ভ্রমণ:: রাজধানীর পথে পথে (ওয়াশিংটন ডিসি ও ফিলাডেলফিয়া) - প্রদীপ্ত ভক্ত

রাজধানীর পথে পথে (ওয়াশিংটন ডিসি ও ফিলাডেলফিয়া)
প্রদীপ্ত ভক্ত

গরমকালে ইস্ট কোস্ট ঘোরার একটা প্ল্যান করেছিলাম। নিউয়র্ক, ওয়াশিংটনডিসি, ফিলাডেলফিয়া, আর নায়াগ্রা। প্রথমে ভেবেছিলাম নিউয়র্ক-এ অর্ণবদার  বাড়ি গিয়ে ওখান থেকে দুজনে একসাথে গাড়ি নিয়ে যাব। কিন্তু আমি আর অর্ণবদা দুজনেই নতুন ড্রাইভার সেই সময়। তাই বৌদি কিছুতেই রাজি হলনা এতটা রাস্তা গাড়িতে যাওয়ার কথায়। অগত্যা আমরা একটা ট্যুর কোম্পানির সাথে যাওয়া ঠিক করলাম। ফিলাডেলফিয়া, সেখান থেকে ওয়াশিংটন, পরেরদিন ওয়াটকিন  গ্লেন স্টেট পার্ক আর কর্নিং গ্লাস মিউজিয়াম। সেই রাতেই নায়াগ্রা পৌঁছনো এবং সেইদিন আর তারপরের দিন নায়াগ্রা দেখে ফেরা। বেশ ভালই প্ল্যান। 4th জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। আর সেই দিনই আমরা ফিলাডেলফিয়ার মত ঐতিহাসিক জায়গায় যাচ্ছি। এবং ওয়াশিংটনও। ভাগ্গিস, ওই দিন গিয়েছিলাম ফিলাডেলফিয়া। ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে প্যারেড হয় ওই দিন। সে এক দারুন ঝলমলে ব্যাপার। ভাগ্যক্রমে আমরা প্যারেড শুরু হওয়ার সময়েই পৌঁছেছিলাম। বিভিন্ন দল এসেছে তাদের সরঞ্জাম নিয়ে।
প্যারেড-এর শুরুর দল 



পতাকা হাতে ক্ষুদে

ইন্ডিপেনডেন্স হল











এবার গন্তব্য ওয়াশিংটন ডিসি। ওয়াশিংটন ডিসি, খুব পরিচ্ছন্ন শহর মানে আমি যতটুকু জায়গা দেখেছি আর কি। রাজধানী বলেই বোধহয়। পাশ দিয়ে পটোম্যাক নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর ওপারটা ভার্জিনিয়া। এখানকার মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে গিয়ে নিল আর্মস্টং থেকে এঞ্জেলিনা জোলি সব্বার সাথে কেত টেত মেরে প্রচুর ছবি তোলা হল (মানে মূর্তিগুলোর সাথে আর কি, এঞ্জেলিনা জোলির ভারি দায় পড়েছে কিনা আমার সাথে ছবি তুলবে)!
এরপর হোয়াইট হাউস দেখতে যাওয়ার কথা, ক্যাপিটাল বিল্ডিং দেখে কিন্তু আগেই বলেছি সেদিনটা ছিলো 4th  জুলাই। তাই অধিকাংশ রাস্তাঘাট বন্ধ। ট্যুর-এর লোকজন বলল ওদিকে তারা যাবে না। এদিকে আমার দেখার প্রবল ইচ্ছে। তাছাড়া এইভাবে বাসে করে করে শুধু টুরিস্ট স্পট দেখে বেড়ানোয় ঠিক শান্তিও পাচ্ছিলাম না। পায়দল না চললে কি শহর দেখা যায়। তো আমি গুগল ম্যাপ খুলে দেখলাম, জায়গাটা মাইল খানেক দূর, আসাযাওয়া সব মিলিয়ে ৫০ মিনিট মত লাগবে, খুব জোরে হেঁটে গেলে। আমি ভদ্রলোককে বললাম তোমরা মিউজিয়াম দেখো (সেই সময় একটা মিউজিয়াম দেখার কথা ছিলো) আমি ওই সময়টা ঘুরে আসছি। সে তো গম্ভীর চিনা-কোরিয়ান-জাপানি ইংলিশ-এ বলে দিল, যাবে যাও দেরী হলে আমরা কিন্তু স্রেফ নেই হয়ে যাব।  অর্ণবদাকে বলতে অর্ণবদাও বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ল যাইহোক "যা হবে দেখা যাবে" বলে রওনা দিয়েই দিলাম। একটু এগোতেই বৃষ্টি শুরু হলো। কি করব ফিরে যাব? দূর যা হবে হোক। বৃষ্টিতে গলে তো আর যাব না! বলে গলায় ঝোলানো ক্যামেরাটা জামার ভিতর ঢুকিয়ে হনহন করে হাঁটা  দিলাম। 4th জুলাই উপলক্ষে রাস্তায় শো হচ্ছে। উপেক্ষা করা গেল না, মিনিট দাঁড়িয়ে দেখতেই হল এদিকে বৃষ্টির স্পিড বেড়েছে। ফোন বের করে গুগল ম্যাপ দেখার উপায় নেই। 4th জুলাই বলেই চারিদিকে পুলিশের ছড়াছড়ি। পুলিশগুলোর চেহারা দেখলে ডাকাত হতে ভয় করবে! যাই হোক, একটা বিশাল বাইকে একজন বিশাল চেহারার পুলিশ আসছিল। সে একবার দাঁড়াতেই, আমি তাকেই জিগ্গেস করলাম, হোয়াইট হাউস কোনদিকে? আমাকে দেখে সন্ত্রাসবাদী মনে হওয়ার কোন কারণ থাকতেই পারে না, কিন্তু কী জানি তুমুল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হোয়াইট হাউস খুঁজতে চাইলে তাকে বোধয় এদেশে সন্ত্রাসবাদী ভাবে! যাই হোক কথা বলে বুঝল যখন আমি নেহাতই ছাপোষা লোক, আমাকে সুন্দর পথনির্দেশ দিল তো বটেই, উপরন্তু, বলল তোমায় আমি সাথে নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু আমি ওদিকে যাব না! ভাবো! মনে মনে বলছি না না, এতটা এডভেঞ্চার এই ভিজে বাঙালির সইবে না, আমার হেঁটেই ভালো।
যাক গে আবারও হনহন করে হাঁটা দিলাম, খানিক সময় চলে গেছে ইতিমধ্যে। বাস চলে গেলে কেলেঙ্কারির সীমা থাকবে না। কিন্তু বললেই তো হয় না, দিক নির্দেশের পরেও আমি কাছাকাছি গিয়ে একটু ঘেঁটে গেছি। প্রচন্ড বৃষ্টিতে চশমা পরে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, চশমা খুললে দূরের কিছু দেখতে পাচ্ছি না। মহা মুশকিল! পাশ দিয়ে একজন যাচ্ছে দেখে মরিয়া হয়ে তাকেই জিগ্গেস করলাম। যদিও কোনো উত্তর পাবার সম্ভাবনা বড়ই কম। যাই হোক সে আর এককাঠি উপরে যায়। বলল আমি দেখেছি, এদিকেই কোথায় ছিল যেন. আমিও টুরিস্ট। বোঝো! আমি তাড়াতাড়ি বললাম আচ্ছা আচ্ছা আমি খুঁজে নেবখন। বলে আর এক দুজনকে জিগ্গেস করে পৌঁছে দেখি, সেও ওখানে এসেছে। বলছে 'আসলে তুমি বলার পর ভাবলাম, তাই তো একবার দেখে আসি, আমি দেখেছি বললাম না।  খুঁজে পেয়ে গেলে দেখলে তো!' আমি বললাম সে আর বলতে, তুমি ভাগ্গিস দেখেছিলে! যাই হোক সে আমার এক দুখানা ছবি তুলে দিল।


  ঐ সময়টা বৃষ্টি একটু কমেছিল, ফটো তোলা শেষ হতেই দ্বিগুন বেগে শুরু। এদিকে সময় হাতে প্রায় নেই। আমি প্রায় দৌড়তে শুরু করেছি। দৌড়াব বললেই তো দৌড়ানো যায় না। জিন্সটার ওজন ২ কেজি বেড়ে গেছে নির্ঘাত। জুতোর ভিতর জল। বাধ্য হয়ে ফোন বের করে অর্ণবদাকে কল করতেই হল, বললাম মিনিট দশেক দেরি হবে এদিকে ওই বৃষ্টিতে স্মার্ট ফোন ব্যবহারের ফল হল সে আনস্মার্ট ব্যবহার শুরু করে দিল। প্রায় কিছুই শোনা যায় না কথাবার্তা। কিন্তু এত টেনশন নিয়েও ওই তুমুল বৃষ্টিতে হাঁটতে দারু লাগছিল। অল্প অল্প জল জমেছে রাস্তায়। কিন্তু নোংরা জল না। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। বৃষ্টিতে সব ঝাপসা, আমি তেড়ে গান ধরেছি (ভাগ্যিস লোকজন ছিল না রাস্তায়, না হলে রক্তারক্তি হয়ে যেত তাদের গান মানে gun দিয়ে)। শুধু বাস ধরার চিন্তা না থাকলেই আহা পুরো। ওদিক থেকে অর্ণবদারা ফোন করছে, আমি কিছুই শুনতে পারছি না, জুতোটা এত ভারি হয়ে গেছে হাঁটাই দায়। শেষমেষ আমি পৌঁছলাম যখন বাসের কোন চিহ্ন নেই। অর্ণবদা বলল ওরা ক্যাপিটাল বিল্ডিং-এর কাছে। আমি সেখানে গিয়ে খুঁজে পেলাম না। আবার ব্যাক করে ওই মিউজিয়াম। কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা ওরা কোথায়। অবশেষে আমি ওই গাইড ভদ্রলোককে ফোন করে বুঝলাম ওরা মিউজিয়ামের অন্য গেটে আছে, এদিকে, মিউজিয়ামের গেট বন্ধ হওয়ার সময়, আর নতুন লোক ঢুকতে দেবে না। আমি তাদের বললাম যে আমার বাসের বাকি লোকেরা অন্য গেটে আছে তাই ঢুকছি, সৌভাগ্যবশত সে বিশ্বাস করল আমিও বাসে পৌঁছলাম
পরের দিন কর্নিং গ্লাস মিউজিয়ামে গিয়ে বেশ অন্য একটা অভিজ্ঞতা হল। ওখানে কি করে একদম গলিত কাচ থেকে চমত্কার সব কাঁচের জিনিস তৈরি হয় তা দেখা যায়।
ওয়াটকিন গ্লেন পার্কটা খুব সুন্দর। পাহাড়ের উপর থেকে নামতে হবে। পাশ দিয়ে একটা ঝরনা নেমে যাবে সাথে। আসলে পাহাড়ের গা বেয়ে না, পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নামা। ক্যামেরাতে এত সুন্দর ধরতে পারিনি।

------------
ছবি - লেখক

2 comments: