আজাদ
হিন্দের ডায়েরি
রাজীবকুমার
সাহা
এ আমার কেমন
বাতিক কে জানে, বেড়াতে
গেলে একা ছাড়া দোকা কাউকে সঙ্গে নিতে মন চায় না কখনওই। এ নিয়ে স্ত্রী-পুত্র, বন্ধুবান্ধবদের
সঙ্গেও মনোমালিন্যের চূড়ান্ত। এবারও স্কুলে গরমের ছুটি পড়তেই নিজের টিকিটটা কেটে
ফেললাম গোপনে। এ-যাত্রায় অবশ্য আমার ক্লাস এইটে পড়া একমাত্র সন্তান রাতুলকে সঙ্গে
নিলেও হত। ওরও তো স্কুলে ছুটি পড়েছে। তাছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, এবারে যে
জায়গাটায় যাচ্ছি সেখানে ছেলেটাও সঙ্গে থাকলে দারুণ একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হত ওর।
সেখানকার প্রতিটি বালুকণায় লেখা রয়েছে এক বাঙালি বীর সন্তানের অসফল গৌরবগাথা। কিন্তু
ওই যে, বাতিক।
সওয়া তিনটে
নাগাদ এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে একটা ক্যাব ভাড়া করে যখন বিনয়ের ওখানে গিয়ে উঠলাম
তখন ঘড়িতে প্রায় সন্ধে সাতটা। প্রায় একশো দশ কিলোমিটার পথের তিন থেকে সাড়ে
তিনঘণ্টার সফর। কখনও সমতল জনপদ পাশ কাটিয়ে পাকদণ্ডী বেয়ে গাড়ি উঠে গেছে আকাশের গায়ে।
তখন ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ মেখে শিরশিরে ছুটকো মেঘ ঢুকেছে খোলা জানালা ডিঙিয়ে। নাক-মুখ, চোখের পাতা
ভিজে গেছে শিশির মেখে। কখনও গাড়ি নেমে গেছে মরণ-খাদের পাড় ঘেঁষে। টিক, গর্জন, গামার, জারুল, পাইন - আরও
কত কী জানা-অজানা সুনিবিড় গাছগাছালি ঘেরা ছোটো ছোটো পাহাড়গুলোর থাকে থাকে টিনের
ছাউনির বাড়িঘর। আঙিনায় হাসছে নানা জাতের ফুল-অর্কিড। মনোরম পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে
শেষে গিয়ে হাজির হলাম ভারত-মায়ানমার সীমান্ত-শহর মোরেতে। সেখানেই বিনয় থাকে।
স্কুল-কলেজে একসঙ্গে পড়াশুনো আমাদের। পরিবার কলকাতায়। মোরের ইন্দো-মায়ানমার রোডের
ওপরই ওর পোস্ট অফিস। থাকেও ঠিক পেছনেই ভাড়াবাড়িতে। ঠিকানা এতই সহজ যে পৌঁছে যেতে
সমস্যা হয়নি মোটেও। বিনয় শুধু সাবধান করে রেখেছিল যে সন্ধের পর যাতে অকারণ দেরি না
করি।
বারান্দাতেই
বসেছিল সে অফিস ফেরত। আমায় দেখতে পেয়ে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে তারও একই মন্তব্য, “ঠিক একাই
এলি এবারেও! আরে ছেলেটা বড়ো হয়েছে, নিয়ে আসতে পারতিস তো! তোদের ওই কালো
ধোঁয়ার বদলে ক’টা
দিন ফ্রেশ এয়ারে থেকে যেত।”
পাত্তা না
দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম সটান। বিনয় পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, “কফি করছি, দাঁড়া।
ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নে। ওই যে শেষের দরজাটা, যা।”
থাকব দিন
তিনেক। মোরের চারদিকটা একটু ঘুরেফিরে যাব।
মণিপুরের
মোরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গেটওয়ে হওয়ার সুবাদে বেজায় ব্যস্ত এক বাণিজ্যিক শহর।
আদিবাসীরা সব কুকি উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও বাঙালি, তামিল, নেপালি, মৈতৈ, পাঞ্জাবি, তেলেগু, বিহারি, মাড়োয়ারি কে
নেই এখানে।
শুনেছি মোরে
থেকে অনায়াসেই নাকি মায়ানমারের ভেতরে প্রায় ষোলো কিলোমিটার ঢুকে বেড়িয়ে আসা যায়।
আমার আসলে মোরে আসার মুখ্য উদ্দেশ্য ওটাই। আসাম রাইফেলস সেনাবাহিনীর তরফে
ইন্দো-মায়ানমার ফ্রেন্ডশিপ গেট পেরিয়ে মায়ানমারের তামু পর্যন্ত প্রবেশাধিকার মেলে
আট ঘণ্টার জন্যে।
পরদিন বিনয়
অফিসে পা বাড়াতেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। ও যদিও আজ হাফ-ডে ছুটি নিয়ে দুপুরের পর
আমাকে নিয়ে বেরোবে বলে গেছে। তবুও কাছাকাছি যতটুকু ঘোরা যায় একবেলায়। পরশু রোববার।
সেদিন আমরা মায়ানমারের তামু বেড়াতে যাব প্ল্যান করেছি। সোমবার ফিরে যাব।
মন মানল না।
একাই বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। আকাশের মুখ ভার। মেঘের শান্ত ছায়ায় ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে
মন্দ লাগছিল না। এ-রাস্তা ও-রাস্তা, এ-দোকান সে-দোকান করে বেড়াচ্ছি।
তারপর একসময় কখন যে পা দুটো ফ্রেন্ডশিপ গেটের দিকে রওনা দিল খেয়াল নেই। একটা ঘোরের
মধ্যে ছিলাম যেন। পাহারায় থাকা আসাম রাইফেলস বাহিনীর কাছে নিজের পরিচয়পত্র দাখিল
করে দশ টাকার একটা এন্ট্রি ফির কুপন পকেটে পুরে পা রাখলাম মায়ানমারের মাটিতে। গাটা
শিরশির করে উঠল। অচেনা রাস্তায় খানিক এগোতেই একটা গাড়ি থামিয়ে চেপে বসলাম। পাতলা
গাছপালার মাঝ বরাবর সোজা পিচঢালা রাস্তা চলে গিয়েছে। কিন্তু আনন্দের বদলে কী একটা
অস্বস্তি হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। গাড়ি কয়েক কিলোমিটার এগোতেই নেমে গিয়ে বিক্ষিপ্ত
হাঁটাপথ ধরলাম। সুনির্দিষ্ট গন্তব্য জানা নেই। হাঁটতে হাঁটতে তামু নামে একটা জায়গা
পড়বে এতটুকু মাথায় আছে।
কিলোমিটার
তিনেকও হাঁটিনি বোধহয় তখনও। বাঁহাতি একটা কাঁচা রাস্তা কী করে যেন পুরো শক্তি টেনে
নিল আমার পা দুটোর। মাথার ওপর তখন মনের একচ্ছত্র আধিপত্য। এগোতে লাগলাম জোর পায়ে।
চারদিক যেন ঝিম মেরে আছে। শুনশান রাস্তা। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে চলেছি।
সংবিৎ ফিরে পেলাম আচমকা নেমে আসা নাকে-মুখে দু-চারটে তিরের ফলার মতো বড়ো বড়ো
বৃষ্টির ফোঁটায়। দৌড়ে একটা বড়ো ঝাঁকড়া গাছের তলায় দাঁড়াতেই কোত্থেকে আরেকজন লোকও
দৌড়ে এসে আশ্রয় নিলেন। পাগড়ি, গালপাট্টায় ইয়া দশাসই চেহারা। বয়সের গাছপাথর নেই। অজস্র
বলিরেখা কাটাকুটি খেলছে সারা মুখে। কিন্তু শরীর ভাঙেনি মোটেও। খানিক অপলক তাকিয়ে
থেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“যানা কিত্থে হ্যায়,
সাবজী? বঙ্গালী
দিখতে হ্যায়।”
অস্বস্তিতে
পড়ে গেলাম ভীষণ। বিদেশ-বিভূঁই, তার ওপর অমন একজন অপরিচিত দশাসই মানুষের সঙ্গে এই নির্জন
দুর্যোগে… বুঝতে
পারছিলাম না ঠিক কী করা উচিত। তবে অতটুকু ভেবে নিজেকে আশ্বস্ত করছিলাম যে লোকটা
আমারই দেশবাসী।
পাগড়িওয়ালা
আমার মনের অবস্থাটা আঁচ করতে পেরেছিলেন কি না জানি না, একটু মিষ্টি
হেসেই বললেন, “ম্যায়
রঘুবীরা, রঘুবীরা
খত্রী। পঞ্জাব দা রহনেওয়ালা থা। আপ, স্যরজী?”
শুকনো মুখে
জোর করে একটুকরো হাসি টানার চেষ্টা করে নিজের পরিচয় জানালাম। এরই মধ্যে বৃষ্টিটা
ঝেঁপে আসার তোড়জোড় শুরু করল। রঘুবীরা ব্যস্ত হয়ে প্রস্তাব করলেন, “চলুন চলুন, ওই
মন্দিরটায় গিয়ে মাথা গুঁজি। ওই যে সামনেই। পাহাড়ি বৃষ্টি, মর্জি বোঝা
দুষ্কর।”
রঘুবীরার
তর্জনী অনুসরণ করে চোখ ফেলে দেখলাম, সত্যিই তো, অনতিদূরেই
ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে উঁকি মারছে ভাঙাচোরা একটা মন্দিরের চূড়া। রঘুবীরা আমার চোখের
দিকে তাকিয়ে রয়েছেন নির্নিমেষ। না, প্রস্তাবটা নাকচ করতে পারিনি। দু’জনেই গিয়ে
উঠলাম মন্দিরটার ছোট্ট চাতালটায় আগাছা মাড়িয়ে। ভাঙাচোরা একটা কাঠের দরজা ঠেলতেই
আশ্রয় পাওয়া গেল ভেতরে। অপরিসর একটা গর্ভগৃহে প্রথমেই একটা ছোটো গর্তমতো নজরে এল
আবছা অন্ধকারে। খানিকটা তফাতেই একটা ষাঁড়ের মূর্তি হাঁটু ভেঙে বসে আছে। ও, তাহলে
শিবমন্দির ছিল এটা কোনও কালে! কৌতূহলবশে পাশেই পড়ে থাকা একটা শুকনো সরু ডাল দিয়ে
ঘেঁটে দেখলাম, গর্তটা
বেশ গভীর। সরে এলাম তাড়াতাড়ি। কে জানে, বিষাক্ত সাপখোপ হয়তো থাকতে পারে
লুকিয়ে।
ছড়িয়ে ছিটিয়ে
থাকা শুকনো লতাপাতা ঘষে ধুলোবালি যতটুকু সম্ভব সাফসুফ করে ভাঙা মেঝেতেই থেবড়ে বসে
পড়লাম দু’জনে।
বৃষ্টি না ধরলে বাইরে পা রাখার উপায় নেই। মনে মনে ভাবছিলাম, কত বছর আগে
এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল;
ফুলে-মালায়, ধূপে-ধুনোয়, ভক্তে-সন্ন্যাসীতে, শ্রদ্ধায়-নৈবেদ্যে
একদিন কতই না ধুমধাম ছিল তার। আর আজ দেখো…
চমক ভাঙল
রঘুবীরার গমগমে গলার আওয়াজে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “কলকাতার বাসিন্দা তো আপনি?”
খানিক
থতোমতো খেয়ে জবাব দিলাম,
“হ্যাঁ, কেন
বলুন তো? গেছেন
কখনও?”
রঘুবীরার
ঘোলাটে দৃষ্টি তখন ভাঙা দরজা পেরিয়ে বাইরের অঝোর ধারায় মিশে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বিড়বিড় করে বললেন,
“না, সে
সৌভাগ্য হয়নি। গেলে প্রথমেই নেতাজীর বাড়ির দরজাটায় মাথাটা ঠেকিয়ে আসতাম।”
অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করলাম, “নেতাজী!
সুভাষচন্দ্র? আপনি
জানতেন ওঁর কথা?”
রঘুবীরা একই
ভঙ্গিতে বসে আছেন। হাঁটুদুটো অর্ধেক ভাঁজ করে ওপরের দিকে ঠেলে তুলে দু’বাহু দিয়ে
বেড় দিয়ে রেখেছেন। চোখদুটোও বাইরে। কীসের মধ্যে যেন ডুবে রইলেন একটুক্ষণ। কী যেন
হাতড়ে বেড়াচ্ছেন প্রতিটি বৃষ্টিকণায়। তারপর একটা বিষণ্ণ হাসি টেনে বললেন, “নেতাজীর
সঙ্গে প্রথম দেখা হয় উনিশশো পঁচিশে। বন্দী ছিলেন মান্দালয় জেলে। বান্দা সিপাহী
ছিলাম ওই লালমুখো সরকারের। পঁচিশ থেকে সাতাশ পাক্কা দু’বছর নেতাজীর
সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। জ্যান্ত দেবতা, জানেন! সাতাশ সালে সাজা খতম হতেই
কোথায় চলে গেলেন। কী জাদু করেছিলেন জানি না, অনেক পরে খবর পেয়ে একদিন পালিয়ে
গেলাম সিঙ্গাপুরে। ততদিনে মোহন সিং দেবের হাত থেকে দায়িত্ব নিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের
চেহারা পালটে ফেলেছেন নেতাজী। সেই উনিশশো বিয়াল্লিশ। মাস খানেকের মধ্যে ওঁর খাস
আদমি হয়ে উঠেছিল এই রঘুবীরা। তারপর দায়িত্ব পেলাম রেঙ্গুনের। দু’মাসের
মধ্যেই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির হেড কোয়ার্টার সিঙ্গাপুর থেকে রেঙ্গুনে চলে এল।
সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা ইংরেজ কলোনিগুলোর ওপর। নেতাজী প্রায়ই কাঁধে হাত
রেখে বলতেন, রঘু, মনে রাখিস, আসন্ন ভোরের
ঠিক আগেই সবচেয়ে বেশি অন্ধকার জমা থাকে। আমরা ওই অন্ধকারটাতেই রয়েছি এখন। ভারত
স্বাধীন হবেই। আমাদের শুধু ওই কালান্তক অন্ধকারের জালটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে
উজ্জ্বল এক ভোরের আলোর পথ করে দিতে হবে।”
চুপ করে
গেলেন রঘুবীরা। আমি অবশ হয়ে বসে আছি পাশে। এ আমি কোথায় এলাম! কী দেখছি, কাকে দেখছি
চোখের সামনে! আজাদ হিন্দ বাহিনীর এক জলজ্যান্ত সৈনিক আমার সামনে বসে! যেভাবে
অবলীলায় বললেন কথাগুলো…
বিশ্বাস অবিশ্বাসের
দোলাচলে রুদ্ধশ্বাসে কখন সামনে বসা মানুষটার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছি খেয়ালই
ছিল না। মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছিল। আচমকা হুঁশ ফিরতেই শুধু এটুকু জিজ্ঞেস করতে
পারলাম, “তা-তারপর?”
রঘুবীরা
কেমন একটা শূন্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “নেতাজী যখন
প্রথম প্যালেল বিমানঘাঁটিতে নামেন তখন এই বান্দাই পৌঁছে দিয়েছিল গোপন ডেরায়। তারপর
আমার কাজ ছিল মায়ানমার থেকে মণিপুরের এই প্যালেল পর্যন্ত একটা গোপন রাস্তা তৈরি
করা যাতে ফৌজ মার্চ করলে নির্বিঘ্নে রসদের যোগান দেওয়া যায়।”
তারপর
রেঙ্গুন থেকে ফৌজের যাত্রা,
কোহিমা দখল, ইংরেজবাহিনীর
হাতে আত্মসমর্পণ সব বলে যাচ্ছিলেন একের পর এক। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম
রঘুবীরার প্রত্যেকটা কথা। আমার চোখের সামনে অভিনীত হতে থাকল জীবন্ত একেকটা দৃশ্য।
সারাদিনের ক্ষুধাতৃষ্ণা টের পাওয়ার মতো বোধশক্তি কে যেন শুষে নিয়েছিল তখন। একসময়
চোখের ঘোলা দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়ে এল রঘুবীরার আলতো ধাক্কায়। কেঁপে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি, আপনি তখন
কোথায় ছিলেন? ধরা
পড়েননি?”
বুক মুচড়ে
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রঘুবীরা উত্তর দিলেন, “আমি কাছাকাছি থাকলে নেতাজীর পা আঁকড়ে
ধরতাম। দেশ ছেড়ে যেতে দিতাম না কোত্থাও। চলে যেতাম এমন কোনও জায়গায় যেখানে ওই
লালমুখোগুলোর বাপও পা রাখার সাহস পেত না।”
“কোথায় ছিলেন
আপনি!” নিজের
অজান্তেই কেমন একটা নিদারুণ অভিমান মিশে বেরিয়ে এল প্রশ্নটা আমার গলা দিয়ে।
“ওই যে
বলছিলাম, গোপন
রাস্তা, সেটার
দায়িত্বে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের ভেতরে। সেনাবাহিনীর রেশন নিয়ে
এগোচ্ছিলাম। কাছাকাছি পৌঁছে শুনি সব শেষ। নেতাজীর খবর কেউ জানে না।”
বলতে বলতে
মোটা মোটা অশ্রুবিন্দু নেমে এল রঘুবীরার দু’গাল বেয়ে। আমিও মাথা নিচু করে চুপ
করে রইলাম।
কতক্ষণ কেটে
গেছে জানি না। অপার্থিব একটা নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছিল যেন আমাদের। চোখ তুলে
তাকালাম রঘুবীরার কথায়। কানে এল, “একটা কাজ করবেন, বাবুজী?”
লক্ষ করলাম, জামার তলা
থেকে কী একটা বইমতো টেনে বের করে আনছেন রঘুবীরা। হাতে তুলে দিতেই চক্ষুস্থির হয়ে
গেল আমার। একটা বহু বিবর্ণ ডায়েরি। মলাটে ইংরেজিতে ‘আই এন এ’ লেখা রয়েছে
স্পষ্ট।
রঘুবীরা
আমার দু’হাত
চেপে আকুতি জানালেন,
“এই ডায়েরিটা ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবেন দয়া করে? অনেক ভার বয়েছি ওটার। আর পারছি না।
বয়স তো কম হয়নি, কবে
চোখদুটো বুজে যায়…”
“কত বয়স হল, আপনার?” এবারে
কৌতূহলটা আর চেপে রাখতে পারলাম না।
“উঁ? গত বৈশাখীতে
একশো চার পেরোলাম।”
চোখ কপালে
উঠে গেল আমার। এই বয়সে একটা লোক এতটা ঋজু থাকতে পারে! বাঙালিদের তো ভাবাই যায় না।
কাঁপা কাঁপা
হাতে ডায়েরির প্রথম পাতাটা উলটালাম। ভেতরে সাংঘাতিক একটা উত্তেজনা হচ্ছিল। হৃৎপিণ্ডটা
লাফাতে শুরু করেছে তীব্র মাত্রায়। কে জানে কার ডায়েরি! যদি নেতাজীরই হয়!
আবছা
অন্ধকারে আঁকাবাঁকা লেখাগুলোকে বিজাতীয় মনে হল খুব। এ-ভাষা আমি জানি না। কোনও
ধারণাও নেই। দ্রুত হাতে বেশ কয়েকটা পাতা খুলে পরখ করলাম। না, একই ভাষা, আমার অজানা।
জিজ্ঞেস
করলাম, “ডায়েরিটা
কার? কী
লেখা আছে তাতে?”
জবাব এল, “এটা নেতাজীর
ডায়েরি। আমার কাছে গচ্ছিত ছিল। ভাষাটা মালয়, আপনার হয়তো জানা নেই।”
ধক করে উঠল
বুকটা। কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “কী করতে বলেন? এ যে অমূল্য
জিনিস!”
“শুনেছি
সরকার নেতাজীর কিছু ফাইল আম-আদমির সামনে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। আপনি ওটা সরকারের
হাতে তুলে দিতে পারেন বা কোনও জাদুঘরে। আপনার যা ইচ্ছে, আপনাকে
দিলাম ওটা।”
“আপনি নিজেই
সরাসরি দিচ্ছেন না কেন?”
“কারণটা এই
ডায়েরিতেই পাওয়া যাবে খুঁজলে। আমাদের অনেকেই নিজের পরিচয় দিয়ে প্রাণ খুইয়েছে।”
“কি-কিন্তু
আপনাদের তো দেশবাসীর তরফে সংবর্ধনা আর একটা নিশ্চিন্ত জীবন পাওয়ার কথা! সেরকম
অনেকের ক্ষেত্রেই তো হয়েছে।”
ফোঁস করে
একটা শ্বাস ছেড়ে রঘুবীরা বললেন, “না,
বাস্তবটা সামান্য ভিন্ন। সবাই পায়নি তার যোগ্য সম্মান। গুপ্তঘাতকের হাতে
প্রাণও দিয়েছে অনেকে। যাক গে, এই ডায়েরিতে সবই খুঁজে পাবেন।”
তারপর
ব্যস্ত হয়ে বললেন, “চলুন
মাস্টারসাব, বৃষ্টি
কমে গেছে। এখন না বেরোলে ঝামেলায় পড়বেন। ওয়ারেন্ট বেরিয়ে যাবে সময়মতো গেটে না
পৌঁছলে।”
শিবমন্দির
থেকে বেরিয়ে আবার সেই গাছতলা। তারপর যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন রঘুবীরা
খত্রী। ঘন জঙ্গলের আড়ালে মিশে যাওয়ার আগে হেঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি থাকেন
কোথায়, খত্রীসাব?”
কোনও উত্তর
পেলাম না। পরিবর্তে মাথাটা সামান্য ডানে বাঁয়ে দুলিয়ে লম্বা লম্বা ঝোপের আড়ালে
মিলিয়ে গেলেন। আমি ফিরে চললাম বিনয়ের ঘরে, মোরেতে।
সন্ধে পার
করে ঘরে ঢুকতে বিনয় তো রেগে আগুন। তেড়ে এসে শাসাতে শুরু করল, “এই
বিচারবুদ্ধি নিয়ে ছেলে পড়িয়ে খাস তুই, অ্যাঁ? আক্কেল বলতে কিছু থাকতে নেই? দুপুরে ঘরে
ফিরে দেখি তুই হাওয়া। মোবাইলে রিং করলাম, বেজে উঠল তোর বালিশের পাশে। আর
ফিরছিস সন্ধে পার করে?
একটা খোঁজ নেই, খবর
নেই, এমন
একটা জায়গা… জানিস, এখানে অলিতে
গলিতে কত বিপদ ওত পেতে থাকে! এটা ইন্টারন্যাশনাল করিডোর। কত শত স্মাগলার, খুনে… বুঝিস না?”
আমি একটা
কথাও বলিনি। বলা ভালো,
বলার অবস্থায় হয়তো ছিলাম না তখনও। মাথায় শুধু নেতাজী আর রঘুবীরার মুখগুলো তাড়া
করছিল। আর অনুভব করছিলাম পেছনে কোমরে গোঁজা এক অমূল্য সম্পদের স্পর্শ।
বিনয় এবারে
খানিকটা ঠাণ্ডা হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, গেছিলি কোথায় বল তো? কথাই তো ছিল দুপুরে খেয়েদেয়ে বেরোব
একসঙ্গে। তর সইল না এটুকুও?”
বলেই হেসে
ফেলল ও। আমি আমতা আমতা করে শুকনো গলায় জবাব দিলাম, “বর্ডার পেরিয়ে ওপারে গেছিলাম ঘুরতে।
বৃষ্টিতে আটকে গেছিলাম।”
বলেই
তাড়াতাড়ি আমার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম জামাকাপড় ছাড়তে। শুনতে পাচ্ছি বিনয়ের অবাক গলা, “সে কী! একা
একাই চলে গেলি, স্বার্থপর
কোথাকার? আমার
কথা মনেও পড়ল না! কতটুকু ঢুকেছিলি? তামু গেছিলি নিশ্চয়ই?”
একটানে
বোতলের অর্ধেকটা জল চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিয়ে হাঁপিয়ে বললাম, “কী আছে খেতে
দে। সকাল থেকে পেটে পড়েনি কিছু।”
সকালে বেশ
বেলা অবধি ঘুমোচ্ছিলাম। বিনয়ের গুঁতো খেয়ে উঠে বসতে হল। ব্যস্ত গলায় বিনয় বলল, “কী কাণ্ড
হয়েছে দেখে যা আমার ঘরে,
নিউজে কী দেখাচ্ছে।”
চোখ কুঁচকে
জিজ্ঞেস করলাম, “কী
দেখাচ্ছে?”
“তুই কাল
ফেরার পথে টের পাসনি কিছু?
অবশ্য তোর এপারে উঠে আসার পরও ঘটতে পারে ঘটনাটা। যা একটানা বৃষ্টি হচ্ছিল কয়েক
ঘণ্টা!”
তারপর হঠাৎ
সামনে এসে খপ করে আমার ডানহাতটা তুলে ধরে বলল, “এ কী! ওভাবে কাটল কী করে?”
আমি
তাড়াতাড়ি আস্তিনটা টানতে টানতে জবাব দিলাম, “মন্দিরটার দরজাটা ভাঙা ছিল খেয়াল
করিনি। বৃষ্টির তাড়া খেয়ে সজোরে ঠেলার সময় লেগে গিয়ে থাকতে পারে। সে কিছু নয়, চল।”
“মন্দির! কোন
মন্দির?”
“সব বলছি, এখন চল, নিউজটা
দেখি।”
তাড়াতাড়ি
টিভির সামনে এসে বসে দেখলাম এক আশ্চর্য খবর। ইন্দো-মায়ানমার বর্ডার থেকে কিলোমিটার
আটেক দূরে এক জঙ্গলের ভেতরে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত এক শিবমন্দিরের ওপর গতদিন
প্রচণ্ড ঝড়-বাদলের সময় ভেঙে পড়ে মন্দির লাগোয়া এক শতাব্দী প্রাচীন বটগাছ। তাতে
মন্দিরের পেছনের দেওয়ালটা একেবারে ধসে পড়ে।
তবে খবর এটা
নয়। আজ ভোর ভোর পাওখো নামের এক বছর চোদ্দোর ছেলে গরু চরাতে গিয়ে প্রথম নজর করে
ঘটনাটা। তারপর কৌতূহল বশে মন্দিরের ভাঙা দেওয়ালের ফোকর গলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা
করতে এক গুপ্তধনে হাত লেগে যায় তার। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে যায় খবরটা।
এ-কান ও-কান ঘুরে থানায় খবর যেতেই পুলিশ এসে উদ্ধার করে রাজরাজড়াদের আমলের বেশ
কিছু দামি পাথর, সোনার
বাট লাগানো গুপ্তিছোরা,
মুক্তোর মালা এসব। নিশ্চয়ই মন্দির তৈরির সময় বা পরবর্তী কালে দেওয়ালে এক
গুপ্তকুঠুরি তৈরি করে রাখা ছিল ওগুলো।
শরীরটা ঘেমে
উঠল টিভির পর্দায় চোখ রাখতে রাখতে। আরে, এ তো সেই মন্দিরটা, যেটায় কাল
রঘুবীরা খত্রীর সঙ্গে আটকে ছিলাম কয়েক ঘণ্টা! দৌড়ে গিয়ে বালিশের নিচ থেকে ডায়েরিটা
বের করে এনে বিনয়ের সামনে ফেলে দিয়ে বললাম, “দ্যাখ ওটা। নেতাজীর ডায়েরি। আমি কাল
ওই মন্দিরেই ছিলাম।”
বিনয়
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী? কোন নেতাজী?”
“ইন্ডিয়ান
ন্যাশনাল আর্মি ক’জন
নেতাজী তৈরি করেছিলেন র্যা? ওপরটায় দেখ, আই এন এ লেখা রয়েছে স্পষ্ট।”
বিনয় হাঁ
করে রইল। কোনওমতে বলল,
“কই, কাল
বলিসনি তো কিছু!”
তারপর গা
ঝাড়া দিয়ে উঠেই প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলল আমায় ও।
প্রায়
আধঘণ্টা ধরে বিনয়কে আদ্যোপান্ত খুলে বলার পর আরও অশান্ত হয়ে উঠল ও। তেতে উঠে বলল, “কী সব
অ্যাবসার্ড শোনাচ্ছিস তখন থেকে! এ আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?”
শান্ত গলায়
কেটে কেটে বললাম, “বিশ্বাস
করবি কি না সেটা সম্পূর্ণ তোর ওপর ডিপেন্ড করছে, বিনু। আই কান্ট হেল্প। তবে যা যা
বললাম এর একটা বর্ণও মিথ্যে নয়। ঘটনাটা আমার সঙ্গে হয়েছে, এটাই সবচেয়ে
বড়ো সত্যি। বিশ্বাস আমিও প্রথমে করতে পারছিলাম না রঘুবীরাকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত
হার আমায় মানতেই হল।”
একটুক্ষণ
স্থির চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে চোখ নামিয়ে নিল বিনয়। ধীরে ধীরে বলল, “ডায়েরিতে কী
লেখা আছে সেটা জানার উপায় নেই এখনই। তবে তোর কথা যদি মেনে নিই, এটা দেশের
সম্পদ। থানায় যেতে হবে একবার, চল।”
“থানায়! কী
করবি?”
“ওটা জমা করে
দেব। বিশেষত মন্দিরটা থেকে যখন আরও কিছু গুপ্ত জিনিস পাওয়া গেছে তখন… দেরি করা
ঠিক হবে না, চল।”
“আরে, মন্দির থেকে
উদ্ধার হওয়া জিনিসের সঙ্গে এটার কী সম্পর্ক? এটা তো মন্দিরের সম্পদ নয়। রঘুবীরা
মন্দিরের কোনও গুপ্তকুঠুরি থেকে বের করে আমায় দেননি ওটা। ওঁর সঙ্গেই ছিল জিনিসটা, কোমরে
গোঁজা।”
“সে যাই হোক, আমাদের এখন
প্রধান কর্তব্য হচ্ছে ওটা থানায় জমা করা। এটা যদি সত্যিই আই.এন.এ.-র ডায়েরি হয়, তবে তুই ওটা
চেপে রাখবি কদ্দিন, অ্যাঁ? পরে
সাংঘাতিক বিপদে পড়ে যাবি কিন্তু। তার চে’ এখনই থানায় জমা করে দেওয়াই মঙ্গল। চ, জামাটা
গলিয়ে নে শিগগির।”
আমি বেঁকে
বসলাম। এত বড়ো একটা জিনিস যেটায় এখন সম্পূর্ণ আমার অধিকার, থানায় জমা
করে দেব! কক্ষনো নয়। খপ করে কেড়ে নিলাম ডায়েরিটা বিনয়ের অসাবধান হাতদুটো থেকে।
প্রায় ঘণ্টা
খানেক বাকবিতণ্ডার পর বিনয় ডায়েরিটা ফের ছিনিয়ে নিয়ে রওনা দিল থানার উদ্দেশে। আমি
অনড় বসে রইলাম ঘরে। ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় শুধু বললাম, “ভেবে দ্যাখ, বিনু।
চাকরিটা বিপদে পড়ে যেতে পারে কিন্তু। কোত্থেকে পেলি জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দিবি?”
বিনয় মুচকি
হেসে, “হাটে
বাজারে, রাস্তাঘাটে
কত শত জিনিসপত্র পড়ে থাকতে দেখা যায়। যায় না?” বলে বেরিয়ে গেল।
বিনয় ফিরল
সেই সন্ধে সাড়ে পাঁচটায়। সারাদিন দারুণ এক রোষ আর উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছি আমি। জলটা
পর্যন্ত খেতে ইচ্ছে করেনি। আর থেকে থেকে নিজের হাত কামড়েছি। কেন খামোখা ডায়েরিটা
দেখাতে গেলাম ওকে? অলক্ষে
ব্যাগে জামাকাপড়ের তলায় ফেলে দিলেই হত। যা করতাম, কলকাতায় গিয়ে করতাম।
একটা দুরাশা
নিয়ে বসেছিলাম হয়তো বিনয় মত বদলে ফেলবে; ডায়েরিটা ফেরত এনে আবার আমার হাতে
তুলে দেবে। নাহ্, ব্যাটা
পাষণ্ড ঠিক খালি হাতেই ফিরে এসেছে ঘরে। লাফিয়ে উঠে জানতে চাইলাম, “ডায়েরিটা? কাকে
দিয়েছিস?”
“থানার
বড়োবাবু জমা নিয়েছেন,
পড়ার ব্যবস্থা করবেন,”
গোমড়া মুখে কথাগুলো বলেই চানঘরে ঢুকল গিয়ে সে।
কলকাতা ফিরে
বিনয়ের সঙ্গে যোগাযোগটা কমিয়ে দিয়েছিলাম নিজে থেকেই। ডায়েরির ঘটনাটা মন থেকে মুছে
ফেলতে পারছিলাম না কিছুতেই। জানি যুক্তি নেই, তবুও কেন যে বার বার মনে হয়, ওর কারণেই
একটুকরো হিরে মাটির ঢেলা হয়ে গেল। প্রথমদিকে ডায়েরিটার কথা অনেক জিজ্ঞেস করে
দেখেছি। ব্যাটা কোনও সদুত্তর দেয় না। শেষদিকে ও ফোন করলে দুয়েকবার হু-হাঁ বলে
ফোনটা ধরিয়ে দিতাম ছন্দা বা রাতুলের হাতে। ওরা গুছিয়ে বসে আড্ডা দিত।
সেদিন ফোন
করে বিনয় প্রথমেই বলল,
“অ্যাই শোন, অরিন্দম
ফিরে এসেছে দিল্লি থেকে। ফোন করেছিল আমায়। তোর নম্বর নেই ওর কাছে।”
“হুম, তো?”
“ডেকেছে
শনিবার সবাইকে। সবাই মানে,
আমি, তুই
আর ছন্দা।”
“কোথায়?”
“ওর বাড়িতেই।
তুই আবার প্লিজ বেঁকে বসিস না। এদ্দিন বাদে একসঙ্গে হচ্ছি সবাই।”
“তুই… তুই কোথায়
এখন? বাড়ি
এসেছিস?”
“হ্যাঁ, কাল রাতেই
পৌঁছলাম। সামনের শনিবার,
মনে রাখিস কিন্তু। রাখছি রে এখন।”
অরিন্দম
আমাদের সঙ্গেই পড়ত। তবে পড়াশোনায় বেশ একটা ঘ্যাম দেখাত বলে এড়িয়ে চলতাম আমি আর
বিনয়। তারপর ওর বাবা দিল্লি বদলি হতেই চলে গেল ওখানে। খুব কম কলকাতায় আসত। যখন আসত
আমাদের খোঁজ নিত অবশ্য। আমিই পাত্তা দিতাম না। এখন দেখছি বিনয় বেশ ভালোই যোগাযোগ
রেখে চলছিল। যাক গে,
কথা যখন দিয়েছি,
যাব একবার। দেখি ব্যাটা কত বড়ো হনু হয়ে ফিরে এল।
শনিবার সকাল
সকাল গিয়ে হাজির হলাম অরিন্দমের বেহালার বাড়িতে। দেখেশুনে ধারণাটা বেশ পালটে গেল
আমার। কলকাতার এক নামী হাসপাতালে জয়েন করেছে পুরোনো চাকরি ছেড়ে। অরিন্দম আর আগের
অরিন্দম নেই। কথায়-বার্তায়,
আচারে-ব্যবহারে দারুণ লাগল আজকে। গালগল্পের মাঝেই হঠাৎ অরিন্দম হাসতে হাসতে
বলে উঠল, “কী
রে অন্তু, কীসব
ঝামেলা পাকাচ্ছিস আজকাল?
লেখালিখি ধরেছিস নাকি?”
আমি তো থ।
একথার মানে কী? ফ্যাল
ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি দেখে বিনয় বলে উঠল, “আসলে এটা তেমন কোনও সমস্যা নয় বোধহয়।
না রে, অরিন্দম?”
“হুম। পর পর
কয়েকটা কাউন্সেলিং…”
অরিন্দমকে
বাধা দিয়ে আমি বলে উঠলাম,
“দাঁড়া দাঁড়া, কী
নিয়ে কথা বলছিস বল তো?
কাউন্সেলিংই বা কীসের?”
অরিন্দমের
সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বিনয় উঠে দাঁড়াল। বলল, “চলো ছন্দা, আমরা সামনের
লনটায় ঘুরে আসি খানিক। অরিন্দম ব্যাপারটা অন্তুকে বুঝিয়ে বলুক ততক্ষণ। কী সুন্দর
ঘাস লাগিয়েছিস রে, অরিন্দম!
বিদেশি?”
আমি তখনও
হতভম্ব হয়ে বসে আছি। বুঝতেই পারছি না কী হচ্ছে। এসেছি বেড়াতে, অনেকদিন পর
কোথায় সবাই একসঙ্গে গল্প করব, অথচ স্পষ্ট দুটো আলাদা টিম হয়ে গেল! এরা কি প্রি-প্ল্যানড
কিছু করছে আমাকে বোকা বানাতে? নিছক মজা?
ধন্দটা
কাটাল অরিন্দমই গলা খাঁকরে। বলল, “দেখ অন্তু, কাজটা পেশাগতই করছি, কিন্তু এই মুহূর্তে শুধুমাত্র একজন
মনোবিদ হিসেবে নিস না আমাকে প্লিজ। কথাবার্তাও সঠিক পদ্ধতি মেনে বলছি না। তোর মতো
ভুরি ভুরি মানুষ রয়েছেন গোটা পৃথিবীতে। তারা স্বচ্ছন্দে দৈনন্দিন জীবন কাটাচ্ছেন।”
“মানে, কী বলতে
চাইছিস!”
“যা বলছি, মনোযোগ দিয়ে
শোন। বিনয় যখন তোর ব্যাপারটা প্রথম তুলেছিল পাত্তা দিইনি তেমন। পরে যখন ছন্দার
সঙ্গে কথা বলে এমন আরও কয়েকটা ঘটনা জানতে পারলাম তখন আমিই সাজেস্ট করেছিলাম তোর
সঙ্গে বসার।”
“রাখ রাখ। কী
ঘটনা বল তো? ছন্দা
জানে অথচ আমি জানি না?”
অরিন্দম
আমার চোখে চোখ রেখে হেসে বলল, “রিসেন্টলি তোর মোরে বেড়াতে গিয়ে যে ঘটনাটা হল। সেই ডায়েরি।”
আমি এবারে
খানিকটা আন্দাজ করতে পারলাম জল আসলে কোনদিকে গড়াচ্ছে। চুপ করে অরিন্দমের কথা শুনতে
লাগলাম। ও বলছে, “ডায়েরির
ঘটনাটার আগেও তোর বেশ কয়েকটা ঘটনা আছে। ছন্দার মুখে শুনলাম, রাতুলের গত
জন্মদিনে তুই অতিথিদের সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিলি যে সেদিনের সব রান্নাবান্না তুই
করেছিলি, আর
কেকটাও নিজের হাতেই বেক করেছিলি। এত সুচারুভাবে বলছিলি কথাগুলো, যে কেউ
সন্দেহই করেনি। অথচ দ্যাখ,
সেদিন রান্নাঘরেই ঢুকিসনি তুই। আর কেক তো ছন্দা আর রাতুল মিলে অর্ডার করে
এসেছিল বেকারিতে তিনদিন আগেই।
“তারপর
স্কুলেও দুয়েকজন টিচারের সঙ্গে মাঝেমধ্যে এমন গল্প ফাঁদছিলি যে একসময় তারা কিছু
একটা গণ্ডগোল বুঝে গোপনে ছন্দাকে জানায়। আবার কখনও-সখনও স্কুল থেকে ফিরে রাতুলের
দুষ্টুমি সম্পর্কেও বেশ কিছু অভিযোগ করতিস ছন্দার কাছে যেগুলো ও-বেচারা করেইনি
স্কুলে। বাপ-ব্যাটা একই স্কুলে শুনলাম তোরা।”
মুখে কে যেন
ছাই লেপে দিচ্ছে আমার একটু একটু করে। কান-মাথা গরম হয়ে উঠছে। অরিন্দমের সাধাসাধিতে
দু’ঢোঁক
জল খেয়ে থম মেরে বসে আছি। বারবার মনে হচ্ছে, নিজের সম্পর্কে এত কিছু নিজেই জানি
না! আমি শেষে কিনা মিথ্যেবাদী এক মানসিক রোগী হয়ে গেলাম! আমি!
কিন্তু… ছন্দা এত
বড়ো ভুল করার মেয়ে তো নয়। ও নিশ্চয়ই অনেক যাচাই করেই এই স্টেপটা নিয়েছে। সবাই মিলে
যা ধারণা করছে আমি কি তাহলে তাই! অন্তরাত্মাটা কেঁপে উঠল হঠাৎ।
কিছুক্ষণ দু’জনের মুখেই
কোনও কথা নেই। একসময় আমার মুখ ফুটে বেরিয়ে এল, “লক্ষণগুলো কী কী?”
“ওয়েল, দু-চার কথায়
বলতে গেলে মানুষটা সাংঘাতিক কল্পনাবিলাসী হয়। কিছুদিন যাবত সেই সম্ভব অসম্ভব
কল্পনাটা মনের কোনও গোপন কুঠুরিতে খুব যত্ন করে লালন করতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে
সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সুযোগমতো। ততদিনে সে ওই কল্পনাটাই মনেপ্রাণে নির্জলা সত্যি
হিসেবে বিশ্বাস করতে শুরু করে। এরপর এমন একজনকে খুঁজে বেড়ায় যাকে ঘটনাটা বলা যায়।
তার অলীক বিশ্বাসটা টলানো তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে।
আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে সেটা ধীরে ধীরে স্মৃতি থেকে মুছে গিয়ে ফের নতুন
কোনও কল্পনার জন্ম নিতে শুরু করে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোর সঙ্গেও ঠিক এটাই ঘটছে। রোগটা যখন
হাইয়েস্ট ইনটেনসিটিতে থাকে তখন একটা পূর্ণ বয়স্ক মস্তিস্কের সঙ্গে একটা বাচ্চার
মস্তিস্কের কোনও পার্থক্য থাকে না।”
ভেবে দেখলাম, অরিন্দম
ঠিকই বলছে। এতক্ষণ ওর বলে যাওয়া অন্যসব ঘটনা তো বটেই ইদানীং মোরেতে বেড়াতে গিয়ে সেই
ডায়েরিটার ঘটনাটাও ভুলতে বসেছি। আবছা আবছা মনে পড়ছে। নিজের ওপর বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে
দিয়েছে অরিন্দম। একটুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, “এগজ্যাক্টলি
কী হয়েছে আমার বল তো ভাই?
তোদের ভাষায় একে কী বলে?”
ট্যাক্সিতে
বসে একটা কথাও বলিনি তখন থেকে। বাড়ির কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে
বিনু, ডায়েরিটার
আর খোঁজ নিয়েছিলি?”
বিনয় আমার
কাঁধে হাত রেখে বলল,
“বিশ্বাস কর অন্তু,
ওটা সেরকম কোনও ডায়েরি ছিল না। কুকিদের লোকগীতির বেশ কিছু গান লেখা ছিল তাতে।
তবে জিনিসটা বেশ পুরোনো। থানার ইন-চার্জ আমার বিশেষ পরিচিত এবং নিজে একজন কুকি।
উনি নিজেই পড়ে দেখেছেন আমাকে সামনে বসিয়ে।”
“আর কভারে
লেখা আই.এন.এ.-টা?”
“ওটা
মণিপুরের এক রাজার নাতনির নাম। ইনা। ইনার বাবা রাজপরিবারের লাগাতার ষড়যন্ত্রে
বীতশ্রদ্ধ হয়ে সেই মন্দিরে পূজারি হিসেবে বাকিটা জীবন কাটিয়েছিলেন। সঙ্গে এসেছিল
মা-মরা একমাত্র মেয়ে ইনা। ভাঙা মন্দিরে সেদিন যা কিছু উদ্ধার করা হয়েছিল, সব ওই রাজার
আমলের। অনেক ঘেঁটে ইতিহাসটুকু বের করেছি ভাই। শুধু তোর খাতিরে।”
তারপর কী
মনে পড়তেই আবার জিজ্ঞেস করল, “সত্যি করে বল তো, ওই উপড়ে নেওয়া শিবলিঙ্গটার গর্তেই সে
ডায়েরিটা লুকোনো ছিল কি না। আমার স্থির বিশ্বাস, ওই ডায়েরিটা তুলে আনতে গিয়েই হাতটা
কেটেছিলি সেদিন তুই।”
জবাব দিলাম
না। বিনয়ের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম জানালার কাচে। অস্ফুটে উচ্চারণ
করলাম, “তবে
রঘুবীরাও কি আমার মতো একজন কল্পনাবিলাসী? ফ্যান্টাসি প্রোন পার্সনালিটি?”
“ও-নামে কেউ
ছিলই না, অন্তু।
কেন বুঝতে পারছিস না বল তো?”
এবারে কি
সামান্য ঝাঁঝ মিশে কানে এল কথাটা বিনয়ের?
_____
ছবিঃ
মৈনাক দাশ
অসাধারণ রাজীবদা! অগ্নি সংযোগ এর পর এটা,দিন দিন লেখা ভালো হচ্ছে..গল্পের ওপেন এন্ড এর ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগলো
ReplyDeleteবহোতখুব ইতি রঘুবীরা।
ReplyDeletenijaswa kalponar jagat tai bhalo
ReplyDelete