ম্যাজিক ল্যাম্প:: জানুয়ারি ২০১৭

দ্বিতীয় বর্ষ।। দ্বিতীয় সংখ্যা।। জানুয়ারি ২০১৭
বিশেষ রূপকথা সংখ্যা


প্রচ্ছদঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
_____

সম্পাদকীয়:: জানুয়ারি ২০১৭


ছোটবেলায় সবকিছুতে ম্যাজিক খুঁজতাম কুড়িয়ে পাওয়া পাথরে, ঠাকুমার শেখানো আশ্চর্য মন্ত্রে, বাবার তাসের খেলায় বাড়িতে যে নতুন মামা বা কাকু এসেছে সে ম্যাজিক জানে... ব্যস আর দেখতে হবে না... সবাই মিলে তাকে ঘেরাও। ...অন্ধকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকত কিছু ম্যাজিক ...জ্যোত্স্নার আলোয় ছড়িয়ে থাকত কিছু ম্যাজিক নদীর জলের মধ্যে সেই ম্যাজিক ছড়িয়ে পড়ত... ঠান্ডা তারাদের গা বেয়ে হিমহিম শীতের রাতে সেই ম্যাজিক ঝরে পড়ত আমার সোয়েটারে ...সোয়েটারে রংবেরঙের তুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে বইয়ের পাতার মধ্যে জমিয়ে রাখতাম ...পড়ার ফাঁকে উঁকি দিত সেই ম্যাজিক কুড়োনো পালকের গায়ে লেগে থাকত যে ম্যাজিক সে বলে দিত অনেক দূরের এক দ্বীপে বাস করা নীলচে সবুজ পাখির ঠিকানা
পাগলি বুড়ি বালির মধ্যে ম্যাজিক খুঁজে পেত তার চিকচিকে চোখে আলোছায়া খেলা করত সে সবসময় হাসত আর বলত “সোনা পেয়েছি, হীরে পেয়েছি, দেখে যা” ...আমরা ভয়ে পালিয়ে যেতাম
সবাই কী ম্যাজিক খুঁজে পায় ওই বুড়ির মতো? ...ছেঁড়া কাঁথা গায়ে সে হাসে কেমন করে জানি না ...কেউ কেউ হয়তো বা পায় সত্যিমিথ্যের বাইরে একটা অন্য জগতের সন্ধান

ম্যাজিক ল্যাম্প শীত সংখ্যা তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছে সেই এক ঝুড়ি ম্যাজিক - “রূপকথা” অর্থাৎ রূপকধর্মী কথা বা গল্প - যেখানে নানা রূপকের আড়ালে বাস্তবের সততা, হিংসা, ভালোবাসা, শত্রুতা, বন্ধুত্ব, উদারতা, জীবনের ভালো খারাপ দুই দিকই ধরা দেবে ছোটোবেলায় রূপকথা পড়ে জীবন সম্পর্কে যা জেনেছি তা হয়তো বড়ো বেলায় মোটামোটা বই পড়েও জানতে পারিনি ম্যাজিক ল্যাম্পের শীত সংখ্যায় রূপকথা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কিশোর-সাহিত্যিকরা তাদের কলম কল্পনার পক্ষীরাজ ঘোড়া ছুটিয়েছে সেখানে কোনও বাধা নিষেধ মানেনি পশুপাখিদের নিয়ে গল্প যেমন রয়েছে তেমন রূপকথার আড়ালে বর্তমান সমাজের সমস্যাগুলোও সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে কোনও কোনও লেখা আবার সবুজ বনে ঝিরঝিরে নদীর মতো বয়ে গেছে তার পাশে দু’দণ্ড বসতেও ভারী ভালো লাগে আবার রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চকর অভিযানও রয়েছে এই সংখ্যায় রূপকথার একটি বিভাগ “গদ্যে পদ্যে রূপকথা” - সেখানে কবিতার ছন্দে, আবার কিছুটা গদ্যে, রূপকথা লেখা হয়েছে - যেটি রূপকথার আদি অকৃত্তিম শৈলী আশা করি সবার ভালো লাগবে আমি নিশ্চিত এই সংখ্যাটা ছোটো-বড়ো সবার কাছেই মনে রাখার মতো একটা সংখ্যা হবে
গল্প-কবিতা ছাড়া অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ - যেমন প্রবন্ধ, কমিকস, গল্প-পাঠ, বায়োস্কোপ, গোলটেবিল সবেতেই এবারে রূপকথার ছোঁয়া মুখোমুখি বিভাগে এই সময়ের প্রখ্যাত সুসাহিত্যিক সৈকত মুখোপাধ্যায়ের ভিডিও ইন্টারভিউটি সবাইকে সমৃদ্ধ করবে এই আশা রাখছি

রূপকথা সংখ্যা বলেই প্রচুর ছবির প্রয়োজন আর বইমেলার আগে শিল্পীদের প্রচন্ড ব্যস্ততা, কিন্তু তা সত্ত্বেও শিল্পীরা তাঁদের মূল্যবান সময় বের করে ম্যাজিক ল্যাম্প-এর জন্য তুলি ধরেছেন তাঁদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই শ্রী তাপস মৌলিক, শ্রী রাজীব কুমার সাহা সুন্দর ভাবে সংখ্যাটি সাজিয়ে তুলেছেন তোমরা কিন্তু আমাদের অবশ্যই জানিও এই সংখ্যাটি তোমাদের কেমন লাগল
বইমেলায় গিয়ে প্রচুর বই কিনে নিও সারাবছরের জন্য, আর ম্যাজিক ল্যাম্প তো রইলই
খুব খুব ভালোবাসা নিও

ইতি,
জিনি
_____
ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য

গল্পের ম্যাজিক:: এক যে ছিল বাঘ - পাপিয়া গাঙ্গুলি


এক যে ছিল বাঘ
পাপিয়া গাঙ্গুলি

এক ছিল ছানাবাঘ ছানাবাঘ মানে ছোট্ট একটা বাঘের ছানা সে থাকত এক সবুজ গভীর জঙ্গলে ওর মায়ের সাথে ওর মা ওকে ডাকত হমু বলে হমু ছিল ভারী দুষ্টু খুব খুব জ্বালাত ওর মাকে মাও ছানাবাঘকে খুব চোখে চোখে শাসনে রাখত এদিক ওদিক যেতে দিত না হমুর কিন্তু এটা একদম ভালো লাগত না সে চাইত জঙ্গল ঘুরে বেড়াতে, একা একা জঙ্গলে কত মজা! সবুজ সবুজ ঝোপ গাছেদের পাশ দিয়ে গেলে তারা ডাল-পাতা দিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় লাল লাল ফল নিয়ে ফুটবল খেলা যায় আগে কিন্তু মা এমন ছিল না আসলে হয়েছে কী, কিছুদিন আগে হমুর বন্ধু পালতু হঠাৎ হারিয়ে গেল
খোঁজ খোঁজ, কোথাও পাওয়া গেল না তাকে পালতুর মা কেঁদে কেঁদে অন্ধ হল পালতুর বাবা শিকার করা ছাড়ল খাওয়াদাওয়া বন্ধ ওদের দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে পরে এক বাজপাখি খবর এনেছিল যে পালতুকে শিকারীরা ধরে নিয়ে দুষ্টুলোকের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে দুষ্টুলোকেরা পালতুকে খাঁচায় আটকে রাখে ভালো করে খেতে দেয় না পালতু নাকি ছাগলের মতো রোগা হয়ে গেছে মাস্টার বলে এক লোক চাবুক হাতে পালতুকে আগুনের রিংয়ের মধ্যে দিয়ে ঝাঁপাতে বাধ্য করে পালতুর ছেঁকা লাগে ভয়ে কুঁকড়ে বসে থাকে তখনই পিঠে পড়ে মাস্টারের চাবুক মানুষেরা টিকিট কেটে এমন মজা দেখে নিজেদের বাচ্চাদের সাথে একে সার্কাস বলে
এরপর থেকে মা খুব সাবধান হমুকে এদিক ওদিক করতে দেয় না সবসময় চোখে চোখে রাখে এমনিতেই তাদের বাঘের প্রজাতি অনেক কমে যাচ্ছে মানুষেরা জঙ্গল কাটছে, বাড়ি বানাচ্ছে তাদের কথা কে ভাবে!
হমু মায়ের কাছে শুনেছে মায়ের মাকে একদল শিকারি গুলি করে মেরেছিল তারপর নাকি তার চামড়া ছাড়িয়ে, দাঁত, নখ সব উপড়ে নিয়ে গেছিল এসব নাকি অনেক দামে বিক্রি হয় মা খুব ভয়ে থাকে
একদিন ছানাবাঘকে ওর মা বলল, “হমু, আমি নদীতে জল খেতে যাচ্ছি চল আমার সাথে
দুষ্টু হমু বায়না ধরল যে সে মায়ের সাথে যাবে না নানা বাহানা দিতে লাগল, না যাওয়ার জন্য
“মা, আমার খুব খুব পা ব্যথা করছে ভোরে উঠে আজ নরম রোদের সাথে অনেক খেলেছি আর আমার তো জলতেষ্টা পায়নি
মা-বাঘ অনেক বলল না, কিছুতেই শুনল না হমু ঘ্যান-ঘ্যান করতে লাগল তখন বাধ্য হয়ে মা একা যাবে স্থির করল হমুকে একা রেখে
হমুর বাবা নেই একবার শিকারে গিয়ে ভুল করে গ্রামে ঢুকে পড়েছিল বসতি বেড়ে যাওয়ায় জঙ্গলের সীমারেখা ছোটো হয়ে গেছে তাই ঠাহর করতে পারেনি গ্রামের মানুষ দড়ি দিয়ে বেঁধে চালান করে দিয়েছে কোথায় যেন সেই থেকে একা বড়ো করছে ওর মা হমুকে মা বলল, “গাছের নীচে বসে থাকবে চুপ করে আমি না ফেরা পর্যন্ত কোত্থাও যাবে না
হমু তো মাথা নেড়ে নেড়ে মায়ের কথা শুনবে প্রমিস করল বাঘ-মা নদীর পথে হেঁটে চলল হমু চুপ করে পিটপিটে চোখে মায়ের হেঁটে যাওয়া দেখছিল, থাবায় মুখ রেখে ওইইই টিলার বাঁকে যেখানে সূয্যি ডোবে, ঠিক সেইখানে মাকে যখন আর দেখা যায় না, হমুর তখন মনে হল যে সে অনেক বড়ো হয়ে গেছে তাই মা তাকে একা রাখতে রাজি হয়েছে
ব্যস, হমু আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল ল্যাজটা নেড়েচেড়ে গুটিগুটি পায়ে তাদের গুহার দিকে গেল একটা ছোট্ট খরগোশ ঘুরছিল দৌড়ে গিয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াল মা আসলে বলতে হবে, যে সে একটা খরগোশ তাড়িয়েছে গুহার ঠিক পাশে একটা ফুলের ঝোপ অনেক ফুল ফুটে আছে সেখানে সে দেখল একটা সুন্দর গোলাপি ফুলের ওপর একটা রংবেরঙের প্রজাপতি বসে আছে খুব পছন্দ হল তার ভাবল, ওটা ধরে মাকে গিফট দেবে আর মা অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলবে, “ওমা, আমার হমুসোনা ধরেছে! কত্ত বড়ো হয়ে গেছে আমার ছানা!”
এই ভেবে হমুর লোমগুলো একটু ফুলে উঠল যেই না ধরতে যাবে নিমেষে প্রজাপতি উড়ে গেলছানাবাঘ ভাবল, চেষ্টা করলে সেও উড়তে পারে মন দিয়ে প্রজাপতির দিকে তাকিয়ে সে দৌড়ে চলল তার পেছন পেছন উড়তে শেখার খুব ইচ্ছা মনে এমন ভাব যে সে উড়তে পারছে প্রজাপতির মতো আর একটু বাদে ধরে ফেলবে প্রজাপতি
কিন্তু প্রজাপতি ধরা কি অত সহজ ব্যাপার? ফুরফুরে প্রজাপতি হাওয়ার মতো এগিয়ে চলে প্রজাপতি নেচে নেচে ওড়ে আর দ্যাখে ছানাবাঘকে হমুর তিড়িং তিড়িং করে লাফানো দেখে খুব মজা পায় প্রজাপতি ঝোপ ছেড়ে জঙ্গলের দিকে এগোয় হমু এদিকে প্রজাপতির দিকে তাকিয়ে দৌড়োতে থাকে আর পায়ে কখনও কাঁটা ফোটে, কখনও ঝোপঝাড়ে নাক ঘষে যায় কুছ পরোয়া নেহি, এমনিভাবে সে দৌড়তে থাকে প্রজাপতির পেছন পেছন
প্রজাপতি চলল গভীর বনে এমন গভীর বন যে দিনের বেলায়ও ঝিঁঝিঁ ডাকে সেথায় একফোঁটা রোদ্দুর ঢোকে না পাতার ফাঁক দিয়ে উড়তে উড়তে এক চত্বরমতো জায়গায় এসে প্রজাপতি হারিয়ে গেল হমুও থামল এ হল প্রজাপতিরাজ্য সে রাজ্যে শুধু ফুল আর প্রজাপতি লিলি, টগর, দোপাটি, জবা, আরও কত কী হমু সব ফুলের নামও জানে না ফুলের মিষ্টি গন্ধে চারদিক ম ম গোলাপি, হলুদ, নীল, কমলা আরও কত রঙ এক গোলাপগাছের এত্ত বড়ো এক লাল ভেলভেটের মতো গোলাপে বসেছে প্রজাপতিরানি চারপাশে তাকে ঘিরে চলছে প্রজাপতি-নাচ কত রঙের প্রজাপতি কোনওটা লালচে, কোনওটা নীল-হলুদ মেশানো, কারোর গায়ে বাঘের মতো ডোরা...
হমু তো এসব দেখে পুরো চোখ ছানাবড়া কোনোদিনও দেখেনি এমন ব্যাপার-স্যাপার
এদিকে সেই প্রজাপতিকে আর দেখা গেল না হমুর পা খুব ব্যথা করছে, কাঁটা ফুটে রক্ত পড়ছে অল্প সে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল জিভ দিয়ে চেটে নিল কাটা জায়গাটা প্রজাপতি-নাচ দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়েও পড়ল

ঘুম ভেঙে দেখে, কোথায় গেল সব প্রজাপতি! চারদিক অন্ধকার
হমু তো খুব ছোটো, খুব ভয় পেয়ে গেল সে চোখ ছলছল, বুক ধড়ফড় আস্তে আস্তে উঠে সে হাঁটি-হাঁটি পায়ে মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে গেল কিছুটা এগিয়ে দেখল, একটা পুকুরে চাঁদ নেমেছে স্নানে আর পাশের মাঠে যেন নেমে এসেছে আকাশের যতেক তারা উড়ে উড়ে খেলছে তারা খুদে খুদে পরিদের সাথে এমন সে কোনোদিনও দেখেনি আলোয় আলোয় ছয়লাপ এক তারা এসে বলল, “কী হমু, খেলবে?
“আরে! তুমি আমার নাম জান কী করে?
“আমরা তো তারা, আকাশে থাকি সব জানি আমরা
“আমার বাবা কোথায় জান?
“তোমার বাবা খুব ভালো তাই সে আমাদের দেশে থাকে ঐ আকাশে
“দেখাবে, আমার বাবাকে?
“নিশ্চয়ই দেখাব
“ঐ দেখ, ঐ পরিরা স্ফটিকের বালতিতে শিশির তুলছে ঐ শিশির চোখে লাগালে স্বপ্নে প্রিয় মানুষকে দেখা যায় কিন্তু তুমি তো বন্ধু আমাদের, একদিন তোমার বাবাকে নিয়ে এসে দূর থেকে দেখাব চল এখন খেলতে
হমুর ঠিক তখন মনে হল খুব খিদে পেয়েছে বলল পরে খেলবে সে
কী খায় এই এত রাতে? সে তো রাতে ঘুমিয়ে পড়লেও মা ঠিক কী করে যেন খাইয়ে দেয় চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে সেও ঠিক খেয়ে নেয় মা কই? মায়ের জন্য খুব খুব মন খারাপ হল একটা গাছের তলায় বসে সে উঁ উঁ করে কাঁদতে থাকল
তা হয়েছে কী, সেই গাছে থাকত এক হুপহুপ হনুমান সে কান্নার আওয়াজ শুনে আস্তে আস্তে নেমে এল নীচে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কে তুমি? এ তল্লাটে আগে কোনদিন দেখিনি তো! কী হয়েছে তোমার? এত কান্না কেন?
ফোঁপাতে ফোঁপাতে হমু বলল সব কথা হুপহুপ হনুমান তখন বলল, “আচ্ছা, এই ব্যাপার? কেঁদো না, কাল সকালে তোমায় বাড়ি দিয়ে আসব
হমু বলল, “তুমি আমার বাড়ি চেন?
“না তোমার বাড়ি তুমি তো চেন সে তুমি পথ দেখিয়ে দিও
আরও জোরে কান্না, “আমি তো পথ চিনি না প্রজাপতি দেখতে দেখতে এসে পড়েছি
হুপহুপ বলল, “আচ্ছা বাপু, এখন এত কেঁদে কী হবে চুপ করে বসো আমি খাবার আনছি তোমার জন্য কাল খুঁজব তোমার বাড়ি আর মাকে এত মন খারাপ কোরো না বাছা
ছানাবাঘ হুপহুপের কথায় ভরসা পেয়ে, চোখ মুছে উঠে বসল ভালো করে চারদিক দেখতে থাকল চারদিক গাছ আর গাছ, মাঝখানটা গোল খালি জায়গা চাঁদের আলো যেন গলে পড়ছে ঝিঁঝিঁর ডাক একটা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছে হমু মুখ উঁচু করে আকাশের তারা গুনছিল মা বলে, আকাশের তারা গুনলে মন খারাপ কমে যায় সে ভাবে, ঐ মাঠে কত তারা নেমে এসে খেলা করছে, তাও আকাশে কত তারা এজন্যই সে কোনওদিন তারা গুনে শেষ করতে পারে না এমন সময় খুট করে এক আওয়াজে মাথা নামাল হমু ওরে বাবা রে! এটা কী রে! অন্ধকারে শুধু দুটো জ্বলজ্বলে চোখ আর কিছু নেই এক লাফে টুপ করে পড়ল গিয়ে হুপহুপ হনুমানের কোলে হনু বলে, “কী হল? কী হল?
“হনুভাই, ভূত ওখানে খেয়ে ফেলল রে!”
“কই ভূত, দেখি? ও, তাই বল পেঁচানির বর পেঁচা বসে তাকে তুমি ভূত ভাবলে আর তোমায়ও বলি বাপু পেঁচাদা, দেখছ নতুন এ তল্লাটে এমন নিঃশব্দে এসে কেউ বসে দেখ দেখি কী ভয়টাই না পেল
পেঁচা বলে, “শুধু প্রাণভরে দেখছিলেম বাছাকে ভারী নধর চেহারাখানি এমন বেমক্কা ভয় পাবে বুঝিনি বাপু
হুপহুপ বলল, “তা এক উপকার করে দাও দাদা
Tell me.” পেঁচা মাঝেমাঝে ইংরিজিও বলে
তুমি এই ছানাবাঘের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে দাও পথ চেনে না বেচারা
All right, চললুম পথ খুঁজতে” এই বলে বড়ো বড়ো ডানা মেলে উড়ে গেল পেঁচানির বর পেঁচা
হুপহুপ হনুমান নারকোলের খোলায় দুধ দিল হমুকে, “নাও, এবার দুধটুকু খেয়ে ঘুমাও দেখি পেঁচাকাকা কাল ঠিক তোমার বাড়ির ঠিকানা আনবে
হমু দুধটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে হুপহুপের বুকে ঘুমিয়ে পড়ল গরম একটা ওম বেশ মা মা মনে হল


কিচিরমিচির ডাকে চোখ খুলল সে রোদেলা সকাল পিটপিট করে এক চোখ কোনওরকমে মেলে দেখল তার সামনে বসে আছে নানারঙের নানাপাখি, খরগোশের দল, ছোটো বড়ো অনেক হনুমান, আরও অনেকে সবার চোখ তার দিকে লাফ দিয়ে উঠে বসল হমু ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল সবাইকে একটা কাঠবেড়ালি টুকটুক করে এসে ওর সামনে একটা বাদাম রেখে বলল, “আমার নাম কুট্টুস এই বাদামটা তোমার জন্য আমার বন্ধু হবে?
হমু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল
কুট্টুস জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কী করে এলে? কার সাথে?
হমু কালকের সব গল্প শোনাল সবাই তখন খুব হাসছে কুট্টুস বলল, “ও বুঝেছি, রঙলি এসব করেছে খুব দুষ্টু প্রজাপতি ও
ইতিমধ্যে হমু দেখল রঙলি তার নাকে বসে সাতরঙি পাখা নাড়িয়ে বলল, “সরি, আমি কাল মজা করছিলাম তোমার সাথে আমি বুঝিনি যে তুমি রাস্তা চেন না হারিয়ে যাবে আমি রাস্তা তো চিনি তোমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব
হুপহুপ হনুমান হমুর জন্য অনেক খাবার এনেছে সেসব পেট ভরে খেয়ে হমু সবার সাথে খেলা শুরু করল মন খারাপের কথা মনে থাকল না এদিকে পেঁচাকাকু এসে গেছে তার বাড়ির পথ জেনে হুপহুপকে বলল, “এখুনি রওনা না হলে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে
হুপহুপ হমুকে ল্যাজ ধরে টেনে এনে বলল, “চল, বাড়ি যেতে হবে
“না, এখন যাব না আরও খেলব আমি,” হমুর বায়না
“আবার আসবে জলদি তোমার মা যে ওদিকে খুব কান্নাকাটি করছে চিন্তায় সে খাওয়া বন্ধ করেছে মায়ের সাথে দেখা করে আবার এস আমার সাথে মাকে জানিয়ে,” এসব বলে হুপহুপ হমুকে নিয়ে এগোল
পেঁচা রাস্তা বুঝিয়ে দিল, সঙ্গে সে যেতে পারবে না কারণ, সকালে তার ওড়ার অসুবিধা রঙলি প্রজাপতি চলল সঙ্গে হুপহুপ হনুমান ছানাবাঘকে বগলদাবা করে এ গাছ ও গাছ লাফিয়ে লাফিয়ে চলল হমুর পেল খিদে সে হুপহুপের কোলে কুঁইকুঁই করতে লাগল তখন সবাই মিলে ডুংরি ঝরনার ধারে বসে খাবারদাবার আর ডুংরির মিষ্টি জল খেয়ে আবার এগোল

সূর্য্য যখন নরম হচ্ছে তখন রঙলি বলল, “এই হল হমুর বাড়ি
সে এক ভারী সুন্দর জায়গা উঁচু তিনমুন্ডি পাহাড় আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে মেঘের ভেলা ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়-কোলে চারদিক লম্বা লম্বা গাছে ঘেরা এক সবজে জমি পাহাড় যেখানে জমি ছুঁয়েছে সেখানে এক গুহার মুখ পাশে ফুলের ঝোপ
হমু দেখল, গুহার মুখে মা শুয়ে কাঁদছে হুপহুপের কোল থেকে নেমে একছুটে হমু মায়ের কাছে মা-বাঘ তো অবাক, খুশিও
“কোথায় ছিলি হমু!” বলে খুব চেটে দিল
হমু বলল, “সরি মা, তোমার কথা শুনিনি ওই দেখছ প্রজাপতি, ওর নাম রঙলি ওকে ধরে তোমায় গিফট দেব ভেবেছিলাম দুষ্টু প্রজাপতিকে ধরতে আমি ওর পেছন পেছন চলে গেছিলাম অনেকদূরে, ওদের দেশে আর ফেরার রাস্তা খুঁজে পাইনি মা জান না কী সুন্দর জায়গা! চাঁদ নামে পুকুরে চান করতে আর তারারা খেলা করতে মাঠে নেমে আসে পাখাওয়ালা ছোটো ছোটো পরিরা সেখানে স্ফটিকের বালতিতে শিশির তুলে রাখে সেই শিশির চোখে লাগালে স্বপ্নে প্রিয় মানুষকে দেখা যায় আমরা একবার বাবাকে দেখব মা
তারপর হুপহুপ হনুমানের সাথে আলাপ করাল নতুন বন্ধুদের গল্প বলল বিকেল গড়াল, হুপহুপ হনুমান বাড়ি ফিরবে যেই না সে টাটা বলেছে, ব্যস, হমু কেঁদে ফেলল তার এবার মন খারাপ হচ্ছে বন্ধুদের জন্য এখানে তার একটাও বন্ধু নেই খেলার সাথি নেই মা-বাঘ তখন বলল, হমুকে সে বেড়াতে নিয়ে যাবে ওখানে
হুপহুপ হনুমান বলল, “আচ্ছা, একটা কাজ করলেও তো হয় হমুর কোনও বন্ধু নেই এখানে তোমরা একাই তো থাক এখানে তোমাদের থাকার জায়গা থেকে মানুষের গ্রামও বেশি দূর না যেকোনও সময় বিপদ আসতে পারে তোমরা দুজন চল আমাদের কাছেওখানে একটা খালি গুহাও আছে কেউ থাকে না সেখানে তোমরা থাক হমুও খুশি হবে ওর বন্ধুদের সাথে থাকতে পারলে সবাই একসাথে আনন্দে থাকা যাবে
“ইয়েএএএএ!” হমুর কী আনন্দ লাফিয়ে উঠল সে মাকে বলল, “চল মা, আমি আর কোনোদিনও দুষ্টুমি করব না তোমার সবকথা শুনব আর ওখানে গেলে সেই পরিদের দেখা পাওয়া যাবে আমরা ওদের দেওয়া শিশির লাগিয়ে বাবাকে স্বপ্নে দেখব
হমুর মা বলল, “ঠিক আছে, আমি একটু ভেবে দেখি এ জায়গায় তোমার বাপঠাকুর্দার বাস ছিল হুট বললেই যাওয়া যায় নাকি! কত স্মৃতি এখানে!”
আপাতত ঠিক হল হুপহুপ হনুমান, প্রজাপতি, টিয়ার দল, ফড়িং এরা সব আসবে একদিন করে হমুর সাথে দেখা করতে এই কথা দিয়ে তবে সবাই নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা দিল রাতে মাংস খেয়ে হমু মায়ের পেট ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সারারাত সে স্বপ্ন দেখল, সে নতুন বন্ধুদের সাথে খেলছে, মজা করছে চাঁদ নেমে এসেছে মাঠে সেও খেলছে তাদের সাথে সুন্দর পরিরা তাকে স্ফটিকের দোলায় দোলাচ্ছে হমু স্বপ্নে প্রজাপতির মতো উড়ছে হঠাৎ একটা গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল সে যেই না মাটিতে পড়া, ঘুমটাও গেল ভেঙে চোখ তাকিয়ে দেখল সে নিজের গুহার মধ্যে শুয়ে ব্যস, আর যায় কোথায়! আবার কান্না শুরু তার, “আমি প্রজাপতির দেশে যাবোওওও
অনেক কষ্টে মা আদর করে আবার ঘুম পাড়ায় তাকে

নতুন বন্ধুরা আসে, খেলে চলে যায় কিন্তু হমুর দুঃখ আর কাটে না সে বায়না করতেই থাকে যে সে নতুন বন্ধুদের সাথে ওই জঙ্গলে গিয়ে থাকবে হমু খায় না ঠিক করে একা থাকলে হমুর সেই দুষ্টুমিও নেই রাত হলে আকাশের তারা গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার সকালে উঠে ছোট্ট ছোট্ট থাবার মধ্যে মুখ রেখে জঙ্গলের পথে তাকিয়ে থাকে কখন আসবে বন্ধুরা খাবার কম খেয়ে ক্রমশ সে রোগা দুর্বল হতে লাগল তখন হমুর মা চিন্তায় পড়ল সে ঠিক করল, তারা নতুন গুহায় গিয়েই থাকবে রঙলি প্রজাপতিকে দিয়ে হুপহুপ হনুমানকে খবর দিল হুপহুপ এলে মা-বাঘ সব বিস্তার করে বলল হুপহুপ খুবই খুশি সে বলল, “তুমি জিনিস গোছাও, আমি আসছি
ওমা, কিছুক্ষণ বাদে মা-বাঘ দেখে একদল ফড়িং-ব্যান্ডপার্টি নিয়ে হাজির হুপহুপ হনুমান একদল প্রজাপতি সুন্দর ছোটো ছোটো ছাতা নিয়ে এসেছে তারা চলেছে ফড়িংদলের পেছনে ছাতা-নাচ করতে করতে সবাই এসেছে ছানাবাঘকে আড়ম্বর করে নিয়ে যাবে বলে
হমুর খুশি দেখে মাও খুশি হয়ে গেল
তারপর সবাই একসাথে খুশি মনে চলল প্রজাপতি-দেশে সেখানে গিয়ে দেখে তাদের জন্য নদীর পাশে একটা গুহা ফুল দিয়ে সাজানো রানি প্রজাপতি মধু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের ওয়েলকাম করতে গুহা পর্যন্ত পথ ফুলে ঢাকা হমু মাকে নিয়ে ঢুকল গুহায় নানাফুলের গন্ধে ভরপুর গুহার ভেতর সন্ধে তখন ঘনিয়ে এসেছে হুপহুপ হনুমান তাদের খাবার দিল সবাই বিদায় নিল
ঠিক রাতের বেলা হমু মাকে নিয়ে গেল তারাদের মাঠে মা-বাঘ অবাক অমন দৃশ্য দেখে অনেকদূরে আকাশ যেথায় মাঠ চুমেছে সেখানে এক আলোর মেলা হমু আর তার মা দেখল ছোটো ছোটো পরীদের কাঁধে চাপানো স্ফটিকের পালকিতে বসে আছে হমুর বাবা মুখে তার হালকা হাসি
_____
অলঙ্করণঃ মঞ্জিমা মল্লিক