দেশবিদেশের গল্প:: আগুন কীভাবে এলো (আমেরিকা) - মল্লিকা ধর

আগুন কীভাবে এলো (আমেরিকা)
মল্লিকা ধর

(এই গল্পটির আখ্যানভাগ নেটিভ আমেরিকান কারোক উপজাতির উপকথা থেকে সংগৃহীত বাংলায় এ কাহিনির পুনর্কথনের সময় নামগুলোকে বাঙালির নাম করা হয়েছে গল্পের ভালো লাগা বাড়িয়ে তোলার জন্য।)  

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা তখন আগুন শুধু আগুনমানুষদের কাছে ছিল তারা কাউকে তা দিত না, খুব সাবধানে পাহারা দিয়ে রাখত। মাঠে জঙ্গলে কত পশু-পাখি, গ্রামে কত মানুষ তারা কেউ আগুন পায় না।
বসন্তে, গ্রীষ্মে, সুখের দিনে কোনও কষ্ট হয় না, কিন্তু শীতের দিনে ভারী কষ্ট
বুড়ো আর কচিরা অনেকে শীতে কষ্ট পেয়ে মারা যায়
এমন তো চলতে পারে না - ঋক্ষবান ভাবে বনকুসুমীর কোলে কচি ছেলে, সামনের শীতে সে যদি না বাঁচে? বনকুসুমী সেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়। বনমালী বলে, ‘কিছু একটা করতে হবে
মণ্ডুক মাথা দুলিয়ে বলে, ‘করতে হবেই কিছু। কিন্তু কী করা যায়?’
বলাকা বলে, ‘জম্বুক কে ডাকি সে সবচেয়ে চালাক একটা না একটা বুদ্ধি বার করবেই
জম্বুক এসে বলে, ‘নো প্রবলেম জাস্ট রিল্যাক্স আমরা আগুন নিয়ে আসব ঐ স্বার্থপর আগুন মানুষেরা চিরকাল আগুন নিজেদের কাছে রেখে দেবে তা হয় না কি? তা হবে না কায়োটে থাকতে তা হতে পারে না
সবাই ভুরু তুলে বলল, ‘আগুন নিয়ে আসবে? কেমন করে?’
মিচকি মিচকি হেসে জম্বুক বলে, ‘আমার একটা প্ল্যান আছে এস আমি তোমাদের বলি কী করতে হবে?’
জম্বুকের প্ল্যান মত সবাই তৈরি হল তারপর একদিন পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঘোরানো প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে তারা পাঁচজনে মিলে চলল আগুনে মানুষদের পাথুরে বাড়ির দিকে।
সকলের গায়ে রঙিন উল্কি, নানা রঙ্গে ছোপানো পোশাক।
জম্বুকের মাথায় মস্ত এক পালকের মুকুট
নদী পার হয়ে শুকনো শনঝোপ তারপর ছোটো একটা জঙ্গল, তারপরে এক বিরাট মাঠ সেই মাঠের পরপারে আগুন মানুষদের বিরাট পাথুরে বাড়ি। বেড়া দিয়ে ঘেরা উঠোন। কড়া পাহারা
জম্বুক, ঋক্ষবান, মন্ডুক, বলাকা আর বনমালী গিয়ে পৌঁছাল সেখানে আগুন মানুষদের বাড়ির দুয়ারে গিয়ে বলল যে তারা যাযাবর, অনেক দূর থেকে হেঁটে হেঁটে আসতে আসতে তারা খুব ক্লান্ত আর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর। যদি আশ্রয় পায় কিছুক্ষণের জন্য আর সামান্য খাদ্য-পানীয় তাহলে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবে তারা।
আগুন মানুষেরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চায় না। বলে, ‘তোমরা যে আমাদের জিনিস চুরি করে পালাবে না তার গ্যারান্টি কী?
জম্বুক একেবারে বিগলিত হয়ে বলে, ‘কী যে বলেন! আমরা সামান্য ধূলা মাখা যাযাবর, আমরা আপনাদের জিনিস নিয়ে গিয়ে কি করব?’
‘আমরা তো আর আপনাদের ঘরে যাবো না, উঠানে বসতে দিলেই আমাদের পক্ষে ঢের। আহ! খুব ক্লান্ত আমরা। আপনাদের মত দয়ালু মানুষরা থাকতে আমরা ক্ষুধা–তৃষ্ণায় মারা যাবো, এই কি একটা ন্যায্য কথা হল, বলুন?’
জম্বুক এমন হাঁপানোর ভঙ্গী করে যেন এক্ষুণি লুটিয়ে পড়ে মরে যাবে
আগুন-মানুষেরা ভালো করে তাদের ঝুলি ঝোলা ঝেড়ে ঝুড়ে দেখে তাদের ভেতরে নিয়ে গেল। উঠানে তাদের বসতে দিল মাদুর বিছিয়ে, খেতে দিল, জল দিল। পথশ্রমে ক্লান্ত তারা পাঁচজন খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল।
ভালো করে একঘুম দিয়ে তারা যখন উঠল তখন বেলা আর নেই, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে
চোখমুখ ডলতে ডলতে মস্ত হাই তুলে জম্বুক বলল, ‘আরে এত দেরী হয়ে গেল! এই অন্ধকারে যাব কী করে আমরা?’
আগুন-মানুষেরা উঠানের মাঝখানে আগুনের কুণ্ডে তখন আগুন জ্বালিয়েছে, এদিকে রান্না-বান্না হচ্ছে, সুরাপানও তারা শুরু করে দিয়েছে। রঙ্গিন চোখে তাদের নেতা এসে হাসতে হাসতে বলে, ‘আরে যাযাবররা যে! ঘুম কেমন হল? তোমরা রাতে আর যাবে কোথা? আমাদের নাচা-গানা হবে একটু পরেই। খাওয়া-দাওয়াও। তোমরাও যোগ দাও সে সবাই কে সুরাপাত্র এগিয়ে এগিয়ে দেয়। যাযাবরেরা হাস্য বিগলিত মুখে ধন্যবাদ দিয়ে পাত্র গ্রহণ করে। আর মুখের কাছে তুলে চুমুক দেবার অভিনয় করে।
জম্বুক আগে পানের সময়ই সবাইকে ভালো করে সতর্ক করে দিয়েছিল যেন ভুলেও তারা আগুন মানুষদের দেওয়া মাদক পান না করে।
খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে নাচ শুরু হল আগুন ঘিরে জম্বুক তো একেবারে পরম উৎসাহে নাচতে নাচতে তারস্বরে গানও গাইছে। আগুন-মানুষরা তারিফও করে খুব। একসময় সে খুলে রাখা পালকের মুকুটটা পরে নেয়, তাতে নাচ আরও জমে
এদিকে নাচতে নাচতে আগুন-মানুষদের খেয়াল হয়নি রাত অনেক হয়েছে আগুনও কেমন নিবু নিবু হয়ে এসেছে।
জম্বুক বলে, ‘আরও উসকে দাও আলো, অন্ধকারে কি নাচ জমে?
আগুন-মানুষদের নেতা যেই নতুন কাঠ-কুটো আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে আগুন খুঁচিয়ে দিয়েছে লম্বা দণ্ড দিয়ে, মস মস শিখা লাফিয়ে উঠেছে। খুব কাছেই ছিল জম্বুক, মাথা নুইয়ে সে পালকমুকুটে ধরে নিল আগুন।
তারপর ছুট ছুট ছুট, তারা পাঁচজনে দৌড়ল আগুন-মানুষেরা তো, ‘আরে রে রে নিয়ে গেল আমাদের আগুন চুরি করে, নিয়ে গেল যাযাবরেরা, ধর ব্যাটাদের ধর’ বলে তাড়া করেছে।
জম্বুকের হাতে আগুন জ্বলা মুকুট, আগুন-মানুষেরা তাকে প্রায় ধরে ধরে। সে ছুঁড়ে দিল মুকুট বনমালীর দিকে। বনমালী লুফে নিয়ে দৌড়। আগুন-মানুষরা এবারে বনমালীর দিকে দৌড়ল, ‘ধর ধর সে আগুন ছুঁড়ে দেয় বলাকার দিকে। তাড়া করে আসা লোকগুলো এবার বলাকার দিকে দৌড়য়। এই ভাবে আগুন হাত থেকে হাতে ফিরতে থাকে। আগুন-মানুষরা তাদের ধরতে পারে না।
এদিকে দৌড়তে দৌড়তে তারা এসে গেছে মাঠ পার হয়ে সেই শুকনো গাছের কাছে। হাত ফেরত হতে হতে আগুন আবার এসে গেছে জম্বুকের হাতে। জম্বুক আছড়ে ফেলে গাছে, দাউ দাউ ধরে যায়। আর চিন্তা নেই, এবারে আর কেড়ে নিতে পারবে না আগুন। ব্যর্থ আগুন-মানুষরা গালাগাল দিতে দিতে ফিরে যায়।
জম্বুক, বনমালী, ঋক্ষবান, বলাকা আর মনুক পাঁচটি শুকনো ডালের ডগায় আগুন ধরিয়ে নেয় ফিরে যায় তাদের গ্রামে।
তারপর থেকে আর তাদের শীতে কষ্ট হয়নি। আর জম্বুক হয়ে যায় তাদের চিরকালের বীর নায়ক।
-----------------------
ছবি - পিয়ালী বন্দোপাধ্যায়

লেখক পরিচিতি - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা। লেখালেখির সূত্রপাত স্কুল জীবন থেকেই। ছোটোবড়ো প্রত্যেকের জন্যই লেখেন। প্রথম সারির সমস্ত পত্রিকায় নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হয়। অশেষ আকাশএবং অনন্ত আগামী লেখিকার প্রকাশিত দুটি বই। বাংলা ব্লগেও নিয়মিত লেখালেখি করেন।

1 comment: