নতুন বন্ধু
রম্যাণী
গোস্বামী
।। ১ ।।
টম
অনেকক্ষণ ধরে নেচেকুঁদে আর ভেংচি কেটে ওকে হাসানোর চেষ্টা করলেও একফোঁটাও হাসি
পাচ্ছে না বুবুনের। টম এরপর হাল ছেড়ে দিয়ে করুণ মুখে ইশারা করে দেখাল বার্গার, পিৎজা আর ফ্রুট জুসের টিন। খুব খিদে
পেয়েছে হয়তো! তাতেও কোনও
ভ্রূক্ষেপ করল না বুবুন। বরং রেগে গিয়ে ও দুমদাম কয়েকটা ঘুষি মেরে বসল টমের মুখে।
আর তাতেই টম হাত-পা উলটে চিৎপাত। ফের উঠে গা-টা ঝেড়ে দাঁড়িয়ে
আছে তোম্বা মুখে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে বুবুন কিছু বলছে কিনা। বুবুনের থমথমে
মুখের দিকে তাকিয়ে একমনে দাঁত খুঁটতে শুরু করল ও।
আসলে
বুবুনের ভীষণ রাগ হচ্ছে টমের ওপর। গতকাল রাতে এত জোরসে গাড়ি চালিয়েও জেতা রেসে হেরেছে
ওরা। আর জিতবেই বা কেমন করে? ওই টমই তো পাশের সিটে বসেছিল। ওর জন্যই সোনা বোঝাই
ট্রাকটাকে ধরে ফেলতে গিয়েও ফসকাল। আর তারপর ডিভাইডারে ঠোক্কর খেয়ে চারবার পালটি
খেল ওদের গাড়ি। আহা! লাল টুকটুকে ফেরারি-খানা যে কী পছন্দের ছিল বুবুনের। রেস হারার শোকটা আবারও
চিনচিন করে উঠল বুকের ভিতর। আজ থেকে তোর সঙ্গে কাট্টি। যাঃ! – আগুন চোখে টমের
দিকে তাকিয়ে কথাটা ছুঁড়ে দিল বুবুন। তারপর উঠে যেতে যেতে ও শুনতে পেল টমও বিচিত্র
গলায় ওর দিকে তাকিয়ে বলছে, আজ থেকে তোর সঙ্গে কাট্টি। যাঃ!
ভেজা চোখে উঠোন পেরিয়ে বাগানের
দিকটায় চলে এল বুবুন। বাগান বলতে দাদানের বাড়ির পিছনের দিকে বাউন্ডারি ঘেরা জমিতে
কয়েকটা ফুলগাছ, পাঁচিল ঘেঁষে বারোটা সুপারি গাছ আর বেশিরভাগই আগাছা, ঝোপঝাড়ে ভরা জায়গাটা। একেবারে
শেষপ্রান্তে টিনের চালের তলায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট ঘর। জানালার পাল্লাদুটো
বন্ধ। কাঠের নোনাধরা দরজায় মরচে পড়া তালা ঝুলছে। বাগানের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে
শীতের মিষ্টি রোদ্দুর গায়ে মেখে নিতে নিতে বুবুন আপনমনে পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে
ছোটো ছোটো চৌকো খোপ কাটতে লাগল মাটিতে। এটা হবে ওর ফার্ম ভিলেজ। এইখানে ও চাষ করবে
স্ট্রবেরী, ক্যাবেজ আর তার পাশে লেটুস, টম্যাটো। ওদিকটায় তৈরি করবে পোলট্রি।
সাতদিনের মধ্যে তিন ক্রেট মুরগির ডিম মার্কেটে সেল করতে হবে। সঙ্গে এক বাস্কেট
ফ্রুট জ্যাম। তাহলেই ফার্স্ট টার্গেট রিচড। কিন্তু হারভেস্ট করে জিনিসগুলো তুলে
রাখবে কোথায়? হুম! স্টোরেজ একটা
চাই।
আঙুল
দিয়ে নিজের জমির সীমানা তৈরি করতে করতে ও আবার এসে পড়ল পুরোনো
ঘরটার সামনে। এই ঘরটা জাস্ট কোনও কাজে আসছে না। টোটাল ওয়েস্টেজ অফ ল্যান্ড। এটাকেই
তো স্টোরেজ বানানো যায় অনায়াসে! কিন্তু চাবি? চাবি কোথায় পাবে? মুখ ফিরিয়ে এদিক
ওদিক তাকাতেই বুবুন দেখতে পেল ঠাম’কে। দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে ওকে খুঁজতে খুঁজতে
এদিকেই আসছেন। বুবুনকে দেখে ভুরু কুঁচকে গেল ঠামের। চোখ পাকিয়ে বললেন, “সারাটা সকাল
কিছু খাওয়া নেই, আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরছ কেন? চলো মা ডাকছে তোমাকে। স্নান করো।”
ঢকঢক করে দুধটা শেষ করে গুড
বয়ের মতো হাসিহাসি মুখে বুবুন খিমচে ধরল ঠামের কনুই। আবদারের সুরে বলল, “ও মামমাম,
এই ভাঙা ঘরটার চাবি আছে তোমার কাছে? দাও না প্লিজ। তাহলে তোমার সব কথা শুনব।” বলতে
বলতেই বুবুনের চোখ চলে গেল ঠামের কোমরের দিকে। চিকনপাড় সাদা শাড়ির কুচির ভাঁজে
ঝুলছে বিভিন্ন সাইজ আর শেপের ছোট বড়ো অসংখ্য জং ধরা ও চকচকে চাবির গোছা। বুবুনের
উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন ঠাম। তারপর তাকালেন সেই ভাঙা ঘরের দিকে। ধীর
গলায় বললেন, “এই ঘরে কী কাজ তোমার? এ তো আস্তাকুড়ে বোঝাই সাপ খোপের আড্ডা।”
“ধুর, তুমি কিছু জানো না। এই
শীতে সাপ আসবে কোথা থেকে? ওরা তো সবাই এখন হাইবারনেশনে রয়েছে।”
“কী নেশন?” ঠাম অন্যমনস্ক
চোখে তাকিয়ে আছেন ওই ভাঙা ঘরের দিকে। হঠাৎ বললেন, “কর্তামশাই একবার খুব রেগে
গেলেন। রেগে আগুন যাকে বলে। খোকা ইশকুল থেকে ফিরে
এসেই চলে গেছে ফুটবল পেটাতে। সন্ধ্যাবেলা তুলসীতলায় সাঁঝবাতি দেখাতে দেখাতে ভয়ে
কাঁপছি আমি। খোকা ফিরলে না জানি কপালে কী আছে ওর!”
“খোকা মানে তো বাবা?” কথার
মাঝখানেই জিগ্যেস করল বুবুন।
“হ্যাঁ, তোমার বাবা। এখন যেমন
দিনরাত কাজে ব্যস্ত, গম্ভীর,
চোখে চশমা পরা লোকটি, ছোট্টবেলা সে ছিল তেমনই দস্যি। দিনরাত খেলা আর বাড়িতে ফিরে
মুখের কাছে গল্পের বই নিয়ে বসা। পড়ানোর
মাস্টার এলেই দে ছুট। বিচ্ছু যাকে বলে। আর কিছু
ডাকাবুকোও ছিল তোমার বাবা। বাপরে বাপ! তখন খোকা তোমার মতো ইস্কুলে পড়ে। আমাদের এই
জায়গাটায় এত ঘরবাড়ি দোকানপাট হয়নি। কাছেই তুরতুরি নদীতে মাছ ধরতে যেত এখানকার
লোকে। নদীর ওপাশেই মাইলের পর মাইল ঘন বাঁশের জঙ্গল। সন্ধ্যার পরে নাকি ওই বাঁশবন
থেকে শোনা যেত নানা আওয়াজ। খিলখিলে হাসি, বাচ্চার কান্না এইসব। তা একবার খোকা ও
তার বন্ধুরা ঠিক করল ওখানে যাবে সেই রহস্য উদ্ধারে।”
“ওয়াও! গ্রেট! কিন্তু তুমি
বারণ করলে না?”
“আমাকে কি আগে বলেছিল নাকি?
এসব পরে শুনেছি ওর মুখে।”
“তারপর? তারপর কী হল মামমাম?”
গল্পের গন্ধ পেয়ে বুবুন জাপটে ধরল ঠামের কোমর।
সিমেন্টের উঠোনে দুটো বেতের
মোড়ায় অলস রোদে গা এলিয়ে দিয়ে বসল দুজনে। টীটী-টীটী শব্দে যেন একটা সবুজ পর্দা সাঁ
করে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। ঠামি ঘুম ঘুম গলায় বলে চললেন, “তখন সন্ধ্যা নেমেছে
বনে। শীতের কুয়াশা ঝুপসি হয়ে বসে আছে ঝোপেঝাড়ে, নদীর বাঁকে। জলের ভিতর ঘাই মারছে
মাছ, ব্যাঙাচি আর নানা সরীসৃপ। তোমার বাবা দুই বন্ধু নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নাক বরাবর।
আকাশে চাঁদ কুয়াশায় ঢাকা। ফিকে আলোয় দূরে দেখা যাচ্ছে তুরতুরি নদীর বাঁক। বাঁক পেরোলেই
শুরু সেই কুখ্যাত বাঁশবন। এমন সময় নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা আওয়াজ ভেসে এলো সেদিক থেকে।”
“কী আওয়াজ ঠাম?”
“একটা ছোটো বাচ্চার কান্নার
আওয়াজ। ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া!”
“রিয়েলি? কেউ কি লুকিয়ে ছিল
ওখানে?” রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল বুবুন। আরেব্বাস! এ তো একেবারে মিসট্রি-কেস-ফাইল গেমস!
এমন কি সত্যি সত্যিও হয়?
“শোনো না। এক বন্ধু তো খুব ভয়
পেয়ে ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু বেঁকে বসল তোমার বাবা আর দিপু। দিপুকাকু, যিনি এখন এখানকার বিডিও।”
“তারপর?”
“ওরা বাঁক পেরিয়ে ঢুকে পড়ল
বাঁশবনের ভিতরে। শুনশান চারিদিক। ঘন কুয়াশায় উঁচু উঁচু বাঁশগাছের মাথাও দেখা
যাচ্ছে না। হঠাৎ খুব কাছে একটা খসখস আওয়াজ হল। ওরা চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে, এই
দ্যাখো দাদুভাই, বলতে বলতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে,” ঠাম ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন
বুবুনের দিকে।
“কী দেখল? একটা ভ্যাম্পায়ার?”
“নাহ, ওরা দেখল ওদের ডানদিকের
দুটো লম্বা বাঁশগাছ হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকি খেয়ে দুলে উঠল। অথচ
গাছে কিচ্ছু নেই। ফাঁকা। নদীর দিক থেকে কোনও হাওয়া আসছে না। অন্য গাছগুলো স্থির
হয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর দুলতে দুলতে গাছদুটো খুব কাছাকাছি এসে পেঁচিয়ে ধরল একে অপরকে।
যেমন করে সাপেরা পেঁচিয়ে ধরে নিজেদের। ঠিক তেমনি।”
“ভ্যাট! হতেই পারে না।
হ্যালুসিনেশন।”
“কী নেশন?” আবারও ভুরু কুঁচকে
বললেন ঠাম।
“ওরা চোখে ভুল দেখেছে মামমাম। মনের
ভুল এসব।”
“তিনজন একই ভুল দেখল? তা কি
হয়? যে বন্ধু প্রথমে ভয় পাচ্ছিল তার তো সে রাতেই ধুম জ্বর এল। ওই অলুক্ষুণে জায়গায়
ওরা অবশ্য আর এক মিনিটও দাঁড়ায়নি। পালিয়ে এসেছিল। তখনও এক নাগাড়ে কানে ভেসে আসছিল
ছোটো বাচ্চার কান্নার স্বর।”
“যাহ্! বাবা সলভ করতে পারল
না মিস্ট্রিটা?” বুবুনের গলায় হতাশা।
“দূর পাগলা! ওঁদের সঙ্গে কি
কেউ পারে? ভূত প্রেত অপদেবতা যে রে! তবে আমার সাহসী খোকা কেবলমাত্র ভয় পেত
একজনকেই। তিনি হলেন কর্তামশাই।” এই বলে ঠাম মোড়া থেকে উঠতে গেলেন আর সঙ্গে সঙ্গে বুবুন
হাত চেপে ধরল ঠামের, “দাদুভাই রেগে গিয়ে কী করেছিল সেদিন বললে না তো মামমাম? খেলার
মাঠ থেকে ফেরার পর খুবসে পিট্টি দিয়েছিল বাবাকে?”
“ওহ, হ্যাঁ, ওই যা বলছিলাম,”
কথার খেই ফিরে পেয়ে বললেন ঠাম, “কর্তামশাই
ছেলের গায়ে হাত তোলা পছন্দ করতেন না বিশেষ। উনি বলতেন যে মার খেলে তো ছেলেপিলের
মারের ভয়টাই চলে যাবে একদিন। তার চাইতে অন্য ওষুধে কাজ দেয় ভালো। তখন সবে সাঁঝ
নেমেছে। তুলসীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে দাওয়ায় উঠে দেখি কর্তামশাই জমির
কাজের তদারকি সেরে ফিরে এসেছেন এবং ঘর বার করছেন। রাগে তাঁর ফরসা মুখটা লাল
দেখাচ্ছে শিখার আলোয়। আমাকে দেখেই উনি হনহন করে খোকার ঘরে ঢুকে পড়লেন। পিছু পিছু
গেলাম। দেখি একটা মাঝারি মাপের সুপারি কাঠের বাক্সের ভিতরে থরে থরে সাজানো আছে
খোকার প্রাণ - ওর সাধের গল্পের বইগুলো। উনি বাক্সের ডালা বন্ধ করলেন। তারপর
চিরকালের জন্য ওটা সরিয়ে দিলেন খোকার নাগালের বাইরে।”
“গল্পের বই?” অস্ফুটে বলল
বুবুন। ওর চোখের তারা চঞ্চল হয়ে উঠল। “দাদুভাই কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল ওই বক্সটা? বলো
না মামমাম। বাবা আর খুঁজেই পেল না ওটা?”
“না রে। পায়নি। দু’রাত ঘুমোয়নি
খোকা। নাওয়া খাওয়াও প্রায় বন্ধ। তারপর কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। এখানে লেখাপড়ার
পরিবেশ ঠিকঠাক ছিল না বলে ওকে কিছুদিন পরে পাঠিয়ে দেওয়া
হল কলকাতার ইশকুলে। সেখান থেকে প্রথমবার ছুটিতে যখন সে বাড়ি এল তখন কোথায় আমার সেই
দামাল ছেলে? এ তো শান্তশিষ্ট, লক্ষ্মী ছেলে! পড়াতেও দেখলাম মন বসেছে বেশ। ওই
গল্পের বইগুলোর কথা ততদিনে হয়তো ভুলেই গেছে সে। চলো দাদু, স্নান করবে চলো।”
বুবুন তবু নড়ল না। ঠামের কনুই
ধরে বলল, “আই গেস, ওই পুরোনো ঘরটাতেই আছে বইগুলো। তাই
না? তুমি নিশ্চয়ই জানো।”
“আহ! চলো তো এবার! আর থাকলেই
বা কী? এতদিনে সে সব গেছে ঘুণের পেটে। চলো চলো। বেলা হয়েছে,” আবারও তাড়া দিলেন
ঠাম।
পরের আড়াই ঘণ্টা বুবুন চুপচাপ
লক্ষ্মী ছেলের মতো স্নান করল। বিনা বাক্যব্যয়ে খাওয়ার পাতে শুরুতেই উচ্ছে সেদ্ধ
দিয়ে ভাত মেখে খেল। মাছ খাব না বলে নাক সিঁটকাল
না। আর মা যখন বললেন, এই যে বাবু, আর একদিন ঠামের আদর খেয়ে নাও। পরশু
আমরা ফিরে যাচ্ছি। সোমবার থেকে স্কুল। সে উত্তরে ঠোঁট পর্যন্ত ফোলাল না। বরং শান্ত
ছেলের মতো বালিশে মাথা দিয়ে চোখ বুঝল এবং দু’মিনিটের মধ্যেই ঘুমে কাদা হয়ে গেল।
।। ২ ।।
তখন দুপুর
তিনটে। চোখ পিটপিট করে খাটের ওপর উঠে বসল বুবুন। সমস্ত বাড়ি
নিস্তব্ধ। ঠাম ঘুমিয়ে আছেন নিজের ঘরে। মায়েরও কোনও সাড়া শব্দ নেই। পা টিপে টিপে
ঠামের ঘরে ঢুকে টেবিল থেকে চাবির গোছাটা তুলে নিয়েই এক দৌড়ে বাগানে এল ও। পুরোনো ঘরের
দরজায় ঝোলানো জং ধরা তালাটা খুলতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। দু-তিনটে মরচে পড়া চাবির
মধ্যে একটা দিব্যি খাপে খাপে গেঁথে গেল। একটানা ঘুঘুর ডাক মেশানো নিঝুম দুপুরকে
চমকে দিয়ে ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হল দরজায়। বুবুন এসে দাঁড়াল ধুলোর আস্তরণে ঢাকা
ঘরের মাঝখানে। ওর মুখে-চোখে জড়িয়ে গেল ঘন মাকড়সার জাল। পায়ের কাছে একটা চিকচিক
আওয়াজ হতেই লাফিয়ে উঠল বুবুন। ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে ছুঁচো ইঁদুর আরশোলা। তারপর বাতিল
জিনিসপত্রের ভিড়ে বুবুন খুঁজতে লাগল ওর গুপ্তধন। হিডেন অবজেক্ট গেমসগুলো খেলার সময়
যেমনটা হয়, তার চাইতেও বেশি উত্তেজনায় ঢিবঢিব করছে ওর বুকের ভিতরটা। কোথায়? কোথায়
লুকিয়ে আছে সেই চৌকো শেপের কাঠের বক্স? বুবুনকে যে খুঁজে পেতেই হবে ওটা।
শেষমেশ
পাওয়া গেল। সিমেন্টের একটা বড়ো রিং-এর ভিতরে এনামেলের তোবড়ানো বালতি, ফুটো কড়াই,
একগোছা দড়ি – এ সব হাবিজাবি জিনিসপত্রের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল ওটা। বুবুন হুমড়ি
খেয়ে পড়ল বাক্সটার ওপর। তাড়াহুড়োয় ডালাটা খুলতে যেতেই মচাৎ করে ভেঙে গেল সেটা।
অদ্ভুত একটা সোঁদা সোঁদা পুরোনো গন্ধ এসে ধাক্কা দিল ওর নাকে। বাক্সের ভিতরে
ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া বিবর্ণ বই এর খসে যাওয়া পাতাগুলোর দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকল
ও। তারপর হাতটা ঢুকিয়ে দিল আরও ভিতরে। কোথায় সেই মোটা চামড়ার হার্ড বাইন্ডিং করা
নীল কভারের বই? বাবার কাছে ছোট্টবেলা থেকে ওটার কথা শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে ওর।
পাগলের মতো ক্ষয়ে যাওয়া কাগজের স্তূপ সরাতে সরাতে ক্রমশ বাক্সের তলার দিকে পৌঁছে
গেল ওর হাত। কনুই অবধি কাগজে ডুবে গেছে যখন এমন সময় হাতে ঠেকল শক্তমতন কিছু।
পেয়েছি!
উফ! নাউ আই অ্যাম দ্য কিং অফ দ্য ওয়ার্ল্ড! আনন্দে দু’পাক ঘুরে নিল বুবুন। তারপর
খুব সাবধানে বুকের কাছে অনেকটা ডায়েরির মতো দেখতে বইখানা জড়িয়ে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে
এল সে।
ছোটো
থেকে ঘুমচোখে যতবার ও বাবার কাছে গল্প শুনতে চেয়েছে, বাবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা গল্প
অনেকবার বলেছেন ওকে। অসমাপ্ত একটা গল্প। ওরই বয়সি ছোট্ট এক ছেলে মা-বাবার সঙ্গে
বেড়াতে গিয়েছিল এক বনবাংলোয়। দূরে ভুটান পাহাড়। ছেলেটা পথ হারিয়ে একা একা চলে যায়
ওই পাহাড়ের বুকে। আরও কিছুটা বলেই আচমকা থেমে যেতেন বাবা। বুবুন বাবার গলা জড়িয়ে
ধরে জিজ্ঞেস করত, ‘তারপর? তারপর কী হল?’ প্রত্যেকবারের মতো বাবা কোনও উত্তর দিতে
পারতেন না। ম্লান মুখে বলতেন, ‘জানি না। কোথায় যে হারিয়ে গেল বইটা! গল্পটা সবে পড়া
আরম্ভ করেছিলাম। বড়ো হয়ে কলকাতার বই-বাজারে অনেক খোঁজ করেছি। পাইনি। পাব কী করে?
বইটার নাম, কে লেখক, কিছুই তো মনে নেই।’
বাবার
গলার স্বরের মনখারাপ ভাবটা চারিয়ে যেত বুবুনের মধ্যেও। কী হল যে বাচ্চা ছেলেটার?
ভেবে ভেবে আকুল হয়ে উঠত ও। নিজের কল্পনায় কতবার কতরকমভাবে সাজিয়েছে ও গল্পের পরের
অংশটা। আজ যেটা ওর দু’হাতের মুঠোয়। মুচকি হাসল বুবুন। কলকাতায় ফিরেই বাবার সঙ্গে স্কাইপে কথা হবে। তখনই কি গল্পের
শেষটা বলে চমকে দেবে ও বাবাকে? নাহ, থাক। বাবা আগে ফিরুক তো হায়দ্রাবাদ থেকে। এসেই
নিজের স্টাডি টেবিলের ওপর বইটা দেখে যে কী অবাক হয়ে যাবে!
দাদান
বাড়ির কাছে পুকুরপাড়ে সিমেন্টের বেদিতে বসে। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বুবুন খুব
সাবধানে উলটোল বইয়ের মলাট। কভারের জায়গায় জায়গায় পোকায় কেটেছে। প্রথম পাতার অবস্থা
শোচনীয়। নামটাও পড়া যাচ্ছে না বইয়ের। তাড়াতাড়ি পাতা উলটোল বুবুন। শুরুর দু’লাইন
পড়েই ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ, ঠিক। মিলে যাচ্ছে সব। এই সেই গল্প! কোনও ভুল নেই।
তৃতীয় পাতায় এসে পড়ল বুবুন। ছোট্ট ছেলেটার নাম শিব। ও এখন বাবা-মায়ের সঙ্গে হাতির
পিঠে চেপে জঙ্গল সাফারি করছে। কী কী দেখতে পাবে তাও জানে বুবুন। দুটো বাইসন আর
একটা রাইনো। নীল রঙের বড়ো বড়ো অক্ষর। লেখাগুলো আবছা হয়ে এলেও বেশ পড়া যাচ্ছে।
আরও
চারটে পাতা পড়ে ফেলল বুবুন। শিবের সেদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে। কীভাবে যেন
বাংলোর কাঠের গেটটা খোলা পেয়ে ও বেরিয়ে এল বাইরে। বাংলোর সামনে পরিখা কাটা। শীতকাল
বলে সেখানে জল কম। সেই গোড়ালি জল পেরিয়ে উলটোদিকের গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ল শিব। বাব্বা! এ
যে একেবারে ‘জাঙ্গল বুক’ এর মোগলি! সাত নম্বর পাতায় এসে বুবুনের দম আটকে গেল
উত্তেজনায়। প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে শিব আশ্রয় নিয়েছে একটা গুহার ভিতরে। হঠাৎ দেখতে
পেল নীচের রাস্তা দিয়ে উঠে আসছে এক ছায়ামূর্তি। ছপছপ আওয়াজ হচ্ছে তার ভারি পায়ের।
কে ও? মানুষ? নাকি অন্যকিছু? ভয়ে কেঁপে উঠল শিব।
পাতা ওলটাতেই থমকে গেল
বুবুন। এতক্ষণ যদিও বা ঝাপসা অক্ষরগুলোর ওপর নাক ঠেকিয়ে সেগুলো উদ্ধার করা
যাচ্ছিল, কিন্তু এই পাতা থেকে সব হলুদ। কিচ্ছু পড়া যাচ্ছে না। পরের পাতাগুলোরও একই
অবস্থা।
গল্পটা
বাবার মতো তারও অজানাই থেকে গেল চিরকালের জন্য!
স্তব্ধ
হয়ে বসে থাকল বুবুন। পাখিরা সব ঘরে ফিরছে। একসময় গালে হাত ছুঁইয়ে সে দেখল দু’চোখের
কোলে ভেজা ভেজা শিশির জমেছে। বইটা আদর করে ও বুকে চেপে ধরল। কমলা বলের মতো
অস্তগামী সূর্যের নরম আলোয় ভিজে আছে ফেরার রাস্তা। উঠে দাঁড়িয়ে সেই আলোর রাস্তা
ধরে চলতে চলতে বুবুন টের পেল ওর বুকের ভিতর থেকে না পাওয়ার অতৃপ্তি ঠেলে উঠে আসছে
একটা অন্যরকম তাগিদ। সেটা যে আদতে ঠিক কী তা ও নিজেও বুঝতে পারল না।
।। ৩ ।।
বুবুনের
মা ভারী অবাক হয়েছেন। তাঁর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া, দিনরাত কমপিউটার গেমসে মুখ গুঁজে
থাকা ছেলের হঠাৎ এবার শীতের ছুটিতে তার দাদান-বাড়ি গিয়ে ক’দিন কাটিয়ে আসার পর থেকে
এমন ভোলবদল! এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার! মনে মনে অবশ্য প্রচণ্ড খুশি হয়ে উনি
স্টাডিরুমের চারটে কাচের আলমারির তালাগুলো খুলে দিয়েছেন। বুবুনের বাবার কালেকশন
সব। উনি কাজের চাপে সময় পান না আর। ধুলো জমে যাচ্ছিল বইগুলোর ওপর। গুনগুন করে
গান গাইতে গাইতে বুবুনের মা যত্ন করে ঝেড়েছেন সব মহানন্দে।
বুবুনের
এক বন্ধু টমের কিন্তু মনটা বড্ড খারাপ। সে মাঝেমাঝেই মায়ের ট্যাবের ভিতর থেকে কুঁই
কুঁই করে বুবুনকে ডাকে কিন্তু ওর সাড়া পায় না। নতুন বন্ধুদের পেয়ে বুবুন কি ওকে
ভুলেই গেল?
আর
বুবুন? সে এখন মন দিয়ে ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ছে।
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি
চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment