লাভপুর গ্রাম, তারাশঙ্কর ও কিছু স্মৃতি
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
আজ তোমাদের নিয়ে যাব রাঙ্গা মাটির পথে। শহরের ধুলো বালি, মন খারাপের কালো ধোঁয়া থেকে দূরে। বীরভুম জেলার লাভপুর গ্রামে। এখানে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে কত পুরনো দিনের কথা, পুরনো গল্প। আছে দেবী ফুল্লরা-র গল্প। কথাসাহিত্যিক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর স্মৃতি। গ্রামের সহজ সরল মানুষ জনের মুখে ছড়িয়ে থাকা সহজ হাসির আলো।
আগে চলো আমরা দেবী ফুল্লরার মন্দিরটাই দেখে আসি। ৫১টি শক্তিপীঠ-এর কথা তোমরা শুনেছ তো? সেই যে দক্ষযজ্ঞের পর সতীর দেহ কাঁধে শিব যখন রুদ্র রূপে নৃত্য করেছিলেন। বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খন্ড খন্ড করে কেটে ফেললেন। যে যে স্থানে ওই দেহ খন্ড পড়ল সেখানে পীঠস্থান হয়ে গেল। লাভপুরের মা ফুল্লরা পীঠস্থানে দেবীর অধরোষ্ঠ পড়েছিল।
বর্তমানে প্রতি বছর মাঘী পূর্ণিমায় এই মন্দিরে খুব ধুমধাম করে পুজো হয়।
মন্দিরের মাথায় নাকি একটি সোনার ঘড়া ছিল। সূর্যের আলো পড়লে সেই সোনার ঘড়া থেকে আলো বিচ্ছুরিত হত। ব্রিটিশ আমলের পরে ওই ঘড়াটি পাওয়া যায়নি। বোলপুরের একটি দিঘিতে মাটির তলা থেকে একটি লিপি উদ্ধার হয়। সেখান থেকে সোনার ঘড়া সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছিল।
আজ থেকে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগে মন্দিরে শিব ভোগের পর "রূপী সূপী" বলে ডাক দিলে বড় বড় শিয়াল এসে দাঁড়াত। তাদের রোজ ভোগ দেওয়া হত। এই প্রথা আজও প্রচলিত।
মন্দির-এর উল্টোদিকে একটা মিষ্টির দোকান। সেই দোকানের মালিক আনন্দ দাঁ আমাদের এতকিছু গল্প শোনালেন। পাশেই তৈরী হচ্ছিল বড় বড় বিশালাকৃতি লোভনীয় রসগোল্লা।
মন্দির-এর উল্টোদিকে একটা মিষ্টির দোকান। সেই দোকানের মালিক আনন্দ দাঁ আমাদের এতকিছু গল্প শোনালেন। পাশেই তৈরী হচ্ছিল বড় বড় বিশালাকৃতি লোভনীয় রসগোল্লা।
এছাড়াও গরম আলুর চপ, বেগনি, আর চা-এর ব্যবস্থা তো রয়েছে। ওখানের মানুষদের আন্তরিক ব্যবহার মিষ্টি মধুর হাসিতেই খাবারের স্বাদ বহুগুণ বেড়ে গেল।
আনন্দবাবু জানালেন তিনি অনেক ছোটবেলায় তারাশংকর-কে দেখেছেন। সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ মানুষগুলিও। তাদের চোখে কিছুটা দেখার চেষ্টা করলাম মানুষ তারাশংকর-কে। কিন্তু আসল জায়গাটিতে তো না গেলেই নয়। তা হলো তারাশঙ্করের ভিটে "ধাত্রীদেবতা"।
একটু খুঁজতেই, গ্রামের মানুষ জনকে জিজ্ঞেস করতে করতেই পৌঁছে গেলাম বিখ্যাত বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি। একটু যে উত্তেজনা হচ্ছিল না তা নয়। মনে হচ্ছিল স্বয়ং লেখকই হয়ত বেরিয়ে আসবেন সদর দরজায়। ভ্রূকুটি করে দেখবেন চশমার ফাঁক দিয়ে। তবে স্বয়ং যেন তাঁরই প্রতিমূর্তি তাঁর ভাইপো বেরিয়ে এলেন। তিনি আমাদের সব কিছু দেখালেন। বাড়ির যে দিকটি এখন সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। লেখকের ব্যবহৃত জিনিস, চিঠিপত্র, সার্টিফিকেট, বংশলতিকা। দেওয়ালে চোখে পড়ল ওনার বিখ্যাত সাহিত্যকৃতিগুলি থেকে উদ্ধৃতি। সমস্ত ঘর তাই স্মৃতির গন্ধ মাখা। কোথাও যেন একটা মন কেমনের বিষাদ ছড়িয়ে গেল। লেখক চলে যান একদিন কালের নিয়মে। রয়ে যায় তার অমূল্য শব্দগুলি মনের গহনে। এই আমরাই তো বাঁচিয়ে রাখি লেখককে। নিজেদের মনের গভীরে। তাই না?
বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে প্রতিবার দূর্গা পুজো হয়। তার মন্ডপ, সাবেকী শৈলীর মন্দির সব দেখলাম। কালীপুজোর ঠিক আগের দিন, তাই প্রতিমা তৈরী হচ্ছিল।
এবার গলি দিয়ে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখে এলাম ধাত্রীদেবতা। কাছারী বাড়ি, সংগ্রহশালা ও গ্রন্থাগার। মনে হলো এই অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণ করার জন্যে প্রশাসনের আরও যত্নবান হওয়া উচিত।
লাভপুর গ্রামের কথা আরও বেশি করে পত্র-পত্রিকায় উঠে আসা উচিত। আমাদের মিডিয়াগুলি খুব বেশি ঝাঁ চকচকে চটকদার জিনিস দেখাতে ব্যস্ত। একটু না হয় উঠে আসুক সোনার সাহিত্য, সোনার বাংলা, আর বরণীয় মানুষদের কথা। আমার লেখা পড়ে যদি তোমাদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে জন্মায় এই গ্রামে যাওয়ার তবে সত্যিই খুব খুশি হব।
তোমাদের জন্যে দিলাম এই বিশেষ সাক্ষাত্কারের ভিডিও।
ভিডিও ম্যাজিক
কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্করের সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য - বিশেষ সাক্ষাত্কার
কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর সম্পর্কে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রী বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে তারাশঙ্করের জন্মভিটেতে গিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্বৈতা গোস্বামী।
--------------
No comments:
Post a Comment