গল্পের ম্যাজিক:: পাঁচমুড়ির খুকু - সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়


পাঁচমুড়ির খুকু
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়

“ইস্‌ এক্কেরে চুপচুপে ভিজে গেলি যে!” মা ফিঙে বলল খুকুকে, “এই জন্যেই বলেছিলাম শহরে আসার দরকার নেই। দিব্যি ছিলি গাঁয়ের ধারে। রেলের তারে বসে দোল খেতিস, মেঘ ডাকলে সবাই মিলে বটগাছ ঘিরে কিচির মিচির উড়তিস আর বৃষ্টি নামলেই গাছের মদ্যে সেঁদিয়ে বসতিসএখানে তো একটা মাথার ওপর ছায়াও নেই যে জল থেকে বাঁচাবে
গা, গলা, পিঠ সাধ্যমতো ফুলিয়ে জল ঝাড়ছিল খুদে ফিঙেটা। মা’র কিচিকিচি শুনে ঘাড় ঘোরালঅল্পই ঘোরালও তো প্যাঁচা না যে অর্ধেক ব্রহ্মাণ্ড দেখে ফেলার মতো ঘাড় ঘোরাতে পারবে। কটকটিয়ে বলে উঠল “গাঁয়ে কী আছে বল দিকি! এই যে চারদিকে এত লোক এত গাড়ি এত মানুষ! আহা দেখ, ঐ যে দিদিটা যাচ্ছে, দেখ! একহাতে ছাতা সামলে অন্য হাতে মোবাইলে টাইপ করতে করতে কেমন তুর্‌তুর্‌ করে এগোচ্ছে! গাঁয়ে হলে এখন এই বৃষ্টিতে কটা ন্যাংটা খোকা কেবল জলে ঝাঁপাবে আর নেড়িগুলো কেঁপে কেঁপে এ বাড়ি ও বাড়ির দরজায় গা ঘষবে, ইষ্টিশনের মুখে মেয়েগুলোর ছাতা উলটে যাবে, চ্যাঙারী ভরা শসাগুলো সবুজ ভ্যাবলা মুখ করে খদ্দের দেখবে কিন্তু ওদের কেউ দেখবে না, কেউ কিনবে না। গরমকাল ছাড়া শসা কারা খায় জান তুমি?
“কারা?” মা ফিঙের ঠোঁটে কৌতূহল।
“গাঁয়ে কেউ শসা কিনে খায়ই না, তাই জানও না। শোনো, শহরে শসা খায় সুগারের রুগিরা, খায় স্লিম হতে চাওয়া দিদি বৌদি মাসিমারা, তাও দই দিয়ে।”
“অ্যাঁ! দই কেন? তোদের শহরে সিন্নি নাই?” মা ডানা গালে ঠেকিয়ে অবাক হয়, “গাঁয়ে যে সবাই শালপাতার দোনায় সিন্নি নিয়ে শসা মাখিয়ে খায় দেখি।”
“সিন্নি মানে ওই বাতাসা সন্দেশ কলা, মানে যত্ত মিষ্টি দিয়ে মাখা খাবারটা? অত মিষ্টি খেলে মোটা হয়ে যাবে না? বললাম না রোগা হতে খায়! আর সিন্নি আবার রোজ রোজ কেউ খেতে পারে?
মা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কত্ত বড়ো হয়ে গেছে তার খুকুটা। কদিন শহরে এসে কত কী শিখেছে! এই কিছুদিন আগেও বাকি খোকা খুকুর সঙ্গেই এটাকেও পোকা ফড়িং তুলে এনে মুখে গুঁজে খাইয়ে দিতে হততারপর একদিন ডানা মেলল ছানারা আকাশে। ইতি উতি ঘোরে, গোঁত্তা খেয়ে পড়ে, আবার ওড়ে আবার পড়ে... একদিন একটি তো ডাল থেকে ধুপ করে পড়েছিল ভুলুয়ার মুখের সামনে। নেহাত ভুলুয়ার বয়েস হয়েছেতাছাড়া আশেপাশের বাড়ির ভাত মাছ মাখা খেতেও পায় তাই কাঁচা পাখির ছানা চেখে দেখার ইচ্ছে হয়নি তার। একটু শুঁকে নাক দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল মাত্রসেদিন বটের কোলে রাখা সিঁদুর মাখা পাঁচমুড়ি মায়ের পায়ে একটা বটফল রেখে দিয়েছিল মা ফিঙে। তারপর ডানা দুটো মুখের সামনে এনে জোড়া করে পেন্নাম করে দু’বার ডিগবাজিও খেয়েছিল ধুলোয়বাছাদের ভালো হোক, বেঁচে বত্তে উড়ে বেড়াক, খিদের মুখে ফড়িংটা, পোকাটা, কুচো মাকড়সাটা ধরে খাক, আর রাতে মায়ের আশেপাশে ঘুমোক, আর কী চাই!
তা ছানারাও তার দিব্যি ইচিকিচি করে খোঁজে মা চক্ষের আড়াল হলেই। কখনও ঘোষেদের মোটা সাদা গাইটার লেজে পিঠে বসে, কখনও তার ওপরেই তুড়ুক তুড়ুক করে লাফায়, পিঠ থেকে পোকা খুঁটে খায়, কখনও ধুলো গায়ে মেখে ঝেড়ে চান করে নেয় খানিক। তারপর আকাশ যখন আগুনতাতা লালচে হলুদ রং নিয়ে দূরে গাঁয়ের শেষ মাথাটা রাঙিয়ে দেয় তখন বটের ডালে এসে বসে ছানারা তাদের মায়ের কাছাকাছি। পাঁচমুড়ির বাকি গাছগুলোতেও পাখপাখালির ভিড় ওই সময়ে। সবাই যে যার পরিবারে ঘেঁষে বসে সারাদিনের গল্প উজাড় করে বলতে থাকে। কিচিরমিচির শব্দে সরগরম হয়ে থাকে পাঁচমুড়ির মোড়। ট্রেন এসে থামলে লোকজন নেমে ঘরে ফেরার পথে বটের ঠেঙে এসে একবার মাথা তুলে দেখে, বলে উফ্‌ এই সময়টায় পাখিগুলোর যেন মাথা খারাপ হয়ে যায় দেখ।

দিব্যি ছিল সবাই মিলে একসঙ্গে। ঘোষেদের গোয়ালের গাই, পাড়ার ভুলুয়া, মেনি, ইষ্টিশনের মানুষজন মিলে পাঁচমুড়ির বটতলাকে আপন জায়গাই জেনে এসেছে ফিঙে মা। থাকা খাওয়া ওড়ার সুখের কমতি নেই সেখানে। বর্ষায় একটা দুটো হেলে কী শাঁখচূড় যদি গাছ বেয়ে ওঠার চেষ্টাও করে তো কাঠঠোকরা ভারি সজাগ। গাছের গায়ে ঠকঠক্কাস রব তুলে সে পাখিদের জাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। কারুর কোনও নালিশ নেই তাই পাঁচমুড়িতে। কেবল এই এক খুকুই ছিল ভারি মনমরাবাকিদের কাঁইকিচিরের মধ্যেও ডানায় মুখ গুঁজে চুপ করেই থাকত বেশি। রেলের শেডের নিচের চায়ের দোকানের কাছে উড়ে যেত। টুকটাক ফেলে দেওয়া বিস্কুট মুড়ি তুলে খেত। দিন যেতে যেতে একদিন সবাই যখন খেলাধুলো কথাবার্তা সেরে দিব্যি ঝিমিয়ে পড়েছে তখন খুকু মায়ের ডানায় ঠোঁট খুঁচিয়ে বিনবিনিয়ে বায়না জুড়ল, “মা আমি এইটুকু উড়তে চাই না মা। দোয়েল পিসি শালিখ মাসির মতো উড়তে পারলেও আমার মন ভরবে না। আমি চাই বাজ জ্যাঠার মতো এদেশ ওদেশ দেখতে।”
ভয় পেয়েছিল মা ... “ওরে, আমাদের ডানায় অত জোর দেয়নি ভগমান। অত কী উড়তে পারি নাকি আমরা?
“রাখ তোমার ভগমান। ডানায় জোর না থাকে তো কী, আরও উপায় আছে দেখো। তুমি আমাকে আশীব্বাদ কর আমি যেন দেশ ঘুরে দেখতে পারি মা।”

পরের দিন একখান ঝমরঝমর রেলের বগির মাথায় চড়ে পাড়ি দিল খুকু দেশ দেখতে। যাওয়ার সময় একদানা মটর মায়ের মুখে দিয়ে বলল, “মন খারাপ কোরো না মা গো। আমি ঠিক আবার ঘুরতে ঘুরতে তোমার কাছে চলে আসব দেখো
তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। মা সন্ধেবেলা বাকি তিনটির সারাদিনের গল্প শুনতে শুনতে উদাস হয়ে যায়। ভাবে না জানি আমার খুকুমা কোথায় কোন দেশ দেখছে। সে দেশে ফলফুলুরি পোকামাকড় পায় কী? নাকি কেবলই ওই ভাঙা বিস্কুট, শুকনো রুটির কোনা খেয়ে দিন কাটে বাছার। মায়ের মন কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে।

কখনো মৌটুসি, দোয়েল, ময়না বোনেরা ছেলেপুলের দুষ্টুমির গপ্পো করে কাঠ পোড়া দুপুরের ডালে। ময়নার খোকাটি পাকা পেয়ারা ঠুকরে শাঁস খেতে শিখেছে। মৌটুসির ছানার পেটের দিকের হলুদ রংটা ধীরে ধীরে খুলছে। তার ওপর গলার কাছে জাম রঙের ঝলমলে পালকতাদের মায়েদের গর্ব আর ধরে না।
ফিঙেকে চুপচাপ দেখে দোয়েল শুধোয়, “তোর বুঝি ঘুম আসছে অবেলায়?
শেষে টুনটুনি বৌ, যে এমনিতে ঘোষেদের গোয়ালের চালার কোণে ছোট্ট বাসা বেঁধে থাকে, সেইই পরামর্শ দিল - বাজ দাদাকে একবার ডাক দিয়ে দেখ দিকি। তাঁর পথ ধরেই তো এত বাড় তোর খুকুর। তা তিনিই বিধান করুন না হয়।
বাজদাদা এমনিতে পাঁচমুড়ির বটে তেমন আসেন না। ইষ্টিশানের বাঁধানো বেদির কাছে তাঁকে দেখা যায় মাঝেসাঝে। সেই তিনিই শেষে খবর দিলেন খুকু ভালো আছে। কলকাতা নামে এক শহরে একা একা ঘুরে বেড়ায়। বন্ধুবান্ধব তেমন হয়নি। সেখানে রাতেও জেগে থাকতে হয় তাকে। রাত দিনের তফাৎ বুঝতে দেয় না সে শহর।
শুনে ফিঙে মায়ের চোখে জল, ডানায় মন খারাপ। শেষে ভেবে চিন্তে একদিন বাকি খোকাখুকুদের টুনটুনি আর দোয়েলের জিম্মায় রেখে মা এসে হাজির শহরে। সেও সেই বাজদাদার দেখানো পথেই আর খুকুমার বুদ্ধির ন্যাজ ধরেই। ট্রেনের মাথায় চড়ে বসল ফিঙে মা আর দূর আকাশে চক্কর দিতে দিতে বাজদাদা চলল সঙ্গে।
যায় যায়, অবাক হয়ে চার দিক দেখে ফিঙে। ঝমঝমে রেলের গাড়ি আর পাঁচমুড়ির মোড় ছাড়া তেমন কিছুই তো দেখেনি সে। রেলের চাকার ঝমরঝামর আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে কেমন চারপাশের ছবি পালটে যায়! কোথাও গাঢ় সবুজ কোথাও হালকা সবুজ রঙের ছড়াছড়ি। কোথাও কাদা পায়ে টোকা মাথায় মানুষজন ওই সবুজের ফাঁকে ফাঁকে নিচু হয়ে কাজ করছে। কোথাও আবার ছোটো ছেলের দল দৌড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক
ফিঙে মায়ের নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। এমনই সবুজ যেন ঢালা কাপড় সাজানো থাকত কোন সে এক গাঁয়ে। যেদিকে দু’চোখ যায় এমনই ফিকে, গাঢ়, মাজা, কচি কতরকমের সবুজ চাদর বুনে বুনে ছড়ানোতারই মধ্যে মধ্যে মাথা উঁচু একদুটো পাকুড় কী জারুল গাছ। অমনি একগাছের ডালে ফিঙে মা নিজেই তখন ছোট্ট খুকুমনি হয়ে তার মায়ের ডানায় ডানায় থাকত। আরও তিন চারটি ভাইবোন ছিল তারও
কিন্তু এমনই কপাল, এক গরমের দিনে হুল্লোড়ে ছেলেরা সামনের ছোটো পুকুরে খানিক ঝাঁপাঝাঁপি সেরে উঠে আসছিল। তার মধ্যে একজনের বুঝি কোমরে গুলতি গোঁজা। কী যে খেয়াল হল, ছেলেটা বড়ো ঢিল গুলতিতে আটকে ছুঁড়ল বাসা লক্ষ্য করে। ডানায় লেগেছিল খুব জোরে। বাসা থেকে পড়ে গেছিল ফিঙে মা। আর একটি ছেলে, বুঝি তার মায়া দয়া বেশি, সেই তাড়াতাড়ি তুলে নিয়েছিল ফিঙেকে নিজের হাতে। বাড়ি নিয়ে গিয়ে ছোটো মাটির পিদিমে করে দুধ দিয়েছিল। দুধের ওপর মুড়ি ভাসিয়ে দিয়েছিল ক’টা। দুটো দিন সেখানেই ছিল ফিঙে, তারপর আবার উড়তে উড়তে নিজের বাসায় ফিরবে ভেবেছিল। কিন্তু বিধি বাম। সে গাছ আর খুঁজেই পায়নি কখনও। উড়ে উড়ে শেষে পাঁচমুড়ি বটগাছে এসেই থিতু হল।

ফিঙে মা-র বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। খুকুও কি আর কখনও পথ চিনে রেলে চড়ে ফিরে আসতে পারবে? সে নিজেও যে খুকুর টানে রেলে চড়ে বসল, এর পর কপালে কী আছে কে জানে। হয়তো আবার হারিয়ে ফেলবে পথ। হয়তো আর বাকি তিন খোকাখুকুকেও কাছে পাবে না।
তবে ধন্যি বাপু বাজদাদার চোখ আর পথ চেনার বুদ্ধি। রেলের পথ যেখানে একটি থেকে অনেকগুলো হয়ে গেছে সেখানে গিয়ে বাজদাদা নেমে এসে বলল, “এবার রেল থেকে নেমে আমার পিছনে পিছনে এসো। চোখ রাখো আকাশে। আমি ধীরে উড়ব, তুমি তোমার মতো উড়ে লাফিয়ে আমার পিছে থেকো।”

শহরে পৌঁছতে বেলা হল বেশ। বাজদাদা অনেক উঁচু দিয়ে উড়ে ঘুরে খুঁজে দিল খুকুকে। খুকু তো মা-কে দেখে খুশিতে কটরকিচির করে ডাকে আর এই ডানা ঝাপটায় তো ওই দেওয়ালে ধাক্কা খায়... একবার এই তারে বসে একবার ওই বারান্দা থেকে বেরিয়ে আসা গাছের ডালে দোল খায়... ফিঙে মা  হইচই সাবধান করে খুকুকে, “ওরে লেগে যাবে, ওরে একটু শান্ত হয়ে পাশে এসে বোস দেখি।”
খুকু ইলেকট্রিকের তারে বসে মায়ের সঙ্গে দোল খায় আর বকবক করেমাঝে বৃষ্টি এল ঝেঁপে, মা নিজেও ভিজে ঢোল, তাও খুকুকে আদর করে বকুনি দিল ভেজার জন্য। ভারি ভালো লাগে খুকুর। ইচ্ছে করে মাকে সব ঘুরিয়ে দেখাতে।
“হ্যাঁ রে খুকু, ঐ যে বড়ো বড়ো বাক্স মতো উঁচু সাদা, ওখানে কখনও গেছিস?
“যাইনি আবার? কত্ত যাই! তুমি যাবে? চল না। ওগুলো বাক্স না মা, দেওয়াল। বাড়ির দেওয়াল। দেখছ না ছোটো ছোটো জানলা, বারান্দা, গাছ... ।”
ফিঙে মা-র তেমন ভাল্লাগে না কাছে গিয়ে। বারান্দা না কী, সেখানে লোক নেই কোনও। দোর বন্ধ। কিছু বারান্দায় পায়রা বসে আছে। ফিঙে মা চিরকাল দেখেছে পায়রারা থাকে কার্ণিশে, ছাদের নিচের ঘুলঘুলিতেও হরি! এখানে তো সেসব কিছুই নেই! বাড়ি না ছাই। ঘুলঘুলি, কার্ণিশ ছাড়া বাড়ি হয় না কি?

খিদে পেতে থাকে মায়ের। খুকু বলে রাস্তার এধারে ওধারে খাবার পাব চল। মায়ের প্রাণ বেরিয়ে আসে ভয়ে। রাক্ষুসে আওয়াজ করে কী সব আসছে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে! ট্রেনের মতো লাইন মেনে লাইন ধরে আসা যাওয়া না। এদিক ওদিক সেদিক দিয়ে একে ওকে টপকিয়ে তারা আসে যায়।
ঘাড় নেড়ে মা বলে, “না বাপু। আমি পারব না অমনি করে খাবার আনতে। তার চেয়ে উপোস দেওয়া ভালো
উপোস করে বাঁচে বুঝি কেউ?” খুকু রাগ দেখায়, “ক’দিন উপোস করে থাকবে শুনি?
ফিঙে মা মাথা নাড়ে, “না খুকু, অত আওয়াজ, অত ভিড়। বড়ো ভয় করে যে।”

সন্ধে কখন নামে বোঝা যায় না। চারদিক ধোঁয়া ধোঁয়া। চোখ জ্বালা করে মায়ের। তার মধ্যেই বড়ো বড়ো বাতি জ্বলে ওঠে রাস্তার। অবাক চোখে দেখে ফিঙে মা। এখানে আকাশ দেখা যায় না। গাঁয়ের পিঠে আগুন রঙা বিকেল দেখা যায় না। এখানে বড়ো বড়ো সাদা আলোতে পথঘাট থইথই করে। গাড়ি না কী যেন ওগুলো যেগুলো ছুটে আসছে, তাদের চোখ জ্বলে ভাঁটার মতো।
ক্লান্ত মা খুকুর পিছে পিছে একখানা গাছে গিয়ে বসে। ছোটো কচি পাতা ভর্তি গাছটাতে। ধীরে ধীরে আরও অনেক অনেক পাখি আসে। সবাই এসে একটি করে জায়গা বেছে বসে। অল্প অল্প ঝিমোয়। খালি পেটে ফিঙে মায়ের ঘুম আসে না। তার মধ্যেই একটু বাদে প্রথমে একটা দুটো, তারপর তিনটে চারটে, তারপর দশটা বারোটা পাখি ডেকে ওঠে। রাস্তার ফটফটে সাদা জোরালো আলো এসে চোখে পড়ে। দিনের আলো ভেবেই ওরা জেগে যায়, তারপর একে অন্যের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয় এটা দিনের আলো না রাতের সেই নিয়েধীরে ধীরে সব পাখিরাই কিচিরকাঁই শুরু করে
খুকু ঝিমন্ত মা’র কাছ ঘেঁষে এসে বসে। বলে, “মা, বাড়ি যাবে?
মা চোখ তুলে চায়, “তুই? তুই আর ফিরবি না খুকু? এই বাক্সর মতো সাদা সাদা দেওয়াল, এই রাক্ষুসে চোখ জ্বলা গাড়ি, এই রাস্তার শুকনো রুটি... এই সবই তোর ভালো লাগে? বাড়ির জন্য মন কেমন করে না তোর খুকু?
খুকু সেই সেদিনের মতো মা’র ডানার পালকে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। বলে, “ভাগ্যিস তুমি এলে মা। ঢের হয়েছে দেশ দেখা আমার। চল মা, কালকে আবার রেলে চড়ে বসি

বাজদাদা ভারি খুশি আজ। সারা আকাশ চক্কর মেরে ঘুরে ঘুরে বেচারা কেবল নজরদারি করে অথচ সে নজরদারি আজ অবধি কারুর কাজে লাগেনি। এই প্রথম বাজদাদার নজর, বুদ্ধি, রাস্তা চেনার বিদ্যে সব কাজে লাগল।
ফিরতি রেলে চড়ে ফিঙে মা আর ফিঙে খুকু যখন পাঁচমুড়িতে পৌঁছল তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধে নেমে গেছে। গাছে গাছে সবাই ঝিমিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কেবল কাঠঠোকরাই রেলের বাঁশির আওয়াজে চমকে মুখ তুলে তাকিয়েই এক্কেবারে অবাক। রেলের কামরার ছাদ থেকে তুড়ুক তুড়ুক ডানা মেলে নামল ফিঙে মা আর ফিঙে খুকু।

গাঁয়ের মেয়ে গাঁয়ে ফিরেছে এ খবর এখুনি সবাইকে না জানালে যেন শান্তি নেই কাঠঠোকরার। গাছের গায়ে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে সব্বাইকে জাগিয়ে দিল সে। টুনটুনি তীরবেগে সবাইকে কাটিয়ে উড়ে এল আগে... গাছ জুড়ে হইচই এমনই জুড়ল সবাই যে নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ফিরতি ট্রেনের লোকজন নিজেদের টর্চ জ্বেলে এদিক ওদিক দেখল খানিক কী জানি বাবা, সাপ টাপ দেখে পাখিগুলো চেঁচাচ্ছে হয়তো - বলল কেউ।

দোয়েল, মৌটুসি, টুনটুনি, ময়না মায়েরা ফিঙে মাকে বলল ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে। চল আমরা পাঁচমুড়ি মাকে পুজো দিয়ে আসি।
পাঁচটি মা আর বাকি পাখপাখালিরা সবাই সন্ধ্যামালতীর ঝোপ থেকে একটি করে ফুল ঠোঁটে করে ছিঁড়ে এনে ঠাকুরতলায় দিয়ে একসঙ্গে গান জুড়ল

ফুল ফুলুতি ফুলের বাতি
ফুল ছড়িয়ে আসন পাতি
ফুলের সুবাস ঢালি মায়ের পায়ে
সাত শহরে ভেরমন সেরে
মায়ের কোলে খুকু ফেরে
কিচির মিচির রব উঠেছে গাঁয়ে।।

খোকাখুকু থাকুক ভালো
মায়ের মুখে ফুটুক আলো
বিপদ যেন কাউকে না ছোঁয় মাগো
হেথায় হোথায় দিনে রাতে
ছানাপোনার চোখ ফোটাতে
পাঁচমুড়ি মা একলা তুমি জাগো।

গানে নাচে ভোর হয়ে এল শেষে। ভোরের ফার্স্ট ট্রেনের প্যাসেঞ্জাররা ইষ্টিশনে ঢোকার আগে মায়ের থানে অত সন্ধ্যামালতী দেখে না জানি কী না কী সব গল্প কথা বানাতে শুরু করল নিজেরাই। বটের পাখির দল যে যার ডানা ঝেড়ে কেউ গান গাইতে, কেউ ওড়া প্র্যাকটিস করতে, আর কেউ খাবার খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। কেবল খুকু বাসার মধ্যে হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে ঘুমিয়ে রইল সারাটি দিন। ভাইবোনেরা কানের কাছে কথা বলতে গিয়ে বকুনি খেল মায়ের কাছে। খুকুর মাথায় ডানার পালক দিয়ে বাতাস করতে করতে মা বলল আহা, খুকু আমার কতদিন শহরের আলোয় ঘুমোতে পারেনি। আজ ওকে ভালো করে ঘুমোতে দে বাছারা। কাল তোদের খেলায় ডাকিস ওকে।
_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

8 comments:

  1. ভারী মিত্তি গল্প। বাচ্চাদের জন্য এমনি আরো অনেক গল্প লেখো সই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. :) আচ্ছা, লিখব আবার। থ্যাঙ্কিউউউ

      Delete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. কী মিষ্টি, কী মিষ্টি।

    ReplyDelete
  4. galpo ta khub maya bhora,odbhut

    ReplyDelete