সূর্যনাথ ভট্টাচার্য
মনে করো কোনও উপায়ে একটা
সমতলের সব বিন্দু হয় লাল না হয় নীল রং করে দেওয়া সম্ভব হল। সাধারণভাবে
কোনোটাই সসীমসংখ্যক নয়। রঙিন বিন্দুগুলোর ঘনত্ব সুষম নাও হতে পারে, দুই রঙের
ক্ষেত্রে কোথাও বেশি কোথাও কম। এইরকম এক সমতলে একটা বর্গক্ষেত্র কি আঁকা যাবে যার
চারটে কৌণিক বিন্দু একই রঙের?
উঁহু, সেরকম তো বলা যাচ্ছে
না। ধর দুটো একই রঙের বিন্দু নেওয়া হল। এটা সবসময়েই করা যেতে পারে। ঐ বিন্দুর
সংযোগকারী সরলরেখার ওপর লম্ব তুলে বর্গক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ করা যেতে পারে। কিন্তু
তার নতুন দুই কৌণিক বিন্দু দুটি একই রঙের হবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনও
একটি অথবা দুটিই অন্য রঙের হতে পারে।
একই রঙের কৌণিক বিন্দুবিশিষ্ট
জ্যামিতিক আকারগুলোকে ‘একবর্ণ’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ঐ
দ্বিরঙা সমতলে যে কোনও রকমের একবর্ণ আকার আঁকা সম্ভব নয়। কিন্তু নীচের একবর্ণ আকারগুলো
সবসময়ে আঁকা যাবে —
(ক) তিনটে একই রঙের সমরেখ
বিন্দু, যার
মাঝেরটা অন্যদু'টোর
মধ্যবিন্দু।
(খ) একটা একবর্ণ সমবাহু ত্রিভুজ।
(গ) একটা একবর্ণ সমদ্বিবাহু
ত্রিভুজ।
(ঘ) একটা একবর্ণ সমদ্বিবাহু
সমকোণী ত্রিভুজ।
(ঙ) একটা বৃত্তে অন্তঃস্থ একটা
একবর্ণ সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ।
(চ) একটা একবর্ণ আয়তক্ষেত্র।
সমস্যাগুলো একেবারে বুনিয়াদি
স্তরের 'কবুতরখানা' নীতির ('Pigeonhole' principle) প্রয়োগ। বিদগ্ধ
গণিতবিদদের কাছে নস্যি। কিন্তু সোজা ভাষায় সাধারণের বোধগম্য করে বলা যায় কি? দেখা যাক।
(ক) দু’টো একই রঙের, ধর লাল,
বিন্দু যুক্ত কর। এই দুই বিন্দুর মধ্যবিন্দু যদি লাল হয়, তাহলে তো হয়েই গেল (চিত্র
১-ক)। তিনটে একই রঙের (লাল) সমদূরবর্তী
বিন্দু পাওয়া গেল। কিন্তু ধর ঐ মধ্যবিন্দুটি লাল নয়, নীল। তাহলে?
ঐ লাল বিন্দু দুটোর বাইরে একই
সরলরেখায় আরও দুটো বিন্দু, যারা লাল বিন্দুদের থেকে একই দূরত্বে, পর্যবেক্ষণ কর।
এদের মধ্যে যে কোনও একটা লাল হলে আমরা তিনটে সমদূরবর্তী একই রঙের (লাল) বিন্দু
পেয়ে গেলাম (চিত্র ১-খ,গ)।
এবার যদি দুটোই নীল হয়,
তাহলেও দেখ এই দুটোর সঙ্গে মধ্যবিন্দুটা নিয়ে আমরা তিনটে একই রঙের (এক্ষেত্রে নীল)
সমদূরবর্তী বিন্দু কিন্তু পেয়ে গেছি (চিত্র ১-ঘ)!
অনুসিদ্ধান্তঃ লক্ষ্য করে
দেখ, সমরেখ না হয়ে একই বৃত্তচাপের ওপরেও একই যুক্তিতে এইরকম তিনটি সমদূরবর্তী
বিন্দু পাওয়া সম্ভব।
(খ) তিনটি একই রঙের (ধর লাল)
সমরেখ বিন্দুর (এটা সম্ভব, (ক) দ্রষ্টব্য) প্রান্তীয় দুটো বিন্দুর সংযোজক সরলরেখার
ওপর একটা সমবাহু ত্রিভুজ খাড়া কর। এর ত্রিভুজের শীর্ষ যদি লাল হয়, তাহলে তো হয়েই
গেল (চিত্র ২-ক)।
কিন্তু ধর এই শীর্ষ নীল পাওয়া
গেল। তাহলে শীর্ষবিন্দুর সংযোজক বাহুদুটোর
মধ্যবিন্দুদ্বয় দেখ। তাদের কোনও একটা লাল হলে ভূমির মধ্যবিন্দুর সঙ্গে সেটি একটা
সমবাহু ত্রিভুজ গঠন করবে (চিত্র ২-খ,গ)। আর দুটোই
নীল হলে শীর্ষবিন্দুর সঙ্গে তারা এক সমবাহু ত্রিভুজ গঠন করবে (চিত্র ২-ঘ)।
(গ) যে কোনও দুটি একই রঙের,
ধর লাল, বিন্দুর ওপর একটা সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ খাড়া কর। এর তৃতীয় শীর্ষটি যদি লাল
হয়, তাহলে তো হয়েই গেল (চিত্র ৩-ক)।
কিন্তু ধর
এই তৃতীয় শীর্ষ নীল। তাহলে শীর্ষবিন্দুর সংযোজক বাহু দুইটিতে ভূমির সমান দূরবর্তী
বিন্দুদ্বয় দেখ। শীর্ষকোণ ৬০৹-র কম হলে বিন্দুদুটি বাহুর অন্তর্বর্তী অংশেই পড়বে,
আর বেশি হলে বর্ধিত অংশে পড়বে। বিন্দুদ্বয়ের কোনও একটি যদি লাল হয়, তাহলে ভূমির
সঙ্গে একটি সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ গঠিত হবে (চিত্র ৩-খ,গ)। আর
দুটিই নীল হলে শীর্ষের সঙ্গে (চিত্র ৩-ঘ)। কেন না,
সহজেই বোঝা যাচ্ছে এই বিন্দু দুটি শীর্ষ থেকে সমদূরবর্তী।
(ঘ) দুটি
একবর্ণ (ধর লাল) কৌণিক বিন্দুর উপর একটি বর্গক্ষেত্র খাড়া কর। এই বর্গের ওপর দুটি
কৌণিক বিন্দুর কোনও একটি লাল হলেই আমরা কিন্তু ঐ সমদ্বিবাহু সমকোণী ত্রিভুজটা পেয়ে
যাচ্ছি (চিত্র ৪-ক,খ)।
ধর ঐ দুটোই
কৌণিক বিন্দু নীল রঙের। তাহলে বর্গের কর্ণদুটির ছেদবিন্দুটি লক্ষ্য কর। এর
রঙ যাই হোক না কেন আমরা একটা ত্রিভুজ পাচ্ছি যা সমকোণী ও সমদ্বিবাহুও বটে। যদি
কর্ণদ্বয়ের ছেদবিন্দু লাল রঙের হয় তাহলে ভূমির দুই প্রান্তীয় বিন্দুর সঙ্গে (চিত্র
৪-গ), আর নীল হলে শীর্ষের দুই প্রান্তীয় বিন্দুর সঙ্গে (চিত্র ৪-ঘ) একটা সমকোণী
সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ গঠিত হবে। কেননা বর্গক্ষেত্রের কর্ণদ্বয় সমকোণে দ্বিখন্ডিত হয়।
(ঙ) ঐ বৃত্তের ওপর দুটি একই
রঙের বিন্দু নির্দিষ্ট কর। এটা সর্বদাই সম্ভব, কেননা কোনও একটি রঙ ঐ বৃত্তে
অনুপস্থিত হতে পারে অথবা একটি মাত্র থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে অন্য রঙটি পর্যাপ্ত
পরিমাণে পাওয়া যাবে।
ধর এই দুই বিন্দু
লাল রঙের। ভূমিস্থ দুই বিন্দুর লম্ব সমদ্বিখন্ডক ও বৃত্তের ছেদবিন্দুটি দেখ। এটা
যদি লাল হয় তাহলে তো হয়েই গেল (চিত্র ৫-ক)।
মনে কর তা
নয়, বিন্দুটি নীল রঙের। তাহলে ভূমির বিন্দুদুটি থেকে বৃত্তে আরও দুইটি চাপ
নির্দিষ্ট করে নাও যাদের দৈর্ঘ বিন্দুদ্বয়ের মধ্যে চাপের সমান। এই চাপদ্বয়ের অপর
প্রান্তবিন্দুর কোনও একটি লাল হলেই আমরা একটি একবর্ণ সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ পেয়ে
যাচ্ছি (চিত্র ৫-খ,গ)।
কিন্তু ধর
দুটিই নীল বিন্দু পাওয়া গেল। সেক্ষেত্রে
ঐ দুই বিন্দুর সঙ্গে শীর্ষবিন্দুটি একবর্ণ (এক্ষেত্রে নীল রঙের) সমদ্বিবাহু
ত্রিভুজ গঠন করে (চিত্র ৫-হগ)। কেননা সহজেই
দেখা যায় ঐ চাপ দুটির অন্য প্রান্তদ্বয় শীর্ষ থেকে সমদূরবর্তী।
(চ) একটা
সরলরেখায় (চিত্র-৭এ বামদিকের উল্লম্ব রেখাটি) চারটি এক বর্ণের বিন্দু নির্দেশ কর।
এটা সবসময়েই করা যাবে। ঐ সরলরেখায় যে কোনও ৭টা বিন্দু নির্বাচিত করলে তার মধ্যে
অন্তত চারটে (বেশিও হতে পারে) একই বর্ণের হতেই হবে। কবুতরখানা নীতি! ধর এইগুলির রঙ
লাল।
এই চারটি
বিন্দু থেকে ঐ সরলরেখার ওপর চারটে লম্ব টান যারা প্রথম সরলরেখার সমান্তরাল (যে
কোনও দূরত্বে) আরও দুটি রেখাকে মোট আটটা বিন্দুতে ছেদ করে।
লক্ষ্য কর,
কোনও একটি সমান্তরাল রেখাকে দুই বা তার বেশি লাল বিন্দুতে ছেদ করলে অন্তত একটি একবর্ণ
(লাল) আয়তক্ষেত্র পেতে কোনও সমস্যা নেই (চিত্র৭-ক)।
আরও লক্ষ্য
কর, ঐ আটটি ছেদবিন্দুর একটিও লাল না হলেও একাধিক একবর্ণ (এক্ষেত্রে নীল)
আয়তক্ষেত্র পাওয়া যাচ্ছে। মোট ৭টি নীল বিন্দু পেলেও তাই। এমনকি, রেখাদুটিতে যদি একটি
করে লাল বিন্দু থাকে এবং তারা সমরেখ হয়, তাহলেও একাধিক আয়তক্ষেত্র পেতে বাধা নেই।
রইল বাকি,
যদি সমান্তরাল রেখা দুটিতে একটি করে লাল বিন্দু — পরস্পর অসমরেখ - থাকে, বাকি সব
নীল। এটাই সবচেয়ে বিপরীত পরিস্থিতি। এক্ষেত্রেও কিন্তু দেখা যাবে অন্তত একটা
একবর্ণ (নীল) আয়তক্ষেত্র নির্মাণ রোধ করা সম্ভব নয় (চিত্র ৬-খ,গ,ঘ)।
অতএব দেখা
গেল অন্তত একটা একবর্ণ আয়তক্ষেত্র যে কোনও অবস্থাতেই পাওয়া যাবে।
* * *
খুব কঠিন
কিছু নয়, তাই না? মনে রেখ প্রশ্নগুলো কিন্তু আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড স্তরের।
অন্তর্নিহিত যুক্তিটা ধরতে পারলে কঠিন অঙ্কও সরল হয়ে যায়।
_____
No comments:
Post a Comment