পদ্মবীজের মালা
অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়
।। ১ ।।
দাদু বলছিলেন, “লজ্জা কোরো না পরিতোষ। ভাল করে খেয়ো। আর দুটো ট্যাংরা মাছ নাও
না! আসলে আমাদের শহরের বাসা তো, ছোটো ছোটো চিনেমাটির থালা বাটি, তা বলে রান্না
কিন্তু কম নেই। বৌমার আমার অন্নপূর্ণার ভান্ডার, বুঝলে হে।”
যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, সেই পরিতোষকাকু ততক্ষণে
পাতে যে’কটা মাছ ছিল, সবকটার মাথা এক এক করে চিবিয়ে প্রায় পাউডার বানিয়ে ফেলেছে। এই সাইজের মাছকে বাবুই বলে
টিকটিকি মাছ, কারণ লম্বায় একটা মাঝারি সাইজের টিকটিকির প্রায় সমান, খালি টিকটিকিগুলোর
হাত পা থাকে, আর মাছেদের নেই, এই যা। তার আবার মাথা চিবিয়ে খাওয়া। মাগোঃ।
‘আমার আর অন্নপূর্ণা হয়ে কাজ নেই বাবা। সেই সকাল বেলা এসে হাজির হয়েছেন
আর এসে থেকে বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিয়েছেন। যবে থেকে আপনি এখানে আছেন, তবে
থেকে দেখছি ছুতো পেলেই উনি এসে যাচ্ছেন, আর তো পারা যায় না। রবিবারটা যে একটু দুপুরে গড়িয়ে
নেব, তারও জো নেই।’
বাবুই অবাক হয়ে দেখল মা’র গজরগজর করার দিকে দাদুর
বা পরিতোষকাকুর ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। তারপরেই তার খেয়াল হল, মার
কিন্তু ঠোঁট নড়ছে না, অথচ সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে মা’র গলার আওয়াজ।
বাবুইয়ের অজান্তেই
তার বাঁ হাতটা চলে গেল বুক পকেটে। মা’র ততক্ষণে ঠোঁট নড়ে উঠেছে, “আর
দুটো মাছ নিন না দাদা, কতদিন বাদে এবার আপনার আসা হল, বলুন দেখি!”
বাবুই সবে ডাল আলুভাজা দিয়ে এক গরাস মুখে দিয়েছিল, জোর
বিষম খেল, মুখের ভেতরের ভাত-ডাল মাখা বেসিনে উগরে দেবার জন্য তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে
আড়চোখে দেখল, দাদু স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। চট করে পিছন ফিরে
বুকপকেটে একবার হাত দিয়ে নিল সে, শক্ত, ছোট্ট গোল দানাটিকে একবার ছুঁয়ে নিল সে। কাজ করছে, ঠিক কাজ করছে
পদ্মবীজ।
।। ২ ।।
ব্যাপারটার শুরু প্রায় হপ্তাখানেক আগে। যে ঘরে পাশাপাশি খাটে দাদু আর
বাবুই শোয়, সে ঘরেই মা’র ঠাকুরের আসন। বাবুই জানে দাদু খুব ভোরে উঠে
সেখানে অনেকক্ষণ বসে থাকেন, তখন তাঁর গলায় পদ্মবীজের মালাটা থাকে।
মানে, থাকত আর কি। গত সপ্তাহে মালাটা কী
করে জানি ছিঁড়ে যায়। তখন দাদু একটা থলির মধ্যেই সব পুঁতিগুলো রেখে দিয়েছিল। দাদুকে জিজ্ঞেস করাতে
দাদু বলেছিলেন, “স্যাকরাকে দিয়ে মালাটা ফের গাঁথিয়ে নিলেই হবে, একটা করে পদ্মবীজ
আর একটা করে স্ফটিক।”
বাবুই জিজ্ঞেস করেছিল, “মালাটা গলায় থাকলে কী হয়?”
দাদু চোখ নাচিয়ে বলেছিল, “হুঁ হুঁ বাবা, ও মালার
স্পেশাল ক্ষমতা আছে।”
কিন্তু বাবুই অনেক চাপাচাপি করেও জানতে পারেনি, কী
সেই স্পেশাল ক্ষমতা।
ইস্কুলে যাবার সময় দাদু ঘরে ছিল না। এদিক ওদিক দেখে
বাবুই একটা পুঁতি তুলে পকেটে পুরে নিয়েছিল। এর আগে যে ক’বার দাদু এসেছে, কখনও
মাসখানেকের বেশি টানা থাকেনি। বাবুইদের গ্রামের বাড়িতে কাকা
জ্যাঠারা আর তাঁদের জ্ঞাতিরা পাশাপাশি এত ঘর বাস করেন যে ওই জায়গাটা খাতায় কলমে
পাঠকপাড়া নামেই পরিচিত। দাদু কলকাতায় এসে কিছুদিন বাদেই ছটফট করতে থাকেন এবং শেষ
পর্যন্ত বাবা-মাকে হার মেনে ফের তাঁকে গ্রামেই রেখে আসতে হয়। ফেরার পথে সারা রাস্তা
মা আর বাবা ইংরাজিতে গজর-গজর করতে থাকে, যার সব কথা বাবুই ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
তাই বাবুই তাড়াহুড়ো করছিল। ইস্কুলে কেমিষ্ট্রি ল্যাবের
বলরামদাকে দেখিয়ে নিতে হবে, যদি এনালিসিস করে কিছু তাড়াতাড়ি জানতে পারা যায়। দাদু তো আর বলবে না। এদিকে বেশি সময়ও নেই।
যাই হোক, ইস্কুলে গিয়ে দেখে রৈ রৈ কাণ্ড। হয়েছে কী, তাদের সেকশনের
বিনীত খারে মোবাইল ফোন নিয়ে ইস্কুলে এসেছে, লুকিয়ে। আর পাবজি খেলা চালু করে
দিয়েছে। ক্লাসের
দরজায় একজন দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখছিল কোনও মাষ্টারমশাই হঠাৎ এসে পড়লেন কিনা।
এই কী-হয় কী-হয় উত্তেজনায় বাবুই বলরামদার কাছে যাবার
ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে গেছিল। ইতিমধ্যে ইতিহাসের ক্লাস শুরুও
হয়ে গেল। এবং সবাইকে আতঙ্কিত করে প্রণববাবু সাল তারিখ পড়া ধরতে শুরু করলেন। পানিপথের প্রথম, দ্বিতীয়
যুদ্ধ, আকবরের জন্মসন.... এবং ওরা সবাই মুখ চুন করে বসে রইল। না পারলে স্যার এমনভাবে
তাকাচ্ছিলেন যেন পোকামাকড় দেখেছেন।
তারপরেই হঠাৎ বাবুইয়ের দিকে তাকিয়ে স্যার বলে
বসলেন, “আচ্ছা এটা বলতে পারলে আজকে আর পড়া না ধরে বরং সেই বাস্কারভিলের হাউন্ডের গল্পটা
শোনাতেও পারি, আচ্ছা, বল তো, আলেকজান্ডার কত সালে ভারত আক্রমণ করেন?”
আলেকজান্ডার নামটা খুব শোনা-শোনা লাগলেও, সালতামামি
বাবুইয়ের কোনোদিন মনে থাকে না। কিন্তু আজ কী যে হয়ে গেল, বাবুই
স্যারের দিকে তাকাতেই একটা আওয়াজ শুনতে পেল, ৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ, আর ফট করে সেটা
সেরেফ পুনরাবৃত্তি করে দিল।
পুরো ক্লাসে পিনপতন নৈঃশব্দ, ঠিক দু’সেকেন্ড, তারপর
সারা ক্লাস করতালিতে ফেটে পড়ল। প্রণববাবু হতভম্ব, বাবুই তো বটেই।
তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে স্যার বললেন, “আন্দাজে ঢিল
মারলি, নারে সুকৃৎ? আচ্ছা, এইটা বল তো, সম্রাট অশো....”
কথা শেষ হল না, সারা ক্লাস একস্বরে বলে উঠল, “হবে
না স্যার, ভেরি আনফেয়ার, আমাদের গল্প চাই, গল্প, প্লীজ।”
এমন জোর আওয়াজ হল, যে বিপিনদা, যে ক্লাসের পরে
ঘন্টা বাজায়, সে পর্যন্ত ছুটে এল। স্যার তখনকার মতো সামলে নিলেও,
হাউন্ডের গল্পের শেষটা মোটেও আর জমল না, গল্প বলতে বলতে মাঝেমাঝেই স্যার অন্যমনস্ক
হয়ে পড়ছিলেন, বাবুইকে আড়চোখে দেখছিলেন।
ইংরাজির পিরিয়ডেও সেদিন কীরকম যেন টকাটক যোগাযোগ
হয়ে যেতে লাগল। রাস্টিক আর রুরালের পার্থক্য স্যার জিজ্ঞেস করেছেন, আর বাবুই তড়াক
করে স্যারের মতো টানে বলে বসল, “রাস্টিক মানে গেঁইয়ো, আর রুরাল মানে গ্রামীণ।”
স্যারের মুখের কথায় যেরকম জেলার টান শুনতে পাওয়া যায়, ঠিক সেরকম করে। স্যারের মুখ সামান্য লাল
হয়ে উঠলেও, বললেন, “আচ্ছা, ঠিক বলেছ, বসো।”
বাবুইও লজ্জা পেয়েছিল খুব, আসলে সেরকম শোনালেও,
স্যারকে অনুকরণ করার কোনও ইচ্ছে তার ছিল না। সে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে যা
শুনতে পেয়েছিল তাই হুবহু উগরে দিয়েছিল। নাটকে যেমন প্রম্পটারের কথা শুনে
অভিনেতা পার্ট বলে দেয়।
তখনই সে আন্দাজ করেছিল, কী ঘটছে! ওই বীজ পকেটে
থাকায় সে সামনের মানুষের মনের কথা বুঝতে পারছে, যেন সে সব কথা তাকে কেউ আলাদা করে
বাজিয়ে শোনাচ্ছে।
এ কথা মনে হতেই বাবুইয়ের মনে একদম নন্দনকাননের ঠান্ডা
বাতাস বয়ে গেল। এবার ইতিহাস, ভূগোল, ইংরাজি... মানে যেসব বিষয় নিয়ে তার সমস্যা, তার
সমাধান হয়ে গেল। পরীক্ষার আগে স্যারকে কী কী ইম্পর্টান্ট জিজ্ঞেস করলেই হবে, জাস্ট স্যারের
মন পড়ে লিখে ফেলার অপেক্ষা। পুরো তাক ধিনা ধিন সিন।
সেই থেকে বাবুই তার এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছে,
আর এক্সপেরিমেন্টের ফল একটা খাতায় লিপিবদ্ধ করছে। যেমন যমুনাদি সেদিন মাকে
বলল, “দিদি, কাল আমি আসবো না।”
“কেন রে?”
“দিদিমা হাসপাতালে, দেখতে যেতে হবে।”
বাবুই কিন্তু স্পষ্ট শুনল, ‘মাসে দুটো রবিবার তো
ছুটি দেবে, না কি! এত ফৈজত, এত পেশ্ন কিসের বাপু!’
কথাটার মানে বাবুই জানে না, তাই সে জিজ্ঞেস করেই
ফেলল, “ফৈজত কী গো?”
আর যমুনাদিটা এমন চমকে উঠল যে মা পর্যন্ত অবাক, “কী
হল রে তোর যমুনা! আচ্ছা, আসিস না, কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না একদিন না এলে।”
যমুনাদি যেন পালিয়ে বাঁচল।
কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা ঠিক কাজ করছিল তা
নয়। যেমন ধরো অঙ্কের ক্লাসে দেখা গেল স্যার যদি অঙ্কটা কষতে দিয়ে খবরের
কাগজ পড়তে থাকেন, তখন মাথা খাটিয়েই অঙ্ক কষতে হয়, স্যারের মনে উঁকি মেরে অঙ্ক
করতে গিয়ে একদিন দেখে খাতায় বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে ফেলেছে, বাইপাসে ফের দুর্ঘটনা। মৃত ১, আহত ৩। কেটেকুটে দিল বটে, কিন্ত
স্যার সেটাও দেখলেন, আর বললেন, “কী রে, সাংবাদিক হতে চাস নাকি! সেও তো ভাল, খুব
ভাল।”
অথচ, যেদিন একটা শক্ত অঙ্ক নিয়ে স্যার আটকে গেছেন,
চক-ডাস্টার হাতে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন, সেদিন যেন বাবুই স্যারের হয়ে ক্লাসটাও
নিয়ে নিতে পারত, হুবহু স্যারের মতো করে আঁক কষে দিতে পারত।
।। ৩ ।।
কিন্তু এর ফলে খুব তাড়াতাড়ি একটা অন্য সমস্যা
দেখা দিল। বাবুই আবিষ্কার করল যে সে যেমন নির্মমভাবে অন্যের মনের কথা টেনে বার
করে আনতে পারছে, তেমনি তাকে প্রশ্ন করলে, তার মুখ থেকেও সত্যি কথা হড়হড় করে
বেরিয়ে আসছে। এ ব্যাপারেও যেন তার ইচ্ছা, বা বিচার বিবেচনার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু সে গল্প পরে।
স্কুলের টুর্নামেন্টে তাদের এ সেকশনের ম্যাচ ছিল বি
সেকশনের সঙ্গে। বি সেকশনের কৌস্তুভের মতো সেন্টার ফরওয়ার্ড স্কুলেও বেশি নেই। বাবুই গোলকিপার, কাজেই
কৌস্তুভকে নিয়ে তার চিন্তা সবচেয়ে বেশি। কৌস্তুভের পেনাল্টি শট বাঁচানো
প্রায় অসম্ভব বলে জানে সারা ইশকুল।
কিন্তু সেদিন তাদের ম্যান টু ম্যান মার্কিং এত ভাল
হয়েছিল যে সারা ম্যাচ গোল-লেস থেকে গেল। কিন্তু একস্ট্রা টাইম খেলার সময় বিনীত
একটা ফাউল করে ফেলায় সেই কৌস্তুভই এল পেনাল্টি কিক নিতে।
কিক নেবার ঠিক আগে কৌস্তুভের মুখ তার ডান দিকে
ফেরানো। বাবুইও বেশ জোরে জোরে শুনতে পেল, ডান দিকে নেব। কিন্ত ডানদিকে ঝাঁপানোর
ঠিক আগের মুহূর্তে তার মনে হল, কৌস্তুভের ডান মানে আমার বাঁ দিক।
পেনাল্টি থেকে এরকম অবশ্যম্ভাবী গোল আটকে যেতে পারে,
না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না। কৌস্তুভ দুই হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ে। এ
সেকশনের ছেলেরা ততক্ষণে হৈ হৈ করতে করতে মাঠে নেমে এসেছে, কাঁধে তুলে নিয়েছে তাকে।
বাড়ি ফেরার সময় স্কুল বাসে রণিত চুপিচুপি তার এই
কৃতিত্বের রহস্য জানতে চাওয়াতে প্রথম বাবুই আবিষ্কার করল যে তার এই সত্যকথনে কোনও
নিয়ন্ত্রণ নেই। যদিও রণিতের মুখ দেখেই মনে হচ্ছিল তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, বাবুই
শুনতে পাচ্ছিল, রণিত নিজের মনে বলে যাচ্ছে, ‘কুছ ভি, তুই আসলে জানতে দিবি না, তাই
বল।’ কিন্তু সত্যের নিজস্ব একটা শক্তি থাকে, সেটা এতই স্বয়ংপ্রকাশ যে তাকে অতি বড়ো
অবিশ্বাসীরও অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাবুই দেখল এক সময় রণিত চুপ করে
গেল।
।। ৪ ।।
পরিতোষকাকা খেয়েদেয়ে উঠে একটা সশব্দ ঢেঁকুর তুললেন। পরিতোষকাকা ওইরকম, হা হা করে
হাসতে হাসতে বাড়িতে আসেন, তেমনি হৈ হৈ করতে করতে চলে যান। দাদু কলকাতায় থাকলে
একটু বেশিই আসেন। গ্রামের নানারকম মজার মজার গল্প বলতে পারেন বলে বাবুই মানুষটাকে
পছন্দই করে। যেমন শীতের রাতে খেজুরের রস চুরি করে খাওয়ার গল্প। বাগালরা মাঠে সাপ
কেমন ল্যাজের দিকে ধরে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিত, সে সব গল্প। মা সামনে থাকলে মাঝে
মাঝে বাবার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়, তুমিও এইসব করেছ বুঝি? বাবা একটা আলগা হাসি
দেয়, যার মানে হ্যাঁ-ও হতে পারে, না-ও হতে পারে।
আজকেও তেমনি সকালে এসে পড়েছিলেন, জলখাবার খেয়েই
চলে যেতেন হয়তো। কিন্তু দাদুই বললেন, “আজ দুপুরে এখানেই খেয়ে যাও পরিতোষ।” মানুষটা বেশ
সোজা-সাপটা, অমনি রাজিও হয়ে গেলেন।
কিন্তু আজ মা’র মনের কথা জেনে ফেলার পর বাবুইয়ের
বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। কী হবে, মা যদি বলে ফেলেন, দাদুর মনের অবস্থা কী হবে?
পরিতোষকাকাই বা কী ভাববেন! আর কোনোদিন কি এত সহজে এ বাড়ি আসবেন, মজার মজার গল্প
করবেন?
তাছাড়া দাদু কি কিছু সন্দেহ করেছেন? সে বেশ ক’টা
পদ্মবীজ এরই মধ্যে সরিয়ে রেখেছে তার ডেস্কে। নাঃ, এক ফাঁকে আবার সেগুলো
ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেই থলিটাও তো আজ আর দেখা যাচ্ছে না বাইরে। দুশ্চিন্তায় তার মাথা
ঝিমঝিম করতে থাকে।
দাদু এরই মধ্যে একবার ঘরে উঁকি দিয়ে গেল, “দাদাভাই,
কী হয়েছে? সব কিছু ঠিক আছে তো?”
বাবুই পাথরের মতো মুখ রেখে বলল, “হ্যাঁ, হোমটাস্ক
করে রাখছি দাদু।” দাদু আর কিছু না বলে বসার ঘরে চলে গেলেন। পরিতোষকাকার হা হা করা
হাসি টেবিলে বসেই শুনতে পাচ্ছিল সে। বাট ইটস টু ডেনজারাস টুডে, মনে
মনেই বলল সে। ভাগ্যিস জিজ্ঞেস করেননি কিছু, তাহলে তো মিথ্যেটাও বলতে পারত না।
রাত্রে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে দাদু আর নাতি।
বাবুইয়ের মাথাটা গরম হয়ে আছে, ঘুম আসতে চাইছে না
কিছুতেই। এমন একটা শক্তি, হাতে পেয়েও সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকা যাবে না, এইটে
কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না সে।
‘তার কারণ এটা একটা অস্ত্র। আমি অন্যের মনের খোঁজ
চাইলেই আমার নিজের মনের খোঁজ দেওয়াটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।’
বাবুই চমকে উঠল। এ তো দাদুর কণ্ঠস্বর!
কিন্তু সে তো মুখে প্রশ্নটা করেনি! তবে কি দাদু টের পেয়ে গেছে? কীভাবে এটা সম্ভব?
মালাটা তো ছেঁড়া, আর দাদুর ফতুয়াতেও কোনও পকেট নেই!
‘আমার বয়সে পৌঁছে মানুষের মনের কথা জানতে খুব বেশি
কষ্ট করতে হয় না দাদাভাই, তার জন্য পদ্মবীজ লাগে না। কিন্তু সব কিছু জানা ও
জানানো উচিত নয়। তাতে সংসারে শান্তি নষ্ট হয়ে যায়, লোকেও অনর্থক কষ্ট পায়।’
‘আমি অন্যায় করে ফেলেছি দাদু,’ বলতে বলতে সে দাদুর
দিকে তাকাল। আধো
অন্ধকারে দাদুর মুখের হাসিটা তার অপার্থিব লাগে, এদিকেই চেয়ে আছেন দাদু। সে মুখে রাগ-দুঃখের কোনও
চিহ্ন নেই।
।। ৫ ।।
পরের দিন ইশকুল থেকে ফেরার সময় বাসে উঠতেই তাকে
রণিত, কৌস্তুভ আর বি সেকশনের কয়েকটা ছেলে ঘিরে ধরল, “টার্ন ওভার ইয়োর পকেটস। আমরা জিনিসটা দেখতে চাই।”
বাবুই ফ্যাকাসে মুখে রণিতের দিকে তাকালে রণিত অন্যদিকে
মুখটা ঘুরিয়ে নিল। কিন্ত বাবুইয়ের আজ মিথ্যে বলতে কোনও অসুবিধা হল না, “কোন জিনিস রে!
কিসের কথা বলছিস!”
কৌস্তুভ ঝাঁঝিয়ে উঠল, “মিথ্যে বলবি না, পেনাল্টি
কোনদিকে মারব কীভাবে টের পেয়েছিলি? ভেবেছিস আমরা কিছু বুঝি না!”
“ওটা বাই ফ্লুক। হয়ে গেছে।”
কেউ তাকে বিশ্বাস করল না। পকেটে হাত দেবার চেষ্টা
করতে লাগল। ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু হয়ে গেল। কয়েকটা বড়ো দাদাও এসে যোগ
দিয়েছিল মনে হয়। বাস থেকে বাড়ির স্টপেজে নামতে নামতে বাবুই দেখল পকেট ছেঁড়া, জামার
বোতাম একটা উড়ে গিয়েছে। কিন্তু পদ্মবীজ কোথাও পাওয়া গেল না। জানালায় রণিত মুখ কালো করে বসে
রইল।
কলিং বেল বাজাতে দরজা খুলে দিল যমুনাদিদি। দাদুর নাকি সকালে একটা
হার্ট এটাক হয়েছে, মা-বাবা সবাই হাসপাতালে। তাকে তৈরি থাকতে বলা হয়েছে, রাজনদা,
বাবার ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে।
বাবুই চটপট তৈরি হয়ে নিল। রাজনদা আসতেই সে তড়াক করে উঠে চলে
যাচ্ছিল। কী মনে হতে রাজনদাকে সে এক মিনিট দাঁড়াতে বলে, ফের ওপরে এসে ডেস্ক
থেকে একটা পদ্মবীজ তুলে নিল। এটা আজ তার লাগবে।
।। ৬ ।।
‘দাদু, দাদু শুনতে পাচ্ছ?’
কাচের পার্টিশনের ওপারে মনিটরের নীচে অসহায়ের মতো
পড়ে আছেন দাদু। বাবুই মনে মনে চিৎকার করে, শ্বাসের বাষ্প জমা হতে থাকে কাচের দেওয়ালে।
একটা ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে, ‘দাদাভাই, ভালো আছ তো?’
‘না, একটুও না। তুমি বাড়ি চল।’
‘যাব দাদাভাই, এবারে যাব। পদ্মবীজের মালা তোমাকে
দিলাম। আমার
ব্যাগের মধ্যে রাখা আছে। সামলে রেখো, বুঝেশুনে ব্যবহার কোরো।’
‘আমার চাই না। আমি আজকে ইস্কুলেও নিয়ে
যাইনি। পদ্মবীজ ছাড়াও আমার চলে যাবে। তুমি শুধু কথা দাও বাড়ি ফিরে
যাবে, আজকেই।’
দাদুর মুখে কি হাসির রেখা দেখা দিল? এতদূর থেকে
বোঝা যায় না ঠিক। কিন্তু এই প্রথম পদ্মবীজ নীরব রইল।
_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী
Arindam, well thought. Nostalgic feeling. Darun hoeche.
ReplyDeleteঅভিনব বিষয়। পড়তেও খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete