেই ভিড় করে আছে পরিযায়ী পাখীরা। মাঝে মাঝেই তাদের ডানার ঝটপটানি বা হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠা নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে। লেকের ধারে একটা আঁশটে পচা গন্ধ। পাখীদের প্রধান খাদ্য এই লেকের সহজ লভ্য মাছ। সদ্য ডিম ফোটা বাচ্চারাও এই মাছ খায়। সেই সব মাছের ভুক্তাবশেষ পড়ে আছে গাছের নিচে। আবার অনেক মেছো বিড়াল আছে এখানে অনেক। তারা রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে সেই সব পড়ে থাকা মাছ খেয়ে যায়। তাদের চোখগুলি মাঝে মাঝে দূর থেকে জ্বলজ্বল করছে। অনেক দূরে জলের মাঝখানে টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে। ওটা নিশ্চয়ই কালিজাই মন্দিরের আলো। নৌকা করে আসার সময়ে মিঃ রিচার্ড চিনিয়ে দিয়েছিলেন। ছোট্ট দ্বীপটির তীরে একটি মন্দির আছে। ঐখানেই পাথরের খাঁজের মধ্যে একটি গুহার ভেতরে ছিল গুহাচিত্রগুলি। মিমো স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করল। এই রকমই পরিবেশ। রিচার্ড বার বার বলছিলেন, এটা একটা মেসেজ। মানে বার্তা। স্বপ্নের মাধ্যমে কি বার্তা পাঠানো যায়?
হঠাৎ সামনের জলটা যেন একটু কেঁপে উঠল। চোখের ভুল নয়ত! হ্যাঁ আবার কাঁপছে। ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি! পায়ের নিচে মাটিও কাঁপছে। মিমো ভয়ে তাঁবুর দিকে দৌড়াতে শুরু করল। কাঁপুনিটা বাড়ছে। সবাই বেরিয়ে এসেছে তাঁবুর মধ্যে থেকে। রিচার্ড সবাইকে চেঁচিয়ে বোটে উঠতে বললেন। জেটির দিকে দৌড়। পাখীরাও ভয় পেয়ে খুব চেঁচামেচি করছে। দ্বীপটা প্রচণ্ড রকম দুলছে। বাবা মায়ের সাথে মিমোও উঠে পড়ল একটা নৌকায়। পাখীদের চেঁচামেচির মধ্যেই আওয়াজটা শুরু হল। তীক্ষ্ণ শিসের মত শব্দ। কিন্তু এটা মোটেই সুরেলা নয়। এ যেন কারো আর্ত চিৎকার। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় যেন কেউ কাঁদছে। স্পিড বোট গুলি দ্রুত লেকের মাঝখানে চলে এল। শান্ত নিথর জলে বড়ো বড়ো ঢেউ। চিৎকারটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। পাখীরা মনে হয় ভয় পেয়েছে খুব। নীল জ্যোৎস্নার মধ্যে আকাশে ভরে গেছে পাখীরা। হুডসন সব কটা বোটকে রম্ভা পান্থনিবাসের দিকে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। মিমো কানে হাত চাপা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে চুপ করে। মাথার মধ্যে যেন চিনচিন করছে।
অনেকক্ষণ ধরে শোনা গেল এই বিকট আওয়াজ। ঐ জায়গা থেকে যত দূরে সরে যেতে লাগল আওয়াজটা তত কমতে থাকল। ঘণ্টা দেড়েক পরে পান্থনিবাসের জেটিতে যখন পৌঁছল তখন আওয়াজটা থেমে গেছে। ঘড়িতে পৌনে দুটো বাজে। বিধ্বস্ত অবস্থায় হোটেলের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা।
ঘুমের মধ্যে আবার সেই স্বপ্ন। আরও স্পষ্ট, আরও জীবন্ত। ঘুমটা যখন ভাঙল সূর্য আকাশের উপরে। মাথাটা যেন ভোম হয়ে আছে। একে তো রাত জাগা তার উপর আবার সেই যন্ত্রণাদায়ক চিৎকার। মিমোর শরীরের মধ্যে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। জ্বর জ্বর ভাব। গরম জলে স্নান সেরে রুমেই খাবার আনিয়ে খেল। মা একটা মাথা ধরার ওষুধ দিল। সেটা খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল।
বিকালে উঠে বসতেই বাবা জানাল, “মিঃ রিচার্ডকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
“কেন? কালকে তো আমাদের সাথেই ফিরলেন।”
“না, আমাদের সাথে আসেননি। হুড়োহুড়ির সময়ে সবাইকে নৌকায় তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে ওঠেননি। আমি লক্ষ করেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল হয়ত অন্য নৌকাতে ফিরবেন। আজকে সকালে যখন ওনার খোঁজ পড়ে তখন জানা যায় উনি কালকে রাতে পান্থনিবাসে আসেননি।”
“এখন কী হবে?”
“পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে। সার্চ টিম গেছে। আর একটা খারাপ খবর হচ্ছে, কয়েক লক্ষ পাখী কালকে মারা গেছে। কয়েক জন ফটোগ্রাফার ভোর বেলা গিয়েছিল ছবি তুলতে। সাংঘাতিক দৃশ্য দেখে তারা চমকে উঠেছে। এখান থেকেও নাকি কালকে মাঝ রাতে সেই আওয়াজ শোনা গিয়েছিল। কিন্তু তার পরিণতি এরকম হবে কেউ ভাবেনি। চিল্কার মাঝামাঝি যত দ্বীপে পাখীরা বাসা বেঁধেছিল সবই প্রায় মারা গেছে।”
মা বলল, “আমার এখানে থাকতে একদম ভালো লাগছে না। চলো এখনই লাগেজ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গোপালপুরে দুদিন থেকে তারপর বাড়ি ফিরব। মিমোর শরীরটাও ভালো নেই। এই জায়গায় আমাদের আসাই উচিৎ হয়নি।”
“যাই বললেই ওরকম যাওয়া যায় না। মিঃ রিচার্ডের খোঁজ যতক্ষণ না পাওয়া যায়, ততক্ষণ এখানে থাকতেই হবে। ভুলে যেওনা আমরা তাঁর গেস্ট। তাছাড়া তাঁর কী হল, কোথায় গেলেন না জেনেই আমরা চলে যাব?”
মিমো হঠাৎ বলল, “বাবা আমি জানি তিনি কোথায়?”
“তুই কী করে জানলি?”
“আমার মনে হচ্ছে আজকে ভোরে স্বপ্নের মধ্যে আবছা দেখেছি। কালিজাই দ্বীপে তিনি আছেন। চলো আমরা সেখানে যাই।”
“কালিজাই দ্বীপে তিনি কী করছেন?”
“জানি না, তবে ওখানে গেলে জানা যাবে নিশ্চয়।”
মা একটু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। যখন বুঝল তার কথায় কেউ কান দিচ্ছে না, তখন নিজেও তৈরি হয়ে বলল, “চলো কোথায় যাবে? তোমাদের যদি কিছু হয়, তবে আমি তো আর এখানে বসে থাকতে পারিনা।”
নিচে জেটির কাছে এসে দেখল সিরিন আর হুডসন ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছেন। ওদের দেখে বললেন, “আমারা তোমাদের কাছেই যেতাম। রিচার্ডকে খোঁজার জন্য একটা রেসকিউ টিম দু’ঘণ্টা হল বেরিয়েছে। আমারাও ভাবছি যাব। তোমরা কী করবে?”
বাবা কিছু বলার আগেই মিমো নৌকায় উঠে বলল, “আমি তো যাবই।”
নৌকা ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল যত এগোচ্ছে, দ্বীপগুলির ধারে ধারে প্রচুর মৃত পাখী পড়ে আছে। আরও কত পাখী, মাছ, ডলফিন মরে জলে ভাসছে। বীভৎস দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। কালকে রাতের সেই প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ আওয়াজে এই প্রাণীগুলি মারা গেছে। যারা দূরে ছিল তারা পালিয়ে বেঁচেছে। কালকে পর্যন্ত দ্বীপ গুলির ধারে গাছের উপরে যত পাখী ছিল, কেউই আর প্রায় নেই। হয়ত দু’একটা পাখী দিনের আলোয় ফিরে এসেছে প্রিয়জনদের খুঁজতে। কিন্তু সেই শব্দটা কেন হল? কোথা থেকে হল? স্বপ্নের মধ্যে তো মিমো এ দৃশ্য দেখেনি। সেখানের ছবিটা কত সুন্দর ছিল। সুরেলা শব্দ, হেলে দুলে ওঠা আলোর স্তম্ভ, আনন্দে বিহ্বল পাখীরা নাচতে নাচতে উড়ছে। কালকে নিজের চোখে দেখা দৃশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।
সাড়ে পাঁচটার সময়ে ওরা কালিজাই দ্বীপে পৌঁছল। দ্বীপটা লম্বাটে ধরনের। এক কোণে কালী ঠাকুরের মন্দির। কালকে রাতের প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে মন্দিরের এক দিকটা ভেঙে গেছে। মন্দিরের পিছনে কোনও রাস্তা নেই। শুধু এবড়ো খেবড়ো বড় বড় পাথরের চাঁই আর জঙ্গল। ওরা পাথরের খাঁজে পা রেখে গাছেদের ডালপালা খামচে ধরে মাঝখানের দিকে এগোল। বেশ কিছু দূর যাবার পর সিরিন চেঁচিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, “জুতো!!”
একটা পাথরের খাঁজে আটকে ছিল জুতোটা। “এটা তো রিচার্ডের জুতো।” বললেন হুডসন।
তার কিছুটা পাশেই ঝোপের আড়ালে আর একটা জুতো দেখতে পেল মিমো। সিরিন ঝোপটাকে সরাতে একটা সরু গুহার মুখ বেরিয়ে পড়ল। একদম রোগা পাতলা না হলে গুহার মুখ দিয়ে ঢোকাই যাবে না। গুহার ভেতরে মুখটা ঢুকিয়ে ‘রিচার্ড ... রিচার্ড...’ অনেক বার ডাকা হল। কোনও উত্তর নেই।
হুডসন বললেন, “ভেতরে ঢোকা বিপদজনক হতে পারে। রেসকিউ টিমকে খবর দেওয়াই ভালো।”
ফোন করতে তারা আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে এল। একজন পুলিশের লোক জানাল, আশেপাশের সব কটা দ্বীপ তন্নতন্ন করে খুঁজলেও এই দ্বীপটা ছোট বলে অতটা গুরুত্ব দেয়নি। তবে এই সরু গুহায় নামা খুবই মুস্কিল। সিরিন বলল, “একটা বড় দড়ি পেলে সে নিজেই নেমে দেখবে।”
দড়ি জোগাড় হয়ে গেল। সিরিনের চেহারাটাও ছোটোখাটো। একটা টর্চ আর ওয়াকিটকি নিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে, সহজেই নেমে গেল গুহার মধ্যে। আর একজন স্থানীয় লোকও গেল সিরিনের সাথে। মিমোরও খুব ইচ্ছা করছিল। সেও ঢুকে যেতে পারত ঐ সরু জায়গার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু মায়ের প্রচণ্ড আপত্তিতে সেটা হল না। কিছুক্ষণ পরে ওয়াকিটকিতে বলল, “নিচে রিচার্ড আহত হয়ে পড়ে আছেন। নিঃশ্বাস চলছে।” আরও কিছুটা পর, “রিচার্ডের জ্ঞান ফিরছে। তাঁকে উপরে তোলা হচ্ছে।” বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে। কিন্তু প্রতিদিনের মত পাখীদের কিচিরমিচিরের আওয়াজ নেই। শান্ত, নিস্তব্ধ।
কিছুক্ষণ পরে টর্চের আলোয় দেখা গেল রিচার্ডকে। গুহার মুখ থেকে খুব কষ্ট করে বের হলেন। মাথায় চোট, নাকের কোল দিয়ে রক্তের রেখা। ফাস্ট এড করে জল দেওয়া হল। তারপর তিনি হাসি মুখে বললেন, “রহস্যের সমাধান করে ফেলেছি। হুডসন, তুমি কালকে জিজ্ঞাসা করেছিলে ডিনামাইট কী কাজে লাগবে? ডিনামাইট লাগাতে গিয়েই আমার এই অবস্থা হয়েছে। এখন তাড়াতাড়ি এই দ্বীপটা ছেড়ে দূরে সরে যেতে হবে। এখানে একটা ব্লাস্ট হবে।”
“এখানে! কেন?”
“ওরা বেরোতে পারছে না। আটকে গেছে ভেতরে। পাথরের তলায় চাপা পড়ে গেছে। ওরা না বেরুতে পারলে এখানে কোনও দিন আর পাখীরা আসবে না।”
“কারা ওরা?”
“বলছি, আগে এখান থেকে চলো সবাই।”
বোট গুলিকে দ্বীপটা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া হল। ততক্ষণে চারিদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। রিচার্ড রিমোটে ডিনামাইটের সুইচ টিপে দিলেন। দু-তিন সেকেন্ডের পরে ভীষণ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পুরো দ্বীপটা। একটা আগুনের ঝলকানি বেরিয়ে এলো মাঝখান থেকে। কিছুক্ষণ একদম নিস্তব্ধ, থমথমে। এরপর শুরু হল সেই সুরেলা আওয়াজ। অদ্ভুত মোহময় একটা সুর। যেমনটি মিমো স্বপ্নে দেখেছিল। তারপর সেই বিস্ফোরণের জায়গা থেকে নীলচে আলোর একটা শুঁড় বেরিয়ে এল। সেটা এঁকে বেঁকে উপরে উঠতে লাগল।
মিঃ রিচার্ড বললেন, “এবারে বোট ঐ দিকে নিয়ে চলো। ভয়ের কিছু নেই।”
আস্তে আস্তে যত কাছে আসছে তত সুরেলা আওয়াজটা আরও জোর হচ্ছে। মিনিট পনেরর মধ্যে কালিজাই দ্বীপের কাছে আবার পৌঁছল ওরা। আলোর শুঁড়টা কাছ থেকে দেখে অবাক! সবার মুখ হাঁ হয়ে গেল। সেই গুহার মধ্যে থেকে বের হচ্ছে কোটি কোটি নীলচে আলোর প্রজাপতি। যেমন জোনাকির পিছনে আলো জ্বলে অনেকটা সেই রকম। সারি বদ্ধ ভাবে একটা আরেকটার সাথে জুড়ে শুঁড়ের আকারে উঠে যাচ্ছে আকাশের উপরে।
“কোথায় যাচ্ছে এরা?” প্রশ্ন করল মিমো।
“এরা মাধ্যাকর্ষনের বাধা ছাড়িয়ে চাঁদের ওপারে সেই ধূমকেতুতে যাচ্ছে। ওটা আসলে একটা জীবন্ত ধূমকেতু। বহু বছর ছাড়া ছাড়া পৃথিবীর কাছে আসে প্রাণীদের বংশ বৃদ্ধির জন্য। এই চিল্কা হ্রদের নিচে বিশাল বড়ো একটা চেম্বার আছে। সেখানে প্রজাপতিগুলো তাদের জীবনচক্র পূর্ণ করে। কিন্তু এদের জীবনচক্র শেষ করতে কয়েক হাজার বছর লেগে যায়। সেই গুহার মুখটা ছিল কালিজাই দ্বীপের মাঝখানে। কোনও সময়ে ভূমিকম্পের ফলে মুখটা এমন ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে ওরা বেরুতে পারছিল না। সেই জন্যই বার্তাটা পাঠাচ্ছিল স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে। যাতে আমরা ওদের মুক্তির ব্যবস্থা করি। কালকে রাত পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি। ভয়ানক চিৎকার করে ওরা সারা রাত কাঁদছিল। আর সেই তীক্ষ্ণ আওয়াজে লক্ষ লক্ষ পাখীরা মারা গেল। আমি ডিনামাইট দিয়ে ঐ মুখটা খুলে দিতেই ওরা বেরিয়ে আসছে। দেখ কী সুন্দর! ঠিক আমাদের স্বপ্নের মত।” বলে মিঃ রিচার্ড পাথরের উপর দিয়ে এগিয়ে গেলেন সেই প্রজাপতিগুলির দিকে।
হুডসন জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় যাচ্ছ রিচার্ড?”
“এবার আমাকেও ফিরতে হবে। আমার কাজ শেষ।”
মিমো অবাক হয়ে দেখল, যে মুহূর্তে কাছে গিয়ে একটা নীল প্রজাপতির গায়ে হাত দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রজাপতিগুলি থেকে একটা বিদ্যুতের রেখা এসে রিচার্ডের শরীরকে স্পর্শ করল। তারপর তাঁর শরীরটা ধীরে ধীরে কুঁকড়ে গিয়ে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আর একটি নীল প্রজাপতি। সেও উড়তে উড়তে চলে গেল ওদের সাথে।
------------
ছবি – লেখক
No comments:
Post a Comment