হিয়াদের চায়ের পার্টি
রম্যাণী গোস্বামী
হিয়ার মাথায় ইদানীং ভূত চেপেছে পার্টি করার। প্রত্যেক বছর যেমন জন্ম দিনের দিনটিতে হয়, সেই এক কেক কাটা, সেই বেলুন ফোলানো, বার্থডে গিফট পাওয়া, লুচি পায়েস মাংস – সেসব নয় কিন্তু! ওই যে বড়রা যেরকম মাঝে মধ্যে করে না? সেরকম আর কী। চার পাঁচ জন ইস্কুলের বন্ধুরা আসবে। এমনিই। অনেক হই হুল্লোড় হবে। কত্ত মজা! খাওয়া দাওয়াও হবে ইচ্ছে মতন। তবে চা কিন্তু চা-ই। সদ্য সদ্য চা খেতে শিখেছে ওরা সবাই। সুন্দর সুন্দর চীনেমাটির কাপে ফুল তোলা টি পট থেকে নিজের হাতে ঢেলে দেবে চা ও ওর বন্ধুদেরকে। ধীরে ধীরে ফুঁ দিয়ে কাপে চুমুক দেবে সবাই। এক্কেবারে বড়দের মত। আহ, ভাবতেই যে কী উত্তেজনা হচ্ছে তা আর কেমন করে বোঝাবে হিয়া সবাইকে।
সুতরাং পরের দিন ইস্কুলে টিফিনের ঘণ্টা পড়া মাত্র খেলার মাঠে জমায়েত হল ক্লাস সিক্সের পাঁচ বন্ধু। তন্ময়, রোহণ, অর্কমিত্রা, সায়েরী আর ও। খানিকক্ষণ ক্যাচর ম্যাচরের পর ভেনু ঠিক হল হিয়াদের বাড়িই। অবশ্য এই নিয়েই এক্ষুণি প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল পাঁচ জনের। সবার ইচ্ছে নিজের বাড়িতেই হোক চায়ের পার্টি। কিন্তু ওসব আবদার করলে চলবে? হু হু বাবা, প্ল্যানটা বেড়িয়েছে কার মাথা থেকে? সেটা দেখতে হবে না? যাই হোক, নেক্সট হল দিনক্ষণ স্থির করা। তা সে তো আর বাড়ির অনুমতি ছাড়া করা যাবে না। তাই অগত্যা মুখ টুখ মুছে ভালমানুষের মত সবাই গিয়ে বসল ম্যাথস ক্লাসে। তবে আরেকটা জিনিসও ঠিক করেছে ওরা সবাই মিলে। এটা বলেছে অবশ্য অর্কমিত্রা। ওরা প্রত্যেকে নিজেদের বাড়ি থেকে কিছু না কিছু স্ন্যাক্স বানিয়ে নিয়ে আসবে ওই দিনটিতে। ওর মায়েদের কিটি পার্টিতেও নাকি এমন ব্যাপারই হয়। বিজ্ঞের মত মুখ করে জানিয়েছে অর্কমিত্রা।
বাড়িতে অবশ্য কোনও সমস্যাই হল না হিয়ার প্রস্তাবে। বরং বাবা তো খুবই উৎসাহ দেখালেন। মা বেচারি একে পুঁচকে ভাইটাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তার মধ্যে দিব্যি এক মাস পুজোর ছুটি কাটিয়ে কয়েকদিন হল মায়ের কলেজ খুলে যাওয়াতে কেমন একটু যেন গম্ভীর গম্ভীর ভাব! হিয়ার খুব ইচ্ছে ছিল সম্ভব হলে আজ বা কালকেই হোক পার্টি। কিন্তু বাবাই বারণ করলেন, “সামনের শনিবারটাই ঠিক কর তোরা, বুঝলি? ওদিন তোর মায়ের ডে অফ আছে।” ব্যস। ইস্কুলে গিয়ে দুটো ক্লাসের মধ্যে একটু ফাঁকা পেয়ে বন্ধুদের সেটা জানানো মাত্র জোর হাততালি আর ইয়া...ইয়া...ইপ্পি...ইপ্পি...! শোরগোল পড়ে গেল। এত হইচইতে রোজকার মত বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে ওদের দিকে তাকাল ক্লাসের ফার্স্ট বয় সৌগত। অবশ্য তাতে ওদের ভারি বয়েই গেল!
দেখতে দেখতে চলে এল সামনের শনিবার। হিয়াদের ইস্কুল ছুটি। কিন্তু সকাল থেকে এ বন্ধু, সে বন্ধুর ফোন এসেই চলেছে। সবাই সমান উত্তেজিত। হিয়াও মোটেই বসে নেই। হোস্টেস বলে কথা! নিজের ঘরটাকে, বইয়ের তাকগুলো, র্যাকের খেলনাগুলো যে কতবার ঝেড়ে ঝুরে সাফ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। মা বোনচায়নার টি সেটটা তাকের থেকে নামিয়ে ধুয়ে টুয়ে রেখেছে। বাবা আরেকটা মজার কান্ড করেছে। দেওয়ালিতে ব্যালকনিতে ঝোলানো হয়েছিল কিছু লাল নীল সবুজ টুনি বাল্ব। সেগুলো কী চমৎকার করে লাগিয়ে দিয়েছে হিয়ার ঘরের জানালার গ্রিল বেয়ে। দিনের বেলা ফটফটে আলোতেই একশো বার সেগুলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে দেখছে হিয়া। বিকেল পাঁচটা নাগাদ এসে যাবে সব। বাবা অফিস ফেরতা নিয়ে আসবে পেস্ট্রি আর চিকেন কাটলেট। দেড়টা নাগাদ সবশেষ ফোনটা এল রোহণের, “জানিস হিয়া? আমার মাম্মা আজকের পার্টির জন্যে কী বানিয়ে দেবে বলেছে? গেস কর? পারলি না তো বুদ্ধু? প্যানকেক! অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে হটকেসে করে নিয়ে যাব আমি। হি হি ...।” ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকল হিয়া। প্রথমেই গেল শোবার ঘরে। মা নেই। ছোট্ট ভাইটা ঘুমোচ্ছে দোলনায়। তারপরই সে ছুটল রান্নাঘরের দিকে। একটা জিনিস তো মাথা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়েই গেছে তার!
রান্নাঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল সে। মেঝেতে বসে ভাত খাচ্ছে মালতিমাসি আর তার মেয়ে টুম্পা। মা ওদের ভাত তরকারি বেড়ে দিচ্ছেন। মালতিমাসি সেই সকালে হলদিবাড়ি লোকাল ট্রেনে চেপে আসে ওদের বাড়ি। মা বাবা বেরিয়ে যাওয়ার আগে। তারপর সমস্তটা দিন ভাইয়ের দেখাশোনা করা, ভাইকে স্নান করানো, খাওয়ানো, সব দায়িত্ব মালতিমাসির। টুম্পা হিয়ারই বয়সী। ইস্কুলে যায় না। ঘরেই পড়াশোনা করেছে অল্প স্বল্প। এখন সেও মার সঙ্গে চলে আসে জলপাইগুড়িতে। হিয়াদের ফ্ল্যাটে আর আশেপাশে অল্প কয়েকটা বাড়িতে ঠিকা কাজ ধরেছে সে। তবে মাঝে মধ্যেই টুকটাক ফাঁকা পেলে সে চলে আসে হিয়াদের বাড়ি। তার মায়ের কাছে। বিশেষত দুপুরের দিকটায়। তারপর দুজনে মিলে বিকেলের ট্রেনে ফিরে যায় হলদিবাড়ি। মা এবারে তাকিয়েছেন ওর দিকে। হিয়া কাঁদকাঁদ গলায় মাকে জিজ্ঞেস করল, “আজ পার্টিতে আমার বন্ধুদের আমি কী বানিয়ে খাওয়াব মা?”
“ওমা, এতে কাঁদার কি হয়েছে?” মার চোখে মুখে বিস্ময়। “কাল বিকেলে তোর বাবা নিজে বাজারে গিয়ে নিয়ে এসেছে সমস্ত কিছু। আদরের মেয়ের পার্টিতে তার বন্ধুদের খাওয়ানো হবে ‘ব্যানানা কুকি’। আর কী? তোমরা তো বলেই খালাস। এখন যত হ্যাপা হয়েছে আমার। রসো একটু। ওদের খাওয়ারটা দিয়ে নিয়ে হাতটা খালি করি, তারপর হবে। তুই যা তো, দেখ, ভাই হিসু টিসু করল কি না।”
তারপর তো মহা আড়ম্বরে শুরু হল কুকি বানানো। ময়দার মধ্যে কলা ম্যাশ করে একটু বেশী করে চিনি মেশানো হল। তাতে আবার দেওয়া হল বাটার, কোকো পাউডার আর বেকিং পাউডার। সবটা অল্প অল্প করে দুধের সঙ্গে মিক্স করার পর চকোলেট রঙের একটা নরম সরম ডো তৈরি হল। আধ ঘণ্টা ওকে সেভাবেই রেখে দেওয়া হল কাঁচের বোলে ঢাকা দিয়ে। তারপর তাকে বেলনা দিয়ে মোটা করে বেলে কুকি কাটার দিয়ে বিভিন্ন আকার বানিয়ে ফেলল মা। মায়ের এই শিল্পকীর্তি দেখে মালতিমাসি, টুম্পা আর হিয়ার চোখ তো একেবারে ছানাবড়া! এরপর আর বেশী কাজ বাকি নেই। ট্রেতে বাটার মাখিয়ে ওগুলো রেখে ঢুকিয়ে দাও ওভেনে। দশ মিনিটেই ডাইনিং টেবিলে রেডি এক বড় প্লেট ভর্তি ফোলা ফোলা খাস্তা খাস্তা গরম গরম ‘ব্যানানা কুকি’।
সাড়ে পাঁচটা বাজে। হিয়ার বন্ধুরা এসে গেছে। হাহা হোহো হিহিতে কান পাতা দায়। টুনির আলো ঝিকমিক করছে। বাড়ি পুরো সরগরম। ওরা এসেই সবাই মিলে পড়েছে হিয়ার দেড় বছরের গুবদু গুবদু ভাইটাকে নিয়ে। ওর গালে চুমু টুমু খেয়ে আদরে আদরে অস্থির করে দিচ্ছে সব। তাও কোন হেলদোল নেই দুষ্টুটার। এর তার কোলে ঘুরে বেরোচ্ছে সে। কিচেনে কেটলিতে ফুটছে চায়ের জল। মা রান্নাঘরে ঢুকেই হিয়াকে দেখে বললেন, “হ্যাঁ রে, কুকিস গুলো তুলে রেখেচিস কোথাও? টেবিলে দেখছি না তো?”
হিয়ার চোখ মেঝের দিকে। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে একবার তাকাল সে মায়ের দিকে। তারপর ফিসফিস করে বলল, “ওগুলো সব কৌটোয় ভরে টুম্পাকে দিয়ে দিয়েছি মা”।
মা চমকে উঠলেন, “কীইইই...?”
“ও কিন্তু একদম নিতে চাইছিল না জানও, বারবার বলছিল যে তুমি রাগ করবে। দুপুরে তুমি যখন ভাইয়ের কাছে ঘুমোতে চলে গেলে, মালতিমাসি রান্নাঘরে, আমি কতক্ষণ গল্প করলাম ওর সঙ্গে।” হিয়ার গলার স্বরটা ভেজা ভেজা, “ও জানেইনা পার্টি করা কাকে বলে। কোনওদিন করেইনি এসব। অথচ ওদের বস্তিতে ওর কত বন্ধু আছে? ভোলা, বিলু, তাপসী, রহিম, ময়না ...আমার থেকেও অ্যাত্ত বেশী। আমি ওকে শিখিয়ে দিলাম জান? আজ করবে ওরা পার্টি। ওদের ঘরে তো কারেন্ট থাকে না মা, মোমবাতির আলোয়। প্লেটে তোমার হাতের তৈরি খাবার দিয়ে। ভাল করিনি মা?” এবার বকা খাবার পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে হিয়া ভয়ে ভয়ে তাকায় মায়ের দিকে।
অবাক কান্ড, ওর কথাগুলো শুনতে শুনতেই মায়ের রাগী রাগী মুখটা কেমন পাল্টে যাচ্ছিল। পুরোটা শোনার পর মা দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন হিয়াকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললেন, “ভালই করেছিস রে, ভালই করেছিস।”
“কিন্তু মা?” এবারে সত্যিকারেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলল হিয়া, “আমি কী খাওয়াব ওদের?”
“দূর বোকা মেয়ে।” কিশোরীর মত একগাল হেসে ফেললেন মা, “বাড়িতে বাটি কেক রয়েছে, ফ্রুট জ্যাম রয়েছে আর আছে টফি। চল না, দুজনে মিলে চট করে বানিয়ে ফেলি একটা ফিউশন ফুড।”
ওফ্, তারপর যা জমে গেল না হিয়াদের চায়ের পার্টি! তোমরাও যদি সুযোগ পাও কখনও বন্ধুরা মিলে করেই ফেল হিয়াদের মত এরকম একটা মজাদার জমায়েত। আর কেমন এনজয় করলে সেটাও আমাদের জানাতে ভুলো না কেমন?
----------------
ছবি –দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
লেখক পরিচিতি - রম্যাণী গোস্বামী - শিলিগুড়ির বাসিন্দা। পেশায় পদার্থবিদ্যার অধ্যাপিকা। লেখালেখি শুরু বছর দুয়েক আগে থেকে। ভালোবাসেন বই পড়তে, বেড়াতে যেতে এবং ফটোগ্রাফি করতে।
দারুণ লাগল গল্পটা। আরও চাই কিন্তু।
ReplyDeleteতোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম ঋজুদা।
Deleteখুব ভাল লাগল !
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা রইল।
Delete